রাশেদ যে-রিকশাটায় বসে আছে, যে-রিকশাঅলা তাকে টানছে, তার পাশ দিয়ে যে-গাড়িগুলো যাচ্ছে, দোকানে দোকানে ঝুলছে যে-সাইনবোর্ডগুলো, আর যে-বাঙালি মুসলমান দু-দিন পর রাস্তায় বেরোনোর অধিকার পেয়েছে, তারা বেগম হাওয়ার জরায়ু থেকে বেরোনোর পর থেকেই অধিকারহীনতায় অভ্যস্ত বলে মনে হচ্ছে রাশেদের। তাদের পিঠে চাবুকের দাগ, দাগ তাদের চোখে সুন্দর অলঙ্কারের মতো, চাবুক তাদের কাছে সুখকর। রিকশাঅলাটিকেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে রাশেদের যে সে মুক্তি বা স্বাধীনতার কথা জানে কিনা, সে হয়তো মুক্তিযুদ্ধের কথা জানে বা শুনেছে, কিন্তু মুক্তির কথা জানে না; টয়োটায় সামরিক বিধিনিষেধ মেনে চলে গেলো যে-লোকটি, তার মুখ দেখে তো মনে হলো না কয়েক দিন আগে তার একটা বড়ো সম্পদ ছিলো, এখন সে তা হারিয়ে ফেলে নিঃস্ব হয়ে গেছে। কারো মুখ দেখেই তা মনে হচ্ছে না। সে যখন। তার প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে গিয়ে পৌঁছোবে, রাশেদের ভয় হতে লাগলো, সেখানে। সবার এতো উল্লাস দেখবে যে সেও উল্লসিত হয়ে উঠবে, সে ভুলে যাবে তার জন্মজন্মান্তরের পিঠের দাগটিকে; ওই বিদ্যালয়ের সামনে অতিকায় যে-মূর্তিগুলো রয়েছে, রাশেদের আরো বেশি ভয় করতে লাগলো যে সেগুলোর মুখেও সে কোনো কষ্ট দেখতে পাবে না, দেখতে পাবে উল্লাস। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের চা-ঘরটিতে খুব ভিড়, উল্লাসে ফেটে না পড়লেও কাঁপছে ঘরটি, কালো যে-ছেলেটা অন্যান্য দিন বিকলাঙ্গের মতো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চা আর শুকনো বিস্কুট পরিবেশন করে, যাকে চা নিয়ে আসতে বলাটাকে অপরাধ বলে মনে হয় রাশেদের, সেও খুব উৎপর হয়ে উঠেছে, মনে। হয় তার আরেকটা পা গজিয়েছে; অধ্যাপকেরা হিশেব নিচ্ছে কে কে উপদেষ্টা হয়েছে, কে কার আত্মীয়, কে কার সাথে ইস্কুলে পড়তো। খুব মূল্য পাচ্ছে এক বুড়ো সহকারী অধ্যাপক, যে দশ বছর ধরেই খুব বিমর্ষ ছিলো পদোন্নতি না পেয়ে, আজ সে খুব উল্লসিত, সবাই তাকে ঘিরে ধরেছে, সেও গৌরবে গোশল করে নিচ্ছে এজনো যে তার একটা ভাগ্নে জেনারেল, এবং এখন খুব শক্তিশালী পুরুষ, দু বা তিন নম্বরেই আছে, বলা যায় না এক নম্বরেও উঠে যেতে পারে। মামা ভাগ্নের গুণ কীর্তন করে চলেছে শুনে মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে অধ্যাপকদের, আর রাশেদ খুব বিস্মিত হচ্ছে যে জেনারেলেরও। কীর্তনযোগ্য গুণ থাকতে পারে। ম্যাকআর্থার নামের একটা জেনারেলের নাম মনে পড়লো, যাকে বরখাস্ত করার কারণ হিশেবে তার দেশের রাষ্ট্রপতি বলেছিলো, সে একটা নির্বোধ কুত্তারবাচ্চা বলে তাকে আমি বরখাস্ত করি নি, যদিও সে তা-ই, তবে নির্বোধ কুত্তারবাচ্চা হওয়া জেনারেলদের জন্যে কোনো অযোগ্যতা নয়; তাকে বরখাস্ত করেছি, কেননা সে রাষ্ট্রপতিকে মানছে না। একটা ঝড়দার, অর্থাৎ একটা প্রাক্তন ভাড়ের। উঠোনটুঠোন পরিষ্কার করার কাজ করেছিলো যে-অধ্যাপকটি, তাকে খুব প্রফুল্ল দেখাচ্ছে; সে হয়তো আবার ঝাড়দারের বা জুতোশেলাইয়ের কোনো কাজ পাবে, হয়তো সে এরই মাঝে ভাঁড়দের পায়ে সেজদা করে এসেছে; মুখ থেকে তার ঝিলিক। বেরোচ্ছে।
কারো চোখেমুখে কোনো উদ্বেগ নেই, সবাই যার প্রতীক্ষায় ছিলো তার আগমনে স্বস্তি পাচ্ছে, স্নায়ু থেকে ভার নেমে গেছে। পতন দেখতে বাঙালি মুসলমানের খুবই ভালো লাগে, রাশেদ ভাবলো, একটাকে ঠেলে ফেলে, শুধু ঠেলে ফেলে নয় কবরে। ঢুকিয়ে দিয়ে, আরেকটা আসে, এবং যে আসে আর যেতে চায় না, মনে করে সে-ই মালিক, তখন আরেকটা আসে আগেরটাকে ঠেলে ফেলে, কবরে ঢুকিয়ে দিয়ে। আগেরটাও যে সরল পথ দিয়ে এসেছিলো, তা নয়; এখানে কেউ সরল পথে আসে না, সরল পথে আসার উপায় নেই, আসতে হয় পতন ঘটিয়ে। আমরা, রাশেদ ভাবলো, বাঙালি মুসলমানেরা কারো উত্থানে সুখ পাই না, অন্যের উত্থান হচ্ছে নিজের পতন, আমরা সুখ পাই কারো পতনে, শক্তিমানের পতনে। শক্তিমানগুলো এখানে নিখাদ শয়তান, একটা শয়তানকে ধংস করে আরেকটার প্রাদুর্ভাব ঘটে, আরেকটা এসে তার গর্ত খোড়ে, এমনই দেখে আসছে এ-জাতি, মনস্তাত্ত্বিকভাবে এরই জন্যে তৈরি বাঙালি মুসলমান। চা চলছে খুব আর চলছে কোলাহল, পতিত শয়তানদের একেকটির কেলেঙ্কারির রগরগে বর্ণনায় মুখর সবাই। কাকে কাকে ধরা হয়েছে পেশ করা হচ্ছে। সে-তালিকা, কে কত কোটি টাকা মেরেছে তারও হিশেব দেয়া হচ্ছে। কাম আর টাকা, টাকা আর কাম হচ্ছে প্রধান বিষয়, টাকা আর কামের কথা বলার সময় তাদের সারা শরীর উত্তেজিত হয়ে পড়ছে, তারপর স্খলিত হওয়ার মতো শিথিলতার ভাব। জাগছে; রাশেদ জানে এ-দুটি ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের ক্ষুধা মেটে নি। কেউ যে নতুন ভাঁড়রা এসেছে বলে উৎসব করছে, এমন নয়, তবে পুরোনোগুলো যে ধ্বংস হয়েছে, তাতেই স্বস্তি বয়ে যাচ্ছে রক্তনালি দিয়ে, যদিও অচিরেই তাদের রক্তে অস্বস্তি ডিম, ছাড়তে শুরু করবে। বাঙালি মুসলমান পতনসম্ভোগী জাতি, পতনই তাদের বেঁচে থাকার খাদ্য; এদের যখন পতন ঘটবে, তখনও সুখ পাবে এ-জাতি। পতন প্রচুর দেখা হয়েছে, পতন এখানে নারকীয় বিভীষিকার মধ্যে দিয়েও আসে, মুসলমানের ইতিহাসে যা নতুন নয়, শোচনীয়ও নয়; এ-জাতির রক্তের মধ্যে রয়েছে বিভীষিকার জন্যে মোহ।