গন্তব্যের অভিমুখে প্রচণ্ডভাবে ছুটে আসছিলো তারা তিনজন; তাদের মোটর সাইকেলের চেহারা আর শব্দ জানিয়ে দিচ্ছিলো আর কারো গন্তব্য নেই, আছে শুধু। তাদের। বিপরীত দিক থেকে তারা আসছিলো, হয়তো গুলিস্থানে গন্তব্য সম্পন্ন করেই আসছিলো; তারা পাড়ার সম্রাট রাস্তার রাজা, যে-দিক ইচ্ছে সে-দিক দিয়ে ছুটতে পারে, ছুটছিলোও তাই; ছুটতে ছুটতে এসে রাশেদের রিকশাটাকে প্রায় ধাক্কাই দিচ্ছিলো। ধাক্কা অবশ্য লাগে নি, কিন্তু লাগার যে-উপক্রম হয়েছিলো তাতেই রিকশাঅলার মাজাখানি চৌচির হয়ে পড়ে যাচ্ছিলো; তবে তার মাজা নড়বড়ে হতে পারে, বুকটি নড়বড়ে নয়, সেটা সাহসের প্রকাণ্ড খনি। মোটর সাইকেলের সম্রাটরা যখন কিছুটা দূরে চলে গেছে, রিকশাঅলা পেছনের দিকে তাকিয়ে বীরের মতো বলে উঠলো, মস্তানি দ্যাহানের জায়গা পায় না। প্রকৃতি এক জায়গার ঘাটতি আরেক জায়গায় এভাবেই মিটিয়ে দেয়, মাজায় জোর না দিলে বুকে জোর দেয়। দেখা গেলো কথাটি বলার পর রিকশাঅলার মাজাটিও বেশ শক্ত হয়ে উঠেছে, প্যাডেলও মারছে স্থিরভাবে; বুকে সাহস জাগলে অন্যান্য জায়গায়ও শক্তি দেখা দেয়। ভালোই লাগছিলো রাশেদের। সাধারণ। মানুষের ভেতরে সাহস সুপ্ত হয়ে আছে, ওই সাহস মাঝেমাঝে প্রকাশ পেয়ে তাদের সুন্দর করে তোলে, এমন একটা বিশ্বাস রয়েছে রাশেদের; রিকশাঅলাকে ওই বিশ্বাসের প্রতিমূর্তিরূপে চোখের সামনে দেখে যখন হর্ষ বোধ করছিলো রাশেদ, তখনি মোটর। সাইকেলটি গোঁ গোঁ ক’রে রিকশাটির সামনে এসে দাঁড়ায়। তাহলে তারা রিকশাঅলার কথাটা শুনতে পেয়েছে। তারা বেয়াদবি সহ্য করে না। মোটর সাইকেল থেকে দুজন নামলো, নেমেই একজন রিকশাঅলার গালে একটা চড় মারলো। রিকশাঅলা ছিটকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়লো, অনেকক্ষণ নড়তে পারলো না, একবার উঠতে গিয়ে পড়ে গেলো। তখন আরেকজন তাকে বাঁ হাত দিয়ে টেনে তুলে আরেকটি চড় মারলো, রিকশাঅলা ঘুরতে ঘুরতে আবার কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়লো। এবার আর ওঠার। চেষ্টা করলো না। রাশেদ রিকশায় বসে বসে দেখছে। একটা ভিড়ও জমে উঠেছে, রাক্ষসদের পাশে ওই ভিড়কে পোকার ভিড় মনে হচ্ছে। অত্যন্ত নিরীহ নিষ্পাপ তাদের
চোখমুখ, তাতে কোনো অভিযোগ নেই, তবে চোখেমুখে রয়েছে পিষ্ট হওয়ার ভয়। রিকশাঅলা গোঙাচ্ছে, কেউ তাকে ধরে তুলছে না; তবে আবার টেনে তুললো প্রথম মাস্তানটি, তুলেই আরেকটি চড় মারলো। রিকশাঅলা নিচে চিৎ হয়ে পড়ে রইলো। ভিড়টা আরো বেড়েছে, চারদিকে পোকাগুলো গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রাশেদও রিকশায় বসে আছে পোকার মতো; গোলের ভেতরে তিনটি সিংহ, তাদের পায়ের নিচে একটা আধমরা মেষ। সিংহরা এখন চলে যাবে, তাদের শিকার সম্পন্ন হয়ে গেছে। কেউ কিছু বলছে না, রাশেদও না। ভিড়ের ভেতর থেকে একটি লোক রাশেদকে সালাম। দিলো, সালামটি আশ্চর্যভাবে কাজ করলো রাশেদের ভেতরে; সে নিজেও পোকা হয়ে। বসে ছিলো, সিংহদের দেখছিলো, সালামটি তাকে পোকা থেকে মানুষে পরিণত করলো। লোকটি চিৎকার করে রাশেদের পরিচয়টা বারবার জানাতে লাগলো, আর। রাশেদও পোকা থেকে মানুষ আর মানুষ থেকে অন্য কিছুতে রূপান্তরিত হতে লাগলো। ভিড়টা আরো বড়ো হয়ে উঠেছে, আরো জমাট বেঁধেছে, এবং রাশেদের পরিচয়টা জেনে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সিংহরা এবার চলে যাবে সিংহরা, তারা মোটর সাইকেলে উঠতে যাচ্ছে। রাশেদ তাদের ডাক দিলো, শুনুন। শুধু তারা তিনজনই নয়, পুরো ভিড়টাই চমকে উঠলো রাশেদের গলা শুনে, যেনো একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেছে। যে-দু মস্তান রিকশাঅলাকে চড় মেরেছে, ডাক শুনে তারা থমকে দাঁড়ালো। রাশেদ বললো, আপনারা কি বুঝতে পারছেন যে আপনারা অপরাধ করেছেন? ভিড়ের কয়েকজন চিৎকার করে উঠলো, হ্যাঁ, এরা অপরাধ করেছে। পুরো ভিড়টাই এবার চিৎকার করে উঠলো, হ্যাঁ, এরা অপরাধ করেছে। মাস্তান দুটি কিছু বলছে না, রাশেদ আবার বললো, আপনারা কি বুঝতে পারছেন আপনারা অপরাধ করেছেন? তারা চারিদিকে তাকিয়ে। স্বীকার করলো যে তারা অপরাধ করেছে। রাশেদ বললো, এর জন্যে আপনাদের শাস্তি প্রাপ্য। ভিড় থেকে চিৎকার উঠলো, এদের শাস্তি দেন। রাশেদ বললো, আপনাদের শাস্তি হচ্ছে রিকশাঅলা আপনাদের গালে দুটি করে চড় মারবে। শুনে কেঁপে উঠলো সবাই, সিংহরাও কেঁপে উঠলো। ভিড়ের চোখগুলো চিকচিক করছে, রিকশাঅলা মাস্তানদের চড় মারছে, এটা তারা দেখতে চায়; কিন্তু দেখার সাহস নেই ওই চোখে, রিকশাঅলা সত্যিই যদি চড় মারে তাহলে তারা চোখ বুজে ফেলবে। এমন অলৌকিক দৃশ্য তারা। সহ্য করতে পারবে না। রাশেদ বললো, তবে এ-শাস্তি আপনাদের দিচ্ছি না। আপনারা রিকশাঅলাকে তুলে তার কাছে মাফ চান। শাস্তিটা জানতে পেরে ভিড়ের চোখমুখগুলো স্বস্তি পেলো। সিংহ দুটি এবার টেনে তুলোে রিকশাঅলাকে, দু-হাত ধরে মাফ চাইলো তার কাছে। সিংহরা পোকা হয়ে গেছে, রিকশাঅলার হাতের নিচে দুটি পোকার মতো ঝুলছে তারা। তারপর পোকার মতো তারা বেরিয়ে গেলো ভিড়ের ভেতর থেকে, মোটর সাইকেলটিকেও একটা পোকার মতো দেখাতে লাগলো।
রাশেদকে তো গুলিস্থানে যেতে হবে, একটি গন্তব্য সে পেয়েছিলো, সে-গন্তব্য যতোই নিরর্থক হোক তবুও সেটাকেও কি সে হারিয়ে ফেলবে? রিকশাঅলা এবার বেশ চালাচ্ছে, তার মাজা কাঁপছে না, হেলছে না, রিকশাটাকেও বেশ সুখী মনে হচ্ছে। রাশেদ গুলিস্থানের দক্ষিণে একটি চৌরাস্তায় নামলো। নামতেই রিকশাঅলা তার পা জড়িয়ে ধরলো। রিকশাঅলা যদি জড়িয়ে ধরে তাকে চুমো খেতো, তাহলেও এতো অস্বস্তি লাগতো না, সেও না হয় একটা চুমো খেতো রিকশাঅলার গালে; তাতে অন্যরা অস্বস্তি বোধ করতে হয়তো, কিন্তু রাশেদের এতোটা অস্বস্তি লাগতো না। রিকশাঅলা এখনো ঘোরের মধ্যে রয়েছে, মাস্তানরা যে তার কাছে মাফ চাইতে পারে এটা সে বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করছে না; তাই রাশেদের পায়ের ধুলো তার দরকার। সে কিছুতেই ভাড়া নেবে না। তার জীবন ভরে উঠেছে, জীবনে সে এতোটা মর্যাদা কখনো পায় নি, সে এখন সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু রাশেদ এ-কোথায় এসে পড়েছে? রিকশাঅলাকে বিদায় দিয়ে সে একটা লম্বা দ্বীপের ওপর দাঁড়ালো। কেউ তাকে ভয় দেখাচ্ছে না, কেউ তার দিকে ছুরি লাঠি বন্দুক নিয়ে ছুটে আসছে না, কিন্তু সে ভয়ে আঁৎকে উঠলো, বন্য পশুর পাল নয়, মানুষ রাশেদকে ভীত। করে তুলোে। রাশেদ না মানুষ ভালোবাসতে? উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম থেকে ময়লার স্রোতের মতো গড়িয়ে আসছে মানুষ, হামাগুড়ি দিয়ে আসছে মানুষ, ভেসে আসছে। মানুষ, উবু হয়ে আসছে মানুষ, বাঁকা হয়ে আসছে মানুষ, কাৎ হয়ে আসছে মানুষ, রিকশায় চেপে আসছে মানুষ, বাসে গুঁজে আসছে মানুষ, ট্রাকের নিচে মাথা গলিয়ে আসছে মানুষ, ছাইমাখা মাছের মতো কাতরাতে কাতরাতে আসছে মানুষ, পশুর মতো আসছে মানুষ, শুধু মানুষের মতো আসছে না মানুষ। রাশেদ কি আগে মানুষ দেখে নি, এই প্রথম দেখলো মানুষ, এবং মানুষ দেখে ভয় পেয়ে গেলো? আসছে রঙচটা মানুষ, ফাটলধরা মানুষ, শ্যাওলাপড়া মানুষ, মচকানো মানুষ, পোকারা মানুষ, ভাঙা মানুষ, প’চে-যাওয়া মানুষ, ঝুললাগা মানুষ, চল্টাওঠা মানুষ, তালিমারা মানুষ, রোঁয়াওঠা মানুষ, ছাতাপড়া, জংধরা মানুষ, ঘুনেখাওয়া মানুষ, উইলাগা মানুষ। রাশেদের কি ঘেন্না ধরে যাচ্ছে মানুষে? ঘেন্না ধরলে চলবে না, এটা ঘেন্নার দেশ নয়, ভালোবাসার দেশ, রাশেদকে ভালোবাসতে হবে। এখানে সবাই মানবপ্রেমিক, রাশেদকেও মানবপ্রেমিক হতে হবে। এজন্যেই রাজনীতিকদের রাশেদ এতো শ্রদ্ধা করে, যাদের একবার দেখেই রাশেদের ভয় আর গোপনে ঘেন্না লাগছে, তাদের জন্যে ভালোবাসায় ঘুম হয় না দরদী। রাজনীতিকদের, তবে এখন একটু ঘুমোনোর সুযোগ পেয়েছে, মুক্তি পেয়েছে। ভালোবাসার দায় থেকেও; ওই ভার কাঁধে তুলে নিয়েছে ভাঁড়টি, সে এখন প্রচণ্ডভাবে মানুষ ভালোবেসে চলছে, ভালোবাসার তোড়ে ঘুমোতেও পারছে না। কোন কারখানায় এরা উৎপন্ন হয়? সব কুটিরশিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে বা ধ্বংসের মুখে বলে অনেক বছর ধরে শুনে আসছে রাশেদ, শুধু একটি কুটিরশিল্পই চলছে দিনরাত; রাশেদ তাঁতের। খটখট শব্দ শুনতে শুরু করে, খটখট করে তাঁত চলছে, চলছে তাঁত, খটখট খটাখট, মেয়েমানুষের ওপর পুরুষমানুষ, খটাখট খটখট, পুরুষমানুষের নিচে মেয়েমানুষ, খটাখট খটাখট, মেয়েমানুষের ওপর পুরুষমানুষ, উৎপন্ন হচ্ছে বাঙালি, বাঙলাদেশি, বাঙালি। মুসলমান, মুসলমান বাঙালি, হিন্দু, বাঙালি হিন্দু, হিন্দু বাঙালি, বাঙলাদেশি হিন্দু। ভালোবাসতে হবে মানুষকে, ভালোবাসার ওপরে কিছু নেই।