একটু নামতে দিন! একটু নামতে দিন দাদা! কাতর কণ্ঠে একথা বলতে বলতে চয়ন প্ৰাণপণে চেষ্টা করছে দরজার দিকে যেতে। দরজা বেশী দূরেও নয়। তিন চার ফুটের মধ্যে। তবু মনে হয়েছে কী ভীষণ দূর।
নামবেন! তা এতক্ষণ কী করছিলেন। বলে কে একজন ধমক দেয়।
বাধ্য হয়েই চয়ন তার অভ্যস্ত মিথ্যে কথাটা বলে, আমার বমি আসছে ভীষণ! একটু নামতে দেবেন।
এই কথাটায় বরাবর কাজ হয়। বমিকে ভয় এবং ঘেন্না না পায় কে? ভীড়ের মধ্যে একটু ঢেউ ঢেউ খেলে যায়। মানুষের শক্ত শরীরগুলো নমনীয় হয়ে যেতে থাকে।
যান দাদা যান! তাড়াতাড়ি এগিয়ে যান।
অনেক সময় হয়, এই কাপন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ভোলা হাওয়ায় দম নিলে কাঁপটা ধীরে ধীরে কমে যায়। সেটা কুচিৎ কদাচিৎ। কিন্তু অভ্যাসবশে চয়ন এই অবস্থাটা দেখা দিলেই খোলা হওয়ার দিকে ছুটে যায়।
আজ কোনও সৌভাগ্যসূচক দিন নয় তার। স্টপে নেমেই সে বুঝতে পারে, বা হাত ঝিঁঝি ধরার মতো অবশ হয়ে আসছে। কঁপন ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। সে চোখে কুয়াশা দেখছে। শ্ৰবণ ক্ষীণ হয়ে এল। সে একজন অস্পষ্ট পথচারীকে বলল, দাদা, একটু হেলপ করবেন? আমি এপিলেপটিক
কে শুনল বা বুঝল কে জানে? ডান হাতটা বাড়িয়ে সে একটা কিছু ধরার চেষ্টা করল। কিছু ধরল কিনা বোঝা গেল। না। তবে এ সময়টায় তার সব শক্তি জড়ো হয় ডান হাতের মুঠোয়।
এ সময়ে তার ডান হাত বড় বিপজ্জনক। মুঠো করে কিছু ধরলে আর তা ছাড়ানো যায় না, যতক্ষণ না জ্ঞান ফিরছে। একবার অজ্ঞান হওয়ার মুহূর্তে সে কণিকার ডান হাত চেপে ধরেছিল। তারপর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। কণিকার আতঙ্কিত চিৎকারে বাড়ির লোক ছুটে আসে এবং দৃশ্যটা দেখে তারাও ভয়ংকর ঘাবড়ে যায়। মুঠো থেকে কণিকার কজি ছাড়াতে না পেরে তাদের কেউ কাপড় কাঁচার কাঠের মুগুড় দিয়ে মেরে চয়নের ডান হাত ভেঙে দিয়েছিল।
ভাঙা হাত জোড়া লেগেছিল যথাসময়ে। চিকিৎসার খরচও দিয়েছিল কণিকার অভিভাবকেরা। কিন্তু টিউশনিটা ছাড়তে হয়েছিল চয়নকে। দেড়শ টাকার টিউশনি।
এখন সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের ভিড়ে সেরকমই কিছু আবার ঘটতে পারত। মুঠোয় কিছু ধরতে পারেনি ভাগ্যিস। জ্ঞান হারানোর আগে সেই ক্ষীণ সান্ত্বনা নিয়ে সে খাড়া থেকে কাটা গাছের মতো পড়ে গেল।
তারপর কুয়াশা আর কুয়াশা। একটা রেলগাড়ির ঝন ঝন শব্দ। তারপর সব মুছে যাওয়া।
জ্ঞান ফেরার পর বেশীর ভাগ সময়েই সে একটা পরিচিত দৃশ্য দেখতে পায়। চারদিকে মানুষের পা। অনেক ওপরে। মানুষদের মুখ। অনেক মুখ। সব কটা চোখ তার ওপর নিবদ্ধ। আর টের পায়, তার মাথা মুখ সব জলে ভেজা। ভেজা জামায় জল, ধুলো, কাদা।
কলকাতায় এবার বৃষ্টি হচ্ছে খুব। ফুটপাথের জল সহজে শুকোয় না। একটা ছোট্ট জমা জলের গর্তে তার মাথাটা পড়েছে আজ। পা থেকে চপ্পল খসে পড়েছে কোথায়!
কে যেন বলল, কেমন লাগছে? উঠতে পারবেন?
মানুষকে তার খুব খারাপ লাগে না। এদের মধ্যে ভাল আছে, মন্দ আছে, দয়ালু আছে, উদাসীন আছে। কিন্তু কোনও মানুষ হঠাৎ এরকম পড়ে গেলে সকলেই জড়ো হয় চারপাশে। সবাই খারাপ নয়, এটাই যা একটা ভাল ব্যাপার।
চয়ন তার দুর্বল শরীর শোয় অবস্থা থেকে টেনে তোলে, আগে লজ্জা করত। আজকাল তেমন লজ্জা করে না। এরকম তার অভ্যাস হয়ে গেছে।
একজনের দিকে চেয়ে সে স্তিমিত গলায় জিজ্ঞেস করে, কটা বাজে?
সোয়া ছটা।
তার মানে মোহিনীদের বাড়িতে যাওয়ার সময় নেই নাকি? যাওয়াটা খুব দরকার। মোহিনীর কাল ইংরজি সেকেন্ড পেপারের পরীক্ষা। মোহিনীর বাবা গত পরশু একটু হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন।
সে উঠে বসার পর ভিড়টা পাতলা হচ্ছে।
কে একজন তার হাতের ওপরের দিকটা ধরে বলল, উঠতে পারবেন তো! তাহলে ধীরে ধীরে উঠে পড়ন।
পারল চয়ন। আগে পারত না। আজকাল পারে। বাধ্য হয়ে পরতে হয়। তবে এই সময়টা এত দুর্বল লাগে যে মাথাটা অবধি ঘাড়ের ওপর লটপট করতে থাকে। হাত পা সব অবশ। শরীর জুড়ে ঝিঁঝির ডাক।
আমাকে ওই দেয়ালটায় ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিন।
পারবেন তো?
পারব। আমার প্র্যাকটিস আছে।
বলবান লোকটি তাকে দেয়ালের গায়ে দাঁড় করিয়ে বলে, ট্যাক্সি নেবেন?
উদ্বেগের মাথায় চয়ন তাড়াতাড়ি বলে, না না। ট্যাক্সি লাগবে না।
বাড়ি যাবেন কি করে?
চয়ন বাড়ির কথায় শিহরিত হল। তার যদি সেরকম একটা বাড়ি থাকত যেখানে অসুস্থ শরীরে ট্যাক্সি নিয়ে গিয়ে নামলেই বাড়ির লোক ছুটে আসবে, ভাড়া মেটাবে এবং ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেবে?
আছে। এখনও মা আছে। ছুটে আসতে পারবে না বা ঘরেও নিয়ে যেতে পারবে না। তবু একমাত্র মা-ই কি হল কি হল বলে সেঁচাবে। কাঁদবেও।
চয়নের সেই অর্থে বাড়ি নেই। দাদার বাড়িতে সে আর মা একরকম জোর করে আছে। একটা সুতোর মতো সম্পর্ক ঘরে আছে বটে, কিন্তু সেটা ঠিক থাকা নয়। উঠি-উঠি যাই-যাই ভাব সবসময়ে। দাদা আর বউদির ভয়, আর বেশীদিন। থাকলে বাড়িটার ওপর তার এবং মায়ের একটা দাবী বা স্বত্ব দাঁড়িয়ে যাবে। তাই আজকাল তাদের তাড়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তারা।
দেয়ালে ঠেস দিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে চয়ন। পারবে কি? মোহিনীর কাল ইংরিজি পরীক্ষা। যাওয়াটা দরকার।
যে লোকটা তাকে ধরে তুলেছে সে এখনও দাড়িয়ে, বাকিরা চলে গেছে।
লোকটা ভাল প্রকৃতির। বলল, ট্যাক্সি ভাড়া না থাকলে বলুন না, দিচ্ছি। সংকোচের কারণ নেই।
চয়ন মাথা নেড়ে বলে, না। এরকম আমার প্রায়ই হয়। চিকিৎসা করিয়েছেন?