রাশেদ শক্ত হয়ে উঠে বসলো। দাদার হাত ধরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রতিদিনের মতো ইস্কুলে যাচ্ছিলো মৃদু, ইস্কুলে যাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে থাকে সে যেমন রাশেদ নিজেও থাকতো, কিন্তু গলি পেরিয়ে যেই বড়ো পথে তারা পা দিয়েছে, ট্রাক থেকে মিলিটারিরা রাইফেল উঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠে। এর আগে মৃদু এমন মানুষ দেখে নি, তারা যে মানুষ তা বুঝতে বেশ সময় লাগে মৃদুর। দাদা তাকে বলে, এরা মানুষই, তবে মিলিটারি। মৃদুর মুখের দিকে তাকিয়ে দাদার মনে হয়েছিলো মিলিটারিরা যে মানুষ তা বুঝে উঠতে পারছে না মৃদু, তাই তিনি স্পষ্ট করে কথাটি বলেন। ওই মিলিটারিরা ধমক দিয়ে তাদের বাড়ি ফিরে যেতে বলে, চিৎকার করে বলে যে এগোলে গুলি করবে, বলে রাস্তায় নামা নিষেধ। একটা মিলিটারি আরো জোরে চিৎকার করে বলে দেশে সব কিছু বন্ধ, ইস্কুলও বন্ধ। মৃদু এতে খুব ভয় পায়, তবে ভয় পাওয়ার থেকে বেশি দুঃখ পায়। মৃদুর মুখে এক বড়ো অভিজ্ঞতার ছাপ, আজ সকালে সে বাইরে থেকে ইতিহাস মুখে করে নিয়ে এসেছে; সে এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে পাঁচ বছর বয়সেই, যার। কোনো ক্ষমা নেই, যার অশ্লীল দাগ কখনো মুছবে না। মৃদু দুঃস্বপ্নের মধ্যে রয়েছে, পাঁচ বছর বয়সেই তার দেশ তাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে এমন দুঃস্বপ্নের গর্তে, যেখান থেকে সে কখনো উঠে আসতে পারবে না। মৃদুর ধারণা ছিলো ইস্কুলে যেতে কেউ কখনো। নিষেধ করে না, আজ পর্যন্ত তাকে কেউ নিষেধ করে নি; তার বিশ্বাস ছিলো রাস্তায় হাঁটতে কেউ কখনো নিষেধ করে না, আজ পর্যন্ত তাকে কেউ নিষেধ করে নি; বরং তাকে ইস্কুলে যেতে দেখে খুশি হয় সবাই, মৃদুর তাই মনে হয়; চকোলেট না কিনলেও রাস্তার মুদি তাকে দেখে হেসে হাত নাড়ে, অচেনা অনেকে রাস্তার ওপার থেকে এসে তার গাল টিপে দেয়। তার ধারণা ছিলো ইস্কুল বন্ধ করতে পারেন শুধু বড়ো আপা, আর কেউ পারে না। মিলিটারিরা তো ইস্কুলে পড়ায় না, তাদের তো সে কোনোদিন ইস্কুলে দেখে নি, তারা কেনো ইস্কুল বন্ধ করবে? খুব আহত বোধ করছে মৃদু, তার সুখ কেউ কেড়ে নিয়েছে তাকে না জানিয়ে, এটা সহ্য করতে পারছে না সে। রাশেদকে জড়িয়ে ধরে সে প্রশ্ন করতে থাকে, রাস্তায় হাঁটতে পারবো না কেন? রাশেদ বললো, মিলিটারিরা এসেছে, তাই। মৃদু জিজ্ঞেস করলো, ইস্কুলে যেতে পারবো না কেনো? রাশেদ বললো, মিলিটারিরা এসেছে, তাই। মৃদু জিজ্ঞেস করলো, মিলিটারিরা এলে সব বন্ধ হয়ে যায়? রাশেদ বললো, হ্যাঁ। মৃদু জিজ্ঞেস করলো, পাখিদের ওড়াও বন্ধ হয়ে যায়? রাশেদ বললো, যা। মৃদু জিজ্ঞেস করলো, ফুল ফোঁটাও বন্ধু হয়ে যায়? রাশেদ। বললো, হ্যাঁ। মৃদু জিজ্ঞেস করলো, গান গাওয়াও বন্ধ হয়ে যায়? রাশেদ বললো, হ্যাঁ। মৃদু জিজ্ঞেস করলো, বৃষ্টিও কি বন্ধ হয়ে যায়? রাশেদ বললো, হ্যাঁ। মৃদু জিজ্ঞেস। করলো, স্বপ্ন দেখাও বন্ধ হয়ে যায়? রাশেদ বললো, হ্যাঁ। মৃদু চিৎকার করে উঠলো, তাহলে দেশে কেনো মিলিটারি আসে? আর দেশে কি শুধু মিলিটারিরাই থাকবে? রাশেদ উত্তর না দিয়ে মুখ দেখছে মৃদুর, মুখের ভেতর দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে মৃদুর রক্তাক্ত হৃদপিণ্ডটি, যেখানে বহু বেয়নেটের খোঁচা লেগে আছে। মৃদুর মুখটি হয়ে উঠেছে। বাঙলাদেশ, যার ওপর অজস্র বুটের অশ্লীল দাগ দগদগ করছে। মৃদু প্রশ্ন করে চলছে : মিলিটারি আমাদের রাইফেল দিয়ে মারতে চাইলো কেনো? বড়ো আপা তো ইস্কুল বন্ধ করে নি, ইস্কুল বন্ধ হলো কেনো, আব্বু? আমাদের ইস্কুলটি কি মিলিটারিদের? মৃদুর চোখের দিকে তাকিয়ে রাশেদের ভয় হলো, ওই চোখে সংখ্যাহীন প্রশ্ন দেখতে পেলো রাশেদ, মনে হলো মৃদু হয়তো অনন্তকাল ধরে প্রশ্ন করতে থাকবে। রাশেদ মৃদুকে কোলে জড়িয়ে ধরে মৃদুর গালে অনেকক্ষণ নিজের গাল লাগিয়ে রাখলো, নাকটি নেড়ে দিলো, তারপর বললো, মৃদু, আজ থেকে বাঙলাদেশের সব রাস্তা মিলিটারিদের। তোমার বইগুলো মিলিটারিদের। ছড়াগুলো মিলিটারিদের। কাজলা দিদি আর আমাদের ছোটো নদী মিলিটারিদের। আকাশ মিলিটারিদের। বাতাস মিলিটারিদের। পাখির গান মিলিটারিদের। তোমার নাচ আর হাসি মিলিটারিদের। বৃষ্টি মিলিটারিদের। আমাদের দেশটি মিলিটারিদের। মৃদু ফুঁপিয়ে উঠলো, আব্বু, আমি ইস্কুলে যাবো।
শেষমার্চের সকালবেলা মৃদুর চোখমুখে বুটের দাগ দেখতে পেয়ে রাশেদ বুঝেছে দেশে আবার ত্রাণকর্তারা এসেছে। সে মৃদুর কাছে অপরাধী বোধ করলে নিজেকে; মনে হলো যেনো সে-ই রাস্তায় রাস্তায় ট্রাকে ট্রাকে বসে আছে, সে-ই জলপাইরঙ পরে ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে রাইফেল উঁচিয়ে ধরে ভয় দেখিয়েছে মৃদুকে, সে-ই জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে মৃদুর ইস্কুল, সে-ই মৃদুকে লাথি মেরে দুঃস্বপ্নের খোড়লে ফেলে। দিয়েছে। সে বুঝলো জলপাইরঙের ত্রাণকর্তারা, কয়েক মাস ধরেই যারা আসি আসি করছিলো, এসেছে; সে উপলব্ধি করলো দেশে এক মহাপুরুষ, মহান ত্রাতা, জাতির। উদ্ধারকর্তা, গণতন্ত্ররক্ষাকারীর আবির্ভাব ঘটেছে আবার। রাশেদ, ছেলেবেলা থেকে, বেশ কয়েকটি মহাপুরুষের আবির্ভাব দেখেছে; তাদের নানা ছন্দের গোঁফ, বুকে বিচিত্র তারকা, আর প্যাঁচানো দড়ি দেখেছে। মৃদুকে জড়িয়ে ধরে রাশেদ আরেকটি মহাপুরুষের মুখ কল্পনা করতে লাগলো;–ওই ভাঁড়টিই কি এসেছে, রাশেদ নিজেকে প্রশ্ন করলো, যেটা কয়েক মাস ধরে খুব ছটফট করছিলো, ক্ষমতায় অংশ চাইছিলো? নানান রঙের প্রতিশ্রুতি শুনতে লাগলো রাশেদ, একের পর এক উৎকট ঘোষণা আর কুচকাওয়াজে তার কান ঘরঘর করতে লাগলো। আবার প্রচুর গণতন্ত্র পাওয়া যাবে, ভাবলো রাশেদ; বেতার-টেলিভিশনের বাক্সগুলো খুললেই গলগল করে আবার গড়িয়ে পড়বে গ্যালন গ্যালন গণতন্ত্র, দেশের রোগা পাছায় লাথি মেরে মেরে আবার তাকে ফুলিয়ে তোলা হবে। বাঙলাদেশ, তোমাকে অভিনন্দন, বললো রাশেদ, তুমি এতো মহাপুরুষ জরায়ু থেকে উগড়ে দিয়েছো! খুব প্রস্রাব পেলো রাশেদের। ভোরে জেগে যেমন প্রতিদিন তলপেটে চাপ বোধ করে আজকের চাপটা তার চেয়ে অনেক বেশি; সম্ভবত তার তলপেটে এরই মাঝে হাজার গ্যালন গণতন্ত্র, আর শান্তিশৃঙ্খলাউন্নতি ঢুকে গেছে। রাশেদ মৃদুর আম্মাকে ডাকলো, যে সকাল থেকেই পাশের ঘরে বসে বেতারে জলপাইরঙের ঘোষণা আর গোলাপি গোলাপি প্রতিশ্রুতি প্রাণভরে খাচ্ছিলো আর পান করছিলো, একা একা খেতে খেতে আর পান করতে করতে বমি বমি বোধ করছিলো। মমতাজ, মৃদুর আম্মা, একটি ছোটো রেডিও হাতে এসে বললো, জানো, সামরিক আইন জারি হয়েছে। আজ তাকে অফিসে যেতে হবে না বলে কণ্ঠে একটা ঢিলেঢিলে ভাব। এসেছে, তবে মুখে বমির ভাবটা বেশ স্পষ্ট। সে যদি একটা চমৎকার বমি করতে পারতো, বমিটা উগড়ে দিতে পারতো ওই সমস্ত ঘোষণার মুণ্ডুর ওপর, তাহলে স্বাভাবিক হয়ে উঠতো। রাশেদের বলতে ইচ্ছে হলো, তুমি একবার বমি করে এসো। প্রস্রাবটা খুব চেপে ধরেছে রাশেদকে, সে ওই চাপে প্রায় কথা বলতে পারছিলো না; শুধু বললো, প্রথম ওটা যাবে বালের ওপর দিয়ে।