নয়নতারা ফের তাড়া দিল, ওঠে। বসে বসে ভাবতে থাকলে তোমার আরও শরীর খারাপ করবে। ওসব নিয়ে অত ভাবতে নেই।
বিষ্ণুপদ উঠল। পাকা ঘরটার দিকে আর একবার চাইল বিষ্ণুপদ। রামজীবন পেরে উঠল না।
কেউ কেউ পেরে ওঠে না। আবার কেউ কেউ পেরে ওঠে। যেমন কৃষ্ণজীবন। সাততলার ওপর আরামে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে থাকে। বর্ষা-বাদলা হোক, ঝড়বাতাস হোক, ধরা বান হোক, পরোয়া নেই।
মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, রামজীবন বুঝি বড় ভাইয়ের সঙ্গে রেষারেষি করেই তুলতে চেয়েছিল পাকা ঘরখানা। কিন্তু তাই কি পারে? কৃষ্ণজীবনকে ধরতে পারা কি রামজীবনের পক্ষে সম্ভব! সে যে বহুদূর এগিয়ে রয়েছে। রামজীবন তার নাগাল তো পাবেই না, বরং ঘেঁদিয়ে মরবে। তবু চেষ্টা তো করেছিল! বুকটা সেই কারণে একটু ভরে থাকে। মাতাল হোক কি আর যাই হোক, সারা দিনমানের কোনও না কোনও সময়ে বাপ-মায়ের কথা ভাবে তো।
আজ একটু সাবান দিয়ে চান করব, দেবে।
সাবান! আবার সাবান কেন! আবান মাখলে বেশী চান হয়ে যাবে। যা বাদলা, বুকে ঠাণ্ডা বসে গেলে বিপদ।
রামজীবন একখানা গন্ধ সাবান এনে দিয়েছিল না! আছে?
সে তো কবেকার কথা। আছে। মাখে কে বলে? আমাদের বাংলা সাবানেই কাজ চলে যায়।
দাও, মাখি।
সাবানটা বর্ষা-বাদলায় বের করলে খরচ হবে খুব। জলে ক্ষয়ে যাবে।
আজ অত হিসেব কোরো না। দাও।
দিচ্ছি। কুয়োতলায় গিয়ে বোসো। বাক্সের তলায় রেখেছি। বের করতে হবে।
বিপদর বড় জানতে ইচ্ছে করে, সাবান জিনিসটা কী দিয়ে তৈরি হয়।
কত কি জানা হল না দুনিয়াটার। সব আবছা রয়ে গেল।
এই বর্ষায় কুয়ো একেবারে টৈটমুর। বালতিতে দড়ি না বাধলেও চলে। তবে কুয়োর চাকগুলো অনেক পুরনো। জোড় আলগা হয়ে কাদামাটি ঢুকে জল ঘোলা করে দেয়। চোত-বোশেখে বড় কষ্ট গেছে। কোন পাতালে নামাতে হত বালতি। কাদাগোলা জল উঠত, আর তাতে বিজবিজ করত পোকা।
বৃষ্টিতে কুয়োর ধারে বসে আনমনে চেয়েছিল বিষ্ণুপদ। তোড় কমে ভারী মিঠে ঝিরঝিরে ঝর্ণাকলের মতো জল পড়ছে এখন। একবার কৃষ্ণজীবন নিয়ে গিয়েছিল তার বাড়িতে। সাতলায় বাঁধানো ঘরদোরে যেন আলো পিছলে যাচ্ছে। সেই বাড়ির বাথরুমে ঝর্ণা কলের নিচে বসে চান করেছিল বিষ্ণুপদ। তখন মনে হয়েছিল যেন বৃষ্টির মধ্যে বসে আছে।
মানুষ কত কল বানিয়েছে। আরও বানাচ্ছে। কলের যেন আর শেষ নেই।
উঠোনে সাইকেলের ঘন্টি। একটা নয়, তিন-চারটে সাইকেল। একটা হেঁড়ে গলা জিজ্ঞেস করল, রামদা নেই বাড়িতে?
রামজীবনের বউ ক্ষীণ গলায় বলে, না। সকালে বেরিয়েছে।
গেল কোথায়?
বলে যায়নি।
এলে বলে দিও বটতলায় যেতে। জরুরী কাজ আছে।
আচ্ছা।
কথাগুলো মন দিয়ে শুনল বিষ্ণুপদ। এরা সব কারা মাঝে মাঝেই রামজীবনের কাছে আসে তা জানে না বিষ্ণুপদ। দেখে বড় ভাল লোক বলে মনে হয় না। চেহারাগুলোই কেমন যেন লোখাচোখা। এই বৃষ্টিতেও কারও মাথায় ছাতা নেই। উঠোনে সাইকেল এসে থামে, সাইকেলে বসে থেকেই একটা হাক দিয়ে চলে যায়। কখনও নামে না, বসে না, বাড়ির কারও সঙ্গে কথাবার্তা কয় না। মনে হয় খুব কাজের লোক সব। খুব তাড়া আছে।
সাইকেল ঘুরিয়ে জলের মধ্যেই চলে গেল ছোঁড়াগুলো। কুয়োপাড় থেকে গাছপালার ভিতর দিয়ে, বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ছানি-পড়া চোখে যতদূর দেখা গেল, চারজন।
এই দুনিয়াটা নিয়ে আর ভাববার কিছু নেই বিষ্ণুপদর। সে কালঘড়ি দেখেছে। সময় ফুরিয়ে এল। এখন চারদিক থেকে নিজেকে কুড়িয়ে তুলে এনে এক জায়গায় জড়ো করা ভাল। কে কি করছে, কার কোন মতলব, কে উচ্ছনে গেল এসব নিয়ে আর মাথা ঘামানো ভাল নয়।
রোজ বড় আশায় আশায় রামজীবনের ঘরখানার দিকে চেয়ে থেকেছে এতদিন। কৃষ্ণজীবনের ঝা-চকচকে ঘরদোরের মতো না হলেও পাকাঘর তো। এই গা-গঞ্জে একখানা পাকাঘরে থাকারও একটা আরাম আছে। কিন্তু আর আশা নেই। ঘরখানা থেকে মনটাকে সরাতে হবে এইবার।
এই যে তোমার সাবান। কিন্তু বাক্স নেই, মোড়কের কাগজখানা ফেলো না। ওতে মুড়ে রাখা যাবে।
সাবানখানা হাতে নিয়ে চেয়ে থাকে বিষ্ণুপদ। কি দিয়ে যে কি বানিয়ে তোলে মানুষ। সাবানখান হাতে নিয়ে ভারী আহ্ৰাদ হল বিষ্ণুপদর। খুব হাসল সে। খুব হাসল।
সাবানের মজাই হচ্ছে তার ফেনায়। বগবগ করে ফেনা উথলে উঠবে তবে না সাবান। কিন্তু ফেনা তুলবে কি, গায়ে ঘষতে না ঘষতেই বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে সব। খামোখা ক্ষয়ে যাচ্ছে। নয়নতারা বুক-বুক করে আগলে রেখেছিল। থাক, মেখে কাজ নেই।
সাবানখানা কাগজে সাবধানে মুড়ে দাওয়ায় রেখে বিষ্ণুপদ হেঁকে বলল, তোমার সাবানখানা নিয়ে যাও।
নয়নতারা দৌড়ে এসে চাপা গলায় ধমক দেয়, সাবানের কথা ভেঁচিয়ে বলতে আছে? বউদের কানে গেলে পাঁচটা কথা উঠে পড়বে। কে দিল, কোথেকে এল। রামজীবন চুপটি করে এনে দিয়েছিল।
বিষ্ণুপদ অপ্রস্তুত হয়ে বলে, তাও বটে। যাকগে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন তুলে রাখে।
জল ঢালতে ঢালতে আর একখানা সাইকেলের আওয়াজ পায় বিষ্ণুপদ। আওয়াজটা চেনা। পটলের ঝাঁ-কুকুর সাইকেল। এই সাইকেল একসময়ে বিষ্ণুপদ নিজে চালাত। চালিয়ে সাত মাইল দূরে একখানা প্রাইমারি স্কুলে পড়াতে যেত। তারপর কৃষ্ণজীবন চালিয়েছে, বামাচরণ চালিয়েছে, রামজীবন চালিয়েছে, শিবচরণ চালিয়েছে। এখন চালায় পটল।
সাইকেলটা উঠোন অবধি এসে থামল। সেজ বউ ছুটে এল কোথা থেকে। ভয়ের গলায় বলল, ওরে শিগগির নিতাইকে গিয়ে একটা খবর দে। ওরা আবার এসেছিল।