একটি পুত্রও সে জন্ম দিয়েছে কয়েক মাসের মধ্যে, তার যন্ত্রটি শেষ পর্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে। পুত্রটির জন্মদিনের ছবি পত্রিকাগুলো পাঁচস্তম্ভ জুড়ে ছেপেছে, তাতে যুবরাজকে চারপাঁচ মাসের মতো দেখাচ্ছে, একদিনের কিছুতেই মনে হচ্ছে না। এতে অস্বাভাবিক কী আছে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক যদি জন্ম দেয়, তাহলে এমনই দেয়া উচিত; তবে লোকজন খুবই সন্দেহ করছে। জনগণের বিশ্বাস সে নপুংসক, আঁটকুড়ো, জন্ম দেয়ার শক্তি তার নেই, থাকলে অনেক আগেই জন্ম দিতো; এমন একটা জনশ্রুতিও রয়েছে যে তার স্ত্রীটির জরায়ু বিয়ের আগেই কেটে ফেলতে হয়েছিলো, যেহেতু তারা বিয়ের আগেই একটা দুর্ঘটনা বাধিয়েছিলো। সে অবশ্য দাবি করছে বাগদাদের এক পিরের দরগার গিলাফ জড়িয়ে কাজ করার ফলেই সে পিতা। হ’তে পেরেছে। গিলাফটি টেলিভিশনে দেখানো হয়েছে, গিলাফটি গলায় জড়িয়ে সে এক মহফিলে ভাষণও দিয়েছে; ভবিষ্যতে সে ওই গিলাফ জড়িয়ে আবার কাজ করবে কিনা, তা জানায় নি; বাগদাদের পিরের দরগা থেকে যে-পাণ্ডা গিলাফ এনে দিয়েছে, যে দেখতে দোজখের প্রহরীর মতো, তাকে সে উপদেষ্টা রেখেছে। কেউ খলনায়ক মনে। করছে না তাকে, নায়কই মনে করছে; কয়েক বছর আগে তার সানগ্লাসপরা পূর্বসূরীটি খুন হয়ে যাওয়ার পর জনগণ একটা নায়কের অভাবে খুব শূন্য শূন্য বোধ করাছিলো, মনে মজা পাচ্ছিলো না, সিনেমার হোদলগুলোও জনগণকে যথেষ্ট পরিতৃপ্ত করতে পারছিলো, এ-ভড় তাদের সে-অভাব মিটিয়েছে; যেখানেই যাচ্ছে, যাচ্ছে সে সবখানেই, তাকে দেখার জন্যে পোকার মতো ভিড় হচ্ছে মানুষের, সে পোকাঁদের জড়িয়ে ধরছে, পোকারা ধন্য হচ্ছে, সে জয় করে ফেলেছে পোকাঁদের মন। শুধু পোকাঁদের মন নয়, এমন চাঞ্চল্যকর সংবাদও ছড়িয়ে পড়ছে যে সে দেহও জয় করে ফেলেছে কয়েকটি নারীর, যাদের মধ্যে কুমারী, সধবা ও বিধবা সব স্বাদের নারীই রয়েছে; তবে সে যে সধবাদের শরীরই বিশেষ পছন্দ করে, তাও রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে। পুরুষগুলো বাঙলায় অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হতে হতে সেগুলোর আর কিছু বাকি নেই; নারীগুলোকেও নষ্ট করা দরকার, ভাঁড়টি সে-কাজ শুরু করেছে, নারীরাও আনন্দের। সাথেই নষ্ট হচ্ছে। তারা এতোদিন নষ্ট হওয়ার মতো সুযোগ পাচ্ছিলো না। একটা। কালোবাজারিকে সে এসেই ধরেছে, বা লোকটিকে ধরবে বলেই তাকে কালোবাজারি নাম দিয়েছে, তার দোষ তার একটা রূপসী স্ত্রী রয়েছে। রূপসী স্ত্রীটি স্বামীকে ছাড়াতে গিয়ে উদ্দিন মোহাম্মদ সালিমের সাথে দেখা করেছে, দেখা করতে করতে সালিমের। সাথে ঘুমোতে শুরু করেছে, ঘুমোতে ঘুমোতে স্বামীর কথা ভুলে গেছে; সে আর ছাড়া পাবে না। একটা আমলাকে সালিম তিনটি পদোন্নতি দিয়েছে যেহেতু তার একটা উপভোগ্য স্ত্রী রয়েছে; সালিম মাঝেমাঝে তার স্ত্রীকে নিয়ে শয্যাকক্ষে রাত্রি যাপন করছে, আমলাটি পরিচারিকাকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে বাইরের ঘরে। এক অনুষ্ঠানে লিলির দেখা হয়েছে উদ্দিন মোহাম্মদ সালিমের সাথে,-লিলি এখন টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান। উপস্থাপন করছে, যে-অনুষ্ঠানের আগে একবার আজান বাজে, মাঝে সংবাদের নামে ওই দিন সালিম কী কী মহৎ কাজ করেছে, তা দেখানো হয়, শেষ হওয়ার আগে আরেকবার আজান বাজে, তাই কেউ তার অনুষ্ঠান দেখে না, তবু লিলি ঘন ঘন শাড়ি বদলিয়ে হিতোপদেশ দেয় জনগণকে; উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম লিলিকে বলেছে লিলির অনুষ্ঠান। দেখে সে মুগ্ধ, লিলির অনুষ্ঠান সে মিস করে না, নামাজ পড়ার আগে তার অনুষ্ঠান। দেখে। লিলি সালিমকে আরো মুগ্ধ করার জন্যে ওই সন্ধ্যায়ই প্রস্তুত হয়ে পড়েছিলো, কিন্তু সালিম তাকে আর কোনো সংকেত দেয় নি বলে কয়েক রাত ধরে লিলি ঘুমোতে পারছে না, ঘুমোনোর জন্যে সে নিজেকে নিজেই তৃপ্ত করে চলছে। লিলি রাশেদকে বলেছে, উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম মারাত্মক সুপুরুষ, টেলিভিশনে ঠিক বোঝা যায় না, কাছে গেলে বোঝা যায়। লিলি আরো একটু কাছে যেতে চেয়েছিলো, যেতে পারে নি; তবে সালিম যে সুপুরুষ সে-কথা বলার সময় লিলি থরথর করে পুলক বোধ। করছিলো। নিজে জিপ চালিয়ে উদ্দিন মোহাম্মদ সালিম শহর ভরে ঘুরছে, জিপ থামিয়ে চৌরাস্তায় বুক মেলাচ্ছে জনগণের সাথে, পোকারা পাগল হয়ে তার হাত ছুঁচ্ছে, তার সামনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। জনগণকে সে খুলাফায়ে রাশেদিনের কালের স্বাদ দিচ্ছে। সপ্তাহে দু-তিন দিন; জিপ চালিয়ে সরাসরি গিয়ে ঢুকেছে কোনো রিকশাঅলার বাড়িতে, তার কিডনি-নষ্ট শিশুটিকে এনে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছে হাসপাতালে, টেলিভিশন সে-দৃশ্য দেখাচ্ছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে; হেলিকপ্টারে করে গ্রাম থেকে নিয়ে আসছে কোনো অন্ধ। বালিকাকে, হাসপাতালে ভর্তি করে দিচ্ছে, তার অপারেশন হচ্ছে, চোখ মেলে সে প্রথম দেখছে উদ্দিন মোহাম্মদ সালিমের মুখ, সালিম তাকে জড়িয়ে ধরছে, টেলিভিশন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে ওই দৃশ্য। জনগণ কাতর হয়ে উঠছে, তাদের চোখে জল টলমল করছে। সাইকেল চালিয়ে সে অফিসে যাচ্ছে, মুগ্ধ হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। পোকারা, টেলিভিশনে ওই সব অভিনব দৃশ্য দেখছে সন্ধ্যা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত। পত্রিকাগুলো তার সামনের পেছনের ডানের বায়ের ছবি ছাপছে, প্রথম পাতায়, পাঁচ। কলাম জুড়ে; বৃহস্পতি, শুক্র, শনিবারের গুজব পত্রিকাগুলোর প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে ছাপা হচ্ছে সে। বাঙলাদেশে নতুন নায়কের আবির্ভাব ঘটেছে।