রোজমারি ফুল এবং ট্যাগ দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, আমার বার্থ ডে তো আজ নয়!
জানি মেমসাব।
ঠিক পঁয়ত্রিশটা ফুল। রোজমারির বয়স এখন পয়ত্রিশই। কিন্তু কে এই ভুল দিনে ফুল পাঠাল সেটা বুঝতে পারল না সে। ফুল সে খুবই ভালবাসে। ভালবাসে কাজ। ভালবাসে সাফল্য। ভালবাসে লড়াই। ভালবাসে হেলথ ফুড। ভালবাসে আরও অনেক কিছু।
রোজমারি তাজুকে বলল, লিভিং রুমে সাজিয়ে রেখে দাও।
তাই রাখল তাজু। মধ্যবয়স্ক তাজু একটু কম কথার মানুষ। সে লম্বা ও রোগা এবং মধ্যবয়স্ক। তার মেয়ে লেখার বয়স কুড়ি হতে পারে। একটু লাজুক। বাবাকে খুব ভয় পায়। এই বাবা আর মেয়েকে খুব লক্ষ করে রোজমারি। এমন অদ্ভুত আনুগত্য ও শ্রদ্ধার ভাব সে কদাচ দেখেনি। এদের মধ্যে সবসময়ে যেন কৃতজ্ঞতার ভাব ফুটে থাকে। মনোজ বলেছিল, এ দেশে ঝি-চাকরের মাইনে নাকি অনেক কম। এরা বেশি মাইনে পায় বলেই অমন কৃতার্থ। রোজমারির বিস্ময় এখানেই। সাতশো টাকাও কি খুব খুব খুব কম টাকা নয়? মাত্র সাতশো টাকায় একটা মানুষ!
ব্রেকফাস্ট করতে যখন লিভিং রুম পেরিয়ে ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছিল রোজমারি তখন বুককেসের ওপর কাট গ্লাসের ফুলদানিটা চোখে পড়ল।
পঁয়ত্রিশটা গোলাপের কুঁড়ি। সেলোফেন ছিঁড়ে তাজু সাজিয়ে রেখেছে। রোজমারি কাছে গিয়ে ফুলগুলো দেখল। টাটকা এবং সুন্দর গন্ধ। একটা গোলাপকে সে একটু স্পর্শও করল।
কে পাঠাল? ভুল দিনে কেন? সে কি তার জন্মদিন জানে না?
ব্রেকফাস্ট খুব সামান্যই খায় রোজমারি। এ দেশের দুধ তার সহ্য হয় না, মুখেও রোচে না। তার বদলে সে বিদেশ থেকে আনানো একটা বিভারেজ খায়। সঙ্গে দুটো মাখন ছাড়া টোস্ট, একটা কলা। সকাল ঠিক নটায়। আর এই সময়েই তার দু’জন সেক্রেটারি এসে হাজির হয়। একজন শুভ, অন্যজন মৈত্রেয়ী। দু’জনেরই বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। খুব চটপটে এবং বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিমতী। শুভ ডিকটেশন নেয় এবং কাগজপত্তর গুছিয়ে রাখে। মৈত্রেয়ী রাখে বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এবং অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এরা খানিকটা রোজমারির সঙ্গীও।
দু’জন লিভিং রুমে অপেক্ষা করছিল। রোজমারি তার ব্রেকফাস্ট সেরে এসে ঢুকতেই তারা উঠে দাঁড়াল।
রোজমারি বলল, একটা মজার ঘটনা দেখবে? আজ আমার বার্থ ডে বলে কে একজন ফুল পাঠিয়েছে। ওই দেখো।
দু’জনে দেখল। মৈত্রেয়ী বলল, কিন্তু আপনার বার্থ ডে তো
সেইটেই তো মজা। কে পাঠাতে পারে বলে তো!
শুভ বলল, কোনও অন্যমনস্ক লোকই হবে।
শুভ গিয়ে ট্যাগটা দেখল। তারপর হঠাৎ বলল, ম্যাডাম, ট্যাগের উলটো পিঠে কিছু লেখা আছে।
কী লেখা আছে?
আর আই পি।
রোজমারি খুব অবাক হয়ে বলল, এটা কীরকম ইয়ারকি? আর আই পি?
হ্যাঁ ম্যাডাম, তাই লেখা।
রোজমারি একটু রেগে গেল। বলল, আর আই পি মানে তো রেস্ট ইন পিস। কবরের ওপর লেখা থাকে। শুভ, ফ্লোরিস্টের নাম আর ঠিকানা ট্যাগে ছাপা আছে। এখনই খোঁজ নাও তো।
নিচ্ছি ম্যাডাম। বলে শুভ ফোন তুলে নিল।
রোজমারি দোতলায় উঠে তার মুখটা আয়নায় দেখে চুলটুল ঠিক করে নিল। আজ বিদেশের ডেলিগেটরা আসবে। তার অনেক কাজ। অফিস থেকে তাকে দুপুরের আগেই চলে যেতে হবে গ্র্যান্ডে। মাননীয় অতিথিবৃন্দকে আপ্যায়িত করতে হবে মধ্যাহ্নভোজে।
যখন নীচে নেমে এল তখন শুভ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে।
ম্যাডাম, ওরা বলছে আর আই পি হল একজনের নাম। রজার আইভ্যান পোলক। ফুলটা সে-ই পাঠিয়েছে।
রোজমারি অবাক হয়ে বলল, কিন্তু লোকটা কে? এ নামে তো আমি কাউকে চিনি না।
ওরাও বলতে পারল না। ওদের অর্ডার বুকে এই নাম লেখা আছে। ওদের বলা ছিল যেন কার্ডের পিছনে আর আই পি প্রিন্ট করা হয়।
রোজমারি অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মিস্টার পোলক বেঁচে থাকুন, কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারছি না। আমাদের আর সময় নেই। চলো।
তারা বেরিয়ে পড়ল। মনোজ আজ একটু আগেই বেরিয়ে গেছে অফিসের রিসেপশন ঠিক করতে। আজকের দিনটা গুরুত্বপূর্ণ।
রোজমারি কোনও ব্যাপার নিয়ে অকারণ দুশ্চিন্তা করে না। সে কাজের মানুষ। কিন্তু গোলাপের তোড়াটা তাকে ভাবাচ্ছে।
আগে নিজের গাড়ি নিজেই চালাত রোজমারি। কিন্তু কলকাতার রাস্তার ভিড় আর উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে সে গাড়ি চালানো ছেড়েছে। তার গাড়ি চালায় শিউশরণ। শিউশরণ খুবই ভাল ড্রাইভার। তাকে দু’হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। এ টাকাটাও যাচ্ছেতাই রকমের কম। ভারতবর্ষের অর্থনীতির ধাঁচটা রোজমারি আজও বুঝে উঠতে পারল না।
নতুন বড় মারুতির সামনের বাকেট সিটে রোজমারি, পিছনে শুভ আর মৈত্রেয়ী। গাড়ির কাঁচ বন্ধ, এয়ার কন্ডিশনার চলছে।
রোজমারি কর্মচারীদের সঙ্গে বাংলা এবং ভাঙা হিন্দিতেই কথা বলে। কারণ তার মাতৃভাষা জার্মান কেউ বুঝবে না। আর ইংরেজি এখনও রোজমারি ভাল রপ্ত করতে পারেনি। মনোজের সঙ্গে আগে সে জার্মান ভাষায় কথা বলত। আজকাল বাংলায় বলে। তাতে ভাষাটা শিখতে তার সুবিধে হয়। এখন সে বাংলা হরফ শেখার পর বই পড়ার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে শুভ আর মৈত্রেয়ী তাকে খুব উৎসাহের সঙ্গে সাহায্য করে।
লাল গোলাপের ঘটনাটা মন থেকে তাড়ানোর জন্য রোজমারি শুভকে বলল, এবার তুমি আমাকে কোন বইটা পড়তে দেবে শুভ?
পথের পাঁচালী পড়বেন ম্যাডাম?
ও বইটার কথা তুমি আর মৈত্রেয়ী অনেকবার বলেছ।