ভাঁড়রা যে আসবে, অনেকখানি এসে গেছে, এটা অজানা ছিলো কার, এর জন্যে অপ্রস্তুত ছিলো কে? কয়েক দিন আগেও যেখানেই গেছে রাশেদ, যার সাথেই কথা বলেছে, সে-ই কি সব কথার মধ্যে মাঝেমাঝে বলে নি দেশের যে-অবস্থা তাতে মিলিটারি আসাই ভালো? যে-আমলা ঘুষ খেতে খেতে চর্বির জন্তুতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেও যেমন বলেছে কুত্তারবাচ্চাদের অর্থাৎ ওই একপাল মন্ত্রীর থেকে মিলিটারি অনেক ভালো, ঘুষ যে-জীবনে চোখে দেখে নি বলে স্বপ্নেও দেখে নি, সে-শিক্ষকও বলেছে শুয়োরগুলোর থেকে মিলিটারিই ভালো। রাশেদ রিকশাঅলাদের সাথে কথা বলে দেখেছে, সে মাঝেমাঝেই রিকশাঅলাদের সাথে কথা বলে ক্লান্তি কমিয়ে আনে বা সে যে সাধারণ মানুষের দরদী এটা নিজেকে বোঝাতে চায়, তারাও বলেছে মিলিটারিই ভালো। কয়েক দিন আগে এক বন্ধুর উপপত্নীর বাসায় সন্ধ্যা কাটাতে গিয়েছিলো, তাদের সামনে বসে সারাক্ষণ ঝিমোচ্ছিলো কালোবাজারি স্বামীটা, বন্ধুটি টেলিফোন করতে যাওয়ার ছুঁতোয় পুব কোণার শয্যাকক্ষে গিয়ে মৃদু মৃদু চুমো খেয়ে আসছিলো তার অধ্যাপিকা উপপত্নীকে, যে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাশেদকে বলছিলো, রাশেদ ভাই, আপনার কতো সুখ, হাঁটতে হাঁটতে আপনি কতো কথা ভাবতে পারেন; আমি যেখানে যাই গাড়িতে যাই কোনো কথা ভাবার সময়ই পাই না, বহুদিন আমি কিছুই ভাবি না, সেই পঞ্চাশী তন্বীও বলেছিলো, এর চেয়ে মিলিটারিই ভালো। তার স্বামীটি–কার। থেকে, আমার থেকে?–ব’লে রসিকতা করতে গিয়ে খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিলো, কেননা মহিলা মুহূর্ত দেরি না করে বন্ধুটির নাম করে বলেছিলো, তোমার থেকে তো রফিক সাহেবও উত্তম। পতির থেকে উপপতি সব সময়ই উত্তম, পত্নীর থেকে উপপত্নী যেমন আবহমান কাল ধরে উত্তম। যেগুলোকে তাড়িয়ে ওরা এসেছে, রাশেদ তাদের প্রায় প্রত্যেকটিকেই চেনে, কারো কারো সাথে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল তার, যদিও অনেক দিন যোগাযোগ নেই, ওইগুলো যে একেকটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা বাঙলার মূর্খ জনগণেরও তাতে সন্দেহ ছিলো না। যদি চাষী, রিকশাঅলা, মাঝি, জেলে, শ্রমিকের কোনো ক্ষমতা থাকতো, তাহলে তো তারা ওগুলোকে ধরে ফাঁসিতে ঝুলোতে অনেক আগেই; ক্ষমতা ছিলো না বলে, তারা যেহেতু শুধুই ক্ষমতার উৎস, হারামজাদারা ক্ষমতার পরিণতি, তারা ওগুলোর জন্যে তোরণ বানিয়েছে, ওদের নামে ভিড় করে শ্লোগান দিয়েছে। বুড়ো আলুর বস্তাটিও ছিলো অস্থিতে অস্থিতে গিঠে গিঁঠে বদমাশ, কোনো-না-কোনো প্রভুর পা চেটেছে সারাজীবন, এবং উঠতে উঠতে সকলের মাথার ওপর উঠে গিয়েছিলো। এখন আলুর বস্তার মতো নিজের ঘরে পড়ে আছে, সেটা মরলে একটা লাশ ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতো না। লাশ এখানে অত্যন্ত মূল্যবান, কিন্তু ওর লাশের মূল্য একটা কুকুরের লাশের থেকে একপয়সাও বেশি নয়।
সামরিক ভাঁড়রা যদি পারতো, তাহলে সান্ধ্য আইনেই ঢেকে রাখতে আকাশ-মাটি-জল চিরকালের জন্যে, অন্তত ওরা যতোদিন থাকবে ততোদিন ধ’রে, কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে দু-তিন দিনে যাকে ধরার, ধরে, যাকে মারার, মেরে, এবং যাকে চাকর বানানোর, তাকে চাকর বানিয়ে সান্ধ্য আইন তুলে নেয়। রাশেদের প্রস্রাব এখনো জমে আছে তলপেটে, রাশেদ এর নাম দিয়েছে শাশ্বতপ্রস্রাব, তা নিয়ে বাইরে বেরোয়। সবাই বলবে সে একা বেরোচ্ছে, রাশেদ জানে একা বেরোচ্ছে না, তার সাথে বেরোচ্ছে তার ওই অদ্ভুত স্তব্ধ প্রপাতটি, যা সে প্রচণ্ড চেপেও বের করে দিতে পারছে না। একটু অচেনা লাগছে সব কিছু যদিও কিছুই অচেনা নয়, রাস্তাগুলো যেনো তাকে দেখে একটু লজ্জা পাচ্ছে, সেও লজ্জা পাচ্ছে রাস্তার মুখের দিকে তাকাতে; মনে হচ্ছে–সান্ধ্য আইনের আড়ালে চোখের আবডালে ওরা সম ও বিষম সব ধরনের মৈথুন করে করে জীর্ণ হয়ে পড়েছে। বেরিয়েই রাস্তায় চোখে পড়লো ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, তবে ওরা খুব বীরের মতো দাঁড়িয়ে নেই, দেশকে উদ্ধার করে ফেলেছে এমন ভাব হেলমেটে ও গোঁফে কিছুতেই দানা বাঁধাতে পারছে না, অপরাধের চিহ্নই স্পষ্ট লেগে আছে ওদেরউর্দিতে। মুদি দোকানদারটা আগের মতোই হাসছে, তবে একটু বিব্রত ও কথায় একটু পরিহাসের ঝাঁজ; রিকশাঅলাটা পা চালাচ্ছে, আর বাঁকা হয়ে মিলিটারি ট্রাকের দিকে তাকিয়ে হাসছে। রাশেদ যাবে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, যেখানে রাশেদ পড়ায়; অন্যরা সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে করে, নামও বিশ্ববিদ্যালয়; রাশেদের কাছে ওটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ই। সে ওটাকে কেননা মনে করে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভালোবেসে, না ঘেন্নায়, তা ভালো করে সেও জানে না; তবে বিদ্যালয়ের কথা মনে হলেই তার মনে পড়ে যায় বাল্যকালের কবরঘেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে, যেখানে গিয়ে তার আবার ভর্তি হতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তা সম্ভব নয় বলে এটাকেই মনে করে তার প্রাথমিক বিদ্যালয়। কেনো যেনো তার মনে হয় মুসলমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানায় না, মানায় মাদ্রাসায়, যেখানে দেড় হাজার বছর ধরে সব কিছু মুখস্থ করে ফেললেও জ্ঞানের জ-ও জন্মে না। রাশেদ আশা করেছিলো দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছে শহর, চোখ মেলে তাকাতে পারছে না, কাঁদতে কাঁদতে ব্লাউজ উপচে তার প্রকাণ্ড স্তন বেরিয়ে পড়েছে, এমন ভাব দেখবে শহরের শরীরে; কিন্তু শহরের দেহের সহ্যশক্তি দেখে মুগ্ধ হলো রাশেদ। লোকজনের মুখে একটু বিনীত বিনীত ভদ্র ভদ্র ভাব চোখে পড়লো রাশেদের, চৌরাস্তার ভিখারিটাও একটু বিনয়ের সাথে ভিক্ষা চাইছে, সবাইকে একটু ক্লান্ত সুন্দর লাগছে, হয়তো দু-তিন দিনের সান্ধ্য আইনের সুযোগে পেট ভরে সঙ্গম করে তারা নতুন বরের মতো শ্রান্ত। সুন্দর হয়ে উঠেছে। মাস দশেক পর দলে দলে জন্ম নেবে সামরিক শিশুরা। সামরিক আইন এলে বাঙালি মুসলমান প্রথমে খুব শান্তশিষ্টসুন্দর হয়ে ওঠে, এবারও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। রিকশার পাশ কেটে একটা লাল গাড়িতে একটা গোলগাল রাজনীতিবিদকে যেতে দেখলো রাশেদ, তার মুখও শান্তসুন্দর; হয়তো সে ভড়দের। সাথে দেখা করে ফিরলো, বা দেখা করতে যাচ্ছে, বা দেখা করার সুযোগ না পেয়ে বিষণ্ণতায় সুন্দর হয়ে উঠেছে।