পর্দা জুড়ে এবার মহাপুরুষটিকে দেখানো হলো, খুব স্মিতগম্ভীর একটা ভাব করে আছে সে, যেনো গ্রাম্য বাঙালি কোনোদিন মহাপুরুষ দেখে নি, বাঙালিকে সে মহাপুরুষ দেখাচ্ছে। টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে একটা ভড় দেখে রাশেদ জোরে জোরে হেসে। উঠলো, মৃদু হেসে উঠলো। মৃদু রাশেদের কাছে জানতে চাইলো লোকটাকে দেখে তো তার খুব হাসি পাচ্ছে, লোকটা নিশ্চয়ই খুব হাসাতে পারে, ওকে আগে টেলিভিশনে কেনো দেখানো হয় নি, দেখালে তো বেশ মজা হতো। রাশেদ মৃদুকে জানালো। এ-লোকটাই তার ইস্কুল বন্ধ করে দিয়েছে। মৃদুর হাসি থেমে গেলো, তার মুখের ওপর। ফিরে এলো আগের দুঃস্বপ্ন; ঘেন্নায় বাকা হয়ে উঠলো মুখ যেনো সে লোকটার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিচ্ছে। রাশেদের তলপেটে তখন কাসপিয়ান ভারী হয়ে আছে, সে জানে না এ-ভার কবে নামবে। ছত্রিশ বছরের জীবনে সে অনেক বিপ্লব দেখেছে, দেশে দেশে সে বিপ্লবে ধ্বংস হয়েছে, আবার জেগে উঠেছে ধ্বংসস্তূপ থেকে; আজ দয়া করে আরেকটি বিপ্লব এসে তার তলপেট ভারী করে তুলেছে। বিপ্লব, রাশেদ উচ্চারণ করলো, লেফরাইট লেফরাইট বিল্পব! শব্দটির যুক্তবর্ণ দুটিকে একটু উল্টেপাল্টে বললো, বিল্পব, বিল্পব! রাশেদ ভাবতে চেষ্টা করলো বিপ্লব শব্দের অর্থ কী, তার মনে আবর্জনা উপচে উঠতে লাগলো; একবার অভিধান দেখবে কিনা ভাবতেই ভয় পেলো হয়তো শব্দটি সেখানে নেই। নিজেকে সে প্রশ্ন করলো, রাশেদ, বলো তো শেষরাতে বিপ্লব করতে। দরকার পড়ে কটা দস্যু? রাশেদের মতো ঘুমিয়ে ছিলো বাঙলাদেশও, জেগে উঠে ভোরে দেখতে পেয়েছে সে দস্যুদের অধিকারে। তার বন, নদী, ধানখেত, কুয়াশা, শিশির, দোয়েল, শাপলা, ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, সিলেট, মেঠোপথ, আল, মেঘ, রাড়িখাল, কোলাপাড়া, কামারগাঁও দস্যুদের বুটের নিচে। ওরা কি জন্মেছে বাঙলাদেশের জরায়ু থেকে, ওদের কি বুক থেকে মধুদুধ দিয়েছিলো বাঙলাদেশ, ওরা কি তার জলে সাঁতার কেটেছে, ভিজেছে তার বৃষ্টিতে? তার নিমের ছায়া কি কখনো পড়ে নি ওদের শরীরের ওপর, মাটির গন্ধ ঢোকে নি ওদের নাসারন্ধ্রে?
বুটের শব্দ শুনতে লাগলো রাশেদ, মনে পড়লো ছেলেবেলায় দেখা জীবনের প্রথম। বিপ্লবকে। দেখার মতো একটা মহাপুরুষ এসেছিলো সেবার, বিপ্লব সে জলবায়ু কাঁপিয়ে তুলেছিলো, রাশেদের সে-বছরই প্রথম পরিচয় হয় বিপ্লব শব্দটির সাথে। ওটি কোনো বইতে তখনো সে পায় নি, পাকিস্থানের সাবধান বইগুলো শব্দটিকে নিষিদ্ধ করে রেখেছিলো; কিন্তু ওই মহাপুরুষ বিপ্লবকে বন্য শুয়োরের মতো ঢুকিয়ে দিয়েছিলো তাদের গ্রামেও। রেডিও ছিলো না গ্রামে, সংবাদপত্রও যেতো না, কিন্তু অক্টোবর মাসে। সেখানে মহাসমারোহে গোঁ গোঁ করতে করতে হাজির হলো বিপ্লব। মহাপুরুষদের ছবি দেখা প্রিয় অভ্যাস ছিলো রাশেদের, বিদ্যাসাগর নামের মহাপুরুষটির প্রতি তার খুব। আবেগ জেগে উঠছিলো; তাঁর অনেক ছবি–একই ছবির অনেক কপি নানা বইপত্র থেকে কেটে সে সংগ্রহ করেছিলো, রাশেদ দেখলো পাকিস্থানের মহাপুরুষ তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন; মহাপুরুষ সম্পর্কে ধারণাই বদলে গেলো রাশেদের। তার মনে হলো এটি মহাপুরুষ হলে বিদ্যাসাগর পুরুষও নন, আর বিদ্যাসাগর যদি মহাপুরুষ হন, তাহলে এটা দস্যু। এমন ভাবতে তার ভয় হচ্ছিলো, সে বুঝতে পারছিলো এমন ভাবা বড়ো অপরাধ, কেউ জানতে পারলে তার শাস্তি হয়ে যাবে, তবে কয়েক দিনের মধ্যে ইস্কুল ও বাজারের দেয়ালে দেয়ালে দস্যুটির এতো ছবি দেখতে পেলো যে রাশেদের বিশ্বাস জন্মালো এই প্রথম সে একটি খাঁটি মহাপুরুষ দেখলো। মহাপুরুষদের বিশাল বিশাল ছবি আর গোঁফ দেখে রাশেদ মুগ্ধ হলো যখন সে দেখলো যে সবাই তার আগেই মুগ্ধ হয়ে গেছে। রাশেদ একদিন বাজারে যখন মুগ্ধ হয়ে পাকিস্থানের ওই মহাপুরুষদের ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলো, একটি কুকুর তাড়া খেয়ে এসে ছবিটি দেখে খুব মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। কুকুরটি হয়তো ক্লান্ত হয়েই দাঁড়িয়ে পড়েছিলো, এমনও হতে পারে কুকুরটি নিজের সামনে একটি অদ্ভুত জন্তু দেখে ভয় পেয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছিলো, তবে রাশেদের মনে হয় যে মহাপুরুষ চিনতে কুকুরও ভুল করে না। বাজারের পুবধারের। চায়ের দোকানের বেড়ার গায়ে ঝোলানো ছিলো পাকিস্থানের ওই মহামানবের বিশাল ছবি। বাজারে গেলেই রাশেদ ওই ছবিটা দেখতো; মহাপুরুষের গোঁফ, বুকভরা তারা, কাঁধের ওপর থেকে সামনের দিকে বাঁধা দড়ি দেখে সে মুগ্ধ হতো, আবার ভয়ও পেতো। তখন এক বুড়ো, যাকে রাশেদ সব সময় চায়ের দোকানেই বসে থাকতে দেখতো, বলেছিলো, কী দ্যাখছো ভাইস্তা, খানের ব্যাডা বাঙ্গালিগো এইবার পাদাইয়া ছাড়বো। লোকটিকে খুব সন্তুষ্টই মনে হয়েছিলো, পারলে সে নিজেই পাদাতো বাঙালিদের, কিন্তু, পারছে না; তার হয়ে পাদাবে ওই মহাপুরুষ।
আবর্জনার বাক্স থেকে উপচে পড়ছে আবর্জনা। রাশেদ শুনতে পেলো : যেহেতু দেশে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যাতে অর্থনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে অচলাবস্থা, বেসামরিক প্রশাসন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারছে না, সকল স্তরে যথেচ্ছ দুর্নীতি। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে, ফলে জনগণ অসহনীয় দুর্দশায় পড়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিপজ্জনক অবনতি ঘটেছে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, যেহেতু বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ এবং জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরে কষ্টার্জিত দেশকে সামরিক আইনের অধীনে ন্যস্ত করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, অতএব আমি সর্বশক্তিমান আল্লার সাহায্য ও করুণায় এবং আমাদের মহান দেশপ্রেমিক জনগণের দোয়ায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিশেবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ সরকারের সকল ও পূর্ণ ক্ষমতা গ্রহন করছি এবং ঘোষণা করছি যে গোটা। বাঙলাদেশ অবিলম্বে সামরিক আইনের আওতায় আসবে। রাশেদ ঘোষণা শুনতে শুনতে অনুভব করলো যে ওগুলো ক্রমশ তার প্রস্রাবে পরিণত হয়ে তলপেটে জমা হচ্ছে। একেবারে পুরোনো ছকবাঁধা আবর্জনা, কোনো অভিনবত্ব নেই; সুই পুরোনো অর্থনীতি, আর শান্তিশৃঙ্খলা, জাতীয় স্বার্থ আর নিরাপত্তা, দেশপ্রেম আর আল্লা! বদমাশরা যদি বলতো যে দেশটাকে আমরা পাদিয়ে দিতে চাই, তাই ক্ষমতা দখল করছি, তাহলেও বোঝা যেতো ভেতরে কিছু আছে, কিন্তু ভাঁড়গুলো এসেছে, রাশেদ ভাবলো, শুধুই ক্ষমতার জন্যে। পর্দায় অনেকগুলো তারকাখচিত দড়িপাচানো উদরপ্রলম্বিত জেনারেল দেখা গেলো; পেটের অবস্থা দেখেই রাশেদ বুঝলো দেশ দখল করা ছাড়া করার মতো ওদের কোনো কাজ নেই। কাজ থাকলে পেট এমন ফুলে উঠতে পারে না, অনেক দিন ধরে হয়তো তারা ওই পেটের জন্যে কামও করতে পারে নি।