দশরথ সাহা কেমনধারা মুখ করে বলে, যা বাঢ়ি যা। পুলিশ এসে লাশ না তুললে কিছু বলা যাচ্ছে না। গিয়ে বামাচরণকে পাঠিয়ে দে।
সে আসবে না। কী হয়েছে বলুন না!
কে কি বলবে বাবা? দেখছিস তো কাণ্ডখানা! লোকে নানা কথা বলাবলি করছে। তুই আর থাকিস না এখানে।
কেন জ্যাঠা? আমি থাকলে কী হবে?
কী যে হবে তা দশরথও জানে না। দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, বাড়ির বড় কাউকে পাঠিয়ে দি গে যা।
পটল কি করবে বুঝতে পারছিল না। তাদের যে আর কেউ নেই। দাদু বুড়ো মানুষ, বসা মানুষ, দাদু কি আসতে পারবে এত দূরে?
পটল হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে ছুটতে লাগল বটতলার দিকে। জ্যাঠা এখনও বোধ হয় বেরোয়নি। সে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে ঠিক নিয়ে আসবে।
সাইকেলের দোকানের কাছাকাছি আসতেই সে একজন নতুন মানুষকে দেখতে পেল। জলকাদা মাখা মানুষ, কিন্তু এ গায়ের হেটো মানুষ নয়। লম্বা চওড়া চেহারা, বাবু মানুষ। মুখটা পটলের বড় চেনা।
কিন্তু লোকটাকে নিয়ে ভাববার সময় ছিল না তার। সাইকেলটা তুলে নিতে যাচ্ছিল, এমন সময় লোকটা ডাকল। তাকে, এই, তুই পটল না।
উদ্ভ্রান্ত চোখে পটল লোকটার দিকে চাইল। চিনতে পারল। তারপর হঠাৎ ঊা করে কেঁদে গিয়ে লোকটাকে জাপটে ধরল সে, বড়জ্যাঠা, আমার বাবা খুন হয়ে গেছে।
কৃষ্ণজীবন ভীষণ অবাক হয়ে বলল, খুন হয়ে গেছে! বলিস কী?
ঘোষপাড়ার নাবালে পড়ে আছে বাবা।
কৃষ্ণজীবন তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ওরকম করিস না। আয় তো, দেখে আসি।
পটল অঝোরে কাঁদছে। নাক দিয়ে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে তার। পৃথিবীতে এখন বড়জ্যাঠার চেয়ে বড় সম্বল আর সহায় তার কেউ নেই যেন, এমনভাবে আঁকড়ে ধরল সে কৃষ্ণজীবনকে।
নাবালের ভিড়ে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণজীবন লাশটাকে দেখল। তারপর পটলের দিকে চেয়ে বলল, কে বলেছে যে ও তোর বাবা?
সবাই জানে।
কৃষ্ণজীবন পটলকে শক্ত করে ধরে বলল, রামজীবনের বাঁ পায়ের গোড়ালিতে মস্ত কাটা দাগ আছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মহাদেব ঘোষের বাড়িতে পেয়ারা চুরি করতে গিয়েছিল রামজীবন। মহাদেব ঘোষ একটা দা ছুঁড়ে মেরেছিল। দাগটা এখনও আছে। আরও বেশি করে আছে। এ লোকটির বাঁ পায়ের গোড়ালিতে কোনও দাগ নেই।
পটল হাঁ করে কিছুক্ষণ জ্যাঠার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, এ আমার বাবা নয়?
কখনোই নয়। চল, বাড়ি চল।
পটলের মনে হল, বড়জ্যাঠা যেন মানুষ নয়। যেন দেবদূত।
৩০. গাঁয়ের স্কুলের অডিট
সেদিন গাঁয়ের স্কুলের অডিট সেরে রশ্মি রায় আর সে একসঙ্গেই ফেরে। এক ট্রেনে, এক কম্পার্টমেন্টে পাশাপাশি বসে এবং একই ট্যাক্সির উষ্ণ, নরম অন্ধকার ও নিকট সান্নিধ্যে। যে কেউ শুনলে বলবে, তবে আর কি, হয়েই তো গেছে।
হয়ে যায়নি, তবে এই এতটা একসঙ্গে থাকার ধকল আজও সামলে উঠতে পারেনি হেমাঙ্গ। আর সেই মাদক গন্ধটা, সেই মারাত্মক বিদেশীসেন্ট মেয়েটার গা থেকে উড়ে এসে কুংফু কারাটে চালিয়ে হেমাঙ্গর হৃদয়কে প্রায় ধরাশায়ী করে ছেড়েছিল। প্রেমের মধ্যে কি গন্ধেরও একটা ভূমিকা আছে। কোনও কোনও সেন্ট কি হৃদয়-বিদারক? কই, সেসব সেন্টের প্রস্তুতকারকরা তো নোবেল প্রাইজ পায় না। তাদের অবশ্যই নোবেল-টোবেল দেওয়া উচিত।
রাস্তা কম নয়। মেয়েটাও কথা বলতে ভালবাসে। ফলে দুজনের মধ্যে একটা কথার জালও শক্তভাবে বোনা হয়েছিল। প্রথম স্কুল নিয়ে, তারপর ভারতবর্ষের এলানো কর্মবিমুখ জীবনদর্শন নিয়ে, প্রশাসনিক পরিকাঠামোর জটিলতা নিয়ে, মানুষের দুরারোগ্য দুনীতি নিয়ে, চিকিৎসার অতীত ধান্ধাবাজি নিয়ে। কথাবার্তা পার্সোনাল লেভেলে এল ট্যাক্সিতে, শিয়ালদা থেকে হাজরার মাঝখানে।
রশ্মি রায় জিজ্ঞেস করল, আমি একটু বেশি কথা বলি, তাই না? অ্যাম আই এ বোর?
না। আপনার কথা খুব ইন্টারেস্টিং। বোধ হয় জমেও ছিল অনেক কথা।
ঠিক বলেছেন তো! রশ্মি মিষ্টি করে হাসল, গত দুবছরের অভিজ্ঞতা খুব খারাপ, একজসটিং। হাঁফিয়ে উঠছি। কাকে বলব? আজ। আপনাকে পেয়ে ফ্লাড গোটটা খুলে দিলাম। কেন যে দিলাম বুঝতেই পারছি না। হয়তো আপনাকে খুব সিমপ্যাথেটিক মনে হয়েছিল।
হেমাঙ্গ মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে চিরকাল অদক্ষ শ্রমিক। সে অনেকটা ভেবে নিয়ে বলল, ঠিকই করেছেন। কথা জমিয়ে রাখলে খুব কষ্ট।
রশ্মি বিষণ্ণ গলায় বলে, বাবা মা আমার এইসব মিণ-টিশন পছন্দ করে না। বাবা তো বলেই দিয়েছিল, গায়ের স্কুলে গিয়ে ত্যাগের মহিমা দেখাতে পারো, কিন্তু কেউ ওর কোনও দাম দেবে না। গান্ধীজী, বিনোবা ভাবে থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন ওসব করতে গিয়েছিল। কিছুই হয়নি। যে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির জোর নেই, সেখানে ত্যাগ-ট্যাগ দেখাতে গেলে কয়েকটা হাততালি আর অনেক টিটকিরি। জুটবে। তার বেশি কিছুই হবে না।
আপনার কি মোহভঙ্গ হয়ে গেছে?
রশ্মি মৃদু হেসে বলে, একরকম তাই। তবে মেয়েগুলো বড্ড ভাল। এত ভালবাসে আমায়। প্রায়ই তরিতরকারি, গাছের ফল এনে দেয়, আর আদরের সেসব দান বয়ে আনতে হয় আমাকে। অন্তত জনা দুই খুব ভাল লোককেও পেয়েছিলাম। কিন্তু ভালদের তো আজকাল ভয়েস থাকে না। আচ্ছা, আপনাকে এত কথা বলছি কেন বলুন তো? ভীষণ টকেটিভ হয়ে গেছি তো আজি!
কথা বলা সরলতার লক্ষণ।
আমি কি সরল?
ওভাবে জিজ্ঞেস করলে বিপদে পড়ে যাই।
রশ্মি খুব হাসল। তারপর বলল, কিন্তু আপনি তো কিছু বললেন না নিজের সম্পর্কে। শুধু একটা জিনিস লক্ষ করলাম, মেয়েদের আপনি ভীষণ লজ্জা পান, আর কোনও মহিলার সামনে খেতে পারেন না!