সাঁতার শিখেছে রাশেদ, এবং প্রথম সাঁতার শেখার পর মনে হয় যেন সব সময়ই পানিতে রয়েছি, বাতাসকে মনে হয় পানি, বিছানাকে মনে হয় পানি, শরীর সব সময়। সাঁতার কাটতে থাকে; রাশেদের ভেতরে রক্তের কণাগুলো সারাক্ষণ সাঁতার কাটছে, সব কিছুকেই জল মনে হচ্ছে আর লাফিয়ে পড়ছে, নাকে পানি ঢুকছে, চোখ লাল টকটক করছে, সে সাঁতার কেটে চলছে। সাঁতার শেখার পর মামাবাড়ি গেছে এই প্রথম, গেছে। নৌকোয় চেপে, কিন্তু যাওয়ার সময় মনে হয়েছে সাঁতার কেটে যাচ্ছে; তার গায়ে লাগছে আউশধানের ধারালো পাতা, গা খশখশ করছে, লাগছে কলমিলতা, দলঘাস, ধনচে। মামাবাড়ির খাল দিয়ে ছুটে চলছে ঘোলা কাটাল; খাল উপচে ঘোলা জল বয়ে চলছে পালানের কচুর ঝোঁপ, আর পাটচারা কাঁপিয়ে। ঘোলা জলে ঘুমিয়ে থাকার মতো পড়ে আছে কলাগাছের ভেলাটি। দুপুরের পর সে কলাগাছের ভেলাটিতে গিয়ে উঠলো। লগি দিয়ে ভেলা বাইতে গিয়ে সুখে ভরে গেছে তার শরীর; কচুঝোঁপের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় পাতাগুলো আস্তে আস্তে পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে, শিরশির শব্দ হচ্ছে, একটা ছিনেঝোঁক পানিতে লাফিয়ে পড়লো। লেবুপাতার গন্ধ পাচ্ছে সে, লেবুপাতার গন্ধ পেলে সে ইলিশের গন্ধও পায়, ভেলাটি একটু বেকে লেবুঝোপে ঢুকে পড়লো, বেশি। ঢোকে নি, ঢুকলে কাঁটায় আটকে যেতো। এখানে পানিতে কাটাল কম, একটু পরেই খাল। রাশেদ জোরে লগি মারতেই ভেলাটি খালে গিয়ে পড়লো, স্রোতের ধাক্কায় গোত্তা খেলো ঘুড্ডির মতো, রাশেদ চেষ্টা করলো লগি মেরে ভেলাটিকে সোজা করতে, কিন্তু। সেটি চরকির মতো ঘুরে কাত হয়ে গেলো। ধাক্কায় পিছলে রাশেদ ভেলা থেকে ছিটকে পানিতে গিয়ে পড়লো, প্রচণ্ড কাটাল তাকে অজগরের মতো টেনে সামনের দিকে ভাসিয়ে নিতে চাইলো। পানিতে পড়েই তলিয়ে গিয়েছিলো রাশেদ, ঘোলা পানিও খেয়েছে অনেকখানি, রাশেদ খালের মাটিতে পা চাপ দিয়ে দু-হাত উঁচু করে ভেসে উঠে ভেলা ধরতে গিয়েই দেখলো ভেলাটি কাটালের টানে অনেকখানি এগিয়ে গেছে, পাতার। মতো ঘুরতে ঘুরতে কাঁপতে কাঁপতে বিলের দিকে চলছে, রাশেদ আর তাকে পাবে না। রাশেদ আবার পানিতে ডুবে গেলো, ডোবার সময় তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সিরাজের মুখ, সিরাজ, যে গত বছর এখালেই ডুবে মারা গেছে, মরতে যার ভয়। লাগতো, যে তার মতোই ভেলায় উঠতে পছন্দ করতো বলে মামাবাড়ি বেড়াতে আসতো, যে আর ভেলায় উঠবে না। না, আমি মরতে চাই না, আমি মরবো না, আমি আবার মামাবাড়ি বেড়াতে আসবো, মামীর হাতে দুধভাত খাবো, মনে মনে চিৎকার করতে করতে রাশেদ পানিতে ডুবে গেলো, পা দিয়ে সে খালের তলা খুঁজতে চেষ্টা করলো, এবং তলায় পা লাগতেই দু-পা দিয়ে ঠেলা দিয়ে পানির ওপর ভেসে উঠলো। তাকে কি কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কেউ কি দেখতে পাচ্ছে না সে তলিয়ে যাচ্ছে? নিশ্চয়ই কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
খুব অস্বস্তিতে পড়েছে মৃদু, যদি দেশের সব লোক এসে গোলাপটিকে দেখতে পায়, তাহলে গোলাপটির কী হবে? সে কোনো কথা বলছে না, তার চোখ এমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে যে বোঝা যায় সে চায় না কেউ গোলাপটিকে দেখুক। ওই গোলাপ শুধু মৃদুর হয়ে থাক, শুধু আব্বর হয়ে থাক। রাশেদ বললো, আমি দরোজায় গিয়ে দেখি কোনো মানুষ নেই, গ্রাম থেকে কেউ আসে নি শহর থেকেও আসে নি কেউ ধানখেত থেকেও কেউ আসে নি নদী থেকেও কেউ আসে নি, শুধু আমার দরোজায় বসে আছে একটি নীল। পায়রা। চমকে উঠলো মৃদু, খুশিতে তার চোখমুখ ভরে উঠলো; মৃদু জানতে চাইলো, পায়রাটি কি ঢুকলো তোমার ঘরে? রাশেদ বললো, হুঁ, আমি পর্দা সরাতেই পায়রাটি নীল মেঘের টুকরোর মতো ভাসতে ভাসতে আমার ঘরে ঢুকলো, বসলো আমার। টেবিলে, বসতেই আমার টেবিলে গজিয়ে উঠলো সবুজ ঘাস, সেখান থেকে একটা। প্রজাপতি উড়ে গিয়ে মেয়েটির মাথায় গিয়ে চুপ করে বসে রইলো। বোঝাই গেলো না যে ওটি প্রজাপতি, ওটি সোনার প্রজাপতি হয়ে গেলো। মেয়েটি ঘুমের মধ্যেই একবার হাত দিয়ে চুল থেকে কাটার মতো খুললো প্রজাপতিটিকে, ডান হাত থেকে বাঁ হাতে। নিলো, আবার ডান হাতে নিলো, তারপর নিজের গালে ঘষে প্রজাপতিটিকে সে পরিয়ে দিলো তার বুকে ঘুমিয়ে থাকা বিড়ালির মাথায়। মৃদু চুপ হয়ে গেছে, বিড়ালি গোলাপ-মেয়ে পায়রা ঘাস প্রজাপতি তাকে ঘিরে ফেলেছে, সে যে উফুল্ল হয়ে খিলখিল করে উঠবে, সে-চেতনাও তার নেই, এতো স্বপ্ন একসাথে এসে উপস্থিত হয়েছে তার চোখের সামনে যে এখুন সে পারে শুধু ঘুমিয়ে পড়তে। রাশেদ দেখতে পায় মৃদুও। অনেকটা ওই গোলাপ-মেয়ে হয়ে গেছে, তার কোলে ঘুমিয়ে আছে বিড়ালি, বিড়ালির মাথায় সোনার প্রজাপতি, ঘুমিয়ে পড়ছে মৃদু। ঘুম থেকে জেগে উঠলে আবার মনে পড়বে তার বিড়ালিকে, গোলাপ-মেয়েকে, পায়রাকে, প্রজাপতিকে, তখন জানতে চাইবে তারা কোথায়?
রাশেদকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, রাশেদও দেখতে পাচ্ছে না কাউকে, তার মগজ জুড়ে আকাশফাড়া বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিচ্ছে সিরাজ, যে ভেলা ভালোবাসতো, যে গতবছর ভেলা থেকে পড়ে গিয়েছিলো, যাকে কেউ দেখতে পায় নি, যে ভেসে। উঠেছিলো বিলের ধানখেতে, সন্ধ্যার পর যাকে খুঁজে পেয়েছিলো গ্রামের লোকেরা। রাশেদ ভেসে উঠেই একটা লেবুর ডাল ধরলো, ডালটি ভেঙে রয়ে গেলো তার। মুঠোতেই, সে আরো অনেকখানি পানি খেলো, একবার সাঁতরাতে গিয়ে উল্টে গেলো, এবং তলিয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো সে সমুদ্রে পড়ে গেছে, একটা বড়ো মাছ হাঁ করে আসছে, কী মাছ সে বুঝতে পারলো না, মনে হলো সে ঢুকে যাচ্ছে মাছের পেটে, অনেক আগে কে যেনো ঢুকে গিয়েছিলো মাছের পেটে, তার মতো সে ঢুকে যাচ্ছে মাছটির পেটে, যেখানে সে আটকে থাকবে, কোনোদিন বেরোতে পারবে না, মাছ তাকে পেটের ভেতরে নিয়ে এই সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্রের দিকে চলে যাবে। মায়ের মুখ। তার মনে পড়লো একবার, সে-মুখ মায়ের কিনা সে বুঝতে পারলো না, দেখতে পেলো একটা লাটিম খড়ের গাদার নিচে লুকিয়ে আছে, একটা জাম্বুরার ফুটবল গড়িয়ে চলছে পুকুরের দিকে, তার হাত অবশ হয়ে আসছে, পা দিয়ে খালের তলা খুঁজতে গিয়ে তলা খুঁজে পাচ্ছে না, তার পৃথিবীতে কোনো বাতাস নেই, তাকে ঘিরে আছে মহাজল। মহাজগত মহাজল হয়ে তাকে ঘিরে ধরেছে। সে কী মরে যাবে, ভেলা থেকে পিছলে পড়ে মরে যাওয়ার জন্যে সে এতো ভালোবাসতো মামাবাড়ি আসতে, এতো। ভালোবাসতো বেলেমাটি, মরে যাওয়ার জন্যেই সে এমনভাবে বেড়ে উঠেছিলো? খালের তলায় রাশেদের পা ঠেকেছে, একটু সুখ লাগলো তার, মাটির ছোঁয়া লাগলে যেমন সুখ। লাগে; পা দিয়ে চাপ দিয়ে সে ভেসে উঠলো, তাকে ভেসে উঠতেই হবে, সে সিরাজ হবে না, সে ধানখেতে ভেসে উঠবে না, সন্ধ্যার পর গ্রামের লোকের অপেক্ষায় সে ধানখেতে ভাসবে না, সে খালের পাড়ে উঠবে, হেঁটে একা মামাবাড়িতে ফিরবে, তারপর বাড়ি যাবে। ভেসে উঠলেও ঘুরপাক খাচ্ছে রাশেদ, ধরার মতো কিছুই পাচ্ছে না হাতের কাছে, সে একবার সাঁতরানোর কথা ভাবলো, তারপর চিৎ হয়ে ভাসতে চেষ্টা করলো, কাটাল তাকে চিৎ হ’তে দিচ্ছে না, তবে তাকে চিৎ হতেই হবে, চিৎ হতেই হবে। তাকে। চিৎ হতে গিয়ে একটা প্রচণ্ড কাটাল তাকে টান দিলো, রাশেদ ঘুরপাক খেয়ে খালের পাশে লেবুঝোঁপের ভেতরে ঢুকে আটকে গেলো, সে একটা লেবুগাছের গোড়া ডান হাত দিয়ে শক্ত করে ধরলো। আমি বেঁচে আছি, ভাবলো রাশেদ, বেঁচে থাকবো; . কিছুক্ষণ সে শুয়ে রইলো লেবুঝোঁপের ভেতরে, শুয়ে থাকতে এতো ভালো লাগলো তার যেমন ভালো আর কখনো লাগে নি, মায়ের কোলে শুয়েও লাগে নি, কোনোদিন লাগবে না। কারা যেনো নৌকো বেয়ে যাচ্ছে, কাটাল উজিয়ে যাচ্ছে, শো শো শব্দ হচ্ছে; রাশেদ। চাইছে তারা যেনো তাকে দেখতে না পায়। কিছুক্ষণ আগেও রাশেদ চাইছিলো কেউ। তাকে দেখুক, গ্রামের সবাই তাকে দেখুক; এখন মনে হলো কেউ যেনো তাকে দেখতে না পায়, সে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকবে লেবুঝোঁপের ভেতরে, তাকে দেখুক শুধু এই লেবুঝোঁপ, যে তাকে বাঁচিয়েছে, আর সে দেখবে লেবুঝোঁপকে। কেউ যেনো না জানে। সে পানিতে পড়ে গিয়েছিলো, সবাই জানুক সে কখনো পানিতে পড়ে নি, সবাই জানুক সে সাঁতার জানে।