মমতাজ বেশ শক্ত সংস্কৃতির মানুষ, জলপাইরঙের ঘোষণা মুখে বমি বমি ভাব এনে দিলেও তার সুরুচিকে নষ্ট করতে পারে নি; সে রুচিসম্পন্নভাবে রেগে উঠলো। বললো, তুমি ঘুম থেকে উঠেই অশ্লীলতা শুরু করলে। এমন শব্দ তোমাকে মানায় না। রাশেদ বললো, কোথায় অশ্লীলতা করলাম? মমতাজ বললো, ওই যে কীসের ওপর দিয়ে যাবে। বললে। রাশেদ বললো, আমার শব্দটি কি ওই ঘোষণাগুলোর থেকেও অশ্লীল? রাশেদের। অবশ্য খুবই অশ্লীলতা করতে ইচ্ছে করছিলো; বাঙালিরা বেশি রেগে গেলে প্রতিপক্ষের পেছনের দিকে কী একটা করার কথা বলে, পেছনটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে চায়, রাশেদেরও ইচ্ছে করছিলো পৃথিবীর সমস্ত উর্দি খুলে পেছনের দিকে ক্রিয়া সম্পন্ন করার; কিন্তু তা না পেরে সে শুধু ওই শব্দটি উচ্চারণ করেছে। বাবার মুখে রাশেদ শব্দটি ছেলেবেলায় বারবার শুনেছে, বাবা রাগলেই চিৎকার করে ওই শব্দটি বলতেন; রাশেদ সাধারণত বাবার মতো চিৎকার করে শব্দটি বলতে পারে না, কিন্তু রেগে গেলেই মনে মনে চিৎকার করে ওঠে, বাল। প্রথম সে শব্দটির অর্থ বুঝতো না, বোঝার আগেই এটি তার রক্তে ঢুকে যায়। তাদের গ্রামের সবাই সবচেয়ে তুচ্ছ জিনিশ বোঝাতে ঘেন্নার সাথে উচ্চারণ করতো শব্দটি, সেও উচ্চারণ করতে চায়, কিন্তু পারে না বলে অসুস্থ বোধ করে। রাশেদ বললো, আমি চুলের কথা বলেছি। মমতাজ বললো, আমি জানি তুমি কীসের কথা বলেছে। আমাকে তুমি ভাষাবিজ্ঞান শেখাতে যেয়ো না। রাশেদ বললো, ছা-ম-রি-ক-ছা-স-ন! উর্দিপরা ভাঁড়! ওই যে ট্রাক ভরে বেরিয়ে পড়েছে, হাতে অস্ত্র, কিন্তু ওরা চুল ছাটার চেয়ে বড়ো কোনো কাজ করতে পারে না; ওদের। জেনারেলরাও পারে না। দেখবে ওরা রাস্তায় ছেলেদের লম্বা চুলের ওপর দিয়ে বিপ্লব করছে।
ওরা বিপ্লব নিয়ে আসে। ভাবতেই আবার প্রস্রাবের চাপটা প্রচণ্ড হয়ে উঠলো রাশেদের। ওরা রাতে আসে, আসার দিনটার নাম দেয় বিপ্লব দিবস; এসেই ওরা রাস্তায় ছেলেদের চুল ছাঁটে, মেয়েদের ঘোমটা পরায়। রাশেদ দেখতে পেলো ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে কয়েকটি জলপাইরঙ একটি লম্বাচুলের ছেলেকে মাটিতে শুইয়ে ফেলেছে, দুটি জলপাইরঙ কাঁচি বের করে এদিকে সেদিকে হেঁটে ফেলছে ছেলেটির চুলগুলো। চুলই রাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা রাশেদ দেখে আসছে ছেলেবেলা থেকে। চুলের ওপর ওরা এতো খাপ্পা কেনো? চুল কি বিদ্রোহের মুক্তির প্রতীক? নাকি ওরা চুল ছাঁটার থেকে। গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুর যোগ্য নয়? রাশেদের প্রস্রাবটা এখন আরো তীব্র; মৃদুকে মায়ের কোলে দিয়ে রাশেদ বাথরুমে ঢুকলো। সে মনে করেছিলো একটা বিশাল হ্রদ ঘুরপাক খাচ্ছে তার ভেতরে, কাসপিয়ান হ্রদের কথাই মনে পড়লো তার, ভেবেছিলো একটা জলপ্রপাত গমগম করে বেরিয়ে আসবে, কিন্তু অন্যদিনের থেকে কোনো পার্থক্য ঘটলো না। অন্যান্য দিনের মতো মিনিটখানেক ঝমঝম করে সেটা বন্ধ হয়ে গেলো, তলপেটটি ভারী হয়ে রইলো; প্রপাতটি ভেতরে ভেতরে গর্জন করছে, আবার চেষ্টা করতে গিয়ে ভেতরটাকে মরুভূমির মতো শুষ্ক ঠেকলো। অনেকক্ষণ ধরে সে শিশি-শি আওয়াজ করলো, ছেলেবেলায় মা নিশ্চয়ই এ-মন্ত্রের সাহায্যে কাজটি সম্পন্ন করাতো, আজ যদি ওই মন্ত্রে কাজ হয় তাহলে সে রক্ষা পায়। কিন্তু সে দেখলো তার প্রত্যঙ্গটি স্মৃতিহীন, বাল্যকালকে একেবারেই মনে করতে পারছে না। রাশেদ তলপেটে একটা গর্জনশীল রুদ্ধ জলপ্রপাত নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই সে ড্রয়িংরুমে ঢুকে। টেলিভিশনে নতুন মহাপুরুষের মুখ দেখে বললো, বাহ, বেশ তো নিধিরাম সর্দার! দেশে একটা বেশ ছিঁচকে মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে। মহাপুরুষটি ত্রাতাত্রাতা মহান মহান ভাব করার চেষ্টা করছে, সম্ভবত মাস ছয়েক সে মহান মহান ত্রাতা ত্রাতা ভাবের রিহার্সেল দিয়েছে টয়লেটে বসে, বুকে তারাও শেলাই করেছে গণ্ডাখানেক, বাহু ঘিরে। দড়িও বেশ পেঁচিয়েছে, দু-কাঁধে তলোয়ারও ঝুলিয়েছে, কিন্তু ওকে একটা ভাঁড় বলেই মনে হচ্ছে। সুন্দর পলিমাটির দেশ বঙ্গ, ভড়ও মহাপুরুষরুপে দেখা দেয় এখানে, ভেবে হাসি পেলো রাশেদের। ওর পাশে দুটি ছোটো মহাপুরুষও রয়েছে, তারাও গাল ফুলিয়ে। খুব মহৎ ভাব করার চেষ্টা করছে, বুক ভরে চাকতি ঝুলিয়েছে; এমন ভাব করছে যেনো ওরা পাটখেত বা কচুরিপানার ভেতর থেকে আসে নি, ইলিশ বা পুঁটি ওরা কখনো দেখে নি, যেনো আকাশ থেকে দয়া করে নেমেছে। খুব হাসি পেলো রাশেদের। রাশেদ চোখ বড়ো বড়ো করে পর্দার খুব কাছে গিয়ে বড়ো মহাপুরুষ আর ছোটো মহাপুরুষ দুটিকে দেখতে চেষ্টা করলো। মমতাজ জানতে চাইলে সে অতো কাছে গিয়ে কী দেখছে; রাশেদ কোনো উত্তর দিলো না, আরো কাছাকাছি গিয়ে দেখার চেষ্টা করলো। অনেকক্ষণ দেখে বললো, আমি ওদের উর্দিগুলো খুলে দেখার চেষ্টা করছি, ওরা বাঙালি কিনা, বাঙালি হলে মানুষ কিনা? এতো পোশাক আর দড়িতে ওদের ভালো করে দেখতে। পাচ্ছি না। ওদের আন্ডারওঅ্যারও খুলে দেখতে চাই। মমতাজ আবার আপত্তি জানালো, বললো, তুমি বড়ো অশ্লীল হয়ে উঠছে। কিন্তু রাশেদ যতোটা অশ্লীলতা করতে চায়, তা সে করতে পারছে না বলে তার সারাদেহ টনটন করতে লাগলো। অশ্লীলতা ছাড়া অশ্লীলতা থেকে মুক্তি নেই।