যখন বেরোচ্ছে রাশেদ, রিকশা খুঁজছে, রিকশাঅলারা আগের মতোই তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না; কোনো-না-কোনো ছাত্রীকে তুলে খুশিতে চলে যাচ্ছে; একটা রিকশা গেলো তারই পাড়ায়, তার ডাক শুনতেই পেলো না রিকশাঅলা, শুনলেও আর সে আট টাকা ভাড়া দিতে চাইলেও রিকশাঅলাটা এমনভাবে মুখ ফেরাতো যেনো সে একটা। পচা জন্তু, যাকে ওই পবিত্র রিকশায় তোলা যায় না, কিন্তু পাঁচ টাকায় মেয়েটিকে নিয়ে সে খুশিতে চলে গেলো-এতো খুশি যে ট্রাকের নিচে পড়বে মনে হচ্ছে, তবে নতুন সামরিক যুগের প্রথম সপ্তাহে হয়তো বাঙালি মুসলমান ট্রাকড্রাইভারও আইন মেনে চলছে; পরিত্যক্ত হলেও রাশেদের ভালো লাগলো যে সৌন্দর্যের ডাকে আজো এ-ভূখণ্ডের মানুষ সাড়া দেয়। তখন গাড়িটা এসে থামলো রাশেদের পাশে, বেরিয়ে এলো লিলি। বিলেত থেকে লিলি কখন ফিরেছে রাশেদ জানে না, লিলিকে দেখলে রাশেদ বুঝে ফেলে তার জীবনের কয়েক ঘণ্টা অপচয় হয়ে গেলো। কোনো নারীর পাশে ব’সে জীবন অপচয়ের বোধ যে জাগতে পারে, এটা রাশেদ আগে বিশ্বাস করতো না, কিন্তু লিলির সাথে পরিচয়ের পর তার মনে এ-মৌলিক বোধটি জন্ম নিয়েছে, যদিও লিলিকে সে পছন্দ করে। দেখা হলেই লিলি প্রথমে তার জীবনপাঁচালির কিছু স্তবক ধীরে ধীরে শোনায়, অনেকগুলো পরিকল্পনার কথা বলে, যেগুলো সে কখনোই বাস্তবায়িত করবে না, যা আধঘণ্টায় করে ফেলার কথা তা কয়েক ঘণ্টা ধরে সে করে বা করে না, এবং রাশেদকে ছাড়ে না। পাঁচ-ছ বছরের বড়ো লিলি এবং পাঁচ-ছ বছর আগে লিলির সাথে পরিচয় হয়েছে রাশেদের; এক সময় যে লিলি রূপসী ছিলো, তা তার শরীর আজো স্থানে স্থানে অকুণ্ঠভাবে প্রকাশ করে। লিলি আজো পুরুষ পছন্দ করে, সব সময় কোনো-না-কোনো পুরুষ পাশে রাখতে তার ভালো লাগে, হয়তো আজ কাউকে সংগ্রহ করতে না পেরে রাশেদের খোঁজে এসেছে বা এসেছে যে-কোনো একটা পুরুষের খোঁজে, এবং রাশেদকে পেয়ে গাড়ি থামিয়েছে। লিলি ডাক দিলে সচিবালয়। থেকে গোটা দশেক, মতিঝিল থেকে গোটা পনেরো, রাজনীতিক দলগুলো থেকে গোটা পাঁচেক ভাইয়ের উন্নয়নপ্রকল্প, আমদানিরপ্তানি, চোরাচালান, আর গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র। ফেলে ছুটে আসার কথা, কিন্তু আজ সেগুলো হয়তো নিজেদের লুকিয়েছে বা নিষ্ঠার সাথে মেনে চলছে সামরিক আদেশ, তাই লিলি একটিও পুরুষ পায় নি। সামরিক আইন এলে প্রথমে পুরুষের আকাল দেখা দেয়। লিলি তাকে টেনে গাড়িতে তুলে জানালো যে শহীদ ভাইকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে; সে যাচ্ছে শহীদ ভাইয়ের বাসায়, রাশেদকেও যেতে হবে। শহীদ একটা পাকা আমলা, আস্ত হারামজাদা, সেটার পাছায় দুটো বন্দুক ঢুকিয়ে দেয়া হলেও রাশেদের পক্ষে সামান্য দুঃখ পাওয়া অসম্ভব, বরং রাশেদ অনেকের মতোই সুখ পাবে; ওটা মারা গেলেও রাশেদের কিছু আসে যায় না, এমনকি ওটার জানাজায় গিয়ে পুণ্য কামানোরও কোনো ইচ্ছে তার হবে না, কিন্তু লিলিকে এড়ানো অসম্ভব। লিলিও ওটাকে দেবতা মনে করে না, শয়তানই মনে করে; অনেক বছর ধরে দেখাও নেই, কিন্তু কাতরতা তার স্বভাব, শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী দুঃখের। মধ্যেও লিলিকে দেখলে ক্ষেপে উঠতে পারেন, কেননা তার বিশ্বাস শহীদ যেমন লিলিকে ছাড়ে নি তেমনি লিলিও শহীদকে ছাড়ে নি, তবু আজ লিলি কেমন কেমন বোধ করছে শহীদ ভাইয়ের জন্যে, তাই শহীদ ভাইয়ের বাড়ি তাকে যেতেই হবে। রাশেদের জন্যে। বিব্রতকর হচ্ছে একটা হারামজাদার বাসায় যাওয়া, যা ওই হারামজাদাটা কোনোদিন। জানবেও না। ওর বাসায় গিয়ে দেখা গেলো খুব কষ্ট পাওয়ার চেষ্টা করছে শহীদের। বউটি, ক্যান্সারে যার মরে যাওয়ার কথা ছিলো বছর দুয়েক আগে, কিন্তু কষ্ট খুব পাচ্ছে না, পঞ্চাশ বছর বয়সে স্বামীর জন্যে কষ্ট পাওয়া খুবই কঠিন দায়িত্ব। হারামজাদাদের বউগুলো দুঃখকষ্টের চমৎকার ফ্যাশন আয়ত্ত করেছে দু-দশকে, ওরা দুঃখে গলে পড়ে, ওদের শাড়ি খসে পড়ে, ওদের স্তনবৃত্ত দিগ্বলয়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে, নিরাসক্ত দর্শকদের কাছে দৃশ্যটা হয়ে ওঠে এক্সএক্স ছবি দেখার মতোই উপভোগ্য। রাশেদ সামরিক আইনের কল্যাণে একটু দূরে বসে একটি এক্সএক্স ছবি উপভোগ করতে লাগলো।
হারামজাদার বউটাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো আরেকটা হারামজাদার বউ। সে হারামজাদাটাকে অবশ্য এখনো মিলিটারিরা ধরে নি, হয়তো ধরবে না; সেটা আমলাগিরি ছেড়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে কোটিপতি হয়েছে, এবং দেশেও নেই, সাধারণত থাকে না। লিলি যখন তার স্বামীর অর্থাৎ কলিম ভাইয়ের সংবাদ জানতে চাইলো, তখন কলিম ভাইয়ের বউ বললো, খানকিমাগিটা আবার দেশে এলো কবে? তার কাছে লিলির দেশে ফেরা দেশ মিলিটারিদের দখলে চলে যাওয়ার থেকে অনেক বিপজ্জনক, লিলির বিদেশে থাকাও কম বিপজ্জনক নয়, তার হারামজাদাটা বিদেশে গেলেই লিলির সাথে গড়িয়ে আসে বলে তার বিশ্বাস। আমলাগুলোর বউরা, যৌবন যাদের এখন মাংসের বদলে প্রসাধনের করুণার ওপর নির্ভরশীল, বিপন্ন এটা জানে। রাশেদ; সুযোগ পেলেই ওরা ছোটো আমলাদের বউগুলোকে রেস্টহাউজে তোলে, শরীরটা সুস্বাদু হ’লে একদিন যার জন্যে আত্মহত্যা করতে চাইতো সেটাকে তালাক দিয়ে ছোটো আমলার বউটাকে ঘরে তোলে, ছোটো আমলাটা আরো ছোটোটার বউ ভাগায়। কলিমের বউটাও কলিমের ভাগানো বউ, সলিম না কার বউ ছিলো বছর দশেক, কলিম তাকে ভাগিয়ে এনেছে, আর লিলি কলিমকে একবার প্রায় ভাগিয়ে নিয়েই গিয়েছিলো, আরেকটুকু হলেই কলিম, তার কলিম আর তার কাছে ফিরতো না, সে-দাগটা বেশ তাজা রয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তার ভাষা; কয়েকবারই লিলিকে। সে খানকি, বেশ্যা বলে পরোক্ষ সম্বোধন করলো, কিন্তু লিলি, এ-সতীদের থেকে অনেক মার্জিত ও মানবিক, শুধু বললো, আপনার ভাষা আজকের জন্যে শোভন নয়। কলিমের স্ত্রীর ভাষা তাতে আরো সাধ্বী হয়ে উঠলো, লিলির গোপনতম প্রত্যঙ্গের নাম ধরে। জানালো যে তার ওই প্রত্যঙ্গটির ক্ষুধা মিটবে না। শহীদের স্ত্রী তখনো কষ্ট পাওয়ার জন্যে অধ্যবসায় করে চলেছে, কষ্টের এক ফাঁকে জানালো ওরা শহীদকে একটা মাঠের মধ্যে ফেলে রেখেছে, একটা বালিশও নেই, মশার কামড়ে সে কালো হয়ে যাচ্ছে, এমনকি তাকে একটা বদনাও দেয়া হয় নি। বালিশ, মশারি, বদনার মতো বস্তুর কথা শুনে রাশেদ বিস্মিত হলো; রাশেদের ধারণা ছিলো ওই হারামজাদাদের জীবনে এসবের কোনো ভূমিকা নেই, ওরা এসব চেনে না, চেনে শীততাপ, গাড়ি, লন্ডনপ্যারিস, হুইস্কি, সুন্দর সুন্দর নারী। সামরিক শাসনের সূচনায় এগুলোই হয়ে উঠেছে শহীদের মতো একটা আমলার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? এক বোতল ব্ল্যাকলেবেল না চেয়ে সে চেয়েছে একটা বদনা, এর চেয়ে নির্মম পরিহাস আর কী হতে পারে? বউটি বলে চলছে, একটা মশারি কেনা দরকার, একটা বালিশ আর একটা বদলা কেনা দরকার, কিন্তু সে এখন উঠতে পারছে না, বাজারে গিয়ে সে এসব কিনবে, সে-শক্তি তার নেই। কলিমের বউটা এতে কান দিচ্ছে না, সে এসব শুনতেই পাচ্ছে না; তার জীবনে এখনো বালিশ-মশারি-বদনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে নি, বরং এসব শব্দ শুনতে খুবই ঘিনঘিনে লাগছিলো তার। রাশেদ বুঝতে পারছিলো সামরিক শাসন তার জীবনে এক কৌতুককর শোকনাটক হয়ে দেখা দিতে যাচ্ছে, বউটি বদনাবালিশ বলার সময় বারবার তাকাচ্ছে। রাশেদের দিকে, অর্থাৎ সামরিক আইনে ধরা-পড়া একটা বদমাশের জন্যে বদনা কেনাই হয়ে উঠতে যাচ্ছে তার নিয়তি। কিন্তু বউটা কোনো টাকাপয়সা বের করছে না, রাশেদকে কি বদনাবালিশ নিজের পয়সায়ই কিনে আনতে হবে? আমলাদের বউগুলোও বেশ পাকা আমলা, রাশেদকে দিয়ে রাশেদের পয়সায় বদনা কিনিয়ে ছাড়বে একটা হারামজাদার জন্যে, হারামজাদাটা যখন মাঠের ঝোপে বসে বিড়ি টানতে টানতে পাছায় পানি ঢালবে, তখন জানবেও না বদনাটা রাশেদের পয়সায় রাশেদের কেনা। সমাজ, রাজনীতি, উত্থান, পতন সত্যিই জটিল ব্যাপার, কার বদনার পানি কে কোথায় ঢালে। রাশেদ অবশ্য জানে লিলি ব্যাগ খুলবে, সে আন্তরিক হতে জানে, এবং তাই হলো। রাশেদ বেরোলো বদনা, মশারি, বালিশ কিনতে; কিন্তু সে কি জানে কোথায় মেলে। এসব, অনেক বছর ধরে এসব তো তারও অভিজ্ঞতার বাইরে। ছাত্রজীবনে সে মশারি কিনতে গিয়েছিলো সদরঘাটে, আজো সেখানে যাবে নাকি? তার মনে পড়লো। নিউমার্কেটের কথা, লিলির গাড়িতে চেপে সে বদনা কিনতে বেরোলো, বুঝতে পারলো রাশেদ যে সামরিক আইনের হাত বেশ দীর্ঘ, ওই হাত ছেলেবেলায় তাকে দিয়ে জঙ্গল সাফ করিয়েছে, আজ তাকে দিয়ে বদনা কিনোচ্ছে একটা বদমাশের জন্যে, কালকে হয়তো একটা বেশ্যার ট্যাম্পুন কিনোবে। তার তলপেটে যে-প্রপাত জমে আছে, বদনা কিনতে কিনতে মনে হলো, ওই প্রপাত কংক্রিটের মতো জমে যাচ্ছে, কোনোদিন বেরোবে না, কিন্তু চাপ দিতে থাকবে অনবরত।