সালিম শীততাপনিয়ন্ত্রিত গাড়িতে, পাজেরোতে, হেলিকপ্টারে ছুটে চলছে দেশের দিকে দিকে। সে বিশেষ করে যাচ্ছে মসজিদগুলোতে। তার এক পূর্বসূরী বাঙালি। মুসলমানকে আবার মুসলমান করে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলো, খুন হয়ে যাওয়ায় ওই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে যেতে পারে নি, উদ্দিন মোহাম্মদ সে-ভার তুলে নিয়েছে; সে একেক। শুক্রবার হানা দিচ্ছে একেক মসজিদে। মসজিদগুলোতে লোকজন উপচে পড়ছে, দেশ জুড়ে নতুন নতুন মসজিদ উঠছে, হেলে-পড়া টিনের মসজিদগুলো হঠাৎ লাল ইটের। মসজিদ হয়ে উঠছে; শুধু গরিবের নয়, টয়োটা পাজেরো ভরে শিল্পপতিরা, আমলারা, চোরাকারবারিরা আসছে মসজিদে। উদ্দিন মোহাম্মদ আগে থেকেই ঠিক করে সে কোন শুক্রবার যাবে কোন সমজিদে, তার গোয়েন্দারা সাত দিন আগে থেকে ঘিরে ফেলে মসজিদটি, চারপাশের ছাদের ওপর উঠে পাহারা দিতে থাকে; কিন্তু শুক্রবারে সে। এমনভাবে গিয়ে উপস্থিত হয় যেনো সে হঠাৎ এসেছে। নামাজের পর সে বক্তৃতা দেয়, তার দামি সিল্কের পাঞ্জাবি আর টুপি ঝলঝল করতে থাকে টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে, বক্তৃতা দেয়ার সময় সে পুণ্যবানের মতো গলে পড়তে থাকে, সে আল্লা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। বক্তৃতার শুরুতেই সে বলে গতরাতে সে স্বপ্ন দেখেছে এক আওলিয়া দরবেশ তাকে বলেছেন তুমি এই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ো। তাই সে ছুটে এসেছে এই মসজিদে। কেঁদে কেঁদে সে জানায় এই মসজিদে নামাজ পড়ে তার বুক শান্তিতে ভরে গেছে, সে কিছু চায় না, ক্ষমতা চায় না, চায় মুসলমান আর ইসলামের ভালো। সে শুধু একটু খাঁটি মুসলমান হতে চায়। আরেক শুক্রবার সে যায় আরেক মসজিদে, সাতদিন আগে থেকে যেটিকে ঘিরে ফেলে তার গোয়েন্দারা। নামাজের পর সে বক্তৃতায় বলে যে দশ বছর আগে সে স্বপ্ন দেখেছে এই সমজিদটিতে সে নামাজ পড়ছে, এতোদিনে তার মনের বাসনা পূর্ণ হলো; দশ বছর ধরে সে মনে মনে এই মসজিদটিতে নামাজ পড়ছে, আজ এখানে নামাজ পড়তে পেরে তার বুক শান্তিতে ভরে গেছে। সে কিছু চায় না, ক্ষমতা চায় না, চায় মুসলমান আর ইসলামের ভালো। সে শুধু একটু খাঁটি মুসলমান হতে চায়। টেলিভিশন তার আকুল বক্তৃতা প্রচার করছে দিনের পর দিন।
উদ্দিন মোহাম্মদ সেনাবাহিনীতে না গিয়ে যদি বায়োস্কোপে ঢুকতো, যদি নিজের নাম রাখতো সালিমকুমার বা ডালিমকুমার, তাহলে আরো সফল হতে পারতো। নামাজকেও সে অভিনয়ে পরিণত করেছে, সে ক্যামেরার মুখোমুখিই নামাজ পড়তে পছন্দ করে, কোনো পির হয়তো তাকে শিখিয়েছে যে ক্যামেরার মুখোমুখি নামাজ পড়লে আশিগুণ সোয়াব কামেল হয়। মসজিদে নামাজের অভিনয়ের পর সে। হেলিকপ্টারে উড়ে যায় পিরের দরগায়। সময়টা হয়ে উঠেছে পিরদের দশক, দেশ ভণ্ডপিরে ছেয়ে যাচ্ছে, পাড়ায় পাড়ায় পিরদের দরগা উঠছে, খুনি আসামী ডাকাতরা পির হয়ে ব্যবসা খুলে বসছে, খুব লাভ হচ্ছে, কালোবাজারিতেও এতোটা লাভ হয় না। অনেক পির অবশ্য পিরব্যবসায়েই সন্তুষ্ট থাকছে না, কালোবাজারিও করছে, শিল্পপতিও হচ্ছে। উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম পিরদের বড়ো ভক্ত, সে উড়ে যাচ্ছে ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল পিরদের বাড়িতে। এক টাকা মূল্যে পিরদের লিখে দিচ্ছে শহরের বিঘে বিঘে জমি, পিররা তাকে দোয়া করছে, আর লাখে লাখে বাড়ছে পিরদের ভক্ত। প্রতিটি অফিসের বড়ো, মাঝারি, ছোটোকর্তারা পিরের মুরিদ, পিরের নাম না নিয়ে তারা কথা বলে না, এবং কথা বলতে বলতে পিরের নাম বলে। ঢাকা শহরের কোণে কোণে পিরের দরগা উঠছে; অফিসের কর্তাদের কেউ পুবকোণের মুরিদ, কেউ পশ্চিমকোণের মুরিদ, কেউ দক্ষিণ কোণের মুরিদ, কেউ উত্তর কোণের মুরিদ। উদ্দিন মোহাম্মদ যে-পিরের দরগায়ই একবার যাচ্ছে, সে-পিরেরই ব্যবসা জমে হয়ে উঠছে, সেনাপতিরা জিপ নিয়ে ভিড় করছে, আমলারা তার আস্তানা টয়োটায় ভরে ফেলছে, ব্যাংকের ব্যবস্থাপকেরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাশ্চার্যরা, দারোগা পুলিশ কেরানিরা তার দরগায় গিয়ে লুটিয়ে পড়ে পিরের পায়ের ধুলো চাটছে। সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করছে ফরিদপুরের পিরটা, উদ্দিন। মোহাম্মদ তার দরগায় প্রত্যেক শুক্রবারেই যায়, টেলিভিশনে তার আস্তানা দেখানো হয় প্রতি শুক্রবার। ওই পির ঠিক করে দিচ্ছে কে কোন পদ পাবে, পদোন্নতিগুলো স্থির হচ্ছে তারই আস্তানায়, তাই তার আস্তানার দিকে গাড়ি ছুটে চলছে দিনরাত। উদ্দিন মোহাম্মদ বুর্জোয়াগুলোর কোমর আর মেরুদণ্ড এমনভাবে ভেঙে দিচ্ছে যে তারা আর মাথা তুলতে পারছে না, পা দেখলেই তারা মাথা ঠেকাচ্ছে, মাথা তুলতে পারছে না; ওগুলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছিলো, কেউ কেউ প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলো, আমলা প্রকৌশলী চিকিৎসক আরো অনেক কিছু হয়েছিলো, বিলেত আমেরিকা গিয়েছিলো, স্যুটটাই পরেছিলো এবং এখনো পরছে, বড়ো বড়ো পদও দখল করেছিলো, এখনো। দখল করে আছে, আরো বড়ো পদ দখল করতে চায়, উদ্দিন মোহাম্মদ দেখিয়ে দিয়েছে ওগুলো ভেতরে ভেতরে নিরক্ষরই রয়ে গেছে, একটুও বুর্জোয়া হয় নি, অশিক্ষিত পিরের পায়ে ওগুলো চাষী আর মুদির থেকেও বেশি ভক্তিতে মাথা ঠেকাচ্ছে। পিরগুলোও বেশ ঝানু, ওদের বেশ শিক্ষা দিচ্ছে। উত্তরকোণের পিরটার মুরিদ হতে হলে তার থুতু খেতে হয় একগ্লাশ। পিরটা তার গদিতে বসে বাণী দিতে থাকে, যার সবটাই ছাইপাঁশ, তার পাশেই থাকে পানিভরা একটা বড়ো গামলা, ওই গামলায় সে অনবরত ফেলতে থাকে থুতু ও কফ, তার পানের পিকের লাল ও থুতুকফের শাদাটে রঙ মিলে গামলার পানি। ঘিনঘিনে থিকথিকে হয়ে ওঠে। যারা তার মুরিদ হতে চায় প্রথমে তাদের খেতে হয় ওই গামলার একগ্লাশ পানি। স্যুটটাইপরা মুরিদরা সারি বেঁধে ওই পানি খেয়ে মুরিদ হচ্ছে; তাদের চোখেমুখে কোনো ঘেন্নার ভাব নেই, ভক্তিতে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। পুবকোণের পিরটা তার পা দুটি ভিজিয়ে রাখে একটি গামলায়, মাঝেমাঝে উঠে গিয়ে খালি পায়ে সে ঘুরে আসে বাইরের নোংরা পায়খানা থেকে, গোয়ালে গিয়ে পা দিয়ে গোবর পরিস্কার করে আসে, আবার পা ভিজিয়ে রাখে গামলায়। তার মুরিদ হতে হলে প্রথমে খেতে হয় ওই গামলার একগ্লাশ পানি। স্যুটটাইপরা আমলারা। ব্যবস্থাপকেরা ওই পানি প্রাণভরে খাচ্ছে, তার মুরিদ হচ্ছে, পিরের পা দুটি তারা গামছা তোয়ালে দিয়ে মুছতে দিচ্ছে না, পিরের পা চেটে চেটে, তারা মুছে ফেলছে। রাশেদ। যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই দু-চারটি পিরের মুরিদ পাচ্ছে, পিরের বাড়ি আর মসজিদ ছাড়া যারা আর কোথাও যাচ্ছে না বছরখানেক ধরে।