পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে জো বলল, এখনও তুমি ততটা স্বাধীন নও রোজমারি।
তার মানে?
তোমার অতীত আমি ভুলে যাইনি। ভিয়েনায় গডার্ড নামে একটা লোককে তুমি খুন করেছিলে। ভুলে গেছ? তোমাকে বাঁচাতে খুনের দায়টা আমাকে নিজের কাঁধে নিতে হয়েছিল। বানাতে হয়েছিল আষাঢ়ে গল্প। গল্প বানানোর কাজটা বা অপরাধের দৃশ্য সাজানোর ব্যাপারে আমি অতিশয় দক্ষ। আর সেইজন্যই পুলিশকে ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে পেরেছিলাম। নইলে এতদিনে জেল খেটে তুমি বুড়ি হয়ে যেতে কিংবা মৃত্যুদণ্ডের কবলে পড়তে পারতে।
আমি ভুলিনি৷ ব্ল্যাকমেল করতে চাও, জো? সুবিধে হবে না। আমি যে-কোনও পরিণতির জন্য তৈরি। কিন্তু তোমার হুকুমে গোপীনাথকে মারা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
জো মনোজের দিকে চেয়ে বলল, আপনারও কি তাই মত মিস্টার সেন? আশা করি, আপনি এই মহিলার মতো অবিবেচক নন। তার কারণ আমার হুকুম তামিল না করলে আপনাদের দুজনকে খুন করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই।
কেন নেই? আমরা তো চলেই যাচ্ছি। কথা দিচ্ছি, পুলিশকে কিছু বলব না।
জো হাসল, এই কারবারে কথার কোনও দাম নেই। কথা নিতান্তই মূল্যহীন শব্দ মাত্র।
মনোজ রোজমারির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল, রোজমারি যা বলছে আমি তা সমর্থন করছি।
আপনার নিজস্ব কোনও বক্তব্য নেই?
না। আমি যে ব্যক্তিত্বহীন তা তো আপনি জানেন।
খুবই দুঃখের ব্যাপার।
রোজমারি মনজের হাত ধরে টেনে দরজার দিকে এক পা এগোতেই জো ক্লাইন মৃদু স্বরে বলল, একসময়ে তোমাকে ভালবাসতাম রোজমারি, সেই ভালবাসার দোহাই, আত্মহত্যা কোরো না।
রোজমারি জোর দিকে চেয়ে দৃঢ় গলায় বলল, জো, তুমি আমাদের জন্য যে ব্যবস্থা করেছ, তাতেও আমরা তো মরবই। তোমার কথামতো গোপীনাথকে যদি মারি সে ক্ষেত্রে আমরা রেহাই পাব না। পুলিশ ধরবে, বিচার হবে, শাস্তি হবে। নষ্ট হবে আমাদের সব সুনাম। ওভাবে মরার চেয়ে তোমার হাতে যদি গুলি খেয়ে মরি তাতে ক্ষতি কী? এখন মরলেও বিবেক পরিষ্কার থাকবে এই কথা ভেবে যে, একজন নির্দোষ লোককে মারতে হয়নি।
খুব ধীরে ধীরে হস্তধৃত আগ্নেয়াস্ত্রটি তুলে আনছিল জো। বলল, তোমাদের কে আগে মরতে চাও?
রোজমারি বলল, আমি চাই।
মনোজ বলল, না, আমি।
রোজমারি মনোজকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে বলল, প্রহসনের দরকার নেই জো। তুমি পাকা খুনি। দু’জনকেই একসঙ্গে মারো। কে দু’সেকেন্ড আগে গেল, কে দু’ সেকেন্ড পরে, তাতে কী আসে যায়?
জো তার পিস্তলটা তুলে ধরে চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তোমাদের দু’জনকে মারাটা আমার প্রোগ্রাম নয়। আমার মূল কাজ গোপীনাথকে সরিয়ে দেওয়া। তোমরা মাঝখানে এসে গেছ বলেই সিদ্ধান্তটা নিতে হচ্ছে। কিন্তু এখনই নয়। পিছিয়ে গিয়ে সোফায় বসে থাকো। আগে গোপীনাথ, তারপর তোমরা।
দরজায় একটা নক হতেই লুলু গিয়ে দরজাটা খুলল। একটা লোক চাপা জরুরি গলায় বলল, আসছে।
লুলু বলল, ঠিক আছে।
দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে লুলু জোর দিকে চেয়ে বলল, তৈরি হও।
জো রোজমারির দিকে চেয়ে বলল, ডোরবেল বাজলে দরজাটা খুলে দিতে পারবে কি?
না জো। আমি বরং চেঁচাব। চেঁচিয়ে গোপীনাথকে সাবধান করে দেব।
জো লুলুর দিকে চেয়ে বলল, তা হলে দু’জনকে শোয়ার ঘরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দাও। নইলে কাজ পণ্ড হতে পারে।
লুলু অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে এসে প্রায় হ্যাচকা টানে দু’জনকে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর অত্যন্ত কঠিন হাতে দু’জনকে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।
জো গিয়ে দরজাটা খুলে একটু ফাঁক করে রাখল। তারপর পিছিয়ে এসে দু’দিকের দেওয়ালের আড়ালে সরে দাঁড়াল দু’জন। হাতে উদ্যত পিস্তল।
দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। তারপর খুব বিনীত কণ্ঠে জার্মান ভাষায় শোনা গেল, শুভ সন্ধ্যা। ভিতরে আসতে পারি?
জো একটা দাতে দাঁত চাপল। তারপর আড়াল থেকে বেরিয়ে লোকটার মুখোমুখি হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল।
বিস্মিত জো?
খুবই।
সুধাকর দত্ত ঘরে ঢুকে চারদিকে চেয়ে দেখল।
ও দুটি বুঝি শোয়ার ঘরে?
হা দাতা। কিন্তু তুমি এখানে কেন?
সুধাকর লুলুর দিকে চেয়ে বলল, এই বুঝি লুলু?
হা দাতা। কিন্তু তুমি কী চাও?
সুধাকর দু’জনের দিকে পর্যায়ক্রমে চেয়ে বলল, আমি বড্ড পরিশ্রান্ত। কয়েক দিনের বিশ্রাম চাই। আমার কী ইচ্ছে করে জানো? এই শীতের মরসুমে রাঁচি বা হাজারিবাগের কোনও জঙ্গলে নদীর ধারে নির্জন কোনও বাংলোয় কয়েকটা দিন হাঁফ ছেড়ে আসি। কিন্তু কপাল এমনই যে, সেই অবসর কখনওই পাওয়া যায় না।
জো পিস্তল নামিয়ে বলল, গোপীনাথ কোথায় দাতা?
সুধাকর সামনের সোফায় বসে নিরুদ্বেগ গলায় বলল, কাছেই রয়েছে। দরজার বাইরেই।
জো একটা পা বাড়াতেই সুধাকর বলল, নিজের অতীতের সব ট্রেনিং কি ভুলে গেছ জো?
কেন?
দরজার বাইরেটা তোমার পক্ষে নিরাপদ না-ও হতে পারে।
জো সুধাকরের দিকে চেয়ে বলল, আমাকে কি ফাঁদে ফেলেছ?
সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, না। কী লাভ তাতে?
জো পিস্তলটা শক্ত হাতে চেপে ধরে বলল, আমি জানতে চাই বাইরে পুলিশ আছে কি।
নেই।
তা হলে কে আছে?
ভিকিজ মব।
কী চাও দাতা? আমাকে মারবে না জেলে দেবে?
সুধাকর দুটো পা ছড়িয়ে দিয়ে আরাম করে বসে বলল, আমাকে কী ভাবো তুমি? আমি কি কোনও অবতার না মেসায়া? আমি দুনিয়ার পাপ বিমোচন করতে এসেছি নাকি? ওটা আমার কাজ নয়।