আবদেল মদটদ খাওয়ায় মাঝেমাঝে; এটা তার এক মস্ত গুণ, বাঙলায় কে কাকে। খাওয়াতে অর্থাৎ পান করাতে চায়? আহা রাশেদ মুসলমান আহা রাশেদ বাঙালি আহা। রাশেদ বাঙলাদেশি, আর মদদ হচ্ছে মুসলমানের স্বপ্নের ও দুঃস্বপ্নের জিনিশ। মুসলমানের পক্ষে কি মদের কথা ভুলে থাকা সম্ভব? না, বারেকের, তাদের গ্রামের চাষী, কথা মনে পড়ছে রাশেদের; সে হয়তো কখনো মদের কথা ভাবে নি, নাকি তার মনেও পড়তো মদের কথা? একবার শ্রীনগরে রথযাত্রা দেখতে গিয়ে নাকি সে কেমন কেমন। করেছিলো, বারবার ভেঙে ভেঙে জড়িয়ে জড়িয়ে পাশের বাড়ির এক হিন্দু বিধবার নাম করেছিলো, হু হু করে কেঁদেছিলো? রাশেদ যে বাঙালি মুসলমান ভাইদের গোত্রের, তারা আল্লাকে ভুলে থাকতে পারে। তবে আজকাল একটু বেশি করেই তার নাম নিচ্ছে যদিও মনে রাখছে না, কিন্তু ওই বস্তুটিকে ভুলে থাকতে পারে না। মুসলমান ভাইরা মদ খায় বা খায় না, খেতে পায় বা পায় না, কিন্তু কখনো মদের কথা ভুলে থাকতে। পারে না। যে-মুসলমান ভাই মদ খায় সেও মাতাল, যে খায় না সেও মাতাল, একটু বেশি করেই মাতাল। রাশেদ ও তার চারপাশের ভাইরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত; ওই শ্রেষ্ঠ ধর্মটি এসেছে যে-মরুভূমি থেকে, সেখানকার কিছু আধুনিক বেদুইন ভাইকে। সে দেখেছে, তারা উটের মতো গেলে; পার্থক্য হচ্ছে উট একবার গেলার পর অনেক দিন গেলার কথা ভাবে না, আর আধুনিক বেদুইন ভাইরা দিনরাত গিলতে না পারলে চারদিকে মরুভূমি দেখে, আর মুখ খুললেই বলে হারাম। জিনিশটি নিয়ে তার শ্রেষ্ঠ ধর্মে তো সমস্যা রয়েছেই, তার মহান বাঙলা ভাষায়ও সমস্যা রয়েছে; এতে হুইস্কি বিয়ার ওআইন সবই মদ। রাশেদ পছন্দ করে হুইস্কি আর বিয়ার; এগুলো চমৎকার। জিনিশ, যা আছে বলে যেমন মেঘ বা পাবদা বা পুকুরপাড়ে লাউয়ের জাংলা, জীবনকে জীবন মনে হয়। তবে এটা নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ কেননা? মুসলমানের জন্যে মদ নিষিদ্ধ কেননা? মুসলমানের জন্যে নিষিদ্ধ হওয়ার কথা শুধু গন্ধম, ওটাই তো খেতে নিষেধ করা হয়েছিলো স্বর্গে, ওই জ্ঞানটুকুই তো শুধু নিষিদ্ধ, মদ নিষিদ্ধ কেননা? মদ কি কোনো জ্ঞান? কিন্তু নিষেধ কে মানে? ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে নিতে ক্লান্ত আর ঘুষ। খেয়ে খেয়ে ব্যাংক ভরে ফেলেছে যে-মুসলমান বাঙালি ভাইরা, দখল করে ফেলেছে। গুলশান বনানী ধানমণ্ডি বারিধারা উত্তরা, যারা মতিঝিলে আমদানিতে তোপখানায়। দেশের উন্নতিতে উত্তরপাড়ায় দেশরক্ষায় তন্দ্রাহীন, তারা সবাই কমবেশি হুইস্কি বিয়ার টানে, এবং বলে হারাম। একটু ভণ্ডামো করতে হয়, একই সাথে বাঙালি ও মুসলমান হলে একটু ভণ্ডামো না করলে চলে না। কেরামত আলি, রাশেদের এক বন্ধু, পকেটে সব সময় পেয়ারাপাতা রাখে। চাপে পড়ে মানুষ আবিষ্কারক হয়, সেও হয়েছে; সে বের করেছে পেয়ারাপাতা চিবোলে হুইস্কির গন্ধ কেটে যায়, সঙ্গমের সময়ও তার স্ত্রী গন্ধ পায় না, যদিও তার স্ত্রীর গন্ধশক্তি প্রবল; টেলিফোনেও সে মদের গন্ধ পায়, কেরামতকে জিজ্ঞেস করে, মদ খাইছ, গন্ধ পাইতাছি; তাই পানের পর আধঘণ্টা ধরে কেরামত পেয়ারাপাতা চিবোয়, পানও চিবোয়, এবং বাসায় ফিরে বউর সাথে এমন ভাব করে যেনো দিনটা সে বায়তুল মোকররামে কাটিয়েছে, পুরস্কার হিশেবে এখন তার প্রাপ্য একটা প্রথম শ্রেণীর সঙ্গম।
সোনার বাঙলায় প্রাণ ভরে পান করে, গেলে, চোরারাই; ওদের টাকা আছে, আর ওরা গেলে ব’লেই পানের এতো সুনাম। সোনার বাঙলা সব কিছুকে বিকারে, পাপে, অপরাধে পরিণত না করে শান্তি পায় না। প্রেমও এখানে পাপ, বড়ো অপরাধ, জেনার সমান, জোগাড় করারও কঠিন যেমন কঠিন এক বোতল হুইস্কি জোগাড় করা। রাশেদ একবার কেনার চেষ্টা করে দেখেছে সে ছোটোখাটো একটা চোরাকারবারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, যেনো সে সাংঘাতিক অপরাধ করে চলছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সে শুনেছিলো। চোরাদের ক্লাবের দারোয়ানদের কাছে জিনিশটা পাওয়া যায়, তাই একবার গিয়েছিলো; দারোয়ানটা তার সাথে চল্লিশ মিনিট ধরে ফিসফিস করেছিলো, মনে হচ্ছিলো সে পথনারী ভাড়া করতে গেছে, তারপর রিকশা করে একটি গলিতে নিয়ে বলেছিলো, টাকা দ্যান। রাশেদ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলো টাকা নিয়ে এটা আর ফিরবে না। তাই পানের জন্যে কেউ একটু ডাকলেই সে স্বস্তি পায়, যেমন ডাকে আবদেল। রাশেদ আমলা আর কালোবাজারিগুলোকে চেনে, দু-চারটার সাথে খেয়েও দেখেছে, সেগুলো। পকেট থেকে একটা সিগারেটও বের করে না, অন্যেরটা দশ মিনিট পরপর অন্যমনস্ক অসাধারণ ভঙ্গিতে তুলে নেয়, যেনো নিয়ে কৃপা করছে। মদ ওগুলো একা একা বাসায় ব’সে গেলে, কেনে না, পায় কোথাও থেকে, গিলতে গিলতে বউর সঙ্গে ঝগড়া করে আর গিলে গিলে পাকস্থলি পচায়। বাঙলার বউগুলোও পাকা জিনিশ, ভাতারের হাতে মদের বোতল বা মুখে একটু গন্ধ পেলেই তারা পা থেকে মাথা পর্যন্ত সতীসাধ্বী হয়ে। ওঠে, মুখ থেকে পাড়ার ভাষা বেরোতে থাকে, কয়েক দিনের জন্যে সমস্ত সুড়ঙ্গে তালা লাগিয়ে দেয়। ওদের বাসায় গিয়ে মদ খেতে ভালো লাগে না রাশেদের, লুকিয়ে বেশ্যাবাড়িতে ঢুকে তাড়ি খাওয়ার জলবায়ু তাকে ঘিরে ধরে। একবার একটার বাসায় গিয়েছিলো সে, গিয়েই মনে হয়েছিলো সে কয়েকটা দালালের সঙ্গে বেশ্যাবাড়িতে ঢুকে গেছে, পুলিশ দিয়ে ঘেরাও হয়ে পড়েছে। রাশেদের থেকে পনেরো বছরের বড়ো হবে, একটা ইঞ্জিনিয়র আরেকটা মতিঝিলের ব্রিফকেস, পরিচয়ের দু-দিন পরেই রাশেদকে বাসা থেকে তুলে নেয়, এবং ইঞ্জিনিয়রটার বাসায় ঢুকতে গিয়েই পতিতাপল্লীর জলবায়ুতে পড়ে রাশেদ। দরোজা খুলেই তার পরিবার খ্যাকখ্যাক করে ওঠে, মদ লইয়া আইছ, লগে লোচ্চাগোও লইয়া আইছ। মহিলা খ্যাকখ্যাক করতে থাকে, কলেজের ছাত্র প্রথম বেশ্যাবাড়িতে ঢুকতে গিয়ে যেমন গলির মুখে এসে ভয় পায়, ঢুকবে কি ঢুকবে না করতে থাকে, একটু ঢুকতেই একপাল বেশ্যার আক্রমণে গলি থেকে পালানোর চেষ্টা। করে, কিন্তু পারে না, তেমনি অবস্থা হয় রাশেদের। ইঞ্জিনিয়রটি তার স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঠেলতে ঠেলতে শয্যাকক্ষে নিয়ে যায়, বাইর থেকে দরোজা বন্ধ করে দেয়। রাশেদ আরেকটি ঘরে একটি কিশোরী ও একটি তরুণীকে দেখতে পেয়ে অত্যন্ত অপরাধবোধগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু ড্রয়িংরুমে ঢুকতে বাধ্য হয়। ইঞ্জিনিয়রটি আধময়লা কয়েকটি গেলাশ ও একটি পানির বোতল নিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে, ঢকঢক করে হুইস্কি ঢালে, আর শয্যকক্ষ থেকে তার স্ত্রী চিৎকার করতে থাকে। রাশেদ বারবার। লোচ্চা, লোচ্চা শব্দ শুনতে পায়। রাশেদের হাতের সবুজ গেলাশটিতে পুঁজ জমে উঠতে থাকে, পোকা থকথক করতে থাকে, বেশ্যার পচে-যাওয়া জিভ থেকে থুতু এসে পড়তে থাকে। রাশেদ দাঁড়িয়ে বলে, আমি যাই, কিন্তু লোক দুটি তার হাত ধরে মাফ চাইতে থাকে। বলে, কিছু মনে করবেন না, একটু খান, যাবেন না। তখন দুজনকেই চমৎকার মানুষ মনে হয় রাশেদের; কিন্তু রাশেদ ভুলতে পারে না শয্যাকক্ষে আটকে রাখা হয়েছে একটি মহিলাকে, যে লোজ্জা লোচ্চা চিৎকার করছে, এবং পাশের ঘরে দুটি মেয়ে তাকে ঘেন্না করছে, তাকেই ঘেন্না করছে বেশি।