Site icon BnBoi.Com

কালো বেড়াল, সাদা বেড়াল – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

কালো বেড়াল, সাদা বেড়াল - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

 ০১-০৫. ইন্টারকমে অতনুর গলা

ইন্টারকমে অতনুর গলা পাওয়া গেল, স্যার, একজন পুলিশের লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন।

মনোজ সেন খুবই অবাক হয়ে বলল, পুলিশের লোক? পুলিশের লোক আমার কাছে কী চায়?

সেটা উনি আপনাকেই বলতে চান।

আজ আমার সময় কোথায়? এখনই ফরেন ডেলিগেটরা এসে পড়বেন। একটু আগে তাজ বেঙ্গল থেকে ওঁরা বেরিয়ে পড়েছেন। মিনিস্টারের সঙ্গে জাস্ট পনেরো মিনিটের অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেরেই চলে আসবেন। আমি কতটা ব্যস্ত বুঝতে পারছ? আই অ্যাম গোয়িং থ্রু দি পেপার্স নাউ। লাস্ট মিনিট চেকিং।

সবই বলেছি স্যার। তবু উনি ইনসিস্ট করছেন।

ওঁকে ফোনটা দাও।

ও-কে স্যার।

টেলিফোনে একটা মিহি গলা পাওয়া গেল যা মোটেই পুলিশি কর্তৃত্বব্যঞ্জক নয়। বরং খুবই ভদ্র ও বিনয়ী গলা, মিস্টার সেন, আমার প্রয়োজনটা বিশেষ জরুরি।

আপনি আগামী কাল আসুন।

আমি জানি আপনি আজ ফরেন ডেলিগেটদের নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। আজ তাদের সঙ্গে আপনার লাঞ্চ এবং মিটিং। একটা কন্ট্রাক্টও আজ সই হবে। কিন্তু আমার দরকারটাও গুরুতর।

খুবই মুশকিলে ফেললেন। এনিওয়ে, দু’মিনিটের বেশি সময় নেবেন না। বাই দি বাই, আপনি কি লালবাজারের লোক?

না।

তা হলে কি লোকাল থানা?

না। আমার হেড কোয়ার্টার প্যারিসে।

বলেন কী? ফরাসি পুলিশ কি বাংলা বলে?

বলে। যদি ইন্টারপোলের লোক হয়। আমি বাঙালি। দুর্ভাগ্যবশত।

ইন্টারপোল? সে তো সাংঘাতিক ব্যাপার। আসুন মশাই।

তার সেক্রেটারি সোনালি সোম চুক্তিপত্রের কাগজগুলো টেবিলে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে দিচ্ছিল। মনোজ সেন তার দিকে চেয়ে বলল, ইন্টারপোলের কে একজন দেখা করতে চাইছে।

ঠিক আছে স্যার, আমি পরে আসছি।

কাগজগুলো চটপট ফাইলবন্দি করে সোনালি পাশের সুইংডোর ঠেলে ও ঘরে চলে গেল। যেতে না যেতেই বেয়ারা সামনের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে স্লিপ রাখল টেবিলে।

মনোজ সেন স্লিপটা নিয়ে নামটা দেখল। সুধাকর দত্ত। ইন্টারপোল।

ভিতরে নিয়ে এসো।

যে লোকটা ঘরে ঢুকল তার চেহারাটা বেশ ভাল। তাকতওয়ালা লোক। লম্বাই চওড়াই আছে। নেভি ব্লু সুট পরা। গলায় বো। বয়স ত্রিশের কাছেপিঠে।

নমস্কার।

নমস্কার, বসুন।

আপনি আজ খুবই ব্যস্ত আমি জানি সেনসাহেব। ডিস্টার্ব করলাম বলে ক্ষমা করবেন।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলুন কী করতে পারি।

আমার বক্তব্য খুব সংক্ষেপে বলা যাবে না। ইটস এ লং স্টোরি।

কিন্তু

কিন্তু আজ আপনার হাতে সময় নেই। ইন ফ্যাক্ট আমার হাতেও নেই। সেইজন্য শুধু কাজের কথাটুকু বলে নিই। কেমন?

সেই ভাল।

আমি আসছি এখন পশ্চিম এশিয়া থেকে।

এই যে বললেন প্যারিস?

হ্যাঁ। আমার হেড কোয়ার্টার প্যারিসে। কিন্তু আমি অন ডিউটি একটা অ্যাসাইনমেন্টে আছি।

বুঝেছি। বলুন।

আপনার কোম্পানি একটা বড় কন্ট্রাক্ট পাচ্ছে, তাই না?

হ্যাঁ।

মোট বারোজন ডেলিগেট এসেছেন, সবাই সরকারি প্রতিনিধি?

হ্যাঁ।

আপনি ক’দিন আগে ওখানে গিয়েছিলেন?

মাস আটেক আগে।

এঁদের সবাইকে কি আপনি চেনেন?

না। তবে কারও কারও সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দু’-তিনজনকে চিনি।

এই বারোজনের মধ্যে একজনকে আমার দরকার।

তার মানে?

তিনি একজন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল।

বলেন কী?

ভয় পাবেন না। আমি তাকে অ্যারেস্ট করব না, কোনও ঝঞ্ঝাট ঝামেলাও হবে না। আমি তাকে জাস্ট আইডেন্টিফাই করতে চাইছি।

তার মানে কি আপনি তাকে চেনেন না?

না। তবে এই বারোজনের মধ্যে একজন তিনি।

কিন্তু এরা সবাই সরকারি প্রতিনিধি। প্রত্যেকেই সরকারের দায়িত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। আপনার কি মনে হয় কোনও সরকার একজন ক্রিমিন্যালকে গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখবেন?

দুটো কারণে রাখতেই পারেন। এক, সরকার সম্ভবত জানে না যে ইনি একজন ক্রিমিন্যাল। দুই, ইনি হয়তো একজন এমন বিশেষজ্ঞ যে, সরকারের পক্ষে এঁকে তাড়ানো সম্ভব নয়। তৃতীয় আর একটা কারণও আছে। ইনি হয়তো সরকারকে ব্ল্যাকমেল করেছেন বা এঁর খুঁটির জোর আছে।

আইডেন্টিফাই করলে কী করবেন?

আমার কাজ আইডেন্টিফাই করা এবং হেড কোয়ার্টারে জানানো।

তারপর?

ডেলিগেটরা এরপর মায়ানমার এবং থাইল্যান্ড যাবেন। তারপর দেশে ফিরবেন। সম্ভবত আমাকেও ওঁদের পিছুপিছু যেতে হবে।

আমাকে কী করতে বলছেন?

আপনার কাছে আমার একটি প্রার্থনা আছে। আমি আজ ডেলিগেটদের কাছাকাছি থাকতে চাই। এ ব্যাপারে আপনিই আমাকে সাহায্য করতে পারেন।

কীভাবে?

আপনি আমাকে আপনার সেক্রেটারি হিসেবে ইন্ট্রোডিউস করবেন। আমি ওঁদের রিসেপশনের চার্জে থাকব।

তা কি হয়? আপনাকে আমি চিনিই না। একজন অচেনা লোকের ওপর এতটা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আপনার ক্রেডেনশিয়ালসও আমি এখনও দেখিনি।

কোটের পকেট থেকে সুধাকর তার কার্ড ও পাসপোর্ট বের করে টেবিলে রেখে বলল, দেখুন। আই অ্যাম নট অ্যান ইমপস্টার।

মনোজ দেখল। জাল বলে মনে হচ্ছে না। পাসপোর্টে বহু দেশের ইমিগ্রেশনের ছাপ আছে। সে আইডেন্টিটি কার্ড আর পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে বলল, কাজটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে।

আপনার পয়েন্টটা আমি বুঝতে পারছি। আমার দিক থেকে যদি ডেলিগেটদের কারও কোনও বিপদ ঘটে তা হলে আপনার এত বড় কন্ট্রাক্ট ভন্ডুল হয়ে যাবে। তাই না?

সেরকম একটা ভয় তো আছেই।

প্রথম কথা, আমার কাছে কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই। আপনি আমাকে সার্চ করে দেখতে পারেন। দ্বিতীয় কথা, আপনি ইচ্ছে করলে লালবাজারে ফোন করে আমার সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে না জানিয়ে আসিনি। আপনার কোনও ভয় নেই। ডেলিগেটরা কিছুই টের পাবেন না। তবে আমি যে ইন্টারপোলের লোক তা অতনুবাবু জানেন এবং আপনার সেক্রেটারি সোনালি সোমও হয়তো জানেন। আপনি সোনালিদেবীকে একটু অ্যালার্ট করে দিলেই হবে।

আপনি সোনালি সোমের নাম জানলেন কী করে?

সিম্পল হোমওয়ার্ক। এবার বলুন, আপনি রাজি?

মনোজ মুশকিলে পড়ল। দ্বিধা, আশঙ্কা দুটোই হচ্ছে। একটু ভেবে সে বলল, কিন্তু আমার কোম্পানির ব্যাপারে এরা আপনাকেও প্রশ্ন করতে পারেন। সে ক্ষেত্রে কী হবে?

সে ক্ষেত্রে জবাব দেবেন মিস সোম। আমার কাজ হবে ওঁদের আপ্যায়নের দিকে নজর রাখা। কাছে কাছে থাকা ছাড়া আমার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই।

আপনি লোকটাকে আইডেন্টিফাই করবেন কী করে বুঝতে পারছি না।

ক্রিমিনালদের চোখমুখ অনেক সময়ে বিট্রে করে। কথাবার্তা থেকেও কিছু বেরিয়ে আসতে পারে।

লোকটার নাম জানেন?

আসল নাম রজার ভ্যালন। কিন্তু এদের মধ্যে ও নামে কেউ নেই।

তা হলে?

নামটা বদলে নেওয়া শক্ত কাজ নয়। ক্রিমিন্যালরা এ কাজ প্রায়ই করে থাকে।

এর ক্রাইম কী?

অনেক রকম। ইনি একজন এক্সপ্লোসিভ এক্সপার্ট। আপাতত এর বেশি জানার দরকার কী?

ক্রিমিন্যালটির এখানে আসার বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য আছে কি?

আছে। কিন্তু সে কথাও আপাতত থাক।

দাঁড়ান মশাই, লালবাজারে ফোনটা আগে করে নিই।

করুন। এই যে নম্বর…

মনোজ ফোন করল। তারপর বলল, ঠিক আছে। কিন্তু ওয়াচ ইয়োর স্টেপস।

ওসব নিয়ে আপনি ভাববেন না।

মনোজ সোনালিকে ইন্টারকমে ডাকল। সোনালি এলে বলল, ইনিই সেই ইন্টারপোল অপারেটর। বিশেষ কারণে ইনি আজ ডেলিগেটদের সঙ্গে থাকতে চান, অ্যাজ মাই সেক্রেটারি। আপনি সামলে নিতে পারবেন তো?

সোনালি একটু অবাক হল। কিন্তু সেটা প্রকাশ পেল চোখে। গলাটা স্বাভাবিক রেখেই বলল, পারব।

কথাবার্তা–মানে টেকনিক্যাল কোনও প্রসঙ্গ উঠলে আপনি সামলে নেবেন। ইনি শুধু অন্যান্য দিক দেখবেন। এঁর নাম সুধাকর দত্ত।

কেউ কারও দিকে ভাল করে তাকাল না। সোনালি নিজের ঘরে চলে গেল।

সুধাকর দত্ত বলল, আপনার আর কোনও প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।

মনোজ একটু চিন্তিতভাবে সুধাকরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, প্রশ্ন তো অনেক। একজন ক্রিমিন্যাল আমার কোম্পানিতে আসছে কেন? আমার কারখানা তো তেমন গুরুতর কিছু তৈরি করে না। আমরা এক ধরনের অ্যালয় তৈরি করি যা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পোনেন্টস তৈরির কাজে লাগে। প্রোডাকশন বেশি নয়, কারণ অনেক মেটেরিয়াল পাওয়া যায় না। কিন্তু আমার এখানে গোপনীয় কিছু নেই।

সুধাকর সামান্য একটু ভেবে বলল, লোকটা কেন এ দেশে এসেছে তা আমরা এখনও জানি না। উদ্দেশ্য ধরা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আমরাও অন্ধকারে হাতড়ে মরছি। তবে ওয়াচ করতে পারলে হয়তো কিছু জানা যেতে পারে। আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?

না। টেনশন হচ্ছে। আপনি আমাকে একটু চিন্তায় ফেলেছেন।

টেলিফোন বাজল। মনোজ টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলল, সেন… আচ্ছা ঠিক আছে।

ফোনটা রেখে বলল, ওঁরা রাইটার্স থেকে রওনা হচ্ছেন। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বেন। ভাল কথা, ওঁরা কিন্তু গুজরাত, মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানাতেও কয়েকটা কারখানা ভিজিট করেছেন।

সেটা আমি জানি। তবে আমরা খবরটা দেরিতে পেয়েছি বলে ওসব জায়গায় ওঁদের ধরতে পারিনি। কলকাতায় ওঁদের শেষ স্টপ ওভারে ধরতে পেরেছি।

ঘড়িটা দেখে নিয়ে মনোজ বলল, আর পনেরো মিনিট পরে আমাদের নীচে যেতে হবে।

সুধাকর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ততক্ষণে আমি আপনার কমপ্লেক্সটা একটু ঘুরে দেখে নিতে চাই। উইথ ইয়োর কাইল্ড পারমিশন।

কোনও বাধা নেই। তবে একা তো পারবেন না। সোনালি বরং আপনাকে নিয়ে যাক।

মনোজ সোনালিকে ডেকে বলল, ওঁকে কারখানাটা চটপট ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিন। হাতে খুব বেশি সময় নেই।

সোনালির ভ্রু সামান্য কুঁচকে ফের সহজ হয়ে গেল। বলল, ঠিক আছে। আসুন মিস্টার দত্ত।

সোনালি মেয়েটাকে মনোজ গত এক বছরেও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি। অত্যন্ত কাজের মেয়ে। চটপটে, স্মার্ট। দেখতেও চমৎকার। কিন্তু মেয়েটার মুখে কখনও হাসি দেখা যায় না। এত গম্ভীর এবং এতই সাংঘাতিক ব্যক্তিত্ব যে মনোজ ওর বস হওয়া সত্ত্বেও মনে মনে ওকে সমীহ করতে বাধ্য হয়। সোনালির অ্যাকাডেমিক রেকর্ড খুবই ভাল। ইংরেজিতে এমএ এবং আরও কয়েকটা ট্রেনিং নেওয়া আছে। কম্পিউটার ভাল জানে। খুব গোছানো এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ। গত এক বছরের মধ্যে একদিনও অফিসে দেরি করে আসেনি। কখনও কাজে কোনও ঢিলেমি দেখা যায়নি। ওর শরীর খারাপ হয় না। কোনও বায়না বা দাবিদাওয়া নেই। সোনালির ওপর চোখ বুজে নির্ভর করা যায়। কিন্তু ওর মধ্যে একটু রোবট রোবট ভাবটা খুব বেশি পছন্দ করতে পারে না মনোজ। এই যে একটু ভ্রু কোঁচকাল এতেই মনোজের অস্বস্তি হচ্ছে। রেগে গেল নাকি সোনালি?

ইন্টারকমে অতনুকে ডেকে মনোজ বলল, ওঁরা রাইটার্স থেকে রওনা হয়েছেন। তোমার রিসেপশন কমিটি ঠিক আছে তো?

সব ঠিক আছে স্যার।

তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। সুধাকর দত্ত নামে যে ভদ্রলোক এসেছেন, আমার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করবেন। বুঝেছ?।

সেক্রেটারি?

হ্যাঁ। অ্যান্ড নো কোশ্চেন।

ওকে স্যার।

আর ইন্টারপোল কথাটা সম্পূর্ণ ভুলে যাও। বুঝেছ।

হ্যাঁ স্যার। উনিও আমাকে সেটা বুঝিয়ে গেছেন।

মনোজ উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। বিশাল দেওয়াল-জোড়া কাঁচের শার্সি। অখণ্ড অভঙ্গুর কাচ। পিছনে গাছপালা, সাজানো বাগান-ঘেরা লন, লনের ওপাশে কয়েকটা লম্বা লম্বা শেড। ওইসব শেড হল তার কারখানা। ইস্টার্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়। বাঁ দিকে কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি, ডানদিকে মেন্টিং শপ। খুব বেশি লোক এখানে কাজ করে না। লোকের তেমন দরকারও নেই। কিন্তু দরকার ভাল বিশেষজ্ঞের। আগে কারখানার আবহাওয়া শান্ত ছিল। এখন একটা ইউনিয়ন হয়েছে। কিছু কিছু অশান্তি দেখা দেয় মাঝে মাঝে। তবে এখনও তা মাত্রা ছাড়ায়নি। আর একটা ঝামেলা হচ্ছে, কিছু পয়সাওলা লোক কারখানাটা কিনে নিতে চায়। তার জন্য চাপও দেয় নানাভাবে। অনেক টাকার অফার।

টেনশন মনোজ সহ্য করতে পারে না। তার নার্ভ শক্ত নয়। কিন্তু তার বউ রোজমারির নার্ভ খুব শক্ত। জার্মানিতে যখন ছিল মনোজ তখন রোজমারির সঙ্গে তার প্রেম এবং বিয়ে। রোজমারিও মনোজের মতোই একজন মেটালার্জিস্ট। তাদের দুজনেরই উঁচু ডিগ্রি আছে। এই কারখানা করার ব্যাপারে রোজমারির অবদানই বেশি। সে-ই একটি জার্মান কোম্পানিকে ধরে একটা কোলাবরেশনের ব্যবস্থা করে। এই কারখানার পিছনে সেই জার্মান কোম্পানির টাকা ও প্রযুক্তি বারো আনাই কাজ করছে।

রোজমারি ছাড়া মনোজ অচল। রোজমারি যেমন কর্মঠ তেমনি বুদ্ধিমতী। ক্ষুরধার তার ধাতু সংক্রান্ত জ্ঞান। এই কারখানায় যে অ্যালয় তৈরি হয় তার যে বাজার একদিন এত ভাল হবে তা রোজমারিই প্রথম বুঝতে পেরেছিল। আজ কারখানা চলছে রমরম করে। বিদেশের বাজার তারা অনেকটাই দখল করতে পেরেছে। যে প্রতিনিধিদল আজ আসছে, তাদের সঙ্গেও প্রথম যোগাযোগ করেছিল রোজমারিই।

বাইরের দিকে চেয়ে সে আনমনে কিছুক্ষণ নানা কথা ভাবল। একটু টেনশন হচ্ছে। কেন হচ্ছে কে জানে। এই সুধাকর দত্তর হঠাৎ উদয় তার একটুও ভাল লাগছে না।

ইন্টারকম বাজল। অতনু।

স্যার, এইমাত্র খবর এল ডেলিগেটদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওঁরা তাজ বেঙ্গলে ফিরে যাচ্ছেন।

কী বলছ? কে অসুস্থ হয়ে পড়ল?

নাম তো বলেনি স্যার। তবে ওঁরা এখন আসতে পারছেন না।

পরে আসবে?

তাও স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।

কে ফোন করেছিল?

সুব্রত।

সুব্রত মনোজের পিআরও। ডেলিগেটদের সঙ্গে সঙ্গে আছে। মনোজ বিরক্ত হয়ে বলল, সুব্রত কি আবার কন্ট্রাক্ট করবে?

হ্যাঁ স্যার, হোটেলে পৌঁছে।

আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে।

ঠিক আছে স্যার।

মনোজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রোজমারি লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে গ্র্যান্ডে রয়েছে। তাকে কি জানানো দরকার? জানানোই ভাল। লাঞ্চটা বোধহয় ক্যানসেল করতে হবে। সে ফোনটা তুলে নিল।

০২.

আজ, তেরোই সেপ্টেম্বর সকালে একগোছা নৈর্ব্যক্তিক রক্তগোলাপ কে পাঠাল তাকে? পার্ক স্ট্রিটের এক ফ্লোরিস্টের নোক এসে দিয়ে গেল। সেলোফেনে যত্ন করে মোড়া, তোড়ার গায়ে একটা ট্যাগ। তাতে টাইপ করা একটি বাক্য: হ্যাপি বার্থ ডে টু রোজমারি। কোনও মানে হয় না ব্যাপারটার। আজ রোজমারির জন্মদিন? তার জন্মদিন পার হয়ে গেছে আরও দশ দিন আগে। ট্যাগে কারও নাম নেই এটা রীতি নয়। রহস্য তার ভাল লাগে না। ঘটনাটা তাকে ভাবিয়ে তুলল।

তাদের বাড়ির কাজের লোক তিনজন। ঘরের কাজ করে তাজু আর লেখা। বাগানের জন্য আছে বনমালী। তাজু আর লেখা বাপ আর মেয়ে। দু’জনেই খুব কাজের। তাজু রাঁধে, বাজারহাট করে, জামাকাপড় মেশিনে কাঁচে ও ইস্তিরি করে, ইলেকট্রিক বা টেলিফোনের বিল মেটায়, জার্মান শেফার্ড কুকুরটার দেখাশুনো করে এবং আরও নানা কাজে সাহায্য করে। লেখা ঘরদোর পরিষ্কার করা, বাসন মাজা, বিছানা করা ও তোলা ইত্যাদি। দু’জনেই খুব পরিশ্রমী। বনমালীও বেশ কর্মঠ। এরা সকলেই সাতশো টাকা করে মাইনে, খাওয়া, থাকার ঘর, কাপড়চোপড় পায়। ডয়েশ মার্কের হিসেবে বেতন এতই কম যে রোজমারি খুবই অবাক হয়। কোনও সভ্য দেশে এই বেতনে দিন-রাতের কাজের মানুষ পাওয়া যায় এরকম সে স্বপ্নেও ভাবেনি। প্রায় ক্রীতদাসের মতোই এরা হুকুম তামিল করে, খুবই ভদ্র এবং অনুগত। মাঝে মাঝে সে ভাবে, এদের কি আমরা এত সস্তায় কিনে নিয়েছি?

গোলাপের তোড়াটা যখন এল তখন দোতলার বারান্দায় সকালের রোদে বসে ছিল রোজমারি। গায়ে হালকা সানট্যান তেল মেখে নিয়ে রোজই সে কিছুক্ষণ সকালের রোদ পোয়ায় এবং চোখ বুজে খুব স্থিরভাবে সারা দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করে নেয়। তার স্বামী মনোজ একটু অগোছালো স্বভাবের এবং হয়তো আত্মবিশ্বাসেরও কিছু অভাব আছে। মনোজের ফাঁকগুলো রোজমারিকেই ভরাট করতে হয়। সকালবেলায় এই রোদ পোয়ানোর সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারা দিনটাকে আগাম সাজিয়ে নেওয়া। ঘড়ি ধরে এবং সঠিক পরম্পরায়।

ঠিক ওই সময়েই গোলাপের তোড়াটা নিয়ে ফুলওয়ালার লোক এল। তোড়াটা ওপরে নিয়ে এল তাজু। মেমসাব, ফুল।

কীসের ফুল?

বার্থ ডে। ফ্লোরিস্টের লোক দিয়ে গেল।

রোজমারি ফুল এবং ট্যাগ দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, আমার বার্থ ডে তো আজ নয়!

জানি মেমসাব।

ঠিক পঁয়ত্রিশটা ফুল। রোজমারির বয়স এখন পয়ত্রিশই। কিন্তু কে এই ভুল দিনে ফুল পাঠাল সেটা বুঝতে পারল না সে। ফুল সে খুবই ভালবাসে। ভালবাসে কাজ। ভালবাসে সাফল্য। ভালবাসে লড়াই। ভালবাসে হেলথ ফুড। ভালবাসে আরও অনেক কিছু।

রোজমারি তাজুকে বলল, লিভিং রুমে সাজিয়ে রেখে দাও।

তাই রাখল তাজু। মধ্যবয়স্ক তাজু একটু কম কথার মানুষ। সে লম্বা ও রোগা এবং মধ্যবয়স্ক। তার মেয়ে লেখার বয়স কুড়ি হতে পারে। একটু লাজুক। বাবাকে খুব ভয় পায়। এই বাবা আর মেয়েকে খুব লক্ষ করে রোজমারি। এমন অদ্ভুত আনুগত্য ও শ্রদ্ধার ভাব সে কদাচ দেখেনি। এদের মধ্যে সবসময়ে যেন কৃতজ্ঞতার ভাব ফুটে থাকে। মনোজ বলেছিল, এ দেশে ঝি-চাকরের মাইনে নাকি অনেক কম। এরা বেশি মাইনে পায় বলেই অমন কৃতার্থ। রোজমারির বিস্ময় এখানেই। সাতশো টাকাও কি খুব খুব খুব কম টাকা নয়? মাত্র সাতশো টাকায় একটা মানুষ!

ব্রেকফাস্ট করতে যখন লিভিং রুম পেরিয়ে ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছিল রোজমারি তখন বুককেসের ওপর কাট গ্লাসের ফুলদানিটা চোখে পড়ল।

পঁয়ত্রিশটা গোলাপের কুঁড়ি। সেলোফেন ছিঁড়ে তাজু সাজিয়ে রেখেছে। রোজমারি কাছে গিয়ে ফুলগুলো দেখল। টাটকা এবং সুন্দর গন্ধ। একটা গোলাপকে সে একটু স্পর্শও করল।

কে পাঠাল? ভুল দিনে কেন? সে কি তার জন্মদিন জানে না?

ব্রেকফাস্ট খুব সামান্যই খায় রোজমারি। এ দেশের দুধ তার সহ্য হয় না, মুখেও রোচে না। তার বদলে সে বিদেশ থেকে আনানো একটা বিভারেজ খায়। সঙ্গে দুটো মাখন ছাড়া টোস্ট, একটা কলা। সকাল ঠিক নটায়। আর এই সময়েই তার দু’জন সেক্রেটারি এসে হাজির হয়। একজন শুভ, অন্যজন মৈত্রেয়ী। দু’জনেরই বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। খুব চটপটে এবং বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিমতী। শুভ ডিকটেশন নেয় এবং কাগজপত্তর গুছিয়ে রাখে। মৈত্রেয়ী রাখে বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এরা খানিকটা রোজমারির সঙ্গীও।

দু’জন লিভিং রুমে অপেক্ষা করছিল। রোজমারি তার ব্রেকফাস্ট সেরে এসে ঢুকতেই তারা উঠে দাঁড়াল।

রোজমারি বলল, একটা মজার ঘটনা দেখবে? আজ আমার বার্থ ডে বলে কে একজন ফুল পাঠিয়েছে। ওই দেখো।

দু’জনে দেখল। মৈত্রেয়ী বলল, কিন্তু আপনার বার্থ ডে তো

সেইটেই তো মজা। কে পাঠাতে পারে বলে তো!

শুভ বলল, কোনও অন্যমনস্ক লোকই হবে।

শুভ গিয়ে ট্যাগটা দেখল। তারপর হঠাৎ বলল, ম্যাডাম, ট্যাগের উলটো পিঠে কিছু লেখা আছে।

কী লেখা আছে?

আর আই পি।

রোজমারি খুব অবাক হয়ে বলল, এটা কীরকম ইয়ারকি? আর আই পি?

হ্যাঁ ম্যাডাম, তাই লেখা।

রোজমারি একটু রেগে গেল। বলল, আর আই পি মানে তো রেস্ট ইন পিস। কবরের ওপর লেখা থাকে। শুভ, ফ্লোরিস্টের নাম আর ঠিকানা ট্যাগে ছাপা আছে। এখনই খোঁজ নাও তো।

নিচ্ছি ম্যাডাম। বলে শুভ ফোন তুলে নিল।

রোজমারি দোতলায় উঠে তার মুখটা আয়নায় দেখে চুলটুল ঠিক করে নিল। আজ বিদেশের ডেলিগেটরা আসবে। তার অনেক কাজ। অফিস থেকে তাকে দুপুরের আগেই চলে যেতে হবে গ্র্যান্ডে। মাননীয় অতিথিবৃন্দকে আপ্যায়িত করতে হবে মধ্যাহ্নভোজে।

যখন নীচে নেমে এল তখন শুভ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে।

ম্যাডাম, ওরা বলছে আর আই পি হল একজনের নাম। রজার আইভ্যান পোলক। ফুলটা সে-ই পাঠিয়েছে।

রোজমারি অবাক হয়ে বলল, কিন্তু লোকটা কে? এ নামে তো আমি কাউকে চিনি না।

ওরাও বলতে পারল না। ওদের অর্ডার বুকে এই নাম লেখা আছে। ওদের বলা ছিল যেন কার্ডের পিছনে আর আই পি প্রিন্ট করা হয়।

রোজমারি অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মিস্টার পোলক বেঁচে থাকুন, কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারছি না। আমাদের আর সময় নেই। চলো।

তারা বেরিয়ে পড়ল। মনোজ আজ একটু আগেই বেরিয়ে গেছে অফিসের রিসেপশন ঠিক করতে। আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ।

রোজমারি কোনও ব্যাপার নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তা করে না। সে কাজের মানুষ। কিন্তু গোলাপের তোড়াটা তাকে ভাবাচ্ছে।

আগে নিজের গাড়ি নিজেই চালাত রোজমারি। কিন্তু কলকাতার রাস্তার ভিড় আর উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে সে গাড়ি চালানো ছেড়েছে। তার গাড়ি চালায় শিউশরণ। শিউশরণ খুবই ভাল ড্রাইভার। তাকে দু’হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। এ টাকাটাও যাচ্ছেতাই রকমের কম। ভারতবর্ষের অর্থনীতির ধাঁচটা রোজমারি আজও বুঝে উঠতে পারল না।

নতুন বড় মারুতির সামনের বাকেট সিটে রোজমারি, পিছনে শুভ আর মৈত্রেয়ী। গাড়ির কাঁচ বন্ধ, এয়ার কন্ডিশনার চলছে।

রোজমারি কর্মচারীদের সঙ্গে বাংলা এবং ভাঙা হিন্দিতেই কথা বলে। কারণ তার মাতৃভাষা জার্মান কেউ বুঝবে না। আর ইংরেজি এখনও রোজমারি ভাল রপ্ত করতে পারেনি। মনোজের সঙ্গে আগে সে জার্মান ভাষায় কথা বলত। আজকাল বাংলায় বলে। তাতে ভাষাটা শিখতে তার সুবিধে হয়। এখন সে বাংলা হরফ শেখার পর বই পড়ার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে শুভ আর মৈত্রেয়ী তাকে খুব উৎসাহের সঙ্গে সাহায্য করে।

লাল গোলাপের ঘটনাটা মন থেকে তাড়ানোর জন্য রোজমারি শুভকে বলল, এবার তুমি আমাকে কোন বইটা পড়তে দেবে শুভ?

পথের পাঁচালী পড়বেন ম্যাডাম?

ও বইটার কথা তুমি আর মৈত্রেয়ী অনেকবার বলেছ।

হ্যাঁ, খুব ভাল বই।

শক্ত নয় তো! শক্ত হলে আমি পারব না। জানো তো রাতে শোওয়ার আগে মাত্র কিছুক্ষণ আমি পড়ার সময় পাই।

জানি ম্যাডাম। এটা শক্ত বই নয়। তবে ঘটনাবহুল নয়।

দিয়ো। তুমি যে মহাভারতটা দিয়েছ সেটা কিন্তু খুব কঠিন। আমি অর্ধেক কথাই বুঝতে পারছি না।

ঠিক আছে ম্যাডাম, আপনাকে একটা সহজ অনুবাদ এনে দেব।

অফিসে নিজের চেম্বারে বসে রোজমারি দ্রুত কয়েকটা কাজ সারল। কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে গিয়ে চারদিকে চরকিবাজি করল। সব ঠিক আছে। ছায়ার মতো তার পিছনে সবসময়ে মৈত্রেয়ী আর শুভ। ওরা তাকে খুব পছন্দ করে, এটা টের পায় রোজমারি। সেও এ দুটিকে বেশ ভালবাসে।

মনোজের সঙ্গে টেলিফোনে তার কিছু কথা হল।

মনোজ, আমি তা হলে গ্র্যান্ডে যাচ্ছি।

যাও।

তুমি একা সব দিকে চোখ রাখতে পারবে তো।

পারব। সব ঠিকই আছে।

ডেলিগেটদের লিডার একজন বাতিকগ্রস্ত লোক। খুব খুঁতখুঁতে। শকুনের মতো চোখ। ইনফ্রাস্ট্রাকচার পছন্দ না হলে কন্ট্রাক্ট দেবে না।

জানি। আমরা তো সাধ্যমতো করছি।

রোজমারি তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। হোটেলে রোজমারির কাজ হল স্যুইটটা ঠিকঠাক গোছানো আছে কি না তা দেখা। সে নিজেও খুঁতখুঁতে। লাঞ্চের মেনু এবং ড্রিঙ্কস সে নিজে অনেক ভাবনাচিন্তা করে ঠিক করেছে। ডেলিগেটদের তেল দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। এমনিতেই তার রুচি একটু নিখুঁত ঘেঁষা। এ দেশের লোকরা বেশির ভাগই একটু অলস এবং অসতর্ক। এদের ওপর নির্ভয়ে ভরসা করা যায় না। তাই রোজমারি সব ব্যাপারেই তদারকিকে গুরুত্ব দেয়।

টেবিলে সাদা টেবিল ক্লথ পাতা। ফুলদানিতে টাটকা ফুল। এবং এখানেও রক্তগোলাপ।

রোজমারি ভ্রু কোঁচকাল, শুভ, মৈত্রেয়ী, দেখতে পাচ্ছ?

মৈত্রেয়ী বলল, কী ম্যাডাম?

এখানেও লাল গোলাপ!

হ্যাঁ। তাই তো!

আমি রজনীগন্ধার কথা বলেছিলাম। একটু খোঁজ নাও তো লাল গোলাপ কেন রেখেছে।

মৈত্রেয়ী গেল এবং একটু বাদেই একজন এসে দুঃখপ্রকাশ করে বলল, ম্যাডাম, আপনার ফ্লোরিস্ট লাল গোলাপই পাঠিয়েছে।

কেন, আমার তো বলা ছিল রজনীগন্ধা। শুভ, খোঁজ নাও।

শুভ টেলিফোন করতে ছুটল এবং ফিরে এসে বলল, ওরা বলছে আপনি নাকি ফোন করে আগের অর্ডার ক্যানসেল করে লাল গোলাপ দিতে বলেছেন!

কখনওই নয়।

রোজমারির ফরসা রং হঠাৎ টকটকে লাল হয়ে গেল। সে বলল, কেউ একজন আমার সঙ্গে আজ রসিকতা করছে। আমি এটা পছন্দ করছি না।

শুভ এবং মৈত্রেয়ী পরস্পরের দিকে চেয়ে খুব গম্ভীর হয়ে গেল। শুভ মৃদু স্বরে বলল, আমি ওদের বলে দিয়েছি রজনীগন্ধা পাঠাতে। এখনই এসে যাবে।

রোজমারি শুভর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কিন্তু কে এরকম করছে বলতে পারো?

না ম্যাডাম। আমাদেরও একটু অবাক লাগছে।

ট্যাগের পিছনে আর আই পি লেখাটাও আমার ভাল লাগছে না।

আপনি কি রজার আইভ্যান পোলক নামে কাউকে মনে করতে পারছেন?

না শুভ, আমার স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল। মানুষের নাম আমার মনে থাকে। ওরকম নামের কাউকে আমি চিনি না। নামটা শুনিওনি কখনও।

শুভ বলল, তা হলে ভাবনার কথা।

মৈত্রেয়ী বলল, এটা প্র্যাকটিক্যাল জোক হতে পারে।

রোজমারি বলল, সেটা হতে পারে, কিন্তু রসিকতাটা করবে কে? আমার তেমন বন্ধু বান্ধবী তো এখানে কেউ নেই। শুভ, আমার তেষ্টা পেয়েছে। ফ্রুট ককটেল দিতে বলল তো আমাদের।

যতক্ষণ পানীয় না এল ততক্ষণ রোজমারি চুপ করে সোফায় বসে রইল। তার দু’পাশে দু’জন ছায়াসঙ্গী, শুভ আর মৈত্রেয়ী।

বেয়ারা পানীয় দিয়ে যাওয়ার পর মৈত্রেয়ী বলল, ম্যাডাম, আপনি অত ভাববেন না। ব্যাপারটা হয়তো সিরিয়াস নয়।

রোজমারি গেলাসে চুমুক দিয়ে বলল, কোনও ডিসকর্ড ঘটলে আমি অস্বস্তি বোধ করি। ঘটনাটা স্বাভাবিক নয়।

এগারোটা নাগাদ মনোজের ফোন এল।

রোজি, একটা ঘটনা ঘটেছে।

কী ঘটনা?

ডেলিগেটরা আসতে পারছেন না। ওঁদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওঁরা হোটেলে ফিরে গেছেন।

সে কী?

রাইটার্স থেকে ফেরার পথে ঘটনাটা ঘটেছে। সুব্রত ওঁদের সঙ্গে আছে। সে ফোন করলে ঘটনাটা জানতে পারব।

আর লাঞ্চের কী হবে?

মনে হচ্ছে লাঞ্চ ক্যানসেল করতে হবে।

আমি কি তাজ বেঙ্গলে যাব? বা কাউকে পাঠাব?

দরকার নেই। সুব্রত ফোন করুক, তারপর দেখা যাবে।

আমি ওয়েট করছি।

শোনো, আর-একটা ঘটনা ঘটেছে।

কী ঘটনা?

হঠাৎ ইন্টারপোলের একজন অপারেটর এসে হাজির।

ইন্টারপোল! সে কী?

সে বলছে, ডেলিগেটদের মধ্যে একজন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল আছে। সে তাকে আইডেন্টিফাই করতে চায়। অপারেটরটি বাঙালি। তার নাম সুধাকর দত্ত।

এসব কী হচ্ছে বলো তো! অপারেটরটি কোথায়?

সে কমপ্লেক্স ঘুরে দেখতে গেছে। সঙ্গে সোনালি।

ডেলিগেটদের মধ্যে ক্রিমিন্যাল ঢুকবে কী করে? ওরা তো বেশির ভাগই সরকারি লোক। তিনজন ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আছেন, তারা সরকারি লোক না হলেও অনারেবল।

সব বলেছি। সুধাকর দত্ত বলছে, ক্রিমিন্যালটি সাধারণ নয়। সে একজন বিশেষজ্ঞ এবং নিজের নাম ব্যবহার করছে না।

তা হলে আমরা এখন কী করব?

বুঝতে পারছি না। কিন্তু তোমাকে নার্ভাস মনে হচ্ছে কেন? তুমি তো ঠান্ডা মাথার মেয়ে।

মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছি না। এ দিকেও কিছু ঘটনা ঘটছে।

কী হল রোজি?

দেখা হলে বলব। আমি নার্ভাস নই, বিরক্ত।

বুঝতে পেরেছি।

সুব্রত ফোন করার পরই আমাকে জানাবে।

ঠিক আছে।

ফোন ধরার সময় তার ছায়াসঙ্গী দু’জন সঙ্গে থাকে না। তারা জানে ফোনে এমন অনেক কথা হয় যা তাদের শোনা উচিত নয়।

রোজমারি ঘরে ফিরে এসে দু’জনকে বলল, তোমরা জানো আমাদের অফিসে আজ ইন্টারপোলের এজেন্ট এসেছে?

দু’জনেই অবাক হয়ে বলল, সে কী?

আজকের দিনটাই বড্ড গোলমেলে। ওদিকে ডেলিগেটদের একজন অসুস্থ। ওঁরা আসবেন কি না বোঝা যাচ্ছে না।

শুভ বলল, কীরকম অসুস্থ?

তা জানি না। সবকিছু ধাঁধার মতো লাগছে।

পানীয়টা ঢকঢক করে শেষ করল রোজমারি। তারপর চুপ করে বসে রইল চোখ বুজে।

অনেকক্ষণ বাদে শুভ বলল, আপনি যখন ফোনে কথা বলছিলেন তখন ফ্লোরিস্টের লোক এসে ফুল বদলে দিয়ে গেছে।

রোজমারি চোখ খুলে দেখল, একগোছা রজনীগন্ধা যেন হেসে উঠল।

ফুল সে খুব ভালবাসে। বিশেষ করে সাদা ফুল। মনটা হঠাৎ যেন এত খারাপের মধ্যেও ভাল হয়ে গেল। সে উঠে গিয়ে ফুলগুলোকে হাত দিয়ে একটু আদর করল। তারপর হঠাৎ শুভর দিকে চেয়ে বলল, শুভ, কেউ কি আমাকে খুন করতে চায়?

০৩.

লোকটাকে একটুও ভাল লাগছে না সোনালির। মনে হচ্ছে, লোকটা ধূর্ত ও কুট। কারখানা দেখার নাম করে লোকটা একটা নোটবই বের করে কী সব যেন টুকে নিচ্ছিল।

মেল্টিং শপ দেখে শুধু প্রশ্ন করল, আপনারা কোল গ্যাস ব্যবহার করেন বুঝি?

সোনালি বলল, হ্যাঁ।

চারদিকে ঘুরেটুরে দেখে বলল, প্রোডাকশন তো বোধহয় তেমন বেশি নয়।

না। এই অ্যালয় একটু রেয়ার টাইপের।

সবচেয়ে বেশি সময় নিল কেমিক্যাল ল্যাবে। ল্যাবের ইনচার্জ ড. ইউ প্রসাদ একজন মস্ত ডিগ্রিধারী মানুষ। দীর্ঘকাল আমেরিকায় কাজ করেছেন। বয়স্ক লোক, কাজে ডুবে থাকতে ভালবাসেন। সুধাকর অনেকক্ষণ চাপা গলায় কথা বলল প্রসাদের সঙ্গে। কী কথা হচ্ছে তা চার-পাঁচ ফুট দূরত্বে বসেও সোনালি বুঝতে পারছিল না। কথা বলতে বলতে টেবিলের তলায় আড়ালে নোট করা অব্যাহত ছিল।

ল্যাব থেকে বেরিয়ে বাগান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুধাকর জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম আপনি ক’দিন এখানে কাজ করছেন?

এক বছর।

তা হলে তো অনেক কিছুই জানেন।

কী জানব?

এই এখানকার টেকনিক্যাল ব্যাপারস্যাপার।

না। আমি সায়েন্টিস্ট নই। আমার কাজ অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে।

তা হলেও কিছু নিশ্চয়ই জানেন। কোন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডার পান আপনারা?

তার কোনও ঠিক নেই।

ইন্ডাস্ট্রি অনেক রকমের আছে। আপনাদের অ্যালয়টা ঠিক কোন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজে লাগে বলতে পারেন?

না। আমার জানা নেই।

হয়তো আপনি বলতে চাইছেন না।

এ ব্যাপারে আপনি মনোজবাবুর সঙ্গেই কথা বলতে পারেন।

সুধাকর দত্ত একটা ছোট্ট ক্যামেরা বের করে চটপটে হাতে কারখানার কয়েকটা ছবি তুলে নিল বাগানে দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা ভাল লাগল না সোনালির। সে অবশ্য প্রতিবাদও করল না। ইন্টারপোলের এজেন্টদের হয়তো এসব স্বাধীনতা আছে।

লোকটা ক্যান্টিনের কাছ বরাবর এসে নাক তুলে একটু গন্ধ শুকে বলল, মাদ্রাজি খাবারের গন্ধ পাচ্ছি। আপনাদের ক্যান্টিন কি কোনও সাউথ ইন্ডিয়ান চালায়?

না। তবে সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশ তৈরি হয়।

মিস সোম, আপনি কি বিবাহিতা?

সোনালি একটু অবাক ও বিরক্ত হয়ে বলল, কেন?

এমনি।

আমি ডিভোর্সি।

মুখে একটু আপশোসের চুক চুক করে সুধাকর দত্ত বলল, আজকাল ডিভোর্স খুব বেড়ে গেছে, না?

হবে হয়তো। সোনালি নিস্পৃহ জবাব দিল।

সুধাকর দত্ত হঠাৎ ফের জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জানেন রোজমারির এটাই প্রথম বিয়ে কি না!

বিরক্ত সোনালি বলল, তা আমি কী করে বলব?

আহা, মেয়েরা তো অনেক কিছু টের পায়। ইন্সটিংক্ট।

না। ওসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

সুধাকর দত্ত যেন বেড়াতে এসেছে, এরকমই হাবভাব। নিশ্চিন্ত মনে বাগানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বলল, বাগানখানা বেশ সুন্দর, না?

সত্যিই সুন্দর। কারখানার ভিতরে এই বাগান এবং দুর্লভ নানারকম গাছগাছালি লাগানোর শখ রোজমারির। প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে, অনেক পরিশ্রম গেছে তার। বনবিভাগের সহযোগিতায় অবশেষে হয়েছে এই বাগান। সোনালি অবশ্য অত কথায় গেল না। শুধু বলল, হ্যাঁ, বেশ সুন্দর।

সুধাকর হঠাৎ তার দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা মনোজবাবু কি খুব এফিশিয়েন্ট লোক?

তার মানে?

আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই কারখানার আইডিয়া, একজিকিউশন, এসবের পিছনে আছেন রোজমারি। তাই না?

দেখুন, আমি এত সব জানি না। আপনি যা খুশি ডিডাকশন করতে পারেন, আমার মতামত চাইবেন না।

আপনি একটু শর্ট টেম্পার্ড। আচ্ছা ঠিক আছে। শুধু এটুকু তো বলতে পারেন, আমি যা বললাম তা ভুল না ঠিক!

না, তাও পারি না। আমাদের কিন্তু হাতে সময় নেই। ডেলিগেটরা এসে পড়বেন।

সুধাকর দত্ত অবাক হয়ে বলল, কারা আসবে?

ফরেন ডেলিগেটরা।

তাই নাকি?

কেন, আপনি জানেন না?

জানি। কিন্তু তারা যে আসবেনই এমন গ্যারান্টি নেই।

কী যা তা বলছেন?

ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, দেয়ার আর মেনি এ স্লিপস, বিটউইন দি কাপ অ্যান্ড দি লিপস!

তা আছে। কিন্তু আমাদের সত্যিই সময় নেই।

ব্যস্ত হবেন না। ডেলিগেটদের আসার সময় হলে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিক টের পাবে।

সোনালি হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। আপনি বরং একা একাই কমপ্লেক্সটা ঘুরে দেখুন, আমি অফিসে যাচ্ছি।

সেটা কি উচিত হবে? এখনও সবাই তো আমাকে চেনে না। একজন ইনট্রিউডার হিসেবে ট্রিট করতে পারে। তা ছাড়া আপনার কাছ থেকে আমার আরও কিছু জানার আছে।

বরং তা হলে সেটাই জানুন।

হ্যাঁ। আসুন, ওখানে একটা চমৎকার পাথরে বাঁধানো বসার জায়গা দেখতে পাচ্ছি। ছায়া আছে। একটু বসি?

একটা ঝুপসি সুন্দর গাছের নিবিড় ছায়ায় গাছটাকে ঘিরে সুন্দর শ্বেতপাথরের স্ল্যাব বসানো। সামনেই একটা ফোয়ারা রয়েছে। একটা ছোট্ট সরু পাথরে বাঁধানো জলপথ চলে গেছে এঁকেবেঁকে। সেই জলধারার ওপর ধনুকের মতো বাঁকা পাথরের সাঁকো। ভারী সুন্দর রুচির পরিচয় দিয়েছেন রোজমারি।

বসবার পর সুধাকর তার কাঁধের ব্যাগটার মুখ খুলে ভিতরে যেন কিছু খুঁজল। তারপর হাতখানা ভিতরে রেখেই বলল, খুবই সাধারণ প্রশ্ন। জবাব দেবেন?

চেষ্টা করতে পারি।

সাক্কি ইনকরপোরেটেড নামে একটা কোম্পানির নাম শুনেছেন?

না।

ভাল করে ভেবে বলুন।

ভাববার কিছু নেই। শুনিনি।

নামটা বিদেশি। উচ্চারণে সবসময়ে ধরা যায় না। আপনারা হয়তো সাক্কিকে শচি বা সাচি বলে উল্লেখ করেন।

সোনালি একটু থমকাল। শচি ইনকরপোরেটেডের সঙ্গে এই কোম্পানির ট্রানজ্যাকশন আছে। কিন্তু লোকটাকে সেকথা কি বলা উচিত হবে? সে একটু ভেবে বলল, রেকর্ড না দেখে বলা যাবে না।

আপনি একটু ফল্টার করলেন। আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে নামটা আপনার অচেনা নয়।

সোনালি মাথা নেড়ে বলল, অনেক কোম্পানির সঙ্গে এঁদের ট্রেড আছে। সব কোম্পানির নাম কি মনে রাখা সম্ভব?

ফর দি টাইম বিয়িং আপনার যুক্তি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু তর্ক বা জেরা করতে আমি এতদূর আসিনি। ধরেই নিচ্ছি সাক্কির সঙ্গে আপনাদের ব্যাবসা আছে।

আপনি অনেক কিছুই ধরে নিতে পারেন। কিন্তু আমাদের আর সত্যিই সময় নেই। ওঁরা হয়তো এসেই পড়েছেন।

সুধাকর মৃদু একটু হেসে বলল, ওঁরা আসছেন না। এলে সবার আগে আমি টের পাব।

কী করে টের পাবেন?

এ যুগটা উন্নত প্রযুক্তির যুগ। আমার পকেটে এই যে কলমের মতো জিনিসটা দেখছেন এটা আসলে একটা বিপার। ওঁরা এদিকে রওনা হলেই এই বিপার আওয়াজ দেবে। কারণ আমার একজন কলিগ ওঁদের অনুসরণ করছেন।

ও, তা হলে—

চিন্তা করবেন না। উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। এখন ফের আমরা সাক্কির প্রসঙ্গে আসি।

বললাম তো, আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি মনোজবাবুর সঙ্গেই তো কথা বলতে পারেন।

পারি। কিন্তু আপনার কাছ থেকে জেনে নিতে পারলে আমার অ্যাডভান্টেজ বেশি থাকবে।

অ্যাডভান্টেজ! কীসের অ্যাডভান্টেজ?

আছে একটা কিছু।

দেখুন, আমার আর এসব কথা ভাল লাগছে না।

আমার প্রশ্নগুলো তো একটুও অস্বস্তিকর নয় মিস সোম। তবে বিরক্ত হচ্ছেন কেন?

যা আমি জানি না আপনি তাই নিয়ে কেন বারবার প্রশ্ন করছেন?

শুধু বলুন সাক্কি ইনকরপোরেটেডের ব্যাবসাটা কী?

বললাম তো জানি না। সোনালি ভীষণ রেগে যাচ্ছিল। হয়তো অভদ্রের মতো উঠে যেত। কিন্তু ঠিক এই সময়ে সুধাকরের বিপার থেকে একটা ক্ষীণ বংশীধ্বনির মতো আওয়াজ হল। সঙ্গে সঙ্গে সুধাকর ব্যাগ থেকে একটা খুদে সেলুলার ফোন বা ওয়াকিটকি গোছের কিছু একটা বের করে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াল।

এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল সুধাকর। ফোনটা যথাস্থানে রেখে একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, যাক, ওঁরা এখানে আসছেন না।

আসছেন না?

না।

কেন?

সুধাকর একটু হেসে বলল, অজুহাত একটা আছে। ওঁদের একজন একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এনিওয়ে, অল ফর দি গুড। এখন আমরা পুরনো কথায় ফিরে আসতে পারি কি? রিগার্ডিং ইনকরপোরেটেড?।

বললাম তো জানি না।

আপনার জানা নেই, বলছেন? আপনি গত এক বছর ধরে মনোজবাবুর একান্ত সচিব। অনেক ট্রেড সিক্রেট আপনার জানা।

আপনি যা খুশি মনে করতে পারেন। কিন্তু আমি কিছু কমিট করছি না।

আপনাকে কমিট করতে হবে না। ভিতরকার কথা হয়তো আপনি জানেন না। কিন্তু ট্রেডের ব্যাপারটা তো গোপন থাকতে পারে না আপনার কাছে। বিশেষ করে আপনি কন্ট্রাক্টগুলো হ্যান্ডেল করেন, করেসপন্ডেস করেন।

হ্যাঁ, আমি তো বলেইছি, এঁদের ব্যাবসা বেশ বড়। অনেক কোম্পানি এঁদের অ্যালয় কেনেন। সব কোম্পানিকে মনে রাখা সম্ভব নয়।

ছেড়ে দিন। লেট আস ফরগেট সাক্কি ইনকরপোরেটেড। এখন বরং আপনার কথা বলুন।

সোনালি অবাক হয়ে বলল, আমার কথা! আমার কথা কেন আপনাকে বলতে যাব?

আরে না, তা নয়। আপনার পারসোনাল লাইফ সম্পর্কে তেমন কিছু জানতে চাইছি না। দয়া করে বলবেন কি আপনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল আ্যালয়ে চাকরিটা কী করে পেলেন?

সোনালি একটু অপমান বোধ করে বলল, কেন, তাই বা কেন বলতে যাব আপনাকে?

থ্রু প্রপার চ্যানেল?

তা ছাড়া আর কী হতে পারে?

এনি রেফারেন্স?

এখানে আমার মতো আরও অনেকেই চাকরি করে। আপনি কি সকলকে এরকম প্রশ্ন করতে পারেন?

না। আর কারও সম্পর্কে আমার কৌতূহল নেই। কারণ তারা কেউ গোপীনাথ বসুর এক্স-ওয়াইফ নয়।

সোনালি একটু শিউরে উঠল নামটা শুনে। গোপীনাথ বসু তার প্রাক্তন স্বামী।

আপনি তাকে চেনেন?

মুখোমুখি পরিচয় নেই। তবে জানি। হি ইজ এ স্মার্ট গাই।

ও। কিন্তু আমি তার এক্স-ওয়াইফ বলে কোনও অপরাধ করিনি তো?

আরে না। মাইন্ড করবেন না। গোপীনাথকে বিয়ে বা ডিভোর্স যাই করে থাকুন আমাদের কিছু যায় আসে না। তবে উই আর ইন্টারেস্টেড ইন হিম।

সোনালি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ও।

সুধাকর ফের একটু হেসে বলল, আপনার সঙ্গে তার বিয়েটা কতদিন টিকে ছিল বলবেন?

প্রায় দু’বছর।

বনিবনা হল না, না?

না।

গোপীনাথের অ্যাকটিভিটি সম্পর্কে আপনি কতখানি জানেন?

ও একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। কনসালট্যান্ট।

হ্যাঁ, সেসব আমরা জানি। উনি উচ্চশিক্ষিত এবং হাইলি সাকসেসফুল।

হ্যাঁ। আমি এটুকুই জানি।

আপনার সঙ্গে আফটার ডিভোর্স গোপীনাথের কোনও সম্পর্ক আছে কি?

সোনালি সামান্য রেগে গিয়ে বলল, না। কেন থাকবে?

আহা, আজকাল তো ডিভোর্সের পরও অনেক এক্স হাজব্যান্ড এবং ওয়াইফ পরস্পরের বন্ধু হিসেবে থাকে।

না। আমাদের কোনও সম্পর্ক নেই।

গোপীনাথ বসু যে এখন বিদেশে চাকরি করে তা কি আপনি জানেন?

সেইরকমই শুনেছিলাম।

কোথায় এবং কোন কোম্পানিতে চাকরি করে তা কি জানেন?

না। জানার কথাও নয়।

ঠিক আছে। এবার চলুন, যাওয়া যাক। আমার বেশ খিদে পেয়েছে।

সোনালি আগে, লোকটা দু’পা পিছনে। তারা এসে অফিসের রিসেপশনে ঢুকল। মনোজ রিসেপশনেই দাঁড়িয়ে ফোন করছিল কাকে যেন। হাতের ইশারায় তাদের অপেক্ষা করতে বলে কথা শেষ করে ফোন রেখে বলল, হ্যাঁ, মিস্টার দত্ত, একটা কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে।

সুধাকর বলল, ডেলিগেটদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়েছে তো! শুনেছি, স্যাড কেস।

সুতরাং আপনার তো এখানে নিশ্চয়ই আর দরকার নেই।

ইউ ওয়ান্ট মি আউট অফ ইয়োর হেয়ার, তাই না? বলে সুধাকর বেশ উঁচু গলায় হাসল।

মনোজ একটু অপ্রতিভ হয়ে হেসে বলল, মানে তা ঠিক নয়। আপনাকে এখন বোধহয় ওঁদের হোটেলেই যেতে হবে। তাই বলছিলাম–

ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি। বাই দি বাই, আপনার কমপ্লেক্সটা কিন্তু খুব সুন্দর।

থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি কমপ্লিমেন্টস।

সোনালিদেবীও খুব কো-অপারেট করেছেন।

শুনে খুশি হলাম।

সুধাকর সোনালির দিকে চেয়ে একটু হাসল। বলল, বাই। সুধাকর বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর মনোজ সোনালিকে জজ্ঞেস করল, কী চাইছিল লোকটা বলুন তো!

ঠিক জানি না।

বেফাঁস কিছু জিজ্ঞেস করেনি তো?

না।

তা হলে তো ঠিকই আছে। আমি একটু টেনশনে ছিলাম। সোনালি দোতলায় উঠে তার ঘরে ঢুকে চুপ করে কম্পিউটার মনিটরের সামনে বসে রইল। মনোজের টেনশন কমলেও তার কমেনি। তার টেনশন শুরু হল।

প্রথম কথা, ‘সাক্কি ইনকরপোরেটেড’ তাদের মস্ত বড় ক্লায়েন্ট। দ্বিতীয় কথা, তার ভূতপূর্ব স্বামী গোপীনাথ বসু সাক্কির সঙ্গে খুব গম্ভীরভাবে যুক্ত। লোকটা হয়তো সব জানে। কিন্তু সোনালি বুঝতে পারছে না সাক্কি বা উচ্চারণভেদে শচি ইনকরপোরেটেডকে নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে। সাক্কি নানারকম অত্যাধুনিক যন্ত্রাংশ তৈরি করে বলে সে জানে। পৃথিবীর অনেক দেশে তাদের কারখানা আছে।

সোনালি চিন্তা করতে লাগল। গম্ভীরভাবে।

৪.

প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলির একটি অনভিজাত পাড়ায় দোতলার একটি ছোট ফ্ল্যাটে মধ্যরাত্রে টেলিফোন বেজে যাচ্ছিল। একজন ক্লান্ত মানুষ গভীর ঘুম থেকে ধীরে ধীরে জাগ্রত হচ্ছিল। তারপর হঠাৎ উঠে বসে টেলিফোন তুলে নিয়ে চোস্ত ফরাসিতে বলল, আমি বোস বলছি।

সুপ্রভাত মঁসিয়ে বোস।

আপনি কে?

আমার নাম পল বা জন বা লিওনার্দো যা খুশি হতে পারে। আপনি আমাকে পল বলেই ডাকবেন। অবশ্য ডাকবার দরকারও হয়তো আর হবে না।

এসব কীরকম হেঁয়ালি?

মঁসিয়ে বোস, কাল বিকেলে শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে পুবদিকে একটি বিমান ছেড়ে যাবে। তাতে আপনার একটি সিট বুক করা আছে। তাই না?

হ্যাঁ। তাতে কী?

মঁসিয়ে বোস, আপনি কি টোকিওতে মরতে চান? নাকি ব্যাঙ্ককে? সিঙ্গাপুর, না মেলবোর্নে? আপনি যে-কোনও জায়গা বেছে নিতে পারেন। কোথায় মরতে আপনি পছন্দ করবেন প্রিয় মঁসিয়ে বোস?

ঘুম-ভাঙা লোকটির বুক কাঁপছিল, ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে এই রসিকতা তার ভাল লাগছিল না। অবশ্য রসিকতা নাও হতে পারে। উগ্রবাদের এই যুগে কিছুই

অবিশ্বাস্য নয়। সে গলাটা স্বাভাবিক রেখে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, একটু বুঝিয়ে বলুন।

আমি শুধু সরল একটা প্রশ্ন করছি। আপনি কোথায় মারা যেতে পছন্দ করবেন?

মারা যেতে আমি পছন্দ করি না।

কিন্তু প্রিয় মঁসিয়ে বোস, আমরা যে আপনার ওপর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছি। মরতে যে আপনাকে হবেই।

তা হলে আমি কোথায় মরতে চাই জিজ্ঞেস করছেন কেন? মরতে যদি হয়ই তা হলে প্যারিসই বা দোষ করল কী? প্যারিসে তো হাজার গন্ডা উগ্রবাদী ঢুকে বসে আছে।

পল একটু হেসে বলল, আপনি রসিক ব্যক্তি। কোনও রসিক ব্যক্তিকে মারা আমি পছন্দ করি না। পৃথিবীতে রসিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যাই হোক, আমরা আপনাকে জানাতে চাইছি, আমাদের সংগঠন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। আমাদের হাত থেকে আপনার পালানোর কোনও পথ নেই। পৃথিবীর যে-কোনও জায়গাতেই আপনাকে হত্যা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব।

শুনে খুশি হলাম। কিন্তু আমি পালাতে চাইছি, একথা আপনাকে কে বলল?

হয়তো আমাদের শর্ত শুনলে চাইবেন।

নাও চাইতে পারি। আমি মরতে পছন্দ করি না বটে, কিন্তু আমার মৃত্যুভয় নেই।

মঁসিয়ে বোস, আপনি কি নিজেকে খুব সাহসী লোক বলে মনে করেন?

না। বরং আমি বেশ ভিতুই।

তা হলে মরতে ভয় পান না বলছেন কেন?

বলছি, কারণ সত্যিই আমার মৃত্যুভয় নেই।

শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণাকেও কি ভয় পান না?

বোস নামক লোকটি একটু হাসির শব্দ করে বলল, যথেষ্ট নাটক হয়েছে। আপনি আসল কথাটা বলার আগে জমি তৈরি করতে চাইছেন। ওসব আমি জানি। কাজের কথায় আসুন।

এই কারণেই বুদ্ধিমানদের সঙ্গে কাজ করে সুখ আছে।

সে তো বটেই। কিন্তু এখন রাত দুটো বাজে এবং আমি সত্যিই ক্লান্ত। দয়া করে কথাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেললে আমি আরও ঘণ্টা পাঁচেক ঘুমিয়ে নিতে পারি। ঘুমটা আমার সত্যিই দরকার।

মঁসিয়ে বোস, আমরা আপনার কাছ থেকে একটা জিনিস চাই।

কী জিনিস?

এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি-র একটা বিস্তারিত কম্পিউটার প্রিন্ট আউট।

বোস হঠাৎ একটু শক্ত হয়ে গেল। তারপর সহজ এবং তরল গলায় বলল, সেটা আবার কী?

মঁসিয়ে বোস, আপনি নিজেই বলছিলেন আপনি ক্লান্ত এবং আপনার ঘুম দরকার। তা হলে কথা বাড়াচ্ছেন কেন? এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি কাকে বলে তা আপনি না জানলে আর কে জানবে? ওটি তো আপনারই মস্তিষ্কপ্রসূত।

বোস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না মঁসিয়ে পল, আমার একার মাথায় কাজটা হয়নি। বিজ্ঞানের এটা সে যুগ নয় যে, একজন বৈজ্ঞানিক হঠাৎ করে একটা কিছু যুগান্তকারী জিনিস আবিষ্কার করে ফেলবে। এখন হচ্ছে দলগত কাজ, দীর্ঘ গবেষণা, অন্তহীন চেষ্টা এবং কঠোর পরিশ্রমের যুগ। অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাবনিকাশ, নিখুঁত এবং পর্যায়ক্রমে এগোনো। এখন একটা আবিষ্কার যে কত জটিল ও কঠিন পদ্ধতিতে হয় এবং তার পিছনে জলের মতো যে কত টাকা খরচ হয় তা কি আপনি জানেন মঁসিয়ে পল?

জানি মঁসিয়ে বোস। আমি নিজেও একজন ছোট মাপের বিজ্ঞানকর্মী। আপনার মতো বড় ডিগ্রি এবং ধুরন্ধর প্রতিভা আমার নেই বটে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানকর্মের কিছু খোঁজখবর আমি রাখি।

ধন্যবাদ মঁসিয়ে পল। কিন্তু এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি সম্পর্কে আপনার তথ্য ঠিক নয়। আমরা একটা জিনিস তৈরি করার চেষ্টা করছি মাত্র। সেই গবেষণা এখনও শেষ হয়নি। হলেও তা যে সাফল্যমণ্ডিত হবেই এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। অনেক সময়েই এইসব গবেষণায় প্রচুর ব্যয় হয়, কাজের কাজ কিছুই হয় না। কিন্তু এ সম্পর্কে আপনার এত উৎসাহ কেন?

মঁসিয়ে বোস, আপনি একজন প্রতিভাবান মিথ্যেবাদী। এত সুন্দর সাজিয়েগুছিয়ে মিথ্যে কথাগুলো বললেন যে আমার সেগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে হলেও উপায় নেই মঁসিয়ে বোস। আপনার মতো মানুষকে বিশ্বাস করা মানে প্রচণ্ড বোকামি।

বিশ্বাস করা বা না-করা আপনার অভিরুচি। কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই।

মঁসিয়ে বোস, আপনি চতুর এবং সাহসী। কিন্তু সাহসও মাঝে মাঝে বোকামির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আপনি তো জানেন এ যুগটা ব্যক্তিগত সাহস, শিভালরি বা তথাকথিত সততার যুগ নয়। কুট বুদ্ধি এবং অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়াই এ যুগের ধর্ম। তা ছাড়া আমি একটি বিশাল সংগঠনের সামান্য একজন অপারেটর মাত্র। আমাকে প্রত্যাখ্যান করা মানে সেই সংগঠনটিকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করা। আশা করি বুঝবেন, আমি রাত দুটোয় আপনার সঙ্গে রসিকতা করছি না।

আপনারা আসলে কারা তা কি জানতে পারি মঁসিয়ে পল?

পারেন মঁসিয়ে বোস। আমরা হচ্ছি ভিকিজ মব।

বোস একটু শিহরিত হল। আজকের লে মদ কাগজেও দুটি নৃশংস ও নিপুণ হত্যাকাণ্ডের খবর ছিল। ফরাসি পুলিশ অনুমান করছে, এটি কুখ্যাত ভিকিজ মব-এর কাজ। গলাটা তবু স্বাভাবিক রেখে এবং একটু বিস্ময় প্রকাশ করে বোস বলল, ভিকিজ মব? ও হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম একটা নাম যেন আজকের খবরের কাগজেও দেখেছি।

আপনি একজন চমৎকার অভিনেতাও মঁসিয়ে বোস। আমি টুপি খুলে ফেলেছি। আর আপনার রক্তও বেশ ঠান্ডা।

আপনি বৃথাই আমার প্রশংসা করছেন। আমি নিজের কাজ নিয়ে উদয়াস্ত ব্যস্ত থাকি। বাইরের জগতের তেমন খোঁজখবর রাখি না। ভিকিজ মব কি খুবই বিখ্যাত সংগঠন?

বিখ্যাত নয়, কুখ্যাত। মঁসিয়ে বোস, আপনার স্মৃতিশক্তি খুবই ভাল এবং আপনি মোটেই খুব আপনভোলা লোক নন। আপনার যাবতীয় খোঁজখবর এবং তথ্যাদি আমাদের ডাটা ব্যাঙ্কে মজুত রয়েছে। আপনি সাক্কি ইনকরপোরেটেডের গবেষণা শাখার প্রধান ব্যক্তি। সাক্কি আপনাকে বছরে কয়েক লক্ষ ডলার বেতন দেয়। দু’বছর আগে আপনি একমি করপোরেশনের গবেষণাগারে ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়ুলে সেই চাকরি করার সময় আপনি একমি করপোরেশনের প্রায় একশো মিলিয়ন ডলারের একটি গবেষণাকর্ম ভেস্তে দিয়েছিলেন। আপনি ইয়ুল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় পালিয়ে যান। আপনি প্যারিসে এসেছেন একটি মাইক্রো কম্পিউটার কোম্পানির কাজকর্ম দেখে একটি চুক্তি করতে। আপনার কোম্পানি যে বহনযোগ্য ছোট ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে এটা তার শেষ ধাপ। এই ক্ষেপণাস্ত্রটি আফ্রিকার কোনও একটি দেশ থেকে চূড়ান্ত সতর্কতার ঘেরাটোপে হাতেকলমে পরীক্ষা করা হবে। আপনাদের টার্গেট প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও জনমানবহীন দ্বীপ অথবা দক্ষিণ মেরুর কোনও নির্জন জায়গা।

দাঁড়ান মঁসিয়ে পল, দাঁড়ান। রাত দুটোর সময় আপনি যে আমাকে রূপকথার গল্প শোনাতে বসলেন। বহনযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কথাটা কি স্ববিরোধী নয়? আপনি নিজে বিজ্ঞানের লোক হয়ে এরকম অবৈজ্ঞানিক কথা বলছেন কী করে?

মঁসিয়ে বোস, আপনার ওপর নজরদারি করার জন্য আমাদেরও বছরে কয়েক লক্ষ ডলার খরচ হয়। কথাটা কবুল করলাম, যাতে আপনাকে আর অভিনয় করার কষ্টটা স্বীকার করতে না হয়।

আপনি সবজান্তা হলেও আমি নাচার। আমার কাছে আপনার এইসব কথা পুরো ধাঁধার মতো লাগছে। একটা বহনযোগ্য ছোট ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে কতখানি জ্বালানি ভরা যাবে মঁসিয়ে পল, যাতে তা হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করতে পারবে?

সেটা আমার জানার কথা নয়। আপনার জানার কথা। আর আমরা আপনার কাছ থেকেই জানতে চাই।

ভিকিজ মব কি বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করে মঁসিয়ে পল?

আজ্ঞে না। আমরা আর একজনের হয়ে কাজ করছি মাত্র।

সেই আর একজন কে?

আপনার পক্ষে সেটা জানা অস্বাস্থ্যকর হতে পারে।

আপনি আমার স্বাস্থ্য নিয়ে খুবই চিন্তিত দেখছি।

আজ্ঞে হ্যাঁ, খুবই চিন্তিত। কারণ আপনার সহকারী এক গবেষক ইতিমধ্যেই খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন কলকাতার এক বড় ক্লিনিকে শয্যাশায়ী। নাও বাঁচতে পারেন।

সচকিত হয়ে বোস এই প্রথম উত্তেজিত গলায় বলল, কে? কার কথা বলছেন?

আপনার প্রিয় আদ্রেঁ।

আদ্রেঁ! তার কী হয়েছে?

উনি সকালে কফির সঙ্গে সামান্য একটু বিলম্বিত ক্রিয়ায় বিষ পান করেছেন।

সর্বনাশ!

সেইজন্যই আপনার স্বাস্থ্য বিষয়েও আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন মঁসিয়ে বোস।

বোস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলাল। তারপর শান্ত গলায় বলল, আদ্রেঁকে কি আপনারা খুন করলেন?

ওভাবে বললে আমরা একটু বিব্রত বোধ করি। তবে স্বীকার করতে বাধা নেই, কাজটায় আমাদের একজন এজেন্টের হাত ছিল।

আদ্রেঁর অপরাধ কী?

উনি একজনকে চিনতে পেরেছিলেন। এর বেশি আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

আদ্রেঁ কি বেঁচে আছে?

মস্তিষ্কের মৃত্যু বলে ডাক্তারি শাস্ত্রের একটা কথা আছে না?

আছে।

প্রিয় মঁসিয়ে বোস, আদ্রেঁ বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই।

আপনারা খুবই ভয়ংকর লোক।

পল একটু হাসল। বলল, আমাদের মৃত্যু-শিল্পীও বলতে পারেন। আমরা মোটা দাগের উগ্রবাদীদের মতো দুমদাম বোমা-বন্দুক ব্যবহার করি না, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে। অপ্রয়োজনে নিরীহ মানুষকেও মারি না। আমরা শিল্পসম্মত এবং অনাটকীয়ভাবে কাজ করতে ভালবাসি।

কিন্তু আপনারা কি জানেন যে আদ্রেঁ মারা গেলে আমাদের গবেষণা আটকে যাবে এবং এই শেষ পর্যায়ের কাজ আরও বহুদিন পিছিয়ে যাবে?

না মঁসিয়ে বোস, আমার তা জানার কথা নয়। তবে আরে না মরে কোনও উপায় ছিল। অপারগ না হলে আমরা কাউকে মারি না।

আপনারা পিশাচ।

যা ঘটে গেছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না মঁসিয়ে রোস। ওটা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়।

দুঃখিত মঁসিয়ে পল, আপনার প্রস্তাব আমি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলাম। ভিকিজ মব যা খুশি করতে পারে, আমি পরোয়া করি না। শুভ রাত্রি।

বলেই বোস ফোনটা রেখে দিল। এবং পরমুহূর্তেই তুলে কলকাতার একটা নম্বর ডায়াল করল। অনেকক্ষণ রিং বেজে যাওয়ার পর একটা ঘুমকাতর পুরুষের গলা বলে উঠল, হ্যালো।

সুব্রত, আমি গোপীদা বলছি, প্যারিস থেকে।

আরে বলুন গোপীদা, কী খবর?

খবর তুমিই দেবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের ব্যাপারে যে দলটা গিয়েছিল তাতে একজন ছিল আদ্রেঁ। তার খবর কী?

স্যাড কেস গোপীদা, উনি খুব অসুস্থ।

বেঁচে আছে?

কাল রাত বারোটা অবধি উডল্যান্ডসে ছিলাম। তখন অবস্থা ভাল ছিল না। এখন সকাল সাড়ে সাতটা। একটা ফোন করে দেখব?

দেখো। কিংবা আমাকে নম্বরটা দাও। আমি ফোন করছি।

নম্বরটা টুকে নিয়ে ফের ডায়াল করল গোপীনাথ বসু। যা খবর পেল তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। আদ্রেঁর বাঁচার কোনও আশাই নেই।

ফোন রেখে গোপীনাথ ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে রইল। কাকে চিনতে পেরেছিল আদ্রেঁ?

বাকি রাতটা আর ঘুম হবে না তার। মাথাটা গরম, আর বুকটা অন্ধকার। আদ্রেঁ তরুণ যুবা নয়, পঞ্চান্ন বছরের মধ্যবয়সি মানুষ। বুদ্ধিমান, সংযতবাক, খুবই কর্মঠ মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করেছে। অভিজ্ঞতাও অনেক। সাক্কি ইনকরপোরেটেডে তাকে নিয়ে এসেছিল গোপীনাথ নিজেই। আদ্রেঁর মৃত্যুর জন্য কি সে-ই দায়ী থাকবে?

গোপীনাথ ঘরের এক কোণে একটা চেয়ারে বসে ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতেই টেলিফোন ডিরেক্টরি খুলে একটা দৈনিক কাগজের অফিসে ফোন করল।

আপনারা কি আমাকে ভিকিজ মব সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেন?

আপনি একটু লাইনটা ধরুন। একজন মহিলার কণ্ঠ বলল।

কিছুক্ষণ পর ফোনে মহিলা বললেন, ভিকি একজন দক্ষিণ আমেরিকার লোক। বেস ছিল ব্রাজিলে। দশ বছর আগে তার একবার জেল হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সে পালায়, ভিকি পেশাদার অপরাধী। সারা পৃথিবীতে তার অপারেটররা কাজ করে। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রী দেশগুলির হয়ে সে অনেক কিছু করেছে। এক সময়ে তার প্রধান কাজ ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে যেসব মগজওলা লোক পালিয়ে যায়, যেমন বৈজ্ঞানিক, গবেষক, লেখক, গায়ক বা শিল্পী, তাদের ধরে আনা বা খতম করা। এ কাজে সে মোটা টাকা নিত।

এখন সে কোথায় থাকে?

সে এক জায়গায় থাকে না।

ধন্যবাদ। প্যারিসে তার এজেন্ট কে আছে জানেন?

দাতা।

দাতা? পুরো নাম কী?

এস দাতা।

তার সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে হতে পারে।

তা জানি না। আন্ডারওয়ার্ল্ড জানে। প্যারিসের গুন্ডা বদমাশরা জানবে।

এরকম কারও খোঁজ দিতে পারেন। আমার প্রয়োজনটা জরুরি।

লাইনটা ধরুন, দেখছি।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটি বলল, দুঃখিত। আমাদের যে রিপোর্টার এসব জানে সে এখন নেই।

ধন্যবাদ।

টেলিফোনটা রেখে দিল গোপীনাথ। কিন্তু রাখতেই টেলিফোনটা তারস্বরে বেজে উঠল।

গোপীনাথ ফোনটা তুলে নিল।

০৫.  

খুব ভোরবেলা রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে বলে রোজমারি এ সময়টায় নিজেই গাড়ি চালায়। গাড়ি চালিয়ে সে আসে ময়দানে। ভোরের ময়দানের মতো সুন্দর জায়গা কলকাতায় নেই। রোজমারির পরনে থাকে শর্টস, গায়ে কখনও কামিজ, কখনও টি-শার্ট, পায়ে দৌড়োনোর জুতো। সকালে খানিকটা দৌড় এবং খানিকটা জগিং করার পর সে কয়েকটা বেন্ডিং করে। তারপর বাড়ি ফেরে। এই সময়টায় সে কোনও সঙ্গী পায় না। তার স্বামীর শরীরবোধ কম, ব্যায়ামট্যায়ামের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই। সকালে ঘুম থেকে তাকে তোলাই মুশকিল। রোজমারিকে তাই একাই আসতে হয়।

আজও রোজমারি একা। ভোর সাড়ে চারটের আবছা আলোয় প্রেতপুরীর মতো ফাঁকা কলকাতার পথ। রোজমারির একটু অস্বস্তি হচ্ছে। গতকাল অনেকগুলো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেছে। তাকে কেউ ভুল করে বা ইচ্ছে করে লাল গোলাপ পাঠিয়েছে। না, ভুল করে নয় মোটেই। ইচ্ছে করেই। কারণ, ফ্লোরিস্টকে ফোন করে লাঞ্চ টেবিলের জন্য রজনীগন্ধার বদলে লাল গোলাপ পাঠাতে বলাটা তো আর ভুল করে করা নয়। তার ওপর ডেলিগেটদের একজনের অসুস্থ হওয়া এবং ইন্টারপোলের এক এজেন্টের আগমন, সবটাই একটা জিগস পাজলের মতো।

ময়দানে রোজমারি একা নয়। এখানে তার এক বান্ধবী জুটেছে। ডোরিন। ডোরিন জার্মান মেয়ে, বিয়ে করেছে মার্কিন কনসুলেটের এক অফিসারকে। সেই সুবাদে ডোরিন কলকাতায় থাকে এবং রোজ সকালে জগিং করতে ময়দানে আসে। ভিক্টোরিয়ার মূল ফটকের উলটো দিকে তাদের গাড়ি পার্ক করা হয়। দু’জনে একসঙ্গে হয়ে দৌড়োয়।

গাড়িটা পার্ক করল রোজমারি। ডোরিনের গাড়ি এখনও আসেনি। রোজমারি চুপ করে গাড়িতে বসে রইল। চারদিকে কুয়াশার আস্তরণ। একটু আবছা পথঘাট। লোকজন বেড়াতে বেরিয়েছে। কয়েকজন দৌড়োচ্ছেও। এত ভোরেও জায়গাটা নির্জন নয়। কলকাতার মতো ভিড়াক্রান্ত শহর রোজমারি দেখেনি। এত ভিড় তার ভাল লাগে না। কিন্তু আজ এই ভোরে চারদিকে লোকজন দেখে, কেন কে জানে, রোজমারির বেশ ভাল লাগছিল।

রোজমারি ঘড়ি দেখল। ডোরিন আজ একটু বেশি দেরি করছে কি? এ সময়ে তো রোজই এসে যায়।

গাড়ির সব কাঁচ তোলা থাকে রোজমারির। ভিতরে এয়ার কন্ডিশনার চলে। কলকাতার দূষিত বায়ুকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে সে। হঠাৎ ডানধারের কাঁচে টুক টুক করে দুটো টোকা পড়তেই রোজমারি একটু চমকে উঠল। চেয়ে দেখল, একজন বেশ লম্বাচওড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে সাদা স্পোর্টস গেঞ্জি এবং পরনে শর্টস।

রোজমারি কাচটা নামিয়ে প্রশ্নভরা চোখে তাকাতেই লোকটা পরিষ্কার জার্মান ভাষায় বলল, সুপ্রভাত।

সুপ্রভাত। কী চাই?

লোকটা জার্মান নয়, চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। লম্বাচওড়া হলেও লোকটাকে তার বাঙালি বলেই মনেই হল। তবে জার্মানটা মাতৃভাষার মতোই বলতে পারে।

লোকটা বলল, আপনার কি আর একটু সতর্ক হওয়া উচিত নয়?

রোজমারি অবাক হয়ে বলল, আপনি কে?

আমার নাম সুধাকর দত্ত।

ও, আপনি সেই ইন্টারপোলের এজেন্ট?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

এখানে কী করছেন?

আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।

আমার জন্য? কেন বলুন তো!

আপনার নিরাপত্তার জন্য।

আমার নিরাপত্তার অভাব ঘটেছে নাকি?

লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তা জানি না। তবে সাবধান হওয়া ভাল।

আপনি আমার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বাংলাতেও কথা বলতে পারেন।

আপনি যে বাংলা ভালই জানেন সে খবর আমি রাখি। তবু জার্মান ভাষায় কথা বলাটাই এখন নিরাপদ। হয়তো বাতাসেরও কান আছে। আপনার সঙ্গে আমার দু’-একটা কথা ছিল।

কথা তো অফিসেও বলতে পারতেন।

সুধাকর মৃদু হেসে বলল, কেন ময়দান জায়গাটাই বা মন্দ কী? এত সুন্দর সকাল, এমন খোলা মাঠ।

রোজমারি ঠোঁট উলটে বলল, কী এমন কথা?

কথাটা আপনার অতীত নিয়ে।

আমার অতীত? সে আবার কী?

জোসেফ ক্লাইন নামটা কি আপনার চেনা ঠেকছে?

জো ক্লাইন আমার প্রাক্তন স্বামী। কেন?

মুশকিল কী জানেন? আমার এই মিশনটাই যেন প্রাক্তন স্বামীদের নিয়ে। কালকেও আর একজনের প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে নাড়াঘাটা করতে হল। জো ক্লাইন সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন ফ্রাউ ঘোষ?

অনেক কিছুই জানি। আমরা এখনও বেশ বন্ধু।

জো ক্লাইনের সঙ্গে আপনার শেষ যোগাযোগ কবে হয়েছে?

যোগাযোগ? না, গত এক বছরের মধ্যে নয়।

তার মানে আপনি তার গতিবিধির খবর রাখেন না?

না।

গত জুলাই মাসে প্যারিসে একজন পুলিশের গোয়েন্দা খুন হন।

রোজমারি চেয়ে ছিল। বলল, এ খবরটায় আমার কী হবে?

দত্ত মাথা নেড়ে বলল, কিছু না, কিছু না। খবরটা আপনি উপেক্ষা করতে পারেন।

তবে বললেন কেন?

এই গোয়েন্দাটি একটি বিশেষ তদন্তে কাজ করছিল।

তাতে আমার কী?

সাক্কি ইনকরপোরেটেডের ব্যাপারে।

ও। কিন্তু তাতেই বা আমার কী যায়-আসে। সাক্কির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা নিতান্তই ব্যবসায়িক।

কিন্তু এই গোয়েন্দা খুনের ব্যাপারে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের নামের একটা তালিকা আমি দেখেছি।

বেশ তো।

তালিকাটায় অন্তত পাঁচজনের নাম আছে। একদিন সন্ধেবেলা প্যারিসের এক কুখ্যাত গলির মধ্যে খুনটা হয়। অত্যন্ত পেশাদার কাজ। খুনিরা কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি।

এসব কথা কেন আমাকে বলছেন হের দত্ত?

সুধাকর যেন খানিকটা লজ্জিত হয়ে বলল, তাই তো! কেন যে বলছি।

রোজমারি ঘড়ি দেখে আপনমনে বলল, ডোরিন যে কেন আসছে না।

সুধাকর দত্ত অত্যন্ত নিরীহভাবে বলল, আসতে একটু দেরি হবে। ফ্ল্যাট টায়ার পালটাতে একটু সময় তো লাগবেই।

ফ্ল্যাট টায়ার? সেটা আপনি জানলেন কী করে?

আমাকে অনেক কিছুই জানতে হয়।

রোজমারি একটু বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে সুধাকরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তাই নাকি হের দত্ত? কিন্তু আমি জানতে চাই দুনিয়ায় এত লোক থাকতে আপনি কেন আমাদের পিছনে লেগেছেন? আমি এবং আমার স্বামী একটা ছোট কারখানা চালাই, কোনও বিপজ্জনক কাজ করি না, আমরা এ দেশে কিছু বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগও করিয়েছি এবং আমরা বিদেশি মুদ্রা আয়ও করি। তবু কেন আপনি বা আপনারা আমাদের বিরক্ত করছেন?

সুধাকর সামান্য অপ্রতিভ মুখ করে বলল, আপনাদের বিরক্ত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিল না। অবস্থা এবং পরিস্থিতি আমাদের কিছু অসুবিধের মধ্যে ফেলেছে বলেই

ডোরিনের গাড়ির চাকা কীভাবে পাংচার হল হের দত্ত? আর আপনিই বা তা কী করে জানলেন দয়া করে বলবেন কি?

সুধাকর খুবই লজ্জিত মুখ করে বলল, সামান্য একটু হাতের কাজ। ওটাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন না ফ্রাউ ঘোষ। তার চেয়ে চলুন, আজ আপনার সঙ্গে আমিও খানিকক্ষণ জগিং করি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

এটা অনুরোধ না আদেশ? নাকি প্রচ্ছন্ন হুমকি?

ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন! আপনার সঙ্গে জগিং করতে পারাটা আমি সৌভাগ্য বলেই বিবেচনা করব।

ক্ষতি কী? বলে রোজমারি নামল। গাড়ি লক করে বলল, চলুন হের দত্ত। আমি প্রস্তুত।

দু’জনে পাশাপাশি ধীরগতিতে দৌড়োতে লাগল। ঘাসে শিশির পড়েছে। শিশিরের জল ছিটকে উঠে তাদের মোজা ভিজিয়ে দিচ্ছিল।

রোজমারি বলল, আপনি কি জানেন গতকাল আমাকে কে এক গোছা রক্তগোলাপ পাঠিয়েছিল?

রক্তগোলাপ?

হ্যাঁ, হ্যাপি বার্থ ডে জানিয়ে। কিন্তু গতকাল আমার জন্মদিন ছিল না।

কেউ ভুল করে পাঠিয়েছিল বলছেন?

মোটেই না। কার্ডের অন্য পিঠে লেখা ছিল আর আই পি। তার একটা ব্যাখ্যা ফ্লোরিস্ট দিয়েছে। জনৈক রজার আইভ্যান পোলক নাকি ফুল পাঠিয়েছে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ বাজে কথা। আর আই পি মানে রেস্ট ইন পিস। আমাকে কেউ হত্যার হুমকি দিচ্ছে।

সুধাকরের ছোটার গতি কমল না। সে একটু বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।

আমি জানতে চাই কে কী কারণে আমাকে খুন করতে চায়? আমি তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি হের দত্ত।

না, জ্ঞানত করেননি। তবু কারও কায়েমি স্বার্থে হয়তো না জেনে আঘাত করেছেন। আমি অনেক ভেবেও সেরকম কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। আপনিই বলুন, আমি কার কায়েমি স্বার্থে আঘাত করতে পারি?

সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।

আপনার রহস্যময় আগমনটাও আমার ভালো লাগছেনা হেরদত্ত। আপনার ক্রেডেনশিয়ালস হয়তো সবই ঠিকঠাক আছে, কিন্তু আমি জানি পাসপোর্ট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড সবই নকল করা যায়। আপনি আসল না নকল তা কে বলবে?

ফ্রাউ ঘোষ, আপনার সন্দেহ অমূলক নয়।

তা হলে কি আমার অনুমান নির্ভুল?

তাও বলছি না। তবে আপনি যে পরিস্থিতিতে আছেন তাতে এরকম সন্দেহ হতেই পারে।

আদ্রেঁর অসুস্থ হয়ে পড়াটাও মোটেই স্বাভাবিক ব্যাপার নয় হের দত্ত।

মানছি। উনি অসুস্থ হননি।

তা হলে?

ওঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে।

সে কী?

বলে থমকে দাঁড়ায় রোজমারি।

দাঁড়াবেন না ফ্রাউ। দয়া করে দৌড়োতে থাকুন। এবং দয়া করে পিছনে তাকাবেন না।

কেন হের দত্ত?

সুধাকর একটু চাপা জরুরি গলায় বলল, প্রশ্ন করবেন না ফ্রাউ। শুধু স্বাভাবিক গতিতে দৌড়াতে থাকুন। ভয় পাবেন না।

কিন্তু রোজমারি ভয় পাচ্ছিল। বেশি দৌড়োয়নি সে, তবু হাঁফ ধরে যাচ্ছিল তার। বুকটাও দুরুদুরু করছে। সে হাঁফসানো গলায় বলল, কেউ কি আমাদের পিছু নিয়েছে?

হা ফ্রাউ। পিছু ফিরে না তাকালে আপাতত ভয় নেই।

রোজমারির পা ইতিমধ্যেই ভারী হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে সে এবার পড়ে যাবে। শুধু মনের জোরে দৌড়োতে দৌড়োতে সে বলল, ওরা কারা?

আমি সবজান্তা নই ফ্রাউ। তবে আমরা এক বিপজ্জনক পৃথিবীতে বাস করি।

আচমকাই পিছনে একটা শব্দ হল। চাপা শিস দেওয়ার মতো শব্দ। মানুষের শিস নয়, ধাতব শিস। যেন কোনও উচ্চশক্তিসম্পন্ন রাইফেল বা পিস্তলের সাইলেন্সর লাগানো শব্দ। তারপরই একটা আর্তনাদ।

পিছনে তাকাবেন না। দৌড়োন।

কেউ কি কাউকে গুলি করল?

পৃথিবীতে কত ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে, সবটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী আমাদের? আমাদের সামনে এখন একটাই কাজ। দৌড়োনো এবং স্বাস্থ্যরক্ষা।

হের দত্ত, আপনি এত নির্বিকার কেন? ঘটনাটায় কি আপনার কোনও হাত নেই?

আমি নিমিত্ত মাত্র।

আমি গীতা পড়েছি। কথাটা গীতা থেকে বললেন?

আপনি যে মহাভারত পড়ছেন তাও আমি জানি।

কী সর্বনাশ। আপনি আমার সম্পর্কে আর কী জানেন?

একটা মানুষ সম্পর্কে জানার কি শেষ আছে?

সেটা ঠিক কথা। কিন্তু আমি এমনই একজন সাধারণ মানুষ যার সম্পর্কে জানাটাও বাহুল্য মাত্র। আমার সম্পর্কে জেনে কী হবে হের দত্ত?

আপনি একজন ছোট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বলে বলছেন?

ঠিক তাই। আমি একটা প্রোজেক্ট দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি মাত্র।

কিন্তু আপনি যতটা নিরীহ নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করেন বলে মনে হয়, আসল ঘটনা হয়তো তা নয়।

আপনি যে কী বলছেন হের দত্ত, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

ফ্রাই, আপনাকে তা হলে সোজাসুজি একটা প্রশ্ন করি। দয়া করে বলবেন কি যে আপনি জেনেশুনে জো ক্লাইনের মতো একজন খুনিকে কেন বিয়ে করেছিলেন?

রোজমারি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, জো ক্লাইন কি খুনি?

আপনি তা ভালই জানেন। ভিয়েনার এক হোটেলে আপনার সামনেই সে গডার্ড নামে একজন ইংলিশ এজেন্টকে খুন করেছিল। আপনি তখন তার সঙ্গে ছিলেন।

ঘটনাটা ওভাবে ঘটেনি।

কীভাবে ঘটেছিল?

আমরা একটা কনসার্টের পর ঘরে ঢুকে দেখি, একটা লোক আমাদের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। জো তাকে চ্যালেঞ্জ করতেই লোকটা একটা পিস্তল বের করেছিল। তখন জো তাকে গুলি করে।

সুধাকর একটু হাসল, বেশ বললেন। লোকটা পিস্তল বের করার পর জো ক্লাইনও তার পিস্তল বের করল এবং গুলি করল এবং লোকটা ততক্ষণ পিস্তল নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল? এরকমও হয় নাকি?

আমি ঘটনাটা দেখিনি। লোকটার হাতে পিস্তল দেখে ভয়ে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। চোখ খুলে দেখলাম, লোকটা পড়ে আছে।

ঠিক আছে ফ্রাউ। মেনে নিচ্ছি। আপনি কি জানতেন না জো কার বা কাদের হয়ে কাজ করে?

না। সে চাকরি করত জানি! আর কিছু জানি না। তার ওই ঘটনার পরই জো-র সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। একজন অনধিকার প্রবেশকারীকে মেরেছিল বলে জো বিচারে ছাড়া পেয়ে যায় বটে, কিন্তু আমি ওকে অপছন্দ করতে শুরু করি। আমি ভায়োলেন্স পছন্দ করি না।

প্যারিসে একজন পুলিশ অফিসারকে মারার ব্যাপারে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের তালিকায় জো-র নাম আছে।

তা হতে পারে।

ফ্রাউ, জো-কে আপনি ত্যাগ করেছেন বটে, কিন্তু সে হয়তো আপনার জীবনে আবার ফিরে আসবে। তবে অন্য ভূমিকায়।

রোজমারি অবাক হয়ে বলল, কেন?

ধৈর্য ধরুন। জানতে পারবেন।

এবার কি পিছন ফিরে তাকাতে পারি?

না। পিছনে একজন আহত বা নিহত মানুষ পড়ে আছে। পুলিশ আসবে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের খোঁজ করবে। আমি বা আপনি কেউই প্রত্যক্ষদর্শী হতে চাই না, তাই না?

কে কাকে মারল?

সেটা জেনেও আপনার লাভ নেই।

কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি জানেন। তাই না?

হ্যাঁ। জানাটা যে কত বড় অভিশাপ তা যদি জানতেন।

আপনি কে বলুন তো! সত্যিই কে?

প্যারিসে আমাকে অনেকে দাতা বলে ডাকে। এস দাতা। সেখানে আমার বেশ খ্যাতি বা অখ্যাতি আছে।

দাতা?

হ্যাঁ। দত্তকে ওরা দাতা করে নিয়েছে।

আদ্রেঁকে কে বিষ দিয়েছে হের দত্ত?

কী করে বলব বলুন তো!

হের দাতা, আমি আপনাকে পছন্দ করতে পারছি না।

০৬-১০. আদ্রেঁ মারা গেল বেলা বারোটায়

আদ্রেঁ মারা গেল বেলা বারোটায়। লাউঞ্জে তার এগারোজন সঙ্গী, মনোজ, রোজমারি, সোনালি, সুব্রত, শুভ, মৈত্রেয়ী এবং কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক সময়োচিত গাম্ভীর্য মুখে মেখে দাঁড়িয়েছিল। ঘটনাটা বড় আকস্মিক এবং সকলেই খানিকটা অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে।

ডেলিগেটদের প্রধান একজন বয়স্ক কোলকুঁজো মানুষ। পদবি লোম্যান। চোখদুটি নীল এবং চাউনি তীব্র। মনোজ তার কাছাকাছি গিয়ে মৃদু স্বরে বলল, আদ্রেঁর পরিবারকে খবরটা কীভাবে জানানো যায়?

লোম্যান মাথা নেড়ে বলল, আদ্রেঁর পরিবার কেউ নেই। একা মানুষ। কাউকে কিছু জানানোর নেই।

ও।

আমি একটা কথা জানতে চাই। আদ্রেঁর ডেডবডি আমরা নিয়ে যেতে চাইলে সেটা কত তাড়াতাড়ি সম্ভব?

দেরি হওয়ার তো কথা নয়।

যদি আজই নিয়ে যেতে চাই?

বোধহয় ব্যবস্থা করা যাবে।

লোম্যান একটা নিশ্চিন্তের খাস ছেড়ে বলল, যাক, বাঁচা গেল।

আপনারা কি মায়ানমার যাওয়ার প্রোগ্রাম বাদ দিচ্ছেন?

অবশ্যই। আদ্রেঁর মৃতদেহ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই হবে আমার এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।

মনোজ একটু অবাক হয়ে বলে, কেন বলুন তো! আদ্রেঁর তো কেউ নেই বললেন।

লোম্যান তার দিকে মিটমিটে চোখে চেয়ে বলল, কাজ আছে মিস্টার ঘোষ। জরুরি কাজ। আপনি দয়া করে আমাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। ডেডবডির জন্য ভাল কফিন চাই।

ভাববেন না। সব ব্যবস্থাই হয়ে যাবে।

ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট কি দিয়েছে?

হ্যাঁ। সুব্রতর কাছে আছে।

মনোজ ডেথ সার্টিফিকেটটা নিয়ে লোম্যানকে দিল। লোম্যান সেটা দেখে পকেটে রেখে দিল। বলল, আপনার সঙ্গে ডিলটা এবার হল না। যা হোক, আমাদের দু’জন প্রতিনিধি আগামী মাসেই আসবে। তারা চুক্তি পাকা করে যাবে।

ধন্যবাদ।

রোজমারি মনোজের কাছাকাছি এসে চাপা গলায় বলল, ডেথ সার্টিফিকেটে কী লিখেছে দেখেছ?

হার্ট অ্যাটাক।

হ্যাঁ। কিন্তু ঘটনাটা কি তাই?

মনোজ একটু অবাক হয়ে বলে, অন্যরকম কেন হবে?

রোজমারি একটু চিন্তিত মুখে বলল, কিছু বিষ আছে যা ধরা যায় না। খুব অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হলে হয়তো ধরা পড়বে। সেই ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই।

মনোজ ভীষণ অবাক হয়ে বলে, বিষ! বিষের প্রশ্ন উঠছে কেন? এটা সহজ সরল হার্ট অ্যাটাক। আদ্রেঁর বয়স ষাটের কাছাকাছি।

সেটা হলেই ভাল। কিন্তু আমার কেন যেন ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে।

অদ্ভুত কেন?

আঁদ্রে সাক্কি ইনকরপোরেটেডের হয়ে কাজ করে।

তাতে কী?

খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। মস্ত বিশেষজ্ঞ। মনোজ, ওরা যদি আরে মৃতদেহ দেশে নিয়ে গিয়ে অটোপসি করে এবং ওর শরীরে কোনও বিষ পাওয়া যায় তা হলে কী হবে?

কী যে বলছ পাগলের মতো। এটা সেরকম কোনও ঘটনাই নয়।

তবু আমার ভয় করছে।

মনোজ রোজমারিকে বাঁ হাতে বেষ্টন করে বলল, কেন বলো তো! তোমার মতো সাহসী মেয়ের ভয় পাওয়ার মতো কী হল?

আমাদের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে না তো?

মনোজ অবাক থেকে আরও অবাক হয়ে বলল, ষড়যন্ত্র! ষড়যন্ত্র করার মতো কী আছে আমাদের? একটা অ্যালয় তৈরি করি, তা সেরকম অ্যালয় আরও কেউ কেউ তৈরি করে। খামোখা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে কেন?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না, বুঝতে চাইছি। হঠাৎ এই দত্ত লোকটাই বা কেন প্যারিস থেকে এসে হাজির হল? কেন আদ্রেঁ মারা গেল? কেন আমাকে পাঠানো হল রক্তগোলাপ? প্রশ্ন যে অনেক।

তুমি আমাকে ভাবিয়ে তুলছ। আমি এমনিতেই নার্ভাস লোক, তোমার ওপর নির্ভর করে চলি। তুমি ভয় পেলে আমার আর ভরসা কীসের?

চলো আমরা ঠান্ডা মাথায় ঘটনাগুলো নিয়ে একটু ভাবি।

ঠিক আছে, কিন্তু তার আগে আদ্রেঁর ডেডবডি দেশে পাঠানো এবং ডেলিগেটদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

ভাববার কিছু নেই। ওরা ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী। ওদের ব্যবস্থা করা কঠিন হবে না। একটা এয়ারলাইন্সে জায়গা না হলে অন্য এয়ারলাইন্সে যেতে পারবে।

তা জানি। কিন্তু ব্যবস্থাটা এখনই চালু করা দরকার।

সুব্রত অত্যন্ত দক্ষ এবং চটপটে ছেলে। ছিপছিপে বেতের মতো চেহারা। একসময়ে ভাল টেনিস খেলত। খুব স্মার্ট আর অনেক যোগাযোগ। পিআরও হিসেবে তাকে মোটা মাইনে দেওয়া হয়। তাকে ডেকে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিল মনোজ।

সুব্রত সব শুনল। তারপর বলল, কিছু ভাববেন না স্যার। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

লোম্যান লোকটা খুঁতখুঁতে। একটু দেখো, পরে যেন কথা শুনতে না হয়।

সুব্রত হাসল, না স্যার, কথা শুনতে হবে না।

তা হলে আমরা যাচ্ছি। আমাদের কিছু জরুরি কাজ আছে।

ঠিক আছে স্যার। এদিকটা আমি সামলাচ্ছি।

***

দ্বিতীয় ফোনটাও করেছিল পল।

মঁসিয়ে, খবরের কাগজে টেলিফোন করে আমাদের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার কোনও দরকার ছিল কি?

খবরের কাগজে ফোন করেছিলাম কে বলল?

আপনার টেলিফোন যে আমরা ট্যাপ করব তা আন্দাজ করা আপনার উচিত ছিল।

আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়লে এ কাজ আপনিও করতেন মসিয়া পল।

ওদের চেয়ে বেশি ইনফর্মেশন আমিই আপনাকে দিতে পারতাম। আমাদের প্যারিস হেড কোয়ার্টার্সের চিফ মঁসিয়ে দাতা এখন প্যারিসের বাইরে। তাকে আপনার প্রয়োজন হলে একটা ফোন নম্বর লিখে নিন। কিন্তু একটা কথা। এই নম্বরটা দয়া করে পুলিশকে দেবেন না। দিলে আপনি বোকা বনবেন। কারণ এটি একটি নিরীহ রেস্তোরাঁর টেলিফোন। পুলিশ এখানে কিছুই খুঁজে পাবে না।

বুঝেছি, নম্বরটা বলুন?

পল বলল, গোপীনাথ টুকে নিল।

এখানে ফোন করে মিশেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। ওরা বলবে, মিশেল বলে এখানে কেউ নেই। তখন আপনি বলবেন, সে কী, আজ যে মিশেলের সঙ্গে আমার নোতরদাম যাওয়ার কথা।

বুঝেছি। এটাই কোড তো?

হ্যাঁ। তবে মঁসিয়ে দাতাকে অকারণে বিরক্ত না করাই ভাল। আপাতত উনি এখানে নেই। আমি ওঁর হয়ে কাজ চালাচ্ছি।

গোপীনাথ একটা খাস ফেলে বলল, তাই বুঝি? আচ্ছা, শুভরাত্রি।

ফোন রেখে গোপীনাথ দ্রুত ভাবতে লাগল। যা করার এখনই করতে হবে। এখনই তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শত্রুপক্ষ প্রবল এবং সতর্ক।

গোপীনাথ চটপট একটা অ্যাটাচি কেস গুছিয়ে নিল। পোশাক পরল। তারপর মধ্যরাত্রিতেই বেরিয়ে পড়ল পথে। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেল না।

খানিক দুরে হেঁটে গিয়ে সে একটা ট্যাক্সি ধরল। হাজির হল একটা দিনরাতের গ্যারেজে। ক্রেডিট কার্ডের জোরে সে একখানা সেকেন্ড হ্যান্ড সিট্রিয়ে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। দূর প্রাচ্যের প্লেন তার প্যারিস থেকে আর ধরা হবে না।

গাড়ির টেলিফোন তুলে সে ডায়াল করল তাদের মূল ল্যাবরেটরি লাইপজিগে। সিকিউরিটির প্রধান মালিককে। মালিক একজন আফগান।

মালিক, ল্যাবরেটরির সিকিউরিটি কেমন?

সব ঠিক আছে।

না, সব ঠিক নেই। সিকিউরিটি বাড়াও। চারদিকে কড়া নজর রাখো। খুব তৎপর থেকো।

ঠিক আছে। কোনও হামলা হবে বস?

হতে পারে।

আমি গা গরম করতে ভালবাসি।

তুমি ভিকিজ মব-এর নাম শুনেছ?

কে শোনেনি? সবাই জানে।

ভিকিজ মব আমাদের পিছনে লেগেছে।

তা হলে দুঃসংবাদ বস। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন।

আপাতত ঈশ্বরের চেয়ে তোমার ওপরেই আমার নির্ভরতা বেশি, কিন্তু ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ওরা এখনই রেড করবে বলে মনে হয় না। তবু সাবধান থাকা ভাল।

গোপীনাথ গাড়ি চালাতে চালাতে গম্ভীরভাবে ভাবতে লাগল। এই যে সে পালাচ্ছে, সে জানে এটা পণ্ডশ্রম। কিছুতেই সে ভিকিজ মবকে এড়াতে পারবে না। তবু অন্তত কিছুক্ষণের জন্য অনুসরণকারীদের ঝেড়ে ফেলা একান্তই দরকার। রোমে তাদের রিসার্চ সেন্টারে আদ্রেঁর কিছু ডকুমেন্ট আছে। সেটা সরিয়ে ফেলা দরকার।

দ্বিতীয় ফোনটা সে করল রোমে।

বিল্লে, কী খবর?

কী খবর চান?

অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি তো!

না। কেন?

ভাল করে মনিটরটা চেক করো। ল্যাবের সব দিক দেখো। কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা দেখলে আমাকে জানাও। আর, আদ্রেঁর ঘরটা ভাল করে দেখো, দরজা ভাঙার বা খোলার কোনও চেষ্টা হয়েছে কি না।

আদ্রেঁর দরজায় ইলেকট্রনিক লক আছে। কোড ছাড়া খুলবে না। তবু দেখছি।

আমি আবার পনেরো মিনিট পরে ফোন করব।

পনেরো মিনিট বাদে ফের ফোন করল গোপীনাথ। বিল্লে বলল, সব ঠিক আছে।

গোপীনাথ একটা উজ্জ্বল এয়ারপোর্ট টার্মিনালে ঢুকে গাড়ি থামাল। শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে সে অন্তত একটা কদমও এগোতে পেরেছে কি? মাত্র একটি বা দুটি ঘণ্টা সময় তার দরকার। তাকে ভাবনায় ফেলেছে আদ্রেঁর নিজস্ব অফিসঘরের দরজায় ইলেকট্রনিক লক। দরজাটা খোলা দরকার। আদ্রেঁর রিসার্চ পেপার এবং কম্পিউটরের তথ্য তার ভীষণ প্রয়োজন। ওটা হাতছাড়া হলে তাদের এত পরিশ্রম বৃথা যাবে।

দু’বার প্লেন বদল করে রোমে যখন নামল গোপীনাথ তখন বিকেল। সারাক্ষণই নানা অস্বস্তি ও সন্দেহে কেটেছে তার কেউ অনুসরণ করছে কি না, কেউ লক্ষ করছে কি না সারাক্ষণ কেবল এই চিন্তা।

সবচেয়ে কঠিন কাজ তার রোমেই। প্রথম কথা আদ্রেঁর ঘরের ইলেকট্রনিক লক খোলা। কাজটা অসম্ভব যদি না লকের কোড জানা থাকে। আদ্রেঁ কোডটা কোথাও নোট করে রেখেছে এরকম একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। এবং তা নোট করে রাখার সম্ভাবনা আছে তার ডেবুক এ। ডেবুক যদি আদ্রেঁ সঙ্গে করে নিয়ে না গিয়ে থাকে তা হলে তা আছে। আরে ফ্ল্যাটে আদ্রেঁ একা থাকে, সুতরাং গোপীনাথ বসুকে এখন যে কাজটা করতে হবে তা অতীব আইনবিরুদ্ধ এবং অপরাধমূলক। তাকে তালা ভেঙে ঢুকতে হবে আদ্রেঁর ফ্ল্যাটে, চোরের মতোই।

গোপীনাথ আদ্রেঁর ফ্ল্যাট চেনে, বেশ কয়েকবার এসেছে। আদ্রেঁ একা বলেই বোধহয় মাঝে মাঝে পার্টি দিত। ইতালির বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য আর্টিস্টের সঙ্গে তার ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। তারাও এসেছে।

গোপীনাথ দু’বার ট্যাক্সি বদল করে যখন আদ্রেঁর ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে পৌঁছোল তখন শহরতলির অভিজাত পাড়াটি নির্জন। রাত আটটা বাজে। সময়টা চৌর্যবৃত্তির পক্ষে প্রশস্ত নয়। কিন্তু গোপীনাথের হাতে আর সময় নেই। যা করার এখনই করতে হবে।

এইসব ফ্ল্যাটবাড়িতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া ঢোকা বেশ শক্ত। প্লেক্সি গ্লাসের শক্ত পাল্লা ইলেকট্রনিক সংকেত ছাড়া খোলে না। দরজার বাইরে একটা ইলেকট্রনিক বোর্ড আছে। তাতে বাসিন্দাদের নামের কার্ড লাগানো। পাশে বোতাম। যার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে তার নামের বোম টিপলে সে ওপর থেকে আর একটা বোতাম টিপে দেয়। একমাত্র তখনই দরজা খোলে। গোপীনাথ দরজাটা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

প্রায় পনেরো মিনিট বাদে একজন লম্বাচওড়া লোককে দরজার কাছে যেতে দেখে গোপীনাথ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। লোকটা ভিজিটর। একটা বোতাম টিপে অপেক্ষা করতে লাগল। গোপীনাথও একটা বোতামে আঙুল ছোঁয়াল, কিন্তু টিপল না। লোকটা যাতে বুঝতে না পারে যে সে ফাঁকতালে ঢোকার মতলব করছে।

কাঁচের দরজা খুলে যেতেই সে লোকটার পিছু পিছু ঢুকে পড়ল ভিতরে। লোকটা তাকে বিশেষ গ্রাহ্য করল না। একটু মাল খেয়ে আছে, বোঝা যাচ্ছিল। গিয়ে লিফটের কাছে দাঁড়াল।

আদ্রেঁ তিনতলায় থাকে। গোপীনাথ এলিভেটর নিল না। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল ওপরে। অ্যাটাচি কেসটা খুলে একটা সরু শিকের মতো জিনিস বের করল সে। তারপর দ্রুত হাতে তালাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। উত্তেজনায় তার কপালে ঘাম ফুটতে লাগল। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে চেষ্টা করল সে। কঠিন দরজা অনড় রইল। যতদুর মনে হচ্ছে আদ্রেঁ কোনও বার্গলার অ্যালার্ম লাগিয়ে যায়নি। তা হলে এতক্ষণে গার্ডরা ছুটে আসত।

লম্বা প্যাসেজ দিয়ে দুটো লোক হেঁটে আসছিল। নিঃশব্দে। গোপীনাথ একটু শক্ত হয়ে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে নিজের টাইয়ের নটটা একটু ঠিকঠাক করে নিতে লাগল। যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি। লোকদুটো যখন তার কাছাকাছি চলে এসেছে তখন গোপীনাথ দুটো হাত মুঠো করে রইল। এরা ভিকির লোক হতে পারে কিংবা নিরীহ সজ্জন।

লোকদুটো দাঁড়াল না। তাকে পেরিয়ে গেল। গিয়ে থামল এলিভেটরের সামনে। এক মিনিট পর তারা লিফটে উঠে যেতেই আবার কাজ শুরু করে দিল গোপীনাথ। বিস্ময়ের কথা, দ্বিতীয়বার প্রায় বিনা ভূমিকায় দরজা খুলে গেল।

ভিতরটা অন্ধকার। দরজাটা বন্ধ করে আলো জ্বালল গোপীনাথ। আদ্রেঁ একা থাকলেও খুব গোছানো লোক। ফ্ল্যাটটা বিশাল বড়। অন্তত তিন হাজার স্কোয়ার ফুট। ঢুকতেই হলঘর। এক ধারে বসবার জায়গা। অন্য ধারে একটা লাইব্রেরির মতো। দুটো মস্ত শোয়ার ঘরের মধ্যে একটা হল আদ্রেঁর কাজের ঘর। অন্তত গোটা পাঁচেক কম্পিউটার সাজানো রয়েছে চারধারে। একটা ল্যাপটপ কম্পিউটারও রয়েছে বাড়তির মধ্যে। একটা ওয়ার্কিং টেবিলে নানা ধরনের মডেল। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড দেয়ালে শাগলের একখানা ওরিজিন্যাল পেইন্টিং ঝুলছে। আদ্রেঁ ছবি-পাগল লোক ছিল। বিজ্ঞানী না হলে হত অবশ্যই একজন আর্টিস্ট।

ডেবুকটা বাইরে কোথাও পড়ে নেই। টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলে খুলে দেখল গোপীনাথ। কখনও কাজের জিনিসটা সহজে পাওয়া যায় না।

পাশের শোয়ার ঘরে গিয়ে গোপীনাথ দেখতে পেল, বিশাল রাজকীয় একখানা খাট ও বিছানা। আদ্রেঁ একটু বিলাসবহুল জীবন কাটাতে ভালবাসত। ভালবাসত একা থাকতে। অনেকে সন্দেহ করে আদ্রেঁ হোমোসেক্সয়াল। গোপীনাথ অবশ্য ততটা ভাল করে জানে না। শুনেছে, এই পর্যন্ত। আদ্রেঁ আর যাই হোক, ছিল অসম্ভব কাজপাগলা।

শোয়ার ঘরে খুঁজতে খুঁজতেও হয়রান হল সে৷ কোথায় রাখতে পারে ডে-বুকটা? গোপীনাথ অবশেষে বাথরুমে হানা দিল। বাথরুমটাও রাজকীয়। কোনও আধুনিক গ্যাজেট বাদ নেই।

বাথরুমে থাকার কথা নয়। তবু বাথরুমেই পেয়ে গেল ডায়েরিটা গোপীনাথ। একটা টেনশনমুক্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেখল, ডে-বুকের প্রথম পৃষ্ঠাতেই তার দরজা খোলার কোডটা লেখা রয়েছে। আদ্রেঁ কোড পালটাত না। তার স্বভাব একটু একবগগা। পরিবর্তন জিনিসটা সে পছন্দ করত না।

ডায়েরিটা অম্লানবদনে অ্যাটাচি কেসে ভরে বাতি নিভিয়ে দরজার সামনে একটু অপেক্ষা করল গোপীনাথ। আদ্রেঁ কি মারা গেছে?

সে ফের বাতি জ্বালাল এবং টেলিফোনের সামনে এসে বসে একটা নম্বর ডায়াল করল।

ও পাশ থেকে একটা পুরুষ গলা বলে উঠল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়।

আমি রোম থেকে বলছি। সুব্রত রায় কি আছেন?

না। উনি অফিসের বাইরে।

আমি একটা ইনফর্মেশন চাই। রিগার্ডিং আদ্রেঁ। ডেলিগেটদের একজন।

হ্যাঁ, উনি আজ মারা গেছেন সকাল এগারোটায়।

টেলিফোনের ওপরে গোপীনাথের মুঠো শক্ত হয়ে গেল। সে ঠান্ডা গলাতেই বলল, ডেডবডি কি নিয়ে আসা হচ্ছে?

হ্যাঁ। আজ রাতের ফ্লাইটে।

টেলিফোনটা রেখে গোপীনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল।

৭.

দরজাটা খুব সাবধানে চুল পরিমাণ ফাঁক করল গোপীনাথ। নিবিষ্ট চোখে করিডরটা দেখল। ফাঁক দিয়ে শুধু বাঁ দিকের করিডরটাই দেখা যায়। ডান দিকেরটা দেখতে হলে মুন্ডু বের করতে হবে।

কিন্তু ভয় পেলে এবং বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে গেলে মূল্যবান সময়ের অপচয়। ভিকিজ মব-এর চেয়ে এক-দুই কদম এগিয়ে না থাকলে এতদিনের এত পরিশ্রম পণ্ড হবে।

গোপীনাথ দরজাটা ঝড়াক করে খুলে ফেলল। না, ডানধারেও কেউ নেই। যদি থাকেও তবে সে বা তারা নিশ্চয়ই গোপীনাথের সামনে বোকার মতো বুক চিতিয়ে হাজির হবে না। থাকলে তারা আড়ালে বাঘের মাসির মতো ওত পেতে অপেক্ষা করছে। যথাসময়ে ঘাড়ে এসে পড়বে। সুতরাং ভেবে লাভ কী?

গোপীনাথ নামবার সময়েও লিফট নিল না। দু’ধাপ করে সিঁড়ি দ্রুত পায়ে ভেঙে নীচে নামল। তার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। পচিশ-ত্রিশ বছর আগেকার ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনাসমূহও তার হুবহু মনে থাকে। সে কারও নাম একবার শুনলে আর ভোলে না। বিশেষ করে সংখ্যার ব্যাপারে তার স্মৃতি আরও তীক্ষ্ণ। ইলেকট্রনিক সুইচ বোর্ডটার কাছে গিয়ে সে মাত্র দু’সেকেন্ড ভাবল। আদ্রেঁ যে চারটে নম্বর টিপে দরজা খুলত সেটা ফটোগ্রাফের মতো তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সাত দুই তিন চার।

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল গোপীনাথ। হাতে সময় বড্ড কম। দ্রুত পায়ে সে পাড়া ছাড়িয়ে ভিড়ের রাস্তায় চলে এল এবং ট্যাক্সি নিল। সারাদিন তাকে যথেষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়েছে, উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা তাড়া করেছে। তবু উত্তেজক পরিস্থিতিতেই সে ভাল থাকে। তার বোধ, বুদ্ধি, রিফ্লেক্স সবই যেন চনমনে হয়ে ওঠে।

ইতালিয়ান আধবুড়ো ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে দু’-একটা রসিকতাও করল। ল্যাবরেটরিতে পৌঁছে গেল রাত দশটার মধ্যেই।

সাক্কি ইনকরপোরেটেডের এই ল্যাবরেটরিটি বিশাল। চারদিকে উঁচু ঘের-পাঁচিল তো আছেই, তা ছাড়া আছে নানারকম ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি এবং বার্গলার অ্যালার্ম। সশস্ত্র প্রহরী এবং পাহারাদার কুকুর সারা এলাকা সর্বক্ষণ পাহারা দেয়।

ফটকে নিজের আইডি কার্ডটা যন্ত্রে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে হল তাকে। ছাড় পেয়ে দ্বিতীয় গাঁট। নিজের গাড়িতে এলে কথা ছিল না। কিন্তু ট্যাক্সি নিয়ে ভিতরে যাচ্ছে বলেই গার্ডরা এসে উকিঝুঁকি দিয়ে ভিতরটা দেখে নিল। আইডি কার্ড দেখল। তারপর বলল, ওকে

স্যার, ইউ মে এন্টার।

ট্যাক্সিটা ছেড়ে দ্রুত পায়ে গোপীনাথ ভিতরে ঢুকল। এসকালেটরে উঠে এল দোতলায়। আদ্রেঁর ঘর দোতলাতেই।

গোপীনাথ বৈদ্যুতিক সংকেতে দরজা খুলল, ঘরে ঢুকল এবং আলো জ্বালল। আদ্রেঁ অত্যন্ত গোছানো মানুষ। তার সবকিছুই খুব নিখুঁত ও পারস্পরিক। আদ্রেঁ যে চেয়ারটায় বসে কাজ করে সেটায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল গোপীনাথ, তারপর ধীরে ধীরে কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগল। কম্পিউটার চালু করে কিছুক্ষণ দেখল। প্রিন্ট আউট বের করল।

রাত ক্রমে গভীর হচ্ছে। সে অনেকক্ষণ কিছুই খায়নি। খিদে পাচ্ছে এবং দুর্বল লাগছে। কাজ শেষ করে অ্যাটাচি কেসে কাগজপত্র ভরে সে বেরিয়ে এল।

রিসেপশন থেকে ফোন করে একটা ট্যাক্সি আনাল সে। তারপর বেরিয়ে পড়ল। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে এসে সে প্রথমেই কালো কফি খেল। তারপর ফ্রিজ খুলে কিছু খাবার বের করে গরম করে গোগ্রাসে খেল।

খাওয়ার পর সে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ কলকাতায় সুব্রতকে ফোন করল।

সুব্রত, গোপীদা বলছি। কী খবর?

গোপীদা, খবর খারাপ। আদ্রেঁ মারা গেছে।

অ্যাজ এক্সপেক্টেড। ডেডবডি?

ওরা আজই নিয়ে যাচ্ছে।

ভাল। অটোপসিটা এখানে হলেই ভাল হয়।

অটোপসি হবে কেন গোপীদা? ডাক্তাররা তো হার্ট অ্যাটাক বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে।

কারণ আছে বলেই হবে। ক্রিমিন্যাল সায়েন্সও অনেক এগিয়ে গেছে, বুঝলি? আর কী খবর?

আপনি কি জানেন যে, ইন্টারপোলের একজন বাঙালি এজেন্ট এসে হাজির হয়েছে?

না তো। কেন?

শুনছি সে নানারকম এনকোয়ারি করছে।

ইন্টারপোলের ইন্টারেস্ট কী?

বউদি আমাকে বলেছেন, ব্যাপারটা আপনাকে জানাতে।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, সোনালিকে তুই এখনও বউদি বলে ডাকিস নাকি?

আরে না। আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?

কী বলে ডাকিস?

দিদি। সোনালিদি।

সোনালি হঠাৎ ইনফর্মেশনটা আমাকে দিতে বলল কেন? সে তো আমার নাম শুনতেও পারে না।

বোধহয় সিচুয়েশনটা ঘোরালো বলেই বলেছেন।

কী বলেছে?

লোকটার নাম সুধাকর দত্ত, ইন্টারপোল এজেন্ট। সাক্কি ইনকরপোরেটেড সম্পর্কে খুব ইন্টারেস্ট।

সাক্কি সম্পর্কে আজকাল সকলেরই ইন্টারেস্ট দেখা যাচ্ছে।

কী ব্যাপার গোপীদা?

তা জানি না। তবে চারদিকে বেশ একটা তৎপরতা শুরু হয়েছে। শোন সুব্রত, লোকটা সম্পর্কে ভাল করে খোঁজ নে। চেহারার বিবরণ এবং আর যা কিছু।

বউদির সঙ্গে লোকটার আলাপ হয়েছে। লম্বা প্রায় ছ’ফুট। বেশ ভাল পেটানো স্বাস্থ্য। গলার স্বর খুবই ভাল। হ্যান্ডসাম। প্যারিসে হেড কোয়ার্টার। এতে হবে?

ওর আইডেন্টিটি কার্ড কি সোনালি দেখেছে?

না বোধহয়। তবে আমাদের অফিসে চেক করা হয়েছে বোধহয়। মিস্টার সেন তো কাঁচা লোক নন।

গোপীনাথ একটু হাসল। বলল, এ যুগটা অত্যন্ত বুদ্ধিমানদের যুগ। বুঝলি? ক্ষুরধার বুদ্ধি ছাড়া এই কম্পিটিটিভ এজ-এ কিছু করা খুব কঠিন। মনোজের সেই বুদ্ধি নেই।

কিন্তু আপনি তো ওঁকে চেনেন না গোপীদা।

না। ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু অনুমান করতে পারি। সিম্পল ডিডাকশন।

মেমসাহেব কিন্তু বুদ্ধিমতী।

রোজমারি সম্পর্কে আমার কোনও রিজার্ভেশন নেই। রোজ সত্যিই বুদ্ধিমতী। কিন্তু ওর একটা অতীত আছে। সেইটেই বিপজ্জনক।

সে কী গোপীদা?

সময়মতো জানতে পারবি হয়তো। এখন একটা কথা মন দিয়ে শোন।

বলুন গোপীদা।

আমার একটা বিপদ চলছে।

কী বিপদ?

একটা আন্তর্জাতিক ক্রিমিন্যাল গোষ্ঠীকে কেউ আমার পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে। এই গোষ্ঠীর নাম ভিকিজ মব।

ও বাবা! এরা তো সাংঘাতিক।

আমার ধারণা আদ্রেঁকে ওরাই মেরেছে।

মেরেছে! ওয়াজ ইট এ মার্ডার?

হ্যাঁ সুব্রত। নিট অ্যান্ড ফুলপ্রুফ।

সর্বনাশ! তা হলে এরা তো আপনাকেও

না সুব্রত। আমাকে এখনই মারবে না। তার কারণ সাক্কি ইনকরপোরেটেডের একটা গুরুতর প্রোজেক্টের আমি কো-অর্ডিনেটের সায়েন্টিস্ট। প্রোগ্রাম চিফও আমি। আমাকে মারলে প্রোজেক্টটা বানচাল হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু ভিকিজ মব-এর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। ওরা প্রোজেক্টটার ব্লু প্রিন্ট চায়।

বুঝেছি।

সেইজন্যই ওরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। প্রয়োজন হলে অবশ্য মারতে দেরি করবে না। তবে ভয় হচ্ছে, অ্যাবডাকশনের।

আপনাকে চুরি করবে?

হ্যাঁ, আমার ফটোগ্রাফিক মেমরির কথা ওরা জানে। যদি আমাকে চুরি করতে পারে তা হলে ওদের খানিকটা সুবিধে হবে।

আপনি পালাচ্ছেন না কেন?

গোপীনাথ হেসে বলল, তোর জানা কোনও নিরাপদ জায়গা আছে নাকি? শোন বোকা ছেলে, দুনিয়ার কোথায় আমি মরতে চাই তা ওরা প্রথমেই জানতে চেয়েছিল। অর্থাৎ বুঝিয়ে দিয়েছিল যে পৃথিবীর সব জায়গায় ওদের কুশলী খুনিরা আছে।

তা হলে কী হবে গোপীদা?

আমার কাছে আদ্রেঁর কিছু কাগজপত্র আছে। আমি সেগুলোর কিছু জেরক্স কপি আজ রাতেই করে রাখছি। কিন্তু আমার অ্যাপার্টমেন্ট নিরাপদ নয়। ওরা ইচ্ছে করলে চুরি করতে পারবে। এখন শোন, আমি কাগজগুলোর কয়েকটা ছবি আমার হ্যাসেলব্লাড ক্যামেরায় তুলে রাখছি। ইন কেস আমার যদি কিছু হয় তা হলে তুই একটা ফোন করে সিসি নামে এক মহিলাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিবি।

সিসিকে আপনিই কেন জানাচ্ছেন না?

তার কারণ হল, সিসি সদ্য বিয়ে করে নতুন বরের সঙ্গে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছে। এক মাসের ছুটি। আরও পঁচিশ দিন তাকে ধরা যাবে না।

হ্যাসেলব্লাড ক্যামেরাটা কোথায় আছে?

বলছি। আমার অ্যাপার্টমেন্টে একটা ডার্করুম আছে। সেখানেই ক্যামেরাটা মাউন্ট করা আছে। আমি ছবি তুলব কিন্তু ফিল্ম ক্যামেরার মধ্যেই থেকে যাবে। বুঝেছিস।

বুঝেছি গোপীদা। কিন্তু আমার যে আপনার জন্য ভয় করছে।

ভয় করে লাভ কী? এখন সিসির ফোন নম্বরটা টুকে নে।

বলুন।

গোপীনাথ ফোন নম্বরটা বলল। তারপর বলল, আজ ছাড়ছি। অনেক রাত হয়েছে। আমি খুব টায়ার্ড। ঘুমোনোর সময় হচ্ছে না।

গুড নাইট গোপীদা।

গোপীনাথ ফোন রেখে তার শোয়ার ঘরের কাবার্ড খুলে একটা শক্তিশালী পিস্তল বের করে আনল। ফ্লিপটা খুলে দেখে নিল, সব গুলি আছে কি না। সব ঠিকই আছে। অনেক দিন আগে কেনা জিনিসটা গোপীনাথের কোনও কাজেই লাগেনি। হয়তো ভবিষ্যতেও লাগবে না। তবু কাছে থাক, একটা ভরসা তো।

ডার্করুমে ঢুকে সে আদ্রেঁর কাগজপত্রগুলো একটা বোর্ডে পিন দিয়ে সাঁটল। তারপর বিশাল হ্যাসেলব্লাড ক্যামেরায় একটার পর একটা ছবি তুলল। তারপর কপি মেশিনে কয়েকটা করে কপি তুলে নিল। স্টাডিতে ঢুকে কাগজপত্রগুলোকে কয়েকটা বইয়ের মধ্যে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে দিল। এসব ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু নয়। শত্রুপক্ষ যদি পেশাদার অপরাধী হয়ে থাকে তবে সব জায়গাই নিপুণভাবে খুঁজে দেখবে। ভরসা একটাই, আঁদ্রের কাগজপত্র কিছু কিছু জায়গায় কোডেড।

গোপীনাথ তার বড় অ্যাপার্টমেন্টটা ভাল করে ঘুরে দেখল। তার অনুপস্থিতিতে কেউ ঢোকেনি বা জিনিসপত্র ঘটেনি বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

রাত প্রায় একটা বাজে। গোপীনাথ ঘরের আলো নেভাল এবং জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে চেয়ে রইল। নিজের জীবনটাকে তার কখনও অভিশপ্ত বলে মনে হয়। সোনালির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। সম্বন্ধ করা বিয়ে। জাত গোত্র সব দেখেশুনেই তার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই বউ আর কাজ এই দুইয়ের মধ্যে সমতা রক্ষা করা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগল। তখন গোপীনাথ সাক্কিতে ছিল না। অন্য কোম্পানিতে। সারা দুনিয়া দৌড়ঝাপ করে বেড়াতে হত। বাড়ি ফেরার ঠিক ছিল না। দিনের পর দিন সারা রাত গবেষণার কাজে কাটাতে হয়েছে ল্যাবরেটরিতে। সোনালি যদি সেই একাকিত্ব সহ্য করতে না পেরে থাকে তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বিছানার দিকেই যাচ্ছিল গোপীনাথ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।

আমি আপনার বন্ধু পল।

গোপীনাথের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। তবু সে গলাটা নিরুদ্বেগ রেখে বলল, হ্যাঁ পল, বলুন।

চোস্ত ফরাসিতে পল বলল, আপনার প্যারিস থেকে রোমে আসার গোটা অ্যাডভেঞ্চারটাই আমরা খুব কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করেছি মঁসিয়ে বোস।

গোপীনাথ একটু কেঁপে গেল। যা ভয় করেছিল তাই। ওরা সারাক্ষণ তাকে মনিটর করেছে।

মঁসিয়ে পল, আমাকে কাজ করে খেতে হয়। আমাকে নিজের কাজেই আসতে হয়েছে।

অবশ্যই মঁসিয়ে। এমনকী নিজের কাজে আপনাকে চুরি এবং বাটপাড়িও করতে হচ্ছে তাও আমরা জানি।

চুরি! বাটপাড়ি। কী যে বলেন মঁসিয়ে পল।

মঁসিয়ে বোস, আপনি যদি ক্রিমিন্যাল হতেন তা হলে জীবনে উন্নতি করতে পারতেন। আমাদের অভিনন্দন।

অভিনন্দন কেন?

আদ্রেঁর কাগজপত্রগুলো উদ্ধার করে আনার জন্য।

গোপীনাথ নার্ভাস বোধ করছিল। বলল, এরকম ঘটনা ঘটেছে নাকি?

মঁসিয়ে বোস, আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন যে, আপনাদের ল্যাবরেটরির প্রত্যেকটা ঘরেই ইলেকট্রনিক আই বসানো আছে। প্রত্যেকটা ঘরই সারাক্ষণ মনিটর করা হয়।

গোপীনাথ ঠান্ডা গলায় বলল, জানব না কেন?

আমরা মনিটরে আপনার সব কার্যকলাপই খুব মন দিয়ে দেখেছি।

গোপীনাথ দ্রুত ভাবছিল। তাদের ল্যাবরেটরির সিকিউরিটি অত্যন্ত উচ্চমানের। বাইরের লোক ঢোকা অসম্ভব। তা হলে কি ভিতরেই কিছু পাজি লোক আছে?

গোপীনাথ বলল, আপনারা আমাদের ল্যাবরেটরিতে মনিটরিং রুমে ঢুকেছিলেন কী করে?

আমাদের লোক সর্বত্র আছে, আপনাকে আগেই বলেছি।

গোপীনাথ বলল, ঠিক আছে। এবার কাজের কথাটা বলুন।

প্রিন্ট আউটটা আমাদের চাই।

গোপীনাথ মৃদু স্বরে বলল, আপনি নিশ্চয়ই বোকা নন।

কেন বলুন তো!

আদ্রেঁর কাগজপত্রের বা কম্পিউটারের প্রিন্ট আউট পেলেই তো আর হবে না। প্রোজেক্টটা বিরাট, জটিল। অনেক সায়েন্টিস্ট কাজ করছে।

আপনি কো-অর্ডিনেটর, আপনি ভালই জানবেন কার কাছে কী আছে।

না মঁসিয়ে পল, আমিও জানি না। এত বড় প্রোজেক্ট যে, একজনের পক্ষে সব জানা বা মনে রাখা সম্ভব নয়। আমরা মাঝে মাঝে মিটিং করে নানা তথ্য বিনিময় করি। প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেকেরই কাজের ধরন আলাদা।

আমরা তা জানি মঁসিয়ে বোস। আমাদের সবচেয়ে বেশি জানা দরকার আপনাদের জ্বালানি সম্পর্কে। আপনারা কী জ্বালানি ব্যবহার করছেন মঁসিয়ে বোস?

দুঃখিত পল। আমার তা জানা নেই।

এ ব্যাপারে আদ্রেঁর কিছু অবদান আছে, তাই না?

হয়তো। কিন্তু আদ্রেঁকে খুন করে আপনারা হয়তো বিজ্ঞানের এক মস্ত সম্ভাবনাকেই নষ্ট করে দিলেন।

তাই কি মঁসিয়ে বোস?

তাই তো মনে হচ্ছে।

এই প্রথম পল যেন একটু দ্বিধায় পড়ল। একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, হতে পারে আদ্রেঁকে খুন করাটা এক মস্ত ভুল।

গোপীনাথ মৃদুস্বরে বলল, মস্ত, মস্ত, ভীষণ ভুল মঁসিয়ে পল। আপনারা উন্মাদের মতো কাজ করেছেন।

দয়া করে রাগ করবেন না। রেগে লাভ নেই।

গোপীনাথ ঠান্ডা গলায় বলল, রাগ করে লাভ নেই জানি। কিন্তু বোকামি আমার সহ্য হয়। আদ্রেঁকে হত্যা করার মতো বোকা লোককে আপনারা সহ্য করেন কী করে?

পল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে, নিশ্চিন্ত থাকুন।

কী শাস্তি?

আমাদের শাস্তি মোটামুটি একটাই। এলিমিনেশন।

গোপীনাথ একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। অন্তত একটা শয়তান তো নিকেশ হবে।

০৮.

সকালটি বেশ মনোরম। চারদিকে ঝলমল করছে রোদ। মনোজের অফিস ঘরেও বাইরের আলোর আভা আসছে। স্বাভাবিক আলো, স্বাভাবিক বাতাস মনোজের খুব প্রিয়। সে একটু প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। নিজের অফিসঘরে বসে সকালে সে প্রথমেই এক কাপ কালো কফি খায়। খুব শিথিল ভঙ্গিতে বসে। এ সময়টায় সে একা থাকতে ভালবাসে। কফি শেষ করে কাজ শুরু করে।

ব্যাবসায় একটা টেনশন থাকেই। মনোজ টেনশন ভালবাসে না। ব্যাবসা জিনিসটার প্রতি বরাবর তার একটা ভীতি আছে। ব্যাবসা একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। সে জার্মানিতে একটা মোটা মাইনের গবেষণাধর্মী চাকরি করত। খুব নিশ্চিন্ত ছিল তখন। বছরে একবার কি দু’বার ইউরোপে বা অন্য কোথাও বেড়াতে যেত। রোজমারির সেই বাঁধা জীবন ভাল লাগছিল না। তাকে টেনে নামাল ব্যাবসায়, প্রোডাকশনে। রোজমারি একটু অ্যাডভেঞ্চারাস টাইপের। তবে ব্যাবসাটা ইউরোপে করলে ভাল হত। নিজের দেশকে চেনে মনোজ, এখানে ব্যাবসা করতে গেলে পদে পদে বাধা। সস্তা শ্রমিক এবং ওভারহেড খরচ কম বলে এবং ভারতবর্ষের প্রতি একটা করুণামিশ্রিত ভালবাসা আছে বলে রোজমারি এদেশেই কারখানা করার গোঁ ধরেছিল। আর করেই ছাড়ল। কাজটা উচিত হয়েছে কি না তা মনোজ এখনও বুঝতে পারছে না। তবে মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি। বিদেশে যাওয়ার পর থেকেই এদেশের প্রতি তার একটা বিরূপতা জন্মেছিল। সেটা এখনও কাটেনি।

কফি শেষ হয়ে গেল। এখন অনেক কাজ। সোনালি এবং সুব্রতকে ডাকা দরকার। আজ কোনও মিটিং বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি না, অর্ডার এবং প্রোডাকশন সংক্রান্ত খোঁজখবর এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাদের এসময়ে কথা হয়।

মনোজ খানিকক্ষণ বসে রইল। চুপচাপ। ডেলিগেটরা ফিরে গেছে। আদ্রেঁর মৃতদেহ এতদিনে কবরস্থ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। শুধু একটা দাগ থেকে গেল। মুখে একটা তেতো স্বাদ।

মনোজ ইন্টারকম তুলে প্রথমে সুব্রতকে ডাকল।

গুড মর্নিং স্যার।

মর্নিং সুব্রত।

সুব্রত এমন একটি ছেলে যাকে দেখলেই ভাল লাগে। বেশ বাঙালি ধরনের সুপুরুষ। অনেকটা জমিদারদের মতো অভিজাত চেহারা। আসলে বোধহয় ওরা জমিদারই। এর পদবি রায়চৌধুরী। বয়স আঠাশ-উনত্রিশের মতো হতে পারে। বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা কিছু একটা আছে, যা মনোজ ভাল করে জানে না। এসব স্টাফ নিয়োগ করেছে রোজমারি নিজে দেখেশুনে। কোনও নির্বাচনই খারাপ বলে মনে হচ্ছে না মনোজের।

সুব্রত বসল। বলল, আজ তেমন গুরুতর কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই স্যার।

নেই?

না। ফিনান্স সেক্রেটারির সঙ্গে একটা মিটিং ছিল, কিন্তু তিনি জরুরি কাজে দিল্লি গেছেন।

মনোজ মৃদু হেসে বলল, আমি যে মিটিং অপছন্দ করি সেটা তুমি টের পেয়ে গেছ, না?

হ্যাঁ স্যার। মিটিংগুলো একটু বোরিং…

মনোজ একটু চুপ করে থেকে বলল, খুব বোরিং।

আপনি আজ রিল্যাক্স করুন স্যার।

আচমকা মনোজ জিজ্ঞেস করল, পুলিশের সঙ্গে তোমার জানাশুনো কেমন সুব্রত? নো এনি বিগ গাই?

না স্যার। আমার চেয়ে আপনি বেশি চেনেন। কিন্তু কেন?

মনোজ মাথা নেড়ে বলে, সেভাবে চিনি না। জাস্ট সোশ্যাল মেলামেশা একটু-আধটু। কারণটা হচ্ছে রোজমারিকে কেউ একজন সেদিন লাল গোলাপ পাঠিয়ে একটু রসিকতা করেছে। লাঞ্চ টেবিলেও লাল গোলাপ ছিল, যদিও ইনস্ট্রাকশন ছিল অন্যরকম। আর আই পোলক নামে একজন লোক নাকি কাণ্ডটা ঘটিয়েছে।

শুনেছি স্যার।

আমি গুরুত্ব দিচ্ছি না। কিন্তু রোজমারির টেনশন হচ্ছে। আমি লোকাল থানায় একটা রিপোর্ট করেছিলাম। ওরা ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ভাবছি একটা পুলিশ ইনভেস্টিগেশন হলে কেমন হয়।

সুব্রত সামান্য গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি কথাটা বলার আগেই আমি নিজে সামান্য এনকোয়ারি করেছি। ফুলওলার বক্তব্য হল, লোকটা ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে টেলিফোনে এবং ইংরেজিতে। পেমেন্টের টাকাটা খামে পুরে আগের দিন ওদের লেটার বক্সে রেখে যায়।

তা হলে তো চিন্তার কথা সুব্রত।

সুব্রত মাথা নেড়ে বলে, চিন্তার কিছু নেই স্যার। বোধহয় ওঁর কোনও বন্ধু বা বান্ধবীই কাজটা করেছে। এখানে তো ওঁর অনেক বন্ধু।

মনোজ একটু অসহায় গলায় বলে, তা হলে তো ভালই। রোজি সাহসী মহিলা, সহজে ঘাবড়ায় না। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে একটু নার্ভাস।

পুলিশ যাতে ব্যাপারটা একটু এনকোয়ারি করে তা আমি দেখব স্যার।

দেখো। এবার সোনালিকে ডাকা যাক। লেট আস স্টার্ট আওয়ার মর্নিং সেশন।

সোনালি এল। রোজকার মতোই গম্ভীর মুখ, হাতে ফাইল। প্রথমে কয়েকটা চিঠিপত্রে সই করিয়ে নিল। তারপর বসল।

মনোজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সোনালিকে বলল, সেই সুধাকর দত্ত লোকটার কী খবর মিস সোম?

কোনও খবর পাইনি তো?

লোকটা কি এখনও এদেশে আছে?

তাও জানি না।

লোকটা একটু অদ্ভুত টাইপের না?

সোনালি মৃদু স্বরে বলল, হ্যাঁ।

কী মনে হল আপনার সেদিন? আপনি তো ওকে কারখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন?

লোকটার সঙ্গে কিছু গ্যাজেটস ছিল। ওয়াকি টকি ধরনের।

আর কিছু?

একটু বেশি জানতে চাইছিল। শচি ইনকরপোরেটেড সম্পর্কে কৌতূহলটাই বেশি।

শচি? ওর আসল নাম সাক্কি৷ কী জানতে চায়?

আমরা সাক্কির সঙ্গে ব্যাবসা করি কি না।

সাক্কি আমাদের স্টেডি ক্লায়েন্ট।

সেটা আমি ওঁকে বলিনি। লোকটাকে আমার ভাল লাগেনি বলেই বলিনি।

বললেও ক্ষতি ছিল না। সাক্কি এক্সপ্লোসিভ নিয়ে কাজ করত। ইদানীং সলিড ফুয়েল নিয়ে করছে। গোপন করার কিছু নেই। কিন্তু লোকটা ইন্টারেস্টেড কেন তা বোঝা যাচ্ছে না। সুব্রত, কিছু আন্দাজ করতে পারো?

না স্যার।

আমিও পারছি না। ইন ফ্যাক্ট, আমরা যে অ্যালয়টা তৈরি করি তা বিজ্ঞানের অনেক সম্ভাবনা খুলে দিচ্ছে। শুনেছি, এই এলিমেন্টটা নানা কাজে লাগে। কতরকম কাজে লাগে তা আমিও জানি না।

সুব্রত একটু দ্বিধা করে হঠাৎ বলল, আদ্রেঁ ছিলেন সাক্কির ফুয়েল এক্সপার্ট।

মনোজ মাথা নেড়ে বলল, ওদের কে যে কী তা আমি জানিনা। রোজি জানে হয়তো। তবে হাই পাওয়ার ডেলিগেশন। আদ্রেঁর মৃত্যুটা খুব আকস্মিক। ভেরি ডিস্টার্বিং। ডেলিগেটদের লিডার রীতিমতো ক্ষুব্ধ কিন্তু আমাদের তো দোষ নেই। হার্ট অ্যাটাকের জন্য তো আমরা দায়ী হতে পারি না।

সুব্রত মৃদুস্বরে বলল, ওদের সন্দেহ, আদ্রেঁ পয়জনিং-এ মারা গেছে।

মনোজ অবাক হয়ে বলে পয়জনিং! কিন্তু সেরকম হলে ডাক্তাররা ডেথ সার্টিফিকেট দিত না।

পয়জনিং নানারকমের হয় স্যার। অনেক সময়ে ধরা যায় না। তাই ওঁরা ডেডবডি নিয়ে গেছেন দেশে গিয়ে অটোপসি করাবেন।

অটোপসি! মাই গড!

সুব্রত অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ওদের কথাবার্তা শুনে তাই মনে হল।

কিন্তু পয়জনিংই বা হবে কেন? কী কারণে?

বলা মুশকিল স্যার।

মনোজ খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। তারপর বলল, তুমি আমার দুশ্চিন্তাটা বাড়িয়ে দিলে সুব্রত।

আমাদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ওদের ব্যাপার ওরা বুঝুক। আমাদের কী?

ফুড পয়জনিং মনে করছে কি?

না স্যার। ওদের সন্দেহ এটা খুন।

সর্বনাশ, এ তো ভয়ংকর কথা!

আপনি রিল্যাক্স করুন স্যার। আমার মনে হয় ওঁরা একটু বাড়াবাড়ি করছেন। এটা আসলে হয়তো নরম্যাল ডেথ।

মনোজ সোনালির দিকে চেয়ে বলল, কফি খাবেন?

না।

কাইন্ডলি আমার আর সুব্রতর জন্য দুটো কফির কথা বলে দিন।

সোনালি উঠে গিয়ে বেয়ারাকে কফির কথা বলে এল।

মনোজ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে ঘটনাবলিকে সাজানোর চেষ্টা করল মনে মনে। পারল না। মানসিক শৃঙ্খলা বলতে তার এখন কিছু নেই।

কফি এল। দু’জনে নিঃশব্দে কফি শেষ করার পর মনোজ বলল, তা হলে আজ আমার কিছু করার নেই?

সুব্রত বলল, না স্যার।

আমি তা হলে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে কিছু কাজ করি। অনেকদিন রিসার্চ ওয়ার্ক কিছু করা হয়নি।

সুব্রত গলা খাঁকারি দিয়ে খুব সতর্ক গলায় বলল, স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

কী কথা সুব্রত?

এখানে যে অ্যালয় তৈরি হয় সেটা কি খুব রেয়ার অ্যান্ড এক্সক্লসিভ?

মনোজের ভ্রু একটু কুঁচকে গেল। তারপর একটু ভেবে সে বলল, বিজ্ঞানে নিত্য নতুন জিনিস তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে বিস্তর বাই প্রোডাক্টও আছে। অনেক সময়ে দেখা যায়, কোনও একটা বাই প্রোডাক্ট মূল জিনিসটার চেয়েও ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে উঠেছে। আমরা যে অ্যালয়টা তৈরি করি তার প্রসেসটা কমপ্লিকেটেড। একজন জার্মান বৈজ্ঞানিক এটা প্রথম তৈরি করেন। তখনও এটার ইউটিলিটি সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অনেক সফিস্টিকেটেড ইন্ডাস্ট্রিতে এটার ডিম্যান্ড হয়েছে। এক্সকুসিভ বলা যাবে না, কারণ পৃথিবীতে এই অ্যালয় আরও কোথাও কোথাও তৈরি হয়। তবে বেশি নেই, একথা ঠিক। ইস্টার্ন জোনে আমরাই শুধু তৈরি করছি। কিন্তু একথা কেন জিজ্ঞেস করলে?

এমনিই। জাস্ট কৌতূহল।

মনোজ একটু ভেবে খুব চিন্তিতভাবে বলল, এমন হতে পারে যে, আমরা যা ভেবে জিনিসটা তৈরি করছি অন্য কেউ সেটা সেভাবে ব্যবহার করছে না। এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে এ জিনিসটার এমন কিছু প্রপার্টি বা ইউসেজ আছে যা আমরা জানি না।

সেটা কীরকম স্যার? আপনি নিজেও তো সায়েন্টিস্ট আপনি কেন জানবেন না?

মনোজ ম্লান হেসে বলল, আমি সায়েন্টিস্ট ঠিকই, কিন্তু উর্বর মস্তিষ্কের মানুষের অভাব তো নেই। এই অ্যালয় হয়তো অন্য কোনও ম্যাটারের সঙ্গে রি-অ্যাক্ট করে, তার হয়তো জটিল প্রক্রিয়া আছে। সব কি আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব?

আপনি কি মনে করেন অ্যালয়টা বিপজ্জনক?

না সুব্রত, অ্যাপরেন্টলি বিপজ্জনক নয়। কিন্তু জিনিসটা নতুন, এখনও এর সব প্রপার্টি নিয়ে গবেষণা হয়নি। আমাদের ল্যাবরেটরিতে তো সবসময়েই জিনিসটা নিয়ে রিসার্চ হচ্ছে।

আমি টেকনিক্যাল লোক নই স্যার, বিজ্ঞানের কিছুই জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই অ্যালয়টা কারও কারও কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।

হতে পারে। তুমি কি বলতে চাও রোজমারিকে সেইজন্যই ভয় দেখানো হচ্ছে?

তা জানি না স্যার।

মনোজ চিন্তিত মুখে চেয়ে থেকে বলল, কারখানাটা অনেকে বহু টাকায় কিনতেও চাইছে।

হ্যাঁ স্যার, জানি।

মনোজ অসহায়ভাবে হাত উলটে বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না। দেয়ার মাস্ট বি এ প্যাটার্ন সামহোয়ার। আদ্রেঁকে যদি খুন করা হয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে আমাদের খুব নিশ্চিন্ত থাকা চলবে না। তুমি আমাকে ভাবিয়ে তুললে।

সোনালি মাথা নিচু করে বসে ছিল। একটিও কথা বলেনি। তার দিকে চেয়ে মনোজ বলল, মিস সোম, আজকের দিনটা আমি ল্যাব-এ কাটাতে চাই। রোজমারি আজ একটা অনাথ আশ্রমে গেছে। আপনারা এদিকটা একটু ম্যানেজ করবেন। আই মাস্ট নট বি ডিস্টার্বড।

সোনালি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে।

চিন্তিত মনোজ উঠে পড়ল। মিটিং শেষ।

সোনালি নিজের ছোট ঘরখানায় এসে তার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত রইল কিছুক্ষণ। তারপরই ফোন এল।

সোনালিদি।

বলুন।

বস কি একটু ভয় পেয়েছেন?

হ্যাঁ সুব্রতবাবু, ওভাবে বলাটা আপনার ঠিক হয়নি।

একটু অ্যালার্ট করার দরকার ছিল। এতে উনি সতর্ক হবেন। ওঁর এখন সত্যিই বিপদ।

কীসের বিপদ?

আপনি ভিকিজ মব-এর নাম শুনেছেন?

শুনব না কেন?

ভিকিজ মব ফিন্ডে নেমে পড়েছে।

তার মানে?

মানে বিপদ।

কিছু বুঝতে পারছি না।

আমিও কি ছাই পারছি। তবে আপনি যার নাম শুনলেই চটে যান সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে টেলিফোনে কথা হচ্ছে, উনিই খবরটা দিয়েছেন।

খবরটা কী?

সেটা আপনার জানার দরকার নেই। তবে গোপীদাও এখন বেশ ঝামেলার মধ্যে আছেন।

তাতে আমাদের কী?

একটু আমাদেরও ব্যাপার আছে। যতদূর মনে হচ্ছে এই অ্যালয়টা নিয়েই গণ্ডগোল।

সোনালি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমাদের কি কিছু করার আছে?

না। কিন্তু চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা ভাল।

ঠিক আছে।

আর একটা কথা।

কী?

মিস্টার সুধাকর দত্ত ইন্টারপোল এখনও কলকাতাতেই আছে।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। আমি তাকে দেখতেও পাচ্ছি। এইমাত্র আমাদের রিসেপশনে ঢুকল এসে।

৯.

রিসেপশন থেকে যে টেলিফোনটা আশা করেছিল সোনালি সেটা এল বটে, কিন্তু এল আরও দশ মিনিট পর।

মিস সোম, আপনার সঙ্গে মিস্টার সুধাকর দত্ত দেখা করতে চান।

সোনালি ভেবে পেল না, দশ মিনিট দেরি হল কেন এবং সুধাকর তার কাছে কী চায়। সে শুধু বলল পাঁচ মিনিট পরে পাঠিয়ে দিন।

পাঁচ মিনিট সময়টা দরকার। এই পাঁচ মিনিট তাকে মন ও চিন্তাভাবনাকে গুছিয়ে নিতে হবে। লোকটা তাকে প্রশ্ন করবেই। কিন্তু জেরা করার মতো করে নয়। খুব প্রাসঙ্গিকভাবে এবং সারল্যের সঙ্গে। অনেকটা বাচ্চা ছেলেদের মতো ‘এটা কী, ওটা কী’ গোছের হঠকারী প্রশ্নই। কিন্তু ওগুলোই হল বেশি বিপজ্জনক। ছদ্ম মোড়কে ঢাকা ওইসব প্রশ্নই মানুষের সতর্কতাকে ভন্ডুল করে দেয়। সুধাকরের এখন অনেক কিছু জানা বাকি। কিন্তু সোনালি তাকে সবকিছু বলতে চায় না। তাই কী বলবে এবং কী বলবে না তা এখনই ঠিক করে নেওয়া দরকার।

সোনালি চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে ধ্যানস্থ হল। এই ধ্যানের প্রক্রিয়া তার খুব প্রিয়। এতে মনের শক্তি বাড়ে, ইচ্ছাশক্তিরও বৃদ্ধি ঘটে।

পাঁচ মিনিট পর দরজায় মৃদু ও ভদ্র করাঘাত। সোনালি তার কম্পিউটার মনিটরের ওপর চোখ রেখে ব্যস্ততার ভাবটি শরীরে ফুটিয়ে রেখে সামান্য অধৈর্যের গলায় বলল, কাম ইন।

সুধাকরের চেহারাটা সত্যিই অ্যাথলিটদের মতো। একখানা আড়া মাল্টি কালার স্ট্রাইপের টি-শার্ট পরে আছে বলে শরীরের ছমছমে ভাবটা বেশ ফুটে উঠেছে। হয়তো স্পোর্টসম্যান ছিল।

সুধাকর তার ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে একটু হেসে বলল, জ্বালাতে এলাম। আপনি বোধহয় খুব ব্যস্ত।

সোনালি একটু ক্লান্তির অভিনয় করে বলল, না, ঠিক আছে। আপনি বসুন।

টেবিলের ওধারে মুখোমুখি বসল সুধাকর। একটু চিন্তিত, একটু গম্ভীরও। আগের দিন বেশ বাচাল ছিল।

মিস সোম, আপনার পক্ষে কি একটা কাজ করা সম্ভব?

সোনালি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, কী কাজ?

আমাকে এক কাপ কফি খাওয়ানো কি আপনার পক্ষে কঠিন হবে?

সোনালি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই একটু হেসে বলল, না, কঠিন আর কী।

বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে কফির কথা বলে দিয়ে সোনালি বলল, এবার দরকারের কথাটা বলুন।

সুধাকর যেন একটু অবাক হয়ে বলল, দরকার? না, দরকার কিছুই নেই। জাস্ট প্যারিসে ফিরে যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাওয়া।

প্যারিসে ফিরে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা করার কী দরকার তা বুঝল না সোনালি। বলল, ও।

বাই দি বাই, গোপীনাথবাবুকে আপনার কোনও মেসেজ দেওয়ার আছে কি? থাকলে আমাকে দিতে পারেন। বা যে-কোনও জিনিস। অনেকে তো এখান থেকে আমসত্ত্ব, পাটালি গুড় আর বাংলা বই পাঠায়, তাও দিতে পারেন।

সোনালির মুখখানা কঠিন হয়ে গেল। নিরাসক্ত গলায় বলল, আপনি ভুলে গেছেন যে, ওঁর সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক নেই। তিনি কোথায় আছেন তাও জানি না।

সুধাকর জিব কেটে বলল, তাই তো, ইস ছি ছি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ডিভোর্সের কথাটা আমার খেয়াল ছিল না।

অভিনয়টা চমৎকার করল সুধাকর। কিন্তু সেটা অভিনয় বলে বুঝে নিতে সোনালির কষ্ট হল না। সে মনিটরটার দিকে চেয়ে অকারণেই একটা পুরনো প্রোগ্রাম রিকল করল।

সুধাকর খুবই লজ্জিতভাবে একটা স্বগতোক্তি করল, অবশ্য উনি বোধহয় এখন প্যারিসে নেইও। আছেন রোমে, ওঁর হেড কোয়ার্টাসে।

যেখানেই থাকুন আমার কিছু যায়-আসে না।

সে তো বটেই।

বলে সুধাকর খুব চিন্তিত মুখে বসে রইল।

আর কিছু বলবেন?

না, না, আপনি কাজ করুন। আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি না তো!

সোনালি জবাব দিল না।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সুধাকর বলল, আপনি বোধহয় রোমে থাকতেন, না?

না। জুরিখে।

চলে এলেন কেন?

সোনালি বিরক্ত হয়ে বলল, চলে আসব না কেন? আমি তো বিদেশে থাকতে যাইনি। বিয়ে ভাঙার পর চলে আসতে ইচ্ছে হল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই তো। তখন বোধহয় মিস্টার বোস সাক্কিতে জয়েন করেননি, না?

না।

বাই দি বাই, সাক্কির সঙ্গে আপনাদের কানেকশনটা চেক করে দেখেছেন?

দেখেছি। সাক্কি আমাদের ক্লায়েন্ট। বানান আর উচ্চারণের তফাতটা জানা ছিল না বলে সেদিন বলতে পারিনি।

একটা কথা বলবেন? সাক্কির পারচেজের পরিমাণ কি এখন হঠাৎ একটু বেড়ে গেছে?

বেড়ে থাকতে পারে।

সাক্কি কি আপনাদের ইউরোপিয়ান এজেন্ট?

না। আমরা সাক্কিকে এজেন্ট হিসেবে অ্যাপয়েন্ট করিনি। তারা প্রোডাকশন কিনে নেয়, তারপর কী করে তা জানি না।

ঠিক কথা। মিস সোম, সাক্কি ঠিক কীসের বিজনেস করে তা কি আপনি জানেন?

খুব ভাল জানি না। শুনেছ এক্সপ্লোসিভস অ্যান্ড কো-রিলেটেড থিংস।

বাঃ, এই তো অনেক জানেন।

সাক্কি নামকরা কোম্পানি। সবাই জানে। আমি বরং কমই জানি।

গোপীনাথবাবু যে এই কোম্পানিতে আছেন তা আপনি জানতেন না, না?

না। আমি ওঁর কোনও খবর রাখি না।

ঠিক কথা। আফটার অল হি হ্যাজ ডেজার্টেড ইউ।

প্রসঙ্গটা আর না তুললেই খুশি হব।

সরি। গোপীনাথ বসু ইজ নাউ এ ফ্লাই ইন ইয়োর অয়েন্টমেন্ট। কিন্তু ওঁর প্রসঙ্গটা উঠছে কেন জানেন? হি ইজ এ বিগ গাই ইন হিজ ফিল্ড।

হতে পারে, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড।

সে তো ঠিক কথাই। আচ্ছা মিস সোম, আমি কি আপনাকে একটা গুরুতর প্রশ্ন করতে পারি?

ভ্রু কুঁচকে সোনালি বলে, কী প্রশ্ন?

প্রশ্নটা হল, কফি আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন বলুন তো!

সোনালি ফের একটু হাসল এবং বেল বাজাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ট্রে-তে দু’ কাপ কফি নিয়ে বেয়ারা ঢুকল।

বেয়ারা কফি রেখে চলে যাওয়ার পর সুধাকর তার কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাঃ, চমৎকার! এরকম কফির জন্যই বেঁচে থাকাটার একটা মানে খুঁজে পাওয়া যায়।

সোনালির মনে হল, কথাটা বড্ড বাড়াবাড়ি এবং বাহুল্য। সে মৃদুস্বরে বলল, আপনি বুঝি খুব কফি খান?

হ্যাঁ। তবে এরকম নয়। পারকোলেটরে তৈরি করা ব্ল্যাক তেতো কফি। ব্ল্যাক কফি ইজ এ ম্যাসকুলিন ড্রিঙ্ক।

আর এটা বুঝি ফেমিনিন?

না, না, তা নয়। এটাও চমৎকার। অত্যন্ত চমৎকার। ধন্যবাদ।

সোনালি লোকটাকে মনেপ্রাণে মোটেই পছন্দ করতে চাইছে না। আবার লোকটাকে তার খারাপও লাগছে না। এরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়া তার আর কখনও হয়নি।

হঠাৎ সোনালি বেমক্কা প্রশ্ন করল, সাক্কিকে নিয়ে আপনি এত চিন্তিত কেন মিস্টার দত্ত?

সুধাকর কফির কাপে তার অখণ্ড মনোযোগ অব্যাহত রেখে খুবই মৃদু স্বরে বল, গুজব। সাক্কিকে নিয়ে হাজারও গুজব।

কীসের গুজব?

সেসব আপনার জানার দরকার নেই, সুখে থাকতে ভূতের কিল খাবেন কেন? এসব কারবারে যত না জেনে থাকা যায় ততই ভাল।

তাই বুঝি?

ঠিক তাই। এই যে আমি হাজার হাজার মাইল দৌড়ে মরছি তার অধিকাংশই হল পণ্ডশ্রম। চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে চিলের পিছনে ছোটার মতো বোকামি। ওয়াইল্ড গুজ চেজ। সাক্কিকে নিয়ে যা রটেছে তাও এরকমই ব্যাপার হতে পারে।

তাই বুঝি?

আচ্ছা মিস সোম, আপনি নিজে সাক্কিকে নিয়ে চিন্তিত নন তো!

অবাক হয়ে সোনালি বলল, আমি! আমি কেন সাক্কিকে নিয়ে চিন্তিত হব?

ঠিক ঠিক, তাই তো। আপনার তো টেনশনের কারণ নেই।

না নেই।

আপনার বস মনোজ সেনের আছে কি?

ওঁর কথা আমি কী করে বলব?

তাও তো বটে। আপনি তো আর থট রিডার নন। আচ্ছা উনি এমনিতে তো লোক ভালই, না?

হ্যাঁ, ভালই তো।

আমারও তাই মনে হল। বেশ লোক। তবে ভাল লোকেরা তেমন বুদ্ধিমান বা যাকে চালাক চতুর চটপটে বলে তা হন না, তাই না?

সোনালি একটু হাসল। কিছু বলল না। আপনার কি মনে হয় মনোজবাবু খুব বুদ্ধিমান?

সোনালি মুখটা গম্ভীর করে বলল, বোকা হলে কি এত বড় কারখানা তৈরি করতে পারতেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাও একটা পয়েন্ট।

সোনালি এবার সুধাকরের চোখে অকপট চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলল, আপনি নিশ্চয়ই গালগল্প করতে আমার কাছে আসেননি। কী জানতে চান স্পষ্ট করে বলুন তো।

খুবই বিব্রত হয়ে সুধাকর কফির কাপটা রেখে বলল, এই দেখুন আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করে ফেললাম। আসলে আমি একটু মাঠো লোক। কিছু মনে করবেন না। আমার বোধহয় এখন বিদায় নেওয়াই উচিত, কী বলেন?

ভ্রু কুঁচকে সোনালি বলল, প্রয়োজন শেষ হয়ে থাকলে অবশ্যই বিদায় নেবেন।

সুধাকর উঠতে গিয়েও ফের বসে পড়ে বলল, প্রয়োজন! প্রয়োজনের কথা বলেই মুশকিলে ফেললেন। আপনার কম্পানিটাই এত লোভনীয় যে সেটাকেই প্রয়োজন বলে ধরে নেওয়া যায়।

মিস্টার দত্ত, ফ্ল্যাটারি আমি পছন্দ করি না।

সুধাকর খুবই অপ্রতিভ হয়ে বলল, যথার্থ বলেছেন। ফ্ল্যাটারি জিনিসটা বোধহয় ভালও নয়। তবু মানতেই হবে যে, জিনিসটা খুবই প্রয়োজনীয়। অবস্থা বিশেষে খুবই কাজে লাগে।

কিন্তু ভুল জায়গায় হলে উলটো ফল হতে পারে।

সুধাকর দত্ত ঘনঘন নেতিবাচক মাথা নাড়া দিয়ে বলল, আমি আপনাকে মোটেই ফ্ল্যাটারি করিনি। এ যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী যেমন হওয়া উচিত আপনি ঠিক তেমনই। আপরাইট, স্পষ্টবক্তা এবং সাহসী। ইউ আর রিয়েলি এ গুড কম্পানি।

আপনার কথা কি শেষ হয়েছে মিস্টার দত্ত?

হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার আমি উঠব।

আসুন নমস্কার।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নমস্কার। আচ্ছা মিস সোম, লাল গোলাপের ব্যাপারটা কি একটু বলতে পারেন?

লাল গোলাপ?

গুজবই হবে। তবে শুনেছি রোজমারি সেনকে কে বা কারা লাল গোলাপ পাঠিয়ে থ্রেট করেছে!

সোনালি ফের ভ্রু কোঁচকায়। তারপর বলে, থ্রেট হবে কেন? হয়তো কেউ রসিকতা করেছে।

আপনি তাই মনে করেন?

আমার মনে করায় কী আসে যায় বলুন।

তা বটে। তবে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ব্যক্তিগত কিছু ডিডাকশন আছে। আপনার ডিডাকশন কী বলে?

সেটা তো বললামই।

রসিকতা? তা হলে তাই হবে। কিন্তু এরকম রসিকতা কে করতে পারে বলুন তো!

তা জানি না। তবে মিসেস সেনের অনেক বন্ধু আছে কলকাতায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

সুধাকর কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে সোনালির দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলল, অঙ্কটা মিলছে না।

কীসের অঙ্ক?

আমার ব্যক্তিগত ডিডাকশন। সেখানে কিছু গণ্ডগোল হচ্ছে।

তার মানে?

আদ্রেঁ এবং লাল গোলাপ দুটো এক হাতের কাজ নয়। বাট হু ইজ দি সেকেন্ড পার্টি?

কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।

সরি। আই ওয়াজ জাস্ট থিঙ্কিং অ্যালাউড।

তাই নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আচ্ছা, রোজমারি বোধহয় খুবই বুদ্ধিমতী। না?

হ্যাঁ।

এই প্রোজেক্টটা কি উনিই চালান?

তা কেন? মিস্টার সেনও আছেন।

দু’জনের মধ্যে কাকে আপনার বেশি এফিশিয়েন্ট বলে মনে হয়?

দু’জনকেই সমান এফিশিয়েন্ট বলে মনে হয়।

ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি আপনাকে কিছু কমিট করতে বলছি না। জাস্ট সিম্পল কৌতূহল। কিছু মনে করবেন না।

মনে করিনি। কিন্তু এখন আমি কাজ করব।

ছি ছি, সত্যিই আমি একটা ইডিয়ট। আপনার মূল্যবান সময় অনেকটা নষ্ট করলাম। আসি তা হলে?

আসুন।

সুধাকর উঠল এবং দরজার কাছ বরাবর গিয়ে ফিরে এল।

আচ্ছা মিস সোম এই যে অ্যালয়টা এঁরা তৈরি করছেন এর কোনও পিকিউলিয়ার ইউসেজের কথা কি আপনি কিছু জানেন?

সোনালি একটু হেসে বলল, আমি নন-টেকনিক্যাল হ্যান্ড। আমার কাজ করেসপন্ডেন্স অ্যান্ড অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ওসব ব্যাপার আমার জানার কথা নয়।

তাও তো ঠিক কথা। আমারই ভুল। কিন্তু অনেক সময়ে অনেক কিছু তো আন্দাজও করে মানুষ।

মাথা নেড়ে বিরক্ত সোনালি বলল, না, আমার অত আন্দাজ করার মতো ক্ষমতা নেই।

মিস সোম, ইউ আর রিয়েলি এ গুড কম্পানি।

ধন্যবাদ।

আচ্ছা, তা হলে গোপীনাথবাবুকে আপনার কোনও মেসেজ দেওয়ার নেই।

সোনালি কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, আমার মনে হচ্ছে আপনি ইচ্ছে করেই আমাকে উত্ত্যক্ত করতে চাইছেন।

জিব কেটে সুধাকর বলল, তা নয়, তা নয়। আসলে আমি তো এখন রোমেই যাচ্ছি। দেয়ার ইজ এ পসিবিলিটি অফ এ চান্স মিটিং। ঠিক আছে মিস সোম, আমি যাচ্ছি।

আসুন।

সুধাকর দত্ত চলে যাওয়ার পর সহজ হতে পারল সোনালি। আবার তার লোকটাকে খারাপও লাগছে না। যদি আবার কখনও দেখা হয় তা হলে সোনালি অন্তত বিরক্ত হবে না। লোকটা খুবই অদ্ভুত। বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর, কিন্তু আকৰ্ষকও।

সোনালি কাজকর্ম শুরু করতে যাচ্ছিল, টেলিফোন বাজল।

সোনালিদি আমি সুব্রত।

হ্যাঁ, বলুন।

দত্ত তো চলে গেল দেখলাম।

হ্যাঁ।

খুব জ্বালিয়েছে নাকি আপনাকে?

একটু।

কেন যেন লোকটাকে আমার বিপজ্জনক মনে হয়।

হতে পারে। ভেবে কী করবেন?

১০.

একটা পোর্টেবল আইসিবিএম তৈরি করাটাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, আমি একজন ভাড়াটে বেতনভুক বৈজ্ঞানিক। প্রভুরা যা চান আমার তা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সাক্কির হয়ে আমি যা করেছি তা একজন কর্মচারী হিসেবেই করেছি। কর্মচারী হওয়া ছাড়া একজন বৈজ্ঞানিকের এ যুগে উপায়ও নেই। তার কারণ বহুল ব্যয়সাপেক্ষ গবেষণা চালাতে গেলে তার দরকার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও বিশাল সংগঠন, যা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা যায় না। কর্মচারী হিসেবে আমি প্রচুর বেতন ও সুবিধা পাই। তার চেয়েও অনেক বেশি পাই কাজ করার অফুরন্ত সুযোগ ও পরিবেশ। সাক্কি অস্ত্রের কারবারি। তাদের তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নরমেধেই প্রযুক্ত হয়। তাদের বিধ্বংসী অস্ত্রে অনেক কলকারখানা, বাড়িঘর, নগর বন্দর ছারেখারে যায় আমি জানি। এইসব অস্ত্র তৈরিতে আমাদের মতো বৈজ্ঞানিকদের অবদান তো কম নয়। এই যে পোর্টেবল, স্বল্প ওজনের দুরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি হচ্ছে এটি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পক্ষে এক অভিশাপ হয়ে রইল। সাক্কি কোনও দেশের হয়ে কাজ করে না, তার কোনও স্থানিক পরিচয়ও নেই। এটি একটি নৈর্ব্যক্তিক, অর্থগৃধ্বু, ক্ষমতালিপ্সু প্রতিষ্ঠান। পৃথিবী ছারেখারে গেলেও এর কিছু যায়-আসে না। কিন্তু এদের ক্ষমতা ও অর্থবল বিশাল। এদের হাতে যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। কিন্তু আমি–গোপীনাথ বসু এই বিশাল সংগঠনের কতটুকু? লক্ষ ভগ্নাংশও নয়। কিন্তু এই আইসিবিএম তৈরি করতে গিয়ে আদ্রেঁ এবং আমি একটি অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাই। আলোকোত্তর প্রতিভার অধিকারী আদ্রেঁ-ধাতব রসায়ন বিক্রিয়া থেকে জ্বালানি তৈরির কথা ভেবেছিল। তাই ওকে একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সাক্কিতে। জ্বালানি তৈরির জটিল ও সূক্ষ্ম কাজে দিনের পর দিন মগ্ন থেকেছে সে। অবশেষে সে একদিন আমাকে তার স্বভাবসিদ্ধ মৃদু স্বরে বলেছিল, হয়তো আমি স্বপ্ন দেখছি না মঁসিয়ে বোস। জিনিসটা হয়তো আমাদের নাগালে এসে গেছে।

ঠিক যে ধরনের আপাত-অসম্ভব জ্বালানির কথা আদ্রেঁ ভেবেছিল তা সত্যিই তৈরি হলে শুধু সাক্কির আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রই উড়বে না, তার চেয়েও অনেক বড় কাজ হবে, আদিগন্ত ভবিষ্যতের জন্য মানুষের জ্বালানি সমস্যারও সমাধান হয়ে যেতে পারে।

যে অ্যালয় নিয়ে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার কাজ করছিল আদ্রেঁ, সেটি কলকাতা এবং পৃথিবীর আরও কয়েকটি জায়গায় তৈরি হয়। কিংবা আরও অন্য কোনও ধাতু বা সংকর ধাতু নিয়ে সে কাজ করছিল। আমি সঠিক জানি না, কিন্তু তার এই কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য আর একজন আদ্রেঁ দরকার। নইলে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ব্যর্থ হয়ে যাবে এত বড় একটা প্রয়োজনীয় আবিষ্কার। ধ্বংসের বিজ্ঞান থেকে অন্তত এটুকু সদর্থক একটা কিছু বেরিয়ে এলে আমি খুশি হতাম। তা হল না, কোন মূর্খ ঘাতক তাকে খুন করে দিল।

আজই আদ্রেঁর অটোপসির রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। তার মৃত্যু হয়েছিল অত্যাধুনিক বিষে। খুব সূক্ষ্ম পরীক্ষা ছাড়া যা ধরাই যায় না। হার্ট অ্যাটাকের সমুদয় লক্ষণ নিয়েই মানুষ মারা যায়। তবু সন্দেহের বশে তার ময়নাতদন্ত করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ দিয়ে।

জানি না ভিকিজ মব-ই তাকে মেরেছে কি না। যদি তারাই এ কাজ করে থাকে তা হলে তাদের অবিলম্বে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া দরকার। জানি তা সম্ভব নয়। এই পৃথিবীতে যা কিছু অসুন্দর, নিষ্ঠুর ও দুষণীয় তা দুর করা যায়নি, যাবেও না। কিন্তু আদ্রেঁর মৃত্যু যে আমাদের কতখানি ক্ষতি করল তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমি বড় অসহায় বোধ করছি।

সুব্রত, তোমাকে সবই বুঝিয়ে লিখলাম। ভিকিজ মব আমার ওপর সর্বত্র ও সর্বক্ষণ নজর রাখছে বটে, কিন্তু আমার কাজে এখনও বাধা দিচ্ছে না। তার কারণ আদ্রেঁ মারা যাওয়ায় আমাদের প্রোজেক্ট এক বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। আরে অসমাপ্ত কাজ শেষ করার মতো কেউ নেই। আশা করছি ভিকিজ মব কয়েকদিনের মধ্যে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিরস্ত হবে। কিন্তু বিপদ আসছে অন্যদিক থেকে। অপ্রত্যাশিত বলব না, এরকম যে ঘটবে তা আমি জানতাম।

বিপদটা হল, সাক্কি ইনকরপোরেটেডের কর্তৃপক্ষ গন্ধ পেয়ে গেছে যে, আদ্রেঁর গবেষণার ভিতরে সোনার খনি রয়েছে। সাধারণত তাদের ভাড়াটে বৈজ্ঞানিকরা কী কাজ করে সে সম্পর্কে সাক্কি কর্তৃপক্ষ ততটা খবর রাখে না। তাদের মূল লক্ষ্য ব্যাবসা এবং মুনাফা। তুমি তো জানোই, এই জ্বালানির ব্যাপারে আজ সারা পৃথিবী জুড়ে কীরকম প্রচেষ্টা চলছে। এই নতুন রকেট ফুয়েল শুধু আইসিবিএম নয়, সামান্য হেরফের ঘটিয়ে প্রায় সব ব্যাপারেই এই জ্বালানিকে কাজে লাগানো যাবে, যদি না কোনও বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আপাতত সাক্কি এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছে। গত পরশু সাক্কির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। তাদের হাবভাব আমার ভাল লাগছে না। নানারকমভাবে তারা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তারা বলছে প্যারিস থেকে পালিয়ে আসার পর আদ্রেঁর কাগজপত্র সরানো এবং ফটোকপি করা ইত্যাদির সব খবরই তারা রাখে। তাদের সন্দেহ আমার উদ্দেশ্য খুবই অসাধু। আমি তাদের ভিকিজ মবের কথা বুঝিয়ে বলেছি, কিন্তু তারা সেটা বিশ্বাস করছে না। আমার দূরভিসন্ধিমূলক কাজকর্ম তারা বরদাস্ত করতেও রাজি নয়। আরে যাবতীয় কাজকর্মের ফটোকপি তাদের হাতে আমি তুলে দিয়েছি, কিন্তু তারা তাতেও খুশি নয়। আমার কাছ থেকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেলে তারা সহজে ছাড়বে না আমাকে।

কাজেই ভিকিজ মব-এর সঙ্গে সাক্কির ভাড়াটে গুন্ডারাও আমার ওপর নজরদারি করছে। আপাতত রোম ছেড়ে আমার কোথাও যাবার উপায় নেই। ল্যাবরেটরিতে আমার প্রবেশ নিষেধ হয়েছে। সাক্কি যাদের কাজে লাগিয়েছে তারা সিসিলির মাফিয়া। চোখের পলকে খুন করে বসে।

আমি বেঁচে থাকার কোনও আশা দেখছি না। মৃত্যু অবধারিত বলেই মনে হচ্ছে। তবে তুমি তো জানোই, কাজ ছাড়া বেঁচে থাকাটাও আমার কাছে অর্থহীন। আমার মনে হয় না সাক্কি আমাকে কাজ করতে দেবে। আমি জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছি।

আমার বিষয়সম্পত্তি নিয়েই প্রশ্ন। তুমি তো জানোই যে, আমার নিকট আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। মা-বাবা গত হয়েছেন। আমার দিদি সম্প্রতি আমেরিকায় মারা গেছেন। তার ছেলেমেয়েরা আছে বটে, কিন্তু তারা আমাকে চেনেও না। সুতরাং আমার উত্তরাধিকারী বলে কেউ নেই। একমাত্র সোনালি আছে–যে আইনত আমার কেউ নয়, কিন্তু একসময়ে সে আমার স্ত্রী ছিল। এখানে আমি আমার অ্যাটর্নি মারফত যাবতীয় সম্পত্তি সোনালির নামে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করেছি। তাকে সরাসরি এ কথা জানানোর উপায় আমার নেই। কারণ আমার প্রতি তার একটা ঘৃণার ভাব আছে। অতীত যে কত বড় বর্তমান হয়ে বাধার সৃষ্টি করে। সে যাক, খবরটা তুমিই তাকে দিয়ো। আমি জানি তার তেমন আর্থিক সচ্ছলতা নেই। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের চাকরি থেকে প্রাপ্ত বেতন থেকে তাকে বাপের বাড়ির জন্য অনেকটাই খরচ করতে হয়। সে আমার কাছ থেকে খোরপোষ বা ক্ষতিপূরণ বাবদও কিছু নেয়নি। হয়তো এবারও নেবে না। কিন্তু আমার তো আর কেউ নেই। তাকে বোলো, গ্রহণ করলে আমি বড় শান্তি পাব।

আমাকে আমার অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়তে হয়েছে। আমি একটা রুমিং হাউসে। এখানে টেলিফোন আছে বটে, তবে পাবলিক ফোন। সাক্কি আপাতত আমার অ্যাপার্টমেন্টের চার্জ নিয়েছে। কেন তা জানি না। আমি হয়তো বা গৃহবন্দি, কারণ, সবসময়ে একটা অস্বস্তি বোধ করছি। আমার চারদিকে অনেক নজরদার।

সোনালিকে আমার অসহায় অবস্থার কথা বোলো। আমার অ্যাটর্নি কয়েকদিনের মধ্যেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ও যেন প্রত্যাখ্যান না করে। ওকে রাজি করানোর ভার তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম।

রোমে আমার একটা ভিলা আছে। আছে কিছু শেয়ার আর নগদ টাকা। খুব কম করে ধরলেও সব মিলিয়ে দশ কোটি টাকার ওপর হবে। সোনালি বিদেশে থাকা পছন্দ করে না। যদি চায় অ্যাটর্নি মারফত বিক্রি করে সব টাকা কলকাতায় ওর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নিতে পারে। আর যদি আসে তা হলে তো নিজেই সব বুঝে নিতে পারবে। যদি বেঁচে থাকি সাতদিন বাদে আমি তোমাকে ফোন করব। সোনালি রাজি হল কি না জানার জন্য উদগ্রীব রয়েছি। ভালবাসা জেনো। গোপীদা।

.

চিঠিটা পেয়ে সুব্রতর মন খারাপ হয়ে গেল। এতটাই খারাপ যে, চোখে জল এল তার। গোপীনাথ শুধু তার ডাকের দাদা নয়, গোপীনাথ ছিল তার আশৈশব হিরো। মেধাবী, সাহসী ও প্রচণ্ড প্রাণবান গোপীনাথ যাতে হাত দিত তাতেই সোনা ফলিয়ে তুলতে পারত। চমৎকার অভিনয় করত, মূর্তি বানাত, ছবি আঁকত, বাচ্চাদের ব্যায়াম শেখাত। তবে গোপীনাথ ছিল গরিব। কষ্ট করে, লড়াই করে বড় হয়েছে। চিররুণ বাবা গোপীনাথের কিশোরবয়সেই মারা যান। মা মারা গেলেন গোপীনাথ কলেজে ভরতি হওয়ার আগেই। গোপীনাথের দিদি সুন্দরী ছিলেন বলে অল্পবয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এবং বিয়ের পরই যে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন, আর বড় একটা আসতেন না। গোপীনাথ প্রায় একা একা জীবন কাটিয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই গোপীনাথ শুধু লেখাপড়া আর চিন্তাভাবনায় সময় কাটাত। ছাত্র অবস্থা থেকেই চেষ্টা করত বিদেশে চলে যাওয়ার। শেষ অবধি গেল। আমেরিকায়। দারুণ সব রেজাল্ট করল, বড় চাকরি পেল। তারপর সাধের বিয়ে।

সুব্রত আজও বিয়ে ভাঙার আসল কারণ জানে না। গোপীনাথ ভেঙে কিছু বলেনি কখনও। কিন্তু সোনালির সঙ্গে একটা যোগাযোগ সুব্রতর ছিল বরাবর। বিয়ের আগে থেকেই চেনা। এই যে সোনালি আর সে একই কোম্পানিতে চাকরি করে এটা কোনও অ্যাক্সিডেন্ট নয়, একটি ধুরন্ধর মাথার ঠান্ডা, হিসেব করা প্ল্যানিং। গোপীনাথ বসু দুর থেকে কলকাঠি নেড়ে এটা ঘটিয়েছে। সোনালি জানে না, সুব্রত জানে। কিন্তু গোপীদা কেন এটা ঘটিয়েছে তা স্পষ্ট জানে না সুব্রত।

চিঠিটা পেয়ে সুব্রত কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসে রইল। গোপীদা যদি খুন হয় তবে তার ভীষণ খারাপ লাগবে। লোকটা জীবনে কখনও সুখ পায়নি। টাকা রোজগার করেছে অনেক, কিন্তু সেই টাকারও ভাগীদার নেই, গোপীদা এমনই দুর্ভাগা। একটি দুঃখী লোক বিদেশ বিভুয়ে অকারণে গুন্ডাদের হাতে খুন হবে, ভাবতেই তার বুক হাহাকার করে।

পরদিন অফিসে এসেই সুব্রত সোনালির ঘরে ফোন করে বলল, ম্যাডাম, একটু কথা আছে।

কী কথা?

একটু সময় লাগবে। লাঞ্চে কি ফ্রি আছেন?

লাঞ্চ বলে কিছু তো আমার নেই। তবে বেলা একটায় সময় দিতে পারব।

তা হলে ওই কথাই রইল।

সোনালি কম কথার মানুষ। বেশ ব্যক্তিত্বও আছে। সোনালি কেন গোপীদাকে পছন্দ করতে পারেনি সেটা আজও রহস্য রয়ে গেল সুব্রতর কাছে।

লাঞ্চ পর্যন্ত সুব্রত আজ অন্যমনস্ক রইল। কাজে তেমন মন বসল না। বেলা একটায় ফোন করল সোনালিকে।

সোনালিদি, আর ইউ ফ্রি নাউ?

হ্যাঁ।

আমি কি আপনার ঘরে আসব?

আসুন।

সুব্রত যখন সোনালির ঘরে গিয়ে ঢুকল, তখন সোনালি নিশ্চিন্তে বসে বাড়ি থেকে আনা স্যান্ডউইচ আর কফি খাচ্ছে। বাঁ হাতে একটা টাইপ করা চিঠি দেখছে। সোনালি সবসময়ে কাজ ভালবাসে।

তার দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে সোনালি বলল, কী ব্যাপার বলুন তো। বেশ টেনশ দেখাচ্ছে আপনাকে।

হ্যাঁ। আমি একটু টেনশনেই আছি।

বসুন।

সুব্রত বসে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। কী করে কথাটা বলবে তা সে গুছিয়ে আসেনি। একটু এলোমেলো লাগছে ভিতরটা।

বলুন। বলে সোনালি খুব গা ছেড়ে বসল।

সুব্রত সামান্য একটু দ্বিধা করে পকেট থেকে গোপীনাথের চিঠিটা বের করে সোনালির হাতে দিয়ে বলল, এ চিঠিটা পড়ুন।

কার চিঠি?

পড়লেই বুঝবেন।

চিঠিটা যতক্ষণ পড়ল সোনালি ততক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রইল সুব্রত। ভাবান্তর দেখার জন্যই।

ভাবান্তর হল। মুখটা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে লাগল। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল সোনালি। ভ্রু কুঁচকে রইল। চিঠিটা পড়া শেষ করে সুব্রতর দিকে নীরবে চেয়ে রইল সোনালি।

সুব্রত বলল, কিছু বুঝলেন?

কী বুঝব?

গোপীদা আপনার একটা জবাব চাইছে।

সোনালি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ, ও তো বিষয়সম্পত্তির কথা। তা দিয়ে আমার কী হবে?

কিন্তু গোপীদা যে—

সোনালি কেমন যেন লাল হয়ে বলল, একটু চুপ করবেন? আমাকে ভাবতে দিন।

সুব্রত থতমত খেয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সোনালি বলল, ও টেলিফোনে অ্যাকসেসেবল নয়। তা হলে কী করে যোগাযোগ করবেন?

চিঠি।

চিঠি? বলে যেন অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইল সোনালি। তারপর বলল, চিঠি পৌঁছোতে তো সময় লাগবে।

তা ছাড়া উপায় কী? সাতদিন বাদে টেলিফোন করবেন বলে লিখেছেন। আমার হিসেবে আগামীকাল। কিছু বলতে হবে?

না। আমার কথা ওকে কিছু বলবেন না, প্লিজ।

তা হলে?

সোনালি একটু চুপ করে থেকে বলল, টাকার লোভ যে একটা মানুষকে কতখানি নষ্ট করে ফেলে।

কার কথা বলছেন?

আপনার গোপীদার কথা।

গোপীদা কি লোভী?

আর কী বলা যায় বলুন তো! ভূতের মতো খাটে, দু’হাতে পয়সা রোজগার করে, এ ছাড়া আর কী করে আপনার গোপীদা? জীবনটা কি ওরকম? শুধু কাজ আর টাকা?

আপনি ভুল বুঝছেন।

সোনালি মাথা নেড়ে বলল, ভুল বুঝব কেন? আমি ঘর করেছি বলেই জানি। পরিণতিটাও দেখুন, একটাও নিজের জন নেই লোকটার, ওর টাকা হাত পেতে নেওয়ার লোক নেই। ওর তো এরকমই হওয়ার কথা।

আপনি একটু ভুল বুঝছেন ম্যাডাম।

সোনালি একটা তীব্র হেসে বলল, ভুল বুঝলে তো ভালই হত। আপনিই দেখুন, বিপদে পড়েও এখন শুধু ওর বিষয়সম্পত্তি আর টাকার কথাই ভাবছে।

সকলেই তো তাই ভাবে। মরার সময়ে যাবতীয় উত্তরাধিকার কাউকে দিয়ে যেতে চায়।

ওটা মানি-সেন্ট্রিকের ভাবনা।

সুব্রত কী একটা বলতে গেল, কিন্তু জুতসই কিছু খুঁজে পেল না। চুপ করে রইল।

সোনালি মৃদু স্বরে বলল, ওকে বলে দেবেন ওর টাকায় আমার দরকার নেই।

সোনালিদি, আপনি বড্ড নিষ্ঠুরতা করছেন। একটু ভেবে বলুন।

আমার ভাবনাচিন্তা অনেক আগেই হয়ে গেছে। আমি কোনওভাবেই গোপীনাথ বসুর উত্তরাধিকারী নই।

তা হলে কী হবে সোনালিদি?

কী আবার হবে। ওর সব টাকাপয়সা বাড়ি গাড়ি সরকার নিয়ে নিক। আমার দরকার নেই।

সুব্রত তবু কিছুক্ষণ বসে রইল। সোনালি তার স্যান্ডউইচ আর খেল না। তুলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিল। কফিটাও আর ছুঁল না।

সোনালিদি, আমাকে আজ একটা কথা বলবেন?

কী কথা?

গোপীদাকে আপনি এত অপছন্দ করেন কেন?

অপছন্দ করার মতো বলেই।

এর বেশি কিছু বলবেন না?

আজ থাক সুব্রতবাবু, অন্য দিন বলব।

গোপীদা কি হৃদয়হীন?

সোনালি একটু চুপ করে থেকে বলল, তাই তো মনে হয়।

আমি ছেলেবেলা থেকে ওকে চিনি, আপনি তো জানেন।

জানি। পুরনো কথা শুনে আমার লাভ নেই। গোপীনাথ জীবনে যা চেয়েছে পেয়েছে। তার বেশি কিছু চায়নি, পায়নি।

সুব্রত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল।

পরদিন রাত প্রায় দশটায় গোপীনাথের ফোন এল তার বাড়িতে।

সুব্রত, গোপীদা বলছি।

হ্যাঁ, গোপীদা, ওদিককার কী খবর?

খবর ভাল নয়। জাল গুটিয়ে আনছে।

তার মানে?

মেয়াদ খুব কম। সোনালি কী বললে?

ভেবে বলবে।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানতাম।

১১-১৫. লক্ষ করো বেনভেনুটি

লক্ষ করো বেনভেনুটি, ওই যে মেয়েটি করিডর ঝাড়ু দিচ্ছে, ওর মতো উরু তুমি কখনও দেখেছ? ওরকম যার ঊরু সে কোন দুঃখে জ্যানিটরের কাজ করছে বলতে পারো? এ তো কোটিপতিদের শয্যাসঙ্গিনী হতে পারে।

বেনভেনুটি নামক গরিলার মতো বলবান লোকটি করিডরের সিঁড়ি ও লিফটের মুখোমুখি একটা পাথরের মূর্তির আড়ালে দুটি চেয়ারের একটিতে বসে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সিগারেট খেতে খেতে বলল, বাসিলোঁ, লক্ষ করাই আমার কাজ।

বাসিলোঁ ছিপছিপে এবং বেশ লম্বা। তার দেহ-গঠনে একটা চিতা বাঘের মতো তৎপরতা আছে। বয়সে সে বেনভেনুটির চেয়ে অন্তত আট-দশ বছরের ছোট। বেনভেনুটির যদি মধ্য ত্রিশ তা হলে এ ছেলেটি পঁচিশ হতে পারে। দু’জনের পরনেই জিক্স এবং ঊর্ধ্বাঙ্গে গরম জ্যাকেট। রোমে একটু শীত পড়তে শুরু করেছে। বাসিলোঁ তরল গলায় বলল, তুমি কি ইমপ্রেসড নও?

অবশ্যই। সুন্দরী মেয়েরা বরাবরই আমাকে ইমপ্রেস করে থাকে।

বেনভেনুটি, তুমি ভাল করে মেয়েটাকে দেখোনি। আমার মনে হচ্ছে, মেয়েটা আমাদের লোভাতুর করতে চাইছে। বুঝলে! ঠিক একজন ব্যালেরিনার মতোই চমৎকার ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে কেমন ঝাড়ু চালাচ্ছে দেখো।

বেনভেনুটি মাথার টুপিটা ভ্রু পর্যন্ত টেনে নামিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মিনি স্কার্ট পরা কোনও ঝাড়ুদার আমি দেখিনি কখনও বাপু।

মেয়েটা বোধহয় নতুন কাজ পেয়েছে। একটু আলাপ করে আসব?

আসতে পারো। তবে বেশি মজে যেয়ো না। ওর হয়তো বয়ফ্রেন্ড আছে, কিংবা স্বামী।

তুমি সত্যিই বুড়ো হয়েছ। দেখো, দেখো, মেয়েটার মুখখানা কী সুন্দর! এতক্ষণ পিছন ফিরে ছিল বলে মুখটা দেখা যায়নি। সোনালি চুল, নীল চোখ এবং অসাধারণ ঠোঁট।

মেয়েমানুষই তোমাকে খেলো, বাসিলোঁ।

আহা, গত সাতদিন ধরে একঘেয়ে যে কাজটা আমাদের করতে হচ্ছে সেটাই বা কোন মজার কাজ? একটা ভিতুর ডিম ইন্ডিয়ান তার ঘরে দরজা বন্ধ করে দিন-রাত বসে আছে আর আমরা বাইরে বসে মাছি তাড়াচ্ছি।

ইন্ডিয়ানটা হয়তো ইম্পর্ট্যান্ট লোক। আমাদের কাজ নজর রাখা, রাখছি।

তুমি কি জানো, বেনভেনুটি, যে পৃথিবীতে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট লোকগুলোই হয় সবচেয়ে বেশি বোর?

জানি।

এ লোকটা যদি একটু পালানোটালানোর চেষ্টা করত তা হলেও না হয় হত। এ তো শুধু মাঝে মাঝে নীচের ল্যান্ডিং-এ গিয়ে ফোন করে, আর রাস্তার ওপাশে সুপার স্টোরে কেনাকাটা করতে যায়। কোনও অ্যাডভেঞ্চারই নেই। আমাকেও ও চিনে ফেলেছে। ওর গায়ের সঙ্গে লেগে লেগে তো আমাকেই থাকতে হচ্ছে।

আমাদের যা করতে বলা হয়েছে তা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই বাসিলোঁ। আমরা এ কাজের জন্য যথেষ্ট টাকা পাচ্ছি।

লোকটাকে এক-আধটা ঘুসি মারা কি বারণ?

হ্যাঁ, বারণ। ওর গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। হয়তো সময়মতো ওকে খুন করা হবে এবং সে ভার পাবে হয়তো বা তুমিই।

চমৎকার। আমি সেই হুকুমটার জন্যই অপেক্ষা করছি। কিন্তু বেনভেনুটি, মেয়েটা যে বড্ড কাছে এসে পড়েছে এবং আমাকে কটাক্ষও করল বোধহয়।

ঠিক আছে, এগিয়ে যাও। এখন সকাল আটটা বাজে, সন্ধে ছ’টায় আমাদের জায়গা নিতে আসবে দিনো আর নিনো দুই ভাই। যদি মেয়েটার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে চাও সেটা ছ’টার পরে যেন হয়।

তাই হবে।

একটু শিস দিতে দিতে হালকা পায়ে বাসিলোঁ এগিয়ে গেল।

সুপ্রভাত।

মেয়েটা যেমন অবাক তেমনি যেন শিহরিত। বড় বড় নিষ্পাপ চোখে চাইল, তারপর স্মিত হাসি হেসে বলল, সুপ্রভাত।

কী নাম তোমার?

সিসি। তোমার?

বাসিলোঁ। তুমি কি জানো, তুমি ভীষণ সুন্দর?

মেয়েটা যেন ভীষণ লজ্জা পেয়ে খুশির গলায় বলল, ধন্যবাদ।

তোমাকে তো আগে দেখিনি। নতুন নাকি?

মেয়েটা একটু অপ্রতিভ হয়ে বলল, আসলে আমার বাবা এ বাড়ির জ্যানিটার। আমি এখানে থাকি না, প্যারিসে রান্না শিখতে গিয়েছিলাম। ছুটিতে এসেছি। বাবাকে একটু বিশ্রাম দিতেই তার কাজ করে দিচ্ছি।

দুটো হাত ঘষাঘষি করতে করতে বাসিলোঁ বলল, ভাল, ভাল, খুব ভাল কথা।

মেয়েটা হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে বলল, আচ্ছা, তোমরা এখানে বসে আছ কেন? কারও জন্য অপেক্ষা করছ নাকি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওইরকমই কিছু। আচ্ছা, তোমার সঙ্গে কোথায় দেখা হতে পারে? ধরো যদি আজ সন্ধেবেলায় তোমাকে ডিনারে নেমন্তন্ন করি?

মেয়েটা আবার শিহরিত হল আনন্দে। রাঙা হয়ে বলল, সত্যি। উঃ, তা হলে তো ভীষণ মজা হয়। কিন্তু আজ নয়। আজ আমার বিকেলটা আগে থেকেই আর একজনকে দিয়ে রেখেছি।

সে কে?

কোনও বয়ফ্রেন্ড নয়। আমার এক বিধবা নিঃসন্তান বুড়ি পিসি৷ সে মারা গেলে তার সম্পত্তি আমিই পাব। পিসি রাগী মানুষ, তাকে খুশি রাখতেই হবে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। কাল হলেও হবে।

তোমরা দু’জন বুঝি বন্ধু?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা খুব বন্ধু।

ওর নাম কী? বেনভেনুটি। একজন প্রাক্তন হেভিওয়েট বক্সার।

বক্সার? আমি বক্সারদের খুব পছন্দ করি।

বাসিলোঁ একটু হেসে বলল, শুধু বক্সারদের? জানো তো, বক্সারদের মাথা মোটা হয়? আর আমাকে দেখো, দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক।

মেয়েটি খুব লজ্জা পেয়ে বলল, তুমিও ভাল। নিশ্চয়ই খুব ভাল তুমি।

আচ্ছা, আচ্ছা। আমি ভাল কিনা সেটা তো তুমি বিচার করতে পারবেই। কাল সন্ধেবেলা তা হলে?

মেয়েটি ফের যেন লাল হল। বলল, আমার হাতে এখন একটু সময় আছে। তোমাদের দু’জনকে আমি কফি আর কুকি খাওয়াতে পারি।

পারো! কী ভাল কথা! সত্যিই পারো?

হ্যাঁ। এর ঠিক নীচের তলাতেই আমার ঘর।

কেন, তুমি তোমার বাবার সঙ্গে থাকে না?

আমাদের জায়গা হয় না। তাই দোতলায় একটা ছোট ঘর নিয়ে আছি। এসো না, তোমার বন্ধুকেও ডাকো।

একটা হাই তুলে বাসিলোঁ বলল, একটু অসুবিধে আছে। এখানে একজনকে মোতায়েন থাকতেই হবে।

কেন বলো তো!

আমাদের এক বন্ধুর ওপর নজর রাখতে হচ্ছে।

ও, তা হলে থাক।

কেন, থাকবে কেন? আমি তো যেতে প্রস্তুত।

মেয়েটি হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, থাক, পরে হবে।

ওঃ, তুমি তো দেখছি সত্যিই বক্সারদের খুব পছন্দ করো। শোনো, আমি বক্সার না হলেও আমার অন্য বিদ্যে জানা আছে। আমি সার্কাসে খেলা দেখাতাম, জানো? ট্রাপিজের খেলা।

মেয়েটা চোখ বড় বড় করে বলল, তাই!

বাসিলোঁ হাসল, এবার খাওয়াবে কফি?

মেয়েটা একটু দুষ্টু হাসি হেসে বলল, তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে, একা ঘরে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানো বিপজ্জনক। আমার একজন দেহরক্ষী দরকার।

বাসিলোঁ হেসে বলল, বুঝেছি।

তারপর ফিরে সে বেনভেনুটিকে ডেকে বলল, কিছুক্ষণের জন্য একটা কফি ব্রেক নেওয়া যাবে কি?

বেনভেনুটি প্রায় নিরবচ্ছিন্ন সিগারেট খায়। বলল, না।

একটি সুন্দরী মেয়ের সম্মানেও নয়? সিসি তোমাকে খুব পছন্দ করেছে।

কাজটা উচিত হবে না।

আরে ওই ইন্ডিয়ানটা তো নড়াচড়াই করছে না। বোধহয় এখন ঘুমোচ্ছে।

কত কী ঘটে যেতে পারে।

দশ মিনিটে কিছুই ঘটবে না, সাত দিনে যখন ঘটেনি। সিসির বক্সারকে পছন্দ।

বেনভেনুটি গড়িমসি করে উঠল। বলল, দশ মিনিট, তার বেশি নয় কিন্তু।

আরে না। এসো, এর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।

তিনজনে কথা বলতে বলতে নীচের তলায় নামল। মেয়েটি তাদের করিডরের শেষ প্রান্তে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দোতলার সিঁড়ির মুখোমুখি আর একটা ঘরের দরজা খুলে হরিণের পায়ে ওপরে উঠে এল সুধাকর দত্ত। সোজা গিয়ে গোপীনাথের দরজায় টোকা দিয়ে বলল, দরজাটা খুলুন। তাড়াতাড়ি।

গোপীনাথ বাংলা কথা শুনে তাড়াতাড়িই দরজা খুলল।

সুধাকর চাপা গলায় বলল, শিগগির আসুন। পাসপোর্টটা নিয়ে।

কোথায়?

কথা বলার সময় নেই। প্লিজ।

গোপীনাথ পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে এল। সুধাকরের পিছু পিছু দোতলায় নেমে এল সে। সুধাকর তার ঘরের দরজা খুলে গোপীনাথকে প্রায় টেনে ঢুকিয়ে নিল ঘরে। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, এখন আপনি অনেকটা নিরাপদ।

গোপীনাথ বলল, আপনি কে?

সুধাকর হাত তুলে বলল, এসব প্রশ্নের জবাব পরে দেব। আমি কে জেনে আপনার লাভ নেই। শত্রুও হতে পারি, মিত্রও হতে পারি। সমুদ্রে শয়ান যার, শিশিরে কি ভয় তার? আপনার তো মশাই, জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। তাই নয় কি?

গোপীনাথ ক্লিষ্ট একটু হেসে বলল, তা বটে।

বসুন। একটু কফি খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নেবেন?

তা খেতে পারি।

খান মশাই, আপনার এখন অনেক কিছু বলার আছে।

আমার ওপর কিন্তু সারাক্ষণ নজর রাখা হচ্ছে। আপনি যে আমাকে নিয়ে এলেন এটা ওরা টের পাবে না?

এখনই পাবে না। কারণ ওরা আপনার ঘরের দরজাটা শুধু নজরে রাখে, আর আপনি বেরোলে পিছু নেয়, তাই না?

হ্যাঁ।

তা হলে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিন্ত। আপনার ঘরে কি ফোন আছে?

না।

বাঃ চমৎকার।

গোপীনাথ মৃদুস্বরে বলল, করিডরের পাহারাদার দু’জন কোথায় গেল?

কাছেপিঠেই আছে। ওদের কফি খেতে পাঠিয়েছি।

পাঠিয়েছেন? তার মানে কি ওরা আপনার লোক?

না মশাই, না। পাঠিয়েছি মানে কি আর আমার হুকুমে গেছে? টোপ ফেলে সরাতে হয়েছে। এবার কফি খেতে খেতে আপনার সমস্যার কথা বলুন।

সমস্যা! বলে গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, সমস্যা বললে কিছুই বলা হয় না। আমি রয়েছি অন্তিম সংকটের মধ্যে। রামেও মারবে, রাবণেও মারবে।

তবু বলুন।

গোপীনাথ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ থাকল। তারপর ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলল, আপনি একজন বাঙালি। এইসব ঘটনার মধ্যে আপনি কী করে এসে পড়লেন বুঝলাম না। তবু আপনাকে বন্ধু বলে মনে হচ্ছে। তাই বলছি।

গোপীনাথ আদ্যোপান্ত তার সব ঘটনাই সংক্ষেপে বলে গেল।

সুধাকর চাপা গলায় বলল, আপনি এখন কী চান?

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, আপনি আমাকে বাঁচাতে পারবেন না। বাঁচার সম্ভাবনা আমার নেই। শুধু আমার বিষয়সম্পত্তিগুলো যাতে শয়তানদের হাতে না পড়ে এইটেই আমার চিন্তা।

কী করতে চান?

আমার প্রাক্তন স্ত্রীকে অনুরোধ করেছি আমার উত্তরাধিকারী হতে। তিনি রাজি হলে নিশ্চিন্ত হই।

এখনও রাজি হননি?

জানি না। ভায়া মিডিয়া কথা চলছে। একটা টেলিফোন থাকলে জেনে নিতাম।

টেলিফোন? দাঁড়ান।

বলে সুধাকর উঠে গিয়ে একটা কর্ডলেস রিসিভার এনে গোপীনাথের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, এটা স্ক্র্যাম্বলার। ট্যাপ করার ভয় নেই। করুন।

কিন্তু কলকাতায় এখন তো শেষ রাত।

তাতে কী? আপনার বিপদ চলছে। এখন কারও ঘুম ভাঙানো অপরাধ নয়।

গোপীনাথ সুব্রতর নম্বর ডায়াল করল।

সুব্রত, গোপীদা বলছি।

বলুন গোপীদা।

কী খবর? আমার চিঠি পেয়েছিস?

পেয়েছি।

সোনালি কী বলল?

আগে বলুন, আপনি কেমন আছেন?

এখনও মরিনি, বুঝতেই পারছিস।

বিপদ কি চলছে?

হ্যাঁ, ভীষণভাবে। সোনালি কী বলল?

নেগেটিভ।

তার মানে? উনি সম্পত্তি চান না।

বলল?

হ্যাঁ। উনি বললেন, আপনি টাকাপয়সা বিষয়সম্পত্তি নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করেন। এটাই ওঁর অপছন্দ।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, ও।

গোপীদা, আমিও বলি, আপনি এসব নিয়ে ভাবছেন কেন? ওসব ভাবনা ছেড়ে দিন।

গোপীনাথ বলল, ঠিক আছে।

ভাল থাকুন গোপীদা। অল গুড উইশেস।

গোপীনাথ ফোনটা অফ করে মলিন মুখে রিসিভার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ধন্যবাদ।

সুধাকর একটু হাসল, সোনালিদেবী রিফিউজ করলেন বুঝি?

হ্যাঁ।

তা হলে কী হবে?

গোপীনাথ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কে জানে। উড়ে পুড়ে যাক।

সুধাকর হঠাৎ চকিতে উঠে দরজার কাছে গিয়ে কান পাতল। তারপর ফিরে এসে বলল, আপনার পাহারাদাররা ওপরে গেল।

বিবর্ণ মুখে গোপীনাথ বলল, তা হলে কি আমার বিপদ?

না। এখনও নয়। বাঁপাশে একটা ছোট ঘর আছে। সেখানে নতুন পোশাক আর কিছু মেক-আপ আছে। আপনি কি ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারেন?

না।

চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।

ছদ্মবেশে কি কাজ হবে?

অন্তত একটা ঝুঁকি তো নিতেই হবে। আসুন, সময় নেই।

গোপীনাথকে নিয়ে সুধাকর ভিতরের ঘরটায় গেল এবং নিপুণ হাতে তার চেহারার পরিবর্তন ঘটাতে লাগল।

প্রায় আধঘণ্টা বাদে গোপীনাথ আয়নার দিকে চেয়ে নিজেকে একদম চিনতে পারল না। তাকে হুবহু একজন কাফ্রি বলে মনে হচ্ছে।

এবার কী হবে?

সুধাকর মৃদু হেসে বলল, লেট আস টেক এ চান্স। আপনাকে এ বাড়ি থেকে বের করে নিতে হবে। আসুন।

সুধাকরের পিছু পিছু গোপীনাথ বেরিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা দরজা দিয়ে একটি মেয়ে বেরোল অন্য ঘর থেকে।

আপনি মেয়েটার একটা হাত ধরে ধীরেসুস্থে নামুন। তাড়াহুড়ো করবেন না।

ঠিক আছে।

নীচে গাড়ি আছে। কোনও দিকে তাকাবেন না।

গোপীনাথ মেয়েটার হাত ধরে নামতে লাগল। বুক কাঁপছে, পা টলছে। ধরা পড়ে যাবে নাকি গোপীনাথ?

১২.

উমাকান্ত প্রসাদের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মাথাভরতি কাঁচাপাকা চুল। একটু আত্মভোলা কাজপাগল লোক। চোখ দুখানা সবসময়েই যেন অন্তর্গত কোনও চিন্তায় তন্ময় হয়ে আছে। বিহারের লোক এই মানুষটি মনোজ ও রোজমারির অনেকদিনের চেনা। পরিচয় জার্মানিতেই। প্রসাদ বিদেশে থাকা পছন্দ করছিলেন না। দেশে ফেরার প্রস্তাবে উজ্জ্বল সম্মতি দিয়েছিলেন। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের কেমিক্যাল ল্যাব-এর ভার পেয়ে খুব খুশি। প্রসাদের একটাই ছেলে, এখন সে আমেরিকায় পিএইচডি করছে।

সকালে অফিসে এসে প্রসাদের সঙ্গে গভীর আলোচনায় ডুবেছিল মনোজ। একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। মনোজের সন্দেহ হচ্ছে, তাদের তৈরি অ্যালয়টার উদ্দিষ্ট ব্যবহারযোগ্যতা ছাড়াও আরও কিছু উপযোগ আছে। সেটা তারা ধরতে পারছে না। কথাটা তাই নিয়েই।

প্রসাদ মাথা নেড়ে বলল, এই অ্যালয় সোজাসুজি অন্য কাজে লাগানো সম্ভব নয়। তবে কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন ঘটিয়ে হতে পারে। আপনি বলার পর থেকে গত সাতদিন আমি দিনে প্রায় আঠারো-উনিশ ঘণ্টা ধরে নানারকম টেস্ট করেছি। কিছু পাইনি। তবে এও বলছি, টেস্ট আরও অনেক করা যায়।

পারলে আপনিই পারবেন।

আমি শুধু ভাবছি, এটা বুনো হাঁসের পিছনে ছোটা হচ্ছে কি না, সবটাই পণ্ডশ্রম হবে তো। মনোজ মাথা নেড়ে বলল, তা বোধহয় হবে না। এর আর একটা ইউজ নিশ্চয়ই আছে। ঘটনাগুলি অন্তত তারই সাক্ষী দেয়।

প্রসাদ গম্ভীর মুখ করে বলে, আদ্রেঁর মৃত্যুর কথা বলছেন?

সেটা অনেক ঘটনার মধ্যে একটা।

মুখে আপশোসের একটা চুকচুক শব্দ করে প্রসাদ বলল, এ গ্রেট লস। আদ্রেঁ ওয়াজ এ জিনিয়াস।

আপনি কি ওকে চিনতেন? বলেননি তো কখনও!

চিনতাম। তবে ডেলিগেটদের মধ্যে যে সেও আছে তা জানতাম না। যেমন সেও জানত যে, আমি এই কোম্পানিতে কাজ করি।

আপনি কি জানেন যে, আদ্রেঁর ডেডবডি নিয়ে গিয়ে রোমে একটা অটোপসি করা হয়েছে। এ ভেরি সফিস্টিকেটেড টেস্ট। তাতে ধরা পড়েছে যে, হি ওয়াজ পয়জনড।

তাও শুনেছি। রোজমারি বলেছেন। ঘটনা কি আরও আছে?

আছে। সাক্কি ইনকরপোরেটেড তাদের অর্ডার বহু গুণ বাড়াতে চাইছে। তার পিছনে অন্য মতলব? ঠিক তাই। সাক্কি যা নেয় এ প্রায় তার দশ গুণ। খবরটা ব্যাবসার পক্ষে নিশ্চয়ই ভাল, কিন্তু আরও ভাল হয় যদি আমরা তাদের মতলবটা বুঝতে পারি এবং তাদের আগেই জিনিসটা তৈরি করে বাজারটা ধরে ফেলি।

ওয়াইজ অব ইউ।

সেইজন্যই আপনাকে খাটাচ্ছি।

প্রসাদ মৃদু হেসে বলল, খাটতে আমার কোনওদিনই আপত্তি নেই। কাজ তো আমি ভালইবাসি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার চেয়েও অনেক বড় এক্সপার্ট ছিল আদ্রেঁ।

তা তো ঠিকই। কিন্তু আদ্রেঁ আমাদের নাগালের বাইরে।

প্রসাদ একটু ভাবল। তারপর বলল, আর একজন আছে।

সে কে? তার নাম গোপীনাথ বসু।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নাম শুনেছি। কিন্তু তিনি তো আদ্রেঁর লাইনের লোক নন।

প্রসাদ মাথা নেড়ে বলল, না। তবে গোপীনাথ হ্যাজ ইনমেনন্স কোয়ালিটিজ। আরও একটা কারণ হল, সে আদ্রেঁর বন্ধু।

আপনি এত সব জানলেন কী করে?

আদ্রেঁ আমার বন্ধু। গোপীনাথও আমার খুব চেনা। তারা দুজনেই সাক্কিতে কাজ করত। ইন ফ্যাক্ট, সাক্কিতে আদ্রেঁকে ঢুকিয়েছিল গোপীনাথই। বিশাল কোম্পানি, অনেক প্রোজেক্ট।

জানি। আমরা সাক্কির সঙ্গে বিজনেস করি, আপনি কি তা জানেন না?

প্রসাদ মাথা নেড়ে বলে, আমি ল্যাব নিয়ে পড়ে থাকি, বিজনেসের খবরে আমার ইন্টারেস্ট নেই। তবে গোপীনাথ বসুর সঙ্গে যদি যোগাযোগ করতে পারেন, হি মে বি অব সাম হেলপ।

গোগাপীনাথ কি সাক্কির গোপন প্রোজেক্টের খবর আমাদের দেবে?

প্রসাদ একটু ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, না। তবে হয়তো একটা হিন্ট দিলেও দিতে পারে। ওয়ান হিন্ট উইল বি এনাফ ফর মি। আমি অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছি। কী করতে চাইছি তাই তো জানি না।

মনোজ ভ্রু একটু কুঁচকে রইল কিছুক্ষণ। তারপর অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমিও জানি না। আপনি কি গোপীনাথবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন?

প্রসাদ একটু হাসল, দেয়ার ইজ এ ওয়ে। কিন্তু সেটা কতটা প্র্যাক্টিকেবল হবে জানি।

কী বলুন তো!

আপনার পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট মিস সোম গোপীনাথের এক্স ওয়াইফ।

মনোজ অবাক হয়ে বলে, তাই নাকি? তা হলে তো বলেই মনোজ টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াচ্ছিল।

প্রসাদ হাত তুলে মৃদু হেসে বলল, ডোন্ট বি হেস্টি।

লেট আস আস্ক হার।

প্রসাদ মাথা নেড়ে বলল, ওদের সম্পর্কটা এখন ভীষণ সেনসিটিভ। কেউ কারও নাম শুনতে পারে না।

তা হলে?

মিস সোম আপনাকে হেল্প করবেন না। তবে শি মে গিভ আস দি টেলিফোন নাম্বার অব গোপীনাথ। কিন্তু ও কাজটা আমিই করব।

মনোজ বলল, ঠিক আছে।

প্রসাদ মৃদু হেসে উঠল। বলল, গোপীনাথ যদি ভাইট্যাল হিন্টটা নাও দেয় তা হলেও আমি হাল ছাড়ছি না। চিন্তা করবেন না।

আচ্ছা। থ্যাঙ্ক ইউ।

প্রসাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, যদি একটা অত্যাধুনিক ল্যাব এবং যন্ত্রপাতি পেতাম তা হলেও না হয় হত। আমাদের ল্যাব তো তেমন সফিস্টিকেটেড নয়।

মনোজ গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছেন। তবু যতদূর যা করা যায়। তারপর দেখা যাবে।

প্রসাদ চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল মনোজ। একটু অবাক লাগছে। সোনালি গোপীনাথ বসুর স্ত্রী! কী আশ্চর্য। গোপীনাথ মস্ত মানুষ। জিনিয়াস।

সোনালি এল আরও আধ ঘণ্টা পরে। কয়েকটা জরুরি চিঠিপত্র সই করাতে।

সইগুলো করে দিয়ে মনোজ হঠাৎ বলল, মিস সোম। বসুন। একটু কথা আছে।

সোনালি হয়তো অবাক হল। তবু বসল।

মনোজ ভদ্রতা বজায় রেখে আড়চোখে সোনালির মুখখানা লক্ষ করে নিল। মুখখানা ঠিক স্বাভাবিক নয়। এমনিতেই সোনালির মুখটা বেশ গম্ভীর। তার ওপর এখন একটা বিষাদের ভাব যেন যুক্ত হয়েছে।

প্রসাদ সাবধান করে দিয়ে গেছে, তবু মনোজ কথাটা উত্থাপনের লোভ সামলাতে পারল না। একটু দ্বিধা ও দোলাচলের পর বলল, মিস সোম, আমি যদি দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করি তা হলে কি কিছু মনে করবেন?

সোনালি একটু অবাক হয়ে বলল, কী কথা?

একটু পারসোনাল।

পারসোনাল?

মানে রিগার্ডিং এ পার্সন।

পার্সনটি কে?

গোপীনাথ বসু।

হঠাৎ তার কথা কেন?

মনোজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, উই আর ইন এ জ্যাম। সর্ট অব জ্যাম। আমাদের প্রোডাকশন কিনে নিয়ে কেউ অন্যরকম কিছু কাজ করছে।

ও। কিন্তু এসবের সঙ্গে তো আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

হয়তো একটু আছে। কিন্তু সে-কথা পরে। আমাদের সমস্যাটার কথা একটু বুঝে দেখুন। আমাদের ধারণা হয়েছে এই অ্যালয় থেকে কেউ আরও কোনও একটা প্রফিটেবল জিনিস তৈরি করছে। সেটা করছে সাক্কি।

সোনালি গম্ভীর থেকে গম্ভীরতর হয়ে যাচ্ছিল। বলল, কিন্তু আমি কী করতে পারি?

এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করতে পারত আদ্রেঁ। ইন ফ্যাক্ট, কাজটা সে-ই করছিল। কিন্তু আদ্রেঁ এখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আদ্রেঁ ছাড়া আর যে পারে সে হল গোপীনাথ বসু।

সোনালি হঠাৎ শুকনো মুখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারি না।

মনোজ অপ্রতিভ হয়ে বলল, আই অ্যাম সরি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম—

সোনালি সামান্য হাঁফ-ধরা গলায় বলল, দেখুন, আমি অফিসিয়াল কাজকর্মের বাইরে যেতে চাই না।

মনোজ বেকুবের মতো চেয়ে রইল। প্রসাদের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করাটা মস্ত ভুল হয়ে গেল হয়তো। বড্ড বোকা বোকা লাগল নিজেকে।

সোনালি বলল, আর কিছু বলবেন?

না না। আপনাকে ডিস্টার্ব করেছি বলে ক্ষমা করবেন।

সোনালি আর একটাও কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেল।

মনোজ ঘটনাটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য এক কাপ কফি খেল। তারপর কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

বিকেলের দিকে পিআরও সুব্রতর একটা ফোন এল।

স্যার, একটু আসতে পারি?

এসো।

সুব্রত এল। ছেলেটিকে মনোজের বেশ পছন্দ। স্মার্ট, চটপটে, হাসিখুশি। বসে হাসিমুখে বলল, আপনি কি কারও সম্পর্কে কোনও ইনফর্মেশন চান?

বুঝতে না পেরে মনোজ বলল, কার কথা বলছ?

সুব্রত সামান্য দ্বিধা করে বলল, শুনলাম আপনি গোপীনাথ বসুর ইনফর্মেশন চাইছেন।

মনোজ বলল, চাইছিলাম। কিন্তু তোমাকে কে বলল?

মিস সোম।

মনোজ অবাক হয়ে বলে, মিস সোম। আশ্চর্য! উনি তো মনে হল, গোপীনাথ প্রসঙ্গে অসন্তুষ্টই হলেন।

সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, শি হ্যাজ হার গ্রাজ।

তা তুমি কী জানো?

আমি বলতে এসেছি যে, গোপীনাথ বসু টেলিফোনে অ্যাভেলেবল নন।

কেন, ওঁর টেলিফোন নেই?

আছে। কিন্তু উনি একটা ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আছেন।

তুমি কী করে জানলে?

গোপীনাথ বসুকে আমি ছেলেবেলা থেকে চিনি আর দাদা বলে ডাকি।

ওঃ, দ্যাটস গুড। কিন্তু বিপদের কথা কী বলছিলে?

উনি একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন। আপাতত, ওঁর প্রাণসংশয়।

মনোজ একটু ভাবল। গোপীনাথ বসুকে সে ব্যক্তিগতভাবে চেনে না, সুতরাং তার বিপদে বিচলিতও সে হচ্ছিল না। সে বলল, বিপদটা কীরকম এবং কেন তা জানো?

খানিকটা জানি। ভিকিজ মব নামে একটা গুন্ডার দল ওঁকে চেজ করছিল। তারপর সাক্কির কর্তারাও ওঁর পিছনে মাফিয়া লাগিয়েছে।

কিন্তু কেন?

কারণ হল আদ্রেঁর মৃত্যু এবং তার গবেষণার কাগজপত্র। গোপীদা সেগুলো নিরাপদে রাখতে গিয়ে উলটে বিপদে পড়ে গেছেন।

মনোজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বেঁচে আছেন কি না জানো? যেরকম গুন্ডার কথা বলছ তাতে তো মনে হচ্ছে মর্টাল ডেনজারের মধ্যে আছেন।

হয়তো তাই।

মনোজ কাধ একটু ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি আমার হয়ে সোনালিকে বোলো যে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করেছি বলে আমি দুঃখিত।

ঠিক আছে স্যার, বলে দেব।

সুব্রত চলে যাওয়ার পর ঘড়ি দেখে মনোজ তার ফোন তুলে নিয়ে সোজা রোমের একটা নম্বর ডায়াল করল নোটবই দেখে।

কিছুক্ষণ পর একটা গমগমে গলা ফোনে ভেসে এল, হ্যালো… হ্যালো…হ্যালো…

মনোজ একটু হাসল। জার্মান ভাষায় বলল, গলাটা নামাও মার্ক।

মার্ক বলল, আরে সেন নাকি? কী খবর?

খবর ভাল নয়। আমাদের একটা বাজে সময় যাচ্ছে।

সেরকম তো সকলেরই হয়। ও কিছু নয়।

শোনো, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।

বলে ফেলো।

তুমি সাক্কির একজন মস্ত কর্তা। খবরটা তোমার জানা উচিত।

কী খবর?

তোমাদের একজন সায়েন্টিস্ট আছে, গোপীনাথ বসু। চেনো?

কে না চেনে? সবাই চেনে। বিগ ম্যান।

তার কী খবর?

কেন, খবর তো ভালই হওয়ার কথা।

সে কি অফিসে আসে?

এক মিনিট ধরে থাকো। খবর নিয়ে বলছি।

মনোজ ধরে রইল।

একটু বাদে মার্ক বলল, না আসেনি আজ।

গতকাল কি এসেছিল?

না। মনে হচ্ছে ছুটি নিয়ে কোথাও গেছে। ওর বাড়িতে রিং করে দেখতে পারো।

তাতে লাভ নেই। তুমি আরও একটু খোঁজ নাও। আমি বাড়ি যাচ্ছি। রাতে আমাকে আমার বাড়িতে ফোন করে খবরটা জানাও জরুরি।

ঠিক আছে।

মনোজ তার কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়ল। বাড়িতে ফিরে ডিনার খেয়ে নিল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল।

রাত প্রায় দশটা নাগাদ মার্কের ফোন এল।

কী জানতে চাও?

মনোজ বলল, সবকিছু।

সবকিছু আমি জানি না। তবে আমি অফিশিয়াল সোর্সে খবর নিয়ে জেনেছি যে, সে বাড়িতে নেই, অফিসে আসছে না।

আনঅফিসিয়ালি কী জানো?

সেটা তোমাকে আনঅফিশিয়ালি বলছি। লোকটা খুব সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে ছিল।

ছিল? পাস্ট টেন্স?

তাঁ। পাস্ট টেন্স। আমার সঙ্গে রোমের আন্ডারওয়ার্ল্ডের যোগাযোগ আছে। আমি তাদের কাছে জেনেছি, মিস্টার বোস অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে একটা প্রায় অসম্ভব অবস্থা থেকে পালিয়ে গেছে। নইলে মাফিয়া আর ভিকিজ মব তাকে প্রায় শেষ করে এনেছিল।

মাই গড! পালাল কীভাবে?

বোধহয় কারও সাহায্যে। আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। জানি না।

তোমাকে ধন্যবাদ। শোনো, গোপীনাথ বসুকে আমার খুব দরকার। কোনও খবর পেলে জানাবে?

জানাব। তবে সে বোধহয় সাক্কিতে ফিরবে না। সেটা সম্ভব নয়। সাক্কি চারদিকে ওকে খুঁজছে। এটাও আনঅফিশিয়াল।

১৩.

রুমিং হাউস থেকে বেরিয়ে এসে যখন সামনের চাতালে একটা লাল টুকটুকে ছোট্ট স্পোর্টস কারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল গোপীনাথ, তখন তার বাঁ হাত ধরে যুবতীটি বারবার ঢলে পড়ছে তার গায়ে, ভীষণ মজার কথা বলছে এবং হাসছে। তারও হাসা এবং কিছু কথা বলা উচিত। কিন্তু গোপীনাথ কিছুতেই হাসতে পারছে না।

গোপীনাথ ভিতু নয়। বরং অত্যন্ত সাহসী। কিন্তু গত কয়েক দিনের কিছু ঘটনা তার ভিতরটাকে একেবারে নির্জীব করে ফেলেছে। আদ্রেঁর মৃত্যু এবং তার কাজকর্ম সম্পর্কে সাক্কির অতি-উৎসাহ। তার ওপর সোনালির শীতল প্রত্যাখান। গোপীনাথের ভিতরে একটা ভাঙচুর হয়েই গেছে। তাই সে যেন নিজের বশে ছিল না। যুবতীটি যথেষ্ট ভাল অভিনয় করছিল, কিন্তু গোপীনাথ পারছিল না। সে এর সঙ্গে কেন যাচ্ছে, কেন এরা তাকে ছদ্মবেশ পরিয়েছে কিছুই সে বুঝতে পারছিল না। সে তাই অভিনয়ও করছিল না।

চাতালটা স্বাভাবিক। দু-চারটে গাড়ি পার্ক করা। দু-চারজন লোক এধারে ওধারে। কোনও অস্বাভাবিকতা নেই।

মেয়েটা গাড়ির দরজা খুলল। গোপীনাথ বাকেট সিটে বসে পড়ল নির্বিকারভাবে। মেয়েটা স্টিয়ারিং ধরে বসল। খুব স্বাভাবিকভাবেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ধীর গতিতে ফটক পেরিয়ে বা ধারের রাস্তা ধরল।

গোপীনাথ ইতালিয়ান ভাষায় জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

কোথাও যাচ্ছি। চুপ করে থাকো।

তুমি কে?

লুসিল।

তুমি কার লোক?

তার মানে?

ও লোকটা কে?

লুসিল একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার বস।

লোকটা বাঙালি?

হ্যাঁ।

বস মানে কী? তোমরা কি সরকারি লোক?

না।

তা হলে তোমরা আসলে কারা?

সে কথা বস হয়তো তোমাকে কখনও বলবে। এখন চুপ করে থাকো। আমার মনে হচ্ছে, একটা গাড়ি আমাদের পিছু নিয়েছে।

গোপীনাথ আয়নার দিকে চেয়ে বলল, কোন গাড়িটা?

একটা কালো সিত্রঁন।

গোপীনাথ কিছুক্ষণ গাড়িটাকে লক্ষ করল আয়নায়। মেয়েটা কয়েকটা মোড় ফিরল ইচ্ছে করেই। গাড়িটা লেগে রইল পিছনে। গোপীনাথ মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, হ্যাঁ, গাড়িটা পিছু নিয়েছে। তুমি কি পারবে ওটাকে ঝেড়ে ফেলতে?

মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর। লম্বাটে, মেদহীন, নমনীয় চেহারা। ব্যালেরিনার মতো দেখতে। মুখখানাও বেশ সুন্দর। কিন্তু এসব ব্যাপারে কতখানি দক্ষ তা বোঝা যাচ্ছে না। গোপীনাথ বলল, শোনো সুন্দরী লুসিল, অত বেশি পাক খেয়ো না। তা হলে ওরা জানতে পারবে যে তুমি ওদের অস্তিত্ব টের পেয়েছ।

তা হলে কী করতে হবে?

স্বাভাবিক গতিতে চালাও। টাইবার নদীর দিকে চলল। ওদের বুঝতে দাও, আমাদের পালানোর কিছু নেই।

মেয়েটা মৃদু একটু হেসে বলল, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। তোমাকে ওই জয়েন্ট থেকে বের করে আনতে আমাদের অনেক মেহনত আর ঝুঁকি গেছে। একটা বোকামির ফলে ঘটনাটা কেঁচে গেলে সর্বনাশ।

কিন্তু তুমি গাড়িটা নাটকীয়ভাবে চালিয়ো না। যে-কোনও একটা রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ চালাও। তোমার যদি ব্যাক আপ থেকে থাকে তবে কার-টেলিফোনে তাকে খবর দাও। যদি গাড়ি সুইচ করার ব্যবস্থা থাকে, তবে ভালই। না হলে একটু মুশকিল আছে। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে দু-তিনটে গাড়ির ব্যবস্থা রাখা ভাল।

মেয়েটা একবার গোপীনাথের দিকে চেয়ে নিয়ে বলল, তোমার কি এরকম সিচুয়েশন হ্যান্ডেল করার অভিজ্ঞতা আছে?

গোপীনাথ ম্লান একটু হেসে বলল, আমি নিরীহ একজন প্রযুক্তিবিদ মাত্র। আমি বিপজ্জনক জীবন যাপন করি না। তবে এরকম কয়েকটা বিপদে আমাকে পড়তে হয়েছে। শোন, রোম আমার ভীষণ চেনা শহর। তুমি স্টিয়ারিং আমার হাতে দাও। হয়তো তোমার চেয়ে আমি সিচুয়েশনটা একটু বেশি সামাল দিতে পারব।

কীভাবে সামাল দেবে? তোমার ইগো তো খুব স্ট্রং দেখছি।

ইগো নয়। অস্তিত্বের সংকট থেকে আমি কিছু বেশি দক্ষতার অধিকারী।

তুমি চুপ করে বসে থাকো। এটা তোমার মাথা ঘামানোর বিষয় নয়। তুমি অতিথি।

তারা রোমের প্রধান সড়কগুলিতেই মাঝারি গতিতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। একটু পিছনে সিত্রঁন গাড়িটা। সামনের সিটে দু’জন কালো সুট পরা লোক বসে আছে। দু’জনেরই কালো টুপি কপাল পর্যন্ত ঢাকা। দু’জনেরই চোখে কালো চশমা।

গোপীনাথ বলল, তুমি বোধহয় তেমন ভয় পাওনি।

আমি অকারণে ভয় পাই না।

অকারণে?

এখন পর্যন্ত তো তাই। ওরা পিছু নিয়েছে, কিন্তু এখনও অবধি তোমাকে ছিনতাই করার তো চেষ্টা করেনি।

করলে?

দেখা যাবে।

লুসিল, আমার একটু টয়লেটে যাওয়া দরকার।

টয়লেট! মাই গড!

খুবই দরকার।

দাঁড়াও দাঁড়াও, এখন টয়লেটে যাওয়া মানেই হল—

প্লিজ! কতগুলো ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক চলে না।

বুঝতে পারছি।

মেয়েটা হঠাৎ বাঁ ধারে একটা রাস্তায় গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিল। বলল, তুমি কোনও ফন্দি করছ নাকি?

না। আমার যা অবস্থা, ফন্দি করে লাভ নেই।

একটা ছোট হোটেলের চত্বরে গাড়িটা ঢুকিয়ে দিল লুসিল। বলল, চলো।

গোপীনাথ গম্ভীর মুখে নামল। তার বাথরুম পায়নি এবং সে সত্যিই একটা প্ল্যান করেছে। সেটা কতদুর ফলপ্রসূ হবে তা সে জানে না।

লুসিল তাকে সোজা রিসেপশনের পিছনে টয়লেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, পালানোর চেষ্টা করবে না তো! করে লাভ নেই। এটা আমার কাকার হোটেল। চারদিকেই আমাদের লোক।

গোপীনাথ মৃদু হেসে বলল, তোমার মতো সুন্দরীকে ছেড়ে পালায় কোন আহাম্মক?

টয়লেটে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল গোপীনাথ। বাস্তবিক সে কোথায় যাবে এবং কী করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। কিন্তু তার মনে হচ্ছে–কিংবা বলা যায় মনের মধ্যে একটা অস্পষ্ট অস্বস্তি হচ্ছে–সে আর একটা জালে জড়িয়ে পড়ছে না তো?

টয়লেটের আয়নায় নিজের ছদ্মবেশে ঢাকা চেহারাটা দেখে সে একটু আঁতকে উঠল। এরকম অদ্ভুত ছদ্মবেশ তাকে কেন পরানো হল কে জানে? এরকম ছদ্মবেশ বরং লোকের দৃষ্টি বেশিই আকর্ষণ করে। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল গোপীনাথ। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ঘুরে চেয়ে অবাক হয়ে দেখল, একটা বেঁটে এবং স্বাস্থ্যবান ইতালিয়ান যুবক তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

গোপীনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, কী চাও?

তুমি একটু বেশি সময় নিচ্ছ।

তাতে কী? আমার কোথাও যাওয়ার তাড়াহুড়ো নেই। তুমি কে?

আমি লুসিলের জ্ঞাতি ভাই। আমরা তোমাকে পালাতে সাহায্য করছি।

গোপীনাথ একটা শ্বাস ফেলে বলল, তা হয়তো করছ, কিন্তু তোমাদের সব কাজই কাঁচা এবং অ্যামেচারিশ। আমাদের ফলো করে এসেছে একটি সিত্রঁন গাড়ি, লুসিল সেটাকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। তার ওপর কোথাও গাড়ি সুইচ করার ব্যবস্থা রাখেনি। আমাকে এরকম কাফ্রি সাজানোরই বা মানে কী?

ওসব আমরা জানি না। আমাদের যা করতে বলা হয়েছে আমরা তা অক্ষরে অক্ষরে করেছি।

এই অপারেশনটা করাচ্ছে কে?

আমাদের বস।

তোমরা কারা?

হয়তো তোমার বন্ধু।

গোপীনাথ কাঁধ ঝাঁকাল। বলল, নির্বোধের বন্ধুত্বের চেয়ে বুদ্ধিমানের শত্রুতাও ভাল। তোমরা আমাকে বের করে এনেছ কি খোলা ময়দানে খুনির সামনে এগিয়ে দেওয়ার জন্য?

আমাদের বস যদি তাই চান তবে তাই হবে।

তোমাদের বসের সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার। কে তোমাদের বস?

বিগ ম্যান। এখন চলে এসো, আমাদের অনেক জায়গায় যেতে হবে।

গোপীনাথকে নিয়ে ছেলেটা বেরিয়ে এল। বাইরে মেয়েটা রিসেপশনের চেয়ারে বসে মন দিয়ে কিছু নোট করছে। একবার চোখ তুলে তাকাল। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ভয় পেয়েছ নাকি?

না। তবু দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

মেয়েটি হেসে বলল, ওই সিত্রঁন গাড়িটা ওখানে পার্ক করা আছে। ওতে যারা ছিল তারা আমাদেরই লোক। ব্যাক আপ কথাটা বোঝো। ওরা হল আমাদের ব্যাক আপ। এখন ওরা। ডাইনিং হলে বসে কফি খাচ্ছে।

গোপীনাথ একটু বেকুব হয়ে গেল। বলল, এরপর আমরা কোথায় যাব?

সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত এই হোটেলেই একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে।

গোপীনাথ একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বলল, বাঁচা গেল। এবার কি আমি আমার মুখের মেক-আপ তুলতে পারি?

পারো। কিন্তু জানালা দিয়ে বেশি উকিঝুঁকি মেরো না। তোমার খোঁজখবর হচ্ছে। জুতো জামা পরেই থেকো, যে-কোনও সময়ে পাঁচ মিনিটের নোটিসে রওনা হতে পড়তে পারে। লুইজি, বোসকে তার ঘরে নিয়ে যাও।

লুইজি হল বেঁটে ছেলেটা। গোপীনাথকে লিফটে করে চারতলায় এনে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে গেল, রুম সার্ভিস চালু আছে। খাবার বা পানীয় ঘরেই আনিয়ে নিয়ো। ঘরের বাইরে না যাওয়াই নিরাপদ। আর হ্যাঁ, এ ঘরে কিন্তু টেলিফোন নেই। শুধু ইন্টারকম।

গোপীনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, কেন নেই?

নিরাপত্তার কারণে। টেলিফোন কল ট্রেস ব্যাক করা যায়। ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী?

গোপীনাথ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। বাথরুমে গিয়ে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে মেক আপ তুলল। জামাকাপড় বদলানোর উপায় নেই। তাই ঘরের বিছানায় জামাকাপড় সমেত শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, ওই বাঙালিটি নিছক তাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য এতটা ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করে এনেছে। বরং এর পিছনে আর একটা চক্র যে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে তাতে সন্দেহ নেই। এত তাড়াতাড়ি সবাই স্বার্থের গন্ধ কী করে টের পেয়ে গেল তা বুঝতে পারছে না গোপীনাথ।

কিন্তু এই গণ্ডিবদ্ধ জীবনটাও তার ভাল লাগছে না। তাকে ঘিরে, তাকে নিয়ে কিছু ঘটনা ঘটছে যেগুলোর ওপর তার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। এটাই বা সে মেনে নেবে কী করে?

ঘণ্টাখানেক বাদে সে রুম সার্ভিসকে ডাকল ইন্টারকমে। বেশ রাজসিক একটা লাঞ্চের অর্ডার দিল। যতদূর সম্ভব এদের ঘাড় ভাঙা যাক।

লাঞ্চ আসতে সময় লাগল প্রায় চল্লিশ মিনিট। সত্যিই এলাহি লাঞ্চ। তিনজন ওয়েটার তিনটে ট্রে-তে বয়ে আনল। ইতালিয়ান আর ফরাসি খাবার।

গোপীনাথ খেল। ফেললও অনেক। এত খাওয়া একজনের পক্ষে তো সম্ভব নয়।

লাঞ্চের পর সে একটু ঘুমিয়ে নিল। ঘুমের মধ্যে সে নানা ধরনের অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। স্বপ্নগুলোর কোনও মানে হয় না। অসংলগ্ন প্রলাপের মতো।

সন্ধের পর দরজায় টোকা পড়ল। সাড়া দিতেই লুইজি এল ঘরে। তার হাতে একটা সুটকেস।

এটা কী?

তোমার জিনিসপত্র। সবই নতুন কেনা হয়েছে।

গোপীনাথ অবাক হল। এরা তার পিছনে যথেষ্ট খরচ করছে। পরে সুদে আসলে তুলবে বোধহয়।

লুইজি সুটকেসটা বিছানায় রেখে ডালা খুলে দিয়ে বলল, দেখে নাও। পাজামা-সুট থেকে শুরু করে সবকিছু আছে। শেভিং সেট, কোলন, সবকিছু।

ধন্যবাদ। রুমিং হাউসে আমার অনুপস্থিতি কি ধরা পড়েছে?

যতদুর জানি, এখনও কেউ টের পায়নি। ল্যান্ডিং-এর পাহারা বদল হয়েছে। তবে বেশিক্ষণ আর নয়। টের পেল বলে।

আজকাল পেশাদার গুন্ডারা এত অসাবধানি হয়, জানা ছিল না।

লুইজি একটু হাসল। বলল, আমাদের চালাকিটা এতই ছোট আর সাধারণ যে, ওরা এরকম ঘটতে পারে বলে ভাবতেই পারেনি। বাই দি বাই, তুমি কি বেনভেনুটিকে চেনো?

কে বেনভেনুটি?

তোমাকে যে দু’জন পাহারা দিচ্ছিল তাদের একজন।

সে আসলে কে?

বেনভেনুটি একসময়ে দুরন্ত বক্সার ছিল। অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর প্রাইজ ফাইটিং-এও দুনিয়া কাপিয়ে দিয়েছিল।

বক্সিং! ওঃ হ্যাঁ, নামটা শুনেছি বটে।

আমি ওর খুব ফ্যান। দুঃখের বিষয়, বেনভেনুটি এখন একজন মাফিয়া ডনের হয়ে গুন্ডামি করে বেড়ায়। প্রতিভার কী অপচয়।

গুন্ডামি করে কেন?

কপাল। রোমের একটা নাইট ক্লাবে মারপিট করে একটা লোককে খুন করে বসেছিল। জেল তো হতই, ফাঁসিও হতে পারত। সেই সময় বেনভেনুটি ডনের কাছে আশ্রয় নেয়। বক্সিং আর পারত না। তবে গুন্ডামিটাই এখন ওর রুজি রোজগার।

তুমি কি ওর খুব ভক্ত?

লুইজি হাসল, খুব। আমিও বক্সার। যে-কোনও বক্সারই জানে বেনভেনুটির মধ্যে কী সাংঘাতিক সম্ভাবনা ছিল। আমাদের স্বপ্নের মানুষ। তোমার সৌভাগ্য যে ওরকম একটা লোক তোমায় পাহারা দিচ্ছিল।

বেনভেনুটি কার হয়ে কাজ করছিল জানো?

না। তবে ও ভিকিজ মব-এর লোক নয়।

তা হলে কি সাক্কির?

হলেও হতে পারে।

লুইজি, আমি অনেক কিছুই জানি না। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

করো।

সকালে একজন বাঙালি আমাকে উদ্ধার করে। সে কে?

লুইজি অবাক হয়ে বলে, ও তো দাতা।

দাতা!

হ্যাঁ। ওই তো দাতা। আমাদের বস।

১৪.

শুভ আর মৈত্রেয়ী এয়ারপোর্টে ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আজ রোজমারি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরবে।

রোজমারি প্রায়ই সিঙ্গাপুর যায়। ওখানে ওর এক বোন থাকে, তার স্বামী আন্তর্জাতিক কোম্পানির কর্মকর্তা। বোনও ওই কোম্পানিরই একজিকিউটিভ। সিঙ্গাপুরে রোজমারির কিছু কেনাকাটাও থাকে। মাসে বা দু’মাসে একবার কয়েক দিনের জন্য তার সিঙ্গাপুরে যাওয়া চাই-ই।

শুভ বলছিল, আচ্ছা, রোজমারি দুনিয়ার সব বড় শহরেই তো যায়, তবু সিঙ্গাপুর ওর এত প্রিয় কেন বলো তো!

মৈত্রেয়ী বলল, কে জানে বাবা, আমার তো মনে হয় ওর বোনের বাচ্চাকে বোধহয় ভালবাসে, নিজের তো নেই। তাই ঘনঘন বোনের কাছে যায়।

যাঃ, ওটা কোনও কারণ হতে পারে না। একটা বাচ্চাকে ভালবাসে বলেই দু’দিন পর পর এক কাঁড়ি টাকা গচ্চা দিয়ে এত দূর যায় কখনও?

সিঙ্গাপুর আর কী এমন দূর। আর টাকাটা আমাদের হিসেবে অনেক হলেও রোজমারির কাছে কিছুই নয়। ওর বোনপোটাকে খুব ভালবাসে রোজমারি। গতবার খ্রিসমাসে এসেছিল, কী ফুটফুটে দেখতে। খুব চটকাতে ইচ্ছে করছিল।

আমার মনে হয় বাচ্চা ছাড়াও অন্য কারণ আছে।

আছেই তো। মার্কেটিং। সিঙ্গাপুর থেকে কত কী নিয়ে আসছে প্রতি মাসে।

শুভ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, দেখো মৈত্রেয়ী, রোজমারির অনেক টাকা। কিন্তু কখনও বেহিসেবি নয়। রোজমারি কখনও কোনও ফ্যান্সি সেন্টিমেন্টের জন্য টাকার অপচয় করবে না। আমি রোজমারিকে কৃপণ বলছি না, কিন্তু ভীষণ হিসেবি।

তোমার অত মাথা ঘামানোর দরকার কী? তুমি তো আর গোয়েন্দা নও। বেশ করে সিঙ্গাপুরে যায়। এর পরের বার আমাকেও সঙ্গে নেবে বলেছে।

তাই বলো! সেইজন্যই রোজমারির পক্ষ নিচ্ছ। কিন্তু কথাটা একটু ভেবে দেখো।

আচ্ছা, একজন মানুষ ঘনঘন সিঙ্গাপুর যায়–এর মধ্যে ভেবে দেখার কী আছে বলো তো! তুমি একটু বেশ অদ্ভুত আছ কিন্তু।

শুভ একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ স্বগতোক্তির মতো করে বলল, ভাগ্যিস তুমি বক্কেশ্বরের কথা জানো না।

মৈত্রেয়ী ভ্রু কুঁচকে বলল, বক্কেশ্বর। সেটা আবার কে?

একটা বেঁটে মতো লোক। বেশ ফরসা আর টাইট চেহারা। খুব স্মার্ট।

সে আবার কে?

সে-ই বক্কেশ্বর।

তার মানে?

শুভ একটুও না হেসে বলল, গত চারবার লোকটাকে লক্ষ করেছি।

কোথায় লক্ষ করেছ?

শুভ বলল, আমার ভিতরে বোধহয় একজন ন্যাচারাল গোয়েন্দা আছে। লক্ষ করা এবং ডিডিউস করা আমার ভীষণ প্রিয় পাসটাইম।

থাক, আর নিজের সম্পর্কে অত সার্টিফিকেট দিতে হবে না। লোকটা কে?

তার আমি কী জানি।

এই যে বললে বক্কেশ্বর!

ওঃ, নামটা আমিই দিয়েছি। কেন যে লোকটাকে দেখলেই আমার বক্কেশ্বর নামটা মনে আসে।

কিন্তু লোকটাকে নিয়ে ভাবছ কেন?

ভাবছি কে বলল? আমি ভাবছি রোজমারিকে নিয়ে।

তা হলে বক্কেশ্বরবক্কেশ্বর করছ কেন?

গত চার মাসে রোজমারি যতবার সিঙ্গাপুরে গেছে ততবারই একই ফ্লাইটে বক্কেশ্বরও গেছে।

মৈত্রেয়ী প্রথমটায় একটু অবাক হলেও সামলে নিয়ে হাসল। সে বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে। বলল, গত চার মাসে রোজমারি সিঙ্গাপুর গেছে মোট তিনবার।

তিনবার?

পাক্কা হিসেব। চার মাসে তিনবার সিঙ্গাপুরে যাওয়াটা বড় কথা নয়। সিঙ্গাপুরে আরও অনেকেই আরও বেশি ঘনঘন যায়। অনেকেরই বিজনেস ইন্টারেস্ট আছে। আমাদের এক কাকু আছেন, যিনি প্রতি সপ্তাহে হংকং যান। বুঝেছ?

হ্যাঁ। এটা আমার মাথায় খেলেনি।

সুতরাং তোমার গোয়ন্দাগিরিটা জলে গেল।

তুমি বলছ বক্কেশ্বরও খুব ঘনঘন সিঙ্গাপুর যায় এবং গত চারবার রোজমারির সঙ্গে তার সিঙ্গাপুর যাওয়াটা কোনও সন্দেহজনক ঘটনা নয়?

ঠিক তাই। তবু লোকটাকে আমি দেখতে চাই।

শুভ যেন খুব লজ্জিত হয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, আসাটাও তাই?

তার মানে?

লোকটা

শুধু যায় না, আসেও।

একই ফ্লাইটে?

অবশ্যই।

মৈত্রেয়ী শুভর দিকে চেয়ে বলল, ইউ মাস্ট বি কিডিং।

শুভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ মুখ করে বলল, আমার দুঃখটা কী জানো?

কী?

তোমারও দু’খানা ড্যাবডেবে চোখ আছে। সে দুটোকে মাশকারা, কাজল ইত্যাদি দিয়ে সেবাও কম দাও না। কিন্তু সে দুটোর আসল কাজটায় কেন যে এত ফাঁক থাকে!

তুমি শুধু ফাজিলই নও, অসভ্যও। সাজগোজ নিয়ে কথা বলা এটিকেট নয়।

শুভ নিপাট ভালমানুষের মতো বলল, সাজতে কেউ বারণ করেনি। বারণ করলেই বা শুনছে কে? আমি বলছি ভগবানের দেওয়া ইন্দ্রিয় সকলের সদ্ব্যবহার করা উচিত। চোখ শুধু কটাক্ষ করার জন্য তো নয়, পর্যবেক্ষণও তার আর একটা কাজ।

আহা, আমি বুঝি তোমার চেয়ে কম অবজার্ভ করি? তুমিই তো বরং গত শুক্রবার রাস্তা পেরোনোর সময় স্কুটারের ধাক্কা খেয়েছিলে।

আচ্ছা, লেট আস মেক পিস। কথা হল, গত চারবার রোজমারির ফ্লাইটে আমি লোকটাকে যেতে এবং আসতে দেখেছি। রোজমারির সঙ্গে লোকটার আলাপ নেই, কেউ কাউকে চেনে বলেও মনে হয় না। না, একটু ভুল হল। রোজমারি চেনে বলে মনে হয় না। কিন্তু লোকটা সম্পর্কে আমি শিয়োর নই।

রহস্য পুষে না রেখে রোজমারিকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতে।

অবাক হয়ে শুভ বলল, কেন জিজ্ঞেস করব? কিছু তো ঘটেনি। জাস্ট কো-ইনসিডেন্স।

কিছুই যদি ঘটেনি তা হলে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?

দুটো কারণে। রোজমারিকে সম্প্রতি ভুল জন্মদিনে লাল গোলাপ পাঠানো এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের আচমকা গুরুত্ব বৃদ্ধি। আমার মনে হচ্ছে ম্যাডাম রোজমারির আরও একটু সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।

রোজমারিকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। উনি নিজের দেখভাল ভালই করতে পারেন।

শুভ একটু চুপ করে থেকে মৈত্রেয়ীর দিকে চেয়ে বলল, তোমার কি সত্যিই তাই মনে হয়?

মৈত্রেয়ী একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এই তো বলছ তেমন ঘটনা কিছু ঘটেনি বলে রোজমারিকে কিছু বলোনি। আবার বলছ রোজমারির সতর্ক হওয়া দরকার।

শুভ কৃত্রিম দুঃখের সঙ্গে বলল, আমার দোষ কী জানো? কাউকেই কিছু ঠিকভাবে বুঝিয়ে বলতে পারলাম না। সেইজন্যই না বিদিশা কোনওদিন আমার ভালবাসা টেরই পেল না। বিয়ে করে বসল একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্টকে।

মৈত্রেয়ী হেসে ফেলে বলল, আর ইয়ারকি করতে হবে না। বিদিশার গল্পটা পুরো গুল।

শুভ মাথা নেড়ে বলল, গুল! বলো কী? আমার আজও তার জন্য কী ভীষণ কষ্ট হয়। অথচ সে তো অপ্রাপ্য ছিল না। শুধু একটু বুঝিয়ে বললেই হত।

মৈত্রেয়ী হেসে বলল, আমি বিদিশা নই। বুঝতে পারি।

কী বুঝতে পারো?

তুমি একটু বোকা আর একটু পাগল। যা বলছিলে বলো।

শুনবে? বোরিং নয় তো!

বোরিং হবে কেন? এ তো রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের গল্প।

গল্প হবে কেন? একটা হাইপোথেসিস বলতে পারো, বেসড অন সলিড ফ্যাক্টস।

কিন্তু ফ্যাক্টগুলো এলোমেলো, ক্যাওটিক।

তাও ঠিক। প্রথম অবস্থায় প্যাটার্নটা বোঝা যায় না। তবে আমার মনে হচ্ছে, রোজমারি ইজ বিয়িং টেইলড। এভরিহোয়ার।

রোজমারিকে ফলো করে কী হবে?

সেইজন্যই তো সিঙ্গাপুর যাওয়াটার একটা ব্যাখ্যা খুঁজছিলাম। রোজমারি একটা বাচ্চাকে আদর করতে প্রায়ই সিঙ্গাপুর যাচ্ছে, আর আর-একটা লোক কাজকর্ম ফেলে এক কাঁড়ি টাকা খরচ করে তাকে ফলো করছে, এটা আমার কাছে বাড়াবাড়ি ঠেকছে।

বাড়াবাড়িই তো। লোকটা মোটেই রোজমারিকে ফলো করছে না। সে যাচ্ছে নিজের কাজে। তোমার উর্বর মাথা বাকিটা বানিয়ে নিচ্ছে।

শুভ চিন্তিতভাবে চেয়ে রইল মৈত্রেয়ীর মুখের দিকে। তারপর বলল, সে যাই হোক, আজ রোজমারির সঙ্গে তার গাড়িতে তুমিই যাবে। আমি মোটরবাইক এনেছি।

হ্যাঁ, সেটাও জিজ্ঞেস করা হয়নি তোমাকে। মোটরবাইক এনেছ কেন?

আমি বক্কেশ্বরকে ফলো করব।

মৈত্রেয়ী চোখ বড় করে বলল, বলো কী? তোমার কী দরকার লোকটাকে ফলো করার?

কারণ আছে। আই ওয়ান্ট টু নো।

শোনো শুভ, মোটরবাইক তুমি সবে কিনেছ। এখনও হাত সেট হয়নি। পাগলামি কোরো না।

তুমি কি জানো নলেজ জিনিসটা মানুষের মস্ত বড় হাতিয়ার?

এটাকে নলেজ বলে না শুভ, বড়জোর ইনফর্মেশন বলা যায়।

ইনফর্মেশনও নলেজ। তবে ছোট মাপের, এই যা।

বাড়াবাড়ি কোরো না শুভ। পুলিশের কাছে বলে দিলে তারাই হয়তো লোকটার খোঁজ করবে।

পুলিশ কেন ইন্টারেস্ট নেবে? লোকটা তো এখনও কোনও ক্রাইম করেনি। এমনকী একমাত্র রোজমারির পিছু পিছু সিঙ্গাপুর যাওয়া-আসা ছাড়া বিশেষ কোনও সন্দেহজনক কাজও করেনি।

ওঃ, তোমার সঙ্গে কিছুতেই পারা যায় না।

শুভ একটু হাসল, রোজমারি আমার বস, তার নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব আমার নয়। কিন্তু রহস্যের গন্ধ পেলে আমি কেন যেন একটু চনমনে হয়ে উঠি। ছেলেবেলা থেকে ডিটেকটিভ বই আর থ্রিলার পড়ে পড়েই বোধহয় এরকমটা হয়েছে।

বুঝেছি। এখন খোঁজ নাও তো, ফ্লাইট এত দেরি করছে কেন? ল্যান্ড করার শিডিউল টাইম তো ঘণ্টাখানেক আগে পেরিয়ে গেছে।

আধ ঘণ্টা লেট তো ছিল। হয়তো আরও একটু বেড়েছে। ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। ফ্লাইট যখন আসবার আসবে। আমাদের কাজ হল অপেক্ষা করা।

তা হলে চলো, গাড়িতে গিয়ে বসি। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গেল। এরা যে কেন লাউঞ্জে আমাদের ঢুকতে দেয় না।

এ দেশের প্রশাসন খুবই নির্বোধ। সিকিউরিটির অজুহাতে আজকাল ভিতরে ঢুকতে দেয় না, কিন্তু আদতে সিকিউরিটি ব্যাপারটায় হাজার ফুটো। তুমি কি বিশ্বাস করবে যে, ইচ্ছে করলে এই আমিই কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে যে-কোনও প্লেন হাইজ্যাক করতে পারি? কিংবা পারি যে-কোনও প্লেনে এক্সপ্লোসিভ লোড করে দিতে?

থাক বাবা, তোমাকে আর ওসব পারতে হবে না। তবে কথাটা হয়তো মিথ্যে বলোনি। পাবলিককে লাউঞ্জে ঢুকতে না দিয়ে খুব একটা কাজের কাজ কিছু হয়নি।

তারা ফিরে এসে পার্কিং লটে রাখা গাড়িতে বসে রইল। স্টিয়ারিং-এ অতীব বিশ্বস্ত শিউশরণ। গম্ভীর, মিতবাক শিউশরণ খুবই ঠান্ডা মানুষ। এরকম কর্তব্যপরায়ণ ও প্রভুভক্ত লোক বিশেষ দেখা যায় না। স্টিয়ারিং-এর পিছনে বসে সে একখানা নাম-কিতাব পড়ছে। বইখানা মজার। ওতে কেবল একটি বীজমন্ত্র পর পর ছাপা আছে। বইটা পড়ে যাওয়া মানেই জপ করে যাওয়া। শিউশরণ অবসর পেলেই বইখানা খুলে বসে যায়। শুভ আর মৈত্রেয়ী যখন গাড়িতে উঠে বসল তখন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাদের দেখে নিল শিউশরণ। কোনও প্রশ্ন করল না, প্লেন দেরি কেন তা নিয়ে উদ্বেগ দেখাল না, নাম বই পড়ে যেতে লাগল শুধু।

মৈত্রেয়ী বলল, শুভ, তোমার বক্কেশ্বর কি পাজি লোক?

কে জানে! তবে সন্দেহজনক।

সত্যিই পিছু নেবে নাকি?

প্রয়োজন হলে। যদি দেখি, ওকে নিতে কোনও গাড়ি এসেছে তা হলে ফলো করব না। গাড়ির নম্বরটা টুকে নেব। পরে ট্রেস করা যাবে।

ট্যাক্সি নিলে?

অবশ্যই পিছু নেব।

কিন্তু তার আগে রোজমারিকে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া ভাল, লোকটাকে সে চেনে কি না।

করেছি।

করেছ? কবে?

এর আগের বার। জিজ্ঞেস করেছিলাম এরকম ড্রেসক্রিপশনের কোনও লোককে সে চেনে কি না। রোজমারি আকাশ থেকে পড়ল। তুমি কি একটু টেনশন করছ আমি লোকটার পিছু নেব বলে?

মৈত্রেয়ী বলল, হ্যাঁ। রিস্ক নেওয়ার দরকারটা কী বুঝছি না।

এসব পরে বোঝা যাবে।

হঠাৎ শিউশরণ মুখ ঘুরিয়ে বলল, হাওয়াই জাহাজ নামছে।

মৈত্রেয়ী শুভ ব্যস্ত হল না। তারা জানে প্লেন নামলেও কাস্টমস ইমিগ্রেশন ইত্যাদিতে আধ ঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট কম করেও লাগবে। ধীরেসুস্থে নেমে তারা যখন টার্মিনালের দরজার বাইরে দাঁড়াল তখন খাড়া দুপুর। বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছিল, সিঙ্গাপুর ফ্লাইটের যাত্রীরা ইমিগ্রেশনে জড়ো হচ্ছে এসে। তবে এত দূর থেকে কাউকে চেনা যাচ্ছিল না।

হঠাৎ শুভ বলল, মৈত্রেয়ী, ওই যে বক্কেশ্বর!

মৈত্রেয়ী চমকে উঠে বলল, কোথায়? আসছে। ওর কোনও মালপত্র নেই, শুধু একটা ছোট ব্যাগ। ও আগে বেরিয়ে যাবে। তুমি রোজমারির জন্য থাকো।

দাঁড়াও, দাঁড়াও, রোজমারি তোমাকে খুঁজবে যে! তিনটে বড় বড় সুটকেস আসছে, কে টানবে বাবা?

পোর্টার আছে। আমার সময় হবে না আজ।

টার্মিনালের গেট দিয়ে যে-লোকটা বেরিয়ে এল সে একটু বেঁটে সন্দেহ নেই, কিন্তু ফরসা টকটকে গায়ের রং। চুলগুলো একটু লালচে, মোটা লালচে গোঁফ। চোখে মুখে বুদ্ধির দীপ্তি আছে। ঝকঝকে ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবক। পরনে জিন্স ও মেরুন রঙের টি শার্ট। লোকটা বেরিয়ে আসার পথে প্রি-পেইড ট্যাক্সি বুথে থেমে ট্যাক্সি বুক করল।

শুভ বলল, সরি মৈত্রেয়ী, আমাকে যেতেই হচ্ছে।

ওয়াইল্ড গুজ চেজ।

বোধহয় ব্যাপারটা ততটা কো-ইনসিডেন্স নয়। এনিওয়ে, গুডবাই…

কিন্তু রোজমারিকে কী বলব?

সত্যি কথাই বোলো। শি উইল আন্ডারস্ট্যান্ড।

শুভ একরকম দৌড়ে গিয়ে তার মোটরবাইকে চেপে বসল। হেলমেট মাথায় বসিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। ওদিকে বঙ্কেশ্বর ট্যাক্সির লাইন ধরে গিয়ে উদ্দিষ্ট গাড়িটার কাছে পৌঁছে গেল। বেশ ধীর-স্থির হাবভাব। মৈত্রেয়ী ভাবল, এত হ্যান্ডসাম একটা লোক কি খুব খারাপ লোক হতে পারে?

ট্যাক্সিটা ছাড়ল। বিশ গজ পিছনে শুভর বাইক। শুভ একবার বাঁ হাতটা তুলে তাকে একটা অস্পষ্ট সংকেত জানিয়ে চলে গেল।

হাই মৈত্রেয়ী! শুভ কোথায়?

মৈত্রেয়ী চমকে উঠল।

১৫.

কলকাতার রাস্তায় মধ্য দ্বিপ্রহরে একটা ট্যাক্সিকে অনুসরণ করা যে কত কঠিন তা বুঝতে একটুও দেরি হল না শুভর। কলকাতার রাস্তায় শয়ে শয়ে ট্যাক্সি। তার মধ্যে কেবল একটিকে লক্ষ রাখা যে কত কঠিন। শুধু নম্বর প্লেটটা ভরসা, তার ওপর মোটরবাইক চালানোর অভিজ্ঞতা শুভর খুব দীর্ঘ নয়। তাকে পেরিয়ে বহুট্যাক্সি, গাড়ি এবং অটোরিকশাও ট্যাক্সিটাকে আড়ালে ফেলে দিয়েছে। শুভ তবু প্রাণপাত করছিল। ভিআইপি রোডেই যদি এই অবস্থা হয় তা হলে শহরের ভিতরকার ঘিঞ্জি রাস্তা বা গলিঘুজিতে ঢুকলে কী হবে?

উলটোডাঙার মোড় অবধি অবশ্য ট্যাক্সিটাকে শেষ পর্যন্ত নজরে রাখতে পারল শুভ। তার পর থেকেই শুরু হল ভজঘট্ট। হাজারো গাড়ি, হাজারো বাইক আর স্কুটারের জঙ্গলে দিশেহারা শুভ যে কতবার দুর্ঘটনা থেকে বরাতজোরে বেঁচে গেল তার হিসেব নেই। বার কয়েক রাস্তা ছেড়ে ফুটপাথেও উঠে পড়ল সে। ট্যাক্সিটা অবধারিত মানিকতলার মোড়ের দিকেই চলেছে। মোড়গুলোকেই ভয়। কোনদিকে বাঁক নেবে কে জানে। তাই বেশ কাছাকাছিই থাকতে হচ্ছিল তাকে। লক্ষ করল লোকটা একবারও পিছন দিকে তাকাল না। বেশ আয়েশ করেই বসে রইল। বাঁচোয়া।

মানিকতলা ছাড়িয়ে বিবেকানন্দ রোড। তারপর সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের খাঁচাকল। তারপর ডানধারে মোড় নিয়ে সোজা এসে থামল পোন্দার বিল্ডিং-এর কাছ বরাবর। ট্যাক্সি থামল। তারপর অলস ভঙ্গিতে নেমে ফুটপাথে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে যেন চারদিকটা খুব মেপেৰুপে দেখল, ক্রিটিক্যাল আই।

শুভ বাইকটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে লক করল। তারপর ধীর কদমে লোকটার দশ হাত দূরে গিয়ে দাঁড়াল। বক্কেশ্বর এখন কোনদিকে যায় সেইটেই সমস্যা।

বক্কেশ্বর তার দিকে তাকাল না। সোজা হেঁটে যেতে লাগল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের দিকে। ডানদিকে মোড় ফিরল। হাঁটতে লাগল। দুলকি চাল। কোনও তাড়া নেই। মিনিট পাঁচেক ভিড়ের রাস্তায় ডানধার ঘেঁষে হাঁটবার পর আচমকাই ডানধারে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল।

একটু দ্বিধায় পড়ে গেল শুভ। সেও কি ঢুকবে? কাজটা উচিত হবে কি? অবশ্য এই অঞ্চলের বাড়িগুলির ভিতরে অসংখ্য অফিস, গুদাম এবং দোকান রয়েছে। ঢুকলেও কেউ কিছু সন্দেহ করবে না, সুতরাং দ্বিধার ভাবটা ঝেড়ে ফেলে শুভও ঢুকল। কিন্তু ওই সামান্য দ্বিধা আর কালক্ষেপই সব গণ্ডগোল করে দিল।

বাড়ির ভিতরে ঘিঞ্জি সব দোকান, আড়ত এবং থিকথিক ভিড়। দিশাহারা পরিস্থিতি। শুভ সেই ভিড়ের মধ্যে বেদিশা হয়ে খানিকক্ষণ ঘোরাফেরা করল। ডান ধারে একটা সরু সিঁড়ি পেয়ে সেটা বেয়ে ওপরেও উঠল সে। ওপরেও হাজার রকমের ব্যাবসা বাণিজ্যের আয়োজন। সর্বত্রই মানুষ আর মানুষ। কোথাও বন্ধেশ্বরকে দেখা গেল না।

প্রায় চল্লিশ মিনিট ঘোরাঘুরি করার পর হতাশ হয়ে নেমে এল সে। একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে বাড়িটার নম্বর শুধু টুকে নিল সে। যদিও বুঝতে পারল, নম্বর নিয়ে কোনও লাভ নেই, এই বিশাল বাড়িতে অচেনা একটা লোককে খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় উঁচ খোঁজার মতো ব্যাপার।

হতাশ হয়ে বেরিয়ে এসে সে হাঁটতে হাঁটতে মোটরবাইকের কাছে ফিরে এল। ভাগ্য ভাল ইতিমধ্যে মোটরবাইকটা চুরি হয়ে যায়নি। নতুন কেনা মোটরবাইকটাকে নিয়ে সর্বদাই তার দুশ্চিন্তা থাকে।

যখন অফিসে ফিরে এল শুভ তখন তিনটে বেজে গেছে। তাকে দেখে মৈত্রেয়ী চোখ বড় বড় করে বলল, আর আধ ঘণ্টা দেরি হলেই পুলিশে খবর দেওয়া হত। রোজমারি তোমার ওপর খুব রেগে আছে ওরকম রিস্ক নিয়েছ বলে।

শুভ অপ্রতিভ হয়ে বলল, তুমি কি রোজমারিকে সব বলে দিয়েছ নাকি?

না বলে উপায় ছিল? কী অ্যাডভেঞ্চার করে এলে?

শুভ মাথা নেড়ে বলল, কলকাতা শহরটা ফলোটলো করার পক্ষে একদম স্যুটেবল নয়, লোকটা বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে একটা বিরাট বাড়িতে ঢুকে হারিয়ে গেল।

তুমি যে ফলো করছিলে তা টের পেয়েছিল?

না, বোধহয় না।

এখন যাও, রোজমারি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

বকাঝকা করবে নাকি?

করতেও পারে, যাও।

শুভ কাঁধ ঝাঁকাল, বলল, আমি তো ওর ভালই করতে চেয়েছিলাম।

মৈত্রেয়ী একটু হেসে বলল, তা হলে ভয় পাচ্ছ কেন?

রোজমারি একতলার বাঁ হাতি উইং-এ বসে। তার এলাকাটা খুব সাজানো গোছানো। শুভ আর মৈত্রেয়ীর বসার জায়গা উইংটার মুখে। রোজমারির ঘরখানা একটু তফাতে, মাঝখানে একটা কনফারেন্স রুম আছে।

বিনা অনুমতিতে রোজমারির ঘরে ঢোকা বারণ। বাইরে একজন বেয়ারা মোতায়েন রয়েছে। ভিতরে খবর পাঠিয়ে একটু অপেক্ষা করতে হল শুভকে৷ মিনিট তিনেক বাদে বাইরের দরজার মাথায় সবুজ আলোটা দু’বার জ্বলে নিবে গেল।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল শুভ। যাকে খুশিয়াল ঘর বলে রোজমারির ঘরখানা তাই। চার দেওয়ালে সিলিং থেকে মেঝে অবধি চিত্রিত মাদুরের ঢাকনা। সিলিং-এ চমৎকার বাঁশের কাজ, বাঁশের তৈরি ঝাড়বাতি আছে। বাঁশ আর মাদুরের কাজের জন্য ত্রিপুরা থেকে কারিগর আনানো হয়েছিল। মেঝেতে কার্পেট পাতেনি রোজমারি। খুব সুন্দর নরম রঙের নকশাদার টাইলস বসানো হয়েছে। রোজমারির কাজের টেবিলটাও তিন ভাগে বিভক্ত এবং ডিজাইন প্রায় ফিউচারিস্টিক। আসবাব বিশেষ নেই। একধারে, হাতের নাগালে একটি স্ট্যান্ডের ওপর খুব দামি একটা বিদেশি কম্পিউটার বসানো। পাঁচখানা টেলিফোন আছে রোজমারির। শুভ যখন ঢুকল তখন রোজমারি কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছিল। শুভকে ইঙ্গিতে বসতে বলে আরও কিছুক্ষণ কথা বলল রোজমারি। তারপর টেলিফোন রেখে শুভর দিকে কৃত্রিম ভ্রুকুটি করে বলল, তারপর, কোন অ্যাডভেঞ্চারে গিয়েছিলে?

আমি লোকটার কথা আপনাকে আগেও বলেছি। লোকটা প্রতিবার আপনার ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর যায় এবং আসে।

রোজমারি মাথা নেড়ে বলল, তাতে কী হয়েছে?

আমি লোকটাকে ট্রেস করার চেষ্টা করেছিলাম।

তুমি আমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছ বলে ধন্যবাদ। তুমি সত্যিই একটি ভাল ছেলে। কিন্তু আমাদের বিপদটা মনে হয় আরও গভীর। আর শত্রুও বোধহয় অনেক কঠিন।

শুভ একটু অবাক হয়ে বলল, একথা কেন বলছেন?

রোজমারি একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, তুমি কি আমাদের কারখানাটির সম্পর্কে সব জানো?

শুভ মাথা নেড়ে বলল, না, আমি তো বৈজ্ঞানিক নই। তবে জানি যে, এটা খুবই আধুনিক কারখানা, ভারতবর্ষে কেন, এশিয়াতেও এরকম অত্যাধুনিক কারখানা নেই।

ঠিক তাই। আর আমাদের প্রোডাকশনটাও আংশিক একচেটিয়া ব্যাবসা করছে। ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট বাড়িয়ে দিলে শতকরা মুনাফা কোথায় পৌঁছোবে তার ঠিক নেই। কারণ পৃথিবীতেও এরকম কারখানা বেশি নেই। কিন্তু আমরা যে ব্যাবসাটা করছি তা অনেকেই ভাল চোখে দেখছে না। প্রথমে এটা আমাদের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। এখন চেষ্টা হচ্ছে কেড়ে নেওয়ার, ভয় দেখিয়ে।

কিন্তু কেন?

সেইটে আমরা এখনও বুঝতে পারছি না।

শুভ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, তা হলে এখন কী করবেন?

ভাবছি।

পুলিশকে জানালে হয় না?

পুলিশকে জানালে একটা কংক্রিট অভিযোগ করতে হয়। আমরা সেটা করতে পারছি না। আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ এবং তথ্য নেই। পুলিশকে জানালে তারা বড়জোর কিছুদিন কারখানা বা আমাদের বাড়ি পাহারা দেবে। কিন্তু তাতে তো লাভ নেই।

কেন নেই?

রোজমারি হেসে বলল, এই লড়াইটা অর্থনৈতিক লড়াই। এই লড়াইয়ে পুলিশের ভূমিকা নেই।

শুভ খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ম্যাডাম, আমার এক কাকা লালবাজারের গোয়েন্দা, তিনি সাহায্য করতে পারেন।

তোমাকে ধন্যবাদ শুভ। আমার মনে হয় তোমার কাকা এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবেন না। তবু তিনি যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে আমাদের পরামর্শ দিতে পারেন।

শুভর মনটা খারাপ লাগছিল। সে ভারাক্রান্ত মনে বেরিয়ে এল। রোজমারিকে সে নিজের মতো করে পছন্দ করে। রোজমারি অনেকটা তার দিদির মতো। স্নেহশীলা এবং প্রশ্রয়দাত্রী।

তাকে বেরিয়ে আসতে দেখে মৈত্রেয়ী জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে বলল, কী হল?

কিছুই নয়।

তোমাকে বকেননি তো!

না। তবে রোজমারি বিপদের মধ্যে আছে বলে মনে হল।

তোমাকে তো বলেইছি বড়লোকদের সবসময়েই বিপদ, তুমি কেন মাথা ঘামাচ্ছ?

আমরা কি কিছু করতে পারি না মৈত্রেয়ী?

কী করবে?

রোজমারি বলল, এই কারখানা নিয়েই নাকি নানারকম খেলা চলছে।

কীরকম খেলা?

খুব একটা ভেঙে বলল না। তোমার কি মনে আছে রোজমারিকে কিছুদিন আগে একগোছা লাল গোলাপ পাঠানো হয়েছিল!

কেন থাকবে না? খুব মনে আছে।

ট্যাগে লেখা ছিল আর আই পি, খ্রিস্টানদের কবরে লেখা থাকে।

তাও জানি।

ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস মৈত্রেয়ী।

হলেও তোমার কিন্তু কিছু করার নেই শুভ।

.

শুভ ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পরই রোজমারি ফোন তুলে একটা নম্বর ডায়াল করল।

ওপাশ থেকে একটা মোলায়েম গলা বলল, লুলু হিয়ার।

রোজমারি জার্মান ভাষায় বলে, বোকামিটা কেন করলে?

জার্মান ভাষাতেই জবাব এল, বোকামি করিনি। শেষ অবধি ছেলেটাকে ঝেড়ে ফেলেছি।

সেটা কথা নয়। তোমার চলাফেরা এবং হাবভাবই তোমাকে ধরিয়ে দিচ্ছে। তোমার আরও অনেক ট্রেনিং বাকি।

আসলে তোমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে যাওয়া এবং আসাটাই একটা বোকামি হয়েছে। কিন্তু ইদানীং আমি তোমার নিরাপত্তা নিয়ে একটু চিন্তিত বলেই একই ফ্লাইটে যাই আসি।

বুঝলাম, কিন্তু ধরা পড়ে গেছ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তোমাকে শেষ অবধি ট্রেস করতে পারেনি।

এর পর থেকে আমি আরও একটু সতর্ক হব রোজমারি।

ছেলেটা তোমার মুখ মনে রেখেছে। কাজেই তুমি আমার অফিসে কখনও আসবে না।

না। আর কিছু?

আপাতত কিছু নয়, পরে কথা হবে।

রোজমারি ফোনটা রেখে দিল।

ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত রোজমারি কিছুক্ষণ ফাঁকা ঘরে পায়চারি করল, তারপর মনোজকে ফোন করল।

মনোজ, কী খবর?

কোনও খবর নেই। গোপীনাথ বসু অদৃশ্য হয়ে গেছে।

আমাদের সায়েন্টিস্ট কী বলছে?

না, কোনও পথ দেখাতে পারছে না।

তা হলে?

অপেক্ষা করা ছাড়া পথ দেখছি না।

আমি কি একটু রোমে যাব?

যেতে পারো, কিন্তু কী লাভ হবে?

তা জানি না, কিন্তু এভাবে অনিশ্চয়তা নিয়েও তো থাকা যায় না। আমার টেনশন হচ্ছে।

টেনশন, টেনশনের কী আছে? গোপীনাথ বসু যদি বেঁচে থাকে তবে একদিন যোগাযোগ করতে পারব।

তুমি কি সোনালিকে একটু ট্যাপ করছ?

ও বাবা, তাতে উলটো ফল হয়েছে। কিন্তু সুব্রত গোপীনাথের খুব কাছের লোক। পারলে সে-ই সাহায্য করবে।

.

যাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল সেই গোপীনাথ বসুর অবস্থা গৃহবন্দির মতোই। ঘর থেকে বেরোনোর উপায় নেই। টেলিফোনে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। শুয়ে বসে সময় কাটানোর ধাত তার নয়। ফলে ক্রমে ক্রমে সে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল।

মজা হল, দ্বিতীয় রাতেই তার কাছে ফোন করে একজন গম্ভীর গলার মানুষ জানতে চাইল, তার বান্ধবীর দরকার আছে কি না।

গোপীনাথ অবাক হয়ে বলল, বান্ধবী! হঠাৎ একথা কেন?

টেনশন কাটাতে বান্ধবী খুব সাহায্য করে।

গোপীনাথের মনে হল ফোনটা করছে ওই দাতা, অর্থাৎ বাঙালি মস্তানটি, যদিও কথা বলছিল ইতালিয়ানে। ফোন বলতে ইন্টারকম। তার মানে লোকটা এখন এই হোটেলেই আছে।

গোপীনাথ বলল, আমার বান্ধবীর দরকার হয় না।

আপনি হোমোসেক্সুয়াল নন তো?

না, এ প্রশ্নই বা কেন?

আপনার সব খবর আমাদের জানা নেই বলে, ভয় পাবেন না, বান্ধবীটি কিন্তু অন্য কোনও মতলবে যাবে না, শুধুই সঙ্গ দেবে।

গোপীনাথ একটু দ্বিধায় পড়ে বলল, পাঠিয়ে দিন।

বান্ধবী এল দশ মিনিট বাদে। তাকে দেখে চমকে গেল গোপীনাথ। বছর পচিশ-ছাব্বিশ বয়সের চাবুক চেহারার একটি ইতালিয়ান মেয়ে। জিপসিদের ধরনের পোশাক পরা। মাথায় একটা ধাতুর তৈরি সাপের মুকুট।

কটাক্ষ এবং লোল হাসির পর মেয়েটি বলল, পছন্দ?

হ্যাঁ।

ড্রিঙ্কস?

না।

তুমি ড্রিঙ্ক করো না?

না, আমার অভ্যাস নেই।

তা হলে সন্ধেটা কাটাবে কী করে?

আমরা কথা বলতে তো পারি? কথা,

কথা দিয়ে সময় কাটানো যায় নাকি?

যায় না?

কিছু অ্যাকশনও তো দরকার, নাচলে কেমন হয়?

আমি নাচ জানি না।

তুমি কি পণ্ডিত লোক?

গোপীনাথ হাসল, পণ্ডিতরাও ফুর্তি করে। আমি আসলে ফুর্তিবাজ নই।

তুমি কেমন?

সেটা তুমিই আজ আবিষ্কার করো।

মেয়েটা তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, বাঃ, এই তো সুন্দর কথা, আমি আজ তোমার ভিতরে আগুন জ্বালিয়ে দেব। তুমি নিজেকে চিনতেই পারবে না।

তথাস্তু।

১৬-২০. গোপীনাথের ভিতরে আগুন

না, গোপীনাথের ভিতরে কোনও আগুনই জ্বলল না, মেয়েটি কিছু ছলাকলা শুরু করতেই গোপীনাথ হঠাৎ খুব ঠান্ডা গলায় বলল, ক্ষান্ত হও, বৃথা পরিশ্রম কোরো না।

মেয়েটা থমকে গিয়ে বলল, কেন? আমি যথেষ্ট আকর্ষক নই?

নিশ্চয়ই, তবু ক্ষান্ত হও, আমি পরিশ্রান্ত, উদ্বিগ্ন এবং খানিকটা ভীত একজন মানুষ। এখন কোনও সুন্দরী মহিলার ঘনিষ্ঠ সাহচর্য আমি উপভোগ করতে পারছি না।

মেয়েটা একটু হেসে বলল, মানুষ তো ওসব কাটানোর জন্যই মেয়েদের চায়। গোপীনাথ মেয়েটার দিকে চেয়ে বলল, তুমি কি জানো সেক্সের মধ্যে কতটা শরীর আর কতটা মন?

মেয়েটা বলল, সেক্স তো শরীর মাত্র।

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, সকলের কাছে নয়। আমার কাছে সেক্স-এর অর্ধেক মন আর অর্ধেক শরীর।

তুমি বোধহয় জ্ঞানী লোক।

না, তবে আমি একজন মনোযোগী ছাত্র।

তুমি কী চাও বলো তো!

আপাতত আমি তোমার সঙ্গে বসে কফি খেতে খেতে একটু কথা বলতে চাই।

মেয়েটা মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, তবে তাই হোক।

গোপীনাথ ইন্টারকমে কফির অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। এই হোটেলের রুম সার্ভিস খুবই ভাল, ঠিক সাত মিনিটের মাথায় একজন বেয়ারা এসে কফির ট্রে নামিয়ে রেখে চলে গেল।

কফি খেতে খেতে মেয়েটা বলল, কী কথা বলতে চাও?

প্রথমে জানতে চাই তোমার নাম কী?

আমার নাম জিনা।

তুমি কি কল গার্ল? খানিকটা তাই। তবে আমি চাকরিও করি।

পুরুষদের খুশি করে বেড়াতে কি পছন্দ করো?

মেয়েটার মধ্যে হঠাৎ যেন সব চঞ্চলতা থেমে গেছে। কফির কাপটা ঠোঁটের কাছে ধরে একটু ভেবে বলল, তুমি আমাকে নীতি উপদেশ দেবে না তো!

না, ওসব আমার আসে না।

খুব ভাল। কারণ ওসব আমি মানি না। যা খুশি করি।

সবাই আজকাল তাই করে। আজকালকার মানুষ কিছু মানার ধার ধারে না।

আমরা একটা ছোট্ট জীবন পেয়েছি আর চারদিকের এই পৃথিবী, জীবনটা যতদূর পারি ভরে নেওয়াই তো ভাল।

ঠিক কথা। জীবনটা যদি ভরে নেওয়া যায় তা হলে আপত্তি কীসের? আমি জানতে চাই তুমি কি এই হোটেলেই চাকরি করো?

হ্যাঁ।

কী চাকরি?

স্ট্রিপ ড্যান্স।

দাতা কে জানো?

মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে বলল, দাতা! দাতা আবার কে?

একজন ভারতীয়, আমার মতোই।

না, আমি লুইজির বান্ধবী।

লুইজি কি এই হোটেলের মালিক?

ওর কাকা মালিক।

লুইজির বোনকে চেনো?

চিনি, কেন বলো তো!

না, আমি একটা প্যাটার্ন বুনবার চেষ্টা করছি।

কীসের প্যাটার্ন?

নানা ঘটনাবলির।

কীরকম ঘটনা?

একে বেশি কিছু বলে লাভ নেই, জানে গোপীনাথ, তবু কাউকে তার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল। সে বলল, তুমি কি সাহসী মেয়ে?

তাই তো জানি।

তা হলে তোমাকে বলা যায়। শুনবে?

শুনব।

গোপীনাথ একটু ভেবে তার কাহিনিটা ছাঁটকাট করে বেশ সংক্ষেপে বলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমি যাদের হেপাজতে রয়েছি তারা কেমন লোক তা কি তুমি জানো জিনা?

জিনা কফির শূন্য কাপটা ট্রে-তে রেখে বলল, এক কথায় এ প্রশ্নের জবাব হয় না। তবে লুইজি ভাল ছেলে। ওর কাকা হোটেল চালায় বলে গুন্ডা বদমাশ এবং সন্দেহজনক লোকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। তবু বলতেই হবে এমপ্লয়ার হিসেবে লোকটা তেমন খারাপ নয়।

আমি লুসিলের কথা জানতে চাই।

লুসিল! না তার কথা আমি তেমন কিছু জানি না। লুইজির কাছে শুনেছি তার বোন লুসিল প্যারিসে থাকে।

এই হোটেলে কোনও মাফিয়া বা গুন্ডার দলের নজর আছে কি না জানো?

তারা তো সব জায়গাতেই আছে।

আমি একটু স্পেসিফিক হতে চাইছিলাম।

মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, এই হোটেলে সন্ধ্যায় আমাকে কয়েক ঘণ্টা কাটাতে হয়। কত লোক আসে! নাচঘর তখন অন্ধকার থাকে।

ঠিক কথা, তুমি আমাকে অনেক কথাই বলেছ। আলাপ করে খুশিই হলাম।

তার মানে তুমি কি আমাকে এখন চলে যেতে বলছ?

তা নয়। তবে আমার যেটুকু জানার ছিল জেনেছি।

শোনো পণ্ডিত মানুষ, তোমার মুখখানা আমার খারাপ লাগছে না। তুমি সেক্সি না হতে পারো, কিন্তু বর্বর নও।

ধন্যবাদ।

আমার কথা শেষ হয়নি।

তা হলে বলো।

আমি মাফিয়া এবং গুন্ডা বদমাশদের ঘেন্না করি।

খুব ভাল।

তুমি যে একটা বিপদের মধ্যে রয়েছ তা আমি বিশ্বাস করছি। তোমার মুখে উদ্বেগটা প্রকাশ পাচ্ছে।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি মিথ্যে কথা সহজে বলি না।

শোনো, তোমাকে আমি সাহায্য করতে চাই।

কীভাবে সাহায্য করবে?

মেয়েটা একটু ভেবে বলল, আমি তোমার নিরাপত্তার কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারি না।

সেটা জানি।

তবু তোমাকে আমি এখান থেকে পালাতে সাহায্য করতে পারি। শুধু তাই নয়, আমাদের পরিবারে তুমি দু’-একদিন আশ্রয়ও পাবে। যদি ইচ্ছে করো।

তারপর?

তারপর তোমার যা ইচ্ছে।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, ভিকিজ মব বা মাফিয়াদের হাত খুবই লম্বা। তারা যেখানেই হোক আমার নাগাল পাবেই।

সেটা ঠিক কথা।

তবু আমি এই জোন থেকে বেরিয়ে পড়তে চাই।

কোথায় যাবে?

কলকাতায়।

তোমার কাছে ভাড়ার টাকা আছে?

না, তবে আমার কাছে চেকবই আছে। কিন্তু আমি টাকা তুলতে গেলেই ধরা পড়ে যেতে পারি।

টাকাটা যদি আমি তোমাকে ধার দিই?

ধন্যবাদ, কিন্তু ব্যাঙ্কে টাকা থাকতে ধার করার মানেই হয় না।

হয়। টাকাটা এখনই তোলার দরকার নেই। চেকটা তুমি আমাকে দিয়ো। তুমি নিরাপদে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর আমি আমার ব্যাঙ্কের সাহায্যে টাকাটা তুলে নেব।

বাঃ। চমৎকার। আমাকে তোমার বিশ্বাস হচ্ছে তো?

হচ্ছে। আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই। এখন সবচেয়ে বেশি গুরুতর ব্যাপার হল, তোমাকে এই হোটেল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া।

কীভাবে সেটা সম্ভব? আমি যতদূর জানি ভিকিজ মব-এর একজন এজেন্ট হল দাতা, অন্যজন লুসিল এবং হয়তো লুইজিও।

দাতাকে আমি চিনি না। তবে লুসিল এখন নিউ ইয়র্কে। লুইজি বার্সিলোনায়। দাতা সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।

নাও।

কীরকম দেখতে সে?

লম্বাচওড়া এবং সুপুরুষ। চেহারায় একটা নিষ্ঠুরতা আছে। এবং খুবই বিস্ময়ের কথা, তোমাকে সেই আমার কাছে পাঠিয়েছে।

মেয়েটা অবাক হয়ে বলে, আমাকে তোমার কাছে আসতে বলেছে এই হোটেলের ম্যানেজার নিনো। সে ভারতীয় নয়, ইতালিয়ান।

তা হলেও পিছনে দাতা আছে।

মেয়েটা উঠে পড়ল, বলল, ভেবো না, আমি খোঁজ নিয়ে আসছি। তুমি তৈরি থেকো। এই হোটেলের ফায়ার এসকেপ দিয়ে নামলে পিছনে একটা সরু গলি পাবে। আমার গাড়িটা ছোট, থ্যাবড়া আর লাল রঙের। ফিয়াট। যদি রাস্তা পরিষ্কার থাকে তা হলে আধঘণ্টা বাদে আমি গাড়ি নিয়ে গলিতে অপেক্ষা করব।

গোপীনাথ সামান্য উদ্বেগের গলায় বলল, তোমার এতে কোনও বিপদ নেই তো!

না। তোমার সঙ্গে আমার দু’ঘণ্টা থাকার কথা। দু’ঘণ্টা পার হয়েছে। এখন চলে গেলে কারও সন্দেহ হওয়ার কিছু নেই। হলেও ভয় পেয়ো না। আমি যেখানে থাকি সেটা রোমের একটা ঘিঞ্জি পাড়া। বাইরের লোক ঢুকে সুবিধে করতে পারবে না, আমরা জোট বেঁধে থাকি।

জিনা বেরিয়ে যাওয়ার পর খুব দ্রুত গোপীনাথ পোশাক পরে নিল। কফির ট্রে দরজার বাইরে রেখে ডোন্ট ডিস্টার্ব সাইন টাঙাল দরজায়। পাসপোর্ট এবং প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বাতি নিবিয়ে পেছনের ফায়ার এসকেপের কাছে এসে দাঁড়াল।

আধঘণ্টা সময় যে কতটা সময় তার কোনও ঠিক নেই। এক-এক পরিস্থিতিতে আধঘন্টা পাঁচ মিনিটের মতো আচরণ করে, এক-এক সময় পাঁচ ঘণ্টার মতো, এখন পাঁচ ঘণ্টার মতো লাগছে।

একজন অচেনা মেয়ের কাছে নিজেকে এতটা সমর্পণ করে কি বোকামি করছে না গোপীনাথ? এটা হয়তো এদেরই তৈরি করা ফাঁদ! গোপীনাথের এখানে তবু একটু নিরাপত্তা ছিল, এরপর কী হবে কে জানে! তবে তার তো জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ। বেশি আর কী-ই বা হতে পারে?

ফায়ার এসকেপটা লাথি মেরে খুলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল গোপীনাথ।

গলির মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হল তাকে। তারপর ডানপ্রান্ত দিয়ে একটা আলো নেবানো ছোট্ট গাড়ি মুখ ঢোকাল গলিতে। স্ট্রিট লাইটের আলোয় লাল রংটা বোঝা গেল।

সামনে এসে গাড়িটা দাঁড়াতেই দরজা খুলে জিনা বলল, উঠে পড়ো, কেউ এখন হোটেলে নেই।

গোপীনাথ উঠে পড়ে বলল, দাতা কোথায়?

খোঁজ নিয়ে জানলাম, যে একটা জরুরি টেলিফোন পেয়ে একটু আগেই বেরিয়ে গেছে।

গোপীনাথ ব্যাগটা পিছনের সিটে রেখে সামনের সিটে জিনার পাশে উঠে বসল। জিনা গাড়ি ছাড়ল।

.

আর ঠিক এসময়ে গোপীনাথের হোটেলের ঘরের দরজাটা কেউ লাথি মেরে খুলে ফেলল। ঘরে ঢুকল দু’জন। তাদের একজন বেনভেনুটি, অন্যজন বাসিলোঁ, দু’জনের হাতেই পিস্তল। চারদিক দেখে নিয়ে বাসিলোঁ বলল, বেনভেনুটি, আমাদের কপাল নিতান্তই খারাপ দেখছি।

বেনভেনুটি বাথরুমে উঁকি মেরে দেখছিল। বলল, কপাল খারাপ বললে তো হবে না বাসিলোঁ, লোকটাকে খুঁজে পাওয়া না গেলে আমাদের কী হবে তা ভেবে দেখেছ?

দেখেছি, কিন্তু ভাবতে চাই না।

আর এসবের জন্য দায়ী তুমি বাসিলোঁ। মেয়েছেলে দেখলেই তুমি এমন চঞ্চল হয়ে ওঠো যে, কাণ্ডজ্ঞান থাকে না, মেয়েটার সঙ্গে খুনসুটি করতে না গেলে সেদিন চিড়িয়া উড়ে যেতে পারত না।

ভুল বেনভেনুটি, তোমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ওদের একটা পরিকল্পনা কার্যকর না হলে আর একটা হতই, আমরা ওদের প্রথম কৌশলটারই শিকার হয়ে গিয়েছিলাম।

বেনভেনুটি ভ্রু কুঁচকে বলল, এখন কী করবে?

অন্য ঘরগুলো খুঁজে দেখব। হোটেলটা তছনছ করব।

দাঁড়াও। ফায়ার এসকেপটা দেখো।

কী দেখব?

ফায়ার এসকেপটা খোলা রয়েছে।

ঈশ্বর! বলে বাসিলোঁ এগিয়ে গেল। ফায়ার এসকেপ খুলে নীচের দিকে চেয়ে বলল, পরিশ্রম অনেকটাই বেঁচে গেল মনে হচ্ছে। হোটেলটা আর তছনছ করতে হবে না। আমাদের পাখি এদিক দিয়েই পালিয়েছে।

অথবা তাকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

একই কথা বেনভেনুটি। আমাদের গর্দান যূপকাষ্ঠেই রয়ে গেল। এসো বেনভেনুটি, তলাটা একটু ঘুরে দেখে আসি।

দু’জনে নীচে নামল। গলির মধ্যে পা রেখে বাতাস শুকে বাসিলোঁ বলল, বেনভেনুটি, পেট্রোলের গন্ধ পাচ্ছ? এই গলি দিয়ে সচরাচর গাড়ি চলাচল করে না। সুতরাং আমাদের পাখিটির জন্য কিছুক্ষণ আগেই এখানে গাড়ি ঢোকানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। গলিটা সরু তাই নিশ্চয়ই কোনও ছোট গাড়ি।

তুমি পুলিশে চাকরি করলে পাকা ডিটেকটিভ হতে।

ডিটেকটিভরা বড্ড গরিব হয় বেনভেনুটি। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, আমি দরিদ্রের জীবন যাপন করি।

কিন্তু শ্রীযুক্ত গোপীনাথ বসুকে খুঁজে বের না করতে পারলে আমাদের দুজনকেই হয়তো ভিক্ষে করতে হবে।

না বেনভেনুটি, না। দলে নতুন এসেছ, তাই জানোনা। ভিখিরি হয়েও যদি বেঁচে থাকতে পারো তো সেটা পরম সৌভাগ্য। লোকটা যদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে তা হলে আমাদের দু’জনকেই গুলি করে টাইবারের জলে ফেলে দেওয়া হবে।

ঈশ্বর! তা হলে কিছু করো বাসিলোঁ।

হ্যাঁ। করতেই তো আসা। আপাতত চলল, ম্যানেজারকে আরও একটু কড়কানো যাক।

দু’জনেই ফিরে এল ফায়ার এসকেপ দিয়ে। আবার চারদিক দেখে নিল। তারপর নেমে এল একতলায়। যেখানে তাদের দলের আরও জনাপাঁচেক পেশাদার গুন্ডা ম্যানেজারের ঘরে এবং দরজায় পাহারা দিচ্ছে। রেস্টুরেন্টের দিক থেকে নাচগানের শব্দ এবং কিছু হল্লা আসছে।

ভীত ইতালিয়ান ম্যানেজার সাদা মুখে নিজের চেয়ারে বসে ছিল।

বাসিলোঁ মৃদু গলায় বলল, গোপীনাথ বোস তার ঘরে নেই।

আ-আমি জানি না।

না জানলে কি চলে? এত মাননীয় দামি একজন অতিথির খবর রাখো না, তুমি কেমন ম্যানেজার?

বিশ্বাস করো, তার এখন ঘরেই থাকার কথা। একটু আগে জিনা তাকে সেবা করতে গিয়েছিল। দু’ঘণ্টা ছিলও তার ঘরে। একটু আগেই জিনা নেমে এল।

জিনা কে?

স্ট্রিপটিজ করে।

বাঃ। তা হলে অতিথির জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা ভালই ছিল।

হ্যাঁ, জিনা এসে বলল অতিথি ভাল আছে।

জিনা কি রোজ গোপীনাথের কাছে যেত?

না। আজই প্রথম।

অন্যান্য দিন কারা যেত?

কেউ না, উনি বোধহয় খুব একটা সেক্সি নন।

তা হলে আজ হঠাৎ জিনাকে দরকার হল কেন?

আ-আমি জানি না।

তা হলে কে জানে?

একজন লোক জিনাকে যেতে বলেছিল।

লোকটা কে?

আমি চিনি না। তবে তাকে দাতা বলে কেউ কেউ ডাকছিল।

বাসিলোঁর ভ্রু কুঁচকে গেল, দাতা! কোন দাতা?

তা জানি না।

রিভলভারটা ম্যানেজারের দিকে আলগোছে তুলে বাসিলোঁ বলল, ব্যাপারটা গুরুতর। বলো।

ম্যানেজার তোতলাতে তোতলাতে বলল, ভিকিজ মব-এর সর্দার।

ঈশ্বর! সে কোথায়?

এখানে নেই। একটু আগে বেরিয়ে গেছে।

মিথ্যে কথা।

বিশ্বাস করো। তবে সে বেশি দূর হয়তো যায়নি। আসবে।

আমরা অপেক্ষা করব। জিনার ঠিকানাটা দাও। তাড়াতাড়ি।

১৭.

কোনও মহিলাকে এত জোরে গাড়ি চালাতে আগে দেখেনি গোপীনাথ। বিশেষ করে রোমের কিছু অপ্রশস্ত রাস্তায়।

জিনা, তোমার সাহস আছে বটে, কিন্তু এটাই কি সাহস দেখানোর সময়?

জিনা একটা মোড় অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ফিরে গতি সামান্য কমাল। তারপর বলল, আমি বিপদের গন্ধ পাই।

সেটা কীরকম?

যখন গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছিলাম তখন হোটেলের চত্বরে তিনটে গাড়ি এসে থামল। একসঙ্গে প্রায় আট-দশজন লোক নেমে এল। তাদের মধ্যে একজন আমার গাড়িতে অত্যন্ত অভদ্রভাবে উঁকি দিয়েছিল।

কই, বলোনি তো?

তোমাকে ঘাবড়ে দিতে চাইনি।

ওরা কারা?

ওরা আর যাই হোক ভালমানুষ নয়। এদের একজনকে আমি চিনি। তার নাম বাসিলোঁ। অত্যন্ত ভয়ংকর লোক।

বাসিলোঁ?

নামটা শুনেছ?

আমি অনেকদিন রোমে বাস করছি। সুতরাং শুনতেই পারি। নামটা চেনা চেনা ঠেকছে।

একটা মাফিয়া দলের সর্দার গোছের। আমার সঙ্গে আলাপও হয়েছিল।

বন্ধুত্বও হয়েছিল কি?

জিনা ব্যথিত গলায় বলল, আমাদের যা জীবন তাতে কত কিছু হয়। না, লোকটা আমাকে ব্যবহার করেছিল বটে, কিন্তু বন্ধুত্ব হয়নি। শোনো গোপীনাথ, আমি গুন্ডা বদমাশদের একদম পছন্দ করি না।

হাঁ, কথাটা বোধহয় আগেও বলেছ।

আর সেইজন্যই অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে ওখান থেকে বের করে এনেছি।

গোপীনাথ সামান্য উদ্বেগের গলায় বলল, কিন্তু ওরা তো তোমার ঠিকানা জানে জিনা।

জানে। তবু আমার ঠিকানায় তুমি নিরাপদ। আমি যদি পাড়ার লোকদের বলে রাখি তবে তারা এমন ব্যবস্থা করবে, যাতে বাইরের কেউ ঢুকতে পারবে না। আমার পাড়াটায় আমারই নানা আত্মীয়স্বজনের বাস। আমরা খুবই আত্মীয়বৎসল।

জিনা ক্রমশ রোমের ঘিঞ্জি একটা এলাকায় ঢুকে পড়ছিল। সরু সরু গলি, বাচ্চারা খেলছে, বউ-ঝিরা গল্পসল্প করছে। রাস্তাটা যেন রাস্তা নয়, বৈঠকখানা। পথে ঝগড়াঝাটিও হচ্ছে কোথাও কোথাও।

জিনা যে পাড়ায় ঢুকল সেটা প্রায় দমবন্ধ করা একটা গলি। বহু পুরনো পাড়া, বাড়িগুলো যেন একটা আর-একটার ওপর ভর করে আছে।

নামো।

শোনো জিনা, তোমাদের বাড়িতে কি আমি অনভিপ্রেত লোক নই?

না। কারণ তুমি বিপন্ন। বিপন্ন মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের পরিবারের সুনাম আছে।

গোপীনাথ নামল। জিনা গাড়িটা পথের পাশেই লক করে রেখে তাকে হাতে হাত ধরে নিয়ে চলল।

জিনাদের বাড়িটা আরও একটা গলির মধ্যে, যেখানে গাড়ি ঢুকবে না। বাড়িটা বেশ বড় এবং পুরনো। গলির পাথরে বাঁধানো রাস্তা থেকে সরাসরি বাড়ির সদর দরজায় উঠতে হয়, অনেকটা উত্তর কলকাতার গলিঘুজির মতোই।

দরজা খুলেছিল একজন বৃদ্ধা।

জিনা চাপা গলায় বলল, আমার পিসি। কথা বলার চেষ্টা কোরো না, বুড়ি কানে শোনে না।

তোমাদের কি যৌথ পরিবার?

না। আমরা মাত্রই কয়েকজন। ভাইরা বেশির ভাগই বিদেশে। আমি, মা, পিসি আর একজন কাকা।

তোমার বাবা?

বাবা নেই।

‘নেই’ কথাটার অনেক রকম মানে হয়। তবে গোপীনাথ আর বেশি জানতে চাইল না।

জিনা তাকে দোতলায় নিয়ে এল। একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, এই ঘরটাই আপাতত তোমার গাড্ডা। আমি বেরোচ্ছি তোমার টিকিটের ব্যবস্থা করতে। ইতিমধ্যে আমার মা তোমার দেখাশোনা করবে। তোমার কি খিদে পেয়েছে?

না। আমি একটু চোখ বুজে পড়ে থাকতে চাই।

বেশ কথা। শুয়ে থাকো। ভয় নেই, কোনও বিপদ হবে না। আমি পাড়ায় বলে যাচ্ছি।

জিনা বেরিয়ে এল। গোপীনাথ জুতোজোড়া খুলে রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। গভীর ক্লান্তি। অথচ ক্লান্তির কারণ নেই। গত দু’দিন সে কোনও পরিশ্রমের কাজই করেনি। তবে কি ভয় আর উদ্বেগই এই ক্লান্তির কারণ?

একটু বাদে দরজায় টোকা পড়ল। গোপীনাথ শক্ত হয়ে গেল হঠাৎ। চাপা গলায় বলল, ভিতরে আসুন।

খিটখিটে চেহারার এক বুড়ি ঢুকেই বলল, তুমি গোপীনাথ?

হ্যাঁ।

কী খাবে?

কিছু না।

কফি?

তারও দরকার নেই।

জিনা তোমার দেখাশোনা করতে বলে গেছে। আমি জিনার মা।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তোমার কি খুব বিপদ?

হ্যাঁ।

চিন্তা কোরো না। এখানে কিছু হবে না। তুমি নিরাপদ।

আপনাকে ধন্যবাদ।

ঘুমোও।

বুড়ি চলে গেল।

গোপীনাথ উঠে ঘরের ছোট জানালাটা দিয়ে গলিটা একটু দেখল। ডাইনে গলির মুখটায় কয়েকটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

কৌতূহলী গোপীনাথ গরাদহীন জানালা দিয়ে আরও একটু ঝুঁকে ছেলেগুলোকে দেখার চেষ্টা করতে যেতেই হঠাৎ বাড়ির নীচে আড়াল থেকে একটা অল্পবয়সি ছেলে বেরিয়ে তার দিকে চেয়ে ইতালিয়ান ভাষায় বলল, ভিতরে যাও। একদম জানালায় থেকো না। ওরা আসছে।

কারা আসছে?

মাফিয়ারা।

গোপীনাথ কেঁপে উঠল। বলল, কী করে জানলে?

আমাদের লোক চারদিকে আছে।

আমার জন্য তোমাদের যদি বিপদ হয়?

আমরা বিপদ পছন্দ করি। তুমি দয়া করে জানালা দিয়ে মুন্ডুটা বের কোরো না।

গোপীনাথ ছেলেটাকে ভাল করে দেখল। বছর কুড়ির বেশি বয়স নয়। রোগা লম্বা চেহারা।

গোপীনাথ বলল, আমার জানা দরকার ওরা আসলে কারা।

বাসিলোঁকে চেনো?

নাম শুনেছি। বা

সিলোঁ আর বেনভেনুটি। সঙ্গে ওদের আরও লোক আছে।

ওদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। পারবে না।

আগ্নেয়াস্ত্র আমাদেরও আছে। তার চেয়েও বড় কথা, এ পাড়ায় ঢুকবার আগে ওদের দু’বার ভাবতে হবে।

কেন বলো তো?

কারণ এখানে বাইরের লোক সুবিধে করতে পারে না।

গোপীনাথ ঘরের মধ্যে পিছিয়ে এল। এভাবে পালিয়ে থাকাটা তার কাপুরুষোচিত বলে মনে হচ্ছে।

কিন্তু বাসিলোঁ কে তা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। নামটা সে কার কাছে শুনেছে। ওদের কে লাগাল তার পিছনে?

গোপীনাথ ফের বিছানায় এসে শুয়ে রইল।

কিছুক্ষণ বাদে হঠাৎ একটা দৌড়োদৌড়ির শব্দ পেল গোপীনাথ। একটা শিস দেওয়ার শব্দও। সে তাড়াতাড়ি উঠে জানালাটা ফাঁক করে চোখ রেখে দেখল, গলিটা ফাঁকা। মোড়ের ছেলেরাও কেউ নেই। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে গোপীনাথ দরজা খুলে প্যাসেজে বেরিয়ে এল। এদিক ওদিক চাইতেই বাঁদিকে সিঁড়িটা দেখতে পেল সে। সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে উঠে এল গোপীনাথ। ছাদ থেকে ঝুঁকে দেখল, গলি ছাড়িয়ে আর একটু দূরের রাস্তায় একটা গাড়ি দাঁড়ানো। দু’জন লোককে নিয়ে কয়েকটা ছেলে। উত্তপ্ত কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। এখান থেকে শোনা গেল না।

গোপীনাথ তবু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে ভুলেই গিয়েছিল যে, সে ভোলা ছাদে দাঁড়ানো। তাকে রাস্তা থেকে দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ দুম করে একটা শব্দ, আর শিস তুলে একটা তীব্র গতির বুলেট তার মাথার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতেই কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এল তার। সে বসে পড়ল এবং হামাগুড়ি দিয়ে চলে এল সিঁড়ির মুখে।

সিঁড়ি দিয়ে দ্রুতগতিতে নেমে দোতলার প্যাসেজে একটু দাঁড়াল সে। রাস্তার ও দুটো লোককে সে চেনে। এরাই আগের রুমিং হাউসটার করিডরে বসে তাকে পাহারা দিত। মারতে চাইলে তো তখনই মারতে পারত। গোপীনাথের বিশ্বাস ছিল, সাক্কি বা ভিকিজ মব কেউই তাকে মারতে চায় না। মেরে লাভ কী? বরং গোপীনাথ বেঁচে থাকলেই তাদের লাভ। কিন্তু আজ সে বিশ্বাস আর গোপীনাথের রইল না। বুঝতে পারছে তাকে খুন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

রাস্তায় আরও দু’বার গুলির শব্দ হল। জিনা যে আশ্বাস দিয়েছিল তা কতটা নির্ভরযোগ্য কে জানে। পাড়ার ছেলেরা হয়তো প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে, কিন্তু প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে পারবে কি?

ঘরে এসে গোপীনাথ একটা চেয়ারে বসল। জানালার কাছে যেতে সাহস পেল না। একটু দূরে কোথাও আবার দুটো গুলির শব্দ হল। নীচের গলি দিয়ে একাধিক দৌড়পায়ের শব্দ এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মিলিয়ে গেল।

তারপরই তাকে চমকে দিয়ে টেলিফোন বেজে উঠল ঘরের মধ্যেই। প্রথমটায় টেলিফোনটা খুঁজেই পেল না গোপীনাথ। তারপর পেল। দেয়ালে ঝোলানো সবুজ রঙের টেলিফোনটা জংলা ছাপের ওয়াল পেপারের সঙ্গে এমন মিশে গেছে যে বোঝা যাচ্ছিল না।

আমি জিনা।

উত্তেজিত গোপীনাথ বলল, জিনা, এখানে ভীষণ বিপদ। গুলি চলছে।

গুলি?

হ্যাঁ। আমি অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। কিন্তু তোমার পাড়ার ছেলেদের কিছু হলে আমার লজ্জার সীমা থাকবে না।

জিনা শান্ত গলাতেই বলল, আমাদের এসব নিয়েই বাঁচতে হয়। তুমি ভেবো না।

না জিনা, আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। এর চেয়ে মরা ভাল।

বীর হওয়ার চেষ্টা কোরো না। মন দিয়ে শোনো। আজ রাত বারোটা নাগাদ এয়ার ইন্ডিয়ার একটা ফ্লাইট রোম হয়ে দিল্লি যাবে। আমি তার একটা টিকিট জোগাড় করেছি।

ঈশ্বর! তুমি তো অসম্ভব সম্ভব করতে পারো।

আমার এক বন্ধু ট্রাভেল এজেন্ট। সে সাহায্য করেছে।

কিন্তু এয়ারপোর্টে যাব কী করে?

আমি তোমায় ঠিক বের করে আনব। অনেক গোপন পথ আছে। আমাদের পাড়াটা একটি পাক্কা গোলকধাঁধা।

জিনা, এ সময়ে তোমার পাড়ায় আসা বিপজ্জনক।

বিপদ কেটে যাবে। ভেবো না। অপেক্ষা করো।

জিনা লাইন কেটে দিল।

গোপীনাথ উঠে ঘরের মধ্যে একটু পায়চারি করল। তারপর গিয়ে জানালাটা ফাঁক করে গলিটা দেখল। সন্ধের আলোয় গলিটা ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। কেউ কোথাও নেই।

গোপীনাথ মুন্ডু বের করে ভাল করে চারদিকটা দেখে নিল। মাফিয়ারা এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র কি?

দরজায় টোকা এবং জিনার মায়ের প্রবেশ, হাতে কফির কাপ।

একটু কফি খাও।

গোপীনাথ বলল, ধন্যবাদ। কফি না হলেও চলত।

তুমি নার্ভাস। কফি খেলে ভাল লাগবে। ওতে একটু ব্র্যান্ডি মেশানো আছে। খাও।

গোপীনাথ কফিতে চুমুক দিয়েই বুঝল, ভদ্রমহিলা জাতশিল্পী। ব্র্যান্ডি মেশানো কালো কফি কীভাবে করতে হয় তা দারুণ জানেন।

গোপীনাথ বলল, হ্যাঁ, আমি নার্ভাস। আমি আপনাদের খুব অসুবিধেয় ফেলেছি।

ভদ্রমহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, অসুবিধে কিছুই নয়। আমরা এরকম বিপদে প্রায়ই পড়ি। নিম্নবিত্ত ইতালিয়ানদের অবস্থা তুমি তো জানো না। আগে আমাদের কাছ থেকে তোলা আদায় করা হত। আন্তনিও সেসব বন্ধ করেছে।

আন্তনিও কে?

এ পাড়ার সে-ই মোড়ল। সে-ই সবাইকে এককাট্টা করে একটা বাহিনী গড়েছে। মাফিয়াবিরোধী গোষ্ঠী। হয়তো সে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবে না। কিন্তু একটু প্রতিরোধ তো হল। ইতালি শেষ হয়ে যাচ্ছে গুন্ডাবাজিতে।

জানি। আন্তনিওকে আমার নমস্কার জানাবেন।

আন্তনিও যদি সফল হয় তবে সারা রোমে এরকম প্রতিরোধ গড়ে উঠবে, দেখো।

তাই হোক।

আর আন্তনিও যদি মারা যায় তা হলে কী হবে বলা যায় না।

গোপীনাথ কফিটা শেষ করে বলল, উপায় থাকলে আমি আন্তনিওর দলে নাম লেখাতাম।

শুকনো মুখটা হাসিতে উদ্ভাসিত করে জিনার মা বলল, তোমাকে ধন্যবাদ। আন্তনিও শুনলে খুব খুশি হবে। জিনা কি তোমাকে ফোন করেছিল?

হ্যাঁ। আজ রাতেই আমি রোম ছাড়ছি। খু

ব ভাল। মাফিয়ারা লোক খুব খারাপ। যত তাড়াতাড়ি পালাতে পারো ততই ভাল।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

করো।

জিনা কেন স্ট্রিপটিজ করে?

ওটা ওর পেশা। খারাপ কী? আমাদের তো বাঁচতে হবে।

এটা তো খারাপ পেশা।

হয়তো তাই। বিশেষ করে এই এইডসের যুগে। তবে বেশিদিন নয়। জিনা হয়তো চাকরি পেয়ে যাবে।

জিনা ভাল মেয়ে। ওকে বলবেন স্ট্রিপটিজ মোটেই ভাল পেশা নয়।

বলব। তুমি যে ওর জন্য ভেবেছ তাতে খুশি হলাম।

নীচে ডোর বেল বাজল। উৎকর্ণ হল গোপীনাথ।

১৮.

জিনার পিসিই বোধহয় দরজা খুলল নীচের তলায়। একটি মেয়েলি কণ্ঠ কী যেন জিজ্ঞেস করল। তারপর একজোড়া লঘু পা উঠে এল ওপরে। একটু বাদে যে এসে ঘরে ঢুকল তাকে বালিকাই বলা যায়। পনেরো-ষোলো বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে। পরনে হালকা নীল রঙের পুলওভার, গরম কাপড়ের প্যান্ট, পায়ে ভারী রবার সোলের জুতো, মাথায় খুব রংদার একখানা রাশিয়ান কান-ঢাকা টুপি।

ঘরে ঢুকেই গোপীনাথের দিকে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে ইতালিয়ানে বলল, মারিয়া। আমি জিনার বন্ধু।

করমর্দন করে গোপীনাথ বলল, আমি গোপীনাথ।

জানি। জিনা তোমার হুবহু বর্ণনা আমাকে দিয়েছে।

জিনা কোথায়?

জিনা তোমার সঙ্গে এয়ারপোর্টে দেখা করবে। আমি এসেছি তোমাকে নিয়ে যেতে।

গোপীনাথ একটু অস্বস্তি বোধ করে বলল, তুমি! তোমার বয়স কম। তুমি কেন এসব বিপদের মধ্যে এলে?

মেয়েটি ভারী সুন্দর হাসি হেসে বলল, আমি বিপদ ভালবাসি।

গোপীনাথ তবু একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। একবার জিনার মায়ের দিকে তাকাল।

জিনার মা তার শুকনো মুখে বললেন, ওকে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। ও আন্তনিওর বোন।

আন্তনিওর বোন! তা হলে তো সত্যিই অবিশ্বাসের কিছু নেই। গোপীনাথ তৈরিই ছিল। উঠে পড়ে বলল, চলো।

আমি কিন্তু তোমাকে একটা মোটরবাইকে চাপিয়ে নিয়ে যাব। ভয় পাবে না তো?

না। ভয়ের কী আছে?

সবাই বলে আমি নাকি বড্ড জোরে চালাই।

রোমের রাস্তায় জোরে না চালানোই বুদ্ধির কাজ।

মারিয়া হাসল, জোরে না চালালে তোমাকে বের করে নিয়ে যাব কেমন করে? এ পাড়া থেকে বেরোবার মোট চারটে পথ আছে! চারটের মধ্যে তিনটে পথই ওরা বন্ধ করে দিয়েছে।

কীভাবে?

বন্ধ করেছে বলতে ওদের লোক তিনটে মোড়েই পাহারা দিচ্ছে। আন্তনিওর ভয়ে ভিতরে এসে হামলা করেনি। কিন্তু এ অবস্থা বেশিক্ষণ চলবে না। ওরা শেষ অবধি দল বাড়িয়ে ভিতরে ঢুকবে। তার আগেই তোমাকে বের করে নিয়ে যেতে হবে। তা ছাড়া সময়ও বেশি নেই।

চার নম্বর পথটা কি নিরাপদ।

মারিয়া ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবল। তারপর বলল, তুমি দশ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিতে পারবে?

অবাক হয়ে গোপীনাথ বলল, তার মানে?

চার নম্বর পথ বলতে কিছু নেই। কিন্তু একটা ছাদ ডিঙিয়ে ওপাশে পড়তে পারলে কোনও চিন্তা নেই। ও পাশে আমার মোটরবাইক রাখা আছে।

গোপীনাথ বলল, পারব।

তা হলে চলো। দেরি করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে।

আমার জন্য তোমরা অনেক ঝুঁকি নিচ্ছ।

ঝুঁকি আবার কীসের? এসব আমাদের কাছে জলভাত। মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের আরও বড় লড়াই করার আছে। চলো।

গোপীনাথ জিনার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল।

সিঁড়ি দিয়ে গোপীনাথের আগে আগে নামতে নামতে মারিয়া বলল, একটু দৌড়োতেও হবে। তুমি দৌড়োতে পারবে তো?

পারব। তবে গত এক সপ্তাহ আমি কোনও ব্যায়াম করিনি।

কিন্তু তোমার ফিগার তো ভাল। দেখতে বেশ শক্তপোক্ত।

হ্যাঁ। আমি সহজে কাবু হই না।

তা হলে পারবে।

রাস্তায় বেরিয়ে চারদিকটা দেখে নিয়ে মারিয়া বলল, গলির মুখে যে আড়াআড়ি রাস্তাটা দেখছ ওটাই দৌড়ে পার হতে হবে। কারণ ডানদিকে একটা প্রান্তে ওরা ওত পেতে আছে।

হ্যাঁ, ওদিক থেকেই ওরা আমাকে তাক করে গুলি চালিয়েছিল।

জানি। ওই রাস্তায় তোমার দিকে আবার গুলি চলতে পারে, যদি ওরা দেখতে পায়। তবে গলির মুখের বাতিগুলো আমরা নিবিয়ে দিয়েছি।

ওখানে তোমাদের পাহারা নেই?

মারিয়া মাথা নেড়ে বলল, আছে। তবে এটা একটা খোলা রাস্তা। বাইরের গাড়িটাড়ি যায়। কাজেই ওটা আমরা পুরোপুরি বন্ধ করতে পারিনি। করলে পুলিশ এসে ঝামেলা করবে, ট্রাফিক জ্যাম হবে।

বুঝেছি।

গলির মুখে এসে সাবধানে ডাইনে বাঁয়ে দেখে নিল মারিয়া। সামনের রাস্তায় খানিকটা সত্যিই অন্ধকার।

মারিয়া চাপা গলায় বলল, এবার আমাদের বাঁদিকে খানিকটা দৌড়ে যেতে হবে। ওই যে জলের কলটা দেখছ, ওর পিছনে ডানদিকের গলিতে ঢুকে যেতে হবে। তারপর নিশ্চিন্ত।

গোপীনাথ ব্যাগটা কাঁধের ওপর ফেলে বলল, চলো, আমি প্রস্তুত।

মারিয়া যত জোরে ছুটতে পারে তত জোরে গোপীনাথ পারে না। অন্তত এখন পারছে। দুশো মিটারের মতো পথ মারিয়া এক লহমায় পার হয়ে গেল। গোপীনাথ মাঝামাঝি পর্যন্ত যেতেই হাঁফাচ্ছিল। কে যেন সামনে থেকে চাপা গলায় বলল, জোরে জোরে দৌড়োও দেখতে পাবে।

জলের কলের কাছটায় পৌঁছেই গিয়েছিল গোপীনাথ। একেবারে শেষ সময়ে আচমকা দূর থেকে একটা গুলির শব্দ হল। কোথায় লাগল কে জানে, কিন্তু গোপীনাথ একটা ধাক্কা খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

দু’জোড়া পা ছুটে এল। দু’জোড়া হাত তাকে ধরে প্রায় হিঁচড়ে গলির মধ্যে নিয়ে গিয়ে ফেলল।

মারিয়া উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তোমার কোথায় লেগেছে?

গোপীনাথ উঠে দাঁড়িয়ে শরীরটাকে অনুভব করল। না, তার গায়ে গুলি লাগেনি। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে সে বলল, সত্তবত ব্যাগে লেগেছে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না।

মারিয়া বলল, পরে দেখা যাবে। চলো, সময় নেই।

যে দুটি ছেলে তাকে টেনে এনেছিল, তাদের দুজনের হাতেই পিস্তল। একজন এসে বলল, দূর থেকে চালিয়েছে বলে বেঁচে গেছ, নইলে ব্যাগসুষ্ঠু তোমাকে ফুটো করে দিত।

মারিয়া গলির মধ্যে তাকে নিয়ে আরও প্রায় দুশো মিটার গেল। কানা গলি। দারুণ ঘিঞ্জি। গলির শেষ প্রান্তের কাছাকাছি মারিয়া তাকে নিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকল। সরু সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে এল চার তলার ছাদে।

গোপীনাথ একটু হাঁফাচ্ছিল। ধকল কম যাচ্ছে না। ব্যায়াম নেই, তার ওপর উদ্বেগ ও অশান্তি তাকে খানিকটা কাহিল করে ফেলেছে।

মারিয়া ছাদের রেলিং-এর কাছে এসে বলল, ও পাশের ছাদটা মাত্র চার ফুট তফাতে। রেলিং-এ উঠে দাঁড়ালে অনায়াসে লাফিয়ে ওপাশে পড়া যায়। তুমি নার্ভাস নও তো?

গোপীনাথ বিবর্ণ মুখে হেসে বলল, আমার অন্য উপায় থাকলে এসব নিয়ে ভাবতাম। তবে এই লাফটা আমাদের প্রোগ্রামে তো ছিল না!

এটা ধর্তব্যের মধ্যে নয় বলে বলিনি।

মারিয়া রেলিং-এর ওপর উঠে দাঁড়াল। নীচে চারতলার ছাদ। কিন্তু সেটা গ্রাহ্য না করে বেড়ালের মতো একটা লাফ মেরে ও পাশের ছাদের রেলিং-এর ওপর চলে গেল। ছাদে নেমে হাত বাড়িয়ে বলল, তোমার ব্যাগটা দাও।

গোপীনাথ ব্যাগটা ওর হাতে চালান করে রেলিং-এর ওপর উঠল। উচ্চতার ভয় তার আছে, তবে এখন তার কাছে এগুলো কোনও ব্যাপার নয়। সে দাঁড়িয়ে একটু ঝুল খেল। তারপর খুব জোরে নিজেকে ছুঁড়ে দিল ওপাশে, এমনভাবে যাতে রেলিং-এ না থেমে ছাদে গিয়ে পড়া যায়। কিন্তু হিসেবের একটু ভুল হল গোপীনাথের। চমৎকার লাফটা দিলেও পা ভাল করে না গোটানোর ফলে পাশের ছাদের রেলিং-এ পা লেগে সে ও পাশের ছাদে গিয়ে পড়ল একেবারে কুমড়ো গড়াগড়ি খেয়ে।

মারিয়াই তাকে তুলে দাঁড় করাল, তোমার লাগেনি তো!

লেগেছে। ভালই চোট হয়েছে বাঁ হাঁটু আর বাঁ কনুইয়ে। শীতকাল বলে ব্যথাও হচ্ছে প্রচণ্ড। কিন্তু তা স্বীকার করে কী করে? সে বলল, না। তেমন কিছু নয়।

এসো, আমাদের সময় নেই।

মারিয়ার পিছু পিছু সে দোতলা অবধি নামল। বাড়িটা ফাঁকা এবং পোড়ো বলে মনে হচ্ছিল তার। জিজ্ঞেস করল, এটা কার বাড়ি?

এ বাড়িটা ভেঙে ফেলা হবে শিগগির। এসো।

তারা একটা ঝুল বারান্দার মতো জায়গায় এল। নীচে গলি।

নীচের দিকে চেয়ে গোপীনাথ আতঙ্কিত গলায় বলল, তুমি বলেছিলে দশ ফুট, কিন্তু এ তো দেখছি পনেরো ফুটের কম হবে না।

না, না, অত নয়। দশের জায়গায় বারো হতে পারে। পারবে না?

না পেরে উপায় কী?

শোনো। লাফ দেওয়ার সময় শরীরটাকে স্প্রিং-এর মতো করে নেবে। মাটিতে পড়েই পারলে গড়িয়ে নেবে একটু। তা হলে ইমপ্যাক্টটা টেরও পাবে না।

গোপীনাথ বলল, চেষ্টা করব।

আমি আগে নামছি।

মারিয়া রেলিংটা ডিঙিয়ে বিনা প্রস্তুতিতে লাফ দিল। অবিকল বেড়াল। পড়ল হাঁটু ভেঙে, পা আর হাতে চমৎকার ভর দিয়ে। এত অনায়াসে কাউকে এরকম নামতে দেখেনি গোপীনাথ। ব্যাগটা নীচে ফেলে সে-ও রেলিং ডিঙোল। তারপর নিজেকে ছেড়ে দিল ওপর থেকে। মারিয়ার নকল করেই নামল সে। কিন্তু গোঁড়ালি আর হাতের কবজি ঝিনঝিন করে উঠল লাফের ধাক্কায়। দাঁতে দাঁতে একটা জোর ঠোকাঠুকিও হল। তবু তেমন গুরুতর কিছুই ঘটল না।

মারিয়া তাকে ধরে গালে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে বলল, তুমি দারুণ লোক। এসো, ওই আমার বাইক।

গোপীনাথ দেখল মোটরবাইকটা মোটেই মেয়েলি নয়। বেশ শক্তিশালী এবং বড়সড়। দুটো হেলমেট রাখা ছিল সিটের ওপর। মারিয়া তাকে একটা পরিয়ে নিজেও পরল।

শুরু থেকেই গোপীনাথ বুঝল মারিয়া বিপজ্জনক মেয়ে। গলিটা যে স্পিডে পার হল তাতে গোপীনাথের হাত-পা শিরশির করে উঠল।

একটু আস্তে চালাও মারিয়া। এত স্পিড, আমি হয়তো উড়ে যাব।

মারিয়া একটা ডানমুখী মোড় ফিরে স্পিড কমিয়ে বলল, এটা রোম, এখানে খুব স্পিডে কি চালানো যায়? আচ্ছা, তোমার সম্মানে আমি স্পিড কমাচ্ছি, কিন্তু মনে রেখো আমাদের হাতে সময় নেই।

দা ভিঞ্চি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত মারিয়া বহুবার তার কথা ভঙ্গ করে মাঝে মাঝে এমন গতিতে চালাল যে গোপীনাথ মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে বসে থেকেও ভাবছিল বোধহয় বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে পিছনে। কিন্তু তারা পৌঁছোল অবিশ্বাস্য কম সময়ে।

নির্দিষ্ট টার্মিনালের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল জিনা। মুখে একটু উদ্বেগ।

এসেছ? বাঁচা গেল।

গোপীনাথ একটা অদ্ভুত আবেগ বোধ করল মেয়েটার প্রতি। কিছুক্ষণ আগেই এই জিনা এসেছিল তাকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু তার পরেই মেয়েটা নিল ত্রাতার ভূমিকা। জীবনটাই অদ্ভুত।

সে জিনার হাত আবেগে চেপে ধরে বলল, আমার জন্য তুমি এতটা করলে কেন?

জিনা একটু হাসল। বলল, সুযোগ পেলে পরে বলব।

আমি তোমার ঋণ কীভাবে শোধ করব বলল তো!

কেউ কারও কাছে ঋণী নয়। আমরা সবাই মানবতার জন্য যেটুকু পারি, করি।

জিনা, তুমি স্ট্রিপটিজ ছেড়ে দাও। তুমি তো সামান্য মেয়েমানুষ নও যে শরীর বেচে খাবে।

যাদের শরীর ছাড়া আর কিছু নেই তারা কী করবে বলো তো?

তোমার অনেক কিছু আছে জিনা। তুমি এক মহান নারী।

জিনা হাসল, এরকম কথা এর আগে আমাকে আর কেউ বলেনি। তুমিই প্রথম।

এটা তোষামোদ নয়। আমি আমার সত্যিকারের মনের কথা বললাম।

জানি। তোমার মুখ দেখে মনে হয় তুমি ধূর্ত নও। এই নাও তোমার টিকিট।

গোপীনাথ তার চেকবই বের করে সই করল। জিনার হাতে দিয়ে বলল, কিছু বেশি টাকা আছে, নিয়ো!

জিনা অবাক হয়ে বলল, কেন?

আমি চাই তুমি সাত দিন ছুটি নিয়ে কোথাও বেড়িয়ে এসো। এটা এক বন্ধুর প্রীতি উপহার।

জিনা চেকটা হাতে নিয়ে চোখ বড়বড় করে বলল, কিন্তু এ তো অনেক টাকা!

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, বেশি নয় জিনা, মোটেই বেশি নয়। তুমি তো জানো না মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগেও যখন মৃত্যুর মুখে বসে আছি তখন আমি উত্তরাধিকারী খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার টাকা পয়সা, ভিলা, গাড়ি কাকে দিয়ে যাব বলো তো! পাঁচ ভূতে লুটে নিত সব। এখনও আমার উত্তরাধিকারী নেই। আমি যদি মারা যাই আমারটা ভোগ করার কেউ নেই।

তা বলে এত টাকা!

টাকার অঙ্কটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। ওটা কিছু নয়।

জিনা তাকে হঠাৎ কাছে টেনে এনে গালে একটা পর একটার চুমু খেয়ে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।

গোপীনাথ আর একটা চেক তাড়াতাড়ি সই করে হাস্যমুখী মারিয়ার হাতে দিয়ে বলল, খুকি তোমাকে এটা দিচ্ছি কেন জানো? এটা ঘুষ। যত তাড়াতাড়ি পারো ওই মোটরবাইকটা ঝেড়ে ফেলে একটা গাড়ি কিনে নাও। দু’চাকা বড্ড বিপজ্জনক জিনিস।

চেকটার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে একটা শিস দিল মারিয়া। বলল, আমি জীবনে একসঙ্গে এত টাকা দেখিনি।

লজ্জিত গোপীনাথ বলল, বন্ধুর সামান্য উপহার।

ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে গোপীনাথ ভিতরের দিকে পা বাড়িয়ে একবার ফিরে তাকাল। দুটি মেয়ে তার দিকে করুণ গম্ভীর মুখ করে চেয়ে আছে। গোপীনাথ মুখ ফিরিয়ে নিল। তার কান্না আসছে।

মধ্যরাত্রির এখনও একটু দেরি আছে। সে বিমানবন্দরের বিবিধ বিধি অতিক্রম করে একসময়ে লাউঞ্জে পৌঁছে গেল। ডিসপ্লে মনিটার দেখল, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ রোম ছেড়ে যাবে।

গোপীনাথ একটা আরামদায়ক আসনে বসে গা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল। গত কয়েক ঘণ্টায় তার ওপর দিয়ে উদ্বেগ ও অশান্তির যে ঝড় বয়ে গেছে তার ফলে সে গম্ভীরভাবে ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত।

কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে। গোপীনাথের একটু ঝিমুনিও এসেছিল।

হঠাৎ কানের কাছে কে যেন পরিষ্কার বাংলায় বলল, বাঃ, এই তো চাই। আপনি তা হলে এসে গেছেন।

গোপীনাথ চমকে উঠে যাকে তার পাশের সিটে দেখল তার মতো অপ্রত্যাশিত লোক হয় না। তার শরীর হিম হয়ে গেল। পাশে বসে দাতা।

চমকে গেলেন নাকি?

আপনি?

আরে ভয় পাচ্ছেন কেন, সব কিছুর পিছনেই তো আমি।

তার মানে?

জিনা তো আমারই লোক।

গোপীনাথ হাঁ হয়ে গেল।

১৯.

আকস্মিক সাক্ষাৎকারের ধাক্কাটা সামলাতে গোপীনাথের কিছুক্ষণ সময় লাগল। লোকটা বাঙালি বটে, কিন্তু ঘটনাচক্রে এই লোকটাই ভিকিজ মব-এর প্যারিস শাখার চাঁই, আর ভিকিজ মব যে তার পরম শত্রু সেটা আর সন্দেহের অবকাশ রাখে না।

গোপীনাথ তার অশান্ত হৃদযন্ত্রকে কিছুক্ষণ সময় দিল শান্ত হতে। তারপর স্তিমিত গলায় বলল, আপনারা কী চান বলুন তো?

দাতা একটু হেসে বলল, আমরা কী চাই তা তো আপনার অজানা নয়। আমার বন্ধু পল প্যারিসে আপনার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছিল। এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রির সম্পূর্ণ কম্পিউটার প্রিন্ট আউট।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনি কি সায়েন্টিস্ট?

না। কিন্তু বন্ধু পল একজন ছোটখাটো বিজ্ঞানী। গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি কত বড় প্রোজেক্ট তা আপনি জানেন। পলকে আমি বুঝিয়ে বলেছিলাম অত বড় একটা কাজের হাজারো দিকের হদিশ দেওয়া সহজ নয়। তা ছাড়া আমি সাক্কি ছেড়ে দিয়েছি, এখন তা আরও অসম্ভব। আপনি তো জানেন, সাক্কি আমাকে কীভাবে নজরবন্দি করে রেখেছিল। আপনি আমাকে উদ্ধার করেছিলেন।

হ্যাঁ। তারপর আরও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, জিনা আপনার লোক অমি তা জানতাম না। জিনাকে আমার ভাল মেয়ে বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু ওখান থেকে আমাকে বের করে আনার নাটকটা করলেন কেন?

আপনি বেনভেনুটি আর বাসিলোঁকে চেনেন কি?

বাসিলোঁর নামটা শোনা।

হ্যাঁ, বেনভেনুটিও বিখ্যাত লোক। প্রাক্তন বক্সার। একটা মাফিয়া দলের নিচু দরের অপারেটর। নির্বোধ, কিন্তু ভয়ংকর। আপনার ওপর ওদের প্রতিশোধ নেওয়ার ছিল, কারণ রুমিং হাউস থেকে পালিয়ে এসে আপনি ওদের বিপদে ফেলেছিলেন।

তাই নাকি? আমি এত কিছু জানতাম না।

আপনি জিনার সঙ্গে পালিয়ে আসার মাত্র আধ ঘণ্টা আগে আমি খবর পাই যে, ওরা আসছে। জিনাকে সেইমতো সংকেত পাঠাই। জিনা আপনাকে নিয়ে পালিয়ে আসে।

জিনাকে কীভাবে সংকেত পাঠালেন? টেলিফোন তো বাজেনি।

দাতা হাসল, ইলেকট্রনিক্সের এই যুগে একজন বৈজ্ঞানিকের মুখে এই কথা? জিনার গলায় একটা সরু হার আছে, দেখেছেন? তার লকেটে….

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি। এবার কী হবে?

দাতা মাথা নেড়ে বলল, কিছু হবে না। আপনাকে আমি নির্ভয়ে কলকাতা পর্যন্ত যেতে দিচ্ছি। কলকাতায় আপনি আপনার নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকবেন। কেউ বাধা দেবে না। সেইখানে বসে ঠান্ডা মাথায় আপনি এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি-র ব্লু প্রিন্টটা তৈরি করবেন।

অসম্ভব!

জানি। আমরা আপনাকে সাহায্য করব। কিছু তথ্য আমরা আপনাকে দিচ্ছি। এগুলোকে লিঙ্ক আপ করা আপনার পক্ষে হয়তো সম্ভব। জিনিসটা একটা মারাত্মক পোর্টেবল ক্ষেপণাস্ত্র আমরা তার সবটুকু জানতে চাই। সবটুকু হলেও অনেকটাই আপনি জানাতে পারবেন।

কলকাতায় কি আমি নিরাপদ?

মৃদু একটু হেসে দাতা বলল, নিরাপত্তার গ্যারান্টি কে কাকে দিতে পারে বলুন তো?

আপনি পারেন। কারণ আপনার অর্গানাইজেশনই আমাকে হুমকি দিয়েছিল।

দাতা একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, আপনি বিজ্ঞানের মানুষ, নিজের কাজ নিয়ে থাকেন। পৃথিবীর অন্ধকার জগতের খবর রাখেন না। যদি রাখতেন তা হলে বুঝতেন, অপরাধের জগৎও কী বিপুল।

আপনি এই জগতে ঢুকলেন কেন?

সেটাও আমার কাজ। তবে আমার পা দু’নৌকায়। সেসব আপনি বুঝবেন না। বোঝার দরকারও নেই।

আন্তর্জাতিক একটা অপরাধ চক্রের চাঁই একজন বাঙালি, এ যে আমি ভাবতেই পারি না।

তা হলে ভাববার দরকার কী? ওসব না ভাবাই ভাল। বাঙালি একটা জাতিসূচক পরিচয় মাত্র। মানুষকে কত ভাবে বাঁচতে হয়।

দাতা তার পাশে রাখা একটা চামড়ার ব্যাগ খুলে একটা ফাইল বের করল। ফাইলটা তার হাতে দিয়ে বলল, এটা সঙ্গে রাখুন।

কী এটা?

এর মধ্যেই আপনার সাধের এক্স টু থাউজ্যান্ড থ্রি-র তথ্যগুলো আছে। সাজিয়ে নেওয়া আপনার কাজ।

আমার কলকাতার ফ্ল্যাটে কম্পিউটার নেই।

দাতা অবাক হয়ে বলল, কে বলল নেই?

আমিই বলছি। কলকাতায় খুব কম যাই, গেলেও বিশ্রাম নিই বলে কম্পিউটার রাখি না।

ওসব ভাববেন না। আপনার ফ্ল্যাটে গেলেই দেখতে পাবেন যে, সেখানে একটা কম্পিউটার বসানো রয়েছে।

গোপীনাথ হাঁ করে দাতার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আপনি তো সাংঘাতিক লোক?

বিনীতভাবে দাতা বলল, নানা, আমি তেমন কিছুনই। আসলে আমাদের অর্গানাইজেশনের হাত খুব লম্বা। তারা সব পারে।

তা বটে।

আর-একটা কথা। সাক্কি কিন্তু জানে যে, আপনি রুমিং হাউস থেকে পালিয়েছেন। তারা এটাও অনুমান করবে যে, আপনি ইতালি ছাড়ার চেষ্টা করবেন।

গোপীনাথ তটস্থ হয়ে বলল, তাই নাকি?

সেটাই তো স্বাভাবিক।

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, তা বটে।

সুতরাং একটু সাবধান থাকবেন।

কীরকম সাবধান?

তা জানি না। সেটা নিজেই ঠিক করে নেবেন।

আপনি কি আমার সঙ্গে এই ফ্লাইটেই যাবেন?

মাথা নেড়ে দাতা বলল, না। আমি যাব অন্য জায়গায়, অন্য কাজে। আপনার ভয় নেই, ভিকিজ মব আপনার পিছু নেবে না। যতদিন আমাদের কথা শুনে চলবেন ততদিন নয়।

আর সাক্কি?

সাক্কি একটা কোম্পানি। তারা তো গুন্ডামি করে না। কিন্তু প্রয়োজন হলে পেশাদার গুন্ডা লাগায়। তাদের গতিবিধি সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। আমি শুধু আপনাকে সতর্ক করতে পারি।

ধন্যবাদ।

লম্বা ও সুপুরুষ লোকটা উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে তার কাঁধে একটু চাপ দিয়ে বলল, চলি, এটা আমার টার্মিনাল নয়। আমার ফ্লাইট অন্য টার্মিনালে। কখনও দেখা হয়ে যাবে হয়তো।

গোপীনাথ কথা বলল না। শুধু হাতটা একবার তুলল।

লোকটা দ্রুত পদক্ষেপে লাউঞ্জ পেরিয়ে কোন দিকে যে চলে গেল তা বুঝতে পারল না গোপীনাথ। কিন্তু লোকটার গতিবিধি যে অবাধ তাতে সন্দেহ রইল না তার।

আরও আধ ঘণ্টা বাদে প্লেনে ওঠার নির্দেশ ফুটে উঠল মনিটরে। খুব ধীরে উঠল গোপীনাথ। এগোতে লাগল যন্ত্রের মতো। মাথায় চিন্তার ঝড়।

যখন সিকিউরিটির গাঁট পেরিয়ে প্লেনের ভিতরে ঢুকল তখনও তার গভীর অন্যমনস্কতা কাটেনি।

সাধারণত আইল সিট তার প্রিয়। আজ সে ইচ্ছে করেই আইল সিট নেয়নি। নিয়েছে জানালার ধার। প্লেনের পিছনে প্রায় টয়লেটের কাছাকাছি। পিছনে মাত্র দুটো রো।

অ্যাটাচি কেসটা পাশে নিয়েই বসল সে। ফাইলটা কোলের ওপর রেখে খুলল। কম্পিউটার প্রিন্ট আউট এবং মাইক্রো ফিমের অনেক কিছুই জোগাড় করেছে এরা। ফাইলটা বন্ধ করে অ্যাটাচি কেসটা খুলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল সে। কেসটা সিটে তার শরীর ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে রেখে সে বসল।

গভীর রাত। প্লেনে অনেক ভারতীয় যাত্রী। বাংলা কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছে সে। কিন্তু তার ভারতীয়ত্ব অর্ধমৃত। দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাসের ফলে বাঙালি বা ভারতীয় দেখলেই আজকাল আর হামলে পড়তে ইচ্ছে যায় না।

পাশের সিট দুটো খালি ছিল। একজোড়া স্বামী-স্ত্রী এসে বসল এবং গোপীনাথ খুব অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। কারণ দু’জনেই বাঙালি। মহিলাটি শাড়ি পরা, সিঁথিতে সিঁদুর। সে বাঙালি টের পেলেই আলাপ জমানোর চেষ্টা করবে।

গোপীনাথ ঘুমের ভান করে সিটে এলিয়ে রইল।

হঠাৎ শুনতে পেল মহিলাটি তার স্বামীকে খুব চাপা গলায় বলল, হ্যাগো, ভদ্রলোককে বললে জানালার পাশের সিটটা ছেড়ে দেবে না?

আরে নাঃ, ওসব বলতে গেলে রেগে যাবে হয়তো।

রাগবে কেন? ভালভাবে বললে ঠিক ছেড়ে দেবে। মুখ দেখে তো ভাল লোকই মনে হচ্ছে, বোধহয় বাঙালিই।

তোমার মাথা। জানালার পাশে বসেই বা কী দেখবে? বাইরের কিছু দেখা যায়?

আহা, আজ চাঁদ উঠেছে দেখোনি? জানালার পাশে বসে জ্যোৎস্না দেখব।

দেখতে হবে না। ঘুমিয়ে পড়ো। গত কুড়ি দিনে অনেক কিছু দেখেছ। জ্যোৎস্নাটা বাদ দাও।

অনেক কিছু না হাতি। প্যাকেজ টুরে কিছু কি দেখা যায়? লুভ্র মিউজিয়ামটায় মাত্র একদিন নিয়ে গেল। রোমও তো কিছু দেখা হল না।

আচ্ছা, পরে আবার আসা যাবে।

আর এসেছ! এবার আসতেই কত সাধাসাধি করতে হয়েছে।

ছেলেমেয়ে রেখে বিদেশ বেড়াতে আমার ভাল লাগে না বলেই আপত্তি ছিল।

ওরা এখন বড় হয়ে গেছে। অত চিন্তা করো কেন বলো তো পুরুষমানুষ হয়ে?

আমার মন তোমার মতো শক্ত নয়।

মহিলা বললেন, এরা কিন্তু আমাদের খুব খাওয়ার কষ্ট দিয়েছে। এরকম জানলে এদের সঙ্গে আসতামই না। খেতে গিয়েই তো টাকা সব ফুরিয়ে গেল, মার্কেটিং হলই না।

আর মার্কেটিং! ইউরোপে যা জিনিসের দাম? ওসব মার্কেটিং দেশে করলে দশ ভাগের এক ভাগ দামে পাওয়া যেত।

ওগো, ভদ্রলোক বোধহয় ঘুমোননি। হাঁটু নাড়ছেন। বলবে?

আরে না, প্লেনে যে যার সিট বেছে নেয়। বললে রেগে যাবে।

আমি বাজি ফেলতে পারি, ভদ্রলোক বাঙালি।

বাঙালিরা তো আরও প্রতিবাদী হয়।

ধ্যাত, তুমি কোনও কাজের নও।

গোপীনাথ আর পারল না। চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে ভদ্রমহিলার দিকে চেয়ে বলল, আসুন, আপনি এই সিটে বসুন।

মহিলা জিভ কেটে হেসে ফেললেন, এ মা, আপনি আমার কথা শুনতে পেলেন নাকি?

না না, একদম শুনতে পাইনি। কিন্তু আকাশে আজ যে জ্যোৎস্নাটা উঠেছে সেটা মনে হল এক্সক্লুসিভলি মহিলাদের জন্যই। আসুন, লজ্জার কিছু নেই।

একটু ‘না না’ করে ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা জানালার দিকে সরে গেলেন। গোপীনাথ আইল সিটে বসল। ওপরের ক্যাবিনেটে অ্যাটাচি রাখতে ভরসা পাচ্ছে না। পাশেই রাখল।

ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এনআরআই?

কী করে বুঝলেন?

বোঝা যায়।

হ্যাঁ, আমি এনআরআই-ই বটে।

আমার নাম গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি।

আমি গোপীনাথ বসু।

কোথায় থাকেন?

রোমে।

দু-চার কথা আলাপ জমে উঠছিল। কিন্তু এই আলাপটা খুব একটা চাইছিল না গোপীনাথ। তার চারদিকে নজর রাখা দরকার। সে আড়চোখে ভিতরটা দেখে নিয়েছে। সন্দেহজনক কিছু দেখতে পায়নি। সামনের দিকে কয়েকজন বিদেশি আছে বটে, কিন্তু তারা মাফিয়া কি না কে বলবে।

গৌরাঙ্গ কিছুক্ষণ কথা বলে ঘুমিয়ে পড়ল। কেবিন লাইটগুলো নিভে গেল একে একে। প্লেন ভেসে চলেছে আকাশের অনেক ওপর দিয়ে।

আজ রাতে গোপীনাথের ঘুম আসবে না। সে মাথাটা এলিয়ে রেখে চোখ বুজে রইল। সামনে অনিশ্চিত একটা সময়। সে নিজের পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না।

ঘণ্টাখানেক বাদে হঠাৎ সে একটু চমকে উঠল। সামনের চারটে রো আগে একটা লম্বা লোক আধো অন্ধকারে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। লোকটা বিদেশি। লোকটা পিছনের দিকে আসছে।

অ্যাটাচি কেসটা শক্ত করে চেপে ধরল গোপীনাথ। লোকটা তাকে পেরিয়ে টয়লেটের দিকে চলে গেল। একটু বাদে ফিরে গেল নিজের সিটে।

গোপীনাথ ভাবল, আমার কি রজ্জুতে সর্পভ্রম হচ্ছে?

ঘড়িতে যখন রাত তিনটে তখনই পূর্ব দিগন্তে সূর্যোদয় ঘটে গেল। প্লেনের ভিতরটা ঝলমল করে উঠল সকালের আলোয়।

গৌরাঙ্গ একটা হাই তুলে বলল, সকাল হয়ে গেল বুঝি?

হ্যাঁ। আমরা পুবদিকে যাচ্ছি তো, তাই।

বেশ মজার ব্যাপার। আচ্ছা, এরা ব্রেকফাস্ট কখন দেবে?

দেবে।

লোকটা টয়লেটে গেল। মহিলা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। এঁরা কষ্ট করে ইউরোপ ভ্রমণ করে এলেন প্যাকেজ ট্যুরে। এই টুরগুলো মধ্যবিত্ত বাজেটে বাঁধা থাকে বলে খানিকটা কষ্ট হয়।

গোপীনাথ খুব সন্তর্পণে চারদিকটা দেখল। টয়লেটে যাওয়া দরকার, কিন্তু অ্যাটাচি কেসটা কারও জিম্মায় না দিয়ে যায় কী করে? একটু অপেক্ষা করার পর গৌরাঙ্গ ফিরলে সে বিনীতভাবে বলল, দয়া করে অ্যাটাচি কেসটা একটু নজরে রাখবেন? আমি টয়লেট থেকে আসছি।

গৌরাঙ্গ অবাক হয়ে বলল, উড়ন্ত প্লেন থেকেও চুরিটুরি হয় নাকি?

গোপীনাথ একটু লজ্জা পেল। বাস্তবিক, প্রস্তাবটাই অবাস্তব। মৃদু হেসে বলল, কত কী হয়।

গৌরাঙ্গ বলল, আমার অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের তেমন অভিজ্ঞতা নেই। ঠিক আছে, আপনি যান।

টয়লেট থেকে যখন ঘুরে এল গোপীনাথ তখন বারো-তেরো মিনিট কেটেছে। এসে দেখল, অ্যাটাচি নেই, গৌরাঙ্গ নেই। শুধু মহিলাটি ঘুমোচ্ছন।

আতঙ্কে খানিকক্ষণ স্ট্যাচু হয়ে রইল গোপীনাথ। তারপর ভদ্রমহিলাকে হাঁটুতে ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে হিংস্র গলায় বলল, আপনার হাজব্যান্ড কোথায়?

মহিলা ভয় পেয়ে সোজা হয়ে বললেন, জানি না তো! আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম।

সর্বনাশ! বলে গোপীনাথ সামনের দিকে দ্রুত পায়ে ছুটে গেল। উড়ন্ত প্লেন থেকে কেউ কখনও পালাতে পারেনি। সুতরাং লোকটাকে ধরা যাবেই।

ধরা গেল সহজেই। গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি খাবারের ঘরের সামনে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে একজন এয়ার হোস্টেসের সঙ্গে গল্প করতে করতে কফি খাচ্ছে। গোপীনাথের অ্যাটাচি কেস তার ডান হাতে। গোপীনাথ গিয়ে তার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল সেটা।

লোকটা অবাক হয়ে বলল, ও আপনি? আমি ভাবলাম ছিনতাই হচ্ছে বুঝি। ভাবলাম, যখন দেখতে বলে গেছেন তখন অ্যাটাচি কেসটায় গুরুতর জিনিস আছে। তাই এটা নিয়েই কফি খেতে এসেছিলাম।

গোপীনাথ অপ্রস্তুতের একশেষ। মৃদু স্বরে বলল, আমাকে ক্ষমা করবেন।

২০.

গোপীনাথ বুঝতে পারছে পরিস্থিতির চাপে সে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। নার্ভাস, নির্বোধ ও কাণ্ডজ্ঞানশূন্য। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ না আনতে পারলে সে হয়তো আরও বোকার মতো কাণ্ড করে ফেলবে। গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলির হাত থেকে অ্যাটাচি কেসটা কেড়ে নিয়ে সে এমন একটা কাণ্ড করল যা আশেপাশের সকলের চোখে পড়েছে।

নিজের সিটে ফিরে এসে সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। মিসেস গাঙ্গুলির ঘুম সে এমন ভাবেই ভাঙিয়ে দিয়েছে যে ভদ্রমহিলা জড়সড় হয়ে বসে ভিতু ভিতু চোখে মাঝে মাঝে তাকে দেখছে। বড় লজ্জা করছে গোপীনাথের। ভদ্রমহিলার হাঁটু সে খিমচে দিয়েছিল।

গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি সিটে ফিরল আরও প্রায় দশ মিনিট পর। বউকে বলল, গুহবাবুর সঙ্গে দেখা করে এলাম। পরশু পাস্তা খেয়ে পেট খারাপ হয়েছিল। এখন ভাল আছেন।

বউ একটু গুম হয়ে আছে। শুধু বলল, ও।

এখনই বউটি ফিসফিস করে গৌরাঙ্গর কাছে এবং গৌরাঙ্গ ফিসফিস করে বউয়ের কাছে তার বিষয়ে বলবে। তখন গোপীনাথের ভাবমূর্তি যে এদের কাছে কী হবে তা ভাবতেই গোপীনাথের বড্ড লজ্জা হচ্ছে। ফিরে আসার পর গৌরাঙ্গ বা তার বউ তার সঙ্গে কথা বলছে না, এটাও অস্বস্তিকর। যদিও প্লেন থেকে নেমে যাওয়ার পর আর কারও সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে না, তবু একটা বিচ্ছিরি ঘটনার তেতো স্বাদ থেকে যাবে। গোপীনাথ তাই এদের সঙ্গে সম্পর্কটা সহজ করার উপায় ভাবতে লাগল।

হঠাৎ একজন তরুণী এয়ার হোস্টেস তাদের সামনে এসে মিসেস গাঙ্গুলিকে ইংরিজিতে জিজ্ঞেস করল, মিস্টার গোপীনাথ বসুর এই সিটে বসার কথা। তিনি কোথায়?

গাঙ্গুলির বউ থতমত খেয়ে গোপীনাথকে দেখিয়ে দিয়ে বাংলায় বলল, উনি এই সিটে ছিলেন।

এয়ার হোস্টেস নিচু হয়ে প্রায় তার কানে কানে বলল, ইউ আর ওয়ান্টেড অন দি ফোন স্যার। ইটস ইন্টারপোল!

ইন্টারপোল! গোপীনাথ তটস্থ হল। ইন্টারপোল তাকে চাইছে কেন?

এবার সে আর অ্যাটাচি কেসটা সঙ্গে নিল না, গৌরাঙ্গকে দেখতেও বলে গেল না। সেটা পড়ে থাকল তার সিটে। যাক, ওইটুকুই তার গৌরাঙ্গ আর তার বউয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা।

টেলিফোনে নির্ভুল দাতার কণ্ঠস্বর, কেমন আছেন?

ভালই।

কোনও ঘটনা ঘটেনি তো!

না। আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন?

প্যারিস। শুনুন, আপনার পিছনে দুটি ছায়া আছে।

তার মানে?

ইউ আর বিয়িং শ্যাডোড বাই টু অপারেটর্স।

তারা কারা?

সাক্কির ভাড়া করা মাফিয়ারা।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, কী করব বলুন তো!

সতর্ক থাকবেন।

সতর্কই আছি।

আমার অনুমান ওরা প্লেনের ভিতরে কিছু করবে না।

কোথায় করবে এবং কী করবে সেটাই জানা দরকার।

কিছুই বলা যায় না। আপনি যে তিমিরে আমিও সেই তিমিরে। আপনি ভয় পাননি তো?

যথেষ্ট নার্ভাস বোধ করছি। কারণ আমি তো বিপজ্জনক জীবন যাপন করি না। এসব অভিজ্ঞতা নতুন।

তা হলে অভিজ্ঞতাটা হোক। জীবনের এসব দিক সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা দরকার।

তাই দেখছি।

এবার ভাল করে শুনুন। আমার কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছেন তো! পাচ্ছি। আর ঘণ্টা দেড়েক বাদে আপনার প্লেন দিল্লিতে নামবে। নামবার সময় আপনি মোটেই তাড়াহুড়ো করবেন না। আপনার আগে অন্য সবাইকে নামতে দেবেন। প্রত্যেকটা লোককে ওয়াচ করার চেষ্টা করবেন।

ঠিক আছে। অ্যাটাচি কেসটা কখনও হাতছাড়া করবেন না। গোপীনাথ একটু শঙ্কিত গলায় বলল, কিন্তু এখন তো ওটা আমি সিটে রেখে এসেছি। সর্বনাশ। তা হলে! ওতে যা আছে সেগুলো তো কপি মাত্র। আপনার সঙ্গে তো আরও কপি আছে।

আছে আবার নেইও। ওতে এমন কিছু ইনফর্মেশন আছে যা হাতছাড়া হলে আমাদের হয়তো তেমন ক্ষতি হবে না, কিন্তু শত্রুপক্ষ বিরাট দাও মেরে দেবে।

আমি সিটে ফিরে যাচ্ছি। শুনুন। যে দু’জন অপারেটর আপনাকে ফলো করছে তাদের চোখে ধুলো দিতে হবে যেমন করেই হোক। কথাটা খেয়াল রাখবেন।

চেষ্টা করব। ফোন রেখে গোপীনাথ দ্রুত পায়ে নিজের জায়গায় ফিরে এল। অ্যাটাচি কেসটা রয়েছে জায়গামতোই। আছে গৌরাঙ্গ এবং তার বউও। তবে গৌরাঙ্গ তার দিকে কেমন যেন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে।

সে বসার পর কিছুক্ষণ ফাঁক দিয়ে গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি হঠাৎ মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

নিশ্চয়ই। করুন না।

আপনার অ্যাটাচি কেসটায় কী আছে জানি না, কিন্তু আপনি কি কোনও বিপজ্জনক বা গোপনীয় জিনিস নিয়ে যাচ্ছেন? আপনি উঠে যাওয়ার পর একটা কালোমতো লোক ওদিক থেকে এসে অ্যাটাচিটা হাতে নিয়ে বলল, মিস্টার বোস এটা চাইছেন, নিয়ে যাচ্ছি।

বলেন কী?

ঠিকই বলছি। লোকটা খুব লম্বা, অন্তত ছ’ফুট দু’ইঞ্চি হবে। ব্ল্যাক।

আপনি কী করলেন?

আমি বললাম, না, অ্যাটাচিটা আপনি আমার হেফাজতে রেখে গেছেন। সুতরাং দরকার হলে আমি নিয়ে যাব।

আপনাকে ধন্যবাদ। লোকটা কী করল?

ইংরিজিতে বলল, আপনার নাকি খুবই দরকার অ্যাটাচিটা না হলেই নয়। একটু টানাহ্যাঁচড়াও করছিল।

তারপর?

গায়ের জোরে পারতাম না। কিন্তু হঠাৎ দু’জন এয়ার হোস্টেস এসে পড়ল। তারা লোকটাকে বলল নিজের জায়গায় চলে যেতে। লোকটা বিড়বিড় করে বোধহয় গালাগাল দিতে দিতেই চলে গেল সামনের দিকে।

লোকটা কোথায় বসেছে বলুন তো!

জানি না। সামনের কোথাও হবে।

আপনাকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! আপনার সঙ্গে আমি একটু অভদ্র ব্যবহারও করেছি। বিশেষ করে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে। আপনারা দুজনেই আমাকে মাপ করে দেবেন। আমি একটা বিশেষ টেনশনের মধ্যে রয়েছি।

আরে তাতে কী হয়েছে? আমরাও বলাবলি করছিলাম যে আপনার একটা টেনশন চলছে।

সম্পর্কটা সহজ হওয়ায় একটা শ্বাস ফেলল গোপীনাথ। তারপর অ্যাটাচিটা খুলল।

গাঙ্গুলি পাশ থেকে আড়চোখে অ্যাটাচির অভ্যন্তরটা দেখে নিয়ে বলল, ইম্পর্ট্যান্ট পেপার্স।

হ্যাঁ।

কাগজপত্র ঠিক আছে দেখে ফাইলটা বন্ধ করে অ্যাটাচিটা ফের পাশে রাখল সে। ব্রেকফাস্ট আসছে। আর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই দিল্লি।

ব্রেকফাস্টে মোটেই মন বসাতে পারছিল না সে। পাশের গাঙ্গুলিরা অবশ্য গোগ্রাসে খাচ্ছিল। খাওয়ারই কথা। ট্রাভেল এজেন্টদের সঙ্গে ইউরোপ ঘোরা মানেই খাওয়ার কষ্ট। গোপীনাথ যতদূর জানে ওরা ব্রেকফাস্ট ছাড়া মোটে আট-দশটা রাউন্ড মিল দেয়। সুতরাং ডিনার আর লাঞ্চ খেতে হয় নিজের পয়সায়, যেটা অধিকাংশ ভারতীয় ভ্রমণকারীই পেরে ওঠে না। ইউরোপে খাবারদাবারের দাম এঁদের পথে বসিয়ে দেয়।

বেশ ভাল ব্রেকফাস্ট খাওয়ায় তো এরা।

হ্যাঁ। ইচ্ছে করলে কোনও আইটেম আবার চাইতে পারেন।

গাঙ্গুলি তার বউয়ের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কিছু নেবে?

না বাবা, অনেক খেয়েছি।

গাঙ্গুলি বলল, কলকাতায় যাবেন নাকি?

হ্যাঁ।

কোথায় থাকেন?

গোপীনাথ কথাটা চেপে গিয়ে বলল, দেশের সঙ্গে বহুকাল সম্পর্ক নেই। হোটেলেই থাকতে হবে।

গ্র্যান্ড নাকি?

দেখা যাক।

আপনারা যারা বিদেশে থাকেন তারা বেশ আছেন। অঢেল পয়সা। আমরা গ্র্যান্ডে এক রাত্রি কাটানোর কথাও ভাবতে পারি না।

হোটেলে থাকা কি ভাল?

টুকটুক এসব কথাবার্তায় সময় কেটে যাচ্ছিল। অবশেষে সিটবেল্ট বাঁধা ও সিগারেট নিবিয়ে দেওয়ার নির্দেশ ঘোষিত হল। তারপর অবতরণের সূচনা।

গোপীনাথ মনে মনে সংযত ও শক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। সামনেই কি বিপদ?

প্লেন টার্মিনালের গায়ে যখন এসে ঠেকল তখন যাত্রীদের মধ্যে নামবার বেশ হুড়োহুড়ি। গাঙ্গুলিরাও ব্যস্তসমস্ত।

গৌরাঙ্গ বলল, নামবেন না? কলকাতার ফ্লাইট এখনই ছাড়বে। আজ ডিরেক্ট ফ্লাইট।

হা নামব। আপনারা এগোন, আমি যাচ্ছি।

গৌরাঙ্গ সস্ত্রীক আর অপেক্ষা করল না। ঘরমুখো বাঙালিকে ঠেকায় কার সাধ্য।

গোপীনাথ অপেক্ষা করল। প্লেনের পিছন দিকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। যখন সব লোক দরজার কাছ বরাবর চলে গেছে তখন হঠাৎ গোপীনাথের মনে হল কাজটা ঠিক হচ্ছে না। যদি কেউ বাথরুম টয়লেটে লুকিয়ে থেকে থাকে তবে এই তার সুযোগ। সে চট করে উঠে পড়ল এবং দ্রুত পায়ে এগোতে লাগল সামনের দিকে।

সিদ্ধান্তটা যে সে ঠিকই নিয়েছে সেটা বুঝতে পারল সঙ্গে সঙ্গেই। পিছনে একটা ক্লিক শব্দ শুনে চট করে পিছনে তাকিয়ে সে একটা লোককে দেখতে পেল। লোকটা মাঝারি উচ্চতার এক সাহেব। চওড়া কাঁধ এবং বিশাল স্বাস্থ্য। লোকটা তার দিকে চিতাবাঘের মতো ছুটে আসছিল।

গোপীনাথ জীবনে কখনও শারীরিক সংঘর্ষে যায়নি। আসলে যেতে হয়নি তাকে। কিন্তু এই পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে আত্মরক্ষার্থে তাকে ঘুরে দাঁড়াতে হল। ছুটে দরজা অবধি যাওয়ার সময় ছিল না। কেউ পিছু ফিরে দেখতও না কী হচ্ছে।

লোকটার হাতে একটা ছোরার মতো জিনিস। মারবে নাকি? লোকটা তার ওপর এসে পড়ার আগেই গোপীনাথ গিয়ে পড়ল লোকটার ওপর, হিংস্র আক্রোশ এবং সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানরহিত হয়ে। কী করে লোককে মারতে হয় তা জানে না গোপীনাথ। তার সম্বল শুধু রাগ।

আর সেই রাগটাই পেশাদার মাফিয়া গুন্ডার বিরুদ্ধে আশ্চর্য সফল হয়ে গেল। গোপীনাথ লম্বা মানুষ, পায়ে একজোড়া ভারী ইতালিয়ান জুতো। সে তার লম্বা পায়ে লোকটাকে সরাসরি একটা জম্পেশ লাথি কষাল অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। লোকটা নিশ্চয়ই মারপিটের কৌশল জানে। বাগে পেলে গোপীনাথকে হালুয়া বানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু গোপীনাথ যে উলটে আক্রমণ করবে এটা প্রত্যাশা করেনি বলেই লাথিটা খেয়ে গেল লোকটা এবং উলটে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল দু’সারি আসনের মাঝখানে অপরিসর জায়গাটায়। পড়ার সময় সিটের হাতলে মাথাটা ঠুকেও গেল খুব জোরে।

গোপীনাথ দ্রুত দরজায় কাছে পৌঁছে গেল। শেষ চার-পাঁচজন যাত্রী বেরিয়ে যাচ্ছে। গোপীনাথ তাদের সঙ্গেই বেরিয়ে এল।

লাউঞ্জ পেরিয়ে কলকাতার প্লেন ধরার জন্য আর একটা লাউঞ্জে পৌঁছে গেল সে। কলকাতায় ফ্লাইটের ঘোষণা চলছে লাউড স্পিকারে।

গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি আর তার বউ মুষ্টিমেয় কলকাতা-যাত্রীদের মধ্যে বসা। গৌরাঙ্গ তাকে দেখে বলে উঠল, দেরি হল যে!

একটু কাজ ছিল।

আসুন মশাই, বসুন এখানে। মেলা জায়গা। কলকাতার যাত্রী তো দেখছি নেই-ই।

সাবালক হওয়ার পর জীবনে এই প্রথম আজ সে একটা শরীরী সংঘর্ষে গেল। আর লাথি খেয়ে একটা লোক এখনও ওই প্লেনের মেঝেয় পড়ে আছে। ঘটনাটা এখনও বিস্মিত ও উত্তেজিত রেখেছে তাকে। সে বসে রুমালে মুখ মুছল। তারপর উঠে গিয়ে কল থেকে জল খেয়ে এল। ধাতস্থ হতে একটু সময় লাগল তার।

গৌরাঙ্গ বলল, আপনাকে একটু রেস্টলেস লাগছে। শরীর ঠিক আছে তো?

আছে।

গৌরাঙ্গের বউ ওপাশ থেকে বলল, ওঁর কী সুন্দর ফিগার দেখছ না? শরীর খারাপ হবে কেন?

ফিগারের প্রশংসায় খুশি হওয়ার মতো অবস্থা এখন তার নয়। তবু ভদ্রতার হাসি হাসল সে।

গৌরাঙ্গ বলল, তা অবশ্য ঠিক। আপনার স্বাস্থ্যটা হিংসে করার মতোই। আপনি কী করেন বলুন তো?

চাকরি।

কোথায়?

রোমে।

বেশ আছেন। প্রাচীন শহর, কত কী দেখার আছে। আমাদের তো রোমটা দেখালই না। যাওয়ার সময় দু’দিন মাত্র ছিলাম। দু’দিনে আর কী দেখা যায় বলুন। ওই কলোসিয়ামটিয়াম যা একটু দেখাল। ফেরার সময় লন্ডন থেকে ছেড়ে দিল টিকিট দিয়ে।

আপনারা কি রোম থেকে ওঠেননি?

না মশাই, না। রোমে প্লেন আসতেই আমরা হ্যান্ডব্যাগট্যাগ নিয়ে টার্মিনালে গিয়ে উকিঝুঁকি মারলাম একটু।

তাই বলুন।

কলকাতার বিমানে ওঠার নির্দেশ ঘোষিত হল। গোপীনাথ চারদিকে নজর রাখছিল। না, লাথি খাওয়া লোকটাকে দেখা যাচ্ছে না।

বিশাল এয়ারবাসের অভ্যন্তরে যাত্রীসংখ্যা ত্রিশ-চল্লিশ জন হবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসার পরও অভ্যন্তরটা হাঁ হাঁ করছিল।

গৌরাঙ্গদের পাশাপাশি সিট পড়েছিল তার। কিন্তু নির্দিষ্টসিটে বসার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সুতরাং সে বসল গৌরাঙ্গদের পিছনের সারিতে জানালার ধারে।

প্লেন ছাড়তে কি একটু বেশি সময় নিচ্ছে? এখনও দরজা খোলা। কেউ কি উঠবে আরও?

গোপীনাথের বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। একটা দীর্ঘকায় লোক দরজা দিয়ে ঢুকেই সামনে একজিকিউটিভ ক্লাসের দিকে চলে গেল না! লোকটা তো কালোই মনে হল!

আরও কিছুক্ষণ দরজাটা খোলা রইল। একেবারে শেষ সময়ে গোপীনাথকে শিহরিত করে ঢুকল লাথি-খাওয়া লোকটা। গতি ধীর। একবার প্লেনের পিছন দিকে তাকাল। তারপর সামনের একজিকিউটিভ ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল।

গোপীনাথ একটু ঘাবড়ে গেল। ফের নিজেকে সংযত করে নিল। একটা লাথি তত দিতে পেরেছে। ভয় কী?

২১-২৫. কলকাতা অবধি সময় লাগে

কলকাতা অবধি সময় লাগে পৌনে দু’ঘণ্টার মতো। এই পৌনে দু’ঘণ্টায় কী কী ঘটতে পারে তার সম্ভাবনা নিয়ে গম্ভীরভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করছিল গোপীনাথ। কিন্তু মানসিক চঞ্চলতা তাকে নিবিষ্ট হতে দিচ্ছে কই?

প্লেন আকাশে উঠল বেশ কিছুক্ষণ পর। গোপীনাথ তার অ্যাটাচি আঁকড়ে বসে রইল সিটে। কিন্তু শক্ত হয়ে। প্রতিটি মিনিট কাটছে যেন ঘণ্টার লয়ে।

শীতের মেঘমুক্ত আকাশে প্লেনের গতি অতি মসৃণ। কোনও ঝাঁকুনি নেই, হেলদোল নেই। ছোট একটা পরদায় দেখানো হচ্ছে একটা ডকুমেন্টারি। গোপীনাথ সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেও বুঝতে পারল না, ডকুমেন্টারিটা কী বিষয়ে। বাইরে উজ্জ্বল রোদ, নীল আকাশ, নীচে সবুজের বিস্তার। কিন্তু গোপীনাথ কিছুই উপভোগ করছে না। তার শ্যেনদৃষ্টি সামনের দিকে। একজিকিউটিভ এনক্লোজারে দু’জন সম্ভাব্য আততায়ী ওত পেতে আছে। তার একদা প্রভু কর্মকর্তারা ওদের নিয়োগ করেছে তাকে সস্নেহে দুনিয়া থেকে মুছে দিতে।

কিন্তু কী লাভ তাতে সাক্কির? কয়েক কোটি টাকার অত বড় প্রোজেক্টের সর্বময় কর্তা গোপীনাথকে সরিয়ে দিলে যে প্রোজেক্টটাই অনেক পিছিয়ে যাবে। গোপীনাথ এও জানে, তার বিকল্প বিশেষজ্ঞ চট করে খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত। সাক্কি তা হলে তার বিরুদ্ধতা করছে কেন? সত্য বটে, কোম্পানিগুলোর কোনও নীতিবোধ থাকে না। সামান্য স্বার্থে ঘা লাগলেই তারা যে-কোনও মানুষকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু গোপীনাথ তো তাদের স্বার্থই দেখছিল। আদ্রেঁর কাগজপত্র সরিয়ে ফেলে সে কোম্পানির উপকারই করতে চেয়েছে। কিন্তু কথাটা বোর্ডকর্তাদের বোঝাতে পারেনি সে। তারা গম্ভীর মুখে শুনেছে, কিন্তু বিশ্বাস করেনি। তাই এতদিন বিশ্বস্ততার সঙ্গে চাকরি করার পর তার বরাতে জুটল এই শত্রুতা। কিন্তু গোপীনাথ কোম্পানির এই বিশ্বাসঘাতকতা হজম করতে পারছে না। রাগে তার ভিতরটা জ্বলছে।

রাগের একটা উপকারী দিকও আছে। রাগটা গনগনে হয়ে তার ভয়ডর কিছু কমিয়ে দিচ্ছে। রাগ তার ভিতরে কিছু শক্তিরও সঞ্চার ঘটাচ্ছে কি? হয়তো তাই।

আবার নতুন করে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হচ্ছে এই বিমানেও। সবিনয়ে ট্রে-টা প্রত্যাখ্যান করল গোপীনাথ। শুধু কফি খেল এক কাপ। বারবার ঘড়ি দেখছিল সে। সময় কাটছে না কিছুতেই। দিল্লি থেকে খবরের কাগজ বোঝাই হয় প্লেনে। যাত্রীরা খবরের কাগজ খুলে মন দিয়ে পড়ছে। গোপীনাথের সে ইচ্ছেটা অবধি হল না। দাতা বলেছে, এই দু’জন অনুসরণকারীর চোখে ধুলো দিতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব তাই ভাবছিল সে। এসব কাজে তার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ভরসা এই যে, মাফিয়া গুন্ডারা কলকাতায় নতুন। সুতরাং গোপীনাথ হয়তো পারবে।

ক্রমে ক্রমে কলকাতা কাছে আসছে। বড্ড ধীর গতিতে অবশ্য। কিন্তু অমোঘভাবেই আসছে।

গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি সামনের সিট থেকে উঁকি দিয়ে বলল, কী মশাই, সব ঠিক আছে তো! গোপীনাথ একটু হেসে বলল, ঠিক আছে।

গৌরাঙ্গ একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা রাখুন। দরকার হলে যোগাযোগ করবেন কলকাতায়।

গোপীনাথ কার্ডটা পকেটে রাখল।

ভাল কথা, এয়ারপোর্টে আমার গাড়ি থাকবে, যদি চান তো আপনাকে গ্র্যান্ড হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যেতে পারি। আমি গলফ ক্লাব রোডে থাকি। ওদিক দিয়েই যাব।

গোপীনাথ অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলল, আমাকে রিসিভ করতে আমার এক বন্ধু গাড়ি নিয়ে আসবে। তবু আপনাকে ধন্যবাদ।

ঠিক আছে। তবে যোগাযোগ করলে খুশি হব। একদিন ডিনার বা লাঞ্চে আমার বাড়িতে এলে আরও খুশি হব।

বিমান নামবার ঘোষণা হল। বিশাল বিমানটি হেলতে দুলতে শুরু করে ক্রমে ক্রমে উচ্চতা হারাতে লাগল। গোপীনাথ দেখল, এখনও কেউ তার দিকে আসছে না। দুই মাফিয়া এখনও চোখের আড়ালে।

প্লেন নেমে পড়ল। গোপীনাথ একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। এটা কলকাতা, রোম নয়। গোপীনাথ আর তেমন অসহায় বোধ করছে না।

এবার সে আর ভুল করল না। দাতা তাকে বলেছিল সবার শেষে নামতে। আর সেটা করতে গিয়েই দিল্লিতে বিপদে পড়েছিল সে। এবার তা করবে না। সিঁড়ি লাগবার পর সে সকলের সঙ্গেই দরজার কাছে গিয়ে হাজির হয়ে গেল।

আশ্চর্যের বিষয়, মাফিয়া দু’জনের দেখা নেই।

গোপীনাথ নামল। প্রথম গাঙ্গুলি দম্পতি এবং তার পরেই সে ইমিগ্রেশন পার হল। গাঙ্গুলিরা লাগেজের জন্য অপেক্ষা করবে। সুতরাং সে বেশ তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিয়ে সোজা প্রি-পেইড ট্যাক্সির কাউন্টারে চলে গেল। কেউ তাকে অনুসরণ করছে না। লক্ষ অবধি করছে না।

ট্যাক্সিতে বসে সে যখন বালিগঞ্জের দিকে ছুটছে তখনও ভাল করে লক্ষ করল, কেউ তার পিছু নেয়নি। হতে পারে, মাফিয়ারা তার কলকাতার ঠিকানা জানে। তাই অকারণে কোনও অ্যাডভেঞ্চার করার ঝুঁকি নিচ্ছে না।

বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িটার সামনে নেমে খুব একটা নিরাপদ বোধ করল না গোপীনাথ। কারণ, দাতা তাকে বলেছে, তার ফ্ল্যাটে তারা একটা কম্পিউটার বসিয়ে দিয়েছে। এটা যদি সম্ভব, তা হলে ফ্ল্যাটের মধ্যে গোপীনাথের নিরাপত্তা বলতে আর কী থাকল?

লিফটে ছ’তলায় উঠে সে নিজের ফ্ল্যাটের দরজা খুলল। বিশাল তিন হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট। দক্ষিণ আর পুবে চমৎকার ব্যালকনি। বিশাল হলঘর এবং তিনটে শোয়ার ঘর। সবগুলিই বড়। এ ছাড়া আলাদা সারভেন্টস রুম আছে।

ফ্ল্যাটে গোপীনাথ বড় একটা থাকে না। কচিৎ কখনও কলকাতায় এলে হোটেলেই থাকে। এমনকী সুব্ৰতর বাড়িতেও থাকে না। তবে বিবাহিত জীবনে বার দুই শ্বশুরবাড়িতে থেকেছিল। এতদিনকার বন্ধ ফ্ল্যাটে আশ্চর্যের বিষয়–ধুলোময়লা তেমন জমেনি। বেশ চকচক ঝকঝক করছে সবকিছু। যেন কেউ সদ্য ঝটপাট দিয়ে ডাস্টিং করে গেছে।

হলঘরটা সোফাসেটে সাজিয়েছিল তার প্রাক্তন স্ত্রী। ফ্ল্যাটের সব আসবাবই তার পছন্দ করে কেনা বা বানিয়ে নেওয়া।

গোপীনাথ কিছুক্ষণ গা এলিয়ে একটা নরম সোফায় বসে রইল। জিরিয়ে নিয়ে সে হলঘরের এক কোণে রাখা টেলিফোনটা গিয়ে তুলল। হ্যাঁ, ডায়ালটোন আছে। টেলিফোনের রেন্টাল চার্জ থেকে শুরু করে ফ্ল্যাটের মেনটেনেন্স বা ট্যাক্স সবই সুব্রতই দেয়। তাকে টাকা পাঠিয়ে দেয় গোপীনাথ।

সুব্ৰতর বাড়ির নম্বরে ডায়াল করে তাকে পাওয়া গেল না। অফিসে পাওয়া গেল।

তার গলা পেয়ে সুব্রত গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, গোপীদা! আপনি বেঁচে আছেন। কোথা থেকে কথা বলছেন?

গোপীনাথ মৃদু স্বরে বলল, ওরে চেঁচাসনি, বেঁচে আছি বটে, কিন্তু কত দিন বেঁচে থাকব বলা যায় না। তবে এখনও বেঁচে আছি বটে। শোন, আমি এখন কলকাতায়।

কলকাতায়! মাই গড! সত্যি কলকাতায়?

হ্যাঁ রে, সত্যিই। নিজের ফ্ল্যাটে।

বলেন কী? রোম থেকে বেরোলেন কী করে? শুনলাম সেখানে নাকি গুন্ডারা আপনাকে ঘিরে রেখেছিল।

এত খবর তোকে কে দিল?

আমাদের বসের এক ইতালিয়ান বন্ধু আছে সাক্কিতে। সে-ই নাকি বলেছে।

তোর বস আমাকে চেনে?

খুব চেনে, আপনাকে তার ভীষণ দরকার। খুব চেষ্টা করছিল যোগাযোগ করতে।

খবরদার, আমার খবর কাউকে দিবি না। কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে।

কেন গোপীদা, এখন তো আপনি কলকাতায়। আর ভয় কীসের?

গোপীনাথ একটু হেসে বলল, তুই নিতান্ত ছেলেমানুষ। আন্তর্জাতিক গুন্ডাদের চিনিস না তো!

তার মানে কি এখানেও আপনার কিছু হতে পারে।

খুব পারে। ইন ফ্যাক্ট আমার পিছু পিছু দুটি গুন্ডা রোম থেকে কলকাতায় এসেছে। তাদের গতিবিধি এখনও বুঝতে পারছি না।

তা হলে আপনি আমার বাড়িতে চলে আসুন। ফ্যামিলির মধ্যে থাকলে কিছু করতে পারবে না।

না, তা হয় না। আমার বিপদের চেয়েও তখন তোদের ফ্যামিলির বিপদ বেশি।

কিছু হবে না গোপীদা।

কথা বাড়াস না সুব্রত। শোন, আমার এখন খিদে পেয়েছে। ধারেকাছে কোনও এমন দোকান আছে কি, যেখান থেকে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে?

ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি এখনই ব্যবস্থা করছি। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আপনার ফ্ল্যাটে খাবার পৌঁছে যাবে। কী খাবেন বলুন।

ভাত খাব, ডাল খাব। আর যা হয়।

আর কিছু?

না, আপাতত আর কিছু নয়। অফিসের পর চলে আয়, একটু আড্ডা মারা যাবে।

বউদির সঙ্গে কথা বলবেন? লাইন ট্রান্সফার করতে পারি।

উঃ, তোকে নিয়ে আর পারি না। ওরে গবেট, আমি যে কলকাতায় আছি এ খবরটা তোর বউদিকেও দেওয়া বারণ।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

শুধুই তুই জানলি, আর যেন কেউ না জানে। এমনকী তোর বাড়ির লোকও নয়। বুঝেছিস?

বুঝেছি। নিশ্চিন্ত থাকুন।

ঘরগুলো ঘুরে দেখতে গিয়ে স্টাডিতে কম্পিউটারটা আবিষ্কার করল গোপীনাথ। একটা স্টিলের টেবিলের ওপর বসানো। দামি জিনিস। বেশ কয়েক বাক্স ফ্লপি রয়েছে।

অ্যাটাচি কেসটা শোয়ার ঘরের স্টিলের আলমারিতে রেখে চাবি দিল সে। তারপর বাথরুমে গিয়ে গিজার অন করল। ভাল করে স্নান করা দরকার।

সারা ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে লক্ষ করল সে। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, কেউ এটা খুব সম্প্রতি ঝাড়পোঁছ করেছে। শোয়ার ঘরের প্রত্যেকটা খাটের পাশে ছোট্ট কাশ্মীরি টুলের ওপর ফ্লাওয়ার ভাসে টাটকা ফুল। এরকমটা তো স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এসব করল কে? ভিকিজ মব-এর লোকেরা?

বাথটাবে জল ভরতি করে বেশ কিছুক্ষণ ঈষদুষ্ণ জলে বসে রইল গোপীনাথ। কলকাতায় এখনও বেশ শীত আছে। আবহাওয়া চমৎকার।

স্নান করে উঠে গোপীনাথ গিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলে দেখল। অনেক দিন আগে ব্যবহৃত জামাকাপড় এখনও রয়েছে কিছু। গোপীনাথ মোটা হয়নি। সুতরাং মাপেও হয়ে গেল। পাজামার ওপর একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি চাপিয়ে একটা শাল জড়িয়ে নিল গায়ে।

সুব্রতকে ফোন করার ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে ডোরবেল বাজল। গোপীনাথ দরজা খুলে দেখল দু’জন লোক ঢাকা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে।

গোপীনাথের সত্যিই খিদে পেয়েছে। লোক দুটো সযত্নে তার ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিল। অন্তত দশ রকমের আইটেম। দই-মিষ্টি অবধি।

খাওয়ার পর বাসনপত্র গুছিয়ে নিয়ে রাতে ক’টার সময় কী কী খাবার দিয়ে যাবে তা জিজ্ঞেস করে নোট করে নিয়ে গেল। চমৎকার ব্যবস্থা। দাম নিল না। বলল, ওসব পরে হবে।

গোপীনাথ দরজা লক করে একটু শুয়ে রইল। শরীর ক্লান্ত, মন অবসন্ন। রোমে যেরকম বিপদ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল এখন পরিস্থিতি তেমন নয়। কিন্তু উদ্বেগ রয়েই গেল।

গোপীনাথের চোখ জড়িয়ে আসছিল ঘুমে।

বিকেল চারটে নাগাদ টেলিফোন বাজল।

একটা পরিচিত গলা বলে উঠল, এই যে! পৌঁছে গেছেন?

গম্ভীর গোপীনাথ বলল, হ্যাঁ।

কোনও ঘটনা ঘটেনি তো?

ঘটেছে।

কী বলুন তো! ওই যে একটা লোককে আপনি প্লেনে লাথি মেরেছিলেন।

অবাক গোপীনাথ বলল, হ্যাঁ, কিন্তু

আরে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওরা দু’জন আমার লোক।

গোপীনাথের এক গাল মাছি। সে বলল, আপনার লোক। আপনার লোকেরা আমাকে অ্যাটাক করবে কেন?

আক্রমণ নয়। আসলে ওরা আপনাকে অ্যালার্ট রাখতে চাইছিল। যাতে আপনি অসতর্ক না হয়ে পড়েন।

তা হলে মাফিয়ারা কোথায়?

তারাও আছে।

আপনি কি বলতে চান একগাদা টাকা খরচ করে আপনার দু’জন লোককে আপনি আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বা অ্যালার্ট রাখার জন্য পাঠিয়েছেন।

না না। ওদের অন্য কাজ আছে। দে আর অন স্পেশাল ডিউটি, ঘাবড়াবেন না, ওরা আপনাকে ডিস্টার্ব করবে না।

গোপীনাথ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, আপনি আসলে কে বলবেন?

আমি হলাম দাতা।

সে তো জানি। কিন্তু আপনার আসল পরিচয়টা আমার জানা দরকার।

সবকিছু জানা কি ভাল? এসব পরিস্থিতিতে যত না জানবেন ততই মঙ্গল।

গোপীনাথ গম্ভীর গলায় বলল, অন্তত এটুকু কি বলবেন যে, হোয়েদার ইউ আর অন দি রাইট সাইড অব দি ল?

রাইট সাইডে থাকলেও রং সাইডেও মাঝে মাঝে যেতে হয়। আই অ্যাম অন বোথ দি সাইডস।

ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। প্লেনে এয়ার হোস্টেস বলেছিল, ইন্টারপোল থেকে আমাকে চাইছে। আপনি কি ইন্টারপোল?

তাও বলতে পারেন। কিন্তু ফরগেট মাই আইডেন্টিটি। এবার কাজের কথা বলি।

বলুন।

আজকের দিনটা আপনি বিশ্রাম নিন। কিন্তু কাল থেকে একটু কাজ শুরু করুন।

কী কাজ?

আদ্রেঁর কাজ। যেখানে আদ্রেঁ শেষ করেছিল সেখান থেকে শুরু করা দরকার। ইটস এ ম্যাটার অফ ভাইটাল ইম্পট্যান্স।

জানি। সলিড ফুয়েল।

হ্যাঁ। এ কাজ আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না।

আপনি কি তেল দিচ্ছেন নাকি মশাই?

আরে না। আপনি তেল দেওয়ার পাত্র নন।

তবে বলছেন কেন? আদ্রেঁর লাইন আমার লাইন এক নয়। আমি ছিলাম প্রোজেক্ট কো অর্ডিনেটর। আদ্রেঁ ছিল স্পেশালিস্ট।

সব জানি।

জানেন না। ইউ আর নট এ সায়েন্টিস্ট।

তাও ঠিক। তবু আমি জানি আদ্রেঁকে এ কাজে লাগিয়েছেন আপনিই।

তাতে কিছু যায়-আসে না।

মানছি। তবু আদ্রেঁর কাজ আর কে শেষ করতে পারে বলুন!

গোপীনাথ একটা শ্বাস ফেলে বলল, হয়তো কেউই পারে না। ঠিক আছে, আগে ঠান্ডা মাথায় ওর পেপারওয়ার্কগুলো দেখি। তারপর ভাবা যাবে।

দয়া করে তাই করুন।

মুশকিল হল, একটা আধুনিক ল্যাবরেটরি তে চাই। এদেশে সেটা কোথায় পাব?

ভেবে দেখছি। কিছু একটা উপায় হবেই। একটা কথা, দরজাটা লক করে শোবেন।

কেন?

বিপদ।

২২.

সন্ধেবেলা টেলিফোনটা এল। খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে। রোজমারি জরুরি একটা মিটিং সেরে গুরুতর কিছু কাজ নিয়ে বসেছিল নিজের একটেরে অফিস ঘরে। মৈত্রেয়ী তাকে সাহায্য করছিল।

ঠিক এই সময়ে রিং বাজল। ফোন ধরল মৈত্রেয়ী।

ম্যাডাম, কে একজন আপনাকে চাইছে। বলে মৈত্রেয়ী ফোনটা এগিয়ে দিল রোজমারির দিকে।

রোজমারি এত অবাক হল যে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। পৃথিবীতে জো ক্লাইন নামের লোক হয়তো আরও আছে। কিন্তু এ লোকটার ফ্যাসফ্যাসে চাপা গলা এবং একটু বিদেশি অ্যাকসেন্টের জার্মান উচ্চারণ রোজমারির ভুল হওয়ার নয়।

রোজমারি গলার বিস্ময় আর বিরক্তিটা চেপে রাখতে পারল না, জো, তুমি কী চাও? তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো চুকেবুকে গেছে।

সম্পর্কের জন্য ব্যস্ত হয়ো না। আমরা স্বামী-স্ত্রী আর নই ঠিকই, কিন্তু হয়তো পুরনো বন্ধুত্ব তুমি সবটা ভুলে যাওনি।

কে বলল ভুলে যাইনি? আমি তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্বীকার করি না।

ঠিক আছে রোজমারি, সেটাও মেনে নিলাম। কিন্তু আমি যদি তোমার কাছে একটু সাহায্য চাই, পাব কি?

কী ধরনের সাহায্য?

বলছি। কিন্তু তার আগে তোমার গলার কাঠিন্য একটু কমানো দরকার। মনে হচ্ছে তুমি খুব রেগে কথা বলছ।

হয়তো তাই। আমি ব্যস্ত মানুষ। একদম সময় নেই।

জানি। শুধু ব্যস্ত নও, এখন তুমি বেশ গুরুতর মানুষও।

বাজে কথা রাখো জো, যা বলার চটপট বলে ফেলল।

অত তাড়াহুড়োয় বলার মলোকথায়। একটুসময় লাগবে। তাছাড়া কথাটা টেলিফোনেও বলা যাবে না। আমি তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। আমি কলকাতাতেই আছি।

অসম্ভব। তোমার সঙ্গে দেখা করার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই।

শোনো রোজমারি, দরকারটা জরুরি।

যত জরুরিই হোক, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

রোজমারি, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দটা বড় কথা নয়। আমি তোমার অপছন্দের মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমি তোমার ক্ষতি করার জন্য আসিনি।

আমাকে ভুলে যাচ্ছ না কেন জো? আমি তো ভুলতে চাই।

ভাবাবেগের দ্বারা চালিত হওয়ার বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি রোজমারি। দুনিয়াটা কঠিন জায়গা। আমাকেও কষ্ট করেই বেঁচে থাকতে হয়। তোমারও বয়স বসে নেই। আমরা নিশ্চয়ই আর ছেলেমানুষ নই।

তোমার দরকারটা কী ধরনের?

সেটা দেখা হলে বলা যাবে।

দেখা করতেই হবে তা হলে?

হ্যাঁ, এবং গোপনে।

যদি তা সম্ভব না হয়?

রোজমারি, তুমি আমাকে স্বেচ্ছায় সময় না দিলে আমি যেমন করেই হোক তোমার সঙ্গে দেখা করবই। এ ব্যাপারে কোনও বাধাই মানব না। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারটা তোমার আরও অপছন্দের হতে পারে।

এটা কি হুমকি?

রোজমারি, আমাকে খামোখা জেদি করে তুলছ কেন? আমি অনেক কিছুই ভুলিনি।

কী ভোলোনি?

ভিয়েনা।

রোজমারি চুপ করে রইল। কিন্তু তার মুখ যে ফ্যাকাশে হয়ে গেল তা লক্ষ করছিল মৈত্রেয়ী। রোজমারি মাউথপিসটা হাত দিয়ে চেপে রেখে মৈত্রেয়ীকে বলল, তুমি একটু বাইরে যাবে মৈত্রেয়ী?

মৈত্রেয়ী চলে গেলে রোজমারি ক্লান্ত গলায় বলল, জো, তুমি কি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ?

না রোজমারি। শুধু বলছি, অতীতকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হওয়া ভাল নয়।

জো, আজ একটা সত্যি কথা বলবে?

শপথ করতে পারি না। তবে সম্ভব হলে চেষ্টা করব।

তুমি কী কাজ করো?

যখন তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল তখন যা করতাম এখনও তাই করি।

তুমি বলেছিলে তুমি একটা কোম্পানির রোভিং সেলসম্যান।

হ্যাঁ।

কথাটা মিথ্যে।

হতে পারে।

তুমি সত্যিই কী করো?

আমি যা করি তা বলার মতো নয়। আমার চাকরিটা এমনই যে ভাল কাজ করলে কেউ পিঠ চাপড়ায় না, কিন্তু ভূল করলে প্রাণ যায়।

তুমি কি পেশাদার খুনি বা গুন্ডা?

এরকম সন্দেহের কারণ কী?

আমার মনে পড়ছে একটা লোক মাসখানেক আগে আমাকে বলেছিল, জোসেফ ক্লাইন আমার জীবনে ফিরে আসবে, তবে অন্য ভূমিকায়।

লোকটা খুবই জ্ঞানী। কিন্তু সে কে?

তার নাম সুধাকর দত্ত। সে ইন্টারপোলের অফিসার বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিল।

জো একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি আজকাল বিপজ্জনক লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো নাকি?

কেন, সুধাকর কি বিপজ্জনক লোক?

হা রোজমারি, খুব সাংঘাতিক বিপজ্জনক লোক। সে হয়তো তোমার অতীতের কথাও জানে।

কী করে জানলে?

সুধাকর দত্তকে গোটা ইউরোপের পাপীতাপীরা চেনে। প্যারিসে তার নামে অনেকে বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকে।

কিন্তু আমি তো পাপীতাপী নই। ভিয়েনায় যা ঘটেছিল তা একটা আপতন মাত্র।

জানি রোজমারি। কিন্তু অনেকে হয়তো ততটা আপতন বলে মনে করবে না। সেই ঘটনাটার জন্য আজ আর তোমাকে কেউ দায়ীও করবে না। তবে বদনামের ভয় আছে, ব্যাবসার সুনাম নষ্ট হতে পারে।

জোসেফ ক্লাইন, তুমি অতীতের ভূত। কী চাও বলো!

আপাতত একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট?

তুমি আগামী কাল ঠিক এসময়ে আমাকে একটা টেলিফোন কোরো।

করব। কিন্তু তারপর?

তোমার সঙ্গে দেখা করব জো।

বুদ্ধিমতী মেয়ে। এই তো চাই। একটা কথা।

কী কথা?

আমাদের এই সাক্ষাৎকারের কথা কাউকে জানাবে না।

কেন?

সেটা তোমার ভালর জন্যই। যদি বলো তা হলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে।

কিন্তু জো, আমার নিরাপত্তার জন্য কথাটা কাউকে জানানো দরকার বলেই আমার মনে হয়।

জো একটু হেসে বলল, তুমি সত্যিই বুদ্ধিমতী। আমাকে বিশ্বাস করা যে ঠিক নয় তা আমরা দুজনেই জানি। তুমি কি তোমার স্বামীকে জানাতে চাও?

না। মনোজ একটু ভিতু গোছের মানুষ। হয়তো উদ্বেগে ভুগবে।

তবে কাকে?

সেটাও কি তোমাকে বলতে হবে?

বললে বলতে পারো। না বললেও ক্ষতি নেই। তবে ব্যাপারটা যত গোপন রাখবে ততই ভাল।

কেন?

আমি একজন সন্দেহজনক লোক, তোমার ভূতপূর্ব স্বামী। আমার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ঘটাটা খুব স্বাভাবিকভাবে লোকে নেবে না হয়তো।

তুমি কতদূর সন্দেহজনক?

এক-একজনের কাছে এক-একরকম।

তার মানে তুমি ভাল জীবন যাপন করো না জো।

আমার মতো আরও অনেকেই তাই।

আমার একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত রোজমারি?

আমি তোমার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। আমাকে তোমার সম্পর্কে সব জানাতে হবে।

জো একটু চুপ করে থেকে বলল, তাতে কী লাভ?

আমি জানতে চাই আমাদের রোমান্সের সময়ে তোমাকে আমার কেন খুব ভাল লোক বলে মনে হয়েছিল।

অদ্ভুত তোমার কৌতূহল। তবু বলি, হয়তো তখন আমি খুব খারাপ লোক ছিলাম না।

এখন কি খারাপ হয়েছ?

তা কি জো ক্লাইন নিজে বলতে পারে?

ঠিক আছে, কাল ফোন কোরো।

.

রোজমারি ফোনটা রেখে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তার মন এমনিতেই ভাল নেই। তার ওপর অতীত থেকে জো ক্লাইনের এই ফিরে আসা এই ঘটনার মধ্যে নিয়তির কোন মার লুকিয়ে আছে কে জানে!

রোজমারি মৈত্রেয়ীকে ইন্টারকমে ডেকে নিল। তারপর ডুবে গেল কাজে।

সন্ধের পরও সে আর মনোজ অনেকক্ষণ অফিসে থাকে। বিস্তর কাজ তাদের। মাঝে মাঝে অফিস থেকেই তারা একসঙ্গে কোনও পার্টিতে যায়। পার্টি তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজও এক পার্টি ছিল। কিন্তু রোজমারির মনে ছিল না।

মনোজের ফোন এল সাতটার পর।

রোজি, হল? সাতটা বাজে যে!

সাতটা! কেন, আজ কি কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?

বাঃ, আজ যে সিং সাহেবের পার্টি।

ওঃ, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।

এখনই বেরিয়ে পড়া যাক।

রোজমারি বলল, শোনো, আমি যাব না।

সে কী? কেন?

আমার শরীরটা ভাল নেই। তুমি আজ একাই যাও।

হয়তো ওরা কিছু মনে করবে। একটু ছুঁয়ে গেলে পারতে।

না। আমি আরও একটু কাজ করে সোজা বাড়ি যাব।

মনোজ আর ঝোলাঝুলি করল না। রোজমারি খুব সহজে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না। সে হতাশ গলায় শুধু বলল, আচ্ছা।

রোজমারি ফোনটা রেখে দিয়ে মৈত্রেয়ীর দিকে চেয়ে বলল, আজ আর কাজ করব না। কাগজপত্র গুছিয়ে রাখো। আমি যাচ্ছি।

রোজমারি বেরিয়ে এল। গাড়িতে উঠল। বাড়ি ফিরে একটা ছোট মাপের ওয়াইন খেয়ে বাথটবে গরম জলে পড়ে রইল অনেকক্ষণ। মাথায় চিন্তা আর চিন্তা। স্মৃতি আর স্মৃতি।

গা মুছে সে একটা ঢিলা পোশাক পরে লিভিং রুমে এসে কিছুক্ষণ আনমনে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে ছবি দেখে গেল।

তাজু খুব বিনীতভাবে এসে বলল, মেমসাব, ডিনার করবেন কি?

না তাজু। আজ কিছু নয়।

একটু স্যুপ?

না। বরং একটা ড্রিঙ্ক দাও। পোর্ট।

ঠিক আছে।

রোজমারি পোর্টটা খুব উপভোগ করল। আবার নিল। এবং আবার। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।

.

পরের দিনটা গেল একটু মন্থর গতিতে। সন্ধে ঠিক ছ’টার সময় ফোন এল।

রোজমারি, আমি জো।

হা জো, আর এক ঘণ্টা পর তুমি আমার দেখা পাবে।

কোথায়?

জায়গাটা তুমি ঠিক করো।

আমি?

হ্যাঁ তুমি।

রোজমারি, তুমি আমাকে ক্রমশ বেশি অবাক করে দিচ্ছ।

এতে অবাক হওয়ার কী আছে?

তা হলে এক কাজ করো। তুমি একটা গাড়ি নিয়ে চলে এসো ভিক্টোরিয়ার সামনে। আমি দাঁড়িয়ে থাকব।

তারপর?

কোথাও যাওয়া যাবে।

আমার গাড়ি চালায় ড্রাইভার। সে থাকলে আপত্তি নেই তো?

আছে। তুমি নিজে ড্রাইভ করলে ভাল।

তাই হবে।

তা হলে এক ঘণ্টা পরে?

হ্যাঁ।

এক ঘণ্টার একটু আগেই সময় হিসেব করে উঠে পড়ল রোজমারি। ড্রাইভার ছেড়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি চালাতে লাগল। আজ কলকাতায় মিছিল নেই। জ্যামও তেমন নয়।

ভিক্টোরিয়ার বড় ফটকের সামনে জো দাঁড়িয়ে ছিল। গায়ে একটা জিনসের জ্যাকেট, পরনেও জিম্স। কাঁধে একটা ঝোলা।

দরজাটা খুলে দিয়ে রোজমারি বলল, উঠে পড়ো।

জো উঠল।

এবার কোথায় যাব জো?

খিদিরপুর চেনো?

চিনি। কিন্তু সেটা তো ঘিঞ্জি জায়গা।

তা হোক। চলো।

রোজমারি গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, তোমার দিক থেকে আমার সত্যিই কোনও ভয় নেই তো?

জো একটু হাসল, বলা যায় না রোজমারি। তোমার চেহারা এখন এত সুন্দর হয়েছে যে, আমার মতো বুড়োরও লোভ হতে পারে।

তেল দিয়ো না। তুমি কি বুড়ো হয়েছ নাকি?

চল্লিশের ওপর তো বুড়োই।

তোমাকে অন্তত সেরকম দেখাচ্ছে না। এখনও গুন্ডাদের মতোই চেহারা আছে তোমার।

বাইরেটাই সব নয়। ভিতরে অনেক ভাঙন।

কীরকম ভাঙন?

বলে লাভ নেই। শুনতে চেয়ো না।

তোমার কথা কি লম্বা?

না না। সেরকম কিছু নয়।

এত ঢাকঢাক গুড়গুড় কেন বলো তো। কী এমন গোপন কথা?

কথার আগে তোমাকে আরও একটু তেল দিয়ে নিই। তুমি একা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ বলে খুব খুশি হয়েছি। আমাকে বিশ্বাস করেছ বলে ধন্যবাদ।

কেন তোমাকে কি আজকাল কেউ বিশ্বাস করে না?

না।

কেন করে না?

হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নই বলেই।

জো, তুমি কী কাজ করো?

শুনবে?

হ্যাঁ।

আমি সেলসম্যান।

সেটা তো মিথ্যে কথা।

জো দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল, না, মিথ্যে নয়। আমি ফিরি করি। তবে কী ফিরি করি তা জানতে চেয়ো না।

কলকাতায় কেন এসেছ?

কাজে।

কী কাজ সেটাই জানতে চাই।

কাজটা তোমার কাছে।

আমার কাছে? আমি কী করব?

তোমার কারখানায় একটা অ্যালয় তৈরি হয়।

হয়।

তোমার কারখানায় তৈরি অ্যালয়ের হঠাৎ চাহিদা খুব বেড়ে গেছে।

হ্যাঁ।

কেন বেড়েছে রোজমারি?

তা জানি না।

আমাকে তোমাদের কারখানা একটু দেখতে দেবে?

কেন? এটাই কাজ। খুব জরুরি।

২৩.

জো-কে বিশ্বাস হয় না রোজমারির। কিন্তু কয়েক বছর আগে মিউনিখে এই জোসেফ তাকে পাগল করে দিয়েছিল। এমন আকর্ষক দুরন্ত পুরুষ সে তার আগে আর দেখেনি। জোসেফ আমেরিকান, পয়সাওয়ালা মানুষ শুধু নয়, চমৎকার ভদ্র ও নম্র ছিল তার স্বভাব। তারপর সামান্য কোর্টশিপের পরই তাদের বিয়ে। এবং সামান্য বিবাহিত জীবনের পরেই ছাড়াছাড়ি। তবু আজও জো ক্লাইন যেন সমান আকর্ষক। জোর ভিতরে একটা চুম্বক আছে হয়তো।

জো তার কারখানা দেখতে চায়। এটা নিশ্চয়ই কোনও গুরুতর গোপন কথা হতে পারে না যার জন্য রোজমারিকে এভাবে টেনে আনতে হবে। রোজমারি মৃদুস্বরে বলল, জো ক্লাইন, আমার কারখানা রোজই বাইরের লোক এসে দেখে যায়। গোপন কিছু নেই। তোমার এই নাটকের তো দরকার ছিল না।

জো সামনের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আমি পর্যটকের মতো দেখব না। আমি দেখব বিশেষজ্ঞের মতো।

তার মানে কি স্ক্রুটিনি?

হ্যাঁ রোজমারি। রোজমারি মাথা নেড়ে বলল, সেটা সম্ভব নয়।

কেন নয়?

তুমি নিশ্চয়ই জানো সেরকমভাবে পরীক্ষা করতে গেলে আমাদের কারখানার প্রোডাকশন মার খাবে, পাঁচটা কথা উঠবে। তা ছাড়া হঠাৎ তোমার এরকমই ইচ্ছেই বা হচ্ছে কেন?

জো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যতটা নিরাপদ জীবনযাপন করছ বলে ভাবো, তোমার জীবন হয়তো ততটা নিরাপদ নয়।

তার মানে?

রোজমারি, তুমি হয়তো অজান্তে কোনও বিপুল ঐশ্বর্যের ওপর বসে আছ। আর সেই কারণেই তোমার নিরাপত্তা সুতোয় ঝুলছে।

রোজমারি একটা শ্বাস ফেলে বলল, জো, কিছুদিন আগে আমাকে কে যেন ভুল জন্মদিনে একগোছা রক্তগোলাপ পাঠায়। তার ট্যাগে লেখা ছিল, আর আই পি। তোমার কথা তাই আমার বাজে কথা বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু কী সে ঐশ্বর্য জো? বলবে আমাকে?

জো নেতিবাচক মাথা নেড়ে বলল, জানি না। তোমার আশ্চর্য অ্যালয় সম্পর্কেও কিছু জানা নেই আমার। তোমার কারখানা খুঁটিয়ে দেখার জন্য আমার সঙ্গে দু’জন লোক এসেছে। একজন বিশেষজ্ঞ, অন্যজন খুনি।

তার মানে?

জো সামান্য ধরাগলায় বলল, আমি স্বাধীন নই রোজমারি। আমাকে কাজ করতে হচ্ছে ভয় ও হুমকির মধ্যে।

তোমাকে কেউ বাধ্য করছে বলতে চাও?

হ্যাঁ।

কে বাধ্য করছে জো?

একটা করপোরেট বডি।

তারা কারা?

জো আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমাকে কিছু কথা বলার দরকার। শুনবে?

বলো।

যখন তোমাকে বিয়ে করি তখন আমি ছিলাম গুপ্তচর।

রোজমারি চমকে ওঠে, গুপ্তচর!

আমেরিকান সরকারের ফেডারেল ব্যুরোর।

আশ্চর্য!

কিন্তু পরে আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়। ব্রুকলিনে আমি একটা দোকান চালাতে শুরু করি। আনা নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করি। আনার দুটো বাচ্চা। নিরাপদ জীবন।

আনা কেমন মেয়ে?

ভাল। খুবই ভাল। জন্মসূত্রে রাশিয়ান।

তারপর বলো।

চিরকাল সমান যায় না। আমি নানাভাবে জড়িয়ে পড়ি অপরাধ জগতের সঙ্গে।

কীভাবে?

অত বলবার সময় নেই।

তা হলে বলে যাও।

নানা সূত্রে আমার আয় হত। মোটা আয়। আনা দোকান নিয়ে পড়ে আছে।

আর তুমি?

আমাকে যে কাজটা করতে হয় তা ভাড়াটে সৈন্যের মতো।

খুনখারাপি কি?

ঠিক তা নয়। তবে অবশ্যই আমি যা করে বেড়াই তার অনেক পরিণতি ঘটে মৃত্যুতে। এসব ঠিক বোঝানো যাবে না।

এখন কারা তোমার বস?

অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সংগঠন।

তারা কী চায় জো?

তারা জানতে চায় তোমার কারখানায় আসলে সত্যিই কী জিনিস তৈরি হয়।

আজকাল অনেকেই বোধহয় তা জানতে চাইছে। কিন্তু আমি নিজেই তো জানি না। পৃথিবীতে এই অ্যালয় তৈরির আর কিছু কারখানা আছে। আমি তো একা নই।

তাও জানি। সেসব কারখানাতেও ঘটনা ঘটছে।

জো, আমি কি অজান্তে বিজ্ঞানের বিস্ময় কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছি?

জো গম্ভীর হয়ে বলল, সেটা বলতে পারত আদ্রেঁ।

আদ্রেঁ।

হ্যাঁ। যাকে কলকাতায় খুন করা হয়।

আদ্রেঁর কথাও তুমি জানো?

জানি। আদ্রেঁ প্রায় ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল। কিন্তু নিজেই বাঁচল না। কিন্তু সেখানে থেমে গেলেই তো চলবে না।

বুঝেছি।

আমাকে বন্ধুর মতো সাহায্য করো রোজমারি। আমি তোমার শত্রু নই।

কিন্তু এটা তো শত্রুতাই।

হয়তো তাই। তুমি সাহায্য করলে কোনওভাবে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব। না করলে আমারও কিছুই করার থাকবে না।

অর্থাৎ খুন?

হয়তো তাই।

তুমি আমাকে খুন করবে জো?

আমি করব না। ওসব করার লোক আছে।

রোজমারি মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, তুমি তো খুনি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছ।

জো একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ নিবিড়ভাবে সিগারেট টেনে সে নিজেকে একটু সংযত করে নিল হয়তো। তারপর বলল, আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে আরও একজন এসে গেছে।

সে কে?

গোপীনাথ বসু নামে একজন ইন্ডিয়ান। বিশেষজ্ঞ।

গোপীনাথ বসু। সাক্কির?

হ্যাঁ। চেনো?

নামটা শুনেছি।

আদ্রেঁ তার অধীনে কাজ করত।

সে কী চায়?

আমরা যা চাই সেও তাই চায়।

রোজমারি ভ্রু কুঁচকে চুপ করে রইল। মনোজ কিছুদিন যাবৎ খুব গোপীনাথ বসুর কথা বলছে। এমন কথাও বলছে গোপীনাথ বসুকে সে মাসে পাঁচ লক্ষ টাকা বেতন দিয়েও রাখবে। কথাটা রোজমারি বলল না।

জো বলল, গোপীনাথের কপাল খারাপ।

কেন?

তাকে মরতেই হচ্ছে।

তোমরা মারবে?

আমরা নিমিত্ত মাত্র। ভাড়াটে খুনি পয়সা নিয়ে লাশ নামিয়ে দেয়, ভ্রুক্ষেপও করে না। কিন্তু খুনটা কি সে করে? না রোজমারি। আপাতদৃষ্টিতে খুনিই খুন করে বটে, কিন্তু পিছনে অন্য ছায়া থাকে।

গোপীনাথ বসু এখন কলকাতায় আছে, তুমি ঠিক জানো?

জানি। কালই এসেছে।

ও। কিন্তু তাকে মারবে কেন, আমাদের কারখানার রহস্য সে তো জানে না।

তার কাছে আদ্রেঁর সব কাগজপত্র আছে। গোপীনাথ মস্তিষ্কবান লোক। সে ঠিক ব্যাপারটা ধরে ফেলবে।

তবে তাকেই কেন তোমরা ভাড়া করছ না?

উপায় নেই। সুধাকর দত্ত তার পিছনে আছে।

তার মতলব কী?

সেও আমাদের মতো অ্যালয়ের রহস্য ভেদ করতে চায়।

আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে জো।

গাড়িটা ডানদিকে ঘোরাও রোজমারি।

কোথায় যাচ্ছ জো?

কোথাও না। আমি গলির মধ্যে নেমে যাব।

আর আমি?

তুমি ফিরে যাও। আমার কথা শেষ হয়েছে।

তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব স্বস্তিতে নেই। ঠিক বলছি জো?

হ্যাঁ। ঠিকই বলছ।

যারা তোমার মতো বিপজ্জনক জীবনযাপন করে তারা স্বস্তিতে থাকে না জো।

তা তো বটেই। কিন্তু আমি যখন সরকারি চাকরি করতাম তখনও বিপজ্জনক ভাবেই বেঁচে ছিলাম রোজমারি। তবে তখন কোনও গ্লানি ছিল না।

এখন আছে?

হ্যাঁ। এখন মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, একটা পিছল পথ দিয়ে হড়হড় করে একটা অন্ধকার গুহায় নেমে যাচ্ছি। ফেরার উপায় নেই।

কেন নেই জো?

এ হচ্ছে এমন একটা সিস্টেম যেখানে একবার ঢুকে পড়লে আর বেরোনো যায় না। অপরাধ সংগঠনগুলি ভাল টাকা দেয় নোজমারি, কিন্তু তার বদলে তারা চায় শতকরা একশোভাগ আনুগত্য এবং মন্ত্রগুপ্তি। তোমার কাছে আজ যে এসব কথা বলে ফেললাম এর শাস্তি কী জানো?

অনুমান করতে পারছি। কিন্তু বললে কেন জো? না বললেই পারতে।

ওইটেই তো বুড়োবয়সের লক্ষণ। আনাকে তো কিছুই বলি না। বললে ওকে বিপদে ফেলা হবে। বড্ড সরল সোজা স্নেহপ্রবণ মেয়ে। কিন্তু তোমার মতো বুদ্ধিমতী এবং স্বনির্ভর নয়। আজও যদি তুমি আমার বউ থাকতে রোজমারি তা হলে হয়তো জীবনে কয়েকটা ভুল সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হত না। পুরুষের জীবনে বউ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আজ তোমাকে যে এসব কথা বললাম তার আর একটা কারণ, তুমি আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে।

রোজমারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু এতে বিপদ আছে জানলে জানতে চাইতাম না।

বিপদ আর বিপদ। সারা জীবন তো বিপদের মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম। জীবন যে কত ক্ষণস্থায়ী তা সংসারী সুখী মানুষরা জানে না। মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে, বারবার মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ভয়ডর কেটে গেছে। কিন্তু নিজের জন্য ভয় না পেলেও অন্যদের জন্য ভয় হয়।

সেটা কেমন?

আনার জন্য, বাচ্চাদের জন্য, এই এখন তোমার জন্যও একটা অশান্তি ভোগ করছি। ভাগ্যক্রমে তোমার বিপদ ডেকে এনেছি আমিই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। ওদের পরিকল্পনা ছিল, তোমার কারখানা সাবোটাজ করবে। সেটা আমি আটকেছি। এমনকী নিজেই এসেছি, যাতে তোমাকে অন্তত প্রাণে বাঁচানো যায়।

রোজমারি গলির মুখে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে শুনছিল চুপ করে। তার হৃদয় দ্রব হয়েছে, চোখ একটু ছলছলে। বলল, আমার জন্য এখনও কি তোমার একটু আবেগ আছে?

আছে রোজমারি।

তা হলে ভিয়েনার কথা তুললে কেন?

তুললাম তোমাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য। যাতে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে না পারো।

ভিয়েনায় যা ঘটেছিল তা দুর্ভাগ্যজনক। তার বেশি কিছু নয়।

জো একটু হাসল। মৃদুস্বরে বলল, রোজমারি, আমি কিন্তু গোয়েন্দা। গোয়েন্দাদের চোখ একটু বেশি তীক্ষ্ণ।

কী বলতে চাইছ জো?

জো রোজমারির দিকে একটু চেয়ে থেকে মৃদুস্বরে বলল, তোমার বয়স এখন মধ্য তিরিশ, তবু এখনও কী সুন্দরীই যে আছ।

এসব কথা তুলছ কেন?

আমাদের বিয়ের সময়ে তুমি আরও সুন্দরী ছিলে। আগুনে চেহারা। সেই সময়ে পুরুষ পতঙ্গেরা তোমার দিকে কম আকৃষ্ট হত না। রোজমারি, তুমিও সেটা পছন্দ করতে। শক্তসমর্থ পুরুষদের প্রতি তোমার আকর্ষণ ছিল।

রোজমারি একটু রক্তাভ হয়ে গিয়ে বলল, তুমি কি আমার নৈতিক চরিত্রের পাহারাদার নাকি?

না রোজমারি। তা কেন? তুমি তোমার জীবনকে উপভোগ তো করবেই। কিন্তু গডার্ডকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে তুমি একটু ভুল করেছিলে। আমাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে, আমরা মধুচন্দ্রিমায় গেছি, সেই সময়ে একটা জরুরি কাজে ডাক পেয়ে আমি তোমাকে হোটেলে রেখে মাদ্রিদে গিয়েছিলাম। তোমাকে ফোন করে জানিয়েছিলাম ফিরতে আমার দু’দিন দেরি হবে। ঠিক তো?

রোজমারি মুখটা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু তখন আমার খুব একা লেগেছিল।

একা লেগেছিল বলেই কি গডার্ডকে একেবারে শোওয়ার ঘর পর্যন্ত আসতে দিলে?

ওসব পুরনো কথা তুলছ কেন?

কারণ গডার্ডকে খুনের দায়টা আমাকে ঘাড়ে নিতে হয়েছিল রোজমারি।

সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

আর সেই ঘটনা থেকেই আমাদের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ছাড়াছাড়িরও সূত্রপাত।

তুমি ব্যাপারটা উপেক্ষা করতে পারতে। যৌবন বয়সে সকলেরই ওরকম ঘটনা ঘটতে পারে। খুব বড় অপরাধ তো নয়।

জো হাসল, দেশটা যদি ভারতবর্ষ হত বা তুমি আমি যদি ভারতীয় হতাম তা হলে কিন্তু ওই ঘটনা মস্ত নৈতিক অপরাধ। সেটা আমি বলছি না। তুমি ভুল করেছিলে, কারণ গডার্ড তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে আমার গোপন তথ্যাবলি হাতানোর চেষ্টা করেছিল।

সেটা আমি জানতাম না।

জানতে না, তাও জানি। কিন্তু ক্ষতি তো হয়েই গিয়েছিল।

তুমি আমাকে খুনের দায় থেকে বাঁচিয়েছিলে বলে আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ জো।

সেই কৃতজ্ঞতার খানিকটা ঋণ আজ শোধ দাও রোজমারি।

কী চাও জো?

পরশু দিন তোমার কারখানায় আমরা যাব। আমাকে অবাধ প্রবেশ ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করে দাও।

রোজমারি একটু ভাবল, মনোজেরও একটা অনুমতি চাই।

তুমিই সব, আমি জানি। মনোজ তো একটা ভেড়া। শোনো রোজমারি, ব্যবস্থা করতে তোমাকে হবেই। নইলে ঘটনাবলি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।

তুমি কি এখনও আমার শুভাকাঙ্ক্ষী?

শতকরা একশো ভাগ।

কেন জো?

কে জানে কেন। জীবন বড় রহস্যময়, বড় জটিল। মানুষের মন আরও গূঢ়।

২৪.

ক্লান্ত, অন্যমনস্ক, বিষণ্ণ রোজমারি যখন বাড়িতে ফিরল তখন রাত ন’টা। মনোজ ফেরেনি। রোজমারি গরম জলে অনেকক্ষণ গা ডুবিয়ে বসে রইল তার শ্বেতপাথরের বাথটাবে। তারপর ঘরোয়া পোশাকে লিভিং রুমে বসে ওয়াইন খেল অনেকটা। সে সাধারণত উত্তেজক পানীয় খায় না। আজ তার মাথাটা গরম, মনটাও খারাপ।

রাত দশটায় সে খানিকটা সুপ আর এক টুকরো মাংস খেয়ে নিজের শোয়ার ঘরে এসে আধশোয়া হয়ে কিছু কাগজপত্র দেখতে লাগল। অফিসের কিছু জরুরি চিঠিপত্র।

মনোজ ফিরল এগারোটায়। রোজমারি এত রাত অবধি জেগে থাকে না। আজ নিঃশব্দে উঠে বাইরের ঘরে গিয়ে মনোজের ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে বলল, জামাকাপড় ছেড়ে আমার ঘরে এসো। কথা আছে।

মনোজ অবাক হয়ে বলল, কথা!

হ্যাঁ, মাতাল হওনি তো?

আরে না। সামান্য দু’পেগ

তা হলে ঠিক আছে।

মনোজের বেশি সময় লাগল না। মিনিট পনেরোর মাথায় রোজমারির ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসল। সামান্য উদ্বেগের সঙ্গে বলল, খারাপ খবর নাকি?

আমি খুব বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি গোপীনাথ বসু এখন কলকাতায়।

মনোজ প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলল, কলকাতায়। মাই গড! তার তো বেঁচে থাকারই কথা নয়!

কিন্তু সে বেঁচে আছে।

দু’দুটো ইন্টারন্যাশনাল গ্যাং তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল যে। আটকেও রেখেছিল কারা যেন। ভুল খবর নয় তো!

না, খবরটা যে দিয়েছে সে ভুল খবর দেওয়ার লোক নয়।

কলকাতায় কোথায় আছে গোপীনাথ?

তা জানি না। খোঁজ করলেই জানা যাবে। এখানে তার আত্মীয়স্বজন আছে।

সোনালি বা সুব্রতকে ট্যাপ করব নাকি?

করতে পারো। কিন্তু তাড়াতাড়ি করতে হবে।

কেন বলো তো?

গোপীনাথের বিপদ এখনও কাটেনি। তাকে মারবার জন্য একজন খুনিও কলকাতায় এসেছে।

সর্বনাশ! এসব খবর তোমাকে দিল কে?

দিয়েছে একজন। এখন আমি জানতে চাই গোপীনাথকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমরা কী করতে পারি।

মনোজ একটু ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, পুলিশ প্রোটেকশন ছাড়া আর কিছুই বোধহয় পারি না।

পুলিশকে মোবিলাইজ করা সহজ কাজ নয়। অন্য কিছু ভাবো।

ভাববার সময় কি আছে রোজমারি?

বুঝতে পারছি না। তবে অনুমান করছি গোপীনাথকে প্রোটেকশন দিচ্ছে সুধাকর দত্ত।

সে কে? সেই ইন্টারপোল এজেন্ট নাকি?

সে আসলে কে জানি না। তবে সেই লোকটাই।

তা হলে আমরা তাকে অতিরিক্ত কী সিকিউরিটি দিতে পারি? ইন্টারপোলই তো তাকে পাহারা দিচ্ছে।

রোজমারি বিরক্ত হয়ে ভ্রু কোঁচকাল, বলল, তুমি তো বোকা নও।

এ কথায় অপ্রস্তুত হয়ে মনোজ বলল, কী বলতে চাইছ?

গোপীনাথ বসুকে আমাদের দরকার, ঠিক তো?

হ্যাঁ, ভীষণ দরকার।

তাকে সকলেরই দরকার। সাক্কি তাকে খুঁজছে, ভিকিজ মব তাকে খুঁজছে, আরও লোক তাকে মারার জন্য বা ধরার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের এখন তার পাশে দাঁড়াতে হবে বন্ধুর মতো। ইন্টরপোল তার বন্ধু হলেও তাকে দিয়ে কাজ করাতে পারবে না। আমরা পারব।

কিন্তু সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা যাবে কী করে? আমাদের তো ওসব অভিজ্ঞতা নেই। তাকে রাখব কোথায়? পাহারা দেব কীভাবে? সবচেয়ে বড় কথা গোপীনাথ আমাদের বিশ্বাস করবে কেন?

রোজমারি মুখখানা কঠিন করে বলল, মনোজ, তোমাকে নিয়ে মুশকিল কী জানো? তুমি ঠান্ডা মাথায় যুক্তিনির্ভর পরম্পরায় কিছু ভাবতে পারো না।

ওকথা কেন বলছ?

তুমি সুব্রতর কথা ভুলে যাচ্ছ কেন?

সুব্রত! ও হ্যাঁ, সুব্রত গোপীনাথের বন্ধু বটে।

খুব রিলায়েবল বন্ধু। তুমি সুব্রতকে ম্যানুপুলেট করতে না পারলে আমি করব।

লজ্জিত মনোজ বলল, সুব্রতর কথা আমার মনে ছিল না।

আরও একজনকে ভুলে যাচ্ছ।

কে বলল তো!

সোনালি।

সোনালি! সে তো গোপীনাথের প্রসঙ্গই সহ্য করতে পারে না।

হতে পারে। কিন্তু গোপীনাথের বিপদ শুনলে সে হয়তো তাকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে।

সবই তো বুঝলাম, কিন্তু গোপীনাথের পিছনে যেরকম ষণ্ডাগুন্ডা লেগেছে তাতে তাকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে পারি না।

আমি পারি।

কীভাবে পারো?

সেটা তোমাকে এখন বলতে পারছি না। তবে ব্যবস্থা করা যাবে। শু

নেছি মাফিয়ারা ভয়ংকর লোক। সহজে রেহাই দেয় না।

তুমি এখন ঘুমোও গে। কাল সকালে আমাদের এ ব্যাপারে কাজে লাগতে হবে।

মনোজ চলে গেলে রোজমারি ফোন তুলে নিল।

ফোন চারবার বাজবার পর একট ভারী গলা বলল, লুলু হিয়ার।

রোজমারি জার্মান ভাষায় বলল, আমি রোজমারি।

বলো রোজমারি।

একটা কাজ আছে।

কাজ ছাড়া এত রাতে আমাকে তোমার মনে পড়ার কথা নয়।

কাজ ছাড়াও আমি তোমাকে প্রশ্রয় দিই। দিই না?

রোজমারি, আজ রাতে তোমাকে একটা প্রস্তাব দেব?

কী প্রস্তাব।

কাজ ছাড়ো, ব্যাবসায় গুলি মারো, স্বামীটাকে ভুলে যাও, তারপর চলো হাওয়াই দ্বীপে পাকাপাকি বাস করি দু’জনে। সেখানে আমার বাড়ি আছে।

সব জানি লুলু, তোমার মতো ফুর্তির জীবন কাটাতে আমার রুচি হয় না।

কাজ আর কাজের টেনশনে তুমি শুকিয়ে যাচ্ছ রোজমারি।

তাই কী? মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুরেও তো যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।

সিঙ্গাপুরটা কোনও জায়গা নয়। হাওয়াই হল সেই জায়গা যাকে মর্তের স্বর্গ বললে ভুল হয় না। ঠিক কি না?

নিষ্কর্মাদের স্বর্গ। কাজের লোকের স্বর্গ অন্যরকম।

তা অবশ্য ঠিক। কাজের লোকদের প্রিয় হল তেলকালির গন্ধ, মেশিনের শব্দ, শ্রমিক আন্দোলন আর টেনশন, ওটাই কি স্বর্গ?

ঠিক তাই।

জীবনটা এভাবে নষ্ট করবে রোজমারি?

নষ্ট হচ্ছে না।

হচ্ছে। ওই মনোজ ক্যাবলাকেই বা তুমি কীভাবে সহ্য করো?

মনোজ ভাল লোক। সৎ, পরিশ্রমী, মস্তিষ্কবান।

শেষ কথাটা কী বললে? মস্তিষ্কবান! হাঃ হাঃ

মনোজ প্রতিভাবান। নিজের কাজটা ভালই বোঝে।

সেটা হতে পারে। মেটালার্জি বুঝলেই কি আর মস্তিষ্কবান হওয়া যায়? তুমি তো ওকে ভালওবাসো না রোজমারি!

নাই বা বাসলাম। আমরা ক’টা মানুষ এ জীবনে সত্যিকারের কাউকে ভালবাসতে পারি বলো তো! হয়তো একজনকেও নয়। কিন্তু তবু কিছু লোকের সঙ্গে পার্টনারশিপে আসতেই হয়। বিবাহিত জীবনও তো একটা করপোরেশন। একটা কোম্পানি পার্টনারশিপ।

ব্যাবসা ছাড়া তুমি কিছু বোঝো না?

তুমি যেমন ফুর্তি ছাড়া কিছু বুঝতে চাও না।

ডার্লিং রোজমারি, আমার বাবা ব্যাবসা করত জানোত।

জানিই তো।

আমার বাবা কত কোটি টাকা করে গেছে তাও তো জানো।

জানি।

আমি মন দিয়ে ব্যাবসা করলে টাকাটা দ্বিগুণ বা দশগুণ হবে।

এবং তুমি সেটা চাও না তাও জানি।

কেন চাই না তাও তোমাকে বলেছি। ওই টাকা ডবল করতে গিয়ে একদিন দেখব আয়ুটাই ফুড়ুত হয়ে গেছে, দুনিয়া হয়ে গেছে ফ্যাকাশে, মন গেছে মরে।

তাও বলেছ, তোমার জীবনদর্শন আমি মানিনি।

মানলে ভাল করতে। আমার বাবা শেষ জীবনে বুড়ো শকুনের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। বড়বাজারের গদিতে হাঁটু উঁচু করে বসে দুই হাঁটুর ফাঁক দিয়ে মুন্ডু বের করে জুলজুল করে চেয়ে থাকতেন। আমার এত হাসি পেত।

এতে হাসি পাওয়ার কী আছে?

দৃশ্যটা দেখলে তোমারও পেত। মানুষের শকুনাকৃতি কতটা নিখুঁত হতে পারে তা দৃশ্যটা দেখলে তুমি আন্দাজও করতে পারবে না। সেই দৃশ্যটাই আমাকে শিখিয়ে দিল, ও জীবন আমার হবে না কখনও।

লুলু, এবার কাজের কথায় এসো।

এগুলো কাজের কথা, রোজমারি। এদেশ আমার ভাল লাগে না, তোমারও ভাল লাগার কথা নয়।

লাগে না।

তা হলে পড়ে আছ কেন?

আমার কারখানা?

বেচে দাও। আমি খদ্দের ঠিক করে দিচ্ছি। না হলে ওই ভেড়া মনোজকে গছিয়ে দিয়ে চলো কেটে পড়ি। হাওয়াই।

লুলু, তোমার অনেক মেয়ে-বন্ধু, আমি জানি।

রোজমারি, নিষ্ঠুর হয়ো না। মেয়ে-বন্ধু থাকা কি দোষের?

তা বলি না। কিন্তু এত সুন্দরী থাকতে আমাকেই বা কেন দরকার হয় তোমার বলো তো!

এর কি কোনও জবাব হয়? আমার বাবা বিয়ে করেছিল একজন সুইডিশ মহিলাকে। তিনি আমার জন্ম দেওয়ার এক বছরের মধ্যে কেটে পড়েন। বাবা আমাকে গভর্নেসের হাতে ফেলে দিয়ে ব্যাবসায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, যেন ওটাই তাঁর স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ। স্কুলে পড়াতে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন লন্ডন। তারপর ব্যাবসা শিখতে আমেরিকা। আমি শিখলাম অনেক, কিন্তু কোনওটারই স্বাদ পেলাম না। আমার মা চলে যাওয়ার পর আমার বাবা নারী-হীন একটা জীবন কাটিয়েছিলেন। বোধহয় প্রকৃতি সেই প্রতিশোধটা আমার ওপর দিয়ে তুলছে। আমার জীবনে অনেক নারী। তবু তুমি আলাদা রোজমারি। তুমি অন্যরকম।

আমি কি এখনও আকর্ষণীয়া?

বটেই তো।

আজ আরও একজন একথা বলেছে।

সে কে? আমার প্রতিদ্বন্দ্বী?

না, তার নাম জো। জোসেফ ক্লাইন।

ঈশ্বর! সে তোমার প্রাক্তন স্বামী!

হ্যাঁ, তার সঙ্গে আজ দেখা হয়েছিল।

কী চায় সে?

আমাকে চায় না। তবে অন্য কিছু চায়। আর সেজন্যই তোমাকে এত রাতে বিরক্ত করা।

বিরক্ত নই। বলো।

ঘরে কেউ আছে?

লুলু একটু হাসল, আছেও বটে, নেইও বটে।

তার মানে আছে।

আছে। তবে মেয়েটা বুরবক। কোনও ভয় নেই, বলল। জার্মান সে জন্মেও শোনেনি। হ করে আমার দিকে চেয়ে আছে।

শোনো লুলু। আমার একজন অতিথি আসছে। তাকে একটু ভালরকম প্রোটেকশন দিতে হবে।

কে অতিথি।

আছে একজন।

বিশেষ কেউ?

খুব বিশেষ।

কী ধরনের প্রোটেকশন?

ফুল প্রুফ।

তার কি জীবন সংশয়?

হ্যাঁ। তার পিছনে তিনটে ইন্টারন্যাশনাল গুন্ডার দল লেগে আছে।

ঈশ্বর! সে এখন কোথায়?

কলকাতায়।

নাম-ঠিকানা বলল।

নাম গোপীনাথ বসু। ঠিকানাটা কাল দেব।

লুলু হঠাৎ একটু চুপ করে গেল। তারপর বলল, ঠিক আছে।

পারবে?

পারতেই হবে। তোমার হুকুম।

আমরা তোমার ফি দেব। কিন্তু তোমাকে গ্যারান্টি দিতে হবে।

মানুষ কোনও গ্যারান্টি দিতে পারে না, রোজমারি। তবে আমি যথাসাধ্য করব।

তা হলেই হবে। তোমার ওপর আমার অনেক নির্ভরতা।

ধন্যবাদ রোজমারি। ঠিকানাটা কখন পাব?

কাল বেলা বারোটা নাগাদ। ঠিকানাটা ট্রেস করতে হবে।

ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করব।

ফোনটা রেখে রোজমারি বাতি নেভাল। কিন্তু অনেকক্ষণ তার ঘুম এল না। গোপীনাথকে কাল থেকে হয়তো নিরাপত্তা দেওয়া যাবে, কিন্তু আজ রাতে সে কতটা নিরাপদ? তার চেয়েও বড় কথা, গোপীনাথকে শুধু নিরাপত্তা দিলেই হবে না, সুধাকর দত্তর থাবা থেকে ওকে বের করতে আনতে হবে। সুধাকর দত্ত নামটা মনে হলেই রোজমারি শক্ত হয়ে যায়। ওরকম ঠান্ডা মাথার রোবট-মানুষ সে আগে কখনও দেখেনি।

রোজমারি দুটো ট্রাঙ্কুলাইজার খেয়ে আবার শুল। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

রাত দুটো অবধি জেগে গোপীনাথ তার কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে যাবতীয় তথ্যাবলি ভরে ফেলছিল। গত তিনদিন ধরে একটানা কাজ। এ সবই পেপার ওয়ার্ক। এতে কাজ ততটা হবে যতক্ষণ না হাতেকলমে করা যায়।

আদ্রেঁর কাগজপত্রের মধ্যে সে বারবার একটা ব্যক্তিগত ডায়েরির উল্লেখ পাচ্ছে। আদ্রেঁ হয়তো ডায়েরি রাখত। কিন্তু ডায়েরিটা কোথায় তা জানে না সে। সেই ডায়েরিতে কি আদ্রেঁ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লিখে রেখে গেছে? চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা সমাধান?

রাত দুটোয় হেলানো চেয়ারে বসে গোপীনাথ চোখ বুজে ভাবতে লাগল। যতদূর মনে পড়ে, আরে ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল না, অবকাশও পেত না। উদয়াস্ত পড়ে থাকত সাক্কির অফিসে নিজের ঘরখানায়। কাজ আর কাজ। তবু ডায়েরির উল্লেখ যখন আছে তখন সেখানে কিছু থাকবেই। কিন্তু সে ডায়েরি কোথায় কে বলবে?

গোপীনাথ চুপ করে বসে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে তার একটু ঝিমুনি এল।

ঝিমোতে ঝিমোতে যখন বড় ঘুম এসে যাচ্ছিল প্রায়, তখনই সে হঠাৎ চমকে উঠল। মৃদু, খুব মৃদু একটা শব্দ হল না? কেউ যেন সন্তর্পণে লিফটের দরজা খুলল এবং বন্ধ করল?

সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা গোপীনাথকে অনেক সতর্ক ও তৎপর করেছে। সে টপ করে উঠল পড়ল এবং দ্রুত পায়ে দরজার স্পাই হোলে গিয়ে চোখ লাগাল।

বাইরের ল্যান্ডিং-এ আলো জ্বলছে না। কেন জ্বলছে না? কেউ কি আলো নিভিয়ে দিল?

গোপীনাথও নিজের ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। দরজা লক করা আছে। বিপদ এলেও সময় পাবে গোপীনাথ।

সে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় মাংস-কাটা ছুরি তুলে নিয়ে এল। আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে এটা কোনও প্রতিরোধ নয়, সে জানে। তবু মরার আগে একটা চেষ্টা করা যাবে। ঘটনাটা একতরফা ঘটতে দেওয়া যায় না।

স্পাই হোলে চোখ রাখল গোপীনাথ। ল্যান্ডিং অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকার যেন অনেক ঘটনার সম্ভাবনায় ভরা।

২৫.

গোপীনাথ বিপজ্জনক জীবন কখনও যাপন করেনি। তার জীবন গবেষণা আর লেখাপড়া নিয়ে। সেখানে মারদাঙ্গা, বিপদআপদ ইত্যাদির উকিঝুঁকি নেই। অন্তত এতকাল ছিল না। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটু নতুন অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রয়োজন। গোপীনাথ ভীত নয় তেমন, কিন্তু উদ্বিগ্ন। কারণ রণকৌশল তার জানা নেই।

স্পাই হোল-এ চোখ রেখে ল্যান্ডিং-এর অন্ধকারে কিছুই দেখতে না পেয়ে সে একটু ভাবল। পৃথিবীর যে-কোনও দরজাই ভঙ্গুর। অভেদ্য দরজা বলে কিছু নেই। সেই দরজাই সবচেয়ে মজবুত যা ভাঙতে বা খুলতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে। ফ্ল্যাটের দরজাটা সাধারণ। এর লক-ও কিছু ভল্টের মতো নয়। কোনও আততায়ী এসে থাকলে এবং সেই আততায়ী প্রশিক্ষিত হয়ে থাকলে দরজাটা ভেদ করতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। আজকাল প্লাস্টিক চার্জও পাওয়া যায়। প্রায় নীরব বিস্ফোরণে যে-কোনও তালা উড়িয়ে দেওয়া যায় চোখের পলকে।

গোপীনাথ একটু ভেবে একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিল। সে খুব সন্তর্পণে দরজার লকটা খুলে ল্যাচ ঘুরিয়ে একটু ফাঁক করে দিল পাল্লাটা। তারপর নিঃশব্দে ঘরের অন্যপ্রান্তে গিয়ে স্টিলের আলমারিটার পাশে দাঁড়াল। যে-ই এসে থাকুক দরজাটা খোলা দেখে খুবই অবাক হবে এবং একটু ঘাবড়েও যেতে পারে। গোপীনাথের ডান হাতে ধরা ছুরি। চোখ ঈগলের মতো দরজায় নিবদ্ধ।

প্রথমটায় অনেকক্ষণ কিছুই ঘটল না। ঘরের বাতি নেভানো থাকলেও কাঁচের শার্সি দিয়ে নাগরিক আলোর আভা আসছে। তাতে ঘরটা ভালই দেখা যাচ্ছে, একটু আবছা এই যা।

মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর দরজার পাল্লাটা খুব ধীরে ধীরে ফাঁক হতে লাগল।

প্রায় মিলিমিটারের মাপে। একটা জোরালো টর্চের আলো ঘরটাকে যেন চমকে দিল হঠাৎ। তলোয়ারের মতো এদিক আর ওদিকে দু’-তিনবার চালিত হয়ে অন্ধকারকে যেন ফালা ফালা করে ফেলল।

ঘরে ঢুকল দু’জন। সামনে একজন, দু’পা পিছনে আর-একজন। একটু কুঁজো হয়ে, সতর্ক পায়ে।

গোপীনাথের মনে হল, এবার একটু ডাইভারশন দরকার। সে ছোরাটা তুলল। ভাবল ঘরের অন্য প্রান্তে ছুঁড়ে মারবে, যাতে শব্দ শুনে খুনিরা ওই দিকে যায়। ছোরাটা তুলেও হঠাৎ থেমে গেল সে। বোধহয় ভুল করবে সে এ কাজ করলে। বরং অপেক্ষা করা যাক।

দু’জনের একজন টর্চটা চারদিকে নিক্ষেপ করল। কিন্তু গোপীনাথ আলমারির আড়ালে থাকায় তাকে দেখতে পেল না।

ঘরটা পেরিয়ে শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ফের টর্চ জ্বালল লোকটা। তারপর চাপা গলায় বলল, ব্যাপারটা কী?

অন্য জন বলল, কী?

মালটি তো নেই দেখছি।

বাথরুমটা দেখ।

আরে দূর, সদর দরজা খোলা ছিল না?

তা ছিল।

শালা ভেগেছে।

তবু খুঁজে দেখা যাক।

দু’জনে ঘরে ঢুকে গেল।

কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে গোপীনাথ নিঃশব্দে দ্রুতগতিতে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে এল। সিঁড়িতে ওপরের দিকে মাঝামাঝি উঠে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে নীচে চেয়ে রইল।

পাঁচ-দশ মিনিট বাদে লোকদুটো বেরিয়ে এল। চারদিকে টর্চটা বারকয়েক ঘুরিয়ে দেখল। তারপর লিফটে উঠে চলে গেল।

দরজাটা খোলাই রেখে গেছে ওরা। গোপীনাথ এসে ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজাটা ফের লক করে আলো জ্বালল। শোয়ার ঘরে এসে দেখল তার সুটকেস হাতড়ানো, মানিব্যাগটা টেবিলের ওপর থেকে হাওয়া, একটা ক্যালকুলেটর, একটা ওয়াকম্যান ইত্যাদি রাখা ছিল বিছানার পাশের টেবিলে। সেগুলো নেই। প্রাণের চেয়ে অবশ্যই এগুলোর দাম বেশি নয়।

কিন্তু সে কতটা নিরাপদ তা গোপীনাথ বুঝতে পারছে না। ওরা কি ফিরে আসবে? এলে কখন, বা কবে? ওদের উদ্দেশ্যই বা কী?

কিছু জিনিস চুরি করলেও ওরা কম্পিউটারটা স্পর্শও করেনি। তাতেই বোঝা যায় ওরা গোপীনাথের গবেষণায় আগ্রহী নয়। সুতরাং খুন ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে।

গোপীনাথ ফ্রিজের ঠান্ডা জল খেল খানিকটা। তারপর ঘরের বাতি নিভিয়ে দরজার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে রইল। ডান হাতে ছুরিটা, যেটা কোনও কাজে লাগেনি। লাগবেও না বোধহয়। তবে গোপীনাথকে হয়তো এক চিমটি আত্মবিশ্বাস ছুরিটা দিচ্ছে।

বাকি রাতটা কোনও উৎপাত হল না। ভোরের দিকে গোপীনাথ একটু তন্দ্রাচ্ছন্নও হয়ে পড়েছিল। তবু সূর্যোদয়ের আগেই সে উঠল এবং নীচে নামল। ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ানদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

রাত-ডিউটি যার ছিল সে ফটক খুলে একটা টুলের ওপর বসে হাই তুলছিল।

গোপীনাথ তাকে জিজ্ঞেস করল, রাতে আপনার ডিউটি ছিল?

লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বলল, জি।

কাল অনেক রাতে দুটো নাগাদ দু’জন লোক এ বাড়িতে ঢুকেছিল কি?

লোকটা একটু ভেবে বলল, বাবুলোগ তো অনেকেই বেশি রাতে ফেরেন।

এ দু’জন বাইরের লোক।

লোকটা আরও একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ, এসেছিল।

কার কাছে যেতে চেয়েছিল।

চারতলার থ্রি ডি ফ্ল্যাটে।

আপনারা কি না জেনেই ছেড়ে দেন?

না, ফোন করতে হয়।

ফোন করেছিলেন?

করেছিলাম।

থ্রি ডি ফ্ল্যাট থেকে কেউ কিছু বলেছিল?

দারোয়ান লোকটা এই জেরায় ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, কিছু গড়বড় হয়েছে কি সাহেব?

সেটা পরে বলছি। আগে আমার কথার জবাব দিন। থ্রি

ডি ফ্ল্যাটে মল্লিকজি থাকেন। খুব ড্রিঙ্ক করেন। ওঁর ঘরে বহোৎ আড্ডা হয়। খানাপিনা হয়। কাল রাতেও পার্টি ছিল। আমি ফোন করতেই মল্লিকজির ঘর থেকে কে একজন বলল, পাঠিয়ে দাও। আরও দুটো পাপী এসেছে।

আপনি তাই ছেড়ে দিলেন?

জি।

লোক দুটোকে চলে যেতে দেখেছেন?

হ্যাঁ। এক ঘণ্টা পরে তারা চলে যায়।

ঠিক আছে। মল্লিকবাবুর ফ্ল্যাটে কে কে থাকে?

মল্লিকবাবু একাই থাকতেন। আজকাল একজন লেডিও থাকেন।

ওঁর কে হন উনি?

তা জানি না।

ওঁর স্ত্রী নেই?

ডিভোর্স করেছেন।

গোপীনাথ আর কথা বাড়াল। লিফটে চারতলায় উঠে এল। থ্রি ডি ফ্ল্যাটের ডোরবেলটা বেশ কয়েকবার বাজাতে হল তাকে।

দরজা খুললেন একজন মহিলা। নাইটি পরা, চোখে ঘুম, মুখে বিরক্তি।

কী চাই? বেশ ঝাঝালো গলা।

গোপীনাথ ভদ্রমহিলাকে কয়েক সেকেন্ডে জরিপ করে নিল। বয়স মধ্য ত্রিশ। একসময়ে বেশ সুন্দরী ছিলেন। রং টকটকে ফরসা, মুখশ্রী চমৎকার। শুধু অনভিপ্রেত কিছু চর্বি শরীরকে অনেকটাই বেঢপ করে দিয়েছে।

আমি এই ফ্ল্যাটবাড়িতেই থাকি। ওপরে। আমি একটা কথা জানতে এলাম।

ভদ্রমহিলা চোখ কুঁচকে বললেন, কী কথা?

রাত দুটোর সময় আপনাদের ফ্ল্যাটে কোনও গেস্ট এসেছিল কি?

মনে নেই।

প্লিজ, একটু ভেবে বলুন। দেয়ার কুড হ্যাভ বিন এ মার্ডার।

ভদ্রমহিলা হঠাৎ বিস্ফারিত চোখে বললেন, মার্ডার! কে মার্ডার হল?

হয়নি। হতে পারত। রাত দুটো নাগাদ দু’জন লোক এসে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। তারা আপনাদের ফ্ল্যাটে আসতে চেয়েছিল। আপনাদের ঘর থেকে কেউ তাদের ওপরে পাঠিয়ে দিতে বলে।

ভদ্রমহিলা বড় বড় চোখে চেয়েই ছিলেন। বললেন, তারা দু’জন তো আসেনি।

সেটাই স্বাভাবিক। তারা আমার ফ্ল্যাটে হানা দিয়েছিল।

সর্বনাশ! কেন?

বোধহয় উদ্দেশ্য ছিল আমাকে খুন করা।

ভদ্রমহিলা ঘরের দরজাটা আরও খুলে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, আপনি ভিতরে আসুন, প্লিজ।

গোপীনাথ মৃদু হেসে বলল, না, সেটা আপনাদের ডিস্টার্ব করা হবে। পার্টির পরের সকালটা বিশ্রামই নেয় লোকে।

ওঃ, পার্টি আমাদের রোজই হয়। আসুন, ভাল করে শুনি

গোপীনাথ ভিতরে ঢুকল। সব ফ্ল্যাটই প্রায় একরকম। বিশাল হলঘর, মুখোমুখি শোয়ার ঘর, ডান ধারে রান্নাঘর। এদের ফ্ল্যাটটা অবশ্য খুবই মহার্ঘ আসবাবে সাজানো। কালো টাকার গন্ধ আসছে। সামনের ঘরটা ভুক্তাবশেষ বা বোতল-গেলাসে অগোছালো হবে বলে আশঙ্কা ছিল তার। দেখল, সবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং গোছানো। পার্টির রেশ নেই। তবে লম্বা সোফায় একজন উপুড় হয়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।

ভদ্রমহিলা বললেন, ডোন্ট মাইন্ড হিম। বসুন।

গোপীনাথ একটু অস্বস্তি নিয়ে বসল।

একটু কফি খাবেন?

না, ঝামেলার দরকার নেই।

ঝামেলা হবে কেন? আমাদের কাজের লোক আছে। এক মিনিট লাগবে। জাস্ট রিল্যাক্স।

ভদ্রমহিলা কফির কথা বলতে গেলেন। এসেই মুখোমুখি বসে বললেন, এবার একটু বলুন তো, কী হয়েছে।

গোপীনাথ সবটা বলল না। রেখেঢেকে বলল। কাল রাতে তার ফ্ল্যাটে ঢোকার চেষ্টা করেছিল দুটো লোক। শেষ অবধি পারেনি, ইত্যাদি।

ভদ্রমহিলা বিস্ফারিত চোখে সব শুনে বললেন, আজকাল কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে এসব খুব হচ্ছে। আমি তো সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি।

কফির ট্রে ঠেলে নিয়ে এল উর্দিপরা একটা লোক। ঠাটবাট এদের ভালই।

গোপীনাথ কালো কফি পছন্দ করে। এক কাপ ঢেলে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, ডিস্টার্ব করলাম বলে দুঃখিত।

কিছু ডিস্টার্ব করেননি। আমাকে সকালে উঠতেই হয়। ন’টায় আমার অফিস। আপনি কোথায় কাজ করেন?

গোপীনাথ আনমনে বলল, সাক্কি ইনকরপোরেটেডে।

ভদ্রমহিলা একটু অবাক হয়ে বললেন, সাক্কি? সেই বিখ্যাত সাক্কি কি? কিন্তু তার তো কোনও অফিস এখানে নেই।

না। আমি কাজ করি রোমে।

রোম! ওঃ, আপনি তা হলে এনআরআই?

হ্যাঁ। অনেকদিন।

ভদ্রমহিলা গুছিয়ে বসে বললেন, রোম চমৎকার শহর, না?

হ্যাঁ। ভালই।

আমি দু’বার গেছি।

তাই বুঝি।

আমিও এনআরআই। আমেরিকায় ছিলাম। বছর পাঁচেক চলে এসেছি। ডিভোর্সও হয়ে গেল।

গোপীনাথ বলল, স্যাড।

না আমার কোনও দুঃখ নেই। বেশ আছি। ফ্রি।

তাও বটে। আমি এবার উঠি? আপনি তো অফিসে যাবেন।

হ্যাঁ। এনি ওয়ে, মাঝে মাঝে আসবেন। আমি মানুষ ভালবাসি। এই ফ্ল্যাটে সপ্তাহে দু’দিন পার্টি থাকেই।

গোপীনাথ হাসে, আর বাকি পাঁচ দিন?

পাঁচ দিন আমরা অন্যদের পার্টিতে যাই।

ভদ্রমহিলাও হাসলেন। তারপর ফের বললেন, পার্টিই বাঁচিয়ে রেখেছে, জানেন! একা হলে হাঁফ ধরে যায়।

পার্টির নেশা যে সাংঘাতিক তা গোপীনাথ জানে। বিশেষ করে একা মানুষদের কাছে পার্টি একটা পালানোর জায়গা। একটা আশ্রয়। নিঃসঙ্গতাকে ভুলে থাকবার উপায়।

মাঝে মাঝে আসবেন। কাম নেক্সট স্যাটার ডে।

পার্টি?

হ্যাঁ। প্লিজ।

চেষ্টা করব।

কাম উইথ ইয়োর ওয়াইফ।

সেটা সম্ভব নয়।

ও মা, কেন? উনি বুঝি কনজারভেটিভ?

না। আমরা ডিভোর্স করেছি।

ওঃ, সরি। তা হলে একাই আসবেন।

গোপীনাথ বিদায় নিয়ে চলে এল। এসেই ফোন করল সুব্রতকে।

ঘুম ভেঙেছে?

হ্যাঁ গোপীদা। কী খবর?

খবর ভাল নয়।

কী হয়েছে?

বডিগার্ড দরকার হবে কি না বুঝতে পারছি না।

কেন, কী হল আবার?

আজ একবার আসতে পারবি?

আরে, আজ তো আপনার ওখানে যাওয়ারই প্রোগ্রাম আমার, ভুলে গেছেন?

ওঃ, হ্যাঁ, আজ শনিবার, না?

হ্যাঁ। আজ আমার ছুটি।

তা হলে চলে আয়।

যাচ্ছি। একটু তৈরি হয়ে নিই।

গোপীনাথ ফোন রেখে দিল। ঘণ্টাখানেক বাদে হঠাৎ আবার সুব্রতর ফোন, গোপীদা, আমাদের বস রোজমারি আমাকে ফোন করে আপনার ঠিকানা চাইছে।

কেন?

তা জানি না। বলছে জরুরি দরকার। দেব? না। কিছুতেই না।

২৬-৩০. সুব্রতকে টেলিফোন করার পর

সুব্রতকে টেলিফোন করার পর গোপীনাথ সারা ফ্ল্যাটটা ঘুরে বেড়াল আর ভাবল। এই ফ্ল্যাট বা আর কোথাও সে নিরাপদ নয়। তবু রোমে সে যে বিপদের মধ্যে ছিল এখানে সে ততটা বিপদে হয়তো নেই। কারণ, মাফিয়ারা কলকাতায় এসে তেমন কিছু সুবিধে করতে পারবে না। এটা অচেনা শহর। তাদের ভাড়া করতে হবে কলকাতার খুনিয়াদের। সেইটেই হয়তো তার ভরসা। কলকাতার খুনেরা মাফিয়াদের মতো সংগঠিত নয় এবং হয়তো ততটা বুদ্ধিমানও নয়। কাল রাতে যারা হানা দিয়েছিল তারা তো রীতিমতো বোকা। তবে বারবার বোকা বানানো সহজ হবে না। তবু তার ততটা ভয় করছে না, যতটা রোমে হয়েছিল।

ফ্ল্যাটটা তার নিরাপদ মনে হচ্ছে না একটাই কারণে। তার ঠিকানাটা কোনও ভাবে প্রতিপক্ষের জানা হয়ে গেছে। তার কি পালানো উচিত?

গোপীনাথ ফ্রিজ খুলে দেখল, খাবারদাবার বিশেষ কিছু নেই। ব্রেকফাস্টের জন্য পাঁউরুটি, মাখন এবং কিছু ফলটল জাতীয় জিনিস দরকার। কফি এবং চাও কিনতে হবে।

গোপীনাথ পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ল। আগে সে রাস্তায় হাঁটত ভাবতে ভাবতে। বরাবরই সে একটু চিন্তাশীল এবং অন্যমনস্ক লোক। কিন্তু জীবনে বিপদ শুরু হওয়ার পর তার অন্যমনস্কতা পালিয়েছে, চিন্তাশীলতায় এসেছে নিয়ন্ত্রণ। সে এখন চারপাশকে লক্ষ করে।

দোকান অবশ্য বেশি দূরে নয়। ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে বড় রাস্তার দিকে গেলে পর পর কয়েকটা ভাল দোকান। দু’মিনিটের হাঁটাপথ। এই পথটুকু পেরোনোই আজ কত শক্ত আর সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। একটা লাল জামা আর কালো প্যান্ট পরা ছোকরা একটা রোগা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে তার দিকে বার দুই তাকাল। গোপীনাথ উলটে ছেলেটির দিকে এমন কঠিন চোখে তাকাল যে, সত্যযুগ হলে ছোকরা ভস্মীভূত হয়ে যেত। দু’জন কৃষ্ণভক্ত গেরুয়াধারী সাহেব তাকে পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত পায়ে। গোপীনাথ খুব ঠাহর করে দেখল তাদের, পিছন থেকে যতটা দেখা যায়।

মাখন পাঁউরুটির দোকান পর্যন্ত আর কিছু ঘটল না বটে, কিন্তু সহজ কাজগুলো যে কত কঠিন হয়ে উঠেছে তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারল সে।

ঘণ্টা দুয়েক বাদে সুব্রত যখন এল তখনও সে সেই কথাটাই বলল।

সুব্রত বলল, কাজ কি আপনার এখানে থাকার? আমার বাড়িতে চলুন।

না রে, আমি এখন বিপজ্জনক মানুষ।

কী যে বলেন। চলুন তো, এমনি লুকিয়ে রাখব যে, কেউ টের পাবে না।

ওরা সব টের পায়।

যাক গে, আমি ভয় খাই না। আপনি চলুন।

ও কথা থাক রে সুব্রত, এখন কাজের কথা বল। রোজমারি আমার ঠিকানা চায় কেন?

স্বার্থেই চায়। তবে মুখে বলছে, আপনাকে সিকিউরিটি দেবে।

কীরকম সিকিউরিটি?

তা জিজ্ঞেস করিনি।

ওর কি কোনও সিকিউরিটি এজেন্সি আছে চেনাজানা?

থাকতেই পারে। ঘ্যামা লোকদের কত কী থাকে।

আমি যে কলকাতায় এসেছি এ খবর রোজমারি পেল কোথায়?

তা তো জানি না।

খোঁজ নে।

নেব। তবে সোমবারের আগে হবে না।

আর একটা কথা। রোজমারির প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হলে আমি ভেবে দেখব।

কেন গোপীদা?

ওর ল্যাবরেটরিটা আমার দরকার।

আপনার বডিগার্ড লাগবে বলছিলেন, সত্যি নাকি?

গোপীনাথ একটু ভেবে বলল, বডিগার্ড ব্যাপারটাই হাস্যকর।

অস্বস্তিকরও। কিন্তু দরকার হলে ব্যবস্থা করতে হবে।

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, আফটার এ সেকেন্ড থট, বডিগার্ডের প্রস্তাব বাতিল করছি।

কেন গোপীদা?

বাঙালি বা ভারতীয় বডিগার্ডের ওপর আমার ভরসা নেই। দ্বিতীয় কথা, বডিগার্ড রাখলে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।

কিন্তু আপনার তো বিপদ।

গোপীনাথ চিন্তিত মুখে বলল, বিপদটাও ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। চিন্তা করিস না। মনে হচ্ছে ক্রাইসিসটা সামলে নিতে পারব।

আপনি রিস্ক নিচ্ছেন গোপীদা।

গোপীনাথ একটু হেসে বলল, একটা নিরাপদ নিশ্চিত জীবন যাপন করার পর এই বিপদের জীবনটা খারাপ লাগছে না কিন্তু। জীবনের একঘেয়ে সাকসেস স্টোরিতে একটা নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। নট ব্যাড।

আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ গোপীদা।

গোপীনাথ শুধু একটু হাসল।

সুব্রত বলল, আপনি সোনালিদির কথা কিছু জানতে চাইলেন না তো!

গোপীনাথের মুখখানা উদাস হয়ে গেল, কী-ই বা জানার আছে! আর জেনে হবেটাই বা কী?

সুব্রত একটু রাগের গলায় বলল, অথচ এই তো কিছুদিন আগে আপনি সোনালিদিকে নিজের বিষয়সম্পত্তি দিয়ে দিতে চাইছিলেন।

তখন উপায় ছিল না। আমার তো উত্তরাধিকারী কেউ নেই। সোনালি একসময়ে তো আমার স্ত্রী ছিল, সেই সুবাদে যা একটু সম্পর্কের ছায়া আছে। তা সে তো রিফিউজই করেছে।

সুব্রত মৃদু স্বরে বলল, সোনালিদি রিফিউজ না করলে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকত না। ভদ্রমহিলার আত্মমর্যাদার বোধ খুব টনটনে।

তা হবে। ওসব আলোচনায় আর লাভ কী? ও আমার অফার রিফিউজ করায় আই ফেল্ট ইনসাল্টেড।

কেন গোপীদা, আপনাকে অপমান করার জন্য তো করেননি। ওঁর আত্মমর্যাদায় লেগেছিল বলে নেননি।

হঠাৎ তুই সোনালির সাউকার হয়ে উঠলি কেন? তোকে কি ও উকিল রেখেছে?

সুব্রত হাসল না। গম্ভীর হয়ে বলল, আপনাদের দুজনের মধ্যে কী ঘটেছিল জানি না, কিন্তু আপনাকে বা সোনালিদিকে কাউকেই আমার খারাপ মনে হয় না।

আমিই খারাপ।

কথা এড়িয়ে যাবেন না গোপীদা। কী হয়েছিল বলুন।

গোপীনাথ সামান্য বিরক্ত হল। বলল, এটা কি সেসব কথা বলার সময়? দেখছিস তো কী অবস্থায় আমি আছি।

সুব্রত একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? আমার মনে হচ্ছে আপনার এই বিপদের দিনে আপনার একজন বিশ্বস্ত ও বুদ্ধিমান সঙ্গী দরকার।

গোপীনাথ একটু ব্যঙ্গের সুরে বলল, সেই সঙ্গী কি সোনালি?

নয় কেন?

নয় এই কারণে যে, আমার সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়ে, ব্যস্ততার সময়ে সোনালি আমাকে অপমান করে ছেড়ে চলে এসেছিল। অ্যান্ড শি নেভার লুকড ব্যাক।

কিন্তু কেন এসেছিল গোপীদা?

বোধহয় সে নারীবাদী বা আর কিছু।

আপনি সোনালিদিকে ভাল করে জেনেছেন কি?

চেষ্টা করেছি। স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম বোঝার মতো এলেম আমার নেই।

এটা একটা ক্লিশে।

সোনালি তোকে কত করে ফি দিচ্ছে বল তো।

সোনালিদি ফি দেবেন কেন? তিনি কি আপনার সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করার জন্য লালায়িত?

গোপীনাথ হেসে বলল, লালায়িত কথাটা বেশ বলেছিস। না হয় মানলাম সে লালায়িত নয়। কিন্তু তুই হামলা মাচাচ্ছিস কেন?

আপনার কথা ভেবে।

আমার কথা বেশি ভাবিস না। দুঃখ পাবি। আমাকে খরচের খাতায় ধরে রাখ।

সেটা পেরে উঠছি না। ছেলেবেলা থেকে আপনাকে দেখে আসছি। আপনি আমার আইডল ছিলেন।

গোপীনাথ একটু গম্ভীর হয়ে বলল, তুই আমার ভাল চাস জানি। কিন্তু সোনালির সঙ্গে আমাকে আর জুড়বার চেষ্টা করিস না, কারণ, স্বামী হিসেবে আমি কোনও মেয়েরই যোগ্য নই। মেয়েদের একটা পারিবারিক জীবন চাই, তাদের কিছু সেন্টিমেন্টাল চাহিদাও থাকে, যেটা একেবারেই অন্যায্য নয়। কিন্তু আমি ভেবে দেখেছি, ওসব আমার দ্বারা হওয়ার নয়। কিছু মানুষ থাকে যাদের ঘরে সেট করা যায় না, তারা অ্যাডজাস্টমেন্টে আসতে জানেই না।

সুব্রত মৃদু হেসে বলল, যার নিজের সম্পর্কে অ্যাসেসমেন্ট এত ক্লিয়ারকাট সে তো ইচ্ছে করলেই এই অসুবিধেটা টপকে ফেলতে পারে।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পারলাম কই?

একটু চেষ্টা করলে পারতেন না?

গোপীনাথ ম্লান হেসে বলল, তুই হয়তো জানিস না সোনালির সন্দেহবাতিক ছিল সাংঘাতিক। তার ধারণা হয়েছিল আমার সঙ্গে বিভিন্ন মেয়েমানুষের সম্পর্ক আছে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। ইউরোপে একা ব্যাচেলর মানুষ থাকতাম, মহিলাসংসর্গ হয়নি বলি কী করে? কিন্তু সেগুলো প্রাক-বিবাহ যুগে। পরে কাজের চাপে আর নেশায় আমার অন্য সব বোধই চলে যায়।

সোনালিদির সন্দেহ কি অমূলক?

মাথা নেড়ে গোপীনাথ বলল, তাও বলছি না। তবে এ প্রসঙ্গটা বাদ দিলেই ভাল করবি। দেয়ার ওয়াজ এ হেল অফ মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংস। আমি কাউকে দোষ দিই না।

সোনালিদি কিন্তু অত্যন্ত রিজার্ভড মহিলা, উইথ পারসোনালিটি।

জানি।

আমার মনে হয় আপনি সোনালিদিকে খুব ভাল করে এখনও জানেন না। তাও হতে পারে। কিন্তু ডোন্ট ট্রাই রিকনসিলিয়েশন। ইট মে হার্ট ইউ। এখন রোজমারি আর মনোজের কথা বল। এরা কেমন লোক?

রোজমারি বুদ্ধিমতী।

আর মনোজ কি গাধা?

তা বলছি না। তবে মনোজ ক্রাইসিস ম্যান নন। বিজনেস ব্রেনও নেই।

খুব স্বাভাবিক। সেটা আমারও নেই।

আর একটা কথা।

বল।

শুভ নামে রোজমারির একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে। বাচ্চা ছেলে। সে আমার ঘরে এসে মাঝে মাঝে আড্ডা মারে।

সে কিছু বলেছে?

হ্যাঁ। সে বলেছে রোজমারি নাকি প্রায়ই সিঙ্গাপুরে যায়।

সেখানে কী আছে?

একজন আত্মীয় থাকে। বোধহয় বোনটোন হবে। কিন্তু সেটা কথা নয়। কথা হল, শুভ দেখেছে একটা লোক রোজমারির সঙ্গে একই ফ্লাইটে যায় এবং আসে। কিন্তু রোজমারির চেনা লোক নয়।

বটে!

লোকটা বেঁটে, ফরসা এবং স্বাস্থ্যবান। শুভ তাকে বশ্বের নাম দিয়েছে। লোকটাকে শুভ একদিন ফলোও করে। কিন্তু চিৎপুরের একটা বাড়িতে ঢুকে লোকটা গায়েব হয়ে যায়।

কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী?

সম্পর্কটা শুভ না জানলেও আমি জানি। আমি কোম্পানির পিআরও। শুভ যে বাড়িটার ঠিকানা দেয় সেই বাড়িতেই লুলু নামে একটা লোক থাকে। লুলু আমাদের কোম্পানির সিকিউরিটির চার্জে আছে। কিন্তু সে কখনও অফিসে আসে না। কোম্পানির অ্যাকাউন্টসে খোঁজ নিয়ে জেনেছি লুলুর নামে একটা বেশ মোটা টাকার বরাদ্দ আছে।

গোপীনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, তার সঙ্গেই বা আমাদের কী সম্পর্ক?

আমাদের নয়। রোজমারির।

তুই কি বলতে চাস রোজমারির সঙ্গে ওর এক্সট্রা ম্যারিটাল রিলেশন আছে।

ডিডাকশন তাই সাজেস্ট করে।

তাতেও আমাদের কিছু যায়-আসে না।

আমার ধারণা রোজমারি লুলুকেই আপনার সিকিউরিটির ভার দেবে।

দিক না।

সুব্রত মাথা নাড়ল, আমার কিছু হোমওয়ার্ক করা আছে।

সেটা আবার কী?

পুলিশ রেকর্ড।

লুলু কি ক্রিমিন্যাল?

ড্রাগ ট্রাফিকার। জার্মানিতে ওর বেস। বেশির ভাগ ব্যাবসাই বে-আইনি।

সেটা কি রোজমারি জানে না?

বোধহয় না।

রোজমারি কি বোকা?

বোকা নয়। অজ্ঞানতা। লুলু ইজ এ ব্যাড নিউজ।

তা হলে কী করতে বলিস?

সাবধান হতে বলি।

তুই তো সকালেই আমাকে জিজ্ঞেস করছিলি আমার ঠিকানা রোজমারিকে দিবি কি না। তা হলে আবার একথা বলছিস কেন? লুলু যে ব্যাড নিউজ এটা তো তোর জানাই ছিল।

সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, না জানা ছিল না। লুলু সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য পুলিশের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের কাছে বলা ছিল। তিনি আমার সম্পর্কে কাকা হন। তিনি ঘণ্টাখানেক আগে আমাকে টেলিফোন করে জানালেন।

লুলুকে তা হলে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে না কেন?

প্রমাণাভাব। তা ছাড়া পুলিশ সব ক্রিমিন্যালকে অ্যারেস্ট করেও না, যতক্ষণ না ঘটনা ঘটছে।

গোপীনাথ কাধটা ঝাঁকিয়ে বলল, টোস্ট খাবি? আমার খিদে পেয়েছে।

টোস্ট! এখন এইসব কথার মাঝখানে হঠাৎ টোস্টের কথা কেন?

বিপদ যেমন সত্য, খিদেও তেমন সত্য। কলা আর আপেল আছে, টোস্টের সঙ্গে মন্দ লাগবে না।

সুব্রত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আপনি খান। আমি খেয়ে এসেছি।

গোপীনাথ উঠে গিয়ে টোস্ট সেঁকে মাখন লাগিয়ে নিয়ে এল। সঙ্গে কলা আর আপেল। খেতে খেতে বলল, লুলু যে বা যা-ই হোক রোজমারির ল্যাবরেটরিতে একটা অ্যাকসেস আমার দরকার।

কেন গোপীদা? কোনও এক্সপেরিমেন্ট করতে চান?

হ্যাঁ। অ্যান্ড এ ভাইট্যাল ওয়ান।

সুব্রত কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলল, গোপীদা, আঁদ্রে যখন খুন হয়, অর্থাৎ যখন তাকে বিষ দেওয়া হয় তখন আমি স্পটে ছিলাম, জানেন?

গোপীনাথ অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি?

হ্যাঁ গোপীদা। আঁদ্রে যখন বিয়ারটা খাচ্ছিল তখন আমি তার দিকেই চেয়ে ছিলাম।

বলিসনি তো!

বলে কী হবে! তখন কি জানতাম যে বিয়ারে বিষ আছে?

কে দিয়েছিল জানিস?

যদি বলি জানি?

জানিস! সত্যিই জানিস?

সুব্রত একটু হাসল।

২৭.

সোমবার দুপুরের দিকে সোনালি রোজমারির ফোন পেল।

সোনালি, একবার আমার ঘরে আসবেন?

সোনালি একটু অবাক হল। সে মনোজের সেক্রেটারি। রোজমারির সঙ্গে তার প্রয়োজন খুবই কম। সে বলল, হ্যাঁ, ম্যাডাম আসছি।

সোনালি একটা গোটা উইং পেরিয়ে আর-একটা উইং-এ রোজমারির দফতরে পৌঁছোতে একটু সময় নিল। এবং এই সময়টুকু সে ভাবল। কয়েকদিন আগে মনোজ সেন তাকে ডেকে গোপীনাথ সম্পর্কে কিছু কৌতূহল প্রকাশ করে। তাতে সে মোটেই সন্তুষ্ট হয়নি। বিরক্ত হয়েছে এবং সেটা প্রকাশও করেছে। রোজমারিও আবার সেই একই প্রসঙ্গ তুলবে নাকি?

রোজমারির ঘরে যখন সে ঢুকল তখন রোজমারির মুখে হাসি এবং আপ্যায়ন। সোনালি এই আন-অফিশিয়াল ভাবভঙ্গি পছন্দ করে না বসদের কাছ থেকে।

রোজমারি পরিষ্কার বাংলায় বলল, বসুন সোনালি।

সোনালি বসল। এবং সে হাসল না।

রোজমারি তবু মুখের হাসিটা বজায় রেখে বলল, আপনাকে কয়েকটা কনফিডেনশিয়াল কথা বলতে চাই, সোনালি।

সোনালি ভ্রু একটু কুঁচকে বলল, কী ব্যাপারে?

আমাদের কারখানার ব্যাপারে।

সোনালির ভ্রু কেঁচকানোই রইল, অফিসের ব্যাপারে! কিন্তু সেটা আমাকে কেন? আমি তো সামান্য একজন কর্মচারী।

রোজমারি তবু হাসিমুখেই বলল, আপনার এই কারখানা সম্পর্কে অনেক কথাই জানা আছে। সুতরাং আপনি আমাদের ঘনিষ্ঠ কর্মচারীদের একজন। আমরা সম্প্রতি কিছু সমস্যায় পড়েছি। আপনি কি শুনবেন?

ঠান্ডা গলায় সোনালি বলল, ইচ্ছে করলে বলুন।

রোজমারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গা এলিয়ে বসল। তারপর খুব ধীর গলায় বলল, আমরা যে অ্যালয়টা তৈরি করি সেটা সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা ছিল। বিভিন্ন অত্যাধুনিক ইন্ডাস্ট্রিতে অ্যালয়টা দরকার হয়।

জানি ম্যাডাম।

খুব সম্প্রতি এই অ্যালয়টা কোনও কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমার কারখানাটা অনেকেই কিনে নিতে চেয়েছিল, আমরা দিইনি। এখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও আমাদের ওপর নজর পড়েছে। আমরা বুঝতে পারছি না কী করব। আপনি তো জানেন, আঁদ্রে মারা গেছে এবং ইন্টারপোলের একজন এজেন্ট সুধাকর দত্ত এসে আমাদের যথেষ্ট বিভ্রান্ত করে দিয়ে যায়।

এ সবই আমি জানি ম্যাডাম।

এর একটা রি-অ্যাকশন হয়েছে সাক্কি ইনকরপোরেটেডেও। আপনি হয়তো জানেন না, সেখানকার একটা প্রোজেক্টের চিফ গোপীনাথ বসুকে অপহরণ করা হয় এবং খুন করারও চেষ্টা হয়েছে।

সোনালি চুপ করে রইল। তার বুক কাঁপছিল।

রোজমারি অত্যন্ত নরম গলায় বলল, আমি আপনাদের সম্পর্কের কথা জানি। গোপীনাথ আপনার প্রাক্তন স্বামী।

সোনালি হঠাৎ মুখটা তুলল। তার দুটো চোখ ছলছল করছে এবং নিজেকে সংযত রাখতে পারছে না সে।

সোনালি বলল, গোপীনাথের কী হয়েছে?

রোজমারি মাথা নেড়ে বলল, যতদূর জানি, এখনও কিছু হয়নি।

সোনালি একটা শ্বাস ছেড়ে চুপ করে রইল।

রোজমারি গলাটা আরও নরম করে বলল, সোনালি, আপনি কি জানেন যে, গোপীনাথের বিপদ এখনও কাটেনি?

আমি কিছুই জানি না। ও কোথায় আছে?

রোজমারি মৃদু স্বরে বলল, বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি গোপীনাথ বসু এখন কলকাতায় রয়েছেন।

ভীষণ চমকে উঠল সোনালি। গত মাসখানেক যাবৎ সে প্রতি মুহূর্তে গোপীনাথের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার আশঙ্কা করছে। ঠিক বটে গোপীনাথ এখন তার কেউ নয়। কিন্তু গোপীনাথ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পুরুষ সোনালির জীবনে কখনও আসেনি। হয়তো গোপীনাথই পুরুষ সম্পর্কে তার যাবতীয় আগ্রহকে নষ্ট করে দিয়েছিল। একজন কঠিন, আত্মসর্বস্ব, কাজপাগল মানুষ ছিল গোপীনাথ। স্ত্রী সম্পর্কে যার না ছিল ভাবাবেগ, না ভালবাসা, না কোনও আগ্রহ। নিষ্ঠুর ঔদাসীন্যে সে বরাবর এড়িয়ে গেছে সোনালিকে। বিদেশে একা সোনালির কীভাবে যে দিন কাটত সে-ই জানে। গোপীনাথ সারা পৃথিবী চষে বেড়াত নিজের কাজে। গোপীনাথ সম্পর্কে আজ সোনালির কোনও ভাবাবেগ নেই ঠিক কথা, কিন্তু একটু স্মৃতি আছে। সুখস্মৃতি না হলেও স্মৃতি। গোপীনাথের করুণ পরিণতি ঘটলে সে দুঃখ পাবে।

সোনালি বলল, কলকাতায়! কবে এল?

খুব সম্প্রতি।

ও। বলে চুপ করে গেল সোনালি।

রোজমারি নরম গলায় বলল, কলকাতায় এলেও যে তিনি রেহাই পাবেন, এমন নয়। আপনি হয়তো জানেন না, বেশ কয়েকটা আন্তর্জাতিক মাফিয়া গোষ্ঠী তাকে খুঁজছে।

কেন খুঁজছে?

গোপীনাথ একজন মন্ত বিশেষজ্ঞ। হয়তো আমাদের অ্যালয় সম্পর্কে সত্যিকারের বিজ্ঞানসম্মত সত্যভাষণটা তিনিই করতে পারবেন। কিন্তু কেউ কেউ চায় না যে গোপীনাথ সেটা করুন।

তা হলে কী হবে?

রোজমারি অত্যন্ত সমবেদনার গলায় বলল, গোপীনাথকে বাঁচানো দরকার।

সোনালি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু কিছু বলল না।

রোজমারি বলল, আমাদেরও একটু স্বার্থ আছে। আমরাও তার কাছ থেকে সত্যটা জানতে চাই। জানলে আমাদের অ্যালয় অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে উঠবে।

ও। সোনালির নিস্পৃহ জবাব।

শুনুন সোনালি, স্বার্থ থাকলেও আমরা গোপীনাথের মতো একজন কাজের লোককে হারাতে এমনিতেই চাই না। তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের কিছু করা উচিত। আপনিও কি তা চান না?

সোনালি অভিভূতের মতো চেয়ে থেকে বলল, আপনি কী বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন।

আমরা গোপীনাথের ফ্ল্যাটের ঠিকানাটা জানি না।

জেনে কী করবেন?

তার সিকিউরিটির ব্যবস্থা করব।

সোনালি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এ ব্যাপারে আমি এখনই কিছু বলতে পারি না।

ভেবে বলবেন?

হ্যাঁ, তার আগে ঠিকানাটা উনি দিতে রাজি কি না সেটাও আমার জানা দরকার।

তবে তাই হোক। যদি গোপীনাথের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তা হলে তাকে বলবেন রোজমারি এই প্রস্তাব দিয়েছে যে, তার সিকিউরিটি এবং মাসে এক লক্ষ টাকা বেতন দিতে আমরা প্রস্তুত। তিনি যদি আমার কনসার্নে কাজ করেন তা হলে আমরা কৃতজ্ঞ বোধ করব।

চেষ্টা করব বলতে।

হ্যাঁ, এক লক্ষ টাকা মাইনে ছাড়াও তার যাবতীয় খরচও আমরা দেব, ধরুন মাসে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকার মতো। দয়া করে একথাও বলবেন, বেতন নিয়ে তিনিও তার মতামত দিতে পারেন, আমরা বিবেচনা করতে রাজি আছি।

বলব।

আপনি আজ একটু টেনশনে আছেন। ঠিক আছে আসুন। কাল কথা হবে।

সোনালি সম্পূর্ণ একটা ঘোরের মধ্যে নিজের ঘরে এল। এমনকী যে-লোকটা তার টেবিলের মুখোমুখি বসে তার জন্য অপেক্ষা করছিল, প্রথমে তাকে লক্ষই করল না।

সুব্রত বলল, কোথায় গিয়েছিলেন দিদি?

আপনি কখন এলেন?

মিনিট পাঁচেক হবে।

সোনালি নিজের চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ নিজেকে সংযত করল। গোপীনাথকে সে ভালবাসে না ঠিকই, কিন্তু উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা তাকে বড্ড কাহিল করে ফেলেছে।

সোনালি বিনা ভূমিকায় বলল, সুব্রতবাবু, আপনার গোপীদা এখন কোথায়?

সুব্রত ভ্রু তুলে বলল, কেন বলুন তো!

আমি জানতে চাই গোপীনাথ এখন কলকাতায় কি না। আপনি জানেন?

সুব্রত একটু চুপ করে থেকে বলল, খবরটা চাপা নেই। অনেকেই জানে। আমিও বলব বলেই আপনার কাছে এসেছি।

তা হলে বলুন।

গোপীদা এখন কলকাতায়।

কেন?

গোপীদাকে রোম থেকে পালিয়ে আসতে হয়েছে। অনেক বিপদের ভিতর দিয়ে।

কীরকম বিপদ?

তাকে মারবার জন্য অনেক চেষ্টা হয়েছে। বরাতজোরে বেঁচে গেছেন। কিন্তু কলকাতাও তার পক্ষে হট হয়ে উঠছে।

তা হলে কী হবে?

শুধু ভাগ্যের ওপর আর নির্ভর করা যাচ্ছে না।

আমরা কী করতে পারি?

গোপীদা যদি পালিয়ে বা লুকিয়ে থাকতে রাজি হতেন তা হলে একটা কথা ছিল। কিন্তু হি ইজ এনজয়িং দি ডেনজারস।

সে কী!

সেটাই তো কথা। পরশু দিন ওঁর ফ্ল্যাটে দুটো নোক ঢুকেছিল, উইথ আর্মস।

সোনালি সভয়ে বলল, তারপর?

গোপীদা অ্যালার্ট ছিলেন বলে বেঁচে যান। কিন্তু বারবার এরকম হবে না। সত্যিকারের প্রফেশনাল খুনির পাল্লায় পড়লে মুশকিল আছে।

সোনালি একটু চুপ করে থেকে বলল, রোজমারি ওর সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে চায়। চাকরিও দিতে চাইছে। মাসে দেড় লাখ টাকা মাইনে এবং সেটাও নেগোশিয়েবল।

সুব্রত একটু হাসল, জানি।

জানেন?

হ্যাঁ। রোজমারি প্রস্তাবটা আমাকেই প্রথম দেয়।

গোপীনাথ কী বলছে?

গোপীদা রাজি।

রাজি?

হ্যাঁ। তবে রোজমারির সিকিউরিটি সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। লুলু লোকটা ভাল নয়।

লুলু কে?

ম্যাডামের পেয়ারের লোক। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ।

ও। লোকটা ভাল নয় কেন?

লুলু মে বি এ ডাবল এজেন্ট। ডাবল এজেন্টদের তো বিশ্বাস করা যায় না। হয়তো উলটো পার্টির টাকা খেয়ে গোপীদাকে সেই খুন করে বসল।

সোনালি শিহরিত হয়ে বলে উঠল, না না, তা হলে কিছুতেই লুলু নয়।

আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু ম্যাডামের লুলুর প্রতি খুব দুর্বলতা। উনি হয়তো লুলু সম্পর্কে কোনও বিরুদ্ধ কথা বিশ্বাসই করতে চাইবেন না।

আমি সেকথা রোজমারিকে জানিয়ে দিতে চাই।

কী বলবেন?

বলব, গোপীনাথের সিকিউরিটির ভার আমরা নেব। লুলুকে এর মধ্যে আনা চলবে।

বলে দেখুন তা হলে।

তার আগে গোপীনাথের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।

টেলিফোন তুলে নিন না, হাতের কাছেই রয়েছে।

সোনালি মাথা নেড়ে বলল, এখন নয়।

কেন এখন নয়?

আই অ্যাম ফিলিং নার্ভাস।

কেন সোনালিদি? নার্ভাস হওয়ার মতো কী আছে?

বহুকাল সম্পর্ক নেই। হয়তো রি-অ্যাক্ট করবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুব্রত বলল, কেন যে আপনাদের সম্পর্কটা এমন বিষিয়ে গেল কে জানে। অথচ দু’জনেই তো ভাল।

আমি ভাল নই।

কে বলল ভাল নন? আপনি খুব ভাল।

তাই বুঝি?

গোপীদাও ভাল।

সোনালি চুপ করে রইল।

সুব্রত একটু পরে বলল, গোপীদা এখন ফ্ল্যাটেই আছেন। আপনি ফোনটা করুন সোনালিদি।

রোজমারির প্রস্তাবটা ওকে দেব তো!

হ্যাঁ, কিন্তু আমার আর একটা জরুরি কথা আছে।

কী কথা?

আপনি কিছু মনে করবেন না তো?

তেমন কিছু কথা কি?

হয়তো পছন্দসই হবে না। প্লিজ, রাগ করবেন না।

ঠিক আছে, বলুন।

গোপীদা কীরকম বিপদের মধ্যে আছেন তা তো বুঝতেই পারছেন।

পারছি। হি ইজ বিয়িং হাউন্ডেড।

হ্যাঁ। হাউন্ডেড বাই হার্ডেন্ড ক্রিমিন্যালস।

বুঝলাম।

গোপীদা তবু একা থাকছেন। এই একা থাকাটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। লোনলি ম্যান ইজ ইজি টারগেট।

তা হলে কী করতে হবে?

আমি চাই, গোপীদার একজন সর্বক্ষণের সঙ্গী থাকুক। তাতে দু’জোড়া চোখ দু’জোড়া কান এবং দু’জোড়া হাত থাকবে।

সোনালি অবাক হয়ে বলল, একজন গার্ড রাখলেই তো হয়।

গার্ড! গার্ড কি ততটা অ্যালার্ট হবে? বেতনভুক কর্মচারী কি পারে বুক দিয়ে বাঁচাতে?

তা হলে কে পারবে?

গোপীদার কোনও আপনজন। গোপীদাকে ভালবাসে এমন কেউ। সেটা আপনি।

আমি! বলে হাঁ করে চেয়ে থাকে সোনালি।

আপনিই সোনালিদি। আপনি ছাড়া কারও কথা ভাবাই যায় না। আমি যাচ্ছি। আপনি ফোনটা করুন।

সুব্রত চলে গেল। সোনালি বিস্মিত সর্বস্বান্তের মতো বসে রইল। কী অনায়াসে বলে চলে গেল সুব্রত। কিন্তু কী সাংঘাতিক একটা ঝড় তুলে গেল তার বুকে।

সোনালি আরও কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল অভিভূতের মত। তারপর দুর্বল হাতে টেলিফোনটা তুলে ডায়াল করল।

টেলিফোনটা কানে দিয়ে শুনল ওপাশে রিং হচ্ছে।

রিং হয়ে যেতে লাগল, ফোন কেউ ধরল না।

২৮.

ফোনে নো-রিপ্লাই হলে ধরে নিতে হয় যে, লোকটা ফ্ল্যাটে নেই। অথবা ফোনটা খারাপ। ফোন খারাপ থাকার কথা নয়, থাকলে সুব্রত জানত। বাড়ি নেই এটাই ধরে নেওয়া ভাল।

সোনালি তবু একটু উদ্বেগের মধ্যে রইল। লোকটা বিপদের মধ্যে আছে। মারাত্মক বিপদ। একটা কিছু যখন তখন হয়েও যেতে পারে তো! চিন্তাটা সোনালি মাথা থেকে তাড়াতে পারল না। অথচ গোপীনাথের সঙ্গে তার জাগতিক সম্পর্ক শেষ হয়েছে। তাকে নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে।

সোনালির ডাক এল মনোজের ঘর থেকে, আধ ঘণ্টা বাদে।

মিস সোম, বসুন।

সোনালি বসল।

আপনার সঙ্গে রোজমারি আজ একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গে কথা বলেছে।

হ্যাঁ।

মনোজের মুখটা খুবই ভারাক্রান্ত এবং উদ্বিগ্ন। সে গলা খাঁকারি দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, আমিও এর আগে একদিন প্রসঙ্গটা তুলে আপনাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিলাম। তবু কথাটা যে উঠছে তার কারণ দুটো। আমাদের অ্যালয়ের কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন থেকে আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। দ্বিতীয় কথা, গোপীনাথ বসুর মতো ট্যালেন্টেড লোককে যে-কোনও মূল্যেই বাঁচানো উচিত।

সোনালি মাথা ঠান্ডা রেখে বলল, গোপীনাথ বসুকে সিকিউরিটি দেওয়ার ব্যাপারে কিছু কথা আছে।

কী কথা?

আপনাদের দেওয়া সিকিউরিটি আমাদের পছন্দ নয়।

মনোজ হঠাৎ এ কথায় ঝুঁকে পড়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, কেন বলুন তো!

লুলু সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা নেই।

মনোজ অবাক হয়ে বলল, লুলু! লুলু আবার কে?

ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ।

মনোজ ভ্রু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড কিছু মনে করার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলল, লুলু! মাই গড! লুলু মানে তো নওলকিশোর লালা। সে-ই কি আমাদের সিকিউরিটি ইনচার্জ?

ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের সিকিউরিটি ইনচার্জ কে সেটাও মনোজ জানে না দেখে বিস্মিত সোনালি বলল, হ্যাঁ। কেন, আপনি জানতেন না?

মনোজ একটা অদ্ভুত চোখে সোনালির দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে ওপর নীচে কয়েকবার মাথা নেড়ে বলল, আঁ! হ্যাঁ-হ্যাঁ। অবশ্যই।

সোনালির স্পষ্ট মনে হল, মনোজ সত্যিই জানত না। এবং জেনে মোটেই খুশি হল না। তার মুখে আচমকা একটা রক্তাভা দেখা গেল।

একটু সময় নিয়ে এই আকস্মিক অপ্রতিভতাকে একটু সামলে নিয়ে মনোজ হেসে বলল, আসলে সবসময়ে সব জিনিস খেয়াল থাকে না। আমি একটু অ্যাকাডেমিক টাইপের। বাস্তববোধ কম। ওসব রোজমারিই দেখে কিনা। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন।

সোনালি খুব শান্ত, দৃঢ় গলায় বলল, আমরা লুলুর কথাই বলছিলাম। সিকিউরিটির ব্যাপারে লুলুকে আমাদের পছন্দ নয়।

মনোজ একটু চুপ করে থেকে বলল, কেন নয় বলবেন?

ওর সম্পর্কে আমাদের কিছু সন্দেহ আছে।

মনোজ ভ্রু কুঁচকে আরও একটু ভেবে বলল, লুলুর কনসার্নের নাম গ্লোবাল সিকিউরিটি, না?

না তো! ইউনিভার্সাল আই।

ওঃ, তা হবে। নওলকিশোরের অনেক কোম্পানি, অনেক ব্যাবসা। সবকিছুর খবর রাখা অসম্ভব। তা হলে আপনারা কী চান?

গোপীনাথের সিকিউরিটির ভার অন্য কেউ নিক।

মনোজ প্রস্তাবটা অগ্রাহ্য করল না। বলল, বেশ। কিন্তু চাকরির অফারটা?

সেটা উনি রাজি হলে আপনাকে জানাব।

চিন্তিত মনোজ হঠাৎ যেন সবকিছু থেকে খানিকটা দূরে সরে গেল। নিস্পৃহ হয়ে গেল। লুলুর প্রসঙ্গটা কি এতই অরুচিকর ওর কাছে? কেনই বা? সুব্রত বলেছিল, লুলু রোজমারির পেয়ারের লোক। কথাটা কতটা সত্যি! আর সবচেয়ে বড় কথা, লুলু কে? আসলে কে?

মনোজের কাছ থেকে খুব নিচু স্বরে বিদায় নিয়ে চলে এল সোনালি। টেবিলটা চটপট গুছিয়ে নিয়ে সে বেরোবার মুখে আর একবার টেলিফোন করল গোপীনাথকে। রিং বেজে গেল। ফোন কেউ ধরল না।

অন্য দিনের চেয়ে আজ অনেক দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল সোনালি। গোপীনাথের ফোন কেন নো-রিপ্লাই হচ্ছে সেটা তার জানা দরকার। ট্যাক্সি পাওয়া যাবে কি না ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যখন সে ঊর্ধ্বশ্বাসে বাইরের দিকে ছুটছিল তখন বাইরে চমৎকার লনের দু’পাশে যে গাড়ি পার্ক করার জায়গা আছে, সেখান থেকে কে যেন অনুচ্চ স্বরে ডাকল, সোনালিদি।

হেলমেট পরা, সুব্রতকে সে প্রথমটায় চিনতে পারেনি। সুব্রত তার মোটর বাইকটাকে পার্কিং লট থেকে বের করে সামনে এনে দাঁড় করাল, উঠুন।

সোনালি এই প্রথম টের পেল তার হাত-পা বশে নেই। সে রীতিমতো কাঁপছে। বলল, আমি পারব না। পড়ে যাব।

উঠুন সোনালিদি। উই মাস্ট রিচ হিম কুইকলি। গত তিন ঘণ্টা ধরে গোপীদার ফোনে নো-রিপ্লাই।

সোনালি সুব্রতর পিছনে উঠে পড়ল। তারপর কীভাবে যে রাস্তাটা পার হল তা সে জানেও না। সম্পূর্ণ হতচেতনা বা আচ্ছন্নতার মধ্যে ছিল সে। একজন চেনা মানুষ এখন আর স্বামী নয়–তবু তো চেনা। তার মৃত্যুটা কীভাবে নেবে সোনালি।

সুব্রত বাইকটাকে লক করে তার হাত ধরে প্রায় হিঁচড়ে টেনে এনে লিফটে উঠে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল।

কী হয়েছে সুব্রতবাবু? আপনি এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন?

সোনালিদি, প্রে টু গড।

ওর কি কিছু হয়েছে?

হোক তা আমরা কেউ-ই চাইছি না।

লিফট থামতেই দরজা খুলে লাফিয়ে নেমে গেল সুব্রত। পিছনে সোনালি।

দরজাটা আধখোলা ছিল। সুব্রত সপাটে সেটাকে খুলে ভিতরে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল। বাইরের ঘরের দৃশ্যটাই বীভৎস। দেওয়াল, দরজা, ডিভান, কম্পিউটার, সোফাসেট সর্বত্র এলোপাথাড়ি গুলি চালানোর চিহ্ন। মেঝেয় অবধি কোথাও কোথাও চলটা উঠে গেছে। না হোক গোটা ত্রিশ-চল্লিশবার গুলি চালানো হয়েছে এই ঘরে।

সুব্রত শোয়ার ঘরটায় উঁকি দিল। এ ঘরেও কয়েকবার গুলি চলেছে বটে, কিন্তু বেশি নয়। সুব্রত বাথরুম, বারান্দা, আর একখানা ঘর সর্বত্র ঘুরে দেখল। কোথাও লাশ নেই।

সোনালি সুব্রতর সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে আছে। আতঙ্কিত গলায় বলল, এসব কী হয়েছে সুব্রতবাবু?

গুলি চলেছে। কিন্তু কেউ মরেনি। গোপীদা হয় পালিয়েছে, নয় কেউ বা কারা তুলে নিয়ে গেছে।

অ্যাবডাকশন?

হতেও পারে। গোপীদাকে কতবার বললাম আমার বাড়িতে চলে যেতে, কেন যে গেল। সাহস ভাল, কিন্তু অতি-সাহস তো ভাল নয়।

সোনালি ঘাবড়ে গেছে। মুখ শুকনো, ঠোঁট সাদা। তবু যেন ভিতর থেকে কিছু কঠিন হয়েছে সে। চারদিকে চেয়ে বলল, এত গুলি চালাল কেন বলুন তো? মারতে হলে তো একটা-দুটো গুলিই যথেষ্ট।

সেটাই ভাবছি।

সদর দরজার কাছে গিয়ে ঘরটা একবার দেখল সোনালি। তারপর হঠাৎ ডান ধারে কাঁচের শার্সিওলা জানালার দিকটায় গিয়ে বলল, সুব্রতবাবু, এদিকে আসুন।

সুব্রত গেল।

যতদুর মনে হচ্ছে কেউ বাইরে থেকে এই জানালা দিয়ে ভিতরে গুলি করেছে।

সুব্রত অবাক হয়ে বলল, বাইরে থেকে?

হ্যাঁ। ওই দেখুন, বাইরে ভারা বাঁধা আছে।

কথাটা মিথ্যে নয়। বাড়ির এ পাশটায় বাস্তবিক ভারা বাঁধা আছে। সম্ভবত রাজমিস্ত্রি বা রঙের মিস্ত্রিদের কাজ চলছে। তবে আজ কোনও মিস্ত্রি নেই। জানালার কাচগুলি ভাইব্রেশনে ফেটে গেছে। শব্দ হয় এমন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। হলে লোক জমে যেত। কাজ হয়েছে নিঃশব্দে।

সুব্রত বলল, কিন্তু গোপীদা কোথায়?

সোনালি চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছিল। কোথাও রক্তের চিহ্ন দেখতে পেল না সে।

সুব্রত জানালা দিয়ে নীচে ঝুঁকে কিছু দেখছিল। হঠাৎ চাপা গলায় বলল, সোনালিদি! এদিকে আসুন।

সোনালি প্রায় ছুটে এল।

কী সুব্রতবাবু?

সুব্রত নীচের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, কিছু দেখতে পাচ্ছেন?

কী?

নীচে কিছু ঝোঁপঝাড় রয়েছে। বোধহয় এ বাড়ির কিচেন গার্ডেন। দেখতে পাচ্ছেন?

সোনালি ঝুঁকে দেখে বলল, পাচ্ছি।

ভাল করে দেখুন, ঠিক জানালার সোজাসুজি নীচে একটা ঝোঁপের ভিতর থেকে একজোড়া পা বেরিয়ে আছে।

সোনালি মাথা ঘুরে বোধহয় পড়েই যেত। সুব্রত ধরে ফেলে বলল, নার্ভাস হবেন না। মাথা ঠান্ডা রাখুন।

কার পা? আপনার গোপীদা?

আসুন আমার সঙ্গে। ব্যাপারটা দেখা দরকার।

কিন্তু যাবে কী করে সোনালি? তার হাত-পা কাঁপছে, বুকে প্রচণ্ড ধড়ফড়, শ্বাসকষ্ট। বলল, সেই দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে?

ভাল করে না দেখে কিছু ধরে নেওয়া কি ভাল? মনে হচ্ছে যার পা দেখা যাচ্ছে সে এই আটতলা থেকেই নীচে পড়ে গেছে।

সোনালি বিবশ গলায় বলল, আটতলা থেকে? তা হলে কি বেঁচে থাকার কথা।

হু নোজ? লেট আস সি। চলুন।

নীচে নেমে গোপীনাথের মৃতদেহ পর্যবেক্ষণের মতো অবস্থা সোনালির নয়। তার শরীর যেন নেই হয়ে গেছে, মাথা সম্পূর্ণ বোধশূন্য। এত বিকল তার কোনওদিন লাগেনি। ভয় নয়, মনটা যেন দুর্ভেদ্য অন্ধকার।

অবস্থাটা বুঝে সুব্রত একরকম তাকে ধরে ধরেই লিফট পর্যন্ত আনল। লিফটাকে ওপরে আনতে একটু সময় লাগল। সুব্রত চাপা স্বরে বলল, স্বাভাবিক আচরণ করুন। নইলে লোকে সন্দেহ করবে।

নীচে নেমে তারা একজন ছোকরা দারোয়ানকে দেখতে পেল। একটা বাচ্চা চা-ওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে।

সুব্রত গিয়ে বলল, পিছনদিকে বাগানের মধ্যে কেউ পড়ে আছে।

লোকটা হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, কে পড়ে আছে?

সেটাই দেখা দরকার। আমাদের সঙ্গে এসো।

আপনারা কোন ফ্ল্যাটের মেহেমান?

গোপীনাথ বসু। আটতলা। এসো, সময় নেই।

লোকটা একটা বেঁটে লাঠি হাতে নিয়ে উঠল। পিছনে বাস্তবিকই বিস্তর ঝোঁপঝাড়। ঘনবদ্ধ বাগান। আটতলা থেকে একটা প্রমাণ সাইজের মানুষ পড়ে যাওয়াতেও যে তেমন শব্দ হয়নি তা দারোয়ানের আচরণেই বোঝা যাচ্ছে। শব্দটা সে শুনতে পায়নি।

মস্ত একটা কামিনী ঝোঁপ ভেদ করে লোকটা পড়েছে। ঝোঁপের মধ্যেই আটকে আছে তার দেহ। শুধু পা দুটো বাইরে। পায়ে বিদেশি দামি জুতো, পরনে ফেডেড জিনসের প্যান্ট, গায়ে একটা জিন্‌সেরই শার্ট।

না, লোকটা গোপীনাথ নয়। এ লোকটা ছোটখাটো, রোগার দিকেই। হাত থেকে একটা স্টেনগান গোছের জিনিস ছিটকে ঝোপেই আটকে আছে।

দারোয়ান চেঁচাল, কে লোকটা?

সুব্রত তাকে ধমক দিয়ে বলল, চেঁচাচ্ছ কেন? পুলিশে খবর দাও।

দারোয়ান বলল, উনি তো ফ্ল্যাটের লোক নন! লোকটার মুখ ভাল করে দেখে নিল সুব্রত। না, এ ফ্ল্যাটের লোক তো নয়ই, এ দেশের লোকও নয়। স্পেন বা দক্ষিণ আমেরিঙ্গর মানুষ। গায়ের রং বাদামি। মোটা গোঁফ আছে।

সোনালি প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে স্থির চোখে লোকটাকে দেখছিল।

সোনালিদি, এবার স্বাভাবিক হোন।

সোনালি মাথা নেড়ে বলল, স্বাভাবিক হব! কী করে বলুন তো! এসব কী হচ্ছে। আপনার গোপীদাই বা কোথায়?

তা জানি না। তবে মনে হচ্ছে এ লোকটাই ভারা বেয়ে উঠে গোপীদাকে গুলি করার চেষ্টা করেছিল।

কিন্তু তারপর কী হয়েছিল?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

দারোয়ানটা হঠাৎ লোকটার পা ধরে টানাহ্যাঁচড়া করতে যাচ্ছিল। সুব্রত ধমক দিয়ে বলল, ওরকম করবে না, পুলিশ খেপে যাবে।

তা হলে কী করব স্যার?

থানায় খবর দাও। বাড়িতে কারও টেলিফোন নেই? যাও তাড়াতাড়ি।

লোকটা চলে গেল।

আমরা কী করব সুব্রতবাবু?

চলুন, গোপীদার ফ্ল্যাটে গিয়ে একটু কফি খাওয়া যাক।

কী যে বলেন!

সোনালিদি, আমাদের যে অপেক্ষা করতেই হবে। চলুন।

তারা আবার ওপরে এল। ফ্ল্যাটে ঢুকল। সোনালি বলল, কফিটা আমি করে আনছি।

সুব্রত চারদিকটা ঘুরে দেখছিল। জবাব দিল না।

হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠতেই সুব্রত একরকম দৌড়ে গিয়ে সেটা ধরল।

হ্যালো।

একটা সতর্ক সরু গলা বলল, কে?

কাকে চাই?

গোপীনাথ বসু আছেন?

না, নেই।

একটু চুপ থেকে গলাটা হঠাৎ মোটা হয়ে গেল, কে রে, সুব্রত নাকি?

হ্যাঁ, গোপীদা! আপনি বেঁচে আছেন?

আছি। আজকাল বেঁচে থাকাটাই কেমন অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।

ফ্ল্যাটে এ কী কাণ্ড হয়ে আছে?

সেইজন্যই একটু গা-ঢাকা দিতে হয়েছে।

কী হয়েছিল বলবেন?

খুব সাংঘাতিক ব্যাপার। দুপুরে কম্পিউটার নিয়ে বসেছিলাম। কিছু কাজ ছিল। হঠাৎ কী হল জানিস, ঘরের স্বাভাবিক আলোর প্যাটার্নে একটা সূক্ষ্ম চেঞ্জ ঘটল। খুব সূক্ষ্ম। বাঁদিকে চেয়েই দেখলাম, শার্সির বাইরে একটা মাথা উঠে আসছে, একটা নলও যেন দেখতে পেলাম।

তারপর?

বিশ্বাস করবি না সেই ঘটনা। কোথায় দৌড়ে পালাব, তা নয়। আমি সটান মেঝেতে শুয়ে ড্রাই সাঁতার দিয়ে ওই জানালার দিকেই এগিয়ে গেলাম। লোকটা শার্সি দিয়ে ভিতরে এলোপাথাড়ি গুলি চালাচ্ছিল।

সর্বনাশ!

আমাকে যখন দেখতে পায় তখন আমি জানালার কাছে পৌঁছে গেছি।

আপনি কি পাগল?

না, আমি বুদ্ধিমান। লোকটা শেষ চেষ্টা করেছিল আমাকে ঝাঁঝরা করে দিতে। আমি শুধু হাত বাড়িয়ে ওকে একটা ধাক্কা দিয়েছি।

এত সাহস ভাল নয় গোপীদা।

লোকটা কি মরে গেছে?

হ্যাঁ। না মরলেও মরবে।

দিস ইজ মাই ফাস্ট মার্ডার।

এটা মার্ডার নয় গোপীদা। সেলফ ডিফেন্স।

২৯.

যে-কোনও ঘটনারই একটা ধাক্কা আছে। গোপীনাথ ধাক্কাটা এখনও সামলে উঠতে পারেনি। একটা লোক–তা সে হোক না আততায়ী–তার হাতেই খুন হয়েছে, এই নগ্ন সত্যটা সে ভোলেই বা কী করে? আত্মরক্ষার্থে খুন যে খুন নয় তাও সে জানে, তবু কি মন তা মানছে?

টেলিফোনে সুব্রতর মোলায়েম গলা বলে যাচ্ছিল, আপনি মোটেই এটাকে হোমিসাইড হিসেবে নেবেন না। আপনি লোকটাকে ধাক্কা না দিলে লোকটা আপনাকে অবশ্যই খুন করত। বুঝেছেন ব্যাপারটা?

বুঝেছি। তবু আমার খুব নার্ভাস লাগছে।

আপনি এখন কোথায় গোপীদা?

একটা পাবলিক কল বুথ থেকে কথা বলছি। গড়িয়াহাটে।

শুনুন, আপনার এখন আর এই ফ্ল্যাটে আসার দরকার নেই। আমার মনে হয়, এখন কিছুদিন অন্যত্র যাওয়াই আপনার পক্ষে ভাল।

দূর বোকা।

কেন, বোকা বলছেন কেন?

লোকটা কোন তলা থেকে পড়েছে, কেন পড়েছে এসব পুলিশের জানা নেই। কিন্তু তদন্তের সময়ে পুলিশ যদি দেখে যে আমি সন্দেহজনকভাবে অনুপস্থিত তা হলে দোষটা আমার ঘাড়ে চাপাতে সুবিধে হবে।

সুব্রত একটু ভেবে বলল, বাঃ বেশ বলেছেন তো! কিন্তু সন্দেহ করার কারণ তো থেকেই যাচ্ছে। আপনার ঘরের দেওয়াল মেঝে সর্বত্র গুলির দাগ, পুলিশ এলে তো জলের মতো বুঝতে পারবে যে, লোকটা কোন ফ্ল্যাটে ঘটনা ঘটাতে এসেছিল। তখন তো আপনাকেই সন্দেহ করবে।

নাও করতে পারে। আমি যদি বলি যে, ঘটনার সময় আমি ঘরে ছিলাম না এবং লোকটা অ্যাক্সিডেন্টলি ভারা থেকে পড়ে গেছে?

পুলিশ বিশ্বাস করবে কি?

করবে। কারণ লোকটা বিদেশি, বাঁশের ভারায় ওঠার অভিজ্ঞতা নেই। তার ওপর লোকটা একটা হাই ইমপ্যাক্ট অটোমেটিক অস্ত্র চালাচ্ছিল। খুবই রিস্ক ছিল কাজটায়।

সুব্রত ফের একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, আপনি না একটু আগেই বলছিলেন যে, আপনি নার্ভাস বোধ করছেন?

করছিই তো।

যে নার্ভাস তার ব্রেন এত চমৎকার কাজ করে কীভাবে?

গোপীনাথ একটু হেসে বলল, মাথা বেচেই তো খাই। আমাদের বুদ্ধিজীবী বলা হয়, সেটা ভুললে চলবে কেন?

যাকগে, তা হলে আপনি ফ্ল্যাটটা ছাড়বেন না?

ফ্ল্যাটটা ছাড়লে এবং গা-ঢাকা দিলে আমি বাঁচব বটে; কিন্তু ঘটনাগুলো আমাদের হাতের বাইরে চলে যাবে। আর বাঁচলেও সেটা হবে সাময়িক। আমার পিছনে যারা লেগেছে তারা খুনের ফেরিওয়ালা। এক-একটা খুনের জন্য যদি বিশেষ ব্যক্তিকে খুনের চুক্তি থাকে–তা হলে বিরাট টাকার লেনদেন হয়, বুঝলি?

বুঝলাম।

তাই ওরা সহজে হাল ছাড়বে না। যেখানেই পালাই, খুঁজে বের করে মারবে। ডেডবডিটা কি ওখানেই পড়ে আছে?

হ্যাঁ। কেউ বুঝতেই পারেনি যে, একটা লোক পড়ে গেছে নীচে। এমনকী দারোয়ানও নয়। সুতরাং আইউইটনেস নেই। না, গোপীদা, আপনি বোধহয় নিরাপদ।

মোটই নয়।

কেন বলুন তো!

আশপাশে মেলা হাইরাইজ বাড়ি আছে। যেসব বাড়ি থেকে কেউ যে ঘটনাটা দেখেনি তার কী বিশ্বাস আছে? এখনই হয়তো মুখ খুলবে না, কিন্তু সময়মতো হয়তো বলে দেবে।

ওঃ, আপনি তো ভীষণ সমস্যায় ফেললেন গোপীদা? যা-ই বলছি তাই উড়িয়ে দিচ্ছেন?

ওরে, বিপদে পড়ে এখন যে আমার বাস্তববুদ্ধি আর কাণ্ডজ্ঞান হয়েছে একটু।

তা হলে কী করবেন?

রিস্ক নিয়ে ওই ফ্ল্যাটেই থাকব। তবে অজুহাতগুলো ভাবতে হবে।

একা থাকবেন?

দোকা থাকার বিপদ আছে। দু’নম্বর লোকটিকে প্রথমত বিশ্বাস করা যাবে না। দ্বিতীয়ত দু’নম্বর লোকটিকে খামোখা বিপদে ফেলা হবে।

কেউ যদি স্বেচ্ছায় বিপদের ঝুঁকি নেয়?

তুই নিবি আমি জানি। কিন্তু তোর বউ বাচ্চা আছে, তোকে এই বিপদে টেনে আনার চেয়ে আমার গলায় দড়ি দেওয়া ভাল।

আমি নই। তবে আমি ছাড়াও কেউ থাকতে পারে।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার কেউ নেই, তুই তো জানিস। এই যে একা হয়ে গেছি, এই একাই এখন আমার অভ্যাস। না রে, তুই আমাকে নিয়ে ভাবিস না।

আমি না ভাবলেও কেউ কেউ ভাবছে।

তুই কি সোনালিকে মিন করছিস? কেন রে? ও মেয়েটার সেন্টুতে খোঁচা দিয়ে কেন এই বিপদের মধ্যে ঠেলে দিবি? ও মতলব ছাড়। সোনালির আমার প্রতি কোনও দুর্বলতা নেই, আমি জানি। আমার দুঃখের আর বিপদের কথা ওকে শুনিয়ে তুই প্রায় ওকে ফোর্স করছিস বলে আমার বিশ্বাস। এ কাজটা ঠিক হচ্ছে না। লিভ সোনালি অ্যালোন।

আপনাকে নিয়ে পারা যায় না। আপনি এত স্টাবার্ন।

শোন না পাগলা, রোজমারি আর মনোজ কী বলছে?

তারা আপনাকে এক লাখ টাকা বেতন এবং ইনসিডেন্টাল এক্সপেন্সের জন্য মাসে আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে চায়। অবশ্য অফার নেগোশিয়েবল।

গোপীনাথ নাক সিঁটকে বলল, দেড় লাখ মাত্র?

আরে না। আরও উঠবে। প্লাস আপনার সিকিউরিটি।

সিকিউরিটি তো তুই অ্যাকসেপ্ট করতে চাইছিস না। লুলু না কী যেন নাম লোকটার!

হ্যাঁ। আপনি কোম্পানির সিকিউরিটি না নিয়ে নিজস্ব সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে পারেন। খরচ ওঁরা দেবেন।

গুড।

আপনার অফার কী?

এটা গরিব দেশ, খুব বেশি চাওয়া হয়তো ঠিক হবে না।

দেশ গরিব হোক, ওঁরা তো গরিব নন। বছরে কয়েক কোটি ডলার টার্নওভার। আপনি ছাড়বেন কেন?

ঠিক আছে, বেতনটাকে তিনগুণ করে দিতে বল।

তার মানে তিন লাখ?

হ্যাঁ। আর ওই পঞ্চাশ হাজার।

রেটটা চিপ হয়ে গেল না?

আরে না। এটা তো স্টপ গ্যাপ ব্যবস্থা।

গোপীদা আপনি সাক্কিতে কত বেতন পেতেন?

সে অনেক টাকা। আমার হিসেব নেই। তবে ফেবুলাস সামথিং। ব্যাঙ্কে জমা হত। টাকা রোজগারটা আমার কাছে অর্থহীন লাগে এখন। কোনও মানে হয় না। টাকা খরচা করারও তো পথ পাই না।

গরিবদের দিলে পারেন তো৷

দূর বোকা? তোর কি ধারণা গরিবদের টাকা বিলিয়ে দিয়ে তাদের উপকার করা যায়? টাকার ব্যবহার গরিবরা জানেই না। উলটোপালটা খরচ করে, মদটদ খায়, ফুর্তি করে। গরিবদের যদি কখনও দিতে হয় দিবি, কিন্তু আন্ডার গাইডেন্স, নইলে ওই টাকা কারও কারও বিপদ ডেকে আনতে পারে।

বুঝলাম। এবার আপনি ফ্ল্যাটে চলে আসুন। আমরা অপেক্ষা করছি।

আমরা। আমরাটা কে?

আমি আর আমার এক কলিগ।

কলিগকে টেনে এনেছিস কেন?

ইনি ভাল সিকিউরিটির কাজ জানেন বলে এনেছি।

তোকে তো বলেইছি আমার সিকিউরিটি গার্ড লাগবে না।

তবু দেখুন, পছন্দ না হলে ফিরিয়ে দেবেন।

তোকে নিয়ে আর পারা যায় না। পুলিশ এসেছে? উঁকি মেরে দেখ তো?

এখনও আসেনি গোপীদা।

গুড। আমি আসছি।

গোপীনাথ ফোন রেখে দেওয়ার পর সুব্রত ফোনটা ধীরে নামিয়ে রেখে ফিরে সোনালির বিবর্ণ মুখ দেখতে পেল।

কী বলছিল ও?

গোপীদাকে যতটা ইমপ্র্যাকটিক্যাল ভাবতাম ততটা নন। ক্লিয়ার ব্রেনে ভাবছেন। ডিটেলসে ভাবছেন, দ্যাটস এ গুড সাইন।

সোনালি দুর্বল গলায় বলল, কীসের গুড সাইন বলুন তো! আপনারা কি পাগল হয়ে গেলেন? এরকম ঝাকে ঝাকে গুলি ছুঁড়ে গেছে, আর একটু হলেই তো মরত, গুড সাইন কীসের?

আছে সোনালিদি, আছে। হি ইজ লিভিং ডেনজারাসলি, ঠিক কথা। কিন্তু উনি যে সিচুয়েশনটা সম্পর্কে সচেতন সেটাও তো একটা প্লাস পয়েন্ট।

এসব হেঁয়ালি আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

সুব্রত একটু হেসে বলল, আসলে বিপদ দেখে আপনি খুব ঘাবড়ে গেছেন, যাওয়ারই কথা, কিন্তু গোপীদা ঘাবড়াননি।

কী হয়েছিল বলল?

লোকটা যখন ভরা বেয়ে ওপরে উঠেছিল তখন গোপীদা কম্পিউটারে কাজ করছিলেন, উনি বললেন, উনি ঘরের আলোয় খুব সূক্ষ্ম একটা চেঞ্জ টের পেয়েছিলেন, বুঝলেন?

বুঝলাম।

না সোনালিদি, বোঝেননি। আরও তলিয়ে ভাবুন। নরম্যালি এত সূক্ষ্ম চেঞ্জ ধরাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়, বিশেষ করে যখন আপনি খুব মন দিয়ে কোনও কাজ করছেন।

ও, তাই বুঝি?

তার মানে কী জানেন তো! গোপীদার সিক্সথ সেন্স খুব ভাল কাজ করছে। আর সেটাই এই সিচুয়েশনে সবচেয়ে ভাল খবর। ইট উইল সেভ হিম।

সোনালি ভ্রু কুঁচকে বলল, কিন্তু একদিন যদি সিক্সথ সেন্সটা ফেল করে তা হলে কী হবে?

সুব্রত নিপাট ভালমানুষের মতো বলল, সেইজন্যই তো আপনাকে দরকার।

আমাকে। বিস্মিত সোনালি বলল, আমাকে দিয়ে কোন কাজ হবে?

গোপীদার এখন বোধহয় সবচেয়ে প্রয়োজন আপনাকে। নইলে এই ত্রিভুবনে গোপীদার আর কোনও বন্ধু নেই।

কেন, আপনিই তো আছেন।

হ্যাঁ, আমিও গোপীদার খুব বিশ্বস্ত বন্ধু বটে, কিন্তু আমি চব্বিশ ঘন্টার বন্ধু নই।

আপনার গোপীদার কোনও বন্ধু নেই কেন বলুন তো।

যাঁরা জিনিয়াস তারা একটু বন্ধুহীন হন। আসলে ইন্টেলেকচুয়ালি তারা এত হাই যে, সমান মাপের মানুষ পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া ইগো প্রবলেম তো থাকেই।

তবু স্বীকার করবেন না যে, আপনার গোপীদা স্বার্থপর।

সুব্রত সবেগে মাথা নেড়ে বলল, না সোনালিদি, গোপীদা একজন হেল্পলেস ম্যান। কতটা অসহায় তা হয়তো আপনি জানেন না। এমনিতেই উনি একটু আনসোশ্যাল, সংসারী নন, তার ওপর কাজপাগল। আর এখন তো ঘোরতর বিপদে পড়ে সম্পূর্ণ এক্স কমিউনিকেটেড। উনি চাকরিটা নিতে চাইছেন কেন জানেন, টু বি ইন দি গেম এগেন। চাকরিতে জয়েন করলে বিপদও আছে। হি উইল হ্যাভ টু লিভ অ্যান এক্সপোজড লাইফ, ইজি টারগেট। গোপীদার সত্যিই কোনও বন্ধু নেই সোনালিদি।

সোনালি গম্ভীর হল। চিন্তিতও হয়তো উদ্বিগ্নও। সামান্য ধরা গলায় বলল, তবে চাকরি করতে দিচ্ছেন কেন? বারণ করুন না।

বারণ করার আমি কে? ওঁর ওপর আমার অধিকার সামান্য, তা ছাড়া ওঁর অলটারনেটিভই বা কী? পালিয়ে থাকলেও খুব সুবিধে হবে না, ওঁর পিছনে কারা লেগেছে তা তো বুঝতেই পারছেন। দুনিয়ার সবচেয়ে কৃতবিদ্য খুনিরা। তাও এক তরফ নয়, দুই তরফ, উনিও সেই কথাই বলছিলেন, পালিয়ে থেকে হবেটা কী, বরং ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে।

সোনালি ভাবছিল। ভ্রু কোঁচকানো এবং দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে থেকে। একটু বাদে বলল, আমার কী করা উচিত তা বুঝতে পারছি না।

যদি ইচ্ছে করে তবে গোপীদাকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা করতে পারেন।

আপনি তো জানেন, উই আর নো মোর রিলেটেড অ্যাজ হাজব্যান্ড অ্যান্ড ওয়াইফ। উই ওয়ার নেভার গুড ফ্রেন্ডস। সত্যি কথা বলতে কী, উই হ্যাড ভেরি লিটল রাপোর্ট। ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হত খুবই কম।

আমি গোপীদাকে জানি সোনালিদি, লোকটা ওই রকমই। কাণ্ডজ্ঞানের বেশ অভাব। কিন্তু হোপফুলি হি হ্যাজ চেঞ্জড।

সেটা প্রমাণসাপেক্ষ।

আচ্ছা, আচ্ছা, লেট হিম কাম।

সোনালি একটা শ্বাস ফেলে বলল, আমি বরং চলে যাই। আমাকে দেখলে হয়তো খুশি হবে না।

হু নোজ? একটু থেকেই যান।

হয়তো ভাববে আমি রি-এন্ট্রির চেষ্টা করছি।

গোপীদা কি মিনমাইন্ডেড সোনালিদি?

লোকটাকে আমি ভাল চিনি না।

কে কাকে চেনে? চিনতে সময় লাগে।

সোনালি নিরস্ত হল। তারপর কে জানে কেন, রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। হয়তো গোপীনাথ আসার মুহূর্তে সামনে থাকতে চায় না।

বাইরে মোটামুটি অন্ধকার হয়ে আসছে। গোপীনাথ একটু দেরি করছে আসতে। কৌতূহলী সুব্রত জানালার কাছে গিয়ে নীচে তাকাল। হ্যাঁ, পুলিশ এসেছে। কয়েকজন পুলিশ এবং বেশ কিছু কৌতূহলী লোক।

ডোরবেল বাজল। সুব্রত গিয়ে দরজা খুলতেই গোপীনাথের হাসিমুখ দেখা গেল।

কী রে?

আপনার জন্য আমরা ভেবে সারা হচ্ছি আর আপনি দিব্যি হাসিহাসি মুখ করে ঘরে ঢুকছেন?

তবে কি কাদব রে? তবে আমার বোধহয় শোকার্ত মুখ নিয়েই থাকা উচিত। কিন্তু কী হচ্ছে জানিস?

কী হচ্ছে?

আই অ্যাম এনজয়িং দা লাইফ থরোলি। যত ঘটনা ঘটছে ততই ভাল লাগছে। বুঝলি রে পাগলা মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আমি এত ভাল কোনওদিন থাকিনি।

বটে!

একজ্যাক্টলি। ভাবছি পাগল হয়ে গেলাম নাকি!

সুব্রত মাথা নেড়ে বলল, পাগলামি হলে টের পেতাম।

এখন কী করলাম জানিস?

কী করলেন?

নীচে গিয়ে পাঁচজনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দিব্যি ডেডবডিটা দেখলাম। পুলিশ অফিসারের সঙ্গে একটু ঠাট্টা-ইয়ারকিও করলাম। একটুও ঘাবড়ে যাইনি। অথচ লোকটা একটু আগে আমার হাতেই

ফের গোপীদা?

যাকগে। এনি ওয়ে আই অ্যাম নাউ এ ভেরি কনফিডেন্ট ম্যান। মনে হচ্ছে আমার আরও এক জোড়া চোখ, আরও এক জোড়া কান এবং মগজে আরও কিছু ঘিলু কেউ সাপ্লাই দিয়েছে। দাঁড়া, আগে পোশাকটা পালটাই।

গোপীনাথ শিস দিতে দিতে শোয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকল এবং কিছুক্ষণ পরে পরিষ্কার একটা সাদা লুঙ্গি আর গেঞ্জি চড়িয়ে বেরিয়ে এল। বলল, মুশকিল কী জানিস, মাঝে মাঝে বড্ড খিদে পায়।

খিদে।

হ্যাঁ। তোর ক্যাটারাররা দু’বেলা সেই মিল সার্ভ করে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জলখাবার তো দেয় না। ওটা আমাকে বানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু সবসময়ে সময় হয় না, খেয়ালও থাকে না। তখন খিদে চেপে জল খেয়ে সময়টা কাটিয়ে দিতে হয়। হ্যাঁ, তা তোর সেই কলিগটি কোথায়? বিদেয় করে দিয়েছিস?

হয়তো বিদেয় হতে চাইবে না।

বটে। কিন্তু তাকে তো আমার দরকার নেই।

কে জানে দরকার আছে কি না। আগে আলাপ তো হোক।

রান্নাঘর থেকে সোনালি বেরিয়ে এল। হাতে একটা ট্রে। তাতে কফির কাপ, টোস্ট ওমলেট এবং কাটা ফল বিভিন্ন প্লেটে সাজানো। কিছু কাজুবাদামও দেখা যাচ্ছিল আলাদা পিরিচে। গোপীনাথের সামনের টেবিলে রেখে যখন দাঁড়াল সামনে, তখন গোপীনাথ যেন ভূত দেখছে। মুখে কথা নেই।

কথা কিছুক্ষণ হারিয়েই গেল যেন সকলের মুখ থেকে।

৩০.

বেশ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত থেকে গোপীনাথ খুব স্তিমিত গলায় বলল, তুমি! সোনালি মুখখানা যেন দাতে দাঁত চেপে কঠোর করে বলল, হ্যাঁ আসতে হল।

আমি তো সুব্রতকে বারণই করেছিলাম তোমাকে ডিস্টার্ব করতে। ও কথা শুনল না।

ও আমাকে এনেছে কে বলল?

সুব্রত আনেনি?

আমার ইচ্ছে না হলে কি আনতে পারত।

গোপীনাথ বোধহয় লজ্জা ও সংকোচে মাথা নিচু করে বলল, তুমি নিজের ইচ্ছেয় আমার সঙ্গে দেখা করবে ভাবিনি। আমার বড় অসময়ে এলে।

কীসের অসময়? তুমি কী করেছ?

গোপীনাথ অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, কোনও দোষ করেছি বলে তো মনে হয় না। কিন্তু ঘটনার একটা ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে গেছি। আমার কাছাকাছি কেউ থাকুক আমি চাই না। হি অর শি উইল বি ইন মরটাল ডেনজার।

সে তো খানিকটা আঁচ পাচ্ছিই। এরকম সাংঘাতিক অবস্থায় তুমি থাকছ কী করে?

একটু ম্লান হেসে গোপীনাথ বলল, থাকছি আর সাধে? থাকতে হচ্ছে। যাব কোথায়?

অন্তত কিছুদিনের জন্য তো একটু লুকিয়ে থাকা যায়।

মাথা নেড়ে গোপীনাথ বলে, কোথায় লুকোব? যেখানেই যাব সেখানেই ঘটনা ঘটবে। যাদের কাছে যাব তারা বিপদে পড়বে। আমি এখন অচ্ছুৎ। আমার কাছে তোমাদের আসার দরকার নেই। দেখছ তো কী কাণ্ড হয়ে গেল আজ। সাব মেশিনগান দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল।

সোনালি একটু রেগে গিয়ে বলল, একটা কারণ তো থাকবে।

কারণ তো আছেই। আদ্রেঁর রিসার্চ নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া চলছে। সলিড ফুয়েল নিয়ে রিসার্চ। জিনিসটা যদি তৈরি করা যায় তা হলে খুব লাভজনক। তাই কম্পিটিটররা নেমে পড়েছে।

আদ্রেঁর দায় তোমার ঘাড়ে চাপছে কেন?

অনেকের ধারণা, কাজটা হয়তো আমি শেষ করতে পারি। সোনালি, তোমার পাসপোর্টটা কি ভ্যালিড আছে?

কেন থাকবে না? আছে।

ওঃ! বলে গোপীনাথ একটা কাতর শব্দ করল।

কী হল?

গোপীনাথ ফের ম্লান হেসে বলল, আমার তো কোনওকালেই কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু ছিল না। তোমার সঙ্গে যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সেটা ভুলে গিয়ে এখনই একটা অন্যায্য আবদার করতে যাচ্ছিলাম।

সোনালি ভ্রু কুঁচকে চাপা গলায় বলল, কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

হ্যাঁ হ্যাঁ খাচ্ছি। আয় রে সুব্রত।

সুব্রত কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, আমারও পাসপোর্ট আছে। আমি একবার হংকং গিয়েছিলাম। কোনও কাজ থাকলে বলতে পারেন।

তুই রোম শহরটা চিনিস না, সোনালি চেনে।

রোমে কোনও কাজ আছে?

হ্যাঁ। কিন্তু বিপজ্জনক কাজ।

কী কাজ?

একটা বন্ধ ফ্ল্যাটে ঢুকে একটা জিনিস খুঁজতে হবে।

কী জিনিস?

আদ্রেঁর ডায়েরি।

কোনও ফর্মুলা আছে নাকি?

কী আছে জানি না। তবে ওর পেপার্সে ডায়েরিটার রেফারেন্স আছে বারবার।

কাজটা খুব শক্ত কি?

খুব শক্ত।

তা হলে সোনালিদিকে বলছেন কেন?

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, ঠিক কাজ করিনি। আমার মাথাটা ঠিক নেই কিনা।

সোনালি একটু দূরে সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, কী ঠিক করেছ, আমার ছোঁয়া কিছু খাবে না?

সেকী!বলে তাড়াতাড়ি কফির কাপ তুলে নিল গোপীনাথ। তারপর বলল, আমার সবকিছুই ডিসকর্ডে চলছে। সংগতিহীন আচরণ। তবে ইন্সটিংক্ট কাজ করছে। ভাল কাজ করছে।

সোনালি বলল, আমাকে অনভিপ্রেত মনে হলে সেটা বলে দাও। তা হলে আমি আর আসব না।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অনভিপ্রেত কেন হবে? তা নয়। তবে তোমাকে আমার কাছে আর আসতে হবে না।

শোনো, তুমি আমাকে সহ্য করতে না পারলে আমি আসব না ঠিকই। কিন্তু যদি বিপদের ভয়ে আমাকে তাড়াতে চাও তা হলে আসব।

কেন সোনালি? তুমি কী করবে এসে?

তা জানি না। পরে ভাবব। সুব্রতবাবু, আপনি আমার বাড়িতে খবরটা দিয়ে দেবেন কি যে, আমি এই ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটে আছি এবং হয়তো কয়েকদিন থাকব?

ওঃ সোনালিদি, বাঁচালেন।

গোপীনাথ মুখ গোমড়া করে বলল, তুই যে এত ইডিয়ট তা জানতাম না। মাথার গ্রে সেলগুলো তো একদম ইনঅ্যাক্টিভ দেখছি।

শোনো মিস্টার বোস, আমি থাকছি।

সোনালি, প্লিজ!!

একটা কারণেই থাকছি যে, দুটো মাথা সবসময়েই একটা মাথার চেয়ে বেশি কাজের। তোমাকে বাঁচানো দরকার।

গোপীনাথ কফি খেল। তারপর হঠাৎ টোস্টের প্লেটটা টেনে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে লাগল। বলল, অনেকক্ষণ খিদে পেয়েছে। খাইনি।

সোনালি সুব্রতর দিকে চেয়ে বলল, আপনাকে একটু সাহায্য করতে বললে করবেন কী?

করব। বলুন।

আমার কিছু জিনিস চাই। একটা চিরকুট দিচ্ছি, আমার মাকে দেবেন। মা সব গুছিয়ে দেবে। সেটা এখানে আমার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

এটা কোনও কাজ হল? চিরকুটটা লিখে ফেলুন। এনে দিচ্ছি।

গোপীনাথ শুধু বলল, অবাধ্য।

কফি খেয়ে সুব্রত চটপট বেরিয়ে গেল। বলে গেল, ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই আসছি। ততক্ষণ আপনারা সেটলমেন্টে আসুন।

সুব্রত চলে যাওয়ার পর সোনালি বলল, শোনো, আমি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটাই এখন আর বিশ্বাস করি না। বিয়ে জিনিসটার ওপর কোনও আস্থা নেই আমার। কিন্তু বন্ধুত্ব জিনিসটাকে মানি৷ তুমি আমাদের বিয়েটাকে ভুলে গেলে ভাল হয়। আমি আজ বন্ধুর মতোই এসেছি, নট অ্যাজ অ্যান এক্স-ওয়াইফ।

গোপীনাথ হঠাৎ মুখ তুলে সোনালির চোখে চোখ রেখে বলল, তুমি কখনও আমার বন্ধু ছিলে? আমাদের বন্ধুত্বের রিলেশনটাই বা কবে কীভাবে হল?

আমরা একসঙ্গে তো কিছুকাল ছিলাম।

ওই পর্যন্তই। একসঙ্গেও কি ছিলাম?

সেটা তোমার দোষ।

কবুল করছি। আমি তোমাকে কম্পানি দিইনি। আমি বর্বরের মতোই ব্যবহার করেছি। তাই আমরা যেমন স্বামী-স্ত্রী হইনি, তেমন বন্ধুও হয়ে উঠিনি। তাই আজ হঠাৎ তোমার এই বন্ধুর মতো আগমনটা অস্বাভাবিক।

সোনালি খোঁচা খেয়ে লাল হল। তীব্র গলায় বলল, তুমি তো সত্যিই বর্বর। কারও বন্ধুত্ব পাওয়ারও যোগ্য নয়।

গোপীনাথ হিমশীতল গলায় বলল, শোনো আমি বর্বর হলেও আমার কতকগুলো নিজস্ব মর‍্যাল ভ্যালুজ আছে। নিঃসম্পর্কের কোনও মহিলার সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

সোনালি এ কথায় ছিটকে উঠে দাঁড়াল। তীব্রতর গলায় বলল, তোমার মর‍্যালিটি শুনে আমার হাসি পায়। ইউ ওয়্যার অলওয়েজ এ লায়ার, এ চিট, এ ডিবচ।

ঠান্ডা গলায় গোপীনাথ বলল, হ্যাঁ, ঠিক কথা। আমার ওসব দোষও আছে। যদি জানোই, তা হলে হঠাৎ আজ বন্ধুত্ব পাতাতে এলে কেন?

কেন বলে তোমার মনে হয়?

মে বি ইউ আর আফটার মাই মানি।

উত্তেজিত সোনালি দাতে দাঁত ঘষে বলল, মানি! মানি! লজ্জা করল না বলতে? যখন রোম থেকে সুব্রতকে ফোন করে আমাকে সর্বস্ব দিতে চেয়েছিল তখন কে রিফিউজ করেছিল?

গোপীনাথ তেমনি উত্তেজনাহীন নিষ্ঠুরতায় বলল, মে বি নট মানি, বাট ফর সাম আদার রিজিনস।

হোয়াট আর দোজ রিজিনস?

গোপীনাথ একটা হাই তুলে বলল, সেটা ভাবতে হবে।

তুমি তোমার এত সাহস যে, আমাকে

সোনালি কাঁদত হয়তো। কিন্তু শক্ত হল। তার চোখ থেকে উগ্র ঘৃণা শরাঘাতে জর্জরিত করছিল গোপীনাথকে। সে বলল, তোমার বন্ধুত্বটাকে কেন বিশ্বাস করি না জানো? ওটা অ্যারেঞ্জড বন্ধুত্ব। তোমাকে কেউ শিখিয়ে পড়িয়ে এনেছে।

অলরাইট, আই অ্যাম লিভিং।

গুড নাইট।

সোনালি প্রায় দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল এবং বেরিয়ে গেল। দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হাসল গোপীনাথ। কৌশলটা যে এত সহজে কাজ করবে তা প্রত্যাশিত ছিল না। আপাতত দুশ্চিন্তা কমল। সোনালি নিরাপদ।

গোপীনাথ চুপচাপ বসে ট্রে-র সমস্ত খাবারগুলো শান্তভাবে খেয়ে নিল। তার খিদে পেয়েছিল, কিন্তু এতক্ষণ টের পায়নি।

খেয়েদেয়ে ট্রে-টা রান্নাঘরে যখন রাখতে গেল গোপীনাথ তখন ডোরবেল বাজল। গোপীনাথ ধীরেসুস্থে গিয়ে দরজা খুলে দেখল, পুলিশ।

স্যার, আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

আপনারা কি পুলিশের লোক? তা হলে আমারই আপনাদের কাছে যাওয়ার কথা।

কেন বলুন তো?

জাস্ট লুক অ্যাট মাই রুম।

পুলিশ অফিসার ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন, মাই গড। ঘটনাটা তা হলে এ ফ্ল্যাটেই ঘটেছে?

দেখতেই তো পাচ্ছেন। ভাগ্যিস আমি ঘটনার সময় ফ্ল্যাটে ছিলাম না! কী কাণ্ড বলুন তো! এসব কি টেররিস্ট গ্রুপটুপের কাজ নাকি মশাই?

তা এখনই বলতে পারি না। লোকটা বিদেশি। তার কাছ থেকেও কিছু জানার উপায় নেই। কারণ লোকটা মারা গেছে। পকেটে কাগজপত্র বা পাসপোর্টও পাওয়া যায়নি। আপনি একবার নীচে গিয়ে লোকটাকে দেখবেন? হয়তো আপনি চিনতে পারেন। আপনাকেই যখন মারতে এসেছিল।

গোপীনাথ শান্ত গলায় বলল, তার দরকার নেই, নীচে ভিড় দেখে আমি স্পটে গিয়ে লোকটাকে দেখেছি। ওকে আমি চিনি না, চেনার কথাও নয়। ওপরে এসে দেখছি এই কাণ্ড।

দু’জন পুলিশ অফিসার ঘরে এসে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখল। জানালার কাছে গিয়ে উকিঝুঁকি দিল। তারপর সোফায় এসে বসে বলল, এবার আমাদের কিছু প্রশ্নের জবাব দিন দয়া করে।

আমার নাম গোপীনাথ বসু। সায়েন্টিস্ট এবং এনআরআই। রোমে থাকি। সাক্কি ইনকরপোরেটেড নামে কোম্পানিতে চাকরি করি। ডিভোর্সি। কয়েকদিন হল দেশে এসেছি। আর কী জানতে চান বলুন!

আপনাকে খুন করে কার লাভ হতে পারে?

আমার জানা নেই।

আপনার কোনও শত্রু আছে? দেশে বা বিদেশে?

না মশাই, আমার খুব সাদামাটা লাইফ। ভেরি সিম্পল।

আপনার পাসপোর্টটা দেখাতে পারেন কি?

কেন পারব না? বলে গোপীনাথ উঠে গিয়ে পাসপোর্টটা নিয়ে এসে পুলিশ অফিসারের হাতে দিল। অফিসার সেটা খুঁটিয়ে দেখে সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে দিয়ে বলল, লোকটা বিদেশি বলেই বলছি, রোমে কিছু ঘটনা ঘটেনি তো!

না। কী ঘটনা ঘটবে?

এই ফ্ল্যাট কি আপনার নিজস্ব?

হ্যাঁ। কয়েক বছর আগে কিনেছিলাম।

এখানে কে থাকে?

আমি এলে থাকি। নইলে ফাঁকা তালাবন্ধ পড়ে থাকে।

কেউ থাকে না?

না।

ঠিক আছে। আগে লোকটার আইডেন্টিটি বের করি, তারপর আমরা আবার আসব।

ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

ইতিমধ্যে আপনি, আশা করি, কোথাও যাবেন না!

আমার ছুটি খুব বেশি দিনের নয়। আপনারা একটু তাড়াতাড়ি করলে ভাল হয়।

চেষ্টা করব স্যার।

দ্বিতীয় পুলিশ অফিসারটি এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বলল, আপনি কি সাধারণত এই ঘরেই থাকেন বা কাজ করেন?

হ্যাঁ। কম্পিউটারের সামনে দিনের অনেকটা সময় কাটে আমার।

আমরা ভাবছি, খুনি খালি ঘরে গুলি চালাল কেন। সেটা তো লজিক্যাল নয়।

তা জানি না। এমনও হতে পারে লোকটা তলা ভুল করেছে। তাড়াহুড়ো ছিল বলে ভাল করে ঘরটা দেখেনি।

আমরা সব পসিবিলিটি নিয়েই ভাবব।

পুলিশ যাওয়ার পর গোপীনাথ দরজা বন্ধ করল এবং বেশ আরাম করে পা ছড়িয়ে সোফায় বসে টিভিটা চালু করল। টিভির দিকে অর্থহীন চেয়ে থেকে সে ভাবছিল। মনের ভিতর একটা কেমন ওলটপালট হচ্ছে সোনালিকে দেখার পর থেকে। সোনালি সুন্দরী।  কিন্তু মেয়েদের সৌন্দর্য ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর নেই গোপীনাথের। বিদেশে সে সুন্দরী তো কম দেখেনি। আর সুন্দরী বলেই হঠাৎ তার এতকালের ঠান্ডা বুকে ঝড় উঠবে তাও নয়। কিন্তু যেটা তাকে সামান্য হলেও স্পর্শ করেছে তা হল সোনালির এই পাশে এসে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা। এবং এই সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে। গোপীনাথের জীবন শুকনো নিঃসঙ্গ। এই উষরতার মধ্যে একটা যেন একটু জীবনের ছোঁয়া, হঠাৎ যেন অন্য জগতের দরজা একটু ফাঁক হয়ে গেল।

বোকা সোনালি গোপীনাথের কৌশলটা ধরতে পারেনি। রেগে চলে গেল, অর্থাৎ যা গোপীনাথ চেয়েছিল। এখন গোপীনাথ নিশ্চিন্ত। শত্রু বা মৃত্যুর সম্মুখীন হতে এখন আর তার দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের কিছু নেই।

ডোরবেল বাজল আধঘণ্টা বাদে। গোপীনাথ বেড়ালের মতো চকিত পায়ে গিয়ে আই হোলে চোখ রাখল। সুব্রত।

দরজা খুলে বলল, আয়।

সুব্রত গম্ভীর মুখে বলল, সোনালিদিকে নাকি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন?

হ্যাঁ। একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেল। ক্ল্যাশ অব ইগো। আগেও হত।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। সোনালিও আমাকে অপমান করেছে।

সুব্রত ঘরে ঢুকে বলল, চালাকি ছাড়ুন গোপীদা।

চালাকি! চালাকির কথা উঠছে কেন?

আপনি ইচ্ছে করে একটা ঝগড়া পাকিয়ে সোনালিদিকে এখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছেন।

ওরে পাগলা, তা নয়।

তাই গোপীদা, আমি জানি।

তা হলে বলি শোন, সোনালির কোনও বিপদ হোক তা আমি চাই না। এই বিপদের মধ্যে কিছুতেই ওকে রাখতে পারি না।

কিন্তু উনি চালাকিটা যে ধরে ফেলেছেন।

অ্যাঁ!

হ্যাঁ।

সোনালি আড়াল থেকে দরজার ফ্রেমে এসে দাঁড়াল। মুখ গম্ভীর।

৩১-৩৬. একটু বেশি রাত অবধি

একটু বেশি রাত অবধিই সুব্রত রয়ে গেল। ক্যাটারার খাবার দিয়ে গেলে তা ভাগ করে খেল তিনজনই। যাওয়ার সময় সুব্রত বলল, গোপীদা, আপনার কি কোনও অস্ত্রশস্ত্র চাই?

গোপীনাথ অবাক হয়ে বলে, অস্ত্র। অস্ত্র দিয়ে কী হবে?

আত্মরক্ষার্থে যদি লাগে।

দুর বোকা। আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র লাগে না, বুদ্ধি লাগে।

তবু ভেবে দেখুন আমি একটা পিস্তল দিতে পারি।

কোথায় পাবি?

কলকাতায় পথেঘাটে পাওয়া যায়।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, স্বাভাবিক। অস্ত্র আজকাল সব দেশেই আকছার পাওয়া যাচ্ছে।

আপনার চাই কি না বলুন।

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, না। ইন ফ্যাক্ট একটা পিস্তল এ বাড়িতেই আছে। সেটার কথা আমার মনে ছিল না।

এ বাড়িতে?

হ্যাঁ। তবে সেটা আমার নয়। বোধহয় সুধাকর দত্ত ওটা রেখে গেছে ইচ্ছে করেই।

তা হলে তো হয়েই গেল।

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, হল না। অস্ত্র হাতে পেলেই মানুষের একটা হননেচ্ছা জাগে। অস্ত্র জিনিসটার এদিকটার কথা কেউ ভাবে না।

তবু অস্ত্রটা হাতের কাছে রাখবেন। দরকার হলে ব্যবহারও করবেন।

আরও মানুষ মারতে বলছিস?

আরও মানে! আপনি তো এখনও একটাকেও মারেননি।

আজই মেরেছি।

না মারেননি। লোকটা পড়ে মারা গেছে। আপনি কিছুই করেননি।

একটা ধাক্কা দিয়েছিলাম।

ওটা ভুলে যান। ধাক্কা না দিলে ও আপনাকে চালুনির মতো শতছিদ্র করে দিত।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপীনাথ বলল, তা দিত।

তা হলে। খামোখা সিমপ্যাথির অপচয় করবেন না।

গোপীনাথ চুপ করে রইল।

টেবিল পরিষ্কার করে সোনালি এসে সোফায় বসতেই হঠাৎ সুব্রত বলল, সোনালিদি, একটা কথা।

কী বলুন তো!

আমি কি আপনাকে বউদি বলে ডাকতে পারি?

সোনালি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, না।

সুব্রত হাসল, আচ্ছা, ডাকব না। বারবার মুখে বউদি ডাকটা এসে যায়। অতি কষ্টে সামলাই।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, তোর মতো গবেট দুটো হয় না। সেই বাঙালির বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট আর সম্পর্ক মেনে চলিস এখনও। ওরে পাগলা, দুনিয়া অনেক এগিয়ে গেছে।

গুড নাইট গোপীদা। গুড নাইট সোনালিদি।

সুব্রত চলে যাওয়ার পর দরজাটা বন্ধ করে গোপীনাথ এসে সোনালির মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, কী একটা সিদ্ধান্ত নিলে বলো তো! আমার দুশ্চিন্তা বাড়ল বই কমল না।

সোনালি মৃদু কঠিন গলায় বলল, চুপ করো। আমাকে ভাবতে দাও।

কী ভাবছ?

অনেক কিছু। কিন্তু সাজাতে পারছি না। এলোমলো।

গোপীনাথ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সোনালিকে সমর্থন করে বলল, ওটাই কঠিন, কিন্তু সাজানোটাই আসল। না সাজালে চিন্তা শুধু উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। আই ক্যান হেলপ।

তোমাকে হেল্প করতে হবে না। শুয়ে ঘুমোও গে।

তুমি?

আমি রাত জাগব।

পাগল নাকি। তুমি জাগবে কেন? জাগব আমি। আমার মনটা আজ ভাল নেই। প্রাণ বাঁচাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটাকে ধাক্কা দিয়েছিলাম। মরে যাবে ভাবিনি। এখন খারাপ লাগছে।

কেন খারাপ লাগবে? তুমি কোনও অন্যায় করোনি। এমনকী ওর মৃত্যুর জন্যও তুমি দায়ী নও। লোকটা মরেছে নিজের দোষে এবং ভুলে।

যাই বলল, আমার মন মানছে না। এ খেলাটা যতদিন চলবে ততদিন হয় মরো না-হয় মারো’ ব্যাপারটাই বহাল থাকবে মনে হচ্ছে। খেলাটা তাড়াতাড়ি শেষ হওয়া দরকার।

কীভাবে হবে?

আমি তো আর ওদের নিকেশ করতে পারব না। বোধহয় ওরাই মারবে আমাকে। সেটা তাড়াতাড়ি ঘটে যাক।

সোনালি ব্রুকুটি করে বলল, তাই নাকি? হাল ছেড়ে দিলে?

ছাড়িনি। হয়তো ছাড়তাম। কিন্তু তুমি এসে একটু হিসেবের গোলমাল করে দিয়েছ। ভাবতে হচ্ছে।

একটু বিষ মেশানো গলায় সোনালি বলল, আমি বুঝি তোমার গলগ্রহ? আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমার জন্যে চিন্তা না হয় আমিই করব।

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, ওটা হল থিয়োরি। প্র্যাকটিক্যাল অন্যরকম। যে খেলাটা শুরু হয়েছে আমি সে খেলাটা একটু খেলেছি। কিন্তু তুমি আনাড়ি। তোমার খুব সাহস আছে। কিন্তু এ খেলায় সাহসের চেয়েও বেশি কিছুর দরকার হবে।

সেটা কী?

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধি।

আমি কি নির্বোধ বলে তোমার মনে হয়?

না, তুমি বুদ্ধিমতী। কিন্তু সেই বুদ্ধি অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বুদ্ধিটাকে এই বাঁচামরার লড়াইতে প্রয়োগ করার জন্য আবার খানিকটা এক্সারসাইজ দরকার। সময় নেবে। তাই বলি, প্রথম কয়েকটা দিন আমার পরামর্শ নাও। তাতে দু’জনেরই মঙ্গল।

কী করতে বলছ?

আজ বিশ্রাম নাও। প্রথম দিকেই যদি রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে পড়ো তা হলে কাল আর মাথা কাজ করবে না।

আমি ঘুমোব আর তুমি জেগে থাকবে?

না, তাও নয়। আমি প্রথম রাতটা একটু চারদিকে চোখ রাখি। তোমাকে শেষরাতে ডেকে দেব। তখন তোমার পালা। তুমি টায়ার্ডও।

সোনালি বাস্তবিকই ক্লান্ত। একদিনে তার অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে। সে উঠল, ঠিক ডেকে দেবে?

দেব।

কোথায় ঘুমোব?

দুটো বেডরুম আছে। পাশেরটাতে শুয়ে থাকো।

বলেই চমকে উঠে গোপীনাথ বলল, না না, দাঁড়াও।

সোনালি অবাক হয়ে বলে, কী হল?

আমার বুদ্ধি মাঝে মাঝে ফেল করছে। এ বাড়ির দুটো দিকে রং করার জন্য ভারা বাঁধা হয়েছে। ওই বেডরুমটার গায়ে ভারা আছে। এদিকেরটায় নেই। তুমি আমার বেডরুমে শোও।

সোনালি একটা হাই তুলল। তারপর চলে গেল।

ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। আজ রাতে আর ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে হল গোপীনাথের, সে উঠে ফ্ল্যাটের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিল। টর্চ হাতে জানালাগুলোর আশেপাশে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াল। কেউ কোথাও নেই। দারোয়ানদের ওপর কড়া পুলিশি হুকুম জারি হয়েছে, বাইরের উটকো লোককে চট করে ঢুকতে দেবে না। ঢুকলেও যে-ফ্ল্যাটে যেতে চাইবে দারোয়ান সঙ্গে করে সেই ফ্ল্যাটের লোকের সঙ্গে মোকাবেলা করে দেবে। সেদিক দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত। তবু গোপীনাথ জানে, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। ওই সামনের বাড়ির ছাত থেকে টেলিস্কোপিক রাইফেলের পাল্লার মধ্যেই সে রয়েছে।

দিন দুই আগে সে গোটা চারেক ইংরেজি থ্রিলার কিনেছে। এসব সে কোনওকালে পড়ে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বুদ্ধিতে ধার দিতে এগুলো কিছু পড়া দরকার।

একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে সে বসে গেল পড়তে।

রাত সাড়ে বারোটায় টেলিফোন বেজে উঠতেই ধক করে উঠল তার বুক। এই অসময়ে কে চায় তাকে?

সে রিসিভার তুলে নিয়েও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল।

মৃদুস্বরে বলল, হ্যালো।

ভয় পেলেন নাকি?

চেনা গলা। গোপীনাথ হেসে বলল, অনেকদিন বাদে যে?

হ্যাঁ। একটু ঘুরপাক খেতে হচ্ছিল। কী খবর?

ভাল নয়।

জানি। আজ আপনার ওপর একটা অ্যাটেম্পট হয়েছে তো।

হ্যাঁ। জানলেন কী করে?

আমার দুটো অপদার্থ শাকরেদ আপনার ওপর এখনও নজর রাখছে।

হ্যাঁ তারা অপদার্থই বটে। বিপদের সময়ে কাজে লাগে না।

নজর রাখাটাই কাজ। আর রক্ষা করা? সেই নিরাপত্তা কে কাকে দিতে পারে বলুন। তবে ওরা দুরবিন দিয়ে পুরো ঘটনাই দেখেছে।

দেখেছে! কী আশ্চর্য!

পালা করে ওরা আপনার ফ্ল্যাটটা নজরে রাখে।

তারা থাকে কোথায়?

কাছাকাছি একাট হাইরাইজে। সেখানে একটা ফ্ল্যাট নেওয়া হয়েছে।

ও বাবা। বেশ কোমর বেঁধে নেমেছেন দেখছি।

আপনি বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই লোকটাকে এলিমিনেট করেছেন শুনেছি। কংগ্রাচুলেশনস।

লোকটা কে?

তা জানি না। চেহারার বিবরণ থেকে বুঝতে পারছি ও ডিউক।

সে কে?

আপনি চিনবেন না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোক।

পাজি।

ভয়ংকর। অসম্ভব সাহসীও। আপনি জোর বেঁচে গেছেন।

কিন্তু কতদিন?

যতদিন পারা যায়। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

অ্যাডভারসারিদের যত দেখছি তত মনে হচ্ছে আমার চান্স কম।

কম হলেও আছে। হাফ চান্স থেকেও কি গোল হয় না?

গোপীনাথ হাসল, বেশ বলেন আপনি। স্ত্রী

কে সঙ্গে রেখে কিন্তু ভাল কাজ করেননি।

গোপীনাথ বিষণ্ণ হয়ে বলে, জানি। কিন্তু শুনল না।

কেন? ইজ শি ইন লাভ উইথ ইউ ফর দি সেকেন্ড টাইম?

না। দেয়ার ওয়াজ নট ইভন এ ফাস্ট টাইম।

তা হলে?

কেউ ওকে বুঝিয়েছে আমার বিপদের দিনে ওর পাশে থাকা উচিত। সর্ট অফ আত্মত্যাগ।

কে বুঝিয়েছে? সুব্রত?

আপনি কি অন্তর্যামী নাকি মশাই?

সর্ট অফ। আজকাল সে-ই অন্তর্যামী যে ওয়েল ইনফর্মড। আমার নেটওয়ার্ক খুব ভাল।

তাই দেখছি। হ্যাঁ, কাণ্ডটা সুব্রতই করেছে।

শুনুন মশাই, আপনি একজনকে এলিমিনেট করেছেন মাত্র। বাট দেয়ার আর মোর পিপল আফটার ইউ।

অনুমান করছি।

ডোন্ট ডাই লাইক এ হিরো। র‍্যাদার ফাইট লাইক এ কাওয়ার্ড। বাট ডোন্ট ডাই।

বাঁচা-মরা কি আমার হাতে?

খানিকটা। এবং অনেকটা। আপনি বিশ্রাম নিতে পারেন। আমার লোকেরা আজ সারারাত আপনার ফ্ল্যাটের বাইরেটা স্ক্যান করবে। সন্দেহজনক কিছু দেখলেই আপনাকে রিং করবে ফোনে।

আর দে রিলায়েবল?

মোর অর লেস।

বাড়ির ভিতরে যদি কেউ ঢুকে থাকে?

ইয়েস দেয়ার ইজ এ পসিবিলিটি। ইউজ দা গান ইফ নিড বি।

আমি জীবনে বন্দুক পিস্তল চালাইনি। ও পারব না।

সব কিছুই একদিন শুরু করতে হয়।

আমি পারব না।

তা হলে জেগে থাকুন। আপনার ওপরতলায় একজন ভদ্রলোক থাকেন। ইউ সেন। চেনেন?

না। কাউকেই চিনি না।

তার ফোন নম্বরটা দিচ্ছি, টুকে নিন।

কেন?

দরজায় কেউ নক করলে আগে তাকে ফোন করবেন।

একে কবে প্ল্যান্ট করলেন এখানে?

আজই।

এত তাড়াতাড়ি?

ফ্ল্যাটটা খালি ছিল। ইউ সেন করিতকর্মা লোক।

ফোন করলে তিনি কী করবেন?

করবেন কিছু। নম্বরটা নিন।

নিচ্ছি।

ফোন নম্বরটা টুকে নিয়ে গোপীনাথ বলল, ধন্যবাদ।

ধন্যবাদের কিছু নেই। আপনি কারেজিয়াস ম্যান।

এটা কমপ্লিমেন্ট, না ঠাট্টা?

কোনটা মনে হয়?

ঠাট্টা।

শুনুন মশাই, আজ যা কাণ্ড ঘটেছে তাতে আপনার জায়গায় আমি থাকলেও ন্যাজ গুটিয়ে পালাতাম। অত্যধিক সাহস আছে বলেই আপনি এখনও পালাননি।

আমার পালানোর জায়গা নেই।

পালাতে চাইলে জায়গাও হয়ে যেত।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

করুন না।

আপনি আমার শত্রু না বন্ধু?

সুধাকর হেসে উঠল। বলল, কী মনে হয়?

কখনও শত্ৰু, কখনও বন্ধু। ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

পারবেন। কিছুদিন অপেক্ষা করুন।

আপনি ভিকিজ মব-এর একটা শাখার প্রধান, ঠিক তো?

ঠিক।

ভিকিজ মব যে মারাত্মক গুণ্ডার দল তা সবাই জানে।

জানারই কথা।

তা হলে তো আপনি ভাল লোক নন।

সুধাকর আবার হাসল, ভাল বলে দাবি করিনি তো।

আবার আপনি ইন্টারপোলের এজেন্ট বলেও শুনি। কোনটা ঠিক?

হয়তো দুটোই ঠিক। হয়তো দুটোই ভুয়ো। আমাকে নিয়ে ভাবছেন কেন?

আপনি এখন কোথা থেকে কথা বলছেন?

রোম থেকে।

রোম?

হ্যাঁ। রোম এবং আদ্রেঁর ফ্ল্যাট থেকে।

মাই গড! আরে ফ্ল্যাট থেকে?

হ্যাঁ। আদ্রেঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিটা খুঁজছি।

সর্বনাশ! সেটা যে আমার ভীষণ দরকার।

জানি। আদ্রেঁর পেপার্সে ডায়েরিটার রেফারে আছে।

সেটা পেয়েছেন?

এখনও নয়। ঝামেলা আছে।

কীসের ঝামেলা?

আদ্রেঁর ফ্ল্যাটে ঠিক এই মুহূর্তে দুটো লাশ পড়ে আছে। সদ্য খুন হওয়া, গা ভাল করে ঠান্ডা হয়নি।

বলেন কী?

এই নিয়ে আদ্রেঁর ফ্ল্যাটে গত দশ দিনে চারটে খুন হল।

কেন এসব হচ্ছে?

লোকে হয়তো ডায়েরিটাকে গুপ্তধনের মর্যাদা দিচ্ছে আর প্রাণ বাজি রেখে সেটা খুঁজতে আসছে।

খুনগুলো করছে কারা?

সিকিউরিটি এজেন্টরা। তারা অবশ্য খুন করছে বাধ্য হয়েই। নইলে তাদেরই খুন হতে হয়।

সিকিউরিটি এজেন্ট? সরকারি কি?

তাও বলতে পারেন।

তারা কি আপনার লোক?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুধাকর বলল, দুঃখের বিষয় তারা আমারই লোক। নিহতরা সকলেই মাফিয়া।

৩২.

সুধাকর দত্ত লোকটা অভদ্রও বটে। জরুরি কথার মাঝখানেই হঠাৎ বলে উঠল, মশাই, আর কথা নয়। দরজায় নক শুনতে পাচ্ছি। গুডবাই।

বলেই ফোনটা কট করে কেটে দিল।

গোপীনাথও ফোনটা রাখল। আদ্রেঁর ডায়েরি বিষয়ে তার আরও খানিকটা জানার ছিল। ঘটনার যা গতি ও প্রকৃতি তাতে ডায়েরিটা এখনই দরকার। সুধাকর যা বলছে তাতে মনে হয়, দুনিয়াসুদ্ধ লোক ডায়েরিটার কথা জানে এবং সবাই প্রাণ বাজি রেখে নেমে পড়েছে সেটা হাতিয়ে নিতে। ডায়েরিটা পাওয়া না গেলে আদ্রেঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করা বোধহয় কঠিন হবে।

ইউ সেন লোকটা কে তাও বুঝতে পারছে না গোপীনাথ। সে ফোনটা তুলে নম্বরটা ডায়াল করল। একবার রিং হতে না হতেই কে যেন ফোনটা তুলে নিল। একটা অত্যন্ত ভারী ও গম্ভীর গলা বলল, বলুন।

আপনি কি ইউ সেন?

হ্যাঁ।

পুরো নামটা কী?

উমাপদ সেন।

আমার বিপদ ঘটলে আপনাকে টেলিফোন করার হুকুম হয়েছে।

আপনার কি এখন কোনও বিপদ ঘটেছে?

না। আমি শুধু ব্যাপারটা যাচাই করছিলাম।

আপনি কি সুধাকর দত্তর লোক?

তাও বলতে পারে।

কী করেন?

এই টুকটাক।

তার মানে, বলতে চান না?

লোকটা চুপ করে রইল।

গোপীনাথ বলল, আমার জানা দরকার আমি বিপদে পড়লে আমাকে রক্ষা করার মতো যথেষ্ট দক্ষতা আপনার আছে কি না।

উমাপদ বলল, গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। তবে যোগ্যতা বা দক্ষতার ব্যাপারে চিন্তা করবেন না। আমি প্রফেশনাল।

আপনার প্রফেশনটা কী সেটাই জানতে চাইছি।

ধরুন সিকিউরিটি গার্ড।

আপনি কি ব্ল্যাক ক্যাট বা কম্যান্ডো ট্রেনিং নিয়েছেন?

তার চেয়েও বেশি। ট্রেনিং নিয়ে ভাববেন না।

আপনার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া দরকার। যদি আমার ফ্ল্যাটে চলে আসেন তা হলে উই মে হ্যাভ কফি টুগেদার। কথাও হবে।

সেটা খুব ওয়াইজ ডিসিশন হবে না মিস্টার বোস।

কেন?

কারণ ইউ আর আন্ডার অবজার্ভেশন। আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা গেলে দি ক্যাট উইল বি আউট অফ দি ব্যাগ। দেখা করার দরকার নেই। আমি আপনাকে চিনি।

কিন্তু আমি আপনাকে চিনি না।

তার দরকার নেই। আমাকে চিনে গেলে আপনার বরং অসুবিধেই হবে।

সুধাকর দত্ত সম্পর্কে আমাকে কিছু বলবেন?

কী জানতে চান?

লোকটা আসলে কে?

উনি নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছেন।

যা বলেছেন তা থেকে কিছুই বোঝা যায় না।

বুঝবার দরকার নেই। উনি তো আপনাকে সাহায্যই করছেন।

তা করছেন। কিন্তু সেটা তো স্বার্থের খাতিরে শত্রুও করে।

শত্রুতা করার আগেই শত্রু বলে ধরে নিচ্ছেন কেন?

আমাকে তো উনি বিনা স্বার্থে রক্ষা করছেন না।

না। স্বার্থ তো থাকতেই পারে। স্বার্থ ছাড়া দুনিয়ায় কিছুই ঘটে না।

আপনি সুধাকর সম্পর্কে আরও একটু স্পেসিফিক হতে পারেন কি?

আমি সামান্যই জানি ওঁকে।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না মশাই, আপনার সঙ্গে কথা বলা মানে একটা টেপ রেকর্ডারের সঙ্গে কথা বলা। যা শেখানো হয়েছে তা ছাড়া আর কিছুই বলবেন না তো!

কথা কম না বললে এই পেশায় টিকে থাকা কঠিন।

আমার ভয় হচ্ছে আমাকে কেন্দ্র করে আরও কিছু খুনখারাপি হবে। আপনি কি জানেন যে, আজ আমার হাতেও…

জানি, জানি। আপনাকে বলতে হবে না। আপনি এখন রেস্ট নিন। গুড নাইট। আর শুনুন ফ্ল্যাটের সব বাতি নিভিয়ে রাখবেন প্লিজ।

এ লোকটাও অভদ্রের মতো কথার মাঝখানে ফোন কেটে দিল।

গোপীনাথ অন্ধকারে বসে তার ঘড়ি দেখল। জ্বলজ্বলে ডায়ালে রাত সাড়ে তিনটে বাজে।

টর্চ নিয়ে সে উঠল। শোয়ার ঘরের দরজা খোলা রেখেই সোনালি ঘুমিয়েছে। এরকমটা হওয়ার কথা নয়। আইনত এবং বিধিমতো তারা এখন সম্পর্কহীন দু’জন যুবক-যুবতী। সোনালির এ কাজটা উচিত হয়নি। আবার হয়তো অন্যদিক দিয়ে দরজা খোলা রাখার দরকার ছিল। বিপদ ঘটলে পরস্পরের কাছে দ্রুত পৌঁছোনোর সুবিধে। দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে দরজার ফ্রেমে দাঁড়িয়ে অনিচ্ছুক হাতে টর্চটা বিছানায় ফেলল সে। কিন্তু বিছানায় সোনালি নেই।

অবাক হয়ে গোপীনাথ টর্চটা এধারে ওধারে ঘুরিয়ে ফেলে দেখল। বাথরুমের দরজা সামান্য ফাঁক এবং ভিতরে অন্ধকার।

অনুচ্চ কণ্ঠে গোপীনাথ ডাকল, সোনালি!

কোনও জবাব নেই।

গোপীনাথের বুকটা বিনা কারণেই ধক করে উঠল। কোথায় গেল সোনালি। সে ঘরটা আর একবার ভাল করে দেখে পাশের শোয়ার ঘরে যাওয়ার দরজাটা খুলে টর্চ ফোকাস করতেই সোনালিকে দেখতে পেল। একটা কালো চাপা প্যান্ট আর কালচে কামিজ পরা সোনালি জানালা দিয়ে একটু ঝুঁকে বাইরে কিছু দেখছে।

সোনালি, কী করছ?

সোনালি শরীরের উর্ধ্বাংশ ভিতরে নিয়ে এসে তার দিকে চেয়ে বলল, ঘুম আসেনি। চারদিকটা দেখছি।

গোপীনাথ উদ্বেগের গলায় বলল, ডু ইউ নো দ্যাট ইউ আর কমপ্লিটলি এক্সপোজড টু আউটার ডেনজারস?

কীভাবে?

আশেপাশে হাইরাইজের অভাব নেই। ইচ্ছে করলেই টেলিস্কোপিক রাইফেলে ছিঁড়ে ফেলতে পারে তোমাকে।

কিছু হবে না। অত চিন্তা কোরো না তো।

এ ঘরে এসো সোনালি। ঘুমোও।

আমার ঘুমের কোটা ফুরিয়েছে। এবার তুমি ঘুমোও।

আর তুমি?

আমি পাহারা দেব। গোপীনাথ হতাশায় মাথা নেড়ে বলে, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। বড্ড হেডস্ট্রং তো তুমি। বলেছি না, ঠিকমতো না ঘুমোলে তুমি পাহারাটাও ঠিকমতো দিতে পারবে না। অসময়ে ঘুম পেয়ে যাবে। ক্লান্ত লাগবে, দুর্বল লাগবে।

ঘুম না এলে কী করব?

ইউ আর এ প্রবলেম। এমনিতেই আমার সমস্যার অভাব নেই। তার ওপর তুমি!

সোনালি বলল, ফোনে তুমি দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছ। একটা কল এসেছিল রোম থেকে। আর একটা কল তুমি করেছ। লোকটা কে?

গোপীনাথ একটু অসন্তোষের গলায় বলল, আড়ি পেতেছিলে নাকি?

আড়ি পাততে হয়নি। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।

কফি খাবে?

খাব। কিন্তু তোমাকে কষ্ট করতে হবে না।

কষ্টের কী?

বাকি রাতটা কি জেগেই কাটাবে?

আজ রাতে আমার ঘুম আসবে না।

এরকম করলে কাল তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও। তোমার জন্য আমার বাড়তি টেনশন হচ্ছে।

আমি বাড়ি যাব না।

এটা আমার ওপর জুলুম করা হচ্ছে। লেট মি ফাইট মাই ওন ওয়ার।

তুমি তো একা লড়াই করছ না। তোমাকে অন্যের সাহায্য নিতে হচ্ছে। তা

হচ্ছে। কিন্তু তুমি তো সাহায্যকারী নও। বরং বাধা সৃষ্টি করছ।

বিপ্লবীর জুতো যদি কেউ সেলাই করে দেয় তা হলে সেও বিপ্লবে সাহায্যই করে।

তার মানে?

আই ক্যান হেলপ ইন স্মল ওয়েজ।

কীভাবে?

আই ক্যান মেক দি কফি।

মাই গড। ইউ আর ইমপসিবল।

সোনালি রঙ্গরসিকতার মেয়ে নয়। সে সিরিয়াস টাইপের। এরকম কথাবার্তা সে সহ্যও করতে পারে না। তবু এখন সয়ে নিল।

দশ মিনিট বাদে দু’কাপ কফি নিয়ে দুটো যুযুধান বেড়ালের মতো বাইরের ঘরে মুখোমুখি বসল তারা। ঘরে একটা ফুট লাইট জ্বলছে মাত্র। তার আলোর আভায় দু’জনে দু’জনকে আবছা দেখতে পাচ্ছে মাত্র।

গোপীনাথ হঠাৎ নরম গলায় বলল, গো হোম সোনালি। কাল সকালেই লিভ মি অ্যালোন।

যাব কি যাব না সেই সিদ্ধান্ত আমিই নেব। তোমার হুকুমে নয়।

ইউ আর নট বিয়িং অফ এনি হেলপ।

সেটা তোমার

সোনালি কথাটা শেষ করার আগেই ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার বিকট শব্দের সঙ্গে তীব্র শিস দেওয়ার শব্দ তুলে একটা বুলেট ঘরের ভিতর ছুটে এল।

চেয়ার সমেত উলটে পড়ল গোপীনাথ। কয়েক সেকেন্ডের বিহুলতা থেকে সে চকিত পায়ে উঠে দাঁড়াল।

সোনালি!

সোনালি জায়গায় নেই। কফির কাপটা রয়েছে শুধু।

গোপীনাথের বাঁ দিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। না, সম্পূর্ণ বেঁচে যায়নি সে। বাঁ কাধ ফুঁড়ে বুলেটটা গেছে। সামনে থেকে পিছনের দিকে। সামান্য কৌণিক হেরফেরে তার গলার নলি ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারত।

আশ্চর্য এই, গোপীনাথের ভয় যেন আরও কমে গেল। মাথা যেন আরও শীতল হয়ে কম্পিউটারের মতো কাজ করতে লাগল। প্রথমেই সে ফুটলাইটটা নিভিয়ে দিল। বাঁ দিকের জামা ক্রমে ভিজে যাচ্ছে আরও। গোপীনাথ বাঁ হাতটা তুলল। তুলতে পারছে এখনও। হাড় ভাঙেনি। ক্ষত শুধু কাঁধের পেশিতেই বলে মনে হচ্ছে।

সোনালি।

অন্ধকারে সোনালি চকিত পায়ে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল।

কোথায় গিয়েছিলে?

জানালায়। ওই হলুদ বাড়িটার ছাদ থেকে গুলি চালিয়েছে।

দেখেছ?

হ্যাঁ। একটা লোক। তার হাতে রাইফেল। আবছা।

দেখেও জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলে?

বাড়িটা চিনে রাখার দরকার ছিল। এখন চুপ করো।

গোপীনাথ একটা শ্বাস ফেলল।

হঠাৎ সোনালি বলল, তোমার কী হয়েছে বলো তো।

নাথিং মাচ।

তার মানে? তোমার জামা…মাই গড! কী হয়েছে? গুলি লেগেছে নাকি?

চেঁচামেচি কোরো না। সামান্য চোট।

সামান্য। সামান্য। ইউ আর ব্লিডিং লাইক হেল। কোথায় লেগেছে?

কাঁধের চামড়া ঘষে চলে গেছে। সিরিয়াস নয়।

সোনালি দৌড়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে অ্যান্টিসেপ্টিক ওষুধ আর ব্যান্ডেজ নিয়ে এল। বলল, ড্রেসিং করতে হলে বাতি জ্বালতেই হবে। আমি উন্ডটাও দেখতে চাই।

অবসন্ন গোপীনাথ জামাটা খুলে ফেলে সেটা দিয়েই ক্ষতস্থান চাপা দিয়ে বলল, যা খুশি করো। আজ রাতে আর হামলা হবে বলে মনে হয় না।

বাতি জ্বেলে অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে সোনালি তার ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধল। বলল, ডিপ হয়ে কেটেছে। ডাক্তার ডাকতেই হবে।

কাল সকালে দেখা যাবে।

চলো, শুয়ে থাকবে।

গোপীনাথ উঠতে যাচ্ছিল। ফোন বেজে উঠতেই ফোনটা ধরল।

ভারী গম্ভীর গলাটা বলল, সরি মিস্টার বোস। এই অ্যাটাকটার জন্য কিছু করার ছিল।

জানি। আমি কিছু মনে করিনি।

আমি কি আসব? আর ইউ ফিট?

গুলিটা কাঁধে লেগে বেরিয়ে গেছে। চিন্তা করবেন না, আমার স্ত্রী আমাকে অ্যাটেন্ড করছেন।

সরি মিস্টার বোস।

ডোন্ট বদার। এরকম তো হতেই পারে।

একটা কথা বলব?

বলুন।

ইউ আর অ্যান এক্সট্রিমলি কারেজিয়াস ম্যান।

গোপীনাথ একটু হাসল। বলল, মরিয়ার সাহস। ওটাও তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কিছু নয়।

কাল সকাল আটটায় একজন ডাক্তার আপনাকে দেখতে আসবেন। ডা. বিনয় দাশগুপ্ত। খুব নামকরা ডাক্তার।

এত তাড়াতাড়ি ডাক্তার ঠিক করে ফেললেন?

করাই ছিল। আপনার যে-কোনও ইভেনচুয়ালিটির জন্য। পেন কিলার বা কিছু লাগবে?

না। সহ্য করা যাবে।

বাই দেন।

বাই।

সোনালি তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, আমার কাঁধে ভর দেবে?

দরকার নেই। সব ঠিক আছে।

অনেকটা রক্ত গেছে। তোমার দুর্বল লাগার কথা।

লাগছে না। আমার হয়তো বাড়তি রক্ত আছে।

তাকে শোয়ার ঘরে এনে শোয়াল সোনালি। জানালার পরদাগুলো ভাল করে টেনে দিয়ে বলল, কাঁচের জানলা খুব বাজে জিনিস।

হ্যাঁ। ফুটলাইট জ্বালানো আমার উচিত হয়নি। ওই আলোতে আমাদের দেখতে পেয়েছে।

এখন তুমি ঘুমোও দয়া করে।

আর তুমি?

আমাকে নিয়ে ভেবো না।

ভাবতে চাইছে কে? ভাবিয়ে তুলছ বলেই ভাবছি।

শোনো, আমি তোমার স্ত্রী নই।

নও-ই তো। হঠাৎ কথাটা উঠছে কেন?

ফোনে কাকে যেন বললে, আমার স্ত্রী আমাকে অ্যাটেন্ড করছেন। কেন বললে।

আত্মরক্ষার্থে বলা। ঘরে বয়সের একজন স্ত্রীলোক, তার একটা লজিক্যাল কারণ থাকবে ত।

সেইজন্যই বললে?

হ্যাঁ।

সত্যি কথাটাই বললে পারতে। ওরা বোধহয় সবই জানে।

তাও ঠিক।

এবার ঘুমোও। ঘুমের ওষুধ খাবে?

না। আমার ঘুম আসবে এমনিতেই। টেনশন নেই।

তুমি খুব ঠান্ডা রক্তের মানুষ।

কেন বলো তো?

গুলি খেলে, অথচ নির্বিকার।

মে বি আই অ্যাম ইকুয়ালি ডেনজারাস।

৩৩.

সুপ্রভাত রোজমারি।

জো। তোমার কী খবর? কই কারখানা দেখতে এলে না তো।

একটা ছোট্ট বাধা হয়েছে।

রোজমারি একটু নিশ্চিন্ত হল। জো তার দলবল নিয়ে কারখানা দেখতে আসুক এটা সে চাইছে না মনেপ্রাণে। সে একটা খাস মোচন করে বলল, তাই বলল। কীসের বাধা?

আমার একজন সঙ্গী মারা গেছে।

একটু অবাক হয়ে রোজমারি বলে, তাই বুঝি? কী করে মারা গেল?

খুব ভাল জানি না। তবে যতদূর মনে হচ্ছে তার হন্তা স্বয়ং গোপীনাথ বসু।

জীবনে এমন অবাক কমই হয়েছে রোজমারি। বলল, গোপীনাথ বসু খুন করেছে?

হ্যাঁ, তাও আবার একজন পেশাদার খুনিকে।

কীভাবে?

আমার কথা রেকর্ড করছ না তো!

না না! কী যে বলো।

তা হলে বলতে পারি। ডিউক একজন পেশাদার খুনি। হাই রেটিং। সে পৃথিবীর সব বড় বড় শহরে খুন করে এসেছে। এ ব্যাপারে তার প্রতিভা ছিল প্রবাদের মতো। তার ব্যর্থতার কথা শোনাই যায় না।

রোজমারি আর একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। গোপীনাথ অন্তত একটা খুনিকে সরিয়েছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।

তারপর বলো।

গোপীনাথের ডেরাটা আমরা খুঁজে বের করেছি। দেখলাম গোপীনাথ যেন বিপদকে নেমন্তন্নের চিঠি দিয়ে বসে আছে। তার বাড়ির দু’দিকে রং করার জন্য বাঁশের সিঁড়ি তৈরি হয়েছে। ডিউক বলল, তার নিউ ইয়র্কে ফিরে যাওয়ার তাড়া আছে, গতকাল বিকেলের প্লেন ধরবে। তাই সে দুপুরেই কাজ হাসিল করবে বলে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। গুলিও চালিয়েছিল। আমরা দুরবিন দিয়ে দেখেছি। কিন্তু গোপীনাথ দৌড়ে এসে ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।

ব্যস?

হ্যাঁ, ব্যস। খুব সাদামাটা ব্যাপার না?

এত প্রতিভাবান খুনিকে এনেও হল না?

না, কিন্তু শোনো রোজমারি গোপীনাথকে মারতে আমরা শুধু আসিনি। আরও লোক এসেছে। কাল মধ্যরাতে তার ওপর আরও একটা অ্যাটাক হয়। এবার সে বেঁচে যায়নি।

সর্বনাশ! কী হয়েছে লোকটার? মারা গেছে?

না। লোকটার বেড়ালের প্রাণ। আহত বটে, তবে বেঁচে আছে।

সত্যি কথা বলো।

সত্যিই বলছি। তুমি কি বিশ্বাস করবে যে, রাতে গুলি খেয়েও লোকটা আজ ভোর পাঁচটায় কাছাকাছি একটা বাড়ির ছাদে গিয়ে উঠেছিল?

কেন?

ওই বাড়ি থেকে তাকে গুলি করা হয়। টেলিস্কোপিক রাইফেলে। ছাদে সম্ভবত একটা বুলেটের খোল ছাড়া কিছু পায়নি সে।

জো, এটা কারা করেছে?

তা জানি না, আমরা বিদেশি। এদেশে এত তাড়াতাড়ি তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব। আরও কথা আছে।

কী কথা জো?

গোপীনাথ বসুর সঙ্গে একজন মহিলা আছেন। খুব সুন্দরী। সে কে জানো?

না তো!

কে হতে পারে?

কী করে বলব?

আমরা জানতে চাই মহিলাটি কি ওর নিরাপত্তারক্ষী?

এসব আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন জো? আমি তো এখনও গোপীনাথের কলকাতার ঠিকানাটাও জানি না।

ঠিকানা জানলেও লাভ নেই। তুমি গোপীনাথকে বাঁচাতে পারবে না। সে এখন ঘোর বিপদে। কাল মধ্যরাতে যে বা যারা তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় তারাও পেশাদার।

জো তোমাকে একটা কথা বলব?

বলো।

তোমরা আর চেষ্টা কোরো না। গোপীনাথকে ছেড়ে দাও।

রোজামারি, মানুষ মেরে কি আমার আনন্দ হয় বলে তোমার ধারণা? তা নয়। আমরা যাদের হয়ে কাজ করি তাদের হুকুম তামিল করা ছাড়া আমাদের অন্য উপায় নেই।

তুমি কি এতটাই খারাপ হয়ে গেছ জো?

কোনটা খারাপ, কোনটা ভাল, সেটাই তো এখন বিতর্কের বিষয়। পুরনো সব ধারণাকে নতুন করে নেড়েচেড়ে দেখা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সারভাইভ্যালের শর্ত পূরণ করতে গেলে আমাদের পুরনো ধারণা বর্জন করতেই হবে। এটা হল বৌদ্ধিক যুগ, বুদ্ধি যার যত বেশি সে তত ভাল ভাবে বাঁচে। নৈতিকতার কানাকড়ি দাম নেই।

বক্তৃতা দিয়ো না জো। তুমি যা বলছ তা তুমি নিজেও বিশ্বাস করো না।

আগে করতাম না। আজকাল আমার মগজধোলাই হয়ে গেছে। শোনো রোজমারি, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও দাম নেই। যে কাজের ভার আমাদের দেওয়া হয়েছে, তা শেষ করতেই হবে। নইলে বিপদ।

তার মানে তুমি আবার চেষ্টা করবে?

এখনই নয়। কারণ ডিউকের আকস্মিক মৃত্যুতে আমাদের কর্মসূচি ওলটপালট হয়ে গেছে।

কীরকম?

পুলিশ ডিউককে ট্রেস করতে করতে আমাদের খুঁজে বের করবেই। তারপর আমরা পড়ে যাব সাংঘাতিক জটিলতায়। সুতরাং ডিউক মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বিকেলেরই একটা ফ্লাইট ধরে কলকাতা থেকে পালিয়েছি।

কোথায় পালালে?

আপাতত আমস্টারডামে।

এত তাড়াতাড়ি?

এসব কাজে সময় একটা মস্ত বড় জিনিস।

রোজমারি গভীর একটা শ্বাস ফেলে বলল, তুমি তা হলে কলকাতায় নেই।

না রোজমারি। খুনটা করার পরই আমাদের বিকেলের ফ্লাইট ধরার কথা ছিল। আমরা সেই ফ্লাইটটাই ধরেছি। তবে আমাকে আবার খুব শিগগিরই দেখতে পাবে কলকাতায়।

তুমি ফিরে আসবে!

আসতেই হবে। তবে অন্য নামে, অন্য পাসপোর্টে। সঙ্গে থাকবে আর একজন খুনি, যদি ততদিনে গোপীনাথ আর কারও হাতে খুন হয়ে যায়।

খুন হলে?

তাও আসব। তোমার কারখানার বিষয়ে আমাদের কৌতূহল তো শেষ হয়নি।

শোনো জো ক্লাইন, তোমাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের কারখানাটা বিক্রিই করে দিতে হবে। অনেক খদ্দের ঘোরাঘুরি করছে। বেচে দিয়ে আমি আর মনোজ ফের জার্মানিতেই ফিরে যাব।

সেটা বোকার মতো কাজ হবে রোজমারি। তোমার ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয় যে একদিন কোটি কোটি ডলার রোজগার করবে এটা তোমার জানা উচিত।

আমার টাকার দরকার নেই। দরকার শান্তিতে বেঁচে থাকার।

তাই কি রোজমারি? তুমি কি শান্তি সত্যিই ভালবাসো?

রোজমারি একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমার অতীত নিয়ে ফের কথা শুরু করবে না।

না। তবে রোজমারি সম্পর্কে আমার একটা পরিষ্কার ধারণা আর হিসেবনিকেশ আছে। সেটা ভুলে যেয়ো না।

কী চাও জো?

চাই, অদূর ভবিষ্যতে আমি গেলে আমাকে সাহায্য কোরো।

তুমি কবে আসবে?

হয়তো পরশু বা তার পরের দিন।

এত তাড়াতাড়ি?

এ কাজে দেরি করা সম্ভব নয়।

ফোন রেখে দিল জো। রোজমারি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে হঠাৎ ফের ফোনটা তুলে নিল।

মনোজ।

বলো

সোনালি কি আজ অফিসে এসেছে?

না। কেন বলো তো!

কোনও খবর দিয়েছে?

হ্যাঁ, ফোন করে জানিয়েছে কী যেন জরুরি কাজ, আসতে পারবে না।

তোমার ঘরে কেউ আছে?

হ্যাঁ।

আধঘণ্টা পর আমি যাচ্ছি তোমার ঘরে। ফ্রি থেকো।

ঠিক আছে।

আধঘণ্টা চুপচাপ বসে রইল রোজমারি। ভাবল আর ভাবল। তারপর উঠে ধীর পায়ে করিডর পেরিয়ে লন এবং লন পেরিয়ে মেন বিল্ডিং-এ ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠল। সরাসরি মনোজের ঘরে না গিয়ে সে গিয়ে ঢুকল সোনালির ঘরে।

সাজানো ছোট্ট অফিসঘর। কম্পিউটার থেকে শুরু করে সব কিছুই খুব পরিচ্ছন্ন হাতে গুছিয়ে রাখা। রোজমারি সোনালির টেবিলটা একটু ঘটল।

সোনালির চেয়ারে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল রোজমারি। বাঙালিরা খুব রোম্যান্টিক জাত। এরা সহজে সম্পর্ক কেটে ফেলতে পারে না। মূল্যবোধ বা আবেগ একটু বেশিই বোধহয়। সোনালি না হলে কেনই বা গোপীনাথকে সঙ্গ দিচ্ছে? জো ক্লাইন গোপীনাথের যে সুন্দরী সঙ্গিনীর কথা বলেছিল তা যে সোনালি ছাড়া কেউ নয়, এ ব্যাপারে তার সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা তার খারাপ লাগছে না। এরকমও হয় তা হলে। রোজমারি আপন মনেই। একটু হাসল।

তারপর উঠে পাশের দরজা দিয়ে মনোজের ঘরে ঢুকল সে।

মনোজ তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। বলল, কী ব্যাপার?

গোপীনাথের ওপর কাল দু-দু’বার হামলা হয়েছে। দু’বারই রাইফেল চালানো হয় তার ঘরে। সে চোট পেয়েছে।

মনোজ অবাক হয়ে বলল, কী করে জানলে?

জানলাম। সূত্র বলা যাবে না।

মাথা নেড়ে মনোজ বলল, গোপীনাথ ইজ এ লস্ট কেস।

হাল ছেড়ে দিচ্ছ কেন? গোপীনাথ ইজ এ গুড সারভাইভার।

মনোজ মাথা নেড়ে বলে, ওটা কোনও ভরসার কথা নয়।

শোনো, আমার খবর আছে, সোনালি এখন গোপীনাথের কাছে রয়েছে।

বটে! বলে মনোজ খুব বিস্ময় প্রকাশ করল।

গোপীনাথকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।

কীভাবে?

তুমি ওর ঠিকানাটা সুব্রতর কাছ থেকে আদায় করো। তারপর চলল, তার সঙ্গে কথা বলি। সবাই মিলে একটা কিছু ঠিক করা যাবে।

কিন্তু তার আগে প্রশ্ন, গোপীনাথ পুলিশের সাহায্য নিচ্ছে না কেন?

বুদ্ধিমান বলেই নিচ্ছে না। পুলিশ তার প্রোটেকশনের কোনও ব্যবস্থা করতে পারবে বলে তোমার মনে হয়? তুমি সুব্রতকে ডাকো।

মনোজ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে ফোন তুলে সুব্রতকে ডাকল।

সুব্রতর এসে হাজির হতে পাঁচ মিনিটও লাগল না।

বলুন স্যার।

সুব্রত, বিনা ভূমিকায় বলছি, তুমি কি গোপীনাথের ওপর লেটেস্ট হামলার কথা জানো?

সুব্রত গম্ভীর হয়ে বলল, জানি। কাল দুপুরে এবং মধ্যরাতে দু’বার অ্যাটাক হয়েছে।

গোপীনাথ ইজ এ স্টাবোর্ন পার্সন। আমরা তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।

সুব্রত কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ইট ডিপেন্ডস অন হিম। উনি চাইলেই সেটা সম্ভব।

মনোজ ফোনটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, টক টু হিম, প্লিজ!

রোজমারি বাধা দিয়ে বলল, না, আমাদের সামনে নয়। আপনি বরং সোনালির ঘরে যান। ওখান থেকে ফোনটা করুন।

সুব্রত গেল। দু’মিনিট বাদে ফিরে এসে বলল, ইটস ও কে স্যার। এখন তিনটে বাজে। আমাদের চারটের মধ্যে পৌঁছুতে হবে।

.

গোপীনাথের ফ্ল্যাটের সব জানালায় মোটা পরদা টানা। ঘরগুলো প্রায় অন্ধকার। ব্যবস্থাটা করেছে সোনালি। পরদাগুলো ছিল একটা ডিভানের খোলের মধ্যে। সেগুলো বের করে পেলমেটের রডে ভরে এত বড় ফ্ল্যাটে সব কটা জানালা ঢাকা দিতে প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে। তার। শুধু তাই নয়, অবাধ্য ও চঞ্চলমতি গোপীনাথকে সামলাতেও হিমশিম খেয়েছে সে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই গোপীনাথ চুপিসারে বেরিয়ে যায়। সোনালি সাড়ে ছ’টায় উঠে তাকে খুঁজে না পেয়ে ভীষণ ঘাবড়ে দারোয়ানের কাছে গিয়ে খোঁজ নেয়। তারা জানায় গোপীনাথ ভোর পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে গেছে। সোনালির তখন রাগে হাত-পা নিশপিশ করছিল লোকটার আক্কেল দেখে। যখন চারদিক থেকে টেলিস্কোপিক রাইফেল আর খুনির চোখ ওকে তাক করছে তখন পাগলটা এমন ন্যালাখ্যাপার মতো বেরিয়ে যায় কোন সাহসে?

যাই হোক, দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ গোপীনাথ ফিরল। হাতে বাজারের থলি।

সোনালি রাগে ফেটে পড়ল, কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

শান্ত গলায় গোপীনাথ বলল, ক্যাটারারের রান্না বড্ড একঘেয়ে লাগছে। বড্ড রিচও। ভাবছি আজ থেকে আমরা রান্না করে খাব।

চোখ কপালে তুলে সোনালি বলল, সেইজন্য তুমি বাজারে গিয়েছিলে? কেন, বাজার তো আমিও করতে পারতাম।

গোপীনাথ তখন পকেট থেকে একটা কার্তুজের খোল বের করে হাতের তেলোয় মেলে ধরল সোনালির চোখের সামনে। বলল, এটার জন্যও।

কী ওটা?

কার্তুজের খোল। ওই হলুদ বাড়িটার ছাদে পেলাম।

সোনালি বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপর বলল, তুমি একা গিয়ে ওবাড়ির ছাদে উঠেছিলে?

গোপীনাথ হেসে বলল, ইজি। ওটা একটা থার্ড গ্রেড ভাড়াটে বাড়ি। উঠে গেলাম, কেউ বাধা দিল না।

ধন্যি তোমাকে।

ঘণ্টাখানেক তাদের কথা বন্ধ ছিল। কথা চালু হল, বেলা ন’টায় দু’কাপ গরম কফি সহযোগে। খুব সতর্কতার সঙ্গে।

ব্যথাটা কেমন আছে?

নেই তেমন।

ডাক্তার আসবে। তৈরি থেকো।

হ্যাঁ। আমি আজ রান্না করব।

বাঃ। খুব আহ্লাদ দেখছি।

কিছু করতে ইচ্ছে করছে।

করার অনেক কিছু আছে।

কী করব বলল তো।

সোনালি হাই তুলে বলল, ঘুমোও।

ঘুমোব। এখন ঘুমোব কেন?

তোমার বিশ্রাম দরকার। অনেক ধকল গেছে।

দুর। এসব ঘটনা আমি গায়ে মাখছি না।

যখন ডোরবেল বাজল, অর্থাৎ আরও আধঘণ্টা পর, তখন দরজাটা খুলতে একটু দেরি হল তাদের। কারণ ঘনবদ্ধ আলিঙ্গন ও চুম্বন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারছিল না কিছুতেই।

৩৪.

ডোরবেল বেজেই যাচ্ছিল। কিন্তু তারা তবু কেউ উঠল না।

সোনালি গোপীনাথের কপাল থেকে কয়েক গুছি চুল হাত দিয়ে সরিয়ে বলল, ডোরবেল বাজছে, কানে যাচ্ছে না বুঝি?

বাজুক।

সোনালি হাসল, যদি জরুরি দরকারে কেউ এসে থাকে?

ফিরে যাক।

কাছাকাছি, বড্ড কাছাকাছি তাদের মুখ, পরস্পরের শ্বাস মিশে যাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে।

গোপীনাথ রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, বলতে গেলে এটাই আমাদের প্রথম প্রেম। তাই না?

তোমার প্রথম, কিন্তু আমার নয়। আমি সেই কবেই তোমাকে ভালবেসে মরেছিলাম। বিয়ের রাতে।

একটু লজ্জা পেয়ে গোপীনাথ বলল, আমি তখন বাডিং সায়েন্টিস্ট। মাথায় যে কত দুশ্চিন্তা। বিয়েটাকে তখন মনে হয়েছিল একটা বাড়তি দায়িত্ব। তোমার মনে আছে বিয়ের পর বউভাতের রাতেই আমাকে জেনেভার প্লেন ধরতে হয়েছিল?

থাকবে না? যা রাগ হয়েছিল।

তখন ওরকমই ছিল আমার জীবন এবং মনোভাবও। হাইলি কম্পিটিটিভ দুনিয়া আর সেই সঙ্গে আমার জেদ। কিন্তু এখন আমি অন্যরকম লোক, না?

মনে তো হচ্ছে।

ডোরবেল থেমে গেছে। দু’জনে দু’জনের দিকে পলকহীন চেয়ে বসে রইল। দুনিয়া মুছে গেছে। বিপদ-আপদ, জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নও থেমে আছে একটু দূরে।

এবার ডোরবেল নয়, টেলিফোন বাজল। টেলিফোনটাকেও উপেক্ষা করল তারা। সোনালির ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে গোপীনাথ বলল, কারা এমন বেরসিক বলো তো!

সোনালি অলস বিহুল গলায় বলল, ওরা কাজের লোক।

আমাদের কি আজ আর কিছু করা উচিত?

সোনালি হাসল। তারপর গোপীনাথের দু’খানা হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে নরমভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। দাঁড়াও, দেখি কার এত জরুরি দরকার।

টেলিফোন কানে তুলতেই একটা মোলায়েম গলা বলল, এনজয়িং দি লাইফ?

সামান্য হাসিরও শব্দ হল। গা জ্বলে গেল সোনালির। বলল, কে বলুন তো আপনি!

একবার পরিচয় হয়েছিল। আমার নাম সুধাকর দত্ত।

সোনালি একটু থমকে গিয়েছিল। বলল, ও। কী ব্যাপার?

কেমন আছেন বলুন।

ভালই।

আপনি বেশ বুদ্ধিমতী। ঘরের জানালাগুলো মোটা পরদায় ঢেকে দিয়ে ভাল কাজ করেছেন। গোপীনাথবাবু এতটা কেয়ারফুল নন।

উনি তো ভাবনাচিন্তা বেশি করেন।

আপনাদের কি তা হলে ভাব হয়ে গেল? কংগ্রাচুলেশনস।

ধন্যবাদ।

গোপীনাথবাবুকে বলবেন, ডায়েরিটা উদ্ধার করা গেছে।

আপনি ওঁর সঙ্গেই কথা বলুন না।

দিন তা হলে, ইফ হি ইজ নট টেরিবলি বিজি ওয়াইপিং লিপস্টিক ফ্রম হিজ লিপস।

একটু রাঙা হয়ে সোনালি বলল, আমি লিপস্টিক মাখি না। আপনি খুব অসভ্য লোক।

বলেই টেলিফোনটা গোপীনাথের বাড়ানো হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোনালি চাপা গলায় বলল, কী সব বলছে, এ মা।

গোপীনাথ একটু হাসল। বলল, আমার বউকে লজ্জায় ফেলছেন কেন?

হঠাৎ ও পাশে সুধাকরের গলাটা একটু বিষণ্ণ শোনাল, লজ্জাটা যে এখনও দুনিয়ার আনাচেকানাচে একটু আধটু রয়ে গেছে সেটা ভাবলে বড্ড খুশি হই, বুঝলেন? এই বেহায়া নির্লজ্জ পৃথিবী যত বে-আবরু হচ্ছে তত আমাদের মতো বুড়ো মানুষরা মুষড়ে পড়ছি।

আপনি আবার বুড়ো হলেন কবে?

হচ্ছি মশাই, হচ্ছি। অভিজ্ঞতারও তো একটা বয়স আছে।

বুঝেছি। আপনি এঁচোড়ে পাকছেন।

যা বলেছেন। কিলিয়েই কাঁঠাল পাকানো হচ্ছে। এনিওয়ে, ডায়েরিটা উদ্ধার হয়েছে।

আঃ বাঁচা গেল। কোথায় পাওয়া গেল?

লম্বা ইতিহাস। অত শুনে কাজ নেই। শুধু বলে রাখি, সাতটা খুন এবং গোটা দুই জখমের পর ডায়েরিটা উদ্ধার হয়েছে একটা ব্যাঙ্কের লকার থেকে। সেটাও সহজে হয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে হয়েছে।

জিনিসটা কবে পাব?

পাবেন কী করে? আধঘণ্টা ধরে ডোরবেল বাজিয়ে এসেছি একটু আগে। অন্য লোক হলে ধরে নিত আপনারা ঘরে নেই। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে, আপনারা দুটি বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়তো বহুদিন পর পুনর্মিলিত হওয়ায়

একটা গলা খাঁকারি দিয়ে থামল সুধাকর।

গোপীনাথ একটু হেসে বলল, মোটেই তা নয় দাতাসাহেব। আসলে আপনার চরেরাই আপনাকে জানিয়েছে যে, আমরা ঘরেই আছি।

কীভাবে জানবে? ঘরে যে মোটা পরদা ফেলা।

আপনার অসাধ্য কিছুই নেই। হয়তো কোনও খুদে মাইক্রোফোন কোথাও সেঁটে রেখে গেছেন। দেখতে না পেলেও শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।

আপনি বুদ্ধিমান।

সে তো বটেই। কোথা থেকে কথা বলছেন?

সেন সাহেবের ঘর থেকে।

এঃ, তা হলে তো আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ডায়ালগ সবই শুনতে পেয়েছেন। ক্লি

য়ার অ্যান্ড লাউড।

প্রাইভেসি বলে আর কিছু রাখলেন না। আমার স্ত্রী লজ্জায় পড়বেন।

আমি আপনাদের শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছি। ইউ আর এ গুড কাপল। আপনাদের রিকনসিলিয়েশনটা দারুণ লেগেছে।

গোপীনাথ একটু দেখে নিল সোনালি কোথায় আছে। সোনালি এখন রান্নাঘরে, হয়তো চা করছে। সে গলাটা একটু নামিয়ে বলল, রিকনসিলিয়েশনটা ভাল হল কি না কে বলবে দাতাসাহেব? বহু বছর পর আমরা মিলেমিশে গেলাম বটে, কিন্তু তার দায়িত্ব কতটা? যেভাবে ঘাতকরা উঠেপড়ে লেগেছে তাতে যে-কোনওদিন আমি শেষ হয়ে যেতে পারি। যদি তাই হয়, তা হলে এই মিলনটা সোনালির কাছে দুঃসহ হয়ে থাকবে। হৃদয়বৃত্তির প্রশংসা করছিলেন, কিন্তু এই নির্দয় পৃথিবীতে হৃদয়বৃত্তি একটা বাড়তি অসুবিধে ছাড়া তো কিছুই নয়।

ইউ আর রাইট। তবে একটা কথা আছে।

কী কথা?

জীবন অতীব ক্ষণস্থায়ী। কে কবে কীভাবে মারা যাবে তার ঠিক নেই। এই ক্ষণস্থায়ী আয়ুষ্কালের মধ্যে যদি সামান্য কয়েকটি মুহূর্তও আপনি জীবনের কাছে পেয়ে থাকেন, তাই বা কম কী? আমাদের জীবনে কয়েকটাই মাত্র গোন্ডেন মোমেন্টস আসে, বাদবাকি জীবনটা কাটে তার স্মৃতি রোমন্থন করে। তাই না?

তা বটে।

আচ্ছা, আজ অপরাহ্নে আমরা এত হাইলি ফিলজফিক্যাল হয়ে উঠলাম কেন বলুন তো!

তাই দেখছি।

ওটাই হল বয়সের দোষ। আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।

আপনি কি ত্রিশ পেরিয়েছেন?

আমি চল্লিশের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছি। দেখতে আমাকে একটু ছোকরা ছোকরা লাগে বটে, কিন্তু আই অ্যাম কোয়াইট ওল্ড।

ইউ আর নট এ গুড লায়ার।

আচ্ছা মশাই, নিতান্ত দরাদরিই যদি করতে চান, তা হলে না হয় আরও পাঁচ বছর হেঁটে দিচ্ছি। মে বি আই অ্যাম থার্টি ফাইভ।

বত্রিশের বেশি এক দিনও নয়।

সুধাকর একটু হাসল। তারপর বলল, ও কে দেন। লেট ইট বি থার্টি টু। বাট স্টিল আই অ্যাম ওল্ড।

গোপীনাথ স্মিত একটু হেসে বলল, আমার স্ত্রী সম্ভবত চা করছেন। উড ইউ লাইক টু জয়েন দি টি পার্টি?

নেমন্তন্নের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু উপায় নেই। আপনার সঙ্গে আমাকে যত না দেখা যায় ততই ভাল।

কিন্তু ডায়েরিটা। সেটা কবে পাব?

ডায়েরিটা ফটোকপি করা হচ্ছে।

ও। আমার জানার ছিল, ওতে সত্যিই কোনও ভাইটাল ক্লু আছে কি না।

আমি সায়েন্টিস্ট হলে বলতে পারতাম। তবে অনেক হিজিবিজি আছে, আপনি হয়তো বুঝবেন। আমি লাইনটা কেটে দিচ্ছি। কারণ আপনার ফ্ল্যাটে এখনই অতিথি সমাগম হবে।

পুলিশ নাকি? আজ সকালে তো তারা এসে ঘরময় সার্চ করেছে। ফটোও তুলেছে। জেরায় জেরায় জেরবার করেছে আমাদের। বলে গেছে আবার আসবে।

পুলিশের তো আসারই কথা। তবে এখন পুলিশ নয়, আসছেন রোজমারি আর মনোজ। সঙ্গে সুব্রত। একটা কথা বলে রাখি।

কী কথা?

দে আর বিয়িং শ্যাডোড। কেউ ওঁদের এখানে অনুসরণ করছে।

কে ওদের পিছনে আছে?

সুধাকর উদাস গলায় বলল, কেউ হবে। তবে রোজমারি সম্পর্কে আপনি একটু সাবধান থাকবেন।

কী ধরনের সাবধান?

ভদ্রমহিলা নিজে ততটা খারাপ নন। কিন্তু শি কিপস এ ব্যাড কম্প্যানি। এ ভিকটিম অফ সারকামস্ট্যান্সেস। হয়তো ব্ল্যাকমেলেরও শিকার।

আপনি এত জানলেন কী করে?

আই কিপ এ ট্যাগ অন হার।

আমি ওঁদের কী বলব? ওঁরা হয়তো একটা চাকরি অফার করবেন।

তাও জানি।

চাকরিটা আমি নেব বলে ঠিক করেছি।

কেন নেবেন? ওঁ

দের ল্যাবটা আমার কাজে লাগবে।

ল্যাবটা হয়তো আপনার উপযুক্ত হবে না।

তা হলে?

স্কিপ দি অফার।

তা হলে কাজ এগোবে কী করে?

অন্য উপায় আছে। আপনি কখনও লুলু বলে কারও নাম শুনেছেন?

গোপীনাথ একটু অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ।

নামটা মনে রাখবেন।

কেন বলুন তো!

দরকার আছে। কিন্তু আর নয়। দে আর অলমোস্ট অ্যাট ইয়োর ডোর।

সুধাকর ফোনটা কেটে দেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডোরবেল বেজে উঠল। চায়ের ট্রে নিয়ে রান্নাঘর থেকে আসছিল সোনালি। বলল, দাঁড়াও, আমি খুলব। কে না কে, কে জানে বাবা। হঠাৎ তুমি সামনে যেয়ো না।

গোপীনাথ সোনালির ভয় দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, খুব বীরাঙ্গনা হয়েছ বুঝি। ভয় নেই, রোজমারি আর মনোজ। তোমার বস।

আমার বস কেউ নেই। চাকরিটা আমি ছেড়ে দিয়েছি।

অবাক গোপীনাথ বলল, কবে ছাড়লে?

মনে মনে ছেড়েছি। কনসার্নটা আমার ভাল লাগছে না। ওরা তোমাকে কাজে লাগাতে চায়।

গোপীনাথ মৃদু হেসে বলে, তা হলে এখন তুমি বেকার?

তা আর হলাম কই? একজনের দেখভাল তো করতে হচ্ছে। আপাতত এটাই চাকরি। গোপীনাথ গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। সামনেই সুব্রত। মুখে হাসি, গোপীদা, মনোজবাবু আর রোজমারি এসেছেন দেখা করতে।

পরিচয় আর কুশল বিনিময় করতে করতেই গোপীনাথ দু’জনকে খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল। মনোজ, যে খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নয় তা তার মুখের নার্ভাস হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। রোজমারি গড়পরতা জার্মান মেয়েদের মতোই মজবুত গড়নের। মোটামুটি দেখতে ভালই। কিন্তু একটু চাপা উদ্বেগে ভুগছে।

রোজমারি সোনালির হাত ধরে পরিষ্কার বাংলায় বলল, পুনর্মিলন সুখের হোক। আমি ভাবতেই পারিনি কখনও যে, এরকমও হয়। আমি বাঙালি বা ভারতীয় হয়ে জন্মালে বেশ হত।

সোনালি লজ্জায় রাঙা হল।

রোজমারি জার্মান মেয়ে। ভ্যানতারা জানে না। সোজাসুজি গোপীনাথের দিকে চেয়ে বলল, আপনি কি আমাদের অফারটা নিচ্ছেন মিস্টার বোস?

গোপীনাথ মৃদু হেসে বলল, আপনি আমার ঘরখানা ভাল করে লক্ষ করেছেন কি?

না তো! কেন?

ভাল করে দেখুন। মেঝের চলটা উঠে গেছে, দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে চাপড়া। কেন জানেন? এ ঘরে অটোমেটিক রাইফেল দিয়ে ঝাকে ঝাকে গুলি চালানো হয়েছে আমাকে মারার জন্য।

রোজমারি সবই দেখল। তারপর বলল, ঈশ্বর! আপনি কি তখন ঘরে ছিলেন?

গোপীনাথ অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলল, না ম্যাডাম। থাকলে এতক্ষণে আমি মর্গে শুয়ে আছি।

খুব বেঁচে গেছেন আপনি।

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, বাঁচিনি। এর পরেও আমার ওপর অ্যাটাক হয়েছে। বাঁ কাধটা জখম। বুঝেছেন?

হ্যাঁ। কিন্তু

শুনুন ম্যাডাম, আমার জীবন এতই অনিশ্চিত যে, আমার কাছাকাছি কারও থাকা উচিত নয়। এই মুহূর্তেই যদি বাইরে থেকে কেউ গুলি চালায়, তা হলে আমাদের যে কারও বিপদ হতে পারে।

মনোজের মুখটা একটু ফ্যাকাশে দেখাল। সে বলল, তা হলে তো

গোপীনাথ বলল, আই অ্যাম লিভিং ডেনজারাসলি। শুধু সেই কারণেই আপনাদের লোভনীয় অফার নিতে পারছি না। নিলে আপনাদেরও বিপদ।

রোজমারি বলল, কিন্তু আমরা যদি আপনাকে অন্য কোথাও রাখি, কোনও নিরাপদ জায়গায়?

গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, নিরাপদ জায়গা বলতে কিছু নেই। এমনকী আপনারা যে এসেছেন, আপনাদের পিছু পিছুও কেউ এসেছে।

রোজমারি অবাক হয়ে বলে, সে কী কথা! আমাদের পিছু কেউ নেয়নি তো।

মনোজ বলে উঠল, অসম্ভব।

কিন্তু সুব্রত হঠাৎ বলল, অসম্ভব না-ও হতে পারে।

মনোজ বলল, কেন বলো তো! তুমি কাউকে দেখেছ?

মনে হচ্ছে, আমরা যখন অফিস থেকে রওনা হই, তখন একটা নীল মারুতি আমাদের পিছনে ছিল।

কী করে বুঝলে?

ওভারহেড মিররে দেখেছি। তখন কিছু মনে হয়নি। নীল মারুতিটাকে নামবার সময়েও দেখেছি যেন। একটু দূরে থেমে গেল।

মনোজ বলল, লেট আস চেক। চলো।

চলুন। বলে সুব্রত আর মনোজ বেরিয়ে গেল।

রোজমারি একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলল, কেউ আমাদের পিছু নিয়েছে কি না তা আপনি কী করে জানলেন?

ইনটুইশন।

ইনটুইশন। শুধু ইনটুইশন?

গোপীনাথ হাসল, না। শুধু ইনটুইশন নয়। ইনফর্মারও।

৩৫.

নীল মারুতির অভাব নেই কলকাতায়। বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে মনোজ আর সুব্রত একটু হাঁটতেই একটা নীল মারুতি দেখতে পেল। লক্ষ করল, ভিতরে কেউ নেই।

এটাই কি সুব্রত?

আমি শিয়োর নই। নম্বর প্লেটটা তো দেখে রাখিনি।

তা হলে?

সুব্রত গাড়ির বনেটে হাত রেখে তাপ অনুভব করে ঘাড় নেড়ে বলল, এটা নয় স্যার।

কী করে জানলে?

এটা হলে বনেট গরম থাকত। এটার বনেট ঠান্ডা, তার মানে অনেকক্ষণ পার্ক করা আছে।

কোয়াইট ইন্টেলিজেন্ট ডিডাকশন। চলো, আর একটু এগিয়ে দেখি।

তারা আরও একটু এগোতেই একটা মোড়। ডানধারে আর একটা সরু রাস্তা। সুব্রত থমকে বলল, স্যার!

হ্যাঁ, বলো।

ওই যে।

ডানধারে একটু ভিতরে একটা নীল মারুতি পার্ক করা।

এটাই যে তা কী করে বুঝলে?

বনেটের ওপর বড় করে একটা দুই লেখা আছে, চারধারে একটা সার্কল। সম্ভবত কোনও মোটর র‍্যালিতে পার্টিসিপেট করেছিল। মনে হচ্ছে ওভারহেড মিররে এটা দেখেছি, কিন্তু মনে পড়ছিল না।

গুড, চলো, লেট আস চেক।

ড্রাইভার তার সিটে বসে আছে, দেখতে পাচ্ছেন? বসে খবরের কাগজ পড়ছে।

মনোজ ভ্রু কুঁচকে বলল, লেট আস টক টু হিম।

কী বলবেন?

জিজ্ঞেস করব কার গাড়ি, এখানে কী করছে।

সুব্রত হাসল, এসব প্রশ্ন করার অধিকার কি আমাদের আছে? হি মে রি-অ্যাক্ট।

মনোজ হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, তাই তো। তা হলে কী করা যাবে।

লাইসেন্স নম্বরটা মুখস্থ করে নিয়েছি। গাড়িটা কার তা হয়তো ট্রেস করা যাবে।

কীভাবে?

আমার এক আত্মীয় পুলিশে কাজ করেন। বিগ শট।

তা হলে কি আমরা ফিরে যাব?

না স্যার। ড্রাইভারকে একটু ক্রস করা যাক। জবাব না দিলেও ক্ষতি নেই। মতলবটা বোঝা যাবে।

মনোজ একটু দ্বিধা করছিল। কিন্তু সুব্রত বেশ গটগট করে এগিয়ে গেল দেখে সেও এগোল।

ড্রাইভারের জানালায় উঁকি দিয়ে সুব্রত হাসিমুখে বলল, গাড়িটা কি আপনার?

ড্রাইভার বেশ একজন শক্তপোক্ত লোক। চোখের দৃষ্টি কঠিন ও স্থির। মোটা গোঁফ, হাতে লোহার বালা, হাস্যহীন মুখ। বয়স পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ হবে। একটু অবাঙালি টানে বলল, কেন, কী দরকার?

আপনি আমাদের ফলো করে এখানে এসেছেন। কেন তা জানতে পারি?

লোকটা খবরের কাগজটা পাশে রেখে বলল, কে কাকে ফলো করেছে? ঝামেলা পাকাতে চান নাকি?

ঝামেলা আপনিই পাকিয়ে তুলছেন। আপনি কি জানেন যে আপনাকে পুলিশে দেওয়া যায়?

লোকটা ঠান্ডা গলায় বলল, এটা আপনার বাবার রাস্তা? হাল্লা মাচালে বহুৎ ঝঞ্ঝাট হয়ে যাবে। কেটে পড়ুন। ফলোটলো আমি করিনি, আপনাকে চিনিও না। যান, ভাগুন।

মনোজ একটু পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে একটু ভাবের জগতের মানুষ। বিজ্ঞান চিন্তা তার বাস্তববোধকে অনেকখানিই খেয়ে ফেলেছে। তবু কর্তব্যবোধবশে সে এবার এগিয়ে এসে বলল, গাড়িটা কার?

লোকটা মনোজের দিকে তাকিয়ে বলল, তা দিয়ে কী দরকার?

বলবেন না?

কেন বলব?

আপনারা তো ক্রিমিন্যাল।

ক্রিমিন্যাল! বলে লোকটা আচমকা দরজাটা খুলে ফেলল এবং দরজার ধাক্কাতেই মনোজকে ছিটকে ফেলে নেমে এল গাড়ি থেকে। নামতেই বোঝা গেল নোকটা প্রায় ছ’ফুট লম্বা, চওড়া কাঁধ এবং মোটা কবজি। বেরিয়ে এসেই মনোজকে একটা লাথি কষিয়েই সুব্রতকে ধরে ফেলল জামার বুকের কাছটায়। তারপর বাঁ হাতে চটাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে বলল, শালা, মামদোবাজির আর জায়গা পাওনি।

মনোজ দরজার ধাক্কা আর লাথি দুটোতেই অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিল। জীবনে এরকম মার সে খায়নি। ভোম্বলের মতো পথেই বসে সে হা করে সুব্রতর মার-খাওয়া দেখছিল। লোকটার সঙ্গে গায়ের জোরে সুব্রতর এঁটে ওঠার কথাও নয়। এক-আধবার হাত-পা চালানোর চেষ্টা করে আর একটা চড় খেয়ে সে নেতিয়ে পড়ল।

ভাগ শালা চুহা কোথাকার!

মনোজ উঠে দাঁড়াল। সুব্রত পড়েনি কিন্তু বোমকে গেছে খুব। মনোজ বলল, এনাফ ইজ এনাফ, লেট আস কুইট।

ইয়েস স্যার।

লোকটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে ছিল, যেন খেয়ে ফেলবে। এর সঙ্গে আর বেশিক্ষণ সময় কাটানোটা যে উচিত হবে না, সেটা বুঝে দু’জনেই যখন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করতে যাচ্ছে তখনই একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটল।

গলির মুখ থেকে একটা লোক এগিয়ে এল। বেশ লম্বাচওড়া চেহারা। এসে তাদের অগ্রাহ্য করে সোজা এসে ড্রাইভারটাকে চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল, তারপর ডানহাতে বিদ্যুচ্চমকের মতো একটা ঘুসি মারল চোয়ালে।

পরম তৃপ্তির সঙ্গে দৃশ্যটা দেখে মনোজ বলে উঠল, বাঃ, চমৎকার মিস্টার দত্ত। এতক্ষণ যে কোথায় ছিলেন!

ড্রাইভারের অচৈতন্য দেহটাকে বনেটের ওপর উপুড় করে ফেলে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাদের দিকে তাকাল সুধাকর। তারপর বলল, কে আপনাদের অ্যাডভেঞ্চারটা করতে বলেছে বলুন তো! কাজের কাজ তো হলই না, উপরন্তু ভন্ডুল হয়ে গেল আমার প্ল্যান।

মনোজ থতমত খেয়ে বলল, এ লোকটা আমাদের ফলো করছিল।

সেটা আমি জানি। এ লোকটা আজ্ঞাবহ মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। কী যে সব কাণ্ড করেন!

মনোজ অপ্রতিভ হয়ে বলে, আজ্ঞে, আমরা তো জানতাম না। হিট অফ দি মোমেন্টে ব্যাপারটা হয়ে গেছে। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো!

ব্যাপার গুরুতর। সুব্রতবাবু ড্রাইভারের সিটের দরজাটা খুলুন। ভিড় জমে যাচ্ছে। এফেক্টটাকে মিনিমাইজ করতে হবে।

বাস্তবিকই ভিড় জমে যাচ্ছে, অন্তত গোটা দশ-বারো লোক দাঁড়িয়ে গেছে।

দু-চারজন এসে জিজ্ঞেসও করল, কী হয়েছে দাদা? ছিনতাই পার্টি নাকি?… ডাকাতির কেস?… আপনারা কি সাদা পোশাকের পুলিশ নাকি?

সুধাকর অবশ্য এসব প্রশ্নের জবাব দিল না। ড্রাইভারের সিটে হতচৈতন্য লোকটাকে বসিয়ে দিল। লোকটা ঘাড় লটকে কেতরে রইল।

সুধাকর মনোজের দিকে চেয়ে বলল, এ গাড়ির আসল সওয়ারি কি আর আসবে এখানে? কাণ্ড দেখে সরে পড়বে।

কিন্তু লাইসেন্স নম্বর?

এই না হলে বুদ্ধি? লাইসেন্স নম্বর ধরে ক্রিমিনালদের খুঁজে বের করা যায় কখনও? হয়তো দেখা যাবে, গাড়িটা হয় চোরাই, না হয় ভাড়া করা। যাকগে, যা ঘটে গেছে তার জন্য ভেবে লাভ নেই। লেট আস ক্লিয়ার আউট।

সেই ভাল। নইলে পুলিশের হুজ্জত হতে পারে। বলে মনোজ সুধাকরের পিছু নিল। সঙ্গে সুব্রত।

মিস্টার দত্ত আপনি হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন বলুন তো! মোক্ষম সময়েই এসে পড়েছিলেন বটে। কিন্তু হঠাৎ এখানে এমন সময়ে একজন ইন্টারপোল এজেন্টের তো হাজির হওয়ার কথা নয়।

সুধাকর হাসল, এ জায়গায় আপনারই কি এ সময়ে হাজির হওয়ার কথা! আপনার তো থাকার কথা অফিসে।

ওঃ হ্যাঁ, তাও বটে। আমি এসেছিলাম একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে।

সবই জানি।

জানেন?

না জানার কিছু নেই। গোপীনাথ বসু আপনাদের চাকরিটা নেবেন না, তার কারণ তিনি আজ অথবা কাল ভোরে আমার সঙ্গে কলকাতা ছাড়ছেন।

কোথায় যাচ্ছেন?

ডেস্টিনেশন আমস্টারডাম।

আজ রাতেই?

সম্ভব হলে।

মনোজ একটু গুম হয়ে থেকে বলল, উনি কি ইন্টারপোলের হাতে বন্দি?

তাও বলতে পারেন।

মনোজ নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। আর কথা বাড়াল।

গোপীনাথের বাড়ির সদরের সামনে এসে সুধাকর বলল, গুড বাই।

বাই।

সুধাকর পার্ক করা নীল মারুতিটা দেখিয়ে বলল, ওটা আমার গাড়ি।

সুধাকর গিয়ে গাড়িতে উঠল। তারপর স্টার্ট দিয়ে ভোঁ করে বেরিয়ে গেল।

মনোজ সুব্রতর দিকে চেয়ে বলল, গোটা ব্যাপারটা একটা জিগশ পাজলের মতো। তুমি কিছু বুঝতে পারলে সুব্রত?

না, স্যার।

দু’জনে উপরে উঠে এসে গোপীনাথের ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল রোজমারি। চোখ-মুখ খানিকটা বিস্মিত।

মনোজ ঘরে ঢুকে দেখল, ঘর ফাঁকা।

গোপীনাথ আর মিসেস বোস কোথায় গেলেন?

রোজমারি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মিনিট দশেক আগে একটা টেলিফোন এল। গোপীনাথ কল পেয়েই সোনালির সঙ্গে গোপনে কিছু কথা বললেন। তারপর আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে দু’জনেই বেরিয়ে গেলেন।

কতক্ষণের জন্য?

বললেন তো মিনিট পনেরোর জন্য। সুব্রতর জন্য একটা মেসেজ রেখে গেছেন। বলে গেছেন, সুব্রত এলেই যেন একবার ল্যান্ডিং-এ গিয়ে মিস্টার সেনের জন্য অপেক্ষা করে।

সুব্রত কিছুই বুঝল না। মিস্টার সেন কে তাও সে জানে না। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। হঠাৎ তার মনে হল, এই ঘরে নিপুণভাবে একটা রঙ্গমঞ্চ সাজানো হয়েছে। একটা কিছু ঘটবে। সে এখানে অনভিপ্রেত।

সুব্রত ঢোক গিলে বলল, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। মিস্টার সেন তো! ঠিক আছে।

বলে সে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। লিফটের জন্য না দাঁড়িয়ে সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল।

ঘরের মধ্যে মনোজ একটু অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসল।

রোজমারি বলল, তোমার কী হয়েছে?

কিছু হয়নি তো।

আয়নায় নিজেকে দেখলেই বুঝতে পারবে। তোমার কোট আর জামায় ময়লা লেগে রয়েছে। গালে ধুলোর ছাপ। চুল এলোমেলো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি ব্যথা চাপছ।

মনোজ ম্লান হেসে বলল, উই হ্যাভ এ স্মল এনকাউন্টার।

মারপিট?

হ্যাঁ।

ঈশ্বর! কার সঙ্গে?

একটা লোক। গুন্ডা।

মারপিট করতে গেলে কেন?

ওই লোকটা, যে গাড়িটা চালাচ্ছিল সেটাই আমাদের ফলো করে।

ঈশ্বর! সুব্রত যে নীল মারুতির কথা বলছিল?

হ্যাঁ।

কী হচ্ছে বলো তো এসব?

আমি বুঝতে পারছি না রোজমারি।

আমরা কি বিপদের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছি?

হতে পারে।

কিছুদিন আগে আমাকে যখন কেউ ভুল দিনে জন্মদিনের গোলাপ পাঠিয়েছিল তখন থেকেই আমি কেমন অস্বস্তিতে আছি। কিছু একটা হবে। কিন্তু কেন হবে মনোজ? আমি কী করেছি?

তা তো জানি না। শোনো, গোপীনাথ চাকরিটা নেবে না। সুধাকর দত্ত ওকে নিয়ে আজই আমস্টারডাম রওনা হচ্ছে।

সুধাকর! তাকে তুমি পেলে কোথায়?

বলব।

ডোরবেল বাজতেই রোজমারি গিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর হঠাৎ একটা আর্তনাদের মতো শব্দ করে পিছিয়ে এল ঘরের মধ্যে। মনোজ চমকে চেয়ে দেখল, দরজায় দু’জন লোক দাঁড়ানো। দু’জনেই বিদেশি চেহারার। দু’জনের একজনকে অবশ্য আবছা চেনে মনোজ। লোকটা লুলু, তাদের সিকিউরিটির কর্তা। অন্যজন অচেনা। দু’জনেরই হাতে দুটো পিস্তল জাতীয় জিনিস, নিম্নমুখী হয়ে ঝুলছে।

রোজমারি চেঁচিয়ে উঠল, কী চাও তোমরা?

অচেনা লোকটা রোজমারির দিকে চেয়ে একটু হাসল। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, কাজটা শেষ করতে এসেছি রোজমারি।

তোমাদের হাতে বন্দুক কেন জো? লুলু?

জো নামে লোকটা বলল, এটাই কাজ।

তোমার সঙ্গে লুলু কেন?

লুলু আমার বন্ধু। লুলু তোমারও বন্ধু। লুলুর সঙ্গে তোমার মধুর সম্পর্কের কথা তোমার স্বামী না জানলেও আমি জানি রোজমারি।

বাজে কথা বোলো না জো।

জো হাসল, বাজে কথা আমি বলি না। আমার কাছে তোমাদের ঘনিষ্ঠতার ভিডিয়ো ক্যাসেটও আছে। একবার ভেবেছিলাম, ওটা দিয়ে তোমাকে ব্ল্যাকমেল করি। কিন্তু দুনিয়া এখন অনেক প্রগতিশীল, অনেক পারমিসিভ। আজকাল স্বামীরা স্ত্রীর ছোটখাটো অবৈধ প্রেম ক্ষমা করে দেয়। তোমার স্বামী তো একটি ভেড়া বই কিছু নয়।

তুমি কি এইজন্য আমাদের ফলো করে এসেছ?

দুর বোকা! তোমাদের জন্য এত পরিশ্রম করব কেন? গোপীনাথ কোথায়? ডাকো।

উনি এখন নেই।

জো আর লুলু চমকে উঠে বলল, মানে? কোথায় গেল?

একটু বাইরে গেছে। এখনই এসে পড়বে। কিন্তু তোমরা কি তাকে খুন করবে জো?

জো অবাক হয়ে বলল, আমরা। আমরা কেন খুন করব?

তা হলে?

ওঁকে খুন করবে তুমি এবং তোমার স্বামী।

কী বলছ জো?

জো ঘড়ি দেখে বলল, গোপীনাথ কোথায় গেছে রোজমারি? সত্য বলে।

লুলু ফ্ল্যাটটা খুঁজে এসে বলল, নেই।

তারপর দরজা খুলে বোধহয় চারদিকটা দেখে এসে বলল, বাইরে বেরোতে পারেনি। আমার লোক নজর রাখছে। অন্য কোনও ফ্ল্যাটে যেতে পারে।

জো বিরক্ত হয়ে বলল, তোমার এটা দ্বিতীয় ভুল লুলু।

৩৬.

জো এবং লুলু পরস্পরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। জো-র চোখে আগুন ঝরছে, লুলুর চোখে ভয়। সিঁটিয়ে থাকা স্থবিরের মতো রোজমারি দৃশ্যটা দেখল। মনোজের অবস্থা তার চেয়ে কিছুমাত্র ভাল নয়। তবু সে-ই প্রথম কথা বলল। পরিষ্কার জার্মান ভাষায় বলল, এসব কী হচ্ছে?

জো ক্লাইন তার দু’খানা রক্ত-জল-করা চোখে মনোজের দিকে চেয়ে জার্মান ভাষায় বলল, একটা নাটক। শেষ দৃশ্য। এই দৃশ্যে প্রধান অভিনেতা আর অভিনেত্রী আপনি আর রোজমারি। কখনও খুনটুন করেছেন মিস্টার সেন?

মনোজ কাপছিল। মাথা নেড়ে বলল, না।

আপনি চিরকাল খুব নিরাপদ জীবন যাপন করে এসেছেন, তাই না?

হ্যাঁ।

খুন করাটা কোনও ব্যাপারই নয়। বিশেষ করে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য যদি করতে হয়।

তার মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

বুঝিয়ে দিচ্ছি। গোপীনাথ যেখানেই থাক এ বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি। সে আসবে। আপনাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকবে। গোপীনাথ বসু ঘরে ঢোকামাত্র দু’জনেই গুলি চালাবেন। আমাদের হাতে যে আগ্নেয়াস্ত্র দেখছেন তা অত্যন্ত শক্তিশালী স্বয়ংক্রিয় পিস্তল। চালানো খুব সোজা।

আমরা গোপীনাথকে মারব কেন?

গোপীনাথকে মারবেন আমি আদেশ করছি বলে। মারতেই হবে, কারণ আপনাদের পিছনে আমরা দুটো পিস্তল আপনাদের দিকে তাক করে অপেক্ষা করব। আপনারা যদি গুলি না চালান সে ক্ষেত্রে কাজটা আমাদেরই করতে হবে। তবে তখন আমরা শুধু গোপীনাথকেই মারব না, আপনাদেরও মারব। বুঝেছেন?

আপনি কে?

আমার নাম জো ক্লাইন। রোজমারির প্রাক্তন স্বামী।

ওঃ হ্যাঁ, আপনার কথা শুনেছি বটে। আপনি মার্কিন সরকারের গুপ্তচর ছিলেন।

ছিলাম। এখন নই।

আপনি এ কাজ কেন করছেন?

স্বার্থে করছি মিস্টার সেন। আমরা সামান্য আজ্ঞাবহ মাত্র। কাজ করে টাকা পাই।

শুধু টাকার জন্য?

জো ক্লাইন মাথা নেড়ে বলল, শুধু টাকা নয় মিস্টার সেন। নিউ ইয়র্কে আমার একটি সরল সোজা বউ আছে। আর আছে ফুটফুটে দুটো বাচ্চা। আমি যাদের আজ্ঞাবহ তাদের হয়ে যদি কাজটা না করি তা হলে তারা প্রথমেই খতম করবে আমার পরিবারটিকে। আমাদের আনুগত্যটাও বাধ্যতামূলক। একরকম পণবন্দি। বুঝেছেন?

মনোজ অবিশ্বাসের গলায় বলল, সত্যি?

এর চেয়ে কঠোর সত্য আর নেই।

খুনটা আমাদের দিয়ে করাতে চান কেন?

কারণ আমরা এখানকার পুলিশি ঝামেলায় জড়াতে চাই না। কোনও চিহ্নও ফেলে যেতে চাই না।

কিন্তু আমরা! আমাদের তো পুলিশে ধরবে!

সেটা আপনাদের শিরঃপীড়ার বিষয়। কিন্তু পুলিশি ঝামেলার চেয়েও আপনার অনেক বেশি দরকার বেঁচে থাকা। তাই নয় কি?

লুলুর সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?

জো একটু হাসল, পাপীর সঙ্গে পাপীর বন্ধুত্ব একটু তাড়াতাড়ি হয়। মিস্টার সেন, লুলু, আপনি এবং আমি, আমাদের তিনজনের একটা জায়গায় খুব মিল। আমরা তিনজনেই রোজমারির প্রাক্তন বা বর্তমান প্রেমিক।

মনোজ একবার রোজমারির দিকে তাকাল, কিছু বলল না। তবে তার মুখে একটা বিস্বাদের ভাব ফুটে উঠল। একটু বেদনাও।

রোজমারি লুলুর দিকে যে চোখে চেয়ে ছিল তা প্রেমপূর্ণ নয়। ঘেন্নায় ভরা। চাপা গলায় সে শুধু একবার বলল, কুকুর।

লুলুর সুন্দর মুখখানা নির্বিকার রইল। সে শুধু ঠান্ডা গলায় বলল, তোমাকে আমি কুত্তি বলতে পারতাম, কিন্তু বলছি না। তার কারণ এটা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জট ছাড়ানোর সময় নয়, রোজমারি। আমাদের হাতে অনেক বেশি জরুরি কাজ আছে।

রোজমারি হঠাৎ বলল, আমরা তোমাদের আজ্ঞাবহ নই। আমরা ভদ্র ও আইন মোতাবেক জীবনযাপন করি। তোমাদের হুকুমে আমরা নিরপরাধ একজন মানুষকে খুন করতে পারব না। আমরা চলে যাচ্ছি। দয়া করে বাধা দিয়ো না। চলো মনোজ।

মনোজের হাত ধরে একটা টান মেরে দাঁড় করিয়ে দিলে রোজমারি।

পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে জো বলল, এখনও তুমি ততটা স্বাধীন নও রোজমারি।

তার মানে?

তোমার অতীত আমি ভুলে যাইনি। ভিয়েনায় গডার্ড নামে একটা লোককে তুমি খুন করেছিলে। ভুলে গেছ? তোমাকে বাঁচাতে খুনের দায়টা আমাকে নিজের কাঁধে নিতে হয়েছিল। বানাতে হয়েছিল আষাঢ়ে গল্প। গল্প বানানোর কাজটা বা অপরাধের দৃশ্য সাজানোর ব্যাপারে আমি অতিশয় দক্ষ। আর সেইজন্যই পুলিশকে ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে পেরেছিলাম। নইলে এতদিনে জেল খেটে তুমি বুড়ি হয়ে যেতে কিংবা মৃত্যুদণ্ডের কবলে পড়তে পারতে।

আমি ভুলিনি৷ ব্ল্যাকমেল করতে চাও, জো? সুবিধে হবে না। আমি যে-কোনও পরিণতির জন্য তৈরি। কিন্তু তোমার হুকুমে গোপীনাথকে মারা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

জো মনোজের দিকে চেয়ে বলল, আপনারও কি তাই মত মিস্টার সেন? আশা করি, আপনি এই মহিলার মতো অবিবেচক নন। তার কারণ আমার হুকুম তামিল না করলে আপনাদের দুজনকে খুন করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।

কেন নেই? আমরা তো চলেই যাচ্ছি। কথা দিচ্ছি, পুলিশকে কিছু বলব না।

জো হাসল, এই কারবারে কথার কোনও দাম নেই। কথা নিতান্তই মূল্যহীন শব্দ মাত্র।

মনোজ রোজমারির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল, রোজমারি যা বলছে আমি তা সমর্থন করছি।

আপনার নিজস্ব কোনও বক্তব্য নেই?

না। আমি যে ব্যক্তিত্বহীন তা তো আপনি জানেন।

খুবই দুঃখের ব্যাপার।

রোজমারি মনজের হাত ধরে টেনে দরজার দিকে এক পা এগোতেই জো ক্লাইন মৃদু স্বরে বলল, একসময়ে তোমাকে ভালবাসতাম রোজমারি, সেই ভালবাসার দোহাই, আত্মহত্যা কোরো না।

রোজমারি জোর দিকে চেয়ে দৃঢ় গলায় বলল, জো, তুমি আমাদের জন্য যে ব্যবস্থা করেছ, তাতেও আমরা তো মরবই। তোমার কথামতো গোপীনাথকে যদি মারি সে ক্ষেত্রে আমরা রেহাই পাব না। পুলিশ ধরবে, বিচার হবে, শাস্তি হবে। নষ্ট হবে আমাদের সব সুনাম। ওভাবে মরার চেয়ে তোমার হাতে যদি গুলি খেয়ে মরি তাতে ক্ষতি কী? এখন মরলেও বিবেক পরিষ্কার থাকবে এই কথা ভেবে যে, একজন নির্দোষ লোককে মারতে হয়নি।

খুব ধীরে ধীরে হস্তধৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি তুলে আনছিল জো। বলল, তোমাদের কে আগে মরতে চাও?

রোজমারি বলল, আমি চাই।

মনোজ বলল, না, আমি।

রোজমারি মনোজকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, প্রহসনের দরকার নেই জো। তুমি পাকা খুনি। দু’জনকেই একসঙ্গে মারো। কে দু’সেকেন্ড আগে গেল, কে দু’ সেকেন্ড পরে, তাতে কী আসে যায়?

জো তার পিস্তলটা তুলে ধরে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তোমাদের দু’জনকে মারাটা আমার প্রোগ্রাম নয়। আমার মূল কাজ গোপীনাথকে সরিয়ে দেওয়া। তোমরা মাঝখানে এসে গেছ বলেই সিদ্ধান্তটা নিতে হচ্ছে। কিন্তু এখনই নয়। পিছিয়ে গিয়ে সোফায় বসে থাকো। আগে গোপীনাথ, তারপর তোমরা।

দরজায় একটা নক হতেই লুলু গিয়ে দরজাটা খুলল। একটা লোক চাপা জরুরি গলায় বলল, আসছে।

লুলু বলল, ঠিক আছে।

দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে লুলু জোর দিকে চেয়ে বলল, তৈরি হও।

জো রোজমারির দিকে চেয়ে বলল, ডোরবেল বাজলে দরজাটা খুলে দিতে পারবে কি?

না জো। আমি বরং চেঁচাব। চেঁচিয়ে গোপীনাথকে সাবধান করে দেব।

জো লুলুর দিকে চেয়ে বলল, তা হলে দু’জনকে শোয়ার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও। নইলে কাজ পণ্ড হতে পারে।

লুলু অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে এসে প্রায় হ্যাচকা টানে দু’জনকে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর অত্যন্ত কঠিন হাতে দু’জনকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

জো গিয়ে দরজাটা খুলে একটু ফাঁক করে রাখল। তারপর পিছিয়ে এসে দু’দিকের দেওয়ালের আড়ালে সরে দাঁড়াল দু’জন। হাতে উদ্যত পিস্তল।

দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। তারপর খুব বিনীত কণ্ঠে জার্মান ভাষায় শোনা গেল, শুভ সন্ধ্যা। ভিতরে আসতে পারি?

জো একটা দাতে দাঁত চাপল। তারপর আড়াল থেকে বেরিয়ে লোকটার মুখোমুখি হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল।

বিস্মিত জো?

খুবই।

সুধাকর দত্ত ঘরে ঢুকে চারদিকে চেয়ে দেখল।

ও দুটি বুঝি শোয়ার ঘরে?

হা দাতা। কিন্তু তুমি এখানে কেন?

সুধাকর লুলুর দিকে চেয়ে বলল, এই বুঝি লুলু?

হা দাতা। কিন্তু তুমি কী চাও?

সুধাকর দু’জনের দিকে পর্যায়ক্রমে চেয়ে বলল, আমি বড্ড পরিশ্রান্ত। কয়েক দিনের বিশ্রাম চাই। আমার কী ইচ্ছে করে জানো? এই শীতের মরসুমে রাঁচি বা হাজারিবাগের কোনও জঙ্গলে নদীর ধারে নির্জন কোনও বাংলোয় কয়েকটা দিন হাঁফ ছেড়ে আসি। কিন্তু কপাল এমনই যে, সেই অবসর কখনওই পাওয়া যায় না।

জো পিস্তল নামিয়ে বলল, গোপীনাথ কোথায় দাতা?

সুধাকর সামনের সোফায় বসে নিরুদ্বেগ গলায় বলল, কাছেই রয়েছে। দরজার বাইরেই।

জো একটা পা বাড়াতেই সুধাকর বলল, নিজের অতীতের সব ট্রেনিং কি ভুলে গেছ জো?

কেন?

দরজার বাইরেটা তোমার পক্ষে নিরাপদ না-ও হতে পারে।

জো সুধাকরের দিকে চেয়ে বলল, আমাকে কি ফাঁদে ফেলেছ?

সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, না। কী লাভ তাতে?

জো পিস্তলটা শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল, আমি জানতে চাই বাইরে পুলিশ আছে কি।

নেই।

তা হলে কে আছে?

ভিকিজ মব।

কী চাও দাতা? আমাকে মারবে না জেলে দেবে?

সুধাকর দুটো পা ছড়িয়ে দিয়ে আরাম করে বসে বলল, আমাকে কী ভাবো তুমি? আমি কি কোনও অবতার না মেসায়া? আমি দুনিয়ার পাপ বিমোচন করতে এসেছি নাকি? ওটা আমার কাজ নয়।

তা হলে আমার কাজে বাধা দিচ্ছ কেন? বাইরে তোমার এজেন্টরাই বা মোতায়েন রয়েছে কেন?

তোমাকে বাড়তি পরিশ্রম থেকে বাঁচাতে।

জো বলল, তার মানে?

গোপীনাথকে মারার দরকার নেই জো। তুমি ফিরে যাও।

জো বিবর্ণ মুখে বলল, দাতা, তুমি কী বলছ জানো? এ কাজটা যদি সমাধা না করতে পারি তা হলে নিউ ইয়র্কে আমার বউ আর দুটো বাচ্চা সাফ হয়ে যাবে। একবার ব্যর্থ হয়েছিলাম বলে আমাকে তারা হুমকি দিয়ে রেখেছে।

সুধাকর একবার আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে বল, জানি।

জানো?

জানি জো।

আমি জানতে চাই তুমি গোপীনাথকে আড়াল করছ কি না। করলে তোমার সঙ্গে অনেকগুলো গ্যাংলিডারের সংঘর্ষ অবশ্যম্ভাবী। আমি সামান্য একজন আজ্ঞাবহ, ভাড়াটে খুনি মাত্র। কিন্তু তারা তো তা নয়।

শোনো জো, ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।

ভাবব না। কিন্তু আমার কী হবে দাতা?

তোমার বউ আর বাচ্চাকে ইতিমধ্যেই নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

তার মানে?

সুধাকর তার পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বের করে জোর হাতে দিয়ে বলল, এই নম্বরে নিউ ইয়র্কে ফোন করলেই তুমি তোমার বউয়ের গলা পাবে। ফোনটা করো।

জো চিন্তিতভাবে ফোনের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ডায়াল করল। মিনিট চারেক বাদে ফোন রেখে সে সুধাকরের দিকে ফিরে বলল, কাল সন্ধেবেলা কয়েকজন বন্দুকধারী আমার বউ আর বাচ্চাদের তুলে এনেছে। তারা আছে হারলেমের একটা বাড়িতে। তুলে আনবার সময় কয়েকজন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সামান্য ধস্তাধস্তিও হয়। তবে গুলি চলেনি। এসব কী হচ্ছে দাতা?

অভিনব কিছু নয় জো। তোমার সংগঠনের লোকেরা তোমার বউ আর বাচ্চাদের ওপর নজর রাখছিল। তুমি এই মিশনে ব্যর্থ হলে তারা শোধ নিত। তুমি ভাল লোক নও জো। কিন্তু তোমার ভিতরে কিছু ভাল এলিমেন্ট ছিল। তোমার ওপর আমার বিন্দুমাত্র করুণা থাকত না, যদি না জানতাম যে তুমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে এবং নিতান্ত প্রাণের ভয়ে মাফিয়াদের হয়ে কাজ করতে নেমেছ। তোমার সবচেয়ে দুর্বলতা তোমার পরিবার। বউ আর বাচ্চা। তুমি আদ্যন্ত একজন পারিবারিক মানুষ। পরিবার নিয়ে সুখে থাকা ছাড়া তোমার আর কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। এই পরিবারমুখী মনোভাবটা আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ গুরা তোমার এই সবচেয়ে দুর্বলতার জায়গাটিকেই আঘাত করেছে। তুমি নিজের পরিবারকে বাঁচাতে যে-কোনও কাজ করতে প্রস্তুত, যদিও তোমার বিবেক তা চায় না। শুধু এই কারণেই তোমার পরিবারকে আমি নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দিয়েছি।

জো হাসল, ধন্যবাদ। কিন্তু এ নিরাপত্তা কতদিন? ওরা একদিন আমার নাগাল পাবেই।

সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, বিশ্বের পরিস্থিতি দ্রুত পালটে যাচ্ছে জো। নিউ ইয়র্কের ব্রংকস এলাকায় গত পরশু থেকে গ্যাংওয়ার শুরু হয়েছে। তোমার অর্গানাইজেশনের দু’জন বস খুন হয়ে গেছে। চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফানুমি নামে একটা লোক সংগঠনের হাল ধরেছিল পরশু মধ্যরাতে। ফানুমি গতকাল নিউ ইয়র্ক ছেড়ে কোনওরকমে পালিয়ে যায়। সংগঠন আপাতত তিন টুকরো।

তা হলে আমার কী হবে?

সুধাকর মৃদু হেসে বলল, সেটা চিন্তার বিষয়।

চিন্তাটা কে করবে দাতা? আমি তো চিরকাল রোবটের মতো কাজ করে গেছি। অগ্রপশ্চাৎ ভাবিনি। পশুর জীবন বোধহয় একেই বলে। বাঁচো আর মায়েরা। এ ছাড়া কিছুই শিখিনি। পরিবারটাকে ভালবাসি। কিন্তু তাদের সঙ্গেই বা বছরে কটা দিন কাটাতে পারি?

নতুন একটা জীবন শুরু করো জো।

অসম্ভব! এরা তা করতে দেবে না আমাকে।

পালাও জো। অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাও। চাষবাস করো। ভদ্রজীবনে ফিরে এসো। তোমার বয়স চল্লিশের কোঠায়। এখনও সময় আছে।

লুলু এতক্ষণ একটা প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল। একটাও কথা বলেনি৷ ঝুলন্ত হাতে একটা পিস্তল নিম্নমুখী হয়ে আছে। আচমকাই সে একজন দক্ষ অ্যাক্রোব্যাটের মতো দাঁড়ানোর ওপরেই একটা ডিগবাজি খেয়ে জানালার দিকে সরে গিয়ে সটান মেঝের ওপর শুয়ে পড়ল। জাদুকরের মতো ডান হাতটা ঝটিতি উঠে এল ওপরে। পরপর দুটো গুলি চালাল সে। সোডার বোতলের ছিপি খোলার মতো দুটো শব্দ হল শুধু। যাকে লক্ষ্য করে সে গুলি চালিয়েছিল সে সুধাকর। সোফা সমেত সুধাকর উলটে পড়ে গিয়েছিল মেঝেয়।

খুব ধীরে উঠে দাঁড়াল লুলু। ইংরেজিতে বলল, হি ইজ ফিনিশড।

জো তার দিকে তাকিয়ে বলল, এ কাজ করলে কেন লুলু?

সেন্টিমেন্টাল ব্যাপারটা আমার সহ্য হয় না জো। ও তোমাকে নরম করে ফেলছিল। দাতা আমার বন্ধু ছিল।

লুলু পিস্তলটা জো এর দিকে স্থির রেখে বলল, খুব ধীরে পিস্তলটা মেঝেয় ফেলে দাও জো।

কেন?

তোমার কাজ শেষ হয়েছে। এখন আমার পালা।

জো ঈষৎ লাল হয়ে বলল, তুমি আমাকে হুকুম করছ? ভয় দেখাচ্ছ?

ভয় দেখাচ্ছি না। তোমাকে ফাঁকা ভয় দেখাব তেমন বোকা নই। পিস্তলটা ফেলে দাও জো।

জো পিস্তলটা ফেলে দিয়ে বলল, তুমি আকাট বোকা। দাতাকে মেরে চূড়ান্ত আহাম্মকের মতো কাজ করেছ। বাইরে ওর লোকেরা আছে। তাদের তুমি চেনো না, আমি চিনি। ভিকিজ মব। তাদের হাত থেকে তুমি কীভাবে রেহাই পাবে?

লুলু অনুত্তেজিত গলায় বলল, সুধাকর দত্ত ভিকিজ মবকে অনেকদিন ধরেই টুপি পরিয়ে আসছে। আহাম্মক আমি নয়, তুমি। সুধাকর দত্তর আসল পরিচয় তুমি জানো না। সুধাকর ইন্টারপোলের বিগ বস।

ইন্টারপোল! মাই গড!

সুখের কথা, সুধাকর দত্ত ওরফে দাতার মুখোশ খুলে গেছে। ভিকিজ মব ওকে আর তাদের ইউরোপিয়ান শাখার সর্দার বলে মানে না। আমি তাদের হয়েই অপ্রিয় কাজটা করলাম মাত্র। এর জন্য ভাল পয়সা পাওয়া যাবে।

ঈশ্বর! তুমি তা হলে কে লুলু?

একজন নিরীহ ব্যবসায়ী। টাকা আয় করি, ওড়াই। আমি জীবনটা আনন্দের সঙ্গে যাপন করতে ভালবাসি। তোমার মতো আমার কোনও পিছুটান নেই। না পরিবার, না প্রিয়জন। দেওয়ালের দিকে একটু সরে যাও জো। তোমার পিস্তলটা কুড়িয়ে নেওয়া দরকার।

তারপর?

তারপর মানে?

আমাকে নিয়ে কী করতে চাও?

ভয় পেয়ো না জো। তোমাকে নিরস্ত্র করে ছেড়ে দেব। তুমি স্বচ্ছন্দে নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। তোমাকে মেরে আমাদের লাভ কী? আর একটা মৃতদেহ নিয়ে বরং সমস্যা বাড়বে। সরে যাও জো।

জো পিছিয়ে গেল। ধীর পায়ে এগিয়ে এল লুলু। পিস্তলটার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। একবার তাকাল মেঝের ওপর কাত হয়ে পড়ে থাকা সুধাকরের দিকে। সামান্য ভ্রু কোঁচকাল তার। দুটো গুলি খেয়েও সুধাকরের কোনও রক্তক্ষরণ হয়নি। অথচ হওয়ার কথা। সে পিস্তলটা কুড়োতে নিচু হল। একটু দ্বিধাগ্রস্ত সে। সুধাকরের রক্তক্ষরণ হয়নি কেন?

লুলু নিচু হয়েছিল বটে, কিন্তু আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। একটা ছোট্ট পিড়িং শব্দ, একটা খুদে পিনের মতো জিনিস বিদ্যুতের গতিতে এসে তার বাঁ দিকের রগে বিধে গেল। কুঁজো অবস্থাতেই বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চোখ। তারপর সে ঢলে পড়ল মেঝের ওপর।

সুধাকর কল-টেপা পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল।

জো প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, তুমি মরোনি?

সুধাকর একটু হাসল, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রাইম অপারেটরের কি লুলুর মতো আনাড়ির হাতে মরা শোভা পায় জো?

কিন্তু ও তো গুলিটা ভালই চালিয়েছিল মনে হল।

তা বটে। শার্প শুটার। তবে টাইম আর স্পেসের কতগুলো হিসেব আছে। সূক্ষ্ম হিসেব। তুমি তো জানো।

জো হাসল, ইউ আর এ গুড সারভাইভার। কিন্তু ভিকিজ মব কি তোমাকে শত্রু ভাবছে? তা হলে এখান থেকে বেরোনো আমাদের কঠিন হবে।

ভয় নেই জো। আমি আসলে কে ভিকি জানে। আমরা হাত ধরাধরি করে কাজ করি। কাটা দিয়েই তো কাটা তুলতে হয়। তাই আমি ক্রিমিনালদের সব সময়ে এলিমিনেট করার পক্ষপাতী নই। তারাও কাজে আসে।

ধন্যবাদ। তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ।

পকেট থেকে একটা সেলুলার ফোন বের করে ডায়ালের পর সংক্ষেপে সুধাকর বলল, চলে আসুন।

পাঁচ মিনিট পর গোপীনাথ আর সোনালি সলজ্জ এবং খানিকটা ভীত মুখে ঘরে ঢুকল। শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল মনোজ আর রোজমারি। ঘরে ঢুকল সুব্রত।

রোজমারির দিকে চেয়ে সুধাকর বলল, খুব বোকার মতো কাজ করেছেন ম্যাডাম। লুলুকে বিশ্বাস করা আপনার উচিত হয়নি। আপনার কারখানার সাবোটাজের পেছনে লুলু। আন্তর্জাতিক গুন্ডাদের লেলিয়ে দেওয়ার পেছনে লুলু। জো-কে কন্ট্রাক্ট দেওয়ার পিছনেও লুলু। চমৎকার মাথা, বিচ্ছিরি চরিত্র এই হল লুলু।

আমি দুঃখিত মিস্টার দত্ত।

আপনার স্বামী হয়তো দুর্বল চিত্ত, কিন্তু উনি মস্তিষ্কবান এবং ভাল লোক। আপনার জীবনে লুলুর মতো লোকের ভূমিকা কী?

আমি বিপদের মুখে পড়ে মনোজকে আজ চিনেছি। সে সত্যিই চমৎকার লোক।

.

বছর দেড়েক বাদে এক সন্ধেবেলা সুইডেনের সোলনা শহরের এক প্রান্তে বিশাল ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের ফটক দিয়ে একটি দামি মার্সিডিজ গাড়ি বেরিয়ে এল। চালকের আসনে গোপীনাথ। মুখে কোনও উদ্বেগ নেই। এই ছোট্ট ছিমছাম সুন্দর শহরটি তার খুব পছন্দ। তার চেয়েও পছন্দ ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারকে। দেড় বছর আগে সে এই কোম্পানিতে যোগ দেয়। কোম্পানি দিয়েছিল প্রভূত বেতন এবং অপার স্বাধীনতা। ভূতের মতো দিনরাত খেটেছিল গোপীনাথ।

এক বছরের মধ্যেই সলিড ফুয়েল তৈরি করা সম্ভব হয়। তবে খরচ পড়েছিল মারাত্মক। পরবর্তী ছ’মাস ধরে চলেছিল বাণিজ্যিক হারে জিনিসটা তৈরির চেষ্টা। দু’মাস আগে সে কাজও সফল হয়েছে অন্তত কুড়িজন বৈজ্ঞানিকের নিরন্তর চেষ্টায়। ভেনাস কিছুদিনের মধ্যেই বহুধা ব্যবহারযোগ্য জ্বালানিটি বাজারে ছাড়বে।

দ্বিতীয়বার বিদেশে এসে সোনালিকে সেই প্রথমবারের মতোই একাকিত্বের জীবন কাটাতে হয়। গোপীনাথ ভয় পেয়ে বলেছিল, তোমার তো আবার একা লাগছে। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো!

সোনালি অবাক হয়ে বলেছিল, একা! না এত একা নই। আমার ভিতরে একটা ছোট্ট তুমি আছে। সে সঙ্গ দেয়।

খুব হেসেছিল তারা। সোনালির একা লাগত হয়তো, কিন্তু গোপীনাথের ভবিষ্যৎ শুধু নয়, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভেবেও মেনে নিত। দিনের বেলা যেত মার্কেটিং-এ। কখনও পার্ক বা হ্রদের ধারে গিয়ে বসে থাকত। সাত মাস আগে তাদের ছেলে দীপ্যমানের জন্ম হল। ব্যস, সোনালির সব মন-খারাপ ডানা মেলে উড়ে গেল।

দীপ্যমানের জন্মের প্রায় সমসময়েই শেষ হয়েছিল গোপীনাথের পাহাড়প্রমাণ কাজ। তারপর থেকে সে রোজ ল্যাবরেটরি থেকে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আসে। শহরটা খুব নির্জন। এই নির্জনতা তাদের ভালই লাগে।

গাড়ি চালাতে চালাতে গত দেড় বছরের কথা ভাবছিল গোপীনাথ। দেড় বছর আগে এক সাংঘাতিক মৃত্যুভয়তাড়িত সময়ে যখন বেঁচে থাকার সবটুকু আশা জলাঞ্জলি দিয়েছিল সে, তখন সোনালি যেন একঝলক হাওয়ার মতো তার বুকে একটা বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার ঘটিয়েছিল। ওইভাবেই সোনালির দ্বিতীয় অভিষেক হল তার জীবনে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আজকাল কর্মক্লান্ত দিনের শেষে সোনালির কাছেই তার ফিরতে ইচ্ছে করে। আর দীপ্যমান। হ্যাঁ, অবশ্যই দীপ্যমান।

ছবির মতো সুন্দর বাগানে ঘেরা তাদের দোতলা বাড়িটি। কত যে ফুল চারদিকে ফুটে আছে। ধুলো নেই, ময়লা নেই। শুধু সুগন্ধ। এখন গ্রীষ্মকাল। বড় মনোরম আবহাওয়া।

ছোট্ট একটু হর্নের শব্দ করে গাড়ি পার্ক করল গোপীনাথ। তারপর নামল। শ্বেতপাথরের সিঁড়ি বেয়ে যখন দরজায় দাঁড়াল তখন তার মুখে হাসি, বুকটা ভরা। সে কি আজ সুখী? সে কতটা সুখী?

দরজাটা খুলে গেল। একটু আনমনা গোপীনাথ ডোরম্যাটে পা মুছে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, দরজার আড়াল থেকে একটা ভারী গলা বলে উঠল, হ্যান্ডস আপ।

গোপীনাথের হৃৎপিণ্ড একটা ডিগবাজি খেল। হাত দুটো ওপরে তুলল সে। আন্দাজ করল, লোকটা তার দু’হাত পিছনে দাঁড়ানো। আচমকা গোপীনাথ সটান উবু হয়ে পিছনের দিকে হাত চালিয়ে লোকটার দুটো পা ধরে হ্যাচকা টান মারল। গোটা ব্যাপারটা ঘটে গেল সেকেন্ডের ভগ্নাংশে। দড়াম করে পড়ে গিয়ে লোকটা বাংলায় বলে উঠল, উঃ, এ তো দেখচি গুরুমারা বিদ্যে।

গোপীনাথ তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে সুধাকরকে মেঝে থেকে তুলে বলল, ইস! লাগেনি তো! ছিঃ ছিঃ, কী কাণ্ড বলুন তো।

সুধাকর হেসে বলল, আই অ্যাম প্লিজড। মাথার কাজ করতে করতে যে রিফ্লেক্স কমে যায়নি তা দেখে খুশি হয়েছি।

কখন এলেন?

ঘন্টা দুই। কফিটফি খেয়েছি। সোনালি আমার জন্য ধোকার ডালনা রান্না করছেন। আর দীপ্যমান আমার নাক কামড়ে দিয়েছে।

খুব হাঃ হাঃ করে হাসল গোপীনাথ। তারপর বলল, আজ থেকে যেতে হবে। অনেক কথা আছে।

সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, ডিনারের পরই চলে যাব। কাজ আছে।

এত কী কাজ বলুন তো!

সুধাকর হাসল, দুনিয়ার একটা দিক আপনি দেখতে পান। অন্যান্য দিকগুলি আমাদের মতো লোককে দেখতে হয়। সেখানে দুনিয়ার যত কাদা, নোংরা, যত ক্লেদ।

আবার কবে আসবেন?

চলে আসব। দীপ্যমানকে দেখার পর আমার একটা মায়া জন্মেছে। ইউ আর এ হ্যাপি ম্যান।

কথায়, হাসিতে, খাওয়ায়দাওয়ায় সন্ধেটা চমৎকার কেটে গেল তাদের। পুরনো কথা হল অনেক। রাত আটটায় একটা গাড়ি এল। চলে গেল সুধাকর।

ফাঁকা ঘরে সোনালি আর গোপীনাথ। দীপ্যমান ঘুমোচ্ছে।

সোনালি বলল, বেশ লোকটা, না?

হ্যাঁ, বেশ লোক। ও না বাঁচালে কবে আমি খুন হয়ে যেতাম।

একটু শিউরে উঠে সোনালি তাড়াতাড়ি তার পাশে এসে বসল। গোপীনাথ তাকে এক হাতে বেষ্টন করে বলল, হানিমুনে যাবে? আমরা আজ অবধি যাইনি কিন্তু।

যাঃ, বাচ্চা হওয়ার পর কেউ হানিমুনে যায় বুঝি?

যায় না?

না। তখন হানিমুন ঘরেই করতে হয়।

তাই! বলে অপলক চোখে সোনালির দিকে চেয়ে রইল গোপীনাথ।

তাই। বলে চোখ বুজে ফেলল সোনালি। লজ্জায়।

Exit mobile version