প্রস্রাব করে নেয়া দরকার একবার, যে-কোনো উত্তেজনার পর একবার প্রস্রাব করলে শান্তি পাওয়া যায়, উত্তেজনা তরল হয়ে বেরিয়ে যায়। দেয়ালের পাশে কোলাব্যাঙের মতো বসে একটি লোক বর্ষণ করার চেষ্টা করছে, ভালোভাবে পেরে উঠছে না, ট্রাউজার পরে বসে এ-কাজটি করার থেকে ট্রাউজার ভিজিয়ে ফেলা অনেক সুখকর। লোকটি সব কিছু করে চলছে স্বাভাবিকভাবে, যেনো নিজের বাড়িতেই বাশঝাড়ের পাশে বসে সে কাজটি করছে, দূরে কচুরিপানার ওপর দিয়ে একটা ডাহুকের দৌড়ও দেখছে, কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারছে না ট্রাউজারের জন্যে। দুটি মেয়ে মুখ চেপে চলে গেলো, লোকটি একবার মুখ ফিরিয়ে দেখলো, কোনো অস্বস্তি বোধ করলো না, যেমন ডাহুক দেখে সে অস্বস্তি বোধ করে না। লোকটি হয়তো ট্রাউজারের নিচে কোচা দিয়ে লুঙ্গিও। পরেছে, পেছন দিকটা বেশ ফুলে আছে। লোকটি কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু লোকটি এখানেই শেষ করতে রাজি নয়, আরো আনুষ্ঠানিকতা আছে তার, রাস্তাটা তার নিজেরই বাড়ির বাঁশঝাড়,-পকেট থেকে সে একটা কী যেনো বের করলো, মাটির ঢিল হয়তো, রাশেদের মনে পড়লো মওলানা সাব একবার তাদের কুলুপ নেয়া শিখিয়েছিলেন, কীভাবে মাটির ঢিল ছিদ্রের মুখে চেপে ধরে চল্লিশ কদম হাঁটতে হয় দেখিয়ে দিয়েছিলেন, আর তারা মাওলানা সাবের শোলমাছটি দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। লোকটি তার শোলমাছের মুখে আধার চেপে ধরে উত্তরে-দক্ষিণে দক্ষিণে-উত্তরে বাঁশঝাড়ের ভেতরে হাঁটতে লাগলো। এ-দৃশ্য মওলানা সাব দেখতে পেলে খুব শান্তি পেতেন। মওলানা সাব তাকে দেখতে পাচ্ছেন না, রিকশায় বসে একটি মেয়ে তার শোলমাছ দেখে আঁৎকে উঠলো, রাস্তার পশ্চিম পাশি মিলিটারিরা প্রশংসার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেনো ওরা এখনি ট্রাক থেকে নেমে নিজেদের শোলমাছ ধরে মার্চ করতে শুরু করবে। রাশেদ শালমাছকে আধার। খাওয়াতে পারবে না, কোলাব্যাঙের মতো বসতে পারবে না; সে হাঁটতে থাকে, তাকে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাবটিতেই যেতে হবে। ক্লাবে ঢুকেই সে প্রথমে টয়লেটে গেলো, টয়লেটটা ধর্মসম্মত, দাঁড়িয়ে প্রস্রাবের জন্যে যেমন দুটি ইউরিনাল আছে তেমনি ধার্মিকদের জন্যেও ব্যবস্থা রয়েছে। কুলুপের জন্যে একপ মাটিও আছে একপাশে। টয়লেটে ঢুকেই রাশেদ দেখলো জিম্বু খুব বিপদে রয়েছে। সে জানতো না জিম্বু টয়লেটে ঢুকেছে, তাহলে রাশেদ দু-পা চেপে বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকতো। জিল্প, প্রাথমিক। বিদ্যালয়টির উপাশ্চার্য, উপাচার্য নয় উপাশ্চার্য শব্দই তাকে মানায়, অত্যাশ্চার্য আরো। মানানসই, চারফুট আটইঞ্চি, প্রস্রাব করতে এসে খুব বিপদে পড়ে গেছে। তার নলটি কিছুতেই নাগাল পাচ্ছে না ইউরিনালের; সে বোতাম খুলে ফেলেছে, নলও বের করে ফেলেছে, ভেতর থেকে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড চাপ আসছে, কিন্তু সে কিছুতেই ইউরিনালের। নাগাল পাচ্ছে না, তার নল ইউরিনালের নিচে পড়ে যাচ্ছে। সে কি তাহলে এতোদিন ইউরিনালের নিচেই কাজটি করে এসেছে, সেজন্যেই কি টয়লেটের প্রান্ত ঘিরে মেঘের রুপোলি পাড়ের মতো সব সময়ই চিকচিক করে একটা সরু ধারা বয়? পাশের ইউরিনালেই দাঁড়িয়েছে রাশেদ, তাই এখন সে ইউরিনালের নিচ দিয়েও নির্ঝর ছোটাতে পারছে না, পায়ের আঙলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েও নলটিকে ইউরিনালের নাগালে আনতে পারছে না। একবার নল বের হয়ে গেলে কী জঘন্য ঘটনা ঘটে তলপেটে রাশেদ তা। জানে, জিন্ধু এখন সেই বিপদে রয়েছে, আল্লা যেনো আর কাউকে কখনো এমন বিপদে না ফেলে; একবার শিৎশিৎ করে একপশলা বেরিয়ে জিম্বুর হাত ভিজে গেলো, জিন্ধু। দু-হাতে নল চেপে ধরে ডেকে উঠলো, ইব্রাহিম, ইব্রাহিম। ইব্রাহিম ছুটে আসতেই সে চিৎকার করে উঠলো, এইখানকার ইট দুইটা গ্যালো কই? আগে দুটি ইট ছিলো ইউরিনালের নিচে, তার ওপর দাঁড়িয়ে জিম্বু নিশ্চিন্তে কাজটি করতো, আজ টয়লেট ধোয়ার সময় ঝাড়দার সে-দুটি সরিয়ে ফেলেছে, আর তাতে প্রকাশ পেয়ে গেছে জিল্লুর। মহিমা। একজোড়া ইট ছাড়া যে-জিপ্ন ইউরিনালের নাগাল পায় না, সে আকাশ ছুঁয়েছে।
ক্লাবে ইউরিনালের থেকে আকর্ষণীয় উস্কৃষ্ট সম্পদ আর কী আছে? সেটা ব্যবহার করা হয়ে গেলে রাশেদ বেরিয়ে পড়ে। বেরোতেই গেইটের পাশে বিড়ি টানছিলো। যে-রিকশাঅলাটি, সে বুঝে ফেলে রাশেদের কোনো গন্তব্য বা ভেতরে কোনো চাপ নেই; রাশেদ তার সাথে যে-কোনো জাহান্নামে যেতে পারে। সে ডাকতেই রাশেদ তার রিকশায় উঠে বসে। সে কোথায় যাবে? যে-কোনো নামই সে বলতে পারে, তবে কোনো নামই বলতে ইচ্ছে করছে না, হঠাৎ মুখ থেকে গুলিস্থান শব্দটি বেরিয়ে পড়ে। ওইখানে। রাশেদ অনেক বছর যায় নি, কলেজে পড়ার সময় বারবার গেছে, তাই এখনো রিকশায় উঠলেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চায় গুলিস্থান, এখনো সেভাবেই বেরিয়ে গেছে শব্দটি। গুলিস্থানে তার কোনো কাজ নেই, কোথাও তার কোনো কাজ নেই, কাজহীনতাই তার মুখে গুলিস্থান রূপে ধ্বনিত হয়ে ওঠে। রাশেদ ভেবেছিলো রিকশাটি উড়তে শুরু করবে, কিন্তু খোঁড়াতে শুরু করে; মনে হয় রিকশাঅলা তার থেকেও গন্তব্যহীন, কোথাও যাওয়ার কোনো সাধ তার ভেতরে নেই, কোনোদিন ছিলো না। তবু ভালো সে কোনো দোয়া পড়ে রাশেদকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে না। বাঁ পা দিয়ে প্যাডেল করার সময় তার মাজা একবার বায়ে হেলে পড়ছে, হেলতে বেশ সময় নিচ্ছে, আবার ডান পা দিয়ে প্যাডেল করার সময় তার মাজা ডান দিকে হেলে পড়ছে, হেলতে বেশ সময় নিচ্ছে; তার মাজাটি এখনি খসে পড়ে রিকশার শেকলের সাথে জড়িয়ে যাবে মনে হচ্ছে। প্যাডেল করার সময় সে তার লিঙ্গটি আস্তে আস্তে একবার বাঁ দিকে আরেকবার ডান দিকে ঘষছে আসনটির সাথে? তাই কি সে মাঝেমাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে? লোকটি কি বিয়ে করেছে, করে থাকলে সে স্ত্রীর সঙ্গে কী করে, এমন প্রশ্ন। জাগলো রাশেদের মনে, যেমন যে-কোনো নির্বোধকেই দেখলেই রাশেদের মনে প্রশ্নটি লাফিয়ে ওঠে। রাশেদ দেখেছে নির্বোধগুলো সেই কাজে বেশ অগ্রসর; একটা নির্বোধকে সে মাঝেমাঝে কিছু টাইপ করতে দেয়, ওটা একই ভুল করে বছরের পর বছর; একবার রাশেদ রেগে জিজ্ঞেস করেছিলো সে বিয়ে করেছে কিনা? নির্বোধটি জানায় সে পাঁচটি সন্তান এরই মাঝে স্ত্রীকে দিয়ে প্রসব করিয়েছে, রাশেদ চিৎকার করে উঠতে চেয়েছিলো সে জন্ম দেয়ার রাস্তাটি কী করে খুঁজে পায়? রাশেদ রিকশাঅলার কাছে জানতে চায় সে কটি বিয়ে করেছে। রিকশাঅলার কান দুটি খুব সজাগ, একবারেই রাশেদের কথা শুনে ফেলে; খ্যাখ্যা করে হাসতে থাকে, কিছুটা লজ্জাও পায়, এবং জানায় যে তিনখান বিয়ে করেছে এ-পর্যন্ত। রাশেদ এমনই অনুমান করেছিলো, ওর মাজার অবস্থা দেখেই বোঝা যায় বউগুলো ওর মাজাটাকে শেষ করে ফেলেছে। একটাকে বশে রাখার মতোও। মাজার জোর ওর নেই; রিকশাটি যদি ওর বউ হতো, তাহলে অনেক আগেই লাথি মেরে ওকে দশ হাত দূরে ছুঁড়ে ফেলে ছালার ওপর কাত হয়ে শুয়ে ওর বাপদাদার। আটাশ পুরুষ উদ্ধার করতো, আর এখনো ওকে চড়তে দিতো না। কিন্তু তিনখানা বউ দিয়ে ও কী করে? যা ইচ্ছে করুক, এখন মাজাটিকে একটু স্থির করুক, রিকশায় একটু গতি আনুক, রাশেদের মনে একটা গন্তব্যের বোধ জাগিয়ে দিক। রিকশাঅলা তুমি স্থির হও গন্তব্যে, আমাকেও গন্তব্য দাও, এমন প্রার্থনা করতে ইচ্ছে হলো তার। রাশেদের পাশ দিয়ে যারা চলে যাচ্ছে তাদের খুব হিংসা করছে রাশেদ, তাদের নিশ্চয়ই অনিবার্য গন্তব্য রয়েছে, তাই ছুটছে পাগলের মতো, না ছুটলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, হয়তো আর। গন্তব্য খুঁজে পাবে না। কিন্তু রাশেদ ও তার রিকশাঅলার কোনো গন্তব্য নেই।