লোক দুটি পান করছে খুব দায়িত্বের সঙ্গে, তারা জীবনের একটি বড়ো কাজ সম্পন্ন। করছে; ঢকঢক করে খাচ্ছে, কোনো কথা বলছে না, গেলাশ ও পরস্পরের দিকে। তাকাচ্ছে, এবং রাশেদের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করছে। ঘরে আবছা অন্ধকার, অপরাধের মতো অন্ধকার, পাপের মতো অন্ধকার, পৃথিবীর সমস্ত বাঙালি ও মুসলমান পানের সময় যে-অপরাধরোগে ভোগে তার অন্ধকারে ঘরটি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। লোক দুটি ভুলতে পারছে না মদ খাওয়া পাপ, তবু খাচ্ছে, একটু বেশি করেই খাচ্ছে, ঢকঢক শব্দে তারা সমস্ত উচ্চ ও অশ্রুত শব্দকে ঢেকে ফেলতে চাইছে। লোক দুটি এখন কী দেখতে পাচ্ছে? ছেলেবেলার খেজুরগাছ, মাছের লাফ, কার্তিকের চাঁদ, লাল ঘুড়ি, কাঁচা আম, কোনো বালিকার মুখ দেখতে পাচ্ছে? অমন কিছু দেখছে না বলেই মনে হচ্ছে, তারা কোনো পতিতার নোংরা উরুর দিকে তাকিয়ে আছে বলে মনে হলো রাশেদের। তার ঝুলেপড়া স্তন দেখছে, রোগা উরু দেখছে, ভজ দেখছে, অন্ধকার দেখছে, পুঁজ দেখছে, এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। ওই মহিলা মদ খাওয়াকে এতো খারাপ মনে করে কেননা, মদ খাওয়া কি দরোজা খুলেই মদ লইয়া আইছ, লগে লোচ্চাগোও লইয়া আইছ’ বলার থেকেও খারাপ? ওই মহিলা কখনো মদ খেয়েছে, খেয়ে বুঝতে পেরেছে। খাওয়া খারাপ? নাকি শুনেই বিশ্বাস করে ফেলেছে মদ খারাপ, মদ যারা খায় তারা খুব খারাপ? রাশেদ সারা বাড়ি ভরে একটা বিকারের অজগর দেখতে পেলো, অজগরটি। পিচ্ছিল দেহ দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে এ-বাড়ি, শহর, দেশ, লোক দুটিকে, ওই মহিলাকে, এবং তাকে। লোক দুটি খাচ্ছে এবং ঝিমোচ্ছে, এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠতেই ইঞ্জিনিয়রটি বিব্রত হয়ে পড়লো, চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কে কে, এবং গলা শুনে ভয় পেয়ে গেলো। সে কাঁপাকাঁপা হাতে বোতলটি টেনে নিয়ে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেললো, পারলে নিজেও ঢুকে যেতো কার্পেটের নিচে; রাশেদের গেলাশটি টেনে নিয়ে সোফার নিচে রাখলো, তার বন্ধু ঢক করে পুরোটা গেলাশ গিলে ফেলে গেলাশটি লুকিয়ে ফেললো; এবং সে বললো, জামাই আর মেয়ে এসেছে। জামাই আর মেয়ে তো। আসবেই, যখন তখনই আসবে, শ্বশুর আর বাপের বাড়ি না গিয়ে কোথায় গিয়ে আর। তারা মরবে বাঙলায়? কিন্তু রাশেদের মনে হলো জামাই নয় শ্বশুরই এসেছে। জামাইর কাছে সে একটা প্রকাণ্ড সৎ শ্বশুর থাকতে চায়; জামাই এসেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম। করবে, সে তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করবে, চমৎকার সুন্দর থাকবে মুসলমান। সমাজ। আদবকায়দায় জামাইটিকে একটা সাচ্চা মুসলমান মনে হলো রাশেদের, কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগলো এ-বদমাশটা কোথায় খায়? নিশ্চয়ই এটা কোথাও খায়, আর ওর বউটা ওকে লোচ্চা বলে গালি দিয়ে দুই উরু চেপে শুয়ে থাকে। জামাই চলে যাওয়ার পর ইঞ্জিনিয়র আবার টেনে বের করলো বোতল আর গেলাশ, আবার ঢক ঢক করে ঢাললো। এবার তাদের দায়িত্ব অনেক, বোতল শেষ করতে হবে, ঢকঢক শব্দ উঠতে লাগলো; রাশেদ মাঝেমাঝে চুমুক দিচ্ছে এবং দেখছে লোক দুটিকে। তারা এখন। টলছে, একটু গানও গাইছে, একজন কবিতার পংক্তিও ভেঙেচুরে টেনে টেনে আবৃত্তি করলো; একদিন তাদের ভেতরেও কবিতা ছিলো। রাশেদ ঘড়িতে দেখলো বারোটা। বাজে, সে ভয় পেয়ে গেলো; তার অনেক আগেই বেরোনো উচিত ছিলো, বারোটা থেকে সান্ধ্য আইন। তখন প্রথম সামরিক যুগ চলছে দেশে, বাঙালি মুসলমান মধ্যরাতের। সান্ধ্য আইনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাশেদ অনেক দিন রাত নটার পর বাইরেই থাকে নি, তাই বুঝতেই পারে নি এরই মাঝে বারোটা বেজে গেছে, এখন রাস্তায় তার অধিকার নেই। সে অপরাধী জাতির সদস্য, তাকে যে দিনের বেলা বাইরে আসতে দেয়া হয়, রাত বারোটা পর্যন্ত পথে চলার অধিকার দেয়া হয়েছে, এইতো বেশি। কিন্তু। রাশেদকে বাসায় ফিরতে হবে; সে উঠে দাঁড়ায়। ওই লোক দুটি তখন পুরোপুরি অন্য পারে চলে গেছে, রাশেদ ভেবেছিলো সে আসি বলে বেরিয়ে পড়লে তারা খেয়ালও করবে না; কিন্তু সে উঠতেই লোক দুটি তার দু পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে, আপনি যাবেন না, আরেকটু খান, আপনি চলে গেলে মনে করবো আপনি আমাদের ঘৃণা করেন। তারা দুজনেই হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। রাশেদ পা থেকে তাদের হাত সরিয়ে আসি’ বলে দরোজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। তখনো শুনতে পায় তোক দুটি কাঁদছে, আর বলছে, আপনি আমাদের ঘৃণা করবেন না, আপনি আমাদের ঘৃণা করবেন না।
রাশেদ যখন আবদেলের রেস্টহাউজে গিয়ে পৌঁছোলো তখন সন্ধ্যে, রেস্টহাউজটিকে কোমল আবেদনময় তরুণীর মতো দেখাচ্ছে, যেনো কিছুক্ষণ পর সেও রাশেদের পাশে ব’সে বিয়ার বা হুইস্কি খাবে, নেচেও উঠবে পশ্চিমি তালে, এবং এক সময়, এগারোটা বাজার আগেই, সোফায় মাথা নিচু করে বসে বমি চাপার চেষ্টা করে চলবে। তখন তাকে আরো রূপসী দেখাবে, তার শরীর থেকে আরো তীব্র আবেদন গলে পড়তে। থাকবে। দারোয়ান মুলদরোজা খুলে দিলো, রাশেদের মনে হলো সে এক রূপসীর ভেতরে ঢুকছে, তবে এমন হেঁটে ঢোকা মানাচ্ছে না, রূপসী তাতে সুখ পাচ্ছে না; যদি তার একটি গাড়ি থাকতো, সে গাড়িটি ধীরে ধীরে চালিয়ে ভেতরে ঢুকে পশ্চিমে যেখানে ঘন সবুজের মধ্যে লাল লাল ফুল ফুটে আছে, সেখানে পার্ক করতো, তাহলে দারুণ পুলকে কেঁপে কেঁপে চিৎকার করে উঠতো রেস্টহাউজরূপসী। সে ঢুকছে হেঁটে, রেস্টহাউজটি তা বুঝতেই পারছে না, এতে রাশেদ একটু অসহায় বোধ করলো। স্বাধীনতা যে মানুষকে বিকশিত করে এ-রেস্টহাউজটিকেই তার উদাহরণ বলে মনে হয় রাশেদের; সে কখনো এমন একটা ভবনের কথা ভাবতেও পারে নি, কিন্তু বাঙালি তা। বাস্তবায়িত করেছে বলে-হয়তো ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করেই বাস্তবায়িত করেছে, কিন্তু তাতে কী আসে যায়-বাঙালি যে এর স্বপ্ন দেখেছে এবং একে বাস্তবায়িত করেছে, সেজন্যে বাঙালিকে, তার স্বাধীনতাকে সে অভিনন্দন জানালো, যেমন জানিয়েছে আগেও, যখনি সে পান করতে এসেছে আবদেলের এখানে। স্বাধীনতায় বাঙালি মুসলমানের ত্বক খুব মসৃণ আর স্পর্শকাতর হয়েছে, বঙ্গীয় গরম ওই ত্বক আর সহ্য করতে পারে না, এটাও সভ্যতার পরিচায়ক; ভাবতে ভালো লাগে রাশেদের এটার স্বাপ্নিক যে, তার। বাপদাদা হয়তো বোশেখ মাসে বোরোখেতে খালি গায়ে রোদে জমি নিডোতে নিডোতে গামছা দিয়ে বারবার গা মুছতো, বাড়ি ফেরার পথে পুকুরে ডুব দিয়ে গামছা পরেই। বাড়ি ফিরতো, আর তার উত্তরপুরুষ, স্বাধীন উত্তরপুরুষ, এখন ওই অসভ্যতা থেকে কতো দূরে। রেস্টহাউজটি তরুণীর মাংসের মতো শীততাপনিয়ন্ত্রিত। আবদেলের বয়স আটচল্লিশ বা পঞ্চাশ হবে; সে পানের জন্যে, রাশেদের মতো দু-একজন ছাড়া, ডাকে। সাধারণত আঠারো থেকে পঁচিশ বছরের তরুণতরুণীদের, যারা পান করার ব্যাপারটিকে প্রফুল্লকর করে তোলে। তরুণতরুনীদের দেহও অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর, ওদের পাশে বসলে গোপনে জীবন ঢুকতে থাকে দেহে, যেমন শেকড় বেয়ে গাছের শরীরে রস ঢোকে। কয়েক বছর আগে রাশেদ এক বুড়োর সাথে গল্প করে বিকেলের পর বিকেল কাটাতো, একদিন সে বুঝতে পারে বুড়োটি নিঃশব্দে তাকে খাচ্ছে, তার ভেতর থেকে রস শুষে নিচ্ছে, পর দিন থেকেই সে বুড়োটির সাথে দেখা করা বন্ধ করে দেয়। কয়েক দিন। পরই রাশেদ খবর পায় বুড়োটির খুব অসুখ হয়েছে, হয়তো বাচবে না; কিন্তু রাশেদ। তাকে দেখতে যায় নি, তা ভয় হতে থাকে বুড়োটি শয্যায় শুয়ে শুয়ে তাকে শুষে নিঃশেষ করে ফেলবে। রাশেদও শুষতে শিখেছে, সে যখন তরুণতরুণীদের সঙ্গ পায়, যদিও তার বয়স ছত্রিশ, সে নিঃশব্দে শোষণ করে তরুণতরুণীদের। কোনো তরুণতরুণী যতোটা জীবন নিয়ে তার কাছে আসে ততোটা জীবন নিয়ে আর ফিরতে পারে না। বসার ঘরে ঢুকেই মুগ্ধ হলো রাশেদ, এতো সুন্দর তরুণতরুণী সে একসাথে অনেক দিন দেখে নি, গাছপালার বাইরে বাঙলাদেশে যে আজো এমন সৌন্দর্য রয়েছে, তার অনেক দিন তা মনেই হয় নি; রাস্তায় আর তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তরুণতরুণীদের দেখে সে ধরে নিয়েছিলো সৌন্দর্য ছেড়ে গেছে দেশটিকে। দশ বারোটির মতো তরুণতরুণী সোফা ও মেঝেতে বসে আছে, খিলখিল করে হাসছে, মেয়েরাই খিলখিল করছে বেশি, গড়িয়ে পাশের তরুণের গায়ে ঝরে পড়ছে, তাদের চুল বাহু গাল চিবুক থেকে সৌন্দর্য ঝরছে। বাদ্য বাজছে, দু-তিন জোড়া তরুণতরুণী নাচছে, তাদের আন্দোলন ও আলিঙ্গন সারা ঘরে অসম্ভব সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। চোখে এসে। আগুনের মতো ঢুকছে তাদের পোশাক, পোশাক উপচে এসে চোখে ঢুকছে তাদের মাংস; বিশেষ করে মেয়েদের বাহু ও বুকের তাতাথৈথৈ সারা ঘরটিকে উত্তেজনায় টানটান করে তুলেছে। আবদেল একটা বড়ো রকমের সংবর্ধনা জানালো রাশেদকে, এটা আবদেলের আরেকটা গুণ, সে মানুষের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয় সহজে।