রাশেদের পড়ার ঘর ঝেড়ে দিতে সাজিয়ে দিতে খুব সুখ লাগতো বিলু আপার। তার টেবিলের সামনের ঢেউটিনের বেড়ায় লাল নীল কাগজ লাগিয়ে দিয়েছিলো বিলু আপা, রাশেদ তাকালেই দেখতে লাল নীল ঢেউ, তার ওপর কাগজ কেটে বড়ো বড়ো ইংরেজি অক্ষরে লাগিয়ে দিয়েছিলো রাশেদের নাম, ইংরেজি অক্ষরে নিজের নাম দেখলে নিজেকে অন্য রকম মনে হতো, অনেক দূরে চলে গেছি মনে হতো, পাশে ইংলন্ডের রানির। একটা ছবি লাগিয়েছিলো রাশেদ, তার সাথে একটা লিকলিকে লোকের ছবিও ছিলো। রাশেদ নিজেই তো গুছিয়ে রাখতে তার পড়ার টেবিল, বিলু আপা তারপরও গোছাতো, মাঝেমাঝে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রাশেদের বাঙলা বই খুলে অনেকক্ষণ ধরে পড়তো, নিশ্বাস ছেড়ে বলতো, তুই কী সুন্দর সুন্দর পড়া পড়িস। বিলু আপা প্রাইমারি ইস্কুলে যেতো, অনেক বছর ধরে যায় না, শাড়ি পরার পর থেকেই যায় না। বিলু আপার সইরাও যায় না; তারা সবাই শাড়ি পরে, কাজ করে, কুশিকাটা দিয়ে শেলাই করে, বালিশে আর রুমালে ফুল তোলে, আর সময় পেলে বাড়ির আমগাছের পাশে দাঁড়িয়ে, হেলান দিয়ে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা খুব দূরের দিকে তাকায়, যেনো খুব দূরে, দিগন্তের ওই পারে, আকাশের পশ্চিম উত্তর পুব দক্ষিণ পাশে, তাদের কেউ রয়েছে। খুব মজা করতে পারতো বিলু আপা। রাশেদ বায়না ধরেছিলো ঝাঁকিজালের; বাবা জালের কথা একদম সহ্য করতে পারেন না, রাশেদকে মাছ ধরতে হবে না, তাকে শুধু পড়তে হবে, কিন্তু জাল দিয়ে মাছ ধরতে ইচ্ছে করে রাশেদের। মাছ ধরার থেকে। মজার হচ্ছে জাল খ্যাও দেয়া, ডান হাতের কনুইয়ে জালের একগুচ্ছ আটকে রেখে ডান আর বাঁ হাত দিয়ে ফ্রকের মতো ধরে দুলে দুলে দূরে জাল ছড়িয়ে দেয়া। বিলু আপা চুপে চুপে একটি জাল বুনছিলো রাশেদের জন্যে। ভাদ্র মাসে বুনতে শুরু করেছিলো, সন্ধ্যায় ছোটোঘরে বসে বসে পাশের বাড়ির বউদের সাথে সইদের সাথে গল্প করতে করতে জাল বুনছিলো বিলু আপা। এক হাত বাড়লেই একটি করে আলতার দাগ দিচ্ছিলো, জালটিকে লালপেড়ে শাদা শাড়িপরা বউয়ের মতো দেখাচ্ছিলো। রাশেদ সন্ধ্যায় চিৎকার করে করে পড়তো, খুব ভালো লাগতো চিৎকার করে পড়তে, মাঝেমাঝে সে ছোটোঘরে গিয়ে দেখে আসতো কতোটুকু হলো জালটি। রাশেদের। পড়ার টেবিলে ছিলো পেতলের একটি উঁচু হারিকেন, তাতে ছিলো ধবধবে বাদুড়মার্কা চিমনি; চোখে তাপ লাগতো বলে রাশেদ চিমনিতে এক টুকরো কাগজ লাগিয়ে রাখতো। অন্ধকারে হারিকেনের আলো ধবধব করতো, চোখ এক সময় বই ছাড়া আর কিছু দেখতে পেতো না। সে-সন্ধ্যায় যে রাশেদের জাল বোনা হয়ে গেছে, রাশেদ জানতো না, সে মন দিয়ে চিৎকার করে দুলে দুলে পড়ছিলো। এমন সময় সে পেছনে একটু শব্দ শুনতে পায়, এবং চোখ ফিরিয়ে একটা আকাশছোঁয়া ভূতবউ দেখে চিৎকার করে ওঠে। চেয়ার থেকে লাফিয়ে সে ভূতবউটিকে জড়িয়ে ধরে। তার চিৎকার শুনে। সবাই ছুটে এসে দেখতে পায় রাশেদ বিলু আপাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে। এমন ঘটবে বিলু আপা ভাবতেই পারে নি। সে-সন্ধ্যায় জাল বোনা হয়ে গেলে বিলু আপার। মন আনন্দে ভরে যায়, রাশেদকে চমকে দেয়ার জন্যে সে মাথার ওপর জাল পরে খিলখিল করে হাসতে হাসতে এসে রাশেদের চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে রাশেদকে ডাকে। রাশেদ চোখ ফিরিয়ে দেখতে পায় ভূতবউ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে, তার মাথা ঘরের চাল পেরিয়ে গাছের মাথা পেরিয়ে আকাশে উঠে গেছে। চিৎকার করে সে জড়িয়ে ধরে বিলু আপাকে। বিলু আপা খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিলো এতে, রাশেদও খুব লজ্জা পেয়েছিলো, আর রাশেদকে খেতে হয়েছিলো একবাটি নুনগোলানো পানি, এটাই ছিলো সবচেয়ে বিচ্ছিরি।
বিলু আপা, আর তার সইরা, পুষু আপা আর পারুল আপা, এতো মিষ্টি ছিলো! তাদের শাড়ি থেকে উঠতো এতো মিষ্টি গন্ধ, চুল থেকে উঠতো এতো মিষ্টি গন্ধ, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করতো সেখানকার বাতাস গন্ধরাজ ফুলের গন্ধে ভরে যেতো। হাঁটলেই শরীর দুলতো তাদের, মনে হতো তাদের হাড় নেই, তাদের ভেতরে আছে। দুধের জমাট সর, অনেক মাখন আছে তাদের চামড়ার ভেতরে। তারা যখন বসে বসে গল্প করতো, তাদের ব্লাউজের নিচের প্রান্তের পরে মাংসের ঢেউ দেখা যেতো, ছুঁয়ে। দেখতে ইচ্ছে হতো রাশেদের; পুষু আপা রাশেদকে তার মাংসের ঢেউ ধরে দেখতে দিতো, রাশেদ দু-আঙুলে ওই ভাজ ধরে জোরে টান দিতো আর পুষু আপা চিৎকার করে উঠতো, তারপর খিলখিল করে হাসতো। মেয়েরা অদ্ভুত চিৎকার দিতে পারে, রাশেদ সেই তখনই বুঝেছিলো, কষ্টের সাথে সুখ মিশিয়ে তারা চিৎকার দিতে পারে। বিলু আপা, পুষু আপা, পারুল আপা কখনো বাড়ির বাইরে যেতো না; অনেক বছর আগে তারা বোর্ডইস্কুলে যেতো, ইস্কুলের জঙ্গলে ভরা মাঠে ছিয়া লো ছিয়া তোর মার বিয়া ধান নাই পান নাই চোতরাপাতা দিয়া বলে ঝড়ের মতো দৌড় দিয়ে খেলতো, রাশেদ তাদের দৌড়িয়ে ছুঁতে পারতো না, এখন মনে হয় তারা কেউ কখনো দৌড়োয় নি, তারা দৌড়োতে জানে না। তারা বাইরে যেতো না, বাইরে গেলে সাড়া পড়ে যেতো, কিন্তু সব সংবাদ তারা আগেই কী করে যেনো পেয়ে যেতো; তারা এমন অনেক সংবাদ পেতে, যা রাশেদ কখনোই পেতো না। বাতাস না পাখি যেনো তাদের জন্যে সংবাদ নিয়ে আসতো। একদিন রাশেদ তাদের ফিসফিস করে কী যেনো বলতে শোনে, রাশেদ শুধু রাবুর ‘মা’ কথাটি বুঝতে পারে, আর কিছু বুঝতে পারে না। রাশেদকে দেখে তারা চুপ হয়ে যায়। রাশেদ রাবুকে দেখেছে, রাবুর মাকে কখনো দেখে নি, ওদের বাড়িও কখনো যায় নি, বিলু আপা পুষু আপা পারুল আপাও কখনো যায় নি। ওদের বাড়িটা গ্রামের পশ্চিম পাশে-এতো পশ্চিম পাশে যে মনে হয় অন্য গ্রাম, চারপাশে ঘন জঙ্গল, অনেক সাপ আছে বলে শুনেছে রাশেদ। সেই রাবুর মাকে নিয়েও গল্প আছে বিলু আপাদের? আপাদের এক অভ্যাস, তারা নিজেদের মধ্যে খিলখিল করে হাসে, ফিসফিস করে কথা বলে, কিন্তু রাশেদ কাছে গেলেই তারা শুধু কাজের কথা বলে, রাশেদের পড়ার কথা জানতে চায়, ফিসফিস করে না খিলখিল করে না। তারা সব জানে শুধু জানে না রাশেদের ভালো লাগে তাদের খিলখিল তাদের ফিসফিস।