- বইয়ের নামঃ পার্থিব
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০০১. বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর
বাদামতলায় রামজীবনের পাকা ঘর উঠছে ওই। সেঁদা স্যাঁতা মেঘলা সকালের ম্যাদাটে আলোয় ও যেন বাড়ি নয়, বাড়ির ভৃত। চারদিকে বড় বড় দাঁতের মতো ইটের সারি যেন খিচিয়ে আছে। গায়ে ভারা বাঁধা। দেড় মানুষ সমান দেয়াল খাড়া হতে বছর ঘুরে গেল। এখন দেয়ালে শ্যাওলা ধরেছে, ভারার বাঁশ পচতে চলল। গেল মঙ্গলবার গো-গাড়িতে সিমেন্টের বস্তা এসেছে অনেকগুলো। পাটের নিচে সেগুলো ডাঁই হয়ে আছে। ছাদ কি আর ঢালাই হবে? বিষ্ণুপদ যে গতকাল রাতে কালঘড়ি দেখেছে। ও একবার দেখলে আর কথা নেই। দরিয়া পেরোনোর সময় ঘনিয়ে এল।
কালঘড়ির কথা এরা কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই বলেওনি কাউকে বিষ্ণুপদ। কথাটা বুকে নিয়ে, কৌটোর মুখ আট করে বন্ধ রেখে বসে আছে। আর কৌটোর মধ্যে প্রাণভোমরা চক্কর মারছে বো-বো করতে করতে। বেরোনোর পথ খুঁজছে। একটা র পেলেই পগার পার।
আজ এই মেঘলা সকালে, হাওয়ায় বৃষ্টির ঝাপটায় দাওয়ায় বসে বাদামতলার দিকে কাহিল চোখে চেয়ে আছে বিষ্ণুপদ। পারলি না তো বাপ, পেরে তো উঠলি না। তোর ঘর রোজ আমাকে মুখ ভ্যাংচায়, থাকবি বুড়ো? আয়, থাক এসে।
রামজীবনের দোষ কি? জোগাড়-যন্তর কি চাট্টিখানি কথা! এটা জোটে তো সেটা জোটে না, দুশো এল তো চারশো বেরিয়ে গেল। নাকের জলে চোখের জলে হয়ে রামজীবন তবু বাপ আর মাকে পাকা ঘরে রাখবে বলে জান বড় কম চুঁইয়ে দেয়নি। তা তার ভাগ্যটাও এমনি। এবার সব জোগাড় হল তো অলক্ষুণে বর্ষা কেমন চেপে ধরল দুনিয়াটাকে। ডাইনীর এলো চুলের মতো ঝেঁপে থাকে মেঘ। সারাদিন একদিন একটু রোদ ওঠে তো হঠাৎ ফের ভূষোকালি মাখানেমেঘ থমথম করে ওঠে দিগন্তে। তারপর হাওয়া দেয়। রণপায়ে চলে আসে বৃষ্টি। টিনের চালে দিনরাত নাচুনে শব্দ। ঘরময় বাট, কৌটো, ভেঁড়া বস্তা পাতা। চালের পুরনো টিন চালুনির মতো হয়ে এল। কটা ফুটোর জল সামাল দেওয়া যায় বাপ! নিত্যনতুন ফুটো দিয়ে জল পড়ছে ঘরে। পাকাঘর এই হল বলে, আশায় আশায় এবার আর ঘরের টিন মেরামত হয়নি। হেমেন মিস্ত্রি কয়েক জায়গায় পুটিং ঠেসে দিয়েছিল শুধু। বর্ষার তোড়ে সে সব পুটিং কবে ভেসে গেছে।
বিষ্ণুপদ যে জীবনে ঘড়ি মেলা দেখেছে তা নয়। বিষ্ণুপদর ঘড়িই নেই। কাল শেষ রাতে সে ঘড়িটা দেখতে পেল। কালো, গোলপানা, মস্ত বড়। তাতে দুখানা সাদা কাটা। একটা বড়, আর একটা ছোটো। কাটা দুখানা বাই বাই করে ঘুরে যাচ্ছে। তারপর ঘুরতে ঘুরতে গতিটা কমে এল। খুব কমে এল। তারপর একেবারে থেমে আমাত লাগল। বড় কাঁটা এক পাক মারলে ছোটাকাঁটা এক ঘর এগোয়, এটাই নিয়ম। বিষ্ণুপদ দেখল, বারোটা ঘরের মধ্যে একটা মাত্র বাকি। বড় কাঁটা খুব ধীরে ধীরে পাক খাচ্ছে আর ছোটো কাঁটাটা শেষ ঘরের দিকে এগোচ্ছে।
কথাটা একমাত্র যাকে বলা যায় সে হল, রামজীবনের মা। নয়নতারা রান্নাঘরে।
বুঝলে একমাত্র নয়নতারাই বুঝবে। বিষ্ণুপদর সব কথা নয়নতারাই একমাত্র বুঝতে পারে। পৌনে একশ বছর বেঁচে আছে বিষ্ণুপদ, নয়নতারা তার সঙ্গে লেগে আছে নাহোক পঞ্চাশ বছর। পঞ্চাশ বছর ধরেই কাছে। বিষ্ণুপদ নিশ্চয়ই সারাদিনে সর্বকথা ঠিকমতো বলে না, ঠিক কথাও বলে না। কিন্তু নয়নতারা তার সব কথাই নেড়েচেড়ে ভেবে দেখে। কালঘড়ির কথাটাও নয়নতারা ফেলবে না।
লম্বা দাওয়ার উত্তরপ্রান্তে রান্নাঘর। ভেজা ঘুটে আর সাতানো গুল দিয়ে আঁচ তুলতে আজ সকালে দমসম হয়েছে। সবাই। খুব ধোঁয়া হয়েছিল। এখন বোধহয় আঁচ উঠেছে। রান্নাঘর থেকে দুটো গলার আওয়াজও আসছে। একটা তর্ক বেধে উঠছে। ঝগড়ায় গড়াবে। ও দুজন হচ্ছে সেজো আর মেজো বউ। দুজনে প্রায়ই লেগে যায়। হাঁড়ি আলাদা হল বলে। এইসব ঝগড়া কাজিয়ায় নয়নতারা কখনও থাকে না। মাঝখানে পড়ে মিটমাটও করতে যায় না। আসলে নয়নতারা বড় ভীতু মানুষ। সবসময়ে সিটিয়ে আছে ভয়ে। মেজো বামাচরণের বউ শ্যামলীর জিভের যেমন ধার, গলার তেমনি জোর। সেজো রামজীবনের বউ রাঙা যে খুব ভালমানুষ তা নয়। তবে কমজোরি। হাঁপানী আছে। খুব ভোগে।
নয়নতারা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। হাতে একটা বড় সোলা কচু। বর্ষায় কচুঘেঁচুই সম্বল।
নয়নতারা কাছে এসে একবার বিষ্ণুপদর দিকে তাকাল। ভারী নিরীহ চোখ নয়নতারার। গরুর চোখ। বিষ্ণুপদ জানে, সে নিজেও তেমন বুদ্ধি রাখে না। তার বউ নয়নতারাও না। ভগবান তাদের একই ছাঁচে তৈরি করেছেন।
নয়নতারার কথা কম। কথা কওয়ার ধাতটাই নেই, কায়দাও জানে না। শুধু বিষ্ণুপদর সঙ্গেই যা একটু কয়। মৃদুস্বরে বলল, বৃষ্টি হচ্ছে। গায়ে ছাঁট লাগছে না তো! ঘরে গিয়ে বসলেই তো হয়।
ঘরখানা বড় আঁধার লাগে। একটু আলোয় বসে আছি।
তাহলে থাকো। একখানা চাঁদর এনে দিই, জড়িয়ে বোসো!
লাগবে না। এই বেশ আছি। কফ-কাশির ধাত তো নয়।
শরীর নিয়ে বড়াই করতে নেই। হতে কতক্ষণ। যা বাদলা হচ্ছে।
বিষ্ণুপদ কথাটা কইবার আগে ভণিতা করতে গিয়ে একটু কেশে নিয়ে বলে, তোমাকে একখানা কথা কইবার জন্য মন করছে। কবো?
বলো।
শেষ রাতে আমি কালঘড়ি দেখলাম। ব্যাপার সুবিধের নয়।
কালঘড়ি দেখলে?
তোমার মনে নাই, আমার ঠাকুর্দাও দেখেছিল! সেই যে মাঘের শেষে যেবার ঠাকুর্দা চলে গেল।