উদ্দিন মোহাম্মদ আর শুধু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নয়, সে এখন রাষ্ট্রপতি, অবসরপ্রাপ্ত যে-বিচারপতিটিকে সে রাষ্ট্রপতি রেখেছিলো, যেটা প্রাণপণে তার জুতো। পরিষ্কার করছিলো, আরো অনেক দিন করার স্বপ্ন দেখছিলো, সেটিকে সে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, সেটা স্বপ্নভঙ্গের দুঃখে রাতের পর রাত আত্মহত্যার কথা ভেবেছে, আত্মহত্যা করতে গিয়ে ভয় পেয়ে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মারা গেছে। উদ্দিন মোহাম্মদ সেটাকে জাতীয় কবরস্থানে কবর দিয়েছে, বাঙলার মাটি তার আরেক মহৎ সন্তানকে নিজের বুকের মধ্যে পেয়ে সুখী হয়েছে। উদ্দিন মোহাম্মদ সব কিছু গুছিয়ে আনছে; মসজিদ, পির, আর পোকাঁদের গুছিয়ে এনেছে, কিন্তু তাদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পারছে না, সে জানে ওগুলো কাজ দেবে, তবে বেশি কাজ দেবে না; টিকে থাকতে হলে শক্ত রাখতে হবে তার ভিত্তিটাকে, যা তার শক্তির উৎস, অনেক জেনারেল তৈরি করতে হবে, তাদের তৃপ্ত রাখতে হবে, তাদের সব কিছু দিতে হবে, এবং তাদের সব কিছু দিচ্ছেও, কিন্তু তাতেই চলবে না; সে টিকে থাকতে চায়, দেড়-দু-দশক ভোগ করতে চায়। দেশটাকে, তার জন্যে কাজে লাগাতে হবে সেই শাশ্বত শয়তানগুলোকে, যেগুলো রাজনীতির নামে দালালি করে, যেগুলো নেতা নামে পরিচিত। উদ্দিন মোহাম্মদ শুরু। থেকেই সেগুলোকে তার বুটের ভেতরে আনার চেষ্টা করে আসছে, অনেকগুলোই তার বুটের ভেতরে এসে গেছে; তার আরো শয়তান দরকার, আরো শয়তান দরকার, আরো শয়তান দরকার, বাঙলাদেশের সমস্ত শয়তান তার দরকার। সুখের কথা বাঙলাদেশ অঢেল শয়তান জন্ম দিয়েছে, সে জানে শয়তান সে পাবে দলে দলে। দেশ দখল করার পরই সে কয়েকটি শয়তানকে ধরেছিলো,–এসেই শয়তান ধরা সামরিক রীতি, তাদের মধ্যে বড়ো শয়তানগুলোকে সে ছেড়ে দিয়েছে, সেগুলো উদ্দিন মোহাম্মদের বন্দনা। গাইছে দেশ জুড়ে, যেমন তারা গাইতো আগের প্রভুদের বন্দনা। তারা সভা করছে, সভায় বলে বেড়াচ্ছে উদ্দিন মোহাম্মদ দেশকে উদ্ধার করেছে, মহামান্য উদ্দিন মোহাম্মদ এলে এতোদিনে দেশ ধ্বংস হয়ে যেত, দেশের জন্যে উদ্দিন মোহাম্মদকে আরো বহু বছর দরকার। তারা উদ্দিন মোহাম্মদের নামের আগেপাছে লাগাচ্ছে বিশেষণের পর। বিশেষণ, তাকে মহামানব আখ্যা দিচ্ছে, বাঙালি মুসলমানের ইতিহাসে এমন মহামানব আর দেখা যায় নি বলে চিৎকার করে চলছে, মহামান্য না বলে তার নাম উচ্চারণ করছে না। ভিড় বাড়ছে উদ্দিন মোহাম্মদের সচিবালয়ে, শয়তানরা তাকে ঘিরে ফেলছে; সে আরো দালাল চায়, আরো শয়তান চায়, সে যতো শয়তান চাইছে দালাল চাইছে ভিড় হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। তার পূর্বসূরীটি, যে খুন হয়ে গেছে, যার খুনের সাথে উদ্দিন মোহাম্মদ জড়িত ছিলো, হয়তো সে-ই ছিলো প্রধান পরিকল্পনাকারী, সে একটি রাজনীতিক দল তৈরি করেছিলো, গণতন্ত্রবাদী নাম রেখেছিলো, যা সে ভরে ফেলেছিলো অবসরপ্রাপ্ত সেনাপতিতে, এবং দলে সে জড়ো করেছিলো কুখ্যাত রাজাকারদের, ও নকল সমাজতন্ত্রীদের। সে রাজনীতিবিদদের জন্যে রাজনীতি কঠিন করে তুলেছিলো, আর সহজ করে তুলেছিলো সুবিধাবাদীদের জন্যে। উদ্দিন মোহাম্মদ আসে ওই গণতন্ত্রবাদীদের উত্থাত ক’রে, ক্ষমতায় থাকতে হলে তাকে প্রথম নষ্ট। করতে হবে ওই দলটিকেই।
গণতন্ত্রবাদীদের নষ্ট করছে উদ্দিন মোহাম্মদ, বা ওই দলের নষ্টরাই বেশি ব্যগ্র হয়ে পড়েছে আরো নষ্ট হওয়ার জন্যে, তারাই দলে দলে ঢুকে পড়ছে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে। একপাল অবসরপ্রাপ্ত রয়েছে ওই দলে, রাজনীতিতে ঢোকার কথা ছিলো না তাদের, উদ্দিন মোহাম্মদের পূর্বসূরীটি তাদের নিয়ে এসে মন্ত্রী করেছিলো, সে। রাজনীতি কঠিন করে তুলতে চেয়েছিলো রাজনীতিকদের জন্যে, তারা আবার মন্ত্রী হতে চায়, মন্ত্রী হওয়া সুখকর; গাধা হলেও তারা বুঝতে পারছে গণতন্ত্রবাদী থেকে। আর মন্ত্রী, এমনকি বাহরাইন বা কাতারে রাষ্ট্রদূতও হওয়া যাবে না। গণতন্ত্রবাদীতে আর থাকা চলে না, থাকতে হবে উদ্দিন মোহাম্মদে, এবং তারা উদ্দিন মোহাম্মদের হয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার একটি অবঃ উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে ঢুকলে শনিবার ঢুকছে। তিনটা অবঃ। গণতন্ত্রবাদীদের জনক একপাল ব্যারিষ্টার বা ছাগল ঢুকিয়েছিলো নিজের গোয়ালে ছাগল সব কিছু খায় জেনে; ছাগলরা বুঝতে পারছে গণতন্ত্রবাদী থেকে আর। ঘাস মিলবে না কাঁঠালপাতা মিলবে না,-তারা পালে পালে উদ্দিন মোহাম্মদের গোয়ালে ঢুকছে। নকল সমাজতন্ত্রীতে দেশ ভরে উঠেছিলো, রাশিয়া আর চিনের কাছ থেকে যা পাচ্ছিলো তাতে পেট ভরছিলো না তাদের, বুঝতে পারছিলো জীবনে তারা কিছুই পাবে না, তাই দলে দলে যোগ দিয়েছিলো গণতন্ত্রবাদীতে। ঢুকে বুঝতে পেরেছিলো। শ্রেণীসংগ্রামের থেকে শোষণ অনেক সুখকর, ক্ষমতা অত্যন্ত মনোহর; গণতন্ত্রবাদী থেকে আর ক্ষমতা সম্ভব নয় শোষণ সম্ভব নয়, তাই তারা দলে দলে এখন উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে ঢুকছে। বড়ো শয়তানগুলো তো ঢুকবেই, ছোঁকরাগুলোও ঝানু শয়তান। হয়ে উঠেছে, তারাও যাচ্ছে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে। রাশেদ একটা ছোঁকরাকে স্নেহ করতো, চমৎকার ছোঁকরা, বিদ্যালয়ের বারান্দা সে শ্লোগানে মাতিয়ে রাখতো, মূর্তির নিচে দাঁড়িয়ে মার্ক্স মার্ক্স লেনিন করে শ্রোতাদের ক্ষেপিয়ে তুলতো, সেটাও। উদ্দিন মোহাম্মদের বুটে ঢুকে গেছে। ছোঁকরাকে রাশেদ চিনতো না, চেনে এক ভয়ঙ্কর ঘটনার মধ্য দিয়ে। রাশেদ বিদ্যালয়ের চা খাওয়ার ঘরে বসে চা খাচ্ছিলো, এমন সময় পাঁচ ছটি ছোঁকরা দৌড়ে আশ্রয় নিতে আসে সেখানে, তাদের তাড়া করে আসে আরো দশবারোটা, ছোঁকরাটা রাশেদের চেয়ারের নিচেই আশ্রয় খুঁজছিলো। তিন চারটি। হকিস্টিক এসে পিটিয়ে তার মাথা ভেঙে দেয়, সে পড়ে থাকে রাশেদের চেয়ারের পাশে, রক্তে মেঝে কালো হয়ে ওঠে। রাশেদ চিনতো না ছোঁকরাকে, ছোঁকরাকে টেনে তোলার মতো কেউ ছিলো না তখন চারপাশে। রাশেদ তাকে টেনে তোলে, মাথার রক্ত মুছে দেয়, ধরাধরি করে হাসপাতালে পাঠায়। ছোঁকরা এখন উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের। ভেতরে। গণতন্ত্রবাদীতে ঢুকেছিলো দলে দলে রাজাকার, তারা রাজার সঙ্গে থাকতেই পছন্দ করে, তাই এখন তারা উদ্দিন মোহাম্মদের পায়ে। আওয়ামির অবস্থা খারাপ বহু বছর ধরেই স্বাধীনতার পর তারা খুব স্বাধীনতা পেয়েছিলো, বাঙালির হাজার বছরের পরাধীনতার ক্ষতি তারা পূরণ নিতে চেয়েছিলো দু-এক বছরেই, সাড়ে তিন বছরে সাড়ে তিন হাজার বছরের স্বাধীনতা ভোগ করার পর দেখতে পায় তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। বর্তমান অন্ধকার, ভবিষ্যৎ অত্যন্ত অন্ধকার। আওয়ামি থেকে একদল ঢোকে গণতন্ত্রবাদীতে, তারা এক সময় বাঙালিতে বিশ্বাস করতো, গণতন্ত্রবাদীতে ঢুকে বাঙলাদেশিতে বিশ্বাস করতে শুরু করে। তারা গণতন্ত্রবাদী ছেড়ে ঢোকে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটে, এবং এতোদিন যারা মাটি কামড়ে পড়ে ছিলো আওয়ামিতে, গণতন্ত্রবাদীতে ঢুকতে লজ্জা পাচ্ছিলো, তাদের অনেকে আর নীরস মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চায় না, তাদের লজ্জাও কেটে গেছে, তারা ঢোকে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটের ভেতরে। উদ্দিন মোহাম্মদের বুটই বাঙলাদেশ।