দেখতেই তো পাচ্ছেন। ভাগ্যিস আমি ঘটনার সময় ফ্ল্যাটে ছিলাম না! কী কাণ্ড বলুন তো! এসব কি টেররিস্ট গ্রুপটুপের কাজ নাকি মশাই?
তা এখনই বলতে পারি না। লোকটা বিদেশি। তার কাছ থেকেও কিছু জানার উপায় নেই। কারণ লোকটা মারা গেছে। পকেটে কাগজপত্র বা পাসপোর্টও পাওয়া যায়নি। আপনি একবার নীচে গিয়ে লোকটাকে দেখবেন? হয়তো আপনি চিনতে পারেন। আপনাকেই যখন মারতে এসেছিল।
গোপীনাথ শান্ত গলায় বলল, তার দরকার নেই, নীচে ভিড় দেখে আমি স্পটে গিয়ে লোকটাকে দেখেছি। ওকে আমি চিনি না, চেনার কথাও নয়। ওপরে এসে দেখছি এই কাণ্ড।
দু’জন পুলিশ অফিসার ঘরে এসে চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখল। জানালার কাছে গিয়ে উকিঝুঁকি দিল। তারপর সোফায় এসে বসে বলল, এবার আমাদের কিছু প্রশ্নের জবাব দিন দয়া করে।
আমার নাম গোপীনাথ বসু। সায়েন্টিস্ট এবং এনআরআই। রোমে থাকি। সাক্কি ইনকরপোরেটেড নামে কোম্পানিতে চাকরি করি। ডিভোর্সি। কয়েকদিন হল দেশে এসেছি। আর কী জানতে চান বলুন!
আপনাকে খুন করে কার লাভ হতে পারে?
আমার জানা নেই।
আপনার কোনও শত্রু আছে? দেশে বা বিদেশে?
না মশাই, আমার খুব সাদামাটা লাইফ। ভেরি সিম্পল।
আপনার পাসপোর্টটা দেখাতে পারেন কি?
কেন পারব না? বলে গোপীনাথ উঠে গিয়ে পাসপোর্টটা নিয়ে এসে পুলিশ অফিসারের হাতে দিল। অফিসার সেটা খুঁটিয়ে দেখে সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে দিয়ে বলল, লোকটা বিদেশি বলেই বলছি, রোমে কিছু ঘটনা ঘটেনি তো!
না। কী ঘটনা ঘটবে?
এই ফ্ল্যাট কি আপনার নিজস্ব?
হ্যাঁ। কয়েক বছর আগে কিনেছিলাম।
এখানে কে থাকে?
আমি এলে থাকি। নইলে ফাঁকা তালাবন্ধ পড়ে থাকে।
কেউ থাকে না?
না।
ঠিক আছে। আগে লোকটার আইডেন্টিটি বের করি, তারপর আমরা আবার আসব।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
ইতিমধ্যে আপনি, আশা করি, কোথাও যাবেন না!
আমার ছুটি খুব বেশি দিনের নয়। আপনারা একটু তাড়াতাড়ি করলে ভাল হয়।
চেষ্টা করব স্যার।
দ্বিতীয় পুলিশ অফিসারটি এতক্ষণ কথা বলেনি। এবার বলল, আপনি কি সাধারণত এই ঘরেই থাকেন বা কাজ করেন?
হ্যাঁ। কম্পিউটারের সামনে দিনের অনেকটা সময় কাটে আমার।
আমরা ভাবছি, খুনি খালি ঘরে গুলি চালাল কেন। সেটা তো লজিক্যাল নয়।
তা জানি না। এমনও হতে পারে লোকটা তলা ভুল করেছে। তাড়াহুড়ো ছিল বলে ভাল করে ঘরটা দেখেনি।
আমরা সব পসিবিলিটি নিয়েই ভাবব।
পুলিশ যাওয়ার পর গোপীনাথ দরজা বন্ধ করল এবং বেশ আরাম করে পা ছড়িয়ে সোফায় বসে টিভিটা চালু করল। টিভির দিকে অর্থহীন চেয়ে থেকে সে ভাবছিল। মনের ভিতর একটা কেমন ওলটপালট হচ্ছে সোনালিকে দেখার পর থেকে। সোনালি সুন্দরী। কিন্তু মেয়েদের সৌন্দর্য ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর নেই গোপীনাথের। বিদেশে সে সুন্দরী তো কম দেখেনি। আর সুন্দরী বলেই হঠাৎ তার এতকালের ঠান্ডা বুকে ঝড় উঠবে তাও নয়। কিন্তু যেটা তাকে সামান্য হলেও স্পর্শ করেছে তা হল সোনালির এই পাশে এসে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা। এবং এই সাংঘাতিক ঝুঁকি নিয়ে। গোপীনাথের জীবন শুকনো নিঃসঙ্গ। এই উষরতার মধ্যে একটা যেন একটু জীবনের ছোঁয়া, হঠাৎ যেন অন্য জগতের দরজা একটু ফাঁক হয়ে গেল।
বোকা সোনালি গোপীনাথের কৌশলটা ধরতে পারেনি। রেগে চলে গেল, অর্থাৎ যা গোপীনাথ চেয়েছিল। এখন গোপীনাথ নিশ্চিন্ত। শত্রু বা মৃত্যুর সম্মুখীন হতে এখন আর তার দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের কিছু নেই।
ডোরবেল বাজল আধঘণ্টা বাদে। গোপীনাথ বেড়ালের মতো চকিত পায়ে গিয়ে আই হোলে চোখ রাখল। সুব্রত।
দরজা খুলে বলল, আয়।
সুব্রত গম্ভীর মুখে বলল, সোনালিদিকে নাকি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছেন?
হ্যাঁ। একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেল। ক্ল্যাশ অব ইগো। আগেও হত।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। সোনালিও আমাকে অপমান করেছে।
সুব্রত ঘরে ঢুকে বলল, চালাকি ছাড়ুন গোপীদা।
চালাকি! চালাকির কথা উঠছে কেন?
আপনি ইচ্ছে করে একটা ঝগড়া পাকিয়ে সোনালিদিকে এখান থেকে সরে যেতে বাধ্য করেছেন।
ওরে পাগলা, তা নয়।
তাই গোপীদা, আমি জানি।
তা হলে বলি শোন, সোনালির কোনও বিপদ হোক তা আমি চাই না। এই বিপদের মধ্যে কিছুতেই ওকে রাখতে পারি না।
কিন্তু উনি চালাকিটা যে ধরে ফেলেছেন।
অ্যাঁ!
হ্যাঁ।
সোনালি আড়াল থেকে দরজার ফ্রেমে এসে দাঁড়াল। মুখ গম্ভীর।
৩১-৩৬. একটু বেশি রাত অবধি
একটু বেশি রাত অবধিই সুব্রত রয়ে গেল। ক্যাটারার খাবার দিয়ে গেলে তা ভাগ করে খেল তিনজনই। যাওয়ার সময় সুব্রত বলল, গোপীদা, আপনার কি কোনও অস্ত্রশস্ত্র চাই?
গোপীনাথ অবাক হয়ে বলে, অস্ত্র। অস্ত্র দিয়ে কী হবে?
আত্মরক্ষার্থে যদি লাগে।
দুর বোকা। আত্মরক্ষার্থে অস্ত্র লাগে না, বুদ্ধি লাগে।
তবু ভেবে দেখুন আমি একটা পিস্তল দিতে পারি।
কোথায় পাবি?
কলকাতায় পথেঘাটে পাওয়া যায়।
গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, স্বাভাবিক। অস্ত্র আজকাল সব দেশেই আকছার পাওয়া যাচ্ছে।
আপনার চাই কি না বলুন।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, না। ইন ফ্যাক্ট একটা পিস্তল এ বাড়িতেই আছে। সেটার কথা আমার মনে ছিল না।
এ বাড়িতে?
হ্যাঁ। তবে সেটা আমার নয়। বোধহয় সুধাকর দত্ত ওটা রেখে গেছে ইচ্ছে করেই।
তা হলে তো হয়েই গেল।
গোপীনাথ মাথা নেড়ে বলল, হল না। অস্ত্র হাতে পেলেই মানুষের একটা হননেচ্ছা জাগে। অস্ত্র জিনিসটার এদিকটার কথা কেউ ভাবে না।