তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি। সুধাকর দত্ত নামে যে ভদ্রলোক এসেছেন, আমার সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করবেন। বুঝেছ?।
সেক্রেটারি?
হ্যাঁ। অ্যান্ড নো কোশ্চেন।
ওকে স্যার।
আর ইন্টারপোল কথাটা সম্পূর্ণ ভুলে যাও। বুঝেছ।
হ্যাঁ স্যার। উনিও আমাকে সেটা বুঝিয়ে গেছেন।
মনোজ উঠে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। বিশাল দেওয়াল-জোড়া কাঁচের শার্সি। অখণ্ড অভঙ্গুর কাচ। পিছনে গাছপালা, সাজানো বাগান-ঘেরা লন, লনের ওপাশে কয়েকটা লম্বা লম্বা শেড। ওইসব শেড হল তার কারখানা। ইস্টার্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়। বাঁ দিকে কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি, ডানদিকে মেন্টিং শপ। খুব বেশি লোক এখানে কাজ করে না। লোকের তেমন দরকারও নেই। কিন্তু দরকার ভাল বিশেষজ্ঞের। আগে কারখানার আবহাওয়া শান্ত ছিল। এখন একটা ইউনিয়ন হয়েছে। কিছু কিছু অশান্তি দেখা দেয় মাঝে মাঝে। তবে এখনও তা মাত্রা ছাড়ায়নি। আর একটা ঝামেলা হচ্ছে, কিছু পয়সাওলা লোক কারখানাটা কিনে নিতে চায়। তার জন্য চাপও দেয় নানাভাবে। অনেক টাকার অফার।
টেনশন মনোজ সহ্য করতে পারে না। তার নার্ভ শক্ত নয়। কিন্তু তার বউ রোজমারির নার্ভ খুব শক্ত। জার্মানিতে যখন ছিল মনোজ তখন রোজমারির সঙ্গে তার প্রেম এবং বিয়ে। রোজমারিও মনোজের মতোই একজন মেটালার্জিস্ট। তাদের দুজনেরই উঁচু ডিগ্রি আছে। এই কারখানা করার ব্যাপারে রোজমারির অবদানই বেশি। সে-ই একটি জার্মান কোম্পানিকে ধরে একটা কোলাবরেশনের ব্যবস্থা করে। এই কারখানার পিছনে সেই জার্মান কোম্পানির টাকা ও প্রযুক্তি বারো আনাই কাজ করছে।
রোজমারি ছাড়া মনোজ অচল। রোজমারি যেমন কর্মঠ তেমনি বুদ্ধিমতী। ক্ষুরধার তার ধাতু সংক্রান্ত জ্ঞান। এই কারখানায় যে অ্যালয় তৈরি হয় তার যে বাজার একদিন এত ভাল হবে তা রোজমারিই প্রথম বুঝতে পেরেছিল। আজ কারখানা চলছে রমরম করে। বিদেশের বাজার তারা অনেকটাই দখল করতে পেরেছে। যে প্রতিনিধিদল আজ আসছে, তাদের সঙ্গেও প্রথম যোগাযোগ করেছিল রোজমারিই।
বাইরের দিকে চেয়ে সে আনমনে কিছুক্ষণ নানা কথা ভাবল। একটু টেনশন হচ্ছে। কেন হচ্ছে কে জানে। এই সুধাকর দত্তর হঠাৎ উদয় তার একটুও ভাল লাগছে না।
ইন্টারকম বাজল। অতনু।
স্যার, এইমাত্র খবর এল ডেলিগেটদের একজন অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওঁরা তাজ বেঙ্গলে ফিরে যাচ্ছেন।
কী বলছ? কে অসুস্থ হয়ে পড়ল?
নাম তো বলেনি স্যার। তবে ওঁরা এখন আসতে পারছেন না।
পরে আসবে?
তাও স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
কে ফোন করেছিল?
সুব্রত।
সুব্রত মনোজের পিআরও। ডেলিগেটদের সঙ্গে সঙ্গে আছে। মনোজ বিরক্ত হয়ে বলল, সুব্রত কি আবার কন্ট্রাক্ট করবে?
হ্যাঁ স্যার, হোটেলে পৌঁছে।
আমার সঙ্গে কথা বলতে বলবে।
ঠিক আছে স্যার।
মনোজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রোজমারি লাঞ্চের ব্যবস্থা করতে গ্র্যান্ডে রয়েছে। তাকে কি জানানো দরকার? জানানোই ভাল। লাঞ্চটা বোধহয় ক্যানসেল করতে হবে। সে ফোনটা তুলে নিল।
০২.
আজ, তেরোই সেপ্টেম্বর সকালে একগোছা নৈর্ব্যক্তিক রক্তগোলাপ কে পাঠাল তাকে? পার্ক স্ট্রিটের এক ফ্লোরিস্টের নোক এসে দিয়ে গেল। সেলোফেনে যত্ন করে মোড়া, তোড়ার গায়ে একটা ট্যাগ। তাতে টাইপ করা একটি বাক্য: হ্যাপি বার্থ ডে টু রোজমারি। কোনও মানে হয় না ব্যাপারটার। আজ রোজমারির জন্মদিন? তার জন্মদিন পার হয়ে গেছে আরও দশ দিন আগে। ট্যাগে কারও নাম নেই এটা রীতি নয়। রহস্য তার ভাল লাগে না। ঘটনাটা তাকে ভাবিয়ে তুলল।
তাদের বাড়ির কাজের লোক তিনজন। ঘরের কাজ করে তাজু আর লেখা। বাগানের জন্য আছে বনমালী। তাজু আর লেখা বাপ আর মেয়ে। দু’জনেই খুব কাজের। তাজু রাঁধে, বাজারহাট করে, জামাকাপড় মেশিনে কাঁচে ও ইস্তিরি করে, ইলেকট্রিক বা টেলিফোনের বিল মেটায়, জার্মান শেফার্ড কুকুরটার দেখাশুনো করে এবং আরও নানা কাজে সাহায্য করে। লেখা ঘরদোর পরিষ্কার করা, বাসন মাজা, বিছানা করা ও তোলা ইত্যাদি। দু’জনেই খুব পরিশ্রমী। বনমালীও বেশ কর্মঠ। এরা সকলেই সাতশো টাকা করে মাইনে, খাওয়া, থাকার ঘর, কাপড়চোপড় পায়। ডয়েশ মার্কের হিসেবে বেতন এতই কম যে রোজমারি খুবই অবাক হয়। কোনও সভ্য দেশে এই বেতনে দিন-রাতের কাজের মানুষ পাওয়া যায় এরকম সে স্বপ্নেও ভাবেনি। প্রায় ক্রীতদাসের মতোই এরা হুকুম তামিল করে, খুবই ভদ্র এবং অনুগত। মাঝে মাঝে সে ভাবে, এদের কি আমরা এত সস্তায় কিনে নিয়েছি?
গোলাপের তোড়াটা যখন এল তখন দোতলার বারান্দায় সকালের রোদে বসে ছিল রোজমারি। গায়ে হালকা সানট্যান তেল মেখে নিয়ে রোজই সে কিছুক্ষণ সকালের রোদ পোয়ায় এবং চোখ বুজে খুব স্থিরভাবে সারা দিনের প্রোগ্রাম ঠিক করে নেয়। তার স্বামী মনোজ একটু অগোছালো স্বভাবের এবং হয়তো আত্মবিশ্বাসেরও কিছু অভাব আছে। মনোজের ফাঁকগুলো রোজমারিকেই ভরাট করতে হয়। সকালবেলায় এই রোদ পোয়ানোর সময়টুকু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সারা দিনটাকে আগাম সাজিয়ে নেওয়া। ঘড়ি ধরে এবং সঠিক পরম্পরায়।
ঠিক ওই সময়েই গোলাপের তোড়াটা নিয়ে ফুলওয়ালার লোক এল। তোড়াটা ওপরে নিয়ে এল তাজু। মেমসাব, ফুল।
কীসের ফুল?
বার্থ ডে। ফ্লোরিস্টের লোক দিয়ে গেল।