নয়নতারার মুখখানা কেমন আরও বোকাটে মার্কা হয়ে গেল। বলল, মনে আছে।
ঠাকুর্দা ঘুম থেকে উঠেই সে কী হাঁকডাক। ওরে তোরা সব তাড়াতাড়ি রান্না-খাওয়া সেরে নে, আজ আর কেউ বেরোবি না ঘর থেকে, সবাই আমার কাছাকাছি থাক, আর গঙ্গাজল তুলসী চন্দনপাটা সব রাখ হাতের কাছে। সব মনে পড়ে?
পড়ে।
সেদিন শেষ রাতে ঠাকুর্দাও কালঘড়ি দেখেছিল। আমি মস্করা করে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন ঘড়ি ও ঠাকুর্দা? তা ঠাকুর্দা যা বলেছিল ঠিক হুবহু সেইরকম দেখলাম কাল রাতে। কালো একখানা চক্কর। তাতে দুটো সাদা কাঁটা কক্কালের হাতের মতো ঘুরে যাচ্ছে।
নয়নতারার চোখ দুখানা জ্বলজুল করছে। বেচারার এ দুনিয়াতে সব থেকেও কেউ নেই, একমাত্র বিষ্ণুপদ ছাড়া। এসব কথায় তার বুক উথাল-পাথাল হওয়ার কথাই। নয়নতারা বলে, সেই দিন তো আর ঠাকুর্দা মরেনি।
না। সাতদিনের মাথায় মরল। কি হবে কে জানে! আমিও দেখলাম।
কথাটা বলা ঠিক হল কিনা কে জানে! ও মানুষটাকে একটা উদ্বেগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হল। নয়নতারা তো বিশেষ সুখে থাকেনি একটা জীবন।
বিষ্ণুপদ ফের বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ময়লা আলোয় রামজীবনের ঘরটার দিকে চেয়ে রইল।
রামজীবনের আধখ্যাঁচড়া ঘর দাঁত বের করে খুব হাসছে। বাঁশের খাঁচায় আটকে আছে কতকাল।
ধপ করে উবু হয়ে বসে পড়েছে নয়নতাৱা। চোখে আঁচল। মেয়েদের কত যে কাঁদতে হয়। সংসারে রোজই এমন কিছু ঘটনা আছে যাতে মেয়েদের কাঁদতে হয়। নয়নতারাকে অনেক কাঁদতে দেখেছে বিষ্ণুপদ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, রামজীবনের ঘরখানা শেষ হলে বেশ দেখতে হবে কিন্তু।
নয়নতারা কিছু বলল না। ঘুঘুন করে কাঁদছে। আকাশ আরও একটু কালো হয়ে গেল নাকি? আলোটা যেন মরে এল। বৃষ্টির সঙ্গে একটা দমকা হাওয়া আসছে। দমকে দমকে।
নয়নতারা ভেজা গলায় বলে, ওঠো, ঘরে যাও।
ঘরে যেতে ইচ্ছে নেই বিষ্ণুপদর। দাওয়ায় বসে এইরকম চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে আজ। জলেডোবা উঠোনের বা ধারে করবী ফুলের গাছের তলা দিয়ে ওরা তাকে নেবে। তারপর আর ফিরে আসা নেই। আর ঘরবাড়ি নেই, সংসার নেই, নয়নতারা নেই। কেমন হবে তখন?
বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, বুঝলাম না।
কী বুঝলে না গো।
কিছু বোঝা যায় না। অজান প্ৰান্তর পড়ে আছে সব। কত কি বোঝা গেল না। এই বলে নয়নতারার দিকে মায়াভরে তাকায় বিষ্ণুপদ। পঞ্চাশ বছরের বন্ধু। নয়নতারাও কি কিছু বোঝে! তারা দুটো বোকা মানুষ। কত কি ঘটে যায় চারদিকে, তাদের কাছে সব আবছা আবছা, ভয়-ভয়, কেমন-কেমন। নয়নতারাকে খুব ভাল কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করে বিষ্ণুপদর। গাছের মতো ছায়া দিল এতকাল, বসা বাঁধতে দিল, ছাপোনা হল। এবার উড়ে যেতে দেয় কি করে? বড় মায়া যে!
তবে কালঘড়ির কথাটা এই বোকা মেয়েটাই বুঝবে। আর কেউ নয়।
মরার সময়টা চতুর্দশী পড়বে কি? ও সময়টা ভারী খারাপ। আজ কৃষ্ণপক্ষ সপ্তমী। বিষ্ণুপদর ঠাকুর্দা কালঘড়ি দেখার ঠিক সাতদিনের মাথায় গিয়েছিল। যদি সেই হিসেবে বিষ্ণুপদও মরে তা হলে চতুর্দশীই পায় সে।
চকবেড়ের হাট থেকে একখানা পকেট-পঞ্জিকা এনে দিয়েছিল রামজীবন। নয়নতারার দিকে চেয়ে বলল, পঞ্জিকাখানা দাও তো এনে।
কী দেখবে?
চতুর্দশীটা পাবো নাকি?
পঞ্জিকা দেখার দরকার নেই। ঘরে চলো।
আর ঘর। বলে বিষ্ণুপদ একটু হাসে। পুবের ভিটে থেকে কেতরে একটা টোড়া উঠোনের জলে নামল। গেছে শালার ঘরদোর ভেসে। বেরিয়ে পড়েছে হারা-উদ্দেশে। এইসময়ে ব্যাটারা বড় ঘরদোরে সেঁধোয় এসে। টোড়াই বেশী, তবে চক্করওলারাও আছেন।
দুপুর হয়ে এল। নাইতে যাও।
বিষ্ণুপদ অবাক হয়ে বলে, দুপুর কোথা? এই তো দশটা বাজল একটু আগে। বেলা এখনও ঢের আছে।
নয়নতারা বিনাবাক্যে ঘর থেকে পঞ্জিকাখানা এনে দিয়ে বলে, ওই দিনে আমিও যাবো।
বিষ্ণুপদ অবাক হয়ে বোকা মুখখানার দিকে চেয়ে বলে, কোথায় যাবে বলছ?
আমাকে একা ফেলে যাবে নাকি? এখনে কে আছে আমার?
বিষ্ণুপদ পঞ্জিকা ওল্টাল না। ভাববার মতো কথা। কারও যদি কেউ নেই তবে সংসারটা কি জন্যে? এতগুলো সস্তান, তাদের ছানাপোনা, এত থেকেও কেউ নেই নয়নতারার, সে ছাড়া?
বিষ্ণুপদ গলা খাকারি দিয়ে বলে, আগুরি কিছু বলা ভাল নয়। যা হওয়ার যখন হওয়ার হবে। দুদিন এদিক আর ওদিক। এ তো ইচ্ছামৃত্যু নয়।
নয়নতারা কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে, স্বপন দেখনি তো?
তাই। তবে স্পষ্ট দেখলাম।
কেমন দেখতে।
কি? কালঘড়ির কথা বলছ?
হ্যাঁ, সেই অলক্ষুণেটা দেখতে কেমন।
সে খুব বড়। যেন আকাশটা জুড়ে দেখা দিল। বুকটা কেমনমোচড় মেরে খা খ করে উঠল। আঁধারকরা বিশাল একটা চাকা। দুটো সাদা লম্বা সবু হাত ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে।
ঠাকুর্দা তাই দেখেছিলেন?
অবিকল।
তাড়াতাড়ি নেয়ে খেয়ে একটু ঘুমোও। মাথাটা পরিষ্কার হবে, ওসব মনের ভূত নেমে যাবে।
মাথা পরিষ্কারই আছে।
রান্নাঘরে দুটো গলা চুপ মেরে গেছে। দিনটাই এমন সতানো যে, মেজাজও সব ঠাণ্ডা মেরে যায়। গরম থাকতে চায় না কিছু।
ছানি কাটানো গেল না বলে বিষ্ণুপদর চোখ কিছু আবছা। পুলিন হোমিওপ্যাথির ওষুধ দিয়ে ছানিটা আটকে রেখেছে এক জায়গায়। নইলে এতদিনে চোখ একেবারেই অন্ধকার হয়ে যেত। রামজীবন কাটাবে বলে ঠিক করেছিল। যা খরচ হত তাতে ঘরের খানিকটা ইট আর সিমেন্ট হয়ে যায়। বিষ্ণুপদ কাটাতে চায়নি। একা রামজীবন আর কত করবে।
চোথে এখনও অনেকটাই দেখতে পায় বিষ্ণুপদ। এই মেঘলা দিনের মরা আলোতেও কত কি দেখতে পায়। রামজীবনের আধখ্যাঁচড়া বাড়ি, নয়নতারার চোখের জল। পঞ্জিকাটা আর খুলল না বিষ্ণুপদ। চতুর্দশী পড়লেই বা কী করার আছে। ভেবে লাভ কি?