ফোন ধরার সময় তার ছায়াসঙ্গী দু’জন সঙ্গে থাকে না। তারা জানে ফোনে এমন অনেক কথা হয় যা তাদের শোনা উচিত নয়।
রোজমারি ঘরে ফিরে এসে দু’জনকে বলল, তোমরা জানো আমাদের অফিসে আজ ইন্টারপোলের এজেন্ট এসেছে?
দু’জনেই অবাক হয়ে বলল, সে কী?
আজকের দিনটাই বড্ড গোলমেলে। ওদিকে ডেলিগেটদের একজন অসুস্থ। ওঁরা আসবেন কি না বোঝা যাচ্ছে না।
শুভ বলল, কীরকম অসুস্থ?
তা জানি না। সবকিছু ধাঁধার মতো লাগছে।
পানীয়টা ঢকঢক করে শেষ করল রোজমারি। তারপর চুপ করে বসে রইল চোখ বুজে।
অনেকক্ষণ বাদে শুভ বলল, আপনি যখন ফোনে কথা বলছিলেন তখন ফ্লোরিস্টের লোক এসে ফুল বদলে দিয়ে গেছে।
রোজমারি চোখ খুলে দেখল, একগোছা রজনীগন্ধা যেন হেসে উঠল।
ফুল সে খুব ভালবাসে। বিশেষ করে সাদা ফুল। মনটা হঠাৎ যেন এত খারাপের মধ্যেও ভাল হয়ে গেল। সে উঠে গিয়ে ফুলগুলোকে হাত দিয়ে একটু আদর করল। তারপর হঠাৎ শুভর দিকে চেয়ে বলল, শুভ, কেউ কি আমাকে খুন করতে চায়?
০৩.
লোকটাকে একটুও ভাল লাগছে না সোনালির। মনে হচ্ছে, লোকটা ধূর্ত ও কুট। কারখানা দেখার নাম করে লোকটা একটা নোটবই বের করে কী সব যেন টুকে নিচ্ছিল।
মেল্টিং শপ দেখে শুধু প্রশ্ন করল, আপনারা কোল গ্যাস ব্যবহার করেন বুঝি?
সোনালি বলল, হ্যাঁ।
চারদিকে ঘুরেটুরে দেখে বলল, প্রোডাকশন তো বোধহয় তেমন বেশি নয়।
না। এই অ্যালয় একটু রেয়ার টাইপের।
সবচেয়ে বেশি সময় নিল কেমিক্যাল ল্যাবে। ল্যাবের ইনচার্জ ড. ইউ প্রসাদ একজন মস্ত ডিগ্রিধারী মানুষ। দীর্ঘকাল আমেরিকায় কাজ করেছেন। বয়স্ক লোক, কাজে ডুবে থাকতে ভালবাসেন। সুধাকর অনেকক্ষণ চাপা গলায় কথা বলল প্রসাদের সঙ্গে। কী কথা হচ্ছে তা চার-পাঁচ ফুট দূরত্বে বসেও সোনালি বুঝতে পারছিল না। কথা বলতে বলতে টেবিলের তলায় আড়ালে নোট করা অব্যাহত ছিল।
ল্যাব থেকে বেরিয়ে বাগান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুধাকর জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম আপনি ক’দিন এখানে কাজ করছেন?
এক বছর।
তা হলে তো অনেক কিছুই জানেন।
কী জানব?
এই এখানকার টেকনিক্যাল ব্যাপারস্যাপার।
না। আমি সায়েন্টিস্ট নই। আমার কাজ অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে।
তা হলেও কিছু নিশ্চয়ই জানেন। কোন দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্ডার পান আপনারা?
তার কোনও ঠিক নেই।
ইন্ডাস্ট্রি অনেক রকমের আছে। আপনাদের অ্যালয়টা ঠিক কোন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজে লাগে বলতে পারেন?
না। আমার জানা নেই।
হয়তো আপনি বলতে চাইছেন না।
এ ব্যাপারে আপনি মনোজবাবুর সঙ্গেই কথা বলতে পারেন।
সুধাকর দত্ত একটা ছোট্ট ক্যামেরা বের করে চটপটে হাতে কারখানার কয়েকটা ছবি তুলে নিল বাগানে দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা ভাল লাগল না সোনালির। সে অবশ্য প্রতিবাদও করল না। ইন্টারপোলের এজেন্টদের হয়তো এসব স্বাধীনতা আছে।
লোকটা ক্যান্টিনের কাছ বরাবর এসে নাক তুলে একটু গন্ধ শুকে বলল, মাদ্রাজি খাবারের গন্ধ পাচ্ছি। আপনাদের ক্যান্টিন কি কোনও সাউথ ইন্ডিয়ান চালায়?
না। তবে সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশ তৈরি হয়।
মিস সোম, আপনি কি বিবাহিতা?
সোনালি একটু অবাক ও বিরক্ত হয়ে বলল, কেন?
এমনি।
আমি ডিভোর্সি।
মুখে একটু আপশোসের চুক চুক করে সুধাকর দত্ত বলল, আজকাল ডিভোর্স খুব বেড়ে গেছে, না?
হবে হয়তো। সোনালি নিস্পৃহ জবাব দিল।
সুধাকর দত্ত হঠাৎ ফের জিজ্ঞেস করল, আপনি কি জানেন রোজমারির এটাই প্রথম বিয়ে কি না!
বিরক্ত সোনালি বলল, তা আমি কী করে বলব?
আহা, মেয়েরা তো অনেক কিছু টের পায়। ইন্সটিংক্ট।
না। ওসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।
সুধাকর দত্ত যেন বেড়াতে এসেছে, এরকমই হাবভাব। নিশ্চিন্ত মনে বাগানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বলল, বাগানখানা বেশ সুন্দর, না?
সত্যিই সুন্দর। কারখানার ভিতরে এই বাগান এবং দুর্লভ নানারকম গাছগাছালি লাগানোর শখ রোজমারির। প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে, অনেক পরিশ্রম গেছে তার। বনবিভাগের সহযোগিতায় অবশেষে হয়েছে এই বাগান। সোনালি অবশ্য অত কথায় গেল না। শুধু বলল, হ্যাঁ, বেশ সুন্দর।
সুধাকর হঠাৎ তার দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা মনোজবাবু কি খুব এফিশিয়েন্ট লোক?
তার মানে?
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, এই কারখানার আইডিয়া, একজিকিউশন, এসবের পিছনে আছেন রোজমারি। তাই না?
দেখুন, আমি এত সব জানি না। আপনি যা খুশি ডিডাকশন করতে পারেন, আমার মতামত চাইবেন না।
আপনি একটু শর্ট টেম্পার্ড। আচ্ছা ঠিক আছে। শুধু এটুকু তো বলতে পারেন, আমি যা বললাম তা ভুল না ঠিক!
না, তাও পারি না। আমাদের কিন্তু হাতে সময় নেই। ডেলিগেটরা এসে পড়বেন।
সুধাকর দত্ত অবাক হয়ে বলল, কারা আসবে?
ফরেন ডেলিগেটরা।
তাই নাকি?
কেন, আপনি জানেন না?
জানি। কিন্তু তারা যে আসবেনই এমন গ্যারান্টি নেই।
কী যা তা বলছেন?
ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, দেয়ার আর মেনি এ স্লিপস, বিটউইন দি কাপ অ্যান্ড দি লিপস!
তা আছে। কিন্তু আমাদের সত্যিই সময় নেই।
ব্যস্ত হবেন না। ডেলিগেটদের আসার সময় হলে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঠিক টের পাবে।
সোনালি হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। আপনি বরং একা একাই কমপ্লেক্সটা ঘুরে দেখুন, আমি অফিসে যাচ্ছি।
সেটা কি উচিত হবে? এখনও সবাই তো আমাকে চেনে না। একজন ইনট্রিউডার হিসেবে ট্রিট করতে পারে। তা ছাড়া আপনার কাছ থেকে আমার আরও কিছু জানার আছে।