সুখের কথা, সুধাকর দত্ত ওরফে দাতার মুখোশ খুলে গেছে। ভিকিজ মব ওকে আর তাদের ইউরোপিয়ান শাখার সর্দার বলে মানে না। আমি তাদের হয়েই অপ্রিয় কাজটা করলাম মাত্র। এর জন্য ভাল পয়সা পাওয়া যাবে।
ঈশ্বর! তুমি তা হলে কে লুলু?
একজন নিরীহ ব্যবসায়ী। টাকা আয় করি, ওড়াই। আমি জীবনটা আনন্দের সঙ্গে যাপন করতে ভালবাসি। তোমার মতো আমার কোনও পিছুটান নেই। না পরিবার, না প্রিয়জন। দেওয়ালের দিকে একটু সরে যাও জো। তোমার পিস্তলটা কুড়িয়ে নেওয়া দরকার।
তারপর?
তারপর মানে?
আমাকে নিয়ে কী করতে চাও?
ভয় পেয়ো না জো। তোমাকে নিরস্ত্র করে ছেড়ে দেব। তুমি স্বচ্ছন্দে নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। তোমাকে মেরে আমাদের লাভ কী? আর একটা মৃতদেহ নিয়ে বরং সমস্যা বাড়বে। সরে যাও জো।
জো পিছিয়ে গেল। ধীর পায়ে এগিয়ে এল লুলু। পিস্তলটার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। একবার তাকাল মেঝের ওপর কাত হয়ে পড়ে থাকা সুধাকরের দিকে। সামান্য ভ্রু কোঁচকাল তার। দুটো গুলি খেয়েও সুধাকরের কোনও রক্তক্ষরণ হয়নি। অথচ হওয়ার কথা। সে পিস্তলটা কুড়োতে নিচু হল। একটু দ্বিধাগ্রস্ত সে। সুধাকরের রক্তক্ষরণ হয়নি কেন?
লুলু নিচু হয়েছিল বটে, কিন্তু আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। একটা ছোট্ট পিড়িং শব্দ, একটা খুদে পিনের মতো জিনিস বিদ্যুতের গতিতে এসে তার বাঁ দিকের রগে বিধে গেল। কুঁজো অবস্থাতেই বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চোখ। তারপর সে ঢলে পড়ল মেঝের ওপর।
সুধাকর কল-টেপা পুতুলের মতো উঠে দাঁড়াল।
জো প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, তুমি মরোনি?
সুধাকর একটু হাসল, একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রাইম অপারেটরের কি লুলুর মতো আনাড়ির হাতে মরা শোভা পায় জো?
কিন্তু ও তো গুলিটা ভালই চালিয়েছিল মনে হল।
তা বটে। শার্প শুটার। তবে টাইম আর স্পেসের কতগুলো হিসেব আছে। সূক্ষ্ম হিসেব। তুমি তো জানো।
জো হাসল, ইউ আর এ গুড সারভাইভার। কিন্তু ভিকিজ মব কি তোমাকে শত্রু ভাবছে? তা হলে এখান থেকে বেরোনো আমাদের কঠিন হবে।
ভয় নেই জো। আমি আসলে কে ভিকি জানে। আমরা হাত ধরাধরি করে কাজ করি। কাটা দিয়েই তো কাটা তুলতে হয়। তাই আমি ক্রিমিনালদের সব সময়ে এলিমিনেট করার পক্ষপাতী নই। তারাও কাজে আসে।
ধন্যবাদ। তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ।
পকেট থেকে একটা সেলুলার ফোন বের করে ডায়ালের পর সংক্ষেপে সুধাকর বলল, চলে আসুন।
পাঁচ মিনিট পর গোপীনাথ আর সোনালি সলজ্জ এবং খানিকটা ভীত মুখে ঘরে ঢুকল। শোয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল মনোজ আর রোজমারি। ঘরে ঢুকল সুব্রত।
রোজমারির দিকে চেয়ে সুধাকর বলল, খুব বোকার মতো কাজ করেছেন ম্যাডাম। লুলুকে বিশ্বাস করা আপনার উচিত হয়নি। আপনার কারখানার সাবোটাজের পেছনে লুলু। আন্তর্জাতিক গুন্ডাদের লেলিয়ে দেওয়ার পেছনে লুলু। জো-কে কন্ট্রাক্ট দেওয়ার পিছনেও লুলু। চমৎকার মাথা, বিচ্ছিরি চরিত্র এই হল লুলু।
আমি দুঃখিত মিস্টার দত্ত।
আপনার স্বামী হয়তো দুর্বল চিত্ত, কিন্তু উনি মস্তিষ্কবান এবং ভাল লোক। আপনার জীবনে লুলুর মতো লোকের ভূমিকা কী?
আমি বিপদের মুখে পড়ে মনোজকে আজ চিনেছি। সে সত্যিই চমৎকার লোক।
.
বছর দেড়েক বাদে এক সন্ধেবেলা সুইডেনের সোলনা শহরের এক প্রান্তে বিশাল ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের ফটক দিয়ে একটি দামি মার্সিডিজ গাড়ি বেরিয়ে এল। চালকের আসনে গোপীনাথ। মুখে কোনও উদ্বেগ নেই। এই ছোট্ট ছিমছাম সুন্দর শহরটি তার খুব পছন্দ। তার চেয়েও পছন্দ ভেনাস ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারকে। দেড় বছর আগে সে এই কোম্পানিতে যোগ দেয়। কোম্পানি দিয়েছিল প্রভূত বেতন এবং অপার স্বাধীনতা। ভূতের মতো দিনরাত খেটেছিল গোপীনাথ।
এক বছরের মধ্যেই সলিড ফুয়েল তৈরি করা সম্ভব হয়। তবে খরচ পড়েছিল মারাত্মক। পরবর্তী ছ’মাস ধরে চলেছিল বাণিজ্যিক হারে জিনিসটা তৈরির চেষ্টা। দু’মাস আগে সে কাজও সফল হয়েছে অন্তত কুড়িজন বৈজ্ঞানিকের নিরন্তর চেষ্টায়। ভেনাস কিছুদিনের মধ্যেই বহুধা ব্যবহারযোগ্য জ্বালানিটি বাজারে ছাড়বে।
দ্বিতীয়বার বিদেশে এসে সোনালিকে সেই প্রথমবারের মতোই একাকিত্বের জীবন কাটাতে হয়। গোপীনাথ ভয় পেয়ে বলেছিল, তোমার তো আবার একা লাগছে। আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো!
সোনালি অবাক হয়ে বলেছিল, একা! না এত একা নই। আমার ভিতরে একটা ছোট্ট তুমি আছে। সে সঙ্গ দেয়।
খুব হেসেছিল তারা। সোনালির একা লাগত হয়তো, কিন্তু গোপীনাথের ভবিষ্যৎ শুধু নয়, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভেবেও মেনে নিত। দিনের বেলা যেত মার্কেটিং-এ। কখনও পার্ক বা হ্রদের ধারে গিয়ে বসে থাকত। সাত মাস আগে তাদের ছেলে দীপ্যমানের জন্ম হল। ব্যস, সোনালির সব মন-খারাপ ডানা মেলে উড়ে গেল।
দীপ্যমানের জন্মের প্রায় সমসময়েই শেষ হয়েছিল গোপীনাথের পাহাড়প্রমাণ কাজ। তারপর থেকে সে রোজ ল্যাবরেটরি থেকে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে আসে। শহরটা খুব নির্জন। এই নির্জনতা তাদের ভালই লাগে।
গাড়ি চালাতে চালাতে গত দেড় বছরের কথা ভাবছিল গোপীনাথ। দেড় বছর আগে এক সাংঘাতিক মৃত্যুভয়তাড়িত সময়ে যখন বেঁচে থাকার সবটুকু আশা জলাঞ্জলি দিয়েছিল সে, তখন সোনালি যেন একঝলক হাওয়ার মতো তার বুকে একটা বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার ঘটিয়েছিল। ওইভাবেই সোনালির দ্বিতীয় অভিষেক হল তার জীবনে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আজকাল কর্মক্লান্ত দিনের শেষে সোনালির কাছেই তার ফিরতে ইচ্ছে করে। আর দীপ্যমান। হ্যাঁ, অবশ্যই দীপ্যমান।