গোপীনাথ নার্ভাস বোধ করছিল। বলল, এরকম ঘটনা ঘটেছে নাকি?
মঁসিয়ে বোস, আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন যে, আপনাদের ল্যাবরেটরির প্রত্যেকটা ঘরেই ইলেকট্রনিক আই বসানো আছে। প্রত্যেকটা ঘরই সারাক্ষণ মনিটর করা হয়।
গোপীনাথ ঠান্ডা গলায় বলল, জানব না কেন?
আমরা মনিটরে আপনার সব কার্যকলাপই খুব মন দিয়ে দেখেছি।
গোপীনাথ দ্রুত ভাবছিল। তাদের ল্যাবরেটরির সিকিউরিটি অত্যন্ত উচ্চমানের। বাইরের লোক ঢোকা অসম্ভব। তা হলে কি ভিতরেই কিছু পাজি লোক আছে?
গোপীনাথ বলল, আপনারা আমাদের ল্যাবরেটরিতে মনিটরিং রুমে ঢুকেছিলেন কী করে?
আমাদের লোক সর্বত্র আছে, আপনাকে আগেই বলেছি।
গোপীনাথ বলল, ঠিক আছে। এবার কাজের কথাটা বলুন।
প্রিন্ট আউটটা আমাদের চাই।
গোপীনাথ মৃদু স্বরে বলল, আপনি নিশ্চয়ই বোকা নন।
কেন বলুন তো!
আদ্রেঁর কাগজপত্রের বা কম্পিউটারের প্রিন্ট আউট পেলেই তো আর হবে না। প্রোজেক্টটা বিরাট, জটিল। অনেক সায়েন্টিস্ট কাজ করছে।
আপনি কো-অর্ডিনেটর, আপনি ভালই জানবেন কার কাছে কী আছে।
না মঁসিয়ে পল, আমিও জানি না। এত বড় প্রোজেক্ট যে, একজনের পক্ষে সব জানা বা মনে রাখা সম্ভব নয়। আমরা মাঝে মাঝে মিটিং করে নানা তথ্য বিনিময় করি। প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেকেরই কাজের ধরন আলাদা।
আমরা তা জানি মঁসিয়ে বোস। আমাদের সবচেয়ে বেশি জানা দরকার আপনাদের জ্বালানি সম্পর্কে। আপনারা কী জ্বালানি ব্যবহার করছেন মঁসিয়ে বোস?
দুঃখিত পল। আমার তা জানা নেই।
এ ব্যাপারে আদ্রেঁর কিছু অবদান আছে, তাই না?
হয়তো। কিন্তু আদ্রেঁকে খুন করে আপনারা হয়তো বিজ্ঞানের এক মস্ত সম্ভাবনাকেই নষ্ট করে দিলেন।
তাই কি মঁসিয়ে বোস?
তাই তো মনে হচ্ছে।
এই প্রথম পল যেন একটু দ্বিধায় পড়ল। একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, হতে পারে আদ্রেঁকে খুন করাটা এক মস্ত ভুল।
গোপীনাথ মৃদুস্বরে বলল, মস্ত, মস্ত, ভীষণ ভুল মঁসিয়ে পল। আপনারা উন্মাদের মতো কাজ করেছেন।
দয়া করে রাগ করবেন না। রেগে লাভ নেই।
গোপীনাথ ঠান্ডা গলায় বলল, রাগ করে লাভ নেই জানি। কিন্তু বোকামি আমার সহ্য হয়। আদ্রেঁকে হত্যা করার মতো বোকা লোককে আপনারা সহ্য করেন কী করে?
পল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে, নিশ্চিন্ত থাকুন।
কী শাস্তি?
আমাদের শাস্তি মোটামুটি একটাই। এলিমিনেশন।
গোপীনাথ একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। অন্তত একটা শয়তান তো নিকেশ হবে।
০৮.
সকালটি বেশ মনোরম। চারদিকে ঝলমল করছে রোদ। মনোজের অফিস ঘরেও বাইরের আলোর আভা আসছে। স্বাভাবিক আলো, স্বাভাবিক বাতাস মনোজের খুব প্রিয়। সে একটু প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। নিজের অফিসঘরে বসে সকালে সে প্রথমেই এক কাপ কালো কফি খায়। খুব শিথিল ভঙ্গিতে বসে। এ সময়টায় সে একা থাকতে ভালবাসে। কফি শেষ করে কাজ শুরু করে।
ব্যাবসায় একটা টেনশন থাকেই। মনোজ টেনশন ভালবাসে না। ব্যাবসা জিনিসটার প্রতি বরাবর তার একটা ভীতি আছে। ব্যাবসা একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। সে জার্মানিতে একটা মোটা মাইনের গবেষণাধর্মী চাকরি করত। খুব নিশ্চিন্ত ছিল তখন। বছরে একবার কি দু’বার ইউরোপে বা অন্য কোথাও বেড়াতে যেত। রোজমারির সেই বাঁধা জীবন ভাল লাগছিল না। তাকে টেনে নামাল ব্যাবসায়, প্রোডাকশনে। রোজমারি একটু অ্যাডভেঞ্চারাস টাইপের। তবে ব্যাবসাটা ইউরোপে করলে ভাল হত। নিজের দেশকে চেনে মনোজ, এখানে ব্যাবসা করতে গেলে পদে পদে বাধা। সস্তা শ্রমিক এবং ওভারহেড খরচ কম বলে এবং ভারতবর্ষের প্রতি একটা করুণামিশ্রিত ভালবাসা আছে বলে রোজমারি এদেশেই কারখানা করার গোঁ ধরেছিল। আর করেই ছাড়ল। কাজটা উচিত হয়েছে কি না তা মনোজ এখনও বুঝতে পারছে না। তবে মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি। বিদেশে যাওয়ার পর থেকেই এদেশের প্রতি তার একটা বিরূপতা জন্মেছিল। সেটা এখনও কাটেনি।
কফি শেষ হয়ে গেল। এখন অনেক কাজ। সোনালি এবং সুব্রতকে ডাকা দরকার। আজ কোনও মিটিং বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি না, অর্ডার এবং প্রোডাকশন সংক্রান্ত খোঁজখবর এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাদের এসময়ে কথা হয়।
মনোজ খানিকক্ষণ বসে রইল। চুপচাপ। ডেলিগেটরা ফিরে গেছে। আদ্রেঁর মৃতদেহ এতদিনে কবরস্থ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। শুধু একটা দাগ থেকে গেল। মুখে একটা তেতো স্বাদ।
মনোজ ইন্টারকম তুলে প্রথমে সুব্রতকে ডাকল।
গুড মর্নিং স্যার।
মর্নিং সুব্রত।
সুব্রত এমন একটি ছেলে যাকে দেখলেই ভাল লাগে। বেশ বাঙালি ধরনের সুপুরুষ। অনেকটা জমিদারদের মতো অভিজাত চেহারা। আসলে বোধহয় ওরা জমিদারই। এর পদবি রায়চৌধুরী। বয়স আঠাশ-উনত্রিশের মতো হতে পারে। বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা কিছু একটা আছে, যা মনোজ ভাল করে জানে না। এসব স্টাফ নিয়োগ করেছে রোজমারি নিজে দেখেশুনে। কোনও নির্বাচনই খারাপ বলে মনে হচ্ছে না মনোজের।
সুব্রত বসল। বলল, আজ তেমন গুরুতর কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই স্যার।
নেই?
না। ফিনান্স সেক্রেটারির সঙ্গে একটা মিটিং ছিল, কিন্তু তিনি জরুরি কাজে দিল্লি গেছেন।
মনোজ মৃদু হেসে বলল, আমি যে মিটিং অপছন্দ করি সেটা তুমি টের পেয়ে গেছ, না?
হ্যাঁ স্যার। মিটিংগুলো একটু বোরিং…