বাসায় ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলো রাশেদ, তার চোখের পাতায় ভিড় করছিলো তরুণ মুসলমান বাঙালিরা, স্বাধীনতার শস্য ও দেশের ভবিষ্যতেরা, জিন্স পরে হুইস্কি বিয়ারের গেলাশ হাতে যারা মধ্যযুগে ফিরে গেছে। রাত একটার মতো হবে, কলিংবেল বেজে উঠলো; রাশেদ শুনতে পেলো এক লোক জোরে জোরে বলছে, স্যার, আমরা। থানা থেকে এসেছি, আমি ওসি স্যার, একটু ওঠেন, আপনার সাথে একটু কথা আছে স্যার। থানা? তার সাথে থানার কী কথা থাকতে পারে? ঢাকা শহরে অনেক থানা আছে বলে রাশেদ শুনেছে, না থাকলেই ভালো হতো বলেও শুনেছে রাশেদ, কিন্তু কী সম্পর্ক তার থানার সাথে? থানায় কি খবর পৌঁছে গেছে যে রাশেদ আজ পান করেছে, হুইস্কি ও বিয়ার দুটোই, এবং মাঝেমাঝে পান করেছে তরুণীদের বাহু গ্রীবা স্তন থেকে গলে পড়া আবেদনঃ একটি মেয়ের গ্রীবা সে আজ একটু বেশি করেই পান করেছে, তাতে একটু মত্ততাও এসেছিলো, এ-সংবাদ কি থানায় পৌঁছে গেছে? রাশেদ হাত বাড়িয়ে দেখে। নিলো সে বাসায় শুয়ে আছে কিনা, পাশের নারীটি তার বউ কিনা, নাকি সে রাস্তায় মদ খেয়ে মাতলামি করে চলছে, পুলিশ তাকে তুলে নিতে এসেছে। না, এটি তার শয্যাই, ডোরাকাটা বালিশটিও তারই, পাশের নারীটিও তার স্ত্রীই, পরস্ত্রী নয় বেশ্যাও নয়, এবং আজ রাতে তার সাথে সে বৈধ বা অবৈধ কিছুই করে নি। তাহলে কি তার মুখ থেকে খুব গন্ধ বেরোচ্ছে, যা থানা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যেহেতু সে পেয়ারাপাতা চিবোয় নি? সামরিক আইনের শুরুর দিকে সব ব্যাটা বড়ো বেশি দায়িত্বশীল হয়ে পড়ে, পুলিশ। একটু বেশি করেই দায়িত্বশীল হয়, ঘুষও নিতে চায় না, নিলে পাঁচ গুণ বেশি নেয়। ঝুঁকি বেশি। সে মদ খেয়েছে, এটা পুলিশ জেনে গেছে, এতে একবার তার খুব শ্রদ্ধা হলো পুলিশের প্রতি। এমন পুলিশ থাকলে শ্রেষ্ঠ ধর্মের কোনো ভয় নেই, দেশের ভয় নেই, তবে পুলিশ কি খায়টায় না? শুধু ঘুষ খায়? মদ ছোয়ও না? রাশেদ দরোজায় এসে জিজ্ঞেস করলো, কে? ওসিটি অত্যন্ত বিনীত, সম্ভবত আইস্ক্রিম দিয়ে তৈরি, গলে গলে সে বলতে লাগলো, স্যার, এতো রাতে আপনাকে ডিস্টার্ব করছি বলে দুঃখিত। স্যার, আমরা তেতলার ফ্ল্যাটটা চেক করবো স্যার, ওখানে অবৈধ কাজ হয় স্যার, আমাদের সাথে একটু থাকতে হবে আপনাকে, স্যার। অবৈধ কাজ? কাকে বলে অবৈধ কাজ? পুলিশ যে তাকে এতো রাতে ডেকে তুলেছে, এটা বৈধ? ভাঁড়রা দেশ দখল করেছে, এটা বৈধ? অবৈধ কাজ, অর্থাৎ তাদের তেতলার ফ্ল্যাটে পতিতাবৃত্তি চলছে? অর্থাৎ অবৈধ সঙ্গম চলছে? মাস তিনেক ধরে ওরা আছে, অথচ একবারও রাশেদের সন্দেহ হয় নি। তিন মাস ধরে এ-দালানটি এক নবযুগের মধ্যে বাস করছে, উল্লাসের মধ্যেও, দালানটির শ্ৰেণীউত্তরণই ঘটে গিয়েছিলো, এটা ভালোই লেগেছে রাশেদের। আগে গাড়ি করে এ-দালানে কেউ আসতো না বা সপ্তাহে এক-আধটি গাড়িতে আসতো কারো না কোনো দূরসম্পর্কিত আত্মীয়, এতে তো খারাপই লাগতো তার, মনে হতো বস্তিতে। পড়ে আছি, দালানে একটাও উন্নত বাঙালির পদধুলি পড়ছে না; আর ওরা আসার পর গাড়ি আসছিলো আর যাচ্ছিলো, বেবি আসছিলো আর যাচ্ছিলো, আসছিলো আর যাচ্ছিলো সুন্দর সুন্দর বালিকারা আর পুরুষেরা। ওদের সম্পর্কে কোনোই সন্দেহ হয় নি তার, শুধু একদিন তার বন্ধু জহির তেতলার জানালার পর্দার আয়তন দেখে বলেছিলো, তোমাদের তেতলায় নিশ্চয়ই পর্দানসিনেরা এসেছে। বাড়িঅলার খচ্চর ঘরজামাইটা, যে দিনরাত অজু করে সামনের কলে, সে তো দাঁড়িয়েই থাকতো ওদের জন্যে, দেখলেই, আফা, ভাল আছেন ত বলতে বলতে পেছনে পেছনে হটতো, কোর্টে যে চোরের জামিন হয় বলে রাশেদ শুনেছে, সেও বুঝতে পারে নি কিছু? বেশ্যা ধরতে রাশেদ পুলিশের। মতো তেতলায় উঠবে? পুলিশকে কি সে বেশ্যাদের থেকে বেশি বৈধ মনে করে? আর। ওরা আছে বলেই তো সেদিন তার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো, যার সাথে এক দশক ধরে দেখা নেই, যে খুব উন্নতি করেছে, দুটি কারখানা দিয়ে শিল্পপতি হয়েছে, যে বিশাল গাড়ি নিয়ে ঢুকেছিলো ভেতরে। সে বললো যে তেতলায় বোনের সাথে দেখা করতে এসেছে; তবে সে একা আসে নি, সঙ্গে তার এক বন্ধু ছিলো, যে একটি ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক। রাশেদ পুলিশের সাথে তেতলায় উঠলো, পুলিশেরা অনেকক্ষণ ধরে দরোজা খোলার জন্যে চিৎকার করলো, একসময় এক নারী দরোজা খুলে ওসিকে বললো, আপনি আবার জ্বালাতন করতে এলেন? আপনাকে তো দিচ্ছিই। ওসি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো, রাশেদ পুলিশের সাথে ভেতরে ঢুকলো। একটি সোফায় বসে আছে বছর ষাটেকের একটি লোক, অবাঙালি, আরেকটিতে এক বাঙালি, অত্যন্ত সুদর্শন, চল্লিশের মতো বয়স। একটি যুবক পুলিশ দেখেই দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে চিৎকার করতে লাগলো, আমারে মাপ কইরা দ্যান, আমি নতুন বিয়া করছি, আমারে মাপ কইরা দ্যান, আমি নতুন বিয়া করছি। যুবকটির জন্যে খুব দরদ বোধ করলো রাশেদ; আহা, চাইলে সে এখন, রাত দুটোর সময়, ঘুম থেকে জাগিয়ে বা না জাগিয়ে নতুন বউয়ের সাথে আরেকটি সঙ্গম করতে পারতো, কিন্তু সে এখন পায়খানায় ঢুকে কাঁদছে, বহুদিন আর সুযোগ পাবে না। পাশের ঘরে তিনটি সুন্দর বালিকা, মোলো সতেরো বছর হবে, প্রায় নগ্ন বসে আছে। এ-বালিকা তিনটিকে রাশেদ বহুবার উঠতে নামতে দেখেছে, মুখে। ইংরেজিও শুনেছে, ওদের প্রায় নগ্ন শরীর দেখে একবার কেঁপে উঠলো রাশেদ। ওসি অশ্লীল ভাষায় ব’কে চলছে সবাইকে, বিশেষ করে বাড়িঅলিকে। বাড়িঅলিকে অনেক শ্লীল মনে হলো ওসির, থেকে, সে চলতি বাঙলাই বলছে, ইংরেজিও বলছে। এখন যদি ভোট হয়ে যায় তাহলে রাশেদ কাকে ভোট দেবে, বাড়িঅলিকে, ওই মেয়ে তিনটিকে, না ওসিকে? না, ওসি তার ভোট পাবে না। বুড়োটা বাঙলা-ইংরেজি-উর্দু মিশিয়ে জানালো। সে এক পাকিস্থানি জাহাজের ক্যাপ্টেন। এ-বুড়োটার সাথেই শুয়েছিলো হয়তো ওই। বালিকাদের একটি, বা দুটি, বা তিনটিই; রাশেদের রক্ত খসখস করতে লাগলো। বাঙালি মেয়েরা নিগ্রো হটেনটট জুলু বুশম্যান যার সাথে ইচ্ছে ঘুমুক, রাশেদের আপত্তি নেই; কিন্তু পাকিস্থানির সঙ্গে ঘুমটা তার রক্তে কামড় দিলো। সুদর্শন লোকটির বসার ভঙ্গি দেখেই একটু দমে গিয়েছিলো ওসি, তাকে একবার প্রশ্ন করেই থেকে গেলো। সে শক্তিমান কেউ হবে, হয়তো ছোটোখাটো কোনো ভড় হবে, তাকে বেশি প্রশ্ন করা ঠিক নয়। ওসি অশ্লীল গালি দিয়ে চলছে বাড়িঅলিকে, শক্তির ভাষা এখানে অশ্লীল হতেই হয়। রাশেদ বললো, ওসি সাহেব, আপনি এমন গালাগালি করছেন কেননা? এদের নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যান। তার কথায় বিস্মিত হলো ওসি, সে এমন আশা করে নি; সে। ভেবেছিলো রাশেদ মুগ্ধ হবে তার গালাগালিতে, তার নৈতিকতা রক্ষার পদক্ষেপকে প্রশংসা করবে, উল্লাসে রাশেদও দু-একটি গালি দেবে। সুদর্শন লোকটি এক সময়। বললো, আমাদের কোথায় নেবেন, চলুন। তারা সবাই পুলিশের সাথে বেরিয়ে গেলো।