রাশেদ একটি খাল দেখতে পায়, খালের ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে ঘোলা জলের তীব্র কাটাল, ছুটে চলছে পদ্মার বালুকণা। ঘোলা জল মানেই পদ্মা, খালের ভেতর দিয়ে ছুটলেও পদ্মা, আর ঘোলো মাইল পাশ ঢেউয়ের ভেতর দিয়ে ছুটলেও পদ্মা। রাশেদের কেনো শুধু মামাবাড়ি যেতে ইচ্ছে করতো, মৃদু তো একবারও মামাবাড়ির কথা বলে না। ওর মামা নেই বলে? ওই গ্রামটি খুব পছন্দ ছিলো রাশেদের, কেননা ওখানে ওর মামাবাড়ি; আর ওই গ্রামের নরম বেলেমাটি, চাঁদের জন্যে পাগল বাশবন, পদ্মার ইলিশের জন্যে উন্মান লেবুবন তাকে টানতো, বর্ষা এলে তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যেতো কাটালভরা ভাল। পদ্মা থেকে একেকটি খাল বেরিয়েছে, শুকনো কালে তাতে। কোনো পানি থাকতো না, কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই পদ্মানদী প্রচণ্ডভাবে ঢুকে পড়তে খাল দিয়ে, আর খাল উপচে খেত পালান কোলার ভেতর দিয়ে। খালের পানি ঘোলা, পদ্মার পানির মতোই, ওই পানি খালের দুপাশ কাঁপিয়ে বইতে বিলের দিকে। বিল। ছিলো খালের সমুদ্র। খালের কাটাল ছিলো প্রচণ্ড, আখের পাতার মতো ধার, মনে হতো খালের দুপাশ-বেতঝোঁপ, লেবুজাম্বুরা কলার ঝাড়, নারকেল শুপুরির সারি কেটে কেটে টেনে টেনে নিয়ে যাবে বিলের ভেতরে। কাটাল উজিয়ে নৌকো বাওয়া ছিলো যেমন কষ্টের তেমনি উত্তেজনার, নৌকো একবার ডানে বেঁকে যেতো আরেকবার বাঁকতো বায়ে, ডানে বেঁকে গিয়ে লাগতো বাঁশঝাড়ে বায়ে বেঁকে গিয়ে লাগতো বেতঝোপে, উঠতে থাকতো ঘোলাজলের শোঁ শোঁ শব্দ। রাশেদ অবশ্য মামাবাড়ি গেলে ওই আট বছর বয়সে নৌকো বাইতে পেতো না, বাওয়ার সাহসও হতো না, নৌকোয় উঠলে নৌকোর গুরা শক্ত করে ধরে থাকার উত্তেজনাই তার ভালো লাগতো; তবে তার সুখ লাগতো কলাগাছের ভেলা বাইতে। ওই গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে নৌকো ছিলো না, নৌকোর দরকারও পড়তো না, তবে কলাগাছের ভেলা থাকতো সবারই; তার মামাতো ভাইটিরও একটি ভেলা ছিলো। কলাগাছের ভেলায় উঠতেই কেমন যে সুখ লাগতো, পায়ের তলাটা সব সময় পিচ্ছিল থাকতো, একটু এদিক ওদিক হলেই উল্টে পানিতে পড়ে যেতে হতো, জড়িয়ে ধরে থাকতে হতো ভেলা, তারপর বুক দিয়ে বেয়ে বেয়ে। উঠতে হতো ভেলায়। যখন খুব ছোটো ছিলো রাশেদ তখনো তার ভেলায় উঠতে খুব ইচ্ছে হতো, কিন্তু তাকে উঠতে দেয়া হতো না সে সাঁতার জানতো না বলে। পিছলে খালের কাটালে পড়লে রক্ষা নেই। সে-বছর সে সাঁতার শিখেছে, অনেকটা শিখেছে, ঘাট থেকে সাঁতরে কিছু দূরে গিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে। দুজোড়া নারকেল। জড়িয়ে ধরে সে সাঁতার শিখেছে, তাদের পাশের বাড়ির এক বুড়ো সাঁতার শিখিয়েছে। তাকে; তার মনে হয়েছে মাটি এতোদিন যেমন তার পায়ের নিচে ছিলো এবার পানিও তার বুকের নিচে। সঁতার শেখা হচ্ছে পানিতে হাত আর বুক দিয়ে হাঁটতে শেখা। এখন সে পানিতে হাঁটতে শিখেছে।
মদুর নায়িকা বিড়ালি এবার লাফ দিয়ে রাশেদের টেবিল থেকে গিয়ে পড়ে ছাত্রীটির কোলে, জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ঘষতে থাকে তার গালে নাকে কানে; খিলখিল করে ওঠে মৃদু, কী দুষ্ট কী দুষ্টু! বিড়ালির ঠোঁটের রেভলন লেগে ছাত্রীটির গাল গোলাপের মতো লাল হয়ে ওঠে, নাক লাল হয়ে ওঠে, কান লাল হয়ে ওঠে। রাশেদ যতোই বর্ণনা দিতে থাকে, ততোই খিলখিল করে ওঠে মৃদু; রাশেদও বাড়াতে থাকে বর্ণনা, বলে বিড়ালি, ছাত্রীটির গলায় ঠোঁট ঘষতে থাকে, ঠোঁট ঘষতে থাকে, ঠোঁট ঘষতে থাকে, বিড়ালির ঠোঁট থেকে আলতার মতো গল গল করে বেরোতে থাকে লিপস্টি, মেয়েটির গলা গোলাপের মতো লাল হয়ে ওঠে। মেয়েটি ঘুমিয়েই পড়ে, স্বপ্ন দেখে সে গোলাপ হয়ে গেছে। মৃদু অবাক হয়, চোখে একটা বড়ো গোলাপ দেখতে পায়; তারও যেনো ইচ্ছে করে গোলাপ হ’তে। মৃদু জানতে চায়, তার জামা, শাড়ি? রাশেদ বলে, তার ব্লাউজ। আগে কেমন ছিলো তা তো দেখি নি, তবে বাতাসে শাড়ি একটু উড়তেই দেখি তার। ব্লাউজ গোলাপের পাপড়ির মতো লেগে আছে তার গায়ে, আর শাড়িও হয়ে গেছে। গোলাপের পাপড়ি। ওই গোলাপের গায়ে ঝুলে আছে শাদা বিড়ালি। এমন সময় বিড়ালি মিউ বলতেই মেয়েটি চোখ মেলে তাকায়, জিজ্ঞেস করে, আমি কোন বাগানে ফুটেছি? আবার সে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়ে, চেয়ার থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতে চায়; বিড়ালি তাকে জড়িয়ে ধরে রাখে, মাথাটি দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দেয়। মেয়েটির শরীর থেকে সুগন্ধ বেরোতে থাকে, সুগন্ধে সারা ঘর ভরে যায়। সে-গন্ধে, রাশেদ বলে, আমার ঘরের দরোজায় ভিড় জমে যায়; মনে হয় দেশের সব মানুষ এসে বলছে, আপনার ঘরে একটা গোলাপ ফুটেছে, তার গন্ধে সারা দেশ ভরে গেছে, আমরা গ্রাম থেকে ধান খেত থেকে নদীর ঢেউয়ের ওপর থেকে দূরের শহর থেকে শহরের গলি থেকে গোলাপটিকে দেখতে এসেছি। মৃদু নির্বাক হয়ে আছে, তার খিলখিল হাসি বন্ধ হয়ে গেছে অনেক। আগেই, বিস্ময়ে সেও ঘুমিয়ে পড়তে চায়; এক সময় সে জানতে চায়, তুমি কি তাদের ওই গোলাপ দেখালে? ওই গোলাপ কি দেশের সবাইকে দেখানো যায়? ওই গোলাপ কি বিক্রির জন্যে যে সবার চোখের সামনে তাকে মেলে ধরতে হবে? রাশেদ অবশ্য ঠিক করতে পারছে না সে গোলাপটিকে সকলকে দেখাবে কী দেখাবে না, মৃদু কোনটা পছন্দ করবে? মৃদু নিশ্চয়ই চাইবে গোলাপটি আর কেউ দেখতে পাবে না, শিশুরা সুন্দরকে নিজের জন্যেই রেখে দিতে চায়, মৃদুও চাইবে তাই; গোলাপটি সকলের হয়ে উঠলে। তার ভালো লাগবে না।