উদ্দিন মোহাম্মদের স্ত্রীটিকে দেখলে ছেলেবেলার ডাইনিদের মনে পড়ে, মনে হয়। রূপকথায় যে-ডাইনিদের কথা শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেছি, কিন্তু চোখের সামনে যাদের কখনো দেখি নি, তাদের প্রধানটিকে দেখছি। সেও বেরিয়ে পড়েছে। রাশেদ প্রথম তাকে দেখতে পায় শুক্রবারের একটি গুজবকাগজের প্রচ্ছদে, দেখেই ডাইনি দেখার ভয়ে তার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যেতে চায়। সেও, উদ্দিন মোহাম্মদের মতো, ভর করছে দেশের ওপর, দেশটা যেমন উদ্দিন মোহাম্মদের দেশটা তারও; সেও দিকে দিকে যাচ্ছে, উদ্দিন। মোহাম্মদের মতো তাকেও তিন ঘণ্টা ধরে দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে, নতুন নতুন জামদানি পরে সে সকাল দুপুর সন্ধ্যায় ফিতে কাটছে, তার জন্যে একটা জামদানির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে, সে ভিত্তিপ্রস্তর বসাচ্ছে, বক্তৃতা দিচ্ছে, তার ডাইনিস্বরে কান ছিঁড়েফেড়ে যাচ্ছে শ্রোতাদের, তবে তার পেছনেও পোকার অভাব হচ্ছে না, . মেয়েমানুষ তাকে ঘিরে ফেলছে পুরুষমানুষ তাকে ঘিরে ফেলছে। সে দেশের প্রথম। মহিলা, এমন মহিয়সী আগে দেখা যায় নি; পত্রিকায় উদ্দিন মোহাম্মদের সমান জায়গা জুড়ে থাকছে সে, অনেক সময় বেশি জায়গাই জুড়ছে, তিনস্তম্ভের নিচে তার ছবি ছাপা হচ্ছে না, কোনোদিন ছাপা হলে পরের দিন চারস্তম্ভে ছাপতে বাধ্য হচ্ছে পত্রিকাগুলো। আমলারা তাকে আম্মা বলছে, তার পা ছুঁয়ে দোয়া চাইছে, তার দোয়ায় পদোন্নতি পাচ্ছে। দেশের কল্যাণের জন্যে সে অতিবাহিত করছে ব্যস্ত সময়; সে নারীদের কল্যাণ দেখছে, শিশুদের কল্যাণ দেখছে, গরিবদের কল্যাণ দেখছে, মাদকদ্রব্যের বিরুদ্ধে। আন্দোলন করছে, পত্রিকার প্রথম পাতা ও টেলিভিশন জুড়ে থাকছে। যা কিছু বাইরের, তাই দেখাচ্ছে আর ছাপছে টেলিভিশন আর পত্রিকাগুলো, ভেতরের কিছু তারা দেখাচ্ছে না ছাপছে না, কিন্তু ভেতরের সত্যও বেরিয়ে পড়ছে। কোনো কিছুই চাপা থাকছে না, সবাই জেনে ফেলছে যে উদ্দিন মোহাম্মদ কোটি কোটি টাকা বানাচ্ছে, বিদেশে পাচার করছে, তাকে টাকা না দিয়ে দেশে কোনো কাজ হচ্ছে না, একটা রাস্তাও খোঁড়া হচ্ছে না; আর সে নারী ভোগ করছে, তার এক নারীকে সে রাখছে শহরের উত্তরে, আরেকটিকে পুবে, আরেকটিকে দক্ষিণে, কোনোটিকে রাখছে বিদেশে। উদ্দিন মোহাম্মদের স্ত্রীটিও তাই করছে, সেও টাকা বানাচ্ছে, তাকেও টাকা না দিয়ে বহু কাজ হচ্ছে না। আর সে যুবক পছন্দ করে, সে যুবক উপভোগ করছে, কয়েকটি যুবক তার সেবা করছে, বারবার সে যুবক বদল করছে। কয়েকটি যুবক তার সেবা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে নাকি একটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে উদ্দিন মোহাম্মদের বিরুদ্ধে, তার অভ্যুত্থানের কাহিনীটি খুব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। উদ্দিন মোহাম্মদ একদিন যখন জরিনা নামের এক উপস্ত্রীর সাথে লিপ্ত ছিলো, তখন সে সচিবালয়ে গিয়ে উদ্দিন মোহাম্মদকে নগ্ন অবস্থায় হাতেনাতে ধরে ফেলে, উদ্দিন মোহাম্মদের দিকে সে একটা ছাইদানি ছুঁড়ে মারে। উদ্দিন মোহাম্মদের নাকটি তাতে ভেঙে যায়, ফলে কয়েক দিনের জন্যে উদ্দিন মোহাম্মদ টেলিভিশনে নিজেকে দেখানো থেকে বিরত থাকে; ওই সময় তার স্ত্রীটি টেলিভিশনে প্রথম মহিলারূপে আবির্ভূত হয়। উদ্দিন মোহাম্মদ তার সাথে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হয়, তাকে নিজের ক্ষমতার এক অংশ আর যুবকসংসর্গের। অধিকার দেয়।
দুটি পার্টিতে যাওয়ার ভাগ্য হয়েছে রাশেদের এর মাঝে; একই লোকের পার্টি, লোকটি ঘন ঘন পার্টি দিচ্ছে, মারাত্মক প্রগতিশীল বলে সে বিখ্যাত, রাশেদ গিয়ে দেখে বাড়িটা একটা ছোটোখাটো বাঙলাদেশ। সেখানে সব আছে, সিনেমার ৭টা অভিনেত্রী আছে, ১ পাল আমলা আছে, ৫টা অবসরপ্রাপ্ত আছে, ২টি নেত্রী আছে, তাদের ঘিরে আছে তাদের গোটাদশেক গণতান্ত্রিক প্রহরী, এমনভাবে ঘিরে আছে নেত্রীদের যেনো তারা গণতন্ত্রের দেবীদের ঘিরে আছে, আছে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরের অধিবাসীরা। উত্তর দিকে এক নেত্রী, তাকে ঘিরে তার প্রহরীরা; দক্ষিণ দিকে আরেক নেত্রী, তাকে ঘিরে তার প্রহরীরা; সবচেয়ে উজ্জ্বল পশ্চিম দিকটা, যেখানে উদ্দিন। মোহাম্মদের মন্ত্রীরা পান করছে, অন্যরা তাদের পান করার দৃশ্য দেখে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে, শুধু স্যার, স্যার শোনা যাচ্ছে। ঝকঝক করছে উদ্দিন মোহাম্মদের মন্ত্রীরা। রাশেদ একপাশে বসে পান করছিলো ১টি কবি, ২টি ঔপন্যাসিক, ৩টি সাংবাদিক-প্রাবন্ধিকের সাথে, খুব বিখ্যাত তারা, গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের জন্যে যারা নিজেদের উৎসর্গ করেছে। দেশে গণতন্ত্র নেই বলে তারা তৃপ্তির সাথে পান করতে পারছিলো না, চুমুকে চুমুকে গণতন্ত্র গণতন্ত্র শব্দ করছিলো, একজনের গণতন্ত্রের হিক্কা ওঠার ক্রম হচ্ছিলো; এমন সময় উদ্দিন মোহাম্মদের একটা মন্ত্রীকে নিয়ে পার্টিদাতা তাদের দিকে এগিয়ে আসে, সে তাদের মন্ত্রীটির সাথে পরিচয় করিয়ে ধন্য করতে চায়। রাশেদ দেখে একটা পাড়ার। মাস্তান, কয়েক দিন আগেও যে প্রকাশ্যে ছিনতাই করতো, যার নাম সে কিছুতেই মনে করতে পারছিলো না। ওই মাস্তানটা, যে উদ্দিন মোহাম্মদের মন্ত্রী, তাদের দিকে এগিয়ে আসতেই বিনয়ে গলে দাঁড়িয়ে পড়ে কবি আর ঔপন্যাসিক আর সাংবাদিক প্রাবন্ধিকগুলো, একের পর এক হাত বাড়াতে থাকে, পারলে চার-পাঁচটি করে হাত বাড়িয়ে দিতো তারা, নিজ নিজ নাম বলতে থাকে অষ্টম শ্রেণীর বালকদের মতে, দুজন উত্তেজনায় নিজেদের নাম বলতেও ভুল করে। মাস্তানটি মহাপুরুষের মতো মৃদু হাসে। রাশেদ বসেই ছিলো, ওই মাস্তানের দিকে হাত বাড়ানোর আর নিজের নাম বলার কোনো ইচ্ছে তার নেই। মাস্তানটি মহাপুরুষের মতো তারও দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, আশা করতে থাকে রাশেদ দাঁড়াবে; রাশেদ বসেই থাকে, তার হাতের দিকে অন্যরা। তাকিয়ে আছে বলে এক সময় ব’সেই হাত বাড়ায়, এবং জিজ্ঞেস করে, এর কী নাম? পার্টিদাতা ও কবি ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিকগুলো বিচলিত হয়ে পড়ে, তারা চিৎকার করে। বলতে থাকে, উনি মাননীয় মন্ত্রী, উনি মাননীয় মন্ত্রী, উনি মাননীয় মন্ত্রী, এবং কী একটা নামও বলে। মাস্তানটি তখনো রাশেদের হাত ধরে রেখেছে, রাশেদ তাকে জিজ্ঞেস। করে, বুটের ভেতর থাকতে কেমন লাগে? মাস্তানটা কেঁপে ওঠে, একবার হোঁচট খায়, এবং রাশেদের হাত ছেড়ে অভিনেত্রীদের দিকে এগিয়ে যায়।