ডাক্তার আসবে। তৈরি থেকো।
হ্যাঁ। আমি আজ রান্না করব।
বাঃ। খুব আহ্লাদ দেখছি।
কিছু করতে ইচ্ছে করছে।
করার অনেক কিছু আছে।
কী করব বলল তো।
সোনালি হাই তুলে বলল, ঘুমোও।
ঘুমোব। এখন ঘুমোব কেন?
তোমার বিশ্রাম দরকার। অনেক ধকল গেছে।
দুর। এসব ঘটনা আমি গায়ে মাখছি না।
যখন ডোরবেল বাজল, অর্থাৎ আরও আধঘণ্টা পর, তখন দরজাটা খুলতে একটু দেরি হল তাদের। কারণ ঘনবদ্ধ আলিঙ্গন ও চুম্বন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে পারছিল না কিছুতেই।
৩৪.
ডোরবেল বেজেই যাচ্ছিল। কিন্তু তারা তবু কেউ উঠল না।
সোনালি গোপীনাথের কপাল থেকে কয়েক গুছি চুল হাত দিয়ে সরিয়ে বলল, ডোরবেল বাজছে, কানে যাচ্ছে না বুঝি?
বাজুক।
সোনালি হাসল, যদি জরুরি দরকারে কেউ এসে থাকে?
ফিরে যাক।
কাছাকাছি, বড্ড কাছাকাছি তাদের মুখ, পরস্পরের শ্বাস মিশে যাচ্ছে পরস্পরের সঙ্গে।
গোপীনাথ রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, বলতে গেলে এটাই আমাদের প্রথম প্রেম। তাই না?
তোমার প্রথম, কিন্তু আমার নয়। আমি সেই কবেই তোমাকে ভালবেসে মরেছিলাম। বিয়ের রাতে।
একটু লজ্জা পেয়ে গোপীনাথ বলল, আমি তখন বাডিং সায়েন্টিস্ট। মাথায় যে কত দুশ্চিন্তা। বিয়েটাকে তখন মনে হয়েছিল একটা বাড়তি দায়িত্ব। তোমার মনে আছে বিয়ের পর বউভাতের রাতেই আমাকে জেনেভার প্লেন ধরতে হয়েছিল?
থাকবে না? যা রাগ হয়েছিল।
তখন ওরকমই ছিল আমার জীবন এবং মনোভাবও। হাইলি কম্পিটিটিভ দুনিয়া আর সেই সঙ্গে আমার জেদ। কিন্তু এখন আমি অন্যরকম লোক, না?
মনে তো হচ্ছে।
ডোরবেল থেমে গেছে। দু’জনে দু’জনের দিকে পলকহীন চেয়ে বসে রইল। দুনিয়া মুছে গেছে। বিপদ-আপদ, জীবন-মৃত্যুর প্রশ্নও থেমে আছে একটু দূরে।
এবার ডোরবেল নয়, টেলিফোন বাজল। টেলিফোনটাকেও উপেক্ষা করল তারা। সোনালির ঠোঁট থেকে ঠোঁট সরিয়ে গোপীনাথ বলল, কারা এমন বেরসিক বলো তো!
সোনালি অলস বিহুল গলায় বলল, ওরা কাজের লোক।
আমাদের কি আজ আর কিছু করা উচিত?
সোনালি হাসল। তারপর গোপীনাথের দু’খানা হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে নরমভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। দাঁড়াও, দেখি কার এত জরুরি দরকার।
টেলিফোন কানে তুলতেই একটা মোলায়েম গলা বলল, এনজয়িং দি লাইফ?
সামান্য হাসিরও শব্দ হল। গা জ্বলে গেল সোনালির। বলল, কে বলুন তো আপনি!
একবার পরিচয় হয়েছিল। আমার নাম সুধাকর দত্ত।
সোনালি একটু থমকে গিয়েছিল। বলল, ও। কী ব্যাপার?
কেমন আছেন বলুন।
ভালই।
আপনি বেশ বুদ্ধিমতী। ঘরের জানালাগুলো মোটা পরদায় ঢেকে দিয়ে ভাল কাজ করেছেন। গোপীনাথবাবু এতটা কেয়ারফুল নন।
উনি তো ভাবনাচিন্তা বেশি করেন।
আপনাদের কি তা হলে ভাব হয়ে গেল? কংগ্রাচুলেশনস।
ধন্যবাদ।
গোপীনাথবাবুকে বলবেন, ডায়েরিটা উদ্ধার করা গেছে।
আপনি ওঁর সঙ্গেই কথা বলুন না।
দিন তা হলে, ইফ হি ইজ নট টেরিবলি বিজি ওয়াইপিং লিপস্টিক ফ্রম হিজ লিপস।
একটু রাঙা হয়ে সোনালি বলল, আমি লিপস্টিক মাখি না। আপনি খুব অসভ্য লোক।
বলেই টেলিফোনটা গোপীনাথের বাড়ানো হাতে ধরিয়ে দিয়ে সোনালি চাপা গলায় বলল, কী সব বলছে, এ মা।
গোপীনাথ একটু হাসল। বলল, আমার বউকে লজ্জায় ফেলছেন কেন?
হঠাৎ ও পাশে সুধাকরের গলাটা একটু বিষণ্ণ শোনাল, লজ্জাটা যে এখনও দুনিয়ার আনাচেকানাচে একটু আধটু রয়ে গেছে সেটা ভাবলে বড্ড খুশি হই, বুঝলেন? এই বেহায়া নির্লজ্জ পৃথিবী যত বে-আবরু হচ্ছে তত আমাদের মতো বুড়ো মানুষরা মুষড়ে পড়ছি।
আপনি আবার বুড়ো হলেন কবে?
হচ্ছি মশাই, হচ্ছি। অভিজ্ঞতারও তো একটা বয়স আছে।
বুঝেছি। আপনি এঁচোড়ে পাকছেন।
যা বলেছেন। কিলিয়েই কাঁঠাল পাকানো হচ্ছে। এনিওয়ে, ডায়েরিটা উদ্ধার হয়েছে।
আঃ বাঁচা গেল। কোথায় পাওয়া গেল?
লম্বা ইতিহাস। অত শুনে কাজ নেই। শুধু বলে রাখি, সাতটা খুন এবং গোটা দুই জখমের পর ডায়েরিটা উদ্ধার হয়েছে একটা ব্যাঙ্কের লকার থেকে। সেটাও সহজে হয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে হয়েছে।
জিনিসটা কবে পাব?
পাবেন কী করে? আধঘণ্টা ধরে ডোরবেল বাজিয়ে এসেছি একটু আগে। অন্য লোক হলে ধরে নিত আপনারা ঘরে নেই। কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে, আপনারা দুটি বিচ্ছিন্ন স্বামী-স্ত্রী বা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়তো বহুদিন পর পুনর্মিলিত হওয়ায়
একটা গলা খাঁকারি দিয়ে থামল সুধাকর।
গোপীনাথ একটু হেসে বলল, মোটেই তা নয় দাতাসাহেব। আসলে আপনার চরেরাই আপনাকে জানিয়েছে যে, আমরা ঘরেই আছি।
কীভাবে জানবে? ঘরে যে মোটা পরদা ফেলা।
আপনার অসাধ্য কিছুই নেই। হয়তো কোনও খুদে মাইক্রোফোন কোথাও সেঁটে রেখে গেছেন। দেখতে না পেলেও শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।
আপনি বুদ্ধিমান।
সে তো বটেই। কোথা থেকে কথা বলছেন?
সেন সাহেবের ঘর থেকে।
এঃ, তা হলে তো আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ডায়ালগ সবই শুনতে পেয়েছেন। ক্লি
য়ার অ্যান্ড লাউড।
প্রাইভেসি বলে আর কিছু রাখলেন না। আমার স্ত্রী লজ্জায় পড়বেন।
আমি আপনাদের শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছি। ইউ আর এ গুড কাপল। আপনাদের রিকনসিলিয়েশনটা দারুণ লেগেছে।
গোপীনাথ একটু দেখে নিল সোনালি কোথায় আছে। সোনালি এখন রান্নাঘরে, হয়তো চা করছে। সে গলাটা একটু নামিয়ে বলল, রিকনসিলিয়েশনটা ভাল হল কি না কে বলবে দাতাসাহেব? বহু বছর পর আমরা মিলেমিশে গেলাম বটে, কিন্তু তার দায়িত্ব কতটা? যেভাবে ঘাতকরা উঠেপড়ে লেগেছে তাতে যে-কোনওদিন আমি শেষ হয়ে যেতে পারি। যদি তাই হয়, তা হলে এই মিলনটা সোনালির কাছে দুঃসহ হয়ে থাকবে। হৃদয়বৃত্তির প্রশংসা করছিলেন, কিন্তু এই নির্দয় পৃথিবীতে হৃদয়বৃত্তি একটা বাড়তি অসুবিধে ছাড়া তো কিছুই নয়।