রাশেদ ভেবেছিলো একটি নেত্রীর সাথে কথা বলবে, কী গণতন্ত্র সে একদিন আনবে সে-সম্পর্কে একটু জানবে, বাসায় গিয়ে একটু গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখবে, গণতন্ত্রের গালে একটু গাল ঘষবে; কিন্তু তাকে ঘিরে চক্রটা বেশ শক্ত, সেটা ভেঙে তার দিকে যাওয়া অসম্ভব। গণতন্ত্রের চক্রও বেশ শক্ত বঙ্গে। রাশেদ দূর থেকে বলে, আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই। পাঁচটা প্রহরী রাশেদকে ঘিরে ধরে, পারলে তারা রাশেদের মুখ চেপে ধরতো; তাদের নেত্রীর সাথে এভাবে কথা বলতে নেই, খুব বিনয়ে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে তার সাথে কথা বলতে হয়। রাশেদ ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবে না। রাশেদ গণতন্ত্রের মুখের দিকে তাকাতে চেষ্টা করে, প্রহরীদের ভিড়ে সে ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের মুখ দেখতে পায় না, হয়তো গণতন্ত্রের মুখ নেই শুধু পা আচে। হাঁ হাঁ করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করে রাশেদের, কিন্তু সে হাসে না, তাকে মাতাল ভাবতে পারে সবাই, পার্টিতে প্রত্যেকে অন্যকে মাতাল ভাবে, বা ভাবতে পারে সে। গণতন্ত্রের অনুপযুক্ত, ভবিষ্যতে দেশ ভরে যে-গণতন্ত্র আসবে রাশেদ তার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে না। রাশেদকে প্রস্তুত হতে হবে গণতন্ত্রের জন্যে, এখন থেকেই শুধু পায়ের দিকে তাকানোর অভ্যাস করতে হবে। কয়েক মাস পর আরেক পার্টিতে রাশেদ ওই নেত্রীকে দেখতে পায়, কিন্তু তখনো রাশেদের পায়ের দিকে তাকানোর অভ্যাস আয়ত্ত হয় নি, সে দূর থেকে নেত্রীর মুখের দিকেই তাকায়; সে আগের মতোই দাঁড়ায়ে আছে উত্তরকোণে, বেশ মলিন দেখাচ্ছে তাকে, তার গণতান্ত্রিক প্রহরীর সংখ্যা কমে গেছে, দু-তিনটিতে ঠেকেছে। যে-প্রহরীগুলো রাশেদকে সেবার কথা বলতে দেয় নি তার সাথে, তারা এবার নেত্রীর সাথে নেই, তবে পার্টিতে আছে; তারা এখন আছে অন্য কোণে, একটা নতুন কোণ উজ্জ্বল করে তারা পান করছে। তাদের তিনটা উদ্দিন মোহাম্মদের মন্ত্রী হয়েছে, উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের মতোই ঝকঝক করছে তাদের মুখমণ্ডল।
রাশেদ একটা স্বপ্ন দেখেছে; এক রাতে ঘুমিয়েই স্বপ্নটি সে দেখেছিলো, তার পর থেকে জেগে জেগেই সে স্বপ্নটি দেখতে থাকে, মাঝেমাঝেই স্বপ্নটি তার মগজ ফেড়ে। ঝিলিক দিয়ে ওঠে। একটা উৎসবে গেছে রাশেদ, উৎসবটা হচ্ছে প্রাসাদের ভেতরে। যেখানে তার যাওয়ার কথা নয়, কিন্তু সে যায় যেমন স্বপ্নে মানুষ যায়, প্রাসাদে ঢোকার আগে সে দেখতে পায় চারপাশে স্থূপ স্থূপ হাড় পড়ে আছে। অতো হাড় কোথা থেকে এলো সে বুঝতে পারে না, প্রাসাদের বাইরে হাড় পড়ে থাকাও তার কাছে অদ্ভুত লাগে। উৎসবে যারা এসেছে, তারা পরে এসেছে তাদের শ্রেষ্ঠ স্যুট, পাজামা, শেরোয়ানি, সাফারি, উর্দি, শাড়ি; কিন্তু রাশেদ যার সাথেই হাত মেলাতে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছে সে-ই তার দিকে একটা থাবা বাড়িয়ে দিচ্ছে, থাবার নখে রক্ত ঝলমল করছে; তাদের কারো মুখ সিংহের কারো মুখ বাঘের কারো মুখ শেয়াল কুকুর শুয়োরের। রাশেদ কোনো মানুষের মুখ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু মানুষের মুখ দেখার জন্যে তার খুব। পিপাসা জেগে উঠছে, যেনো হাজার বছর ধরে সে মানুষের মুখ দেখে নি। সে কি হাজার বছর ধরে প্রাসাদের ভেতরে উৎসবের ভেতরে রয়েছে? সিংহগুলো গম্ভীরভাবে হাঁটছে, বাঘগুলোও গম্ভীর; তারা মুখোশ পরে আছে বলে মনে হচ্ছে, গম্ভীর না হলে মুখোশ খসে পড়ে যেতে পারে। কুকুরগুলো তাদের ঘিরে ঘিরে ঘুরছে, শেয়াল। শুয়োরগুলো তাদের ঘিরে ঘিরে ঘুরছে; আরেক পাশে কারা যেনো খুঁজছে বাঘের মুখোশ সিংহের মুখোশ, কিন্তু সবগুলো মুখোশ পরা হয়ে গেছে, তারা মুখোশ পাচ্ছে না। হাড়। জমে উঠছে প্রাসাদের দেয়ালের বাইরে, নখে রক্ত ঝলমল করছে। রাশেদ স্বপ্নটি মগজে বয়ে বয়ে জীর্ণ হয়ে পড়ছে, কাউকে বলতে পারছে না।
রক্তমাংসের রহস্য
বিলু আপা তোমাকে মনে পড়ছে মেঘ উড়ছে দেখতে ইচ্ছে করছে কতোদিন তোমাকে দেখি না সরোবর দেখি না পদ্ম দেখি না তোমাকে দেখলে মাথা জুড়োতো এইসব দুঃস্বপ্ন ফুরোতো সামরিক আইন গণতন্ত্র দানব দেবী থাকতো না লাশ ফাস বদমাশ মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ রাজাকার গাঁজাকার সাজাকার দালাল আমলা কামলা আলবদর। তালবাদর মন্ত্রী সান্ত্রী মাস্তান জেনারেল গেনারেল ভেনারেল থাকতো না বিলু আপা তুমি দক্ষিণ ঘরের পাশের পেয়ারাপাতার সুগন্ধ তুমি জোনাকিরা লেবুঝোঁপের ঘ্রাণ তোমার মুখ মনে হলে আমি পেয়ারাপাতার গন্ধ পাই গোড়ালেবুর গন্ধ পাই তোমার মুখ মনে হলে দেখি ডালিম ফুল ফুটছে উঠোন লাল হয়ে যাচ্ছে দইকুলি বসছে ঘুমিয়ে পড়ছে। আতার গন্ধ উঠছে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে দুপুরবেলা লাল মোরগের শিখা জ্বলছে কুয়াশা। নামছে রোদ উঠছে বৃষ্টি হচ্ছে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে পশ্চিম পুকুরে কচুরিপানার ওপরে ডাহুক হাঁটছে। রাশেদ একটি বই পড়তে শুরু করেছিলো, অত্যন্ত জঘন্য বই, ওই বই পড়ার সময় এমন আবেগ ধাক্কা দেবে রাশেদ ভাবতে পারে নি; আবশ্য এমন বিষম। ব্যাপার তার ঘটে কখনো, দশ বছরে একআধবার, একবার একটা বিদঘুঁটে লোকের। জানাজায় দাঁড়িয়ে রাশেদের বারবার মনে পড়ছিলো একটি প্রেমের কবিতার পংক্তি, তার ভয় হচ্ছিলো সে হয়তো জোরে পংক্তিটি উচ্চারণ করে ফেলবে। রাশেদ দেখতে পাচ্ছে। বিলু আপা কাজ করছে, সে তো সারাদিনই কাজ করতো, তার কাজের শেষ ছিলো না, একটার পর একটা কাজ সৃষ্টি হয়ে উঠতো তার হাতে; বিলু আপার হাতে একটা কাজ শেষ হয়ে আসছে দেখে যখনই রাশেদ ভাবতো বিলু আপার হাতে আর কাজ নেই, তখনই অবাক হয়ে রাশেদ দেখতে আরেকটি কাজ সৃষ্টি হয়েছে তার হাতে। বিলু আপা পুকুর থেকে মাটির কলসি কাঁখে করে পানি আনতো, কী সুন্দর বেঁকে গিয়ে হাঁটতো, একটার পর একটা কলসি সাজিয়ে রাখতে কাঠের চকে, ফিটকিরি দিতো, ওই পানি খেতে জিভ জড়িয়ে যেতো রাশেদের। বিলু আপা এতো ঝকঝক করে বাসন মাজতে পারতো;-পশ্চিম পুকুরঘাটে বিলু আপা ছাই দিয়ে বাসন মাজতো, নারকেলের আঁশে ছাইমেখে ঘষতে থাকতো, তার হাতের আঙুল নাচের মুদ্রার মতো নাচতো, তার। আঙুলের ঘষায় সোনা হয়ে উঠতে পেতলের থালা গেলাশ বাটি, যা দাঁত দিয়ে কামড়াতে ইচ্ছে হতো রাশেদের। অন্য সবাই ভাত খেতে টিনের থালায়, বাবা আর রাশেদের জন্যে ছিলো পেতলের থালা গেলাশ; বিলু আপা পেতলের থালা আর গেলাশ মাজতে সম্ভবত পছন্দ করতো, অনেকক্ষণ ধরে মাজতো, তারপর ধোয়ার জন্যে। তলোয়ারের মতো থালা ঢুকিয়ে দিতে পানিতে, পানিতে একটা মধুর শব্দ উঠতো, পানির নিচে চাঁদের মতো জ্বলতো তার থালাটি, পাশের হেলেঞ্চার ছোট্ট চালিটি ঢেউ লেগে লেগে কাঁপতে থাকতো। বিলু আপার মাজা পেতলের থালার দিকে তাকিয়ে থাকতে কেমন একটা সুখ লাগতো রাশেদের, রক্তের ভেতরে সে একটা ঝলমলে। সোনালি আলোর নাচ অনুভব করতো।