কালুর পেচ্ছাপ পেটের মধ্যেই শুকিয়ে গেল ভয়ে, সে টপ করে দোকানে ঢুকে ঝাঁপ টেনে ফুটোয় চোখ রাখল। সাত আটজন লোকে একজনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের হাতে বড় বড় ল্যাজা, গজা, ভোজালি। এত জোরে লাথি মারছে, চাটি মারছে যে পটকা ফাটার মতো আওয়াজ হচ্ছে। লোকটা চেঁচাতে পারছে না, তার মুখে একটা নোংরা কাপড় গোঁজা। এত কিছু অন্ধকারে থেকেও দেখা যাচ্ছিল, বাদুর দোকানের হ্যাজাকবাতির আলোয়। বাদু ভোরবেলা গরু দুইতে ওঠে।
কালু লোকটাকে দেখেছে। তাকে সে চেনেও। যারা নিয়ে যাচ্ছিল তাদেরও। কিন্তু কালু জানে, তাকে এখানে বাস করতে হলে মুখে কোনও নাম উচ্চারণ করা চলবে না।
ঘোষপাড়ার নাবালে কি হল তা কালু আর জানে না। সে ভয়ে আর বেলোয়নি। ঘুমোতেও পারেনি। সকালে বেরিয়ে সে লাশটার কথা শুনল। কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে। দেখতে গেল না। সকাল থেকে সে মন দিয়ে সাইকেল মেরামতির কাজ করে যাচ্ছে।
যখন চা আর পাউরুটি খাচ্ছিল বাদুর দোকানের বেঞ্চে বসে তখন নাটা এসে কাছে দাঁড়াল। ভয়ে বুক শুকিয়ে গিয়েছিল কালুর। পাউরুটির ডেলা আটকে গেল গলায়। বিষম খেল।
নাটা চাপা গলায় বলল, ঝাঁপ খুলে বেরিয়েছিলি কেন? মজা দেখতে?
কালু মাথা নেড়ে বলে, না তো! আমার পেচ্ছাপ পেয়েছিল, তাই।
মুখ দিয়ে যদি একটা কথাও বেরোয় তাহলে ফিনিস হয়ে যাবি।
কালু কথা কইতে পারেনি। শুধু মাথা নেড়ে বলেছিল, কিছু দেখিনি।
সাত আটজন খুনিয়ার মধ্যে নাটা ছিল। সবচেয়ে বেশীই ছিল। তার হাতে ছিল চকচকে মস্ত একটা জোলি। কালু সিঁটিয়ে আছে ভয়ে।
কাল রাত থেকে রামজীবন বাড়ি ফেরেনি। সকালে উঠে পটল শুনতে পেল, তার মা কান্নাকাটি করছে রান্নাঘরের দরজায় বসে। বারান্দায় দাদু মাথায় হাত দিয়ে বসা। ঠাকুমা ভ্যাবলা মুখে একটা কুলোয় চাল ঝাড়তে বসে থেমে আছে। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে।
রাঙা কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ওই বটতলাই ওকে খাবে। সেই কাল দুপুরে ইটের ভাটিতে যাবে বলে বেরিয়েছিল, সঙ্গে পাঁচশ টাকা। দুপুরে এসে খাওয়ার কথা, বিকেল গেল, রাত গেল, এখনও কোনও খোঁজ নেই!
বামাচরণ গামছা পরে নির্বিকারভাবে কাঠকয়লার গুঁড়ো আর নস্যি মেশানো মাজনে দাঁত মাজতে মাজতে ঘর থেকে বেরিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি শুনল, তারপর ঘটি হাতে পুকুরের দিকে চলে গেল বৃষ্টির মধ্যে। যেন সে এ বাড়ির কেউ নয়।
শ্যামলী বেরোলো না, কিন্তু দরজার আড়াল থেকে দাঁড়িয়ে শুনছিল। তার শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছিল।
দৃশ্যটা, ঘটনাটা ঘুমের মাথায় বুঝতে অনেক সময় লাগল পটলের। তার বাবা ফেরে অনেক রাতে, যখন সে ঘুমিয়ে কাদা। বাবা যে রাতে ফেরেনি এটা তার জানা ছিল না।
সে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল, কাঁদছো কেন মা? কী হয়েছে?
সাইকেলটা নিয়ে যা তো বাবা। বটতলায় খুঁজে আয়। আমার বুক কঁপছে, অম্বলের ব্যথায় মরে যাচ্ছি। একটু আগে। বমি হয়েছে এক কড়ি। সারা রাত ঘুম হয়নি তো!
পটল আর একটিও কথা বলেনি। মুখে চোখে একটু জল ছিটিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছে।
বটতলা অবধি যেতে হয়নি তাকে। তার আগেই মল্লিকদের বাড়ির সামনে একটা জটলা দেখে সে সাইকেল দাঁড় করাল।
দেবদাস মল্লিক জটলার দিকে চেয়ে বলছিল, কে খুন হয়েছে তা আগ বাড়িয়ে কি বলা যায়। পুলিশ আসবে, লাশ তুলবে, তারপর ববাঝা যাবে। দিনকাল যা পড়েছে এ সব নিয়ে বেশী কথা না বলাই ভাল। বটতলাটা তো একটা বিভীষিকা হয়ে উঠছে দিনকে দিন।
খুন কথাটা শুনেই পটল পাই পাই করে সাইকেল চালিয়ে দিল। নামল এসে বটতলায় গণার সাইকেলের দোকানে। কালু অন্য দিনের চেয়ে বেশী মনোযোগ দিয়ে একটা টিউবের লিক সারাচ্ছিল।
কালুর সঙ্গে তার খুব ভাব। গণা না থাকলে কালু অনেক সময় বিনা পয়সাতেও তার চাকায় পাম্প দিয়ে দেয়।
এই কালু, কোথায় কে খুন হয়েছে রে?
খুন! বলে কালু আকাশ থেকে পড়ে, জানি না তো!
বটতলায় আজ দোকানপাট খোলনি তেমন। লোকজন দেখা যাচ্ছে না। থমথমে ভাব।
এই যে শুনলাম কে খুন হয়েছে। আমার বাবা নয় তো!
কালু মাথা নেড়ে বলে, আমি কিছু শুনিনি।
কালু যে মিথ্যে কথা বলছে তা এক লহমায় বুঝে গেল পটল।
লোজন সব কোন দিকে গেছে জানিস?
আমি কিছু জানি না। কাজ করছি এখন।
বাদুর দোকানে জিজ্ঞেস করতেই চা-ওলা ছেলেটা বলল, ঘোষপাড়ার নাবালে যাও। কেটে ফেলে রেখে গেছে রাতে।
কে খুন হল?
কে জানে!
আমার বাবা নয় তো!
ছেলেটা নির্বিকার মুখে নিদুরের মতো বলল, হতে পারে। দেখগে, চিনতে পারে কিনা।
পটলের হাত পা থথর করে কাঁপছিল। সাইকেলটা সে কালুর সামনে ফেলে রেখে বলল, এটা রইল। এখন চালাতে পারব না।
দৌড়তে দৌড়তে পটল যখন নাবালের ধারে পৌছোলো তখন ভিডটা বেড়েছে। মেলা লোক, কিন্তু গণ্ডগোল নেই।
জীবনে খুন-হওয়া মানুষ কখনও দেখেনি পটল। মানুষকে যে এভাবে অনাদরে ফেলে রাখা যায়, মারা যায় তা তার কল্পনাতেও ছিল না কখনও। জলে আধ-ডোবা লোকটার নিথর পা দুখানার দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে ছিল সে। আমার বাবা নয় তো!
হতে পারে তার বাবা-ইও টা। সবুজ জামা আর কালো প্যান্ট তো বাবার আছে।
কাছেই দশরথ সাহা দাঁড়িয়ে। সে মুখ তুলে লম্বা লোটার দিকে চেয়ে করুণ গলায় বলল, দশরথ জ্যাঠা, এ আমার বাবা নয় তো!
দশরথ সাহা তার দিকে চেয়ে একটু যেন চমকে উঠল। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, কেন তোর বাবা বাড়ি নেই?
না। কাল দুপুর থেকে আর ফেরেনি।