তখন বিকেল, একটি চৌরাস্তায় সে গাড়ি থেকে নামলো। সারাদিন বাসায় যায় নি, সবাই হয়তো তাকে নিয়ে ভয় পেতে শুরু করেছে, সে আরেকটুকু গুরুত্বপূর্ণ হলে খোঁজাখোজি পড়ে যেতো এরই মাঝে; সে নিশ্চিত তাকে নিয়ে তেমন কিছু শুরু হয় নি। হয়তো মৃদু আর বাবা তার কথা একটু বেশি বলছে। আরো কিছু সময় বাইরে থাকার তার ইচ্ছে হলো, সামরিক আইন উপভোগের, বাইরে হেঁটে হেঁটে, সাধ জাগলো তার। পথে পথে ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, কোনো কোনো ট্রাকে ভয় দেখানোর মতো অস্ত্রপাতি সাজিয়ে ওরা বীরের মতো যাচ্ছে, বিদেশি বিদেশি দেখাচ্ছে ওদের; আর রিকশায় বা হেঁটে, এমনকি গাড়িতে যাচ্ছে যারা, তাদের লাগছে শূদ্রের মতো, যেনো তারা নগরে অধিকারহীন ঢুকেছে। লিলি তাকে এ-চৌরাস্তায় নামিয়ে দেয়ার পর রাশেদ একটিও নারী দেখে নি, সে দাঁড়িয়ে রিকশাগুলোতে নারীর মুখ খোঁজার চেষ্টা করলো, কিন্তু একটিও নারী দেখতে পেলো না। শহর থেকে কি পালিয়ে গেছে নারীরা, রাস্তা কি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তাদের জন্যে? একাত্তরেও রাস্তায় তাদের দেখা যেতো না, বারান্দায়ও না; তাদের শাড়িও শুকোতে হতো ঘরের ভেতরে, তেমনি হয়ে গেছে আজ? এই যে আমি দাঁড়িয়ে আছি, রাশেদ ভাবলো, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, নারী দেখার চেষ্টা করছি, জলপাইরঙের ট্রাকের দিকে তাকাচ্ছি, এটা কি সিদ্ধ, এটা কি কোনো নির্দেশের মধ্যে পড়ে না? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখার ভেতরে নিশ্চয়ই অভিসন্ধি থাকে, মানুষ শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, কোনো অভিসন্ধি থাকলেই মানুষ একা একা কোনো চৌরাস্তায়, বাজারের গেইটে, বা কোনো গাছের নিচে দাঁড়ায়, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। একবার সে একটি মেয়ের জন্যে বোশেখের দুপুরে একটি গাছের নিচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো, মেয়েটি আসছিলো না, আর রাশেদের মনে হচ্ছিলো প্রত্যেকটি গাড়ি আর রিকশা তার। মনের অভিসন্ধি জেনে ফেলছে, এখনি কেউ এসে তাকে ধমক দিয়ে বলবে, মেয়েটিকে। আজ তুমি চুমো খাবে না। দাঁড়িয়ে থাকলেই মাথায় চক্রান্ত আসে, এই যেমন রাশেদের মাথায় নানা চক্রান্ত আসছে। এখন যদি ট্রাক থেকে ওই বিদেশি বিদেশি জলপাইরঙটি নেমে তাকে বলে সে চক্রান্ত আটছে, উত্তর দিকে একটা আপত্তিকর আবেগ চালনা। করছে, তাহলে কি সে অস্বীকার করতে পারবে? বোঝাতে পারবে সে চক্রান্ত করছে না, শুধু ঘৃণা করছে, আর ঘৃণা এমন আবেগ যা চালনা করা যায় না, যা অক্রিয়? ঘৃণা করা কি সিদ্ধ সামরিক আইনে? রাশেদ হাঁটতে শুরু করলো, এবং তাকে দেখলো; প্রথম খুব অচেনা অদ্ভুত লাগলো, জলপাইরঙের শহরে তাকে দেখার আশা করে নি রাশেদ। সে। একটি পাখি। অনেক দিন রাশেদ পাখি দেখে নি, দেখার কথা ভাবেও নি; কিন্তু ছোটো একমুঠো পাখিটার বুকের শাদারঙ দেখে বুকে কাঁপন বোধ করলো রাশেদ। এটা নিশ্চয়ই দোয়েল, সে ভাবলো। দোয়েলটির জন্যে এখানে একটা আমগাছ থাকা উচিত। ছিলো, তাতে সবুজ পাতা থাকা উচিত ছিলো; কিন্তু নেই, দোয়েল দেয়ালের ভাঙা হঁটের ওপর বসে আছে। দোয়েলটির জন্যে আম গাছ নেই, এটা বেশ স্বাভাবিক; দোয়েলটিরই তো থাকার কথা নয় এখানে। তবু সে এখানে কেনো? এই শহরে কেনো? সামরিক আইনের মধ্যে শহরের এই চৌরাস্তার পাশের দেয়ালে কেনো? রাশেদ দেয়ালটির আরেকটুকু কাছে আসতেই দোয়েল উড়ে একটু দূরে সরে গিয়ে আবার বসলো, হয়তো। বসতো না, বসেছে ভালোভাবে উড়তে পারছে না বলে। ওর ডান ডানাটি কি ভাঙা, কয়েকটা পালক খসে গেছে ডানা থেকে? রাশেদ আবার এগোতেই আবার উড়তে চেষ্টা করলো দোয়েল, রাশেদ দেখলে খুব কষ্ট হচ্ছে তার উড়তে।
তার দিকে তাকিয়ে আছে দোয়েল, তবে দোয়েলের চোখ অতোটা দূর থেকে রাশেদ দেখতে পাচ্ছে না; এটা যদি তার ছেলেবেলা হতো তাহলে হয়তো দোয়েলের চোখ দেখতে পেতো, ওই চোখে কিসের ছায়া পড়েছে, তাও হয়তো দেখতে পেতো। দোয়েল। নিশ্চয়ই দেখছে রাশেদকে, এবং দূরে দাঁড়ানো ট্রাকটিকে। দোয়েল কি বুঝতে পারছে রাশেদের সাথে ট্রাকের কোনো সম্পর্ক নেই, রাশেদ ট্রাক থেকে নেমে আসে নি? দোয়েলের ডানা ভাঙলো কী করে? একেবারে ভাঙে নি, ভাঙলে একেবারেই উড়তে। পারতো না; কিন্তু ভেঙেছে কোথাও। রাশেদের দেখতে ইচ্ছে হলো কোথায় ডানা ভেঙেছে দোয়েলের। এদেশে কি পাখির ডানার চিকিৎসা হয়? সে যদি পাখিটিকে নিয়ে হাসপাতালে যায়, কোনো ক্লিনিকে ঢেকে চিকিৎসার জন্যে, তাহলে কেউ কি তাকে। মানবিক ভাববে, সবাই কি তাকে পাগল ভাববে না? রাশেদ আবার এগোলো দোয়েলের দিকে, দোয়েল উড়ে উড়ে ঢুকে পড়লো আঠারোতলা দালানটির ভেতর। রাশেদও দরোজা খোলা দেখে ভেতরে ঢুকে দোয়েল কোথায় গেলো দেখার চেষ্টা করলো, দেখলো দোয়েল বসে আছে সিঁড়ির হাতলে। সিঁড়ির হাতল কি দোয়েলের বসার জন্যে উপযুক্ত? ওটা কচি আম গাছের ডাল হলে ভালো হতো। রাশেদ দোয়েলের দিকে যেতেই দোয়েল উড়ে দোতলায় গিয়ে বসলো। কোথাও কেউ নেই, সবাই চলে গেছে, প্রত্যেকটি ঘর মসৃণভাবে বন্ধ; শুধু আছে দোয়েল আর সে। রাশেদ যতোই দোয়েলের দিকে যায়, ভাঙা ডানার দোয়েল ততোই উড়ে তেতলা থেকে চারতলার সিঁড়িতে ওঠে, চারতলা থেকে পাঁচতলার সিঁড়িতে ওঠে; হাতলে বসে একটু জিরোয়, বিষণ্ণ চোখে তার দিকে তাকায়। দোয়েল ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, রাশেদও কি ক্লান্ত হয় নি? দোয়েলের তবু ভাঙা ডানা রয়েছে, রাশেদের তাও নেই; দশতলার সিঁড়িতে এসে রাশেদের পা। কংক্রিটের মতো শক্ত হয়ে গেলো, যে বসে পড়লো ক্লান্ত মূর্তির মতো। দোয়েলের দিকে তাকাতে গিয়ে রাশেদ দেখলো সামনে পুকুর, পাড়ে বাঁশঝাড়, হিজলের সারি; পুকুরের জল তিরতির করে কাঁপছে। একপাশে কচুরিপানার ঘন সবুজ। পুকুরের জলে এক কিশোরী ডুব দিচ্ছে, ডুব দিতে দিতে কিশোরী এক কিশোরের দিকে এগিয়ে। আসছে। তারা দুজনেই ডুব দিলো, ডুব দিয়ে তারা একে অন্যকে ছুঁলো, গালে গাল ছোঁয়ালো, তারপর দূরে গিয়ে ভেসে উঠলো। রাশেদ তাকিয়ে দেখে দোয়েলটি নেই। কোথায় গেলো ভাঙা ডানার পাখি? রাশেদ সিঁড়ি বেয়ে ওপর থেকে ওপরে উঠতে লাগলো, কিন্তু কোথাও দোয়েল নেই। রাশেদ উঠতে উঠতে ছাদে গিয়ে পৌঁছোলো, মাথার ওপরে আকাশ কিন্তু কোনো দোয়েল নেই। ছাদ থেকে সে সারিসারি ট্রাক। দেখতে পেলো, যেগুলোকে জঙ্গল বলেই মনে হলো তার। তার তলপেটের প্রপাতটি উষ্ণ হয়ে উঠেছে, গর্জন করতে শুরু করেছে, যেনো তার তলপেট ছিদ্র করে সহস্র জলপ্রপাত হয়ে বেরিয়ে পড়বে। আশ্চর্য, এতোদিনের জমাট প্রপাত গলগল করে। বেরিয়ে পড়ার জন্যে ব্যর্থ হয়ে পড়েছে। রাশেদ কিছুতেই চেপে রাখতে পারছে না, ভেতরে বরফফাটার শব্দ হচ্ছে অনবরত। রাশেদ উত্তর দিক করে দাঁড়ালো, তার জিন্সের জিপ খুলে প্রপাতের মুখ বাড়িয়ে ধরলো, এবং প্রবল গর্জন করে তার ভেতর থেকে প্রস্রাব না অনন্ত ঘৃণাধারা যেনো নির্গত হতে লাগলো।
মুসলমান ও মদ্য ও গোলাপি সাপ
সন্ধ্যায় তার ওখানে, গুলশানের এক রেস্টহাউজে যেখানে সে থাকে, পানের নিমন্ত্রণ করেছে আবদেল, যার সাথে রাশেদের পরিচয় হয় বছর দুয়েক আগে এক পানের আসরে। তাদের সম্পর্ক যে নিবিড়, প্রতিদিন বা প্রতিমাসে যে তাদের দেখা হয়, তা নয়; দেখা হয় তাদের পান উপলক্ষেই, বিশেষ করে যখন আবদেল এরকমভাবে হঠাৎ নিমন্ত্রণ করে। তারা এক প্রজাতির নয়, আকস্মিকভাবেই তারা কাছাকাছি এসেছে; পানশালায় তো কতোজনেরই মুখোমুখি বসতে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ নানা অভিনব, সামগ্রী উৎপাদন করেছে, স্বাধীনতা সব সময়ই সৃষ্টিশীল হয়ে থাকে; আবদেল তারই একটি, ও তার নামের মতোই চমকপ্রদ। বাঙালি মুসলমানের নামগুলো বুর্জোয়াদের। জন্যে বিব্রতকর, মোহাম্মদ আহাম্মদ আবদুল কেরামত বেজায়েত আকিদুল মোহব্বত চোখে ঝোঁপঝোঁপ দাড়িপুটির দৃশ্য জাগিয়ে তোলে চোখে, তবে ওগুলোকে একটু কাতচিৎ করে নিলে বেশ লাগে; আবদুল বললে ভৃত্য মনে হয়, আর আবদেল বললে মনে হয় শীততাপনিয়ন্ত্রিত আমলা/বলপয়েন্টপিচ্ছিল সাংবাদিক/মতিঝিলের মসৃণ ব্রিফকেস। তারা বন্ধু নয়, হয়তো হবেও না কখনো, চুম্বকের মতো তারা টানে না পরস্পরকে; কিন্তু আবদেলের সাথে দেখা হলে রাশেদ কয়েক ঘণ্টা নষ্ট করতে প্রস্তুত থাকে, কয়েক ঘণ্টা তুচ্ছতায় নষ্ট করেও তার অনুতাপ হয় না, তখন পানটুকুকেই মনে হয় অর্জন; আর আবদেল পছন্দই করে সময় নষ্ট করতে, অন্তত সময়কে সে মূল্যবান। মনে করে না। সে সাধারণত ডাকে পান করতে, পানের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না; বাঙলার সবুজ মরুভূমিতে এক গেলাশ বিয়ার, একটুকু হুইস্কি বেশাখি বৃষ্টির মতো সুখকর। ভাঁড়রা চারদিক খটখটে করে তুলেছে, গাছপালার দিকে তাকালেও চোখে। কোনো রস ঢোকে না, মেঘের দিকে তাকালে মনে হয় ঝামাপাথর উড়ছে উত্তর দক্ষিণ। পুব পশ্চিম আকাশ জুড়ে; তবে ভাঁড়দের পেট অবশ্য খটখট করছে না, সেখানে নিশ্চয়ই শ্রাবণধারা চলছে হুইস্কির, বন্যায় পেট উপচে হয়তো দামি কার্পেট ভাসিয়ে দিচ্ছে। রাশেদের রক্তে একটা খটখটে ঝমাঝামা ভাব এসে গেছে; রাস্তায় রাস্তায় ট্রাক দেখে। দেখে ঘেন্না ধরে গেছে, তাই আবদেলের ডাক মেঘের ডাকের মতোই মধুর লাগলো। আবদেলের ওখানে পানের সুবিধা হচ্ছে সেখানে সতীগৃহিণীর দোররার নিচে পাপিষ্ঠের মতো পান করতে হয় না। পান করতে করতে যদি মিনিটে মিনিটে মনে পড়ে পাপ করছি, বাড়িঅলি যদি মাঝেমাঝেই ড্রয়িংরুমে এসে স্বামী ও সঙ্গীদের একরাশ ইতর শব্দ উপহার দিয়ে যায়, এবং গালাগাল করতে থাকে পাশের ঘর থেকে, তাহলে পুরো। জলবায়ুই ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে, মনে হয় পাড়ায় বা মেথরপট্টিতে বসে ব্যাটারিভেজানো তাড়ি খাচ্ছি। সতী গৃহিণীদের ভাষা এতো চমৎকার যে মনে হয় তারা অন্তত বছর। দশেক পাড়ায় কাটিয়ে এসেছে। আবদেলের রেস্টহাউজে সে-ঝামেলা নেই, সেখানে। কোনো সতী নেই; আবদেলের বউ থাকে বিদেশে, আগে সে আবদেলের একাধিক বন্ধুর বউ ছিলো, এখন আবদেলের; আবদেলের থেকে সে পাঁচসাত বছরের বড়ো, এখন। আবদেলের বা সত্যিই আবদেলের কিনা তা জানে না রাশেদ, তবে তার শরীরটা একান্ত আবদেলের নয়, যেমন আবদেলেরটাও সম্পূর্ণ তার স্ত্রীর নয়। কোনো কিছু, দেহ বা রাষ্ট্র যা-ই হোক, সম্পূর্ণরূপে কারো অধিকারে থাকা খুবই অস্বস্তিকর। আবদেলও বিদেশেই থাকতো, দু-দশক ছিলো, চলে এসেছে, বউ আসে নি; বাঙালি মেয়েরা বিদেশে গেলে সাধারণত ফিরতে চায় না। এটা অবশ্য রাশেদের ভালো লাগে। ওই নারী, যে আবদেলের স্ত্রী, যাকে দেখে নি রাশেদ, কখনো দেখবে না, যার বয়স হয়তো এখন। চুয়ান্নো, তাকে কি বউ বলা যায়? স্ত্রী বলা যায়? বলবে কি পরিবার, যেমন ছেলেবেলায় বুড়োদের মুখে সে শুনেছে? আবদেলের পরিবার আবদেলের সাথে থাকে না বলেই সে এতো আকর্ষণীয়।