কিন্তু ভয় পেলে এবং বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে গেলে মূল্যবান সময়ের অপচয়। ভিকিজ মব-এর চেয়ে এক-দুই কদম এগিয়ে না থাকলে এতদিনের এত পরিশ্রম পণ্ড হবে।
গোপীনাথ দরজাটা ঝড়াক করে খুলে ফেলল। না, ডানধারেও কেউ নেই। যদি থাকেও তবে সে বা তারা নিশ্চয়ই গোপীনাথের সামনে বোকার মতো বুক চিতিয়ে হাজির হবে না। থাকলে তারা আড়ালে বাঘের মাসির মতো ওত পেতে অপেক্ষা করছে। যথাসময়ে ঘাড়ে এসে পড়বে। সুতরাং ভেবে লাভ কী?
গোপীনাথ নামবার সময়েও লিফট নিল না। দু’ধাপ করে সিঁড়ি দ্রুত পায়ে ভেঙে নীচে নামল। তার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। পচিশ-ত্রিশ বছর আগেকার ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনাসমূহও তার হুবহু মনে থাকে। সে কারও নাম একবার শুনলে আর ভোলে না। বিশেষ করে সংখ্যার ব্যাপারে তার স্মৃতি আরও তীক্ষ্ণ। ইলেকট্রনিক সুইচ বোর্ডটার কাছে গিয়ে সে মাত্র দু’সেকেন্ড ভাবল। আদ্রেঁ যে চারটে নম্বর টিপে দরজা খুলত সেটা ফটোগ্রাফের মতো তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সাত দুই তিন চার।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল গোপীনাথ। হাতে সময় বড্ড কম। দ্রুত পায়ে সে পাড়া ছাড়িয়ে ভিড়ের রাস্তায় চলে এল এবং ট্যাক্সি নিল। সারাদিন তাকে যথেষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়েছে, উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা তাড়া করেছে। তবু উত্তেজক পরিস্থিতিতেই সে ভাল থাকে। তার বোধ, বুদ্ধি, রিফ্লেক্স সবই যেন চনমনে হয়ে ওঠে।
ইতালিয়ান আধবুড়ো ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে দু’-একটা রসিকতাও করল। ল্যাবরেটরিতে পৌঁছে গেল রাত দশটার মধ্যেই।
সাক্কি ইনকরপোরেটেডের এই ল্যাবরেটরিটি বিশাল। চারদিকে উঁচু ঘের-পাঁচিল তো আছেই, তা ছাড়া আছে নানারকম ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি এবং বার্গলার অ্যালার্ম। সশস্ত্র প্রহরী এবং পাহারাদার কুকুর সারা এলাকা সর্বক্ষণ পাহারা দেয়।
ফটকে নিজের আইডি কার্ডটা যন্ত্রে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে হল তাকে। ছাড় পেয়ে দ্বিতীয় গাঁট। নিজের গাড়িতে এলে কথা ছিল না। কিন্তু ট্যাক্সি নিয়ে ভিতরে যাচ্ছে বলেই গার্ডরা এসে উকিঝুঁকি দিয়ে ভিতরটা দেখে নিল। আইডি কার্ড দেখল। তারপর বলল, ওকে
স্যার, ইউ মে এন্টার।
ট্যাক্সিটা ছেড়ে দ্রুত পায়ে গোপীনাথ ভিতরে ঢুকল। এসকালেটরে উঠে এল দোতলায়। আদ্রেঁর ঘর দোতলাতেই।
গোপীনাথ বৈদ্যুতিক সংকেতে দরজা খুলল, ঘরে ঢুকল এবং আলো জ্বালল। আদ্রেঁ অত্যন্ত গোছানো মানুষ। তার সবকিছুই খুব নিখুঁত ও পারস্পরিক। আদ্রেঁ যে চেয়ারটায় বসে কাজ করে সেটায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল গোপীনাথ, তারপর ধীরে ধীরে কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগল। কম্পিউটার চালু করে কিছুক্ষণ দেখল। প্রিন্ট আউট বের করল।
রাত ক্রমে গভীর হচ্ছে। সে অনেকক্ষণ কিছুই খায়নি। খিদে পাচ্ছে এবং দুর্বল লাগছে। কাজ শেষ করে অ্যাটাচি কেসে কাগজপত্র ভরে সে বেরিয়ে এল।
রিসেপশন থেকে ফোন করে একটা ট্যাক্সি আনাল সে। তারপর বেরিয়ে পড়ল। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে এসে সে প্রথমেই কালো কফি খেল। তারপর ফ্রিজ খুলে কিছু খাবার বের করে গরম করে গোগ্রাসে খেল।
খাওয়ার পর সে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ কলকাতায় সুব্রতকে ফোন করল।
সুব্রত, গোপীদা বলছি। কী খবর?
গোপীদা, খবর খারাপ। আদ্রেঁ মারা গেছে।
অ্যাজ এক্সপেক্টেড। ডেডবডি?
ওরা আজই নিয়ে যাচ্ছে।
ভাল। অটোপসিটা এখানে হলেই ভাল হয়।
অটোপসি হবে কেন গোপীদা? ডাক্তাররা তো হার্ট অ্যাটাক বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে।
কারণ আছে বলেই হবে। ক্রিমিন্যাল সায়েন্সও অনেক এগিয়ে গেছে, বুঝলি? আর কী খবর?
আপনি কি জানেন যে, ইন্টারপোলের একজন বাঙালি এজেন্ট এসে হাজির হয়েছে?
না তো। কেন?
শুনছি সে নানারকম এনকোয়ারি করছে।
ইন্টারপোলের ইন্টারেস্ট কী?
বউদি আমাকে বলেছেন, ব্যাপারটা আপনাকে জানাতে।
গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, সোনালিকে তুই এখনও বউদি বলে ডাকিস নাকি?
আরে না। আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?
কী বলে ডাকিস?
দিদি। সোনালিদি।
সোনালি হঠাৎ ইনফর্মেশনটা আমাকে দিতে বলল কেন? সে তো আমার নাম শুনতেও পারে না।
বোধহয় সিচুয়েশনটা ঘোরালো বলেই বলেছেন।
কী বলেছে?
লোকটার নাম সুধাকর দত্ত, ইন্টারপোল এজেন্ট। সাক্কি ইনকরপোরেটেড সম্পর্কে খুব ইন্টারেস্ট।
সাক্কি সম্পর্কে আজকাল সকলেরই ইন্টারেস্ট দেখা যাচ্ছে।
কী ব্যাপার গোপীদা?
তা জানি না। তবে চারদিকে বেশ একটা তৎপরতা শুরু হয়েছে। শোন সুব্রত, লোকটা সম্পর্কে ভাল করে খোঁজ নে। চেহারার বিবরণ এবং আর যা কিছু।
বউদির সঙ্গে লোকটার আলাপ হয়েছে। লম্বা প্রায় ছ’ফুট। বেশ ভাল পেটানো স্বাস্থ্য। গলার স্বর খুবই ভাল। হ্যান্ডসাম। প্যারিসে হেড কোয়ার্টার। এতে হবে?
ওর আইডেন্টিটি কার্ড কি সোনালি দেখেছে?
না বোধহয়। তবে আমাদের অফিসে চেক করা হয়েছে বোধহয়। মিস্টার সেন তো কাঁচা লোক নন।
গোপীনাথ একটু হাসল। বলল, এ যুগটা অত্যন্ত বুদ্ধিমানদের যুগ। বুঝলি? ক্ষুরধার বুদ্ধি ছাড়া এই কম্পিটিটিভ এজ-এ কিছু করা খুব কঠিন। মনোজের সেই বুদ্ধি নেই।
কিন্তু আপনি তো ওঁকে চেনেন না গোপীদা।
না। ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু অনুমান করতে পারি। সিম্পল ডিডাকশন।
মেমসাহেব কিন্তু বুদ্ধিমতী।
রোজমারি সম্পর্কে আমার কোনও রিজার্ভেশন নেই। রোজ সত্যিই বুদ্ধিমতী। কিন্তু ওর একটা অতীত আছে। সেইটেই বিপজ্জনক।