হোহামিওপ্যাথি করাই। এটা ঠিক সারবার অসুখ নয়।
জানি। আমার ছোট বোনটার আছে।
লোকটাকে লক্ষ করে চয়ন। বেঁটে মতো, স্বাস্থ্যটা পেটানো, মাথায় একটু টাক আর গোঁফ, রংশানা কটা আর মুখে একটা সদাশয় ভাব আছে। বেশ লোক।
কোন দিকে যাবেন?
সাউথে। সাউথ তো অনেক বড়। সাউথে কোথায়?
গোলপাকের কাছে। সেখানেই বাড়ি?
না, টিউশনি করতে যাই।
এ অবস্থায় সেখানে গিয়ে কি হবে? পড়াতে পারবেন?
পারব। আজ আর অজ্ঞান হবে না। দিনে একেবারের বেশী হয় না।
তার মানে কি দিনে একবার করে হয়? তাহলে তো সাংঘাতিক কথা!
না, রোজ হয় না। এক দুই সপ্তাহ পরে হয়। কখনও তারও বেশী গ্যাপ যায়।
আমার বোনটার মতোই। কি করেন।
টিউশনি।
আর কিছু নয়? না।
আর কি করব?
আমি সাউথের দিকেই যাব। আমার সঙ্গে যেতে পারেন।
তারও দরকার নেই। একাই পারব। একটু রেস্ট নিলেই হবে।
আপনার স্ট্যামিনা আছে মশাই। আমার বোনটার যেদিন অ্যাটাক হয় সারাদিন আর উঠতে পারে না। শুয়ে থাকতে হয়।
আমার শুয়ে থাকলে চলে না।
তা বলে—লোকটা একটু ইতস্তত করে কথাটা অসমাপ্ত রাখে।
চয়ন চোখ বুজে ঘন ঘন বড় শ্বাস নিতে থাকে। একমাত্র বড় বড় শ্বাসই তাকে তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক করে তোলে। একটু সময় লাগে, এই যা।
লোকটি দাঁড়িয়ে আছে এখনও। দয়ালু লোক। চয়ন চোখ মেলতেই বলে, কিছু খাবেন? এ সময়ে একটু গরম দুধটুধ খেলে ভাল হয়। কিন্তু দুধ এখানে বোধহয় পাওয়া যাবে না। অন্য কিছু খাবেন?
চয়ন লাজুক মুখে মাথা নেড়ে বলে, না না। এখন কিছু খেতে পারব না।
খুব দুর্বল লাগছে?
একটু লাগে।
পকেটে একটা নাম-ঠিকানা লেখা কাগজ রাখবেন। এপিলেপটিকদের ওটা রাখা দরকার।
চয়ন জবাব দেয় না। নাম-ঠিকানা লেখা কাগজ পকেটে রাখলেই বা কি লাভ হবে? কলকাতার পথচারী জনসাধারণের ওপর তার আস্থা অনেক বেশী। পথেঘাটে এই রকম প্রায়ই হয় তার। তবু দুবারের বেশী তার পকেটের টাকা-পয়সা খোয়া যায়নি। গেছেও সামান্যই। সেটা না ধরলে কলকাতার অনাত্মীয় জনসাধারণই তার দেখভাল করেছে। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে মাথা কিছু পরিষ্কার হল। লোকটা তার মুখের দিকে নিবিড় চোখে চেয়ে আছে। একটু লজ্জা করছে চয়নের লোকটি একটু বেশীই দয়ালু। সে বলল, এবার আর ভয় নেই। আমি চলে যেতে পারব।
আমিও দক্ষিণেই থাকি। যাদবপুরে। একসঙ্গে যেতে আপত্তি আছে?
লাজুক চয়ন বলে, না না, আপত্তি হবে কেন? তবে টাক্সির দরকার নেই।
দরকার থাকলেও পাওয়া যাবে কিনা সেটাই বড় কথা। আপনি আর একটু জিরিয়ে নিন বরং। এখনও হাঁফাচ্ছেন। টিউশনিতে কি আজ না গেলেই নয়?
কাল আর ছাত্রীর পরীক্ষা। না গেলে কথা হবে।
ছাত্রীর বাবা খুব কড়া ধাতের বুঝি?
লজ্জিত চয়ন মাথা নেড়ে বলে, তা নয়। তবে টিউটরের তো অভাব নেই। সামান্য কারণে হয়তো ছাড়িয়ে দিতে পারে।
কটা করছেন।
তিনটে।
আমি আপনার মতো বয়সে দিনে ছ-সাতটা করতাম। ভাল রোজগার ছিল। পরে হোম টিউটোরিয়াল খুলি। এখন চাকরি করি বলে টিউটোরিয়াল তুলে দিতে হয়েছে। আসুন, অন্তত একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক। তাতেও খানিকটা কাজ হবে আপনার।
লোকটার কজির ঘড়িটা বিরাট বড়। সেটা লক্ষ করছিল চয়ন। সাড়ে ছটা বাজে। আর দেরী করলে যাওয়াটা অর্থহীন হয়ে যাবে। সে মাথা নেড়ে বলে, আমার দেরী হয়ে যাবে।
বলতে একটু কষ্ট হল তার। লোকটা তার জন্য এতটা দরদ দেখাচ্ছে, মুখের ওপর না বলতে লজ্জা করছে। কিন্তু উপায় নেই।
লোকটা বুক পকেট থেকে একটা ছোটো নোটবই বের করে বলে, আপনার ঠিকানাটা অন্তত দিন। একজন সাধুর একটা মাদুলি পেয়েছি। বোনটাকে ধারণ করিয়েছি গত পরশু। যদি উপকার পাওয়া যায় তবে আপনাকেও একটা জোগাড় করে দেবখন। কতরকম মিরাক আছে মশাই। কী থেকে কী হয় কে জানে। আমার ঠিকানাটাও জেনে রাখুন। এই যে এল. আই. সি. বিল্ডিংটা দেখছেন এর চারতলায় মেশিন ডিপার্টমেন্টে আমি চাকরি করি। আশিস বর্ধন আমার নাম। এবার আপনার ঠিকানাটা আমায় বলুন।
চয়ন ঠিকানাটা বলল। তারপর অতিশয় সংকোচের সঙ্গে জানাল, বাড়িটা আমার দাদার। সেখানে—
সেখানে কী?
মানে সেখানে আমার বন্ধু বা পরিচিতরা ঠিক ওয়েলকাম নয়। আমি যদি বাড়িতে না থাকি তবে আমার বউদি খুব একটা পাত্তা দেন না।
লোকটি হাসল, বুঝেছি। আপনি কোন সময়টায় অ্যাভেলেবল?
দুপুরবেলাটায় থাকি। বেলা বারোটা থেকে তিনটে।
লোকটা নোটবই পকেটে রেখে বলল, আশা করি আবার দেখা হবে। আপনি সংকোচ বোধ করছেন, নইলে আপনাকে গোল পার্ক অবধি পৌঁছে দিতাম। চলি।
লোকটা বোধহয় তাকে রেহাই দিতেই ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। যেন একটু স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। মানুষের ভালবাসা, সহানুভূতি গ্রহণ করতে আজকাল তার লজ্জা হয় না বটে, কিন্তু খুব বেশীক্ষণ সে সইতে পারে না। শুধুই নতমস্তকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে যেতে যেতে সে আজকাল হীনমন্যতায় ভোগে। মানুষের জন্য উল্টে যদি কিছু করতে পারত্ব সে!
ভাগ্যক্রমে পরের বাসটা দু মিনিটের মধ্যেই পেয়ে গেল চয়ন। কষ্ট করেই সে এল. নাইন বাসের দোতলায় উঠল। এ বাটা এসপ্লানেডে কিছুটা ফাঁকা হয়। ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন থাকলে বসার জায়গা পেয়েও যেতে পারে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার। পর জ্ঞান ফিরলে তার বড় ঘুম পায়। এখন পাচ্ছে। চোখ জুড়ে আসছে বারবার। বসতে পারলে সে একটু ঘুমিয়ে নেবে।
আশিস বর্ধন নামটা তার মনে থাকবে। সে সহজে কিছু ভোলে না। না নাম, না মুখ। তার স্মৃতিশক্তি চমৎকার। কিন্তু লোকটা যদি হুট করে তাদের বাড়িতে হাজির হয় তাহলে অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তার একজন উপকারী বন্ধু তার আরও বেশী উপকার করতে উপাঁচক হয়ে তাদের বাড়িতে গিয়ে অপমানিত হয়ে আসবে ভাবতেই সে সংকোচে মরে যাচ্ছে।