রশ্মি আর অবাক না হয়ে হেসে ফেলে বলে, খুব চালাক, না? কিন্তু কি করব বলুন, এখনও কলকাতার ট্রাম-বাসে ওঠার অভ্যাস হল না। এত ভিড়, আর লোকজনও তো তেমন সভ্যভব্য নয়।
ফেরেনও তো গাড়িতেই?
হ্যাঁ। সন্ধে ছটা থেকে গাড়ি শিয়ালদায় গিয়ে থাকে। আজ ড্রাইভারের ছুটি বলে গাড়ি যায়নি।
আপনি চালাতে পারেন না?
ও বাবা! কলকাতায় গাড়ি চালাবো! ভয়েই মরে যাই যে। লন্ডনে চালাতাম।
রশ্মির বাবা বা মা কেউই বাড়িতে ছিলেন না। ফলে পরিচয়ের ঝামেলাটা ছিল না। হেমাঙ্গ নিশ্চিন্তে বসে এক কাপ কফি খেল। তারপর উঠল।
আজ যাই।
ঠিকানাটা দিয়ে যান তো। আর ফোন নম্বর।
এটা কি আরও এক পী এগিয়ে আসা! হেমাঙ্গ রাশির ডায়েরিতে নিজের ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিল।
রশ্মি ঠিকানাটা দেখেই বলল, গরচা! ওমা, এ তো হাঁটাপথ!
হেমাঙ্গ মৃদু হেসে বলে, অনেক সময়ে সামান্য হাঁটা পথও লক্ষ বছরে পেরোতে পারে না মানুষ।
খুব কথা শিখেছেন!
হেমাঙ্গ দিন তিনেক রশ্মির মুখ মনশ্চক্ষে দেখতে পেত, রশ্মির গলার স্বর শুনতে পেত মনেরই কানে। কফির স্বাদ আর সেই সেন্টও তার জিব। আর নাককে কয়েকদিন দখলে রেখেছিল।
দিন সাতেক বোধ হয় ক্রিয়াটা রইল। তারপর বিস্মৃতির জল মিশতে-মিশতে নেশার জিনিসটা ফিকে হতে লাগল। আর ঠিক সেই সময়েই একদিন একটা ফোন এল।
আমি রশ্মি বলছি। মনে আছে তো আমাকে!
মনে থাকবে না! যা পেল্লায় বাড়ি!
ইস, কী বিচ্ছু লোক! বাড়িটাকে মনে রেখেছেন, আর বাড়ির জন্যই আমাকে?
ঠিক তা নয়। তবে বাড়ি জিনিসটাও কিন্তু একটা ফ্যাক্টর। উপেক্ষা করার জিনিস নয়।
বুঝলাম। বাড়িটা না দেখালে বোধ হয় আমাকে মনেও থাকত না!
তা নয়। আপনার বাড়ির সঙ্গে আপনার যদি একটা কনটেস্ট হয়, তাহলে আপনিই জিতবেন। বলুন, কেমন আছেন।
ভাল।
আপনার স্কুল কেমন আছে?
টিকে আছে এখনও। শুনুন, রবিবারে ফ্রি আছেন?
আমি তো সব সময়ে ফ্রি।
মোটেই নয়। রবিবারে রবিবারে তো আপনি অডিট করেন বলছিলেন।
সেটা সব রবিবারে নয়। এই রবিবারে আমার ছুটি। কেন বলুন তো?
আমাদের বাড়িতে আসবেন বিকালে? ছটা সাড়ে ছটা নাগাদ?
যেতে পারি। কিন্তু কারণটা কি?
আপনি না সেদিন আমার বন্ধুত্ব মেনে নিয়েছিলেন! এমনিই আসুন।
খাওয়া-দাওয়া আছে?
রশ্মি খিলখিল করে হাসল, কিন্তু আপনি তো মেয়েদের সামনে খান না। কি করবেন তাহলে?
না তাকালে খেতে পারি।
রশ্মি খুব মায়াবী গলায় বলল, একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান আছে। আর আমি ফরাসী দেশে রান্না শিখেছি। রাঁধতে ভীষণ ভালবাসি। সেদিন কয়েকটা নতুন রেসিপি এক্সপেরিমেন্ট করব।
ও বাবা! আমি কি গিনি পিগ নাকি?
রশ্মি আবার খুব হাসল, না হয় তাই হলেন।
আচ্ছা। যাবো। মেয়েদের জন্য পুরুষদের কত স্বার্থই তো ত্যাগ করতে হয়।
রশ্মি হাসল, ছাড়ছি। বাই।
হেমাঙ্গ ফোনটা রেখে দিয়ে খুব গভীর একাগ্রতা নিয়ে চিন্তা করতে বসল। মানুষের মন স্বভাবতই এলোমেলো। চিন্তাগুলোকে পৰ্যায়ক্রমে বা পরম্পরায় সাজাতে পারে না বলে তার সিদ্ধান্তে আসতে দেরি হয় না কখনোই আসতে পারে না। কিন্তু প্রশ্নটা হল, এটা কী হচ্ছে? এটা কি কোনও সঙ্কেত? কোনও পূর্বলক্ষণ?
ফোনটা সে করল অগতির গতি চারুশীলাকে।
কি রে হাঁদারাম, কেমন আছিস?
শোন, আমার একটা প্রবলেম হয়েছে।
তোর তো বরাবরই প্রবলেম। এবার একটা বিয়ে কর। তাহলে আর প্রবলেমে পড়লেই আমাকে ফোন করতে হবে না।
তুই বড্ড সেকেলে।
বিয়ে করতে বললেই বুঝি সেকেলে হয়? তা তুই করতে চাস কী? লিভ টুগেদার করবি নাকি? তোর ভাবসোব আমি একটুও ভাল বুঝছি না।
দেখ, বিয়েটাও একটা লিভ টুগেদার ছাড়া কিছু নয়, সে হিন্দু, খ্ৰীস্টান, মুসলমানি মতে বা রেজিস্ট্রি করলেও হরেদরে কাশ্যপ গোত্র। বিয়ের সুবিধে এই যে, ছাড়াছাড়ি হলে অ্যালিমনি বা কমপেনসেশন পাওয়া যায়।
ও বাবা, এ তো খুব অত্যাধুনিক মতামত হয়েছে দেখছি। জানিয়ে দেবো নাকি বাড়িতে?
তা জানাতে পারিস। কিন্তু তাতে সত্যটা তো বদলে যাবে না। বিয়েকে উদ্দবন্ধন কেন বলে জনিস? ওর মানে হল
বেঁধে মারা।
মোটেই তা নয়। উদবন্ধন মানে বিয়ে নয় মোটেই। বিয়ে হল উদ্বাহ বন্ধন। বাংলাটা তুই কিছু জানিস না।
ওই হল। উদ্বাহটাও এমন কিছু ভাল ব্যাপার নয়। খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে ওটার মানেও খুব খারাপ।
তুই বরং ইংরিজিতে বল না, ভুল একটু হবে।
ইংরেজিতে বললে যে তুই কিছুই বুঝবি না। তোর কাছে ইংরেজি তো গ্ৰীক ভাষা।
তোর কাছে যেমন বাংলা? তোর জন্মদিন কবে যেন! এবার তোর জন্মদিনে একটা ভাল বাংলা ডিকশনারি প্রেজেন্ট করব তোকে।
দিস। ডিকশনারি দিয়েই শুরু কর। হাত আসুক।
ইস! আমি কেপ্পন না তুই কেপ্পন! বিয়ে তো করতে চাস না খরচের ভয়ে। বউ খাবে, পরবে, এটা ওটা চাইবে, তাতে তোর টাকা খরচ হবে। হ্যাঁ রে, তুই এত টাকা চিনলি কবে থেকে? হাড় কঞ্জুস হয়েছিস মাইরি!
রোজগার করলে তুইও টাকা চিনতিস। পরের ঘাড়ে পড়ে দিব্যি লাইফটা কাটিয়ে গেলি। সিন্দাবাদের কাঁধে যে সেই বুড়োটা চেপে বসেছিল, কিছুতেই নামে না, তুই হলি তেমনি। শুধু চেপে বসা? লোকটাকে ছিবড়ে করে দিলি।
আচ্ছা, তুই না একটা গাঁয়ের মেয়ে বিয়ে করবি বলেছিলি! তাই না হয় কর না বাবা। গাঁয়ের মেয়েদের ডিম্যান্ড কম হয়। রুজ লিপস্টিক চাইবে না, ড়ুরে শাড়ি পেলে খুশি, পার্টিটার্টি দেবে না, মোষের মতো খেটে তোর খরচ বাঁচিয়ে দেবে।
গাঁয়ের মেয়ে তুই খুব চিনেছিস দেখছি! গাঁয়ে যাস কখনও? গিয়ে দেখিস তোর মতো আধুনিক গণ্ডায় গণ্ডায় ঘুরে বেড়ায় আজকাল। সেই দিন আর নেই রে নাতি, থাবা থাবা চিনি খাতি।