এরা সবাই সঙ্গমের ফলে উৎপন্ন হয়েছে? এদের প্রত্যেককে আজ দুপুরে গুলিস্থানের চৌরাস্থায় আসার জন্যে সঙ্গম করতে হয়েছে একটি মেয়েমানুষ ও একটি পুরুষমানুষকে, পুরুষমানুষটি আর মেয়েমানুষটি চিৎ আর উপুড় না হলে তারা এখানে আজ আসতো না? সঙ্গম ছাড়া এদের কেউ উৎপন্ন হয় নি?-এমন প্রশ্ন ভয়ঙ্কর প্রত্যাদেশের মতো রাশেদের মনে জাগতেই সে শুধু ভয়ই পেলো না, তার শরীর এবং ভেতরে কী একটা যেনো আছে, যেটাকে মনই বলতে চায় সে, দুটিই আঠালো আদিম তরল পদার্থের প্লবনে চটচট করতে লাগলো। কোটি কোটি সঙ্গমের দৃশ্য তার চোখের সামনে; চটের ওপর, মেঝের ওপর, খাটের ওপর, গলির অন্ধকারে, একতলায়, বস্তির ভেতরে, কুঁড়েঘরে, দোতলায়, দালানে, তেতলায়, শনের ঘরে, ঘেঁড়া পলিথিনের নিচে, ইস্টিশনে, ইটের পাঁজার ভেতরে শুধু নিরন্তর নগ্ন নোংরা সঙ্গম। মেয়েমানুষ পা ফাঁক করে দিয়েছে, ফাঁক করতে চাইছে না, তবু ফাঁক করছে, পুরুষমানুষ প্রলম্বিত একটি প্রত্যঙ্গ ভেতরে ঢুকোতে চেষ্টা করছে, ঢুকোতে পারছে না, পিছলে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে, ঢুকোচ্ছে বের করে আনছে, পারছে না, পারছে, শিথিল হয়ে পড়ে যাচ্ছে। খুব ঘিনঘিনে লাগছে রাশেদের, বারবার তরল পদার্থ ছরকে পড়ে পাঁচতলা দালান ভাঙা বাস রিকশা। দোকান প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অভিনেত্রীদের বক্ষদেশ প্লাবিত করে ফেলছে, সব কিছু চটচট করছে। কী সুখ পেয়েছিলো তারা? গড়িয়ে গড়িয়ে, রাশেদের সামনে, ভিক্ষে করছে। পাঁচটি অন্ধ, রাশেদ ভেবেছিলো তাদের ছেঁড়া চাদরটার ওপর একটা টাকা ছুঁড়ে দেবে, এখন আর দিতে ইচ্ছে করছে না; যদি সঙ্গমের ফলে উৎপন্ন না হতো ওরা, তাহলে। টাকাটা দিতো, পকেটে যা আছে সব দিয়ে দিতো। রাশেদ একটি মানুষ চায় যে সঙ্গমের ফলে উৎপন্ন হয় নি। এক মওলানা সাব, হয়তো নামের শুরুতে তার হজরত মওলানা শাহ সুফি রয়েছে, আতর কিনছেন, চোখে সুরমা পরেছেন, কালামকেতাব ছাড়া কিছু। জানেন না মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে উৎপন্ন হলেই তাঁকে বেশি মানাতো, তিনিও ওই সঙ্গমের ফলেই উৎপন্ন, এবং তিনিও সঙ্গমযোগে উৎপাদন করেন? এমন এক পুণ্যবান ব্যক্তিকে উৎপাদন করার জন্যে ক-মিনিট সময় নিয়েছিলেন পিতা? দেড় মিনিটের বেশি নেন নি; তার মাতাকে ছালার ওপর ফেলে কয়েকবার জাতা দিয়েই হয়তো পয়দা। করেছিলেন, একটি পুণ্যবানকে, যার ফলে এখন গুলিস্থানের চৌরাস্তায় সুরমাপরে তিনি আতর কিনছেন। এই আতর গর্দানে মেখে মাগরেবের পর তিনি হয়তো একবার। সোহবত করবেন। তিনটা বাস দুটি ট্রাক খোটা চারেক ঠেলাগাড়ি ঢুকে গেছে একটা আরেকটার ভেতরে, কুকুরকুকুরির মতো, খুলতে সময় লাগবে; নীল আর লাল রঙের ট্রাক দুটির ড্রাইভার দুটির মুখের ওপর তাদের জনকজননীর ধস্তাধস্তির ছাপটা স্পষ্ট লেগে আছে। রাশেদের ঘেন্না লাগছে, সে জানে ঘেন্না লাগলে চলবে না; কেউ ঘেন্না। করে না এখানে, ঘেন্না করা পাপ, সবাই এখানে ভালোবাসে, রাশেদকেও ভালোবাসতে হবে। কিন্তু মানুষকে যে আর মানুষ মনে হচ্ছে না রাশেদের, মনে হচ্ছে অশ্লীল সঙ্গম, তার শরীর ঘিনঘিন করতে থাকে; দৌড়োতে ইচ্ছে হচ্ছে তার, সে এমন কোথাও যেতে চায় যেখানে সঙ্গম নেই, কিন্তু সে দৌড়োতে পারছে না, তাকে হাঁটতে হচ্ছে। সে উত্তর। দিকে হাঁটতে থাকে, আর দিকদিগন্ত থেকে উজ্জ্বিত লালা এসে পড়তে থাকে তার শরীরে।
আমি কি মানুষ ভালোবাসি না তাহলে, ঘৃণা করি মানুষ, রাশেদ জিজ্ঞেস করে। নিজেকে, অন্যরা কী করে এতো ভালোবাসে মানুষ, যেমন ভালোবাসে রহমত আলি, যে মানুষকে ভালোবাসার ধর্মে দীক্ষা নিয়ে দল থেকে দলে যাচ্ছে, দল বদলাচ্ছে, ওপর থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছে, এবং নিরন্তর মানুষ ভালোবেসে চলছে? যখন সে আওয়ামিতে ছিলো, তখন মানুষ ভালোবাসতো সে প্রচণ্ডভাবে, মানুষ বলতে তখন সে বুঝতে বাঙালি, আর কিছু বুঝেতো না; পঁচাত্তরের পর সে দেখে আওয়ামিতে থেকে আর মানুষ ভালোবাসা সম্ভব হচ্ছে না, মানুষ ভালোবাসার জন্যে দল বদল দরকার, তখন সে দেখে জাতীয়তাবাদীতে থেকেই শুধু অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসা সম্ভব মানুষ, যে-মানুষ ক্ষমতার উৎস, মানুষ বলতে তখন সে বোঝে শুধু বাঙলাদেশি, বাঙালি আর তার কাছে মানুষ নয়, বাঙালি বলে কোনো মানুষ নেই; এখন অবশ্য সে কিছুদিনের জন্যে বিশ্রাম নিচ্ছে মানুষ ভালোবাসা থেকে, বাধ্য হয়েই সে বিশ্রাম নিচ্ছে, ক্লান্তিতে নয়; কিন্তু ভালোবাসা। তাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না, বিশ্রাম নিতে পারছে না সে, মানুষকে ভালোবাসবে বলে। এরইমাঝে সে সেনাপতিদের সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন করেছে। প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসা কখনো বিফলে যায় না, শতধারায় তা ফিরে আসে নিজের উৎসমুখে; রহমত আলির। বাড়িতে তা বারবার ফিরে এসেছে সহস্রধারায়, ওর বনানীর বাড়িটা দেখলে তা কিছুটা আঁচ করা যায়। মাত্র একটি রহমত আলিই যে মানুষ ভালোবাসছে, তা নয়; কয়েক। হাজার রহমত আলি আছে দেশে, যারা মানুষ ভালোবাসছে বলে মানুষ আজো আসতে পারছে গুলিস্থানের চৌরাস্তায়, ঢুকে যেতে পারছে একে অন্যের ভেতরে। কিন্তু রাশেদ মানুষ ভালোবাসতে পারছে না, রহমত আলির মতো জড়িয়ে ধরতে পারছে না মানুষ। রহমত আলি যদি আজ এখানে আসতো, তাহলে সে নিশ্চয়ই জড়িয়ে ধরতে ওই ভিখিরিগুলোকে, অন্ধ ভিখিরি ছেলেটাকে হয়তো কাঁধে তুলে আইস্ক্রিমই কিনে দিতো; কিন্তু রহমত আলি এখানে আসার সময় পায় না, আগে ভালোবাসার বক্তৃতা দিতে আসতো। কী করে আসবে, এখন তাদের প্রেম ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। জলপাইরঙপরা লোকগুলো, যাদের বুকে জেগেছে তীব্র ভালোবাসা, তারাও মানুষ। ভালোবাসতে চায়, এবং তারা মানুষের জন্যে একটি নতুন নাম খুঁজছে, বাঙালি বা বাঙলাদেশির মতো নষ্ট নামে তারা মানুষকে ভালোবাসতে চায় না, একটি অনাঘ্রাত নাম তারা শিগগিরই বের করে ফেলবে। রাশেদের নিজের প্রতিই মায়া হয়, সে যদি জড়িয়ে ধরতে পারতো ওই ট্রাকড্রাইভারটিকে, গাল ঘষতে পারতো ভিখিরিটার গালে, কোলে তুলে নিতে পারতো রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা অন্ধ শিশুটিকে, সেও সুখী হতে পারতো রহমত আলির মতো; তা সে পারছে না, নিজেকে তার ঘেন্না করা উচিত বলে মনে। হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে রাশেদ পবিত্ৰগৃহটির কাছাকাছি এসে যায়, তার শরীর কয়েকবার শিউরে ওঠে। ছেলেবেলা থেকেই পবিত্ৰগৃহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার শরীর শিরশির ছমছম করে; দূর থেকে পবিত্ৰগৃত দেখলেই সে অনেকটা পথ ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু পেরে ওঠে না। পবিত্ৰগৃহটির দিকে তাকালে রাশেদের দু-রকম অনুভূতি হয়, মাথা তুলে ওপরের দিকে তাকালে তার ভয় লাগে, আর মাথা নিচু করে। সামনের দিকে তাকালে খুব আনন্দ হয়। রাশেদ দেখতে পায় চারদিকে হাজার হাজার। মানুষ আনন্দে রয়েছে, তারাও মাথা তুলে ওপরের দিকে তাকাচ্ছে না, হয়তো ভয় পাবে বলে; তাই তারা সামনের দিকে তাকিয়ে খুব আনন্দে রয়েছে।