পরম তৃপ্তির সঙ্গে দৃশ্যটা দেখে মনোজ বলে উঠল, বাঃ, চমৎকার মিস্টার দত্ত। এতক্ষণ যে কোথায় ছিলেন!
ড্রাইভারের অচৈতন্য দেহটাকে বনেটের ওপর উপুড় করে ফেলে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাদের দিকে তাকাল সুধাকর। তারপর বলল, কে আপনাদের অ্যাডভেঞ্চারটা করতে বলেছে বলুন তো! কাজের কাজ তো হলই না, উপরন্তু ভন্ডুল হয়ে গেল আমার প্ল্যান।
মনোজ থতমত খেয়ে বলল, এ লোকটা আমাদের ফলো করছিল।
সেটা আমি জানি। এ লোকটা আজ্ঞাবহ মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। কী যে সব কাণ্ড করেন!
মনোজ অপ্রতিভ হয়ে বলে, আজ্ঞে, আমরা তো জানতাম না। হিট অফ দি মোমেন্টে ব্যাপারটা হয়ে গেছে। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো!
ব্যাপার গুরুতর। সুব্রতবাবু ড্রাইভারের সিটের দরজাটা খুলুন। ভিড় জমে যাচ্ছে। এফেক্টটাকে মিনিমাইজ করতে হবে।
বাস্তবিকই ভিড় জমে যাচ্ছে, অন্তত গোটা দশ-বারো লোক দাঁড়িয়ে গেছে।
দু-চারজন এসে জিজ্ঞেসও করল, কী হয়েছে দাদা? ছিনতাই পার্টি নাকি?… ডাকাতির কেস?… আপনারা কি সাদা পোশাকের পুলিশ নাকি?
সুধাকর অবশ্য এসব প্রশ্নের জবাব দিল না। ড্রাইভারের সিটে হতচৈতন্য লোকটাকে বসিয়ে দিল। লোকটা ঘাড় লটকে কেতরে রইল।
সুধাকর মনোজের দিকে চেয়ে বলল, এ গাড়ির আসল সওয়ারি কি আর আসবে এখানে? কাণ্ড দেখে সরে পড়বে।
কিন্তু লাইসেন্স নম্বর?
এই না হলে বুদ্ধি? লাইসেন্স নম্বর ধরে ক্রিমিনালদের খুঁজে বের করা যায় কখনও? হয়তো দেখা যাবে, গাড়িটা হয় চোরাই, না হয় ভাড়া করা। যাকগে, যা ঘটে গেছে তার জন্য ভেবে লাভ নেই। লেট আস ক্লিয়ার আউট।
সেই ভাল। নইলে পুলিশের হুজ্জত হতে পারে। বলে মনোজ সুধাকরের পিছু নিল। সঙ্গে সুব্রত।
মিস্টার দত্ত আপনি হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন বলুন তো! মোক্ষম সময়েই এসে পড়েছিলেন বটে। কিন্তু হঠাৎ এখানে এমন সময়ে একজন ইন্টারপোল এজেন্টের তো হাজির হওয়ার কথা নয়।
সুধাকর হাসল, এ জায়গায় আপনারই কি এ সময়ে হাজির হওয়ার কথা! আপনার তো থাকার কথা অফিসে।
ওঃ হ্যাঁ, তাও বটে। আমি এসেছিলাম একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট রাখতে।
সবই জানি।
জানেন?
না জানার কিছু নেই। গোপীনাথ বসু আপনাদের চাকরিটা নেবেন না, তার কারণ তিনি আজ অথবা কাল ভোরে আমার সঙ্গে কলকাতা ছাড়ছেন।
কোথায় যাচ্ছেন?
ডেস্টিনেশন আমস্টারডাম।
আজ রাতেই?
সম্ভব হলে।
মনোজ একটু গুম হয়ে থেকে বলল, উনি কি ইন্টারপোলের হাতে বন্দি?
তাও বলতে পারেন।
মনোজ নিঃশব্দে হাঁটতে লাগল। আর কথা বাড়াল।
গোপীনাথের বাড়ির সদরের সামনে এসে সুধাকর বলল, গুড বাই।
বাই।
সুধাকর পার্ক করা নীল মারুতিটা দেখিয়ে বলল, ওটা আমার গাড়ি।
সুধাকর গিয়ে গাড়িতে উঠল। তারপর স্টার্ট দিয়ে ভোঁ করে বেরিয়ে গেল।
মনোজ সুব্রতর দিকে চেয়ে বলল, গোটা ব্যাপারটা একটা জিগশ পাজলের মতো। তুমি কিছু বুঝতে পারলে সুব্রত?
না, স্যার।
দু’জনে উপরে উঠে এসে গোপীনাথের ফ্ল্যাটের ডোরবেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল রোজমারি। চোখ-মুখ খানিকটা বিস্মিত।
মনোজ ঘরে ঢুকে দেখল, ঘর ফাঁকা।
গোপীনাথ আর মিসেস বোস কোথায় গেলেন?
রোজমারি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মিনিট দশেক আগে একটা টেলিফোন এল। গোপীনাথ কল পেয়েই সোনালির সঙ্গে গোপনে কিছু কথা বললেন। তারপর আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে দু’জনেই বেরিয়ে গেলেন।
কতক্ষণের জন্য?
বললেন তো মিনিট পনেরোর জন্য। সুব্রতর জন্য একটা মেসেজ রেখে গেছেন। বলে গেছেন, সুব্রত এলেই যেন একবার ল্যান্ডিং-এ গিয়ে মিস্টার সেনের জন্য অপেক্ষা করে।
সুব্রত কিছুই বুঝল না। মিস্টার সেন কে তাও সে জানে না। সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। হঠাৎ তার মনে হল, এই ঘরে নিপুণভাবে একটা রঙ্গমঞ্চ সাজানো হয়েছে। একটা কিছু ঘটবে। সে এখানে অনভিপ্রেত।
সুব্রত ঢোক গিলে বলল, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। মিস্টার সেন তো! ঠিক আছে।
বলে সে দরজা খুলে বেরিয়ে এল। লিফটের জন্য না দাঁড়িয়ে সে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল।
ঘরের মধ্যে মনোজ একটু অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসল।
রোজমারি বলল, তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয়নি তো।
আয়নায় নিজেকে দেখলেই বুঝতে পারবে। তোমার কোট আর জামায় ময়লা লেগে রয়েছে। গালে ধুলোর ছাপ। চুল এলোমেলো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তুমি ব্যথা চাপছ।
মনোজ ম্লান হেসে বলল, উই হ্যাভ এ স্মল এনকাউন্টার।
মারপিট?
হ্যাঁ।
ঈশ্বর! কার সঙ্গে?
একটা লোক। গুন্ডা।
মারপিট করতে গেলে কেন?
ওই লোকটা, যে গাড়িটা চালাচ্ছিল সেটাই আমাদের ফলো করে।
ঈশ্বর! সুব্রত যে নীল মারুতির কথা বলছিল?
হ্যাঁ।
কী হচ্ছে বলো তো এসব?
আমি বুঝতে পারছি না রোজমারি।
আমরা কি বিপদের মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছি?
হতে পারে।
কিছুদিন আগে আমাকে যখন কেউ ভুল দিনে জন্মদিনের গোলাপ পাঠিয়েছিল তখন থেকেই আমি কেমন অস্বস্তিতে আছি। কিছু একটা হবে। কিন্তু কেন হবে মনোজ? আমি কী করেছি?
তা তো জানি না। শোনো, গোপীনাথ চাকরিটা নেবে না। সুধাকর দত্ত ওকে নিয়ে আজই আমস্টারডাম রওনা হচ্ছে।
সুধাকর! তাকে তুমি পেলে কোথায়?
বলব।
ডোরবেল বাজতেই রোজমারি গিয়ে দরজা খুলে দিল। তারপর হঠাৎ একটা আর্তনাদের মতো শব্দ করে পিছিয়ে এল ঘরের মধ্যে। মনোজ চমকে চেয়ে দেখল, দরজায় দু’জন লোক দাঁড়ানো। দু’জনেই বিদেশি চেহারার। দু’জনের একজনকে অবশ্য আবছা চেনে মনোজ। লোকটা লুলু, তাদের সিকিউরিটির কর্তা। অন্যজন অচেনা। দু’জনেরই হাতে দুটো পিস্তল জাতীয় জিনিস, নিম্নমুখী হয়ে ঝুলছে।