তবু অস্ত্রটা হাতের কাছে রাখবেন। দরকার হলে ব্যবহারও করবেন।
আরও মানুষ মারতে বলছিস?
আরও মানে! আপনি তো এখনও একটাকেও মারেননি।
আজই মেরেছি।
না মারেননি। লোকটা পড়ে মারা গেছে। আপনি কিছুই করেননি।
একটা ধাক্কা দিয়েছিলাম।
ওটা ভুলে যান। ধাক্কা না দিলে ও আপনাকে চালুনির মতো শতছিদ্র করে দিত।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোপীনাথ বলল, তা দিত।
তা হলে। খামোখা সিমপ্যাথির অপচয় করবেন না।
গোপীনাথ চুপ করে রইল।
টেবিল পরিষ্কার করে সোনালি এসে সোফায় বসতেই হঠাৎ সুব্রত বলল, সোনালিদি, একটা কথা।
কী বলুন তো!
আমি কি আপনাকে বউদি বলে ডাকতে পারি?
সোনালি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, না।
সুব্রত হাসল, আচ্ছা, ডাকব না। বারবার মুখে বউদি ডাকটা এসে যায়। অতি কষ্টে সামলাই।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলল, তোর মতো গবেট দুটো হয় না। সেই বাঙালির বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট আর সম্পর্ক মেনে চলিস এখনও। ওরে পাগলা, দুনিয়া অনেক এগিয়ে গেছে।
গুড নাইট গোপীদা। গুড নাইট সোনালিদি।
সুব্রত চলে যাওয়ার পর দরজাটা বন্ধ করে গোপীনাথ এসে সোনালির মুখোমুখি সোফায় বসে বলল, কী একটা সিদ্ধান্ত নিলে বলো তো! আমার দুশ্চিন্তা বাড়ল বই কমল না।
সোনালি মৃদু কঠিন গলায় বলল, চুপ করো। আমাকে ভাবতে দাও।
কী ভাবছ?
অনেক কিছু। কিন্তু সাজাতে পারছি না। এলোমলো।
গোপীনাথ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সোনালিকে সমর্থন করে বলল, ওটাই কঠিন, কিন্তু সাজানোটাই আসল। না সাজালে চিন্তা শুধু উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে। আই ক্যান হেলপ।
তোমাকে হেল্প করতে হবে না। শুয়ে ঘুমোও গে।
তুমি?
আমি রাত জাগব।
পাগল নাকি। তুমি জাগবে কেন? জাগব আমি। আমার মনটা আজ ভাল নেই। প্রাণ বাঁচাতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটাকে ধাক্কা দিয়েছিলাম। মরে যাবে ভাবিনি। এখন খারাপ লাগছে।
কেন খারাপ লাগবে? তুমি কোনও অন্যায় করোনি। এমনকী ওর মৃত্যুর জন্যও তুমি দায়ী নও। লোকটা মরেছে নিজের দোষে এবং ভুলে।
যাই বলল, আমার মন মানছে না। এ খেলাটা যতদিন চলবে ততদিন হয় মরো না-হয় মারো’ ব্যাপারটাই বহাল থাকবে মনে হচ্ছে। খেলাটা তাড়াতাড়ি শেষ হওয়া দরকার।
কীভাবে হবে?
আমি তো আর ওদের নিকেশ করতে পারব না। বোধহয় ওরাই মারবে আমাকে। সেটা তাড়াতাড়ি ঘটে যাক।
সোনালি ব্রুকুটি করে বলল, তাই নাকি? হাল ছেড়ে দিলে?
ছাড়িনি। হয়তো ছাড়তাম। কিন্তু তুমি এসে একটু হিসেবের গোলমাল করে দিয়েছ। ভাবতে হচ্ছে।
একটু বিষ মেশানো গলায় সোনালি বলল, আমি বুঝি তোমার গলগ্রহ? আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমার জন্যে চিন্তা না হয় আমিই করব।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, ওটা হল থিয়োরি। প্র্যাকটিক্যাল অন্যরকম। যে খেলাটা শুরু হয়েছে আমি সে খেলাটা একটু খেলেছি। কিন্তু তুমি আনাড়ি। তোমার খুব সাহস আছে। কিন্তু এ খেলায় সাহসের চেয়েও বেশি কিছুর দরকার হবে।
সেটা কী?
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধি।
আমি কি নির্বোধ বলে তোমার মনে হয়?
না, তুমি বুদ্ধিমতী। কিন্তু সেই বুদ্ধি অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বুদ্ধিটাকে এই বাঁচামরার লড়াইতে প্রয়োগ করার জন্য আবার খানিকটা এক্সারসাইজ দরকার। সময় নেবে। তাই বলি, প্রথম কয়েকটা দিন আমার পরামর্শ নাও। তাতে দু’জনেরই মঙ্গল।
কী করতে বলছ?
আজ বিশ্রাম নাও। প্রথম দিকেই যদি রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে পড়ো তা হলে কাল আর মাথা কাজ করবে না।
আমি ঘুমোব আর তুমি জেগে থাকবে?
না, তাও নয়। আমি প্রথম রাতটা একটু চারদিকে চোখ রাখি। তোমাকে শেষরাতে ডেকে দেব। তখন তোমার পালা। তুমি টায়ার্ডও।
সোনালি বাস্তবিকই ক্লান্ত। একদিনে তার অভিজ্ঞতা অনেক হয়েছে। সে উঠল, ঠিক ডেকে দেবে?
দেব।
কোথায় ঘুমোব?
দুটো বেডরুম আছে। পাশেরটাতে শুয়ে থাকো।
বলেই চমকে উঠে গোপীনাথ বলল, না না, দাঁড়াও।
সোনালি অবাক হয়ে বলে, কী হল?
আমার বুদ্ধি মাঝে মাঝে ফেল করছে। এ বাড়ির দুটো দিকে রং করার জন্য ভারা বাঁধা হয়েছে। ওই বেডরুমটার গায়ে ভারা আছে। এদিকেরটায় নেই। তুমি আমার বেডরুমে শোও।
সোনালি একটা হাই তুলল। তারপর চলে গেল।
ঘড়িতে সাড়ে এগারোটা বাজে। আজ রাতে আর ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে হল গোপীনাথের, সে উঠে ফ্ল্যাটের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দিল। টর্চ হাতে জানালাগুলোর আশেপাশে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াল। কেউ কোথাও নেই। দারোয়ানদের ওপর কড়া পুলিশি হুকুম জারি হয়েছে, বাইরের উটকো লোককে চট করে ঢুকতে দেবে না। ঢুকলেও যে-ফ্ল্যাটে যেতে চাইবে দারোয়ান সঙ্গে করে সেই ফ্ল্যাটের লোকের সঙ্গে মোকাবেলা করে দেবে। সেদিক দিয়ে খানিকটা নিশ্চিন্ত। তবু গোপীনাথ জানে, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। ওই সামনের বাড়ির ছাত থেকে টেলিস্কোপিক রাইফেলের পাল্লার মধ্যেই সে রয়েছে।
দিন দুই আগে সে গোটা চারেক ইংরেজি থ্রিলার কিনেছে। এসব সে কোনওকালে পড়ে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বুদ্ধিতে ধার দিতে এগুলো কিছু পড়া দরকার।
একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে সে বসে গেল পড়তে।
রাত সাড়ে বারোটায় টেলিফোন বেজে উঠতেই ধক করে উঠল তার বুক। এই অসময়ে কে চায় তাকে?
সে রিসিভার তুলে নিয়েও খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল।
মৃদুস্বরে বলল, হ্যালো।