হুইস্কি আর বিয়ারের ব্যবস্থা করেছে আবদেল; যার যা পছন্দ তুলে নিয়ে উফুল্ল হওয়ার অনুরোধ জানালো সে। একটি বিয়ারের ক্যান ভেঙে রাশেদ গেলাশে ভরলো, তাকিয়ে রইলো উপচানো ফেনার দিকে, বিয়ার উপচে পড়ার দৃশ্য সে উপভোগ করে সব সময়, জীবনপাত্র উচ্ছলিত হওয়ার চিত্রকল্পটি তার মনে পড়ে, সোনালি রঙটিও তার খুব পছন্দ। তরুণতরুণীরা নিজেদের পছন্দমতো হুইস্কি ও বিয়ার নিয়ে সোফায় আর মেঝেতে বসলো, খুব পিপাসাগ্রস্ত তারা, গলা ফেটে বিলের মাটির মতো চৌচির হয়ে আছে; একটি তরুণী নেচে নেচে গিয়ে বসলো আবদেলের কোলে। নাচতে সে যতোটা শিখেছে তার চেয়ে অনেক সুন্দরভাবে শিখেছে কোলে বসতে, জড়িয়ে ধরতে; কার কোলে বসতে হবে, তাও চমৎকার শিখেছে। এ-তরুণীদের সাথে আবদেলের সম্পর্ক। চমৎকার, সে যে-কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারে, ধরেও; তারা কিছু মনে করে না, খুশি। হয় একটু বেশি করে, তাদের প্রেমিকেরাও খুশিতে বিহ্বল হয়ে ওঠে। যে এমন পানের সুযোগ দিচ্ছে তাকে এটুকু দিতে তরুণদের বাধছে না, তরুণীরা তো দিতেই উৎসাহী। রাশেদের ভালো লাগলো যে বাঙলার ছেলেমেয়েরা এগিয়েছে, স্বাধীনতাই নিশ্চয়ই। এগিয়ে দিয়েছে, পানটান আর জড়িয়ে ধরা, আর গালে বা চিবুকে বা গ্রীবায় একটু ভেজা চুমোকে তারা আর পাপ মনে করে না, তারা তাদের বাপদাদার অপরাধবোধের মধ্যে নেই। ওই যে-মেয়েটি হাঁটছে আর খাচ্ছে, খোঁপার মতো যার বুক দুটি, তার পুরুষ বন্ধুদের নিয়ে ঘরে ঢুকতেই সে চিৎকার করে উঠবে না, মদ লইয়া আইছ, লগে লোচ্চাগোও লইয়া আইছ। মেঝেতে বসে যে-মেয়েটি হুইস্কির গেলাশে চুমুক দিচ্ছে, ওর ঠোঁটের বাঁক দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও খুব সুখ পাচ্ছে, ও কি বাসায় গিয়ে স্বীকার করবে ও হুইস্কি খেয়েছে? নাকি যখনই আজকের কথা কাউকে বলবে, তখনি বলবে আবদেলের এখানে যারা এসেছিলো তারা সবাই মদ খেয়ে চুর হয়ে গিয়েছিলো, শুধু সে একাই খেয়েছিলো কোমল পানীয়। মদদ সে একদম সহ্য করতে পারে না, কোমল। পানীয়ই তার প্রিয়। সে কি বলতে পারবে হুইস্কি সে পছন্দ করে, হুইস্কিতে খারাপ কিছু নেই? নাকি সেও হবে সেই মাগিটার মতো যে দূতাবাসগুলো চষে বেড়ায়, সব ধরনের বোতল চুষতে চুষতে শেষে দুটি ষাঁড়ের কাঁধে চড়ে বাসায় ফেরে বা ফেরে না, এবং পত্রিকায় গল্পগুজবের পাতায় লেখে পার্টিতে সে শুধু খায় একটু কোমল পানীয়, মদটদ সে একদম সহ্য করতে পারে না? রাশেদের পাশে বসেছে এক ঝকঝকে তরুণ, দাড়িও রেখেছে ঝকঝকে, তাতে তার ঝকঝকে ভাবটা আরো বেড়েছে। তার পাশে বসেছে। যে-মেয়েটি, সে নিশ্চিত তার প্রেমিকা; তারা হাত ধরে থাকছে, একটু বউ বউ ভাবও করছে মেয়েটি, ছেলেটিও একটু স্বামী স্বামী ভাব করছে। মেয়েটি কী খাচ্ছে? বিয়ার? বেশ, কিন্তু যখন এ-বালকের বউ হবে সে, তখন খেতে পারবে তো? বালক তাকে খেতে দেবে তো? নাকি তখন এ-বালক টানবে, বছর বছর মেয়েটির পেট বোঝাই করবে, মেয়েটি পানি ছাড়া কিছু ছোঁবে না, আর বালকটি বন্ধুদের নিয়ে ঘরে ঢুকলেই চিৎকার করবে, মদ লইয়া আইছ, লগে লোজাগোও লইয়া আইছ। টেলিভিশনে আজান শোনা গেলো, আজান শুনলেই রাশেদের কায়কোবাদকে মনে পড়ে, কে মোরে শুনাইল মধুর আজানের ধ্বনি। ছেলেদের কোনো বদল ঘটলো না, মনে হলো না কেউ উঠে গিয়ে অজু করতে শুরু করবে, জায়নামাজ খুঁজবে; কয়েকজন টেলিভিশনে ওই মধুরধ্বনি শুনতে শুনতে গেলাশ ভরলো। তাদের মর্মেমর্মে বেজে চলছে অন্য সুর; কিন্তু মেয়েরা। ঘোমটা দেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠলো। জিন্সের সাথে তারা ওড়নাও পরে? বাজারে কি এরই মধ্যে ওড়না-জিন্স বেরিয়ে গেছে? ব্যাগে তারা বহন করে ঘোমটা? একটি মেয়ে মাথায় দেয়ার মতো কিছু জোগাড় করতে পারে নি, সে নিজের স্তন দুটি টেনে মাথায় তুলে দিতে চেষ্টা করছে। ধর্ম ও পানের মধ্যে মিলন ঘটিয়েছে তারা, হুইস্কি ও ঘোমটায় কোনো বিরোধ নেই; তারা ঘুমাবে কিন্তু সতীত্ব বিসর্জন দেবে না। হুইস্কির কাজ হুইস্কি করবে, ঘোমটার কাজ করবে ঘোমটা। অন্ধ ধরনের একটি লোক ইসলাম, আল্লা, ও আরো অনেকের মহিমা আবেগে মেতে বর্ণনা করতে লাগলো টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে, তাকে দেখেই বোঝা যায় শোবিজ কতো প্রতাপশালী, ধর্মও শোবিজ হয়ে উঠেছে। ধর্মকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হলে শোবিজ ছাড়া উপায় নেই।-আচ্ছা বলুন। তো, রাশেদ আবদেলকে জিজ্ঞেস করলো, আল্লা কি এ-লোকটিকে পছন্দ করতে পারে? তার কথা শুনে সবাই টেলিভিশনের দিকে ভালো করে তাকালো। লোকটির মুখ ভরে কালো কালো দাগ, বড়ো বড়ো গর্ত, গালের পাশটা যেনো ছুরি দিয়ে ফালা করে কেটে নেয়া হয়েছে, কপালটা কালো ঝামা, আর সে চোখ দুটি ওপরে নিচে এমনভাবে নামাচ্ছে উঠোচ্ছে যে তাকে অন্ধ মনে হচ্ছে, তবে সে অন্ধ নয়। সে নিশ্চয়ই ভিডিওখোর, হিন্দি কোনো ক্যাসেট হয়তো বাকি রাখে নি। সে আবৃত্তি করে চলছে অতিশয়োক্তি, যে কেউ যা কেয়ামত পর্যন্ত, ঘিলু ছাড়াই, আবৃত্তি করে যেতে পারে। আবদেল বললো, আমি নিশ্চিত আল্লা একে পছন্দ করতে পারে না, প্রভুর নিশ্চয়ই সৌন্দর্যবোধ রয়েছে। আবদেল তার কোলের তরুণীটির মুখ সকলের দিকে তুলে ধরে বললো, সৌন্দর্যবোধ থাকলে প্রভু পছন্দ করবে একে। সবাই হেসে উঠতে যাচ্ছিলো, তার আগেই রাশেদের পাশের ছেলেটি চিৎকার করে উঠলো, আল্লারে লইয়া আমি ফাঁইজলামি পছন্দ করি না।। দ্যাখেন ইসলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তার চিৎকারে চমকে উঠলো সবাই, খুব বিব্রত হয়ে পড়লো তার পাশের মেয়েটি, যে হয়তো তার প্রেমিকা; আবদেলও খুব বিব্রত বোধ করলো। একটি মেয়ে বললো, ইসলাম নিয়ে ফাজলামো আমিও পছন্দ করি না। আমি মুসলমান, ইসলাম যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম তাতে কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। চোদ্দো শো বছর আগে ইসলামই প্রথম নারীদের মুক্তি দিয়েছিলো। রাশেদ চোখের সামনে একটি মুক্ত নারী দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হলো, যে চোদ্দো শো বছর ধরে মুক্ত, চোদ্দো শো বছর ধরে যে হুইস্কি খাচ্ছে, জিন্স পরছে, নাচছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো রাশেদ, সময় দেখার জন্যে নয়, শতাব্দী দেখার জন্যে; তার ঘড়িটিতে সেকেণ্ড মিনিট ঘণ্টা দিন মাস। বছর সব ধরা পড়ে, খুব দুঃখ হলো তার যে এটিতে শতাব্দী ধরা পড়ে না। একটু পরেই সে-বালকটি, যে আল্লাকে নিয়ে ফাজলামো পছন্দ করে না, সোফা থেকে গড়িয়ে পড়লো, ভক ভক করে বমি করতে লাগলো। সে এরই মাঝে পাঁচ ছটি বিয়ার আর চার পাঁচটি হুইস্কি শেষ করে দিয়েছে, রাশেদের দ্বিতীয়টিও তখন শেষ হয় নি। বমিতে সে কার্পেট ভাসিয়ে দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো, তাকে টেনে অন্য ঘরে সরিয়ে নিলো আবদেল। সবাই আবার পান করতে লাগলো, আর সে-মেয়েটি যে এর বউ হবে সে খুব অপরাধী। বোধ করতে লাগলো, পান না করে সে মেঝে পরিষ্কার করতে লাগলো। ওই শ্রেষ্ঠ ধার্মিক পান করবে, পান করতে করতে চিৎকার করবে, দ্যাখেন ইসলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। ধর্ম, আর মেয়েটি সারাজীবন ওই ধার্মিকের বমিই পরিষ্কার করে চলবে।