গোপীনাথ আদ্রেঁর ফ্ল্যাট চেনে, বেশ কয়েকবার এসেছে। আদ্রেঁ একা বলেই বোধহয় মাঝে মাঝে পার্টি দিত। ইতালির বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য আর্টিস্টের সঙ্গে তার ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। তারাও এসেছে।
গোপীনাথ দু’বার ট্যাক্সি বদল করে যখন আদ্রেঁর ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে পৌঁছোল তখন শহরতলির অভিজাত পাড়াটি নির্জন। রাত আটটা বাজে। সময়টা চৌর্যবৃত্তির পক্ষে প্রশস্ত নয়। কিন্তু গোপীনাথের হাতে আর সময় নেই। যা করার এখনই করতে হবে।
এইসব ফ্ল্যাটবাড়িতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া ঢোকা বেশ শক্ত। প্লেক্সি গ্লাসের শক্ত পাল্লা ইলেকট্রনিক সংকেত ছাড়া খোলে না। দরজার বাইরে একটা ইলেকট্রনিক বোর্ড আছে। তাতে বাসিন্দাদের নামের কার্ড লাগানো। পাশে বোতাম। যার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে তার নামের বোম টিপলে সে ওপর থেকে আর একটা বোতাম টিপে দেয়। একমাত্র তখনই দরজা খোলে। গোপীনাথ দরজাটা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
প্রায় পনেরো মিনিট বাদে একজন লম্বাচওড়া লোককে দরজার কাছে যেতে দেখে গোপীনাথ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। লোকটা ভিজিটর। একটা বোতাম টিপে অপেক্ষা করতে লাগল। গোপীনাথও একটা বোতামে আঙুল ছোঁয়াল, কিন্তু টিপল না। লোকটা যাতে বুঝতে না পারে যে সে ফাঁকতালে ঢোকার মতলব করছে।
কাঁচের দরজা খুলে যেতেই সে লোকটার পিছু পিছু ঢুকে পড়ল ভিতরে। লোকটা তাকে বিশেষ গ্রাহ্য করল না। একটু মাল খেয়ে আছে, বোঝা যাচ্ছিল। গিয়ে লিফটের কাছে দাঁড়াল।
আদ্রেঁ তিনতলায় থাকে। গোপীনাথ এলিভেটর নিল না। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল ওপরে। অ্যাটাচি কেসটা খুলে একটা সরু শিকের মতো জিনিস বের করল সে। তারপর দ্রুত হাতে তালাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। উত্তেজনায় তার কপালে ঘাম ফুটতে লাগল। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে চেষ্টা করল সে। কঠিন দরজা অনড় রইল। যতদুর মনে হচ্ছে আদ্রেঁ কোনও বার্গলার অ্যালার্ম লাগিয়ে যায়নি। তা হলে এতক্ষণে গার্ডরা ছুটে আসত।
লম্বা প্যাসেজ দিয়ে দুটো লোক হেঁটে আসছিল। নিঃশব্দে। গোপীনাথ একটু শক্ত হয়ে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে নিজের টাইয়ের নটটা একটু ঠিকঠাক করে নিতে লাগল। যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি। লোকদুটো যখন তার কাছাকাছি চলে এসেছে তখন গোপীনাথ দুটো হাত মুঠো করে রইল। এরা ভিকির লোক হতে পারে কিংবা নিরীহ সজ্জন।
লোকদুটো দাঁড়াল না। তাকে পেরিয়ে গেল। গিয়ে থামল এলিভেটরের সামনে। এক মিনিট পর তারা লিফটে উঠে যেতেই আবার কাজ শুরু করে দিল গোপীনাথ। বিস্ময়ের কথা, দ্বিতীয়বার প্রায় বিনা ভূমিকায় দরজা খুলে গেল।
ভিতরটা অন্ধকার। দরজাটা বন্ধ করে আলো জ্বালল গোপীনাথ। আদ্রেঁ একা থাকলেও খুব গোছানো লোক। ফ্ল্যাটটা বিশাল বড়। অন্তত তিন হাজার স্কোয়ার ফুট। ঢুকতেই হলঘর। এক ধারে বসবার জায়গা। অন্য ধারে একটা লাইব্রেরির মতো। দুটো মস্ত শোয়ার ঘরের মধ্যে একটা হল আদ্রেঁর কাজের ঘর। অন্তত গোটা পাঁচেক কম্পিউটার সাজানো রয়েছে চারধারে। একটা ল্যাপটপ কম্পিউটারও রয়েছে বাড়তির মধ্যে। একটা ওয়ার্কিং টেবিলে নানা ধরনের মডেল। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড দেয়ালে শাগলের একখানা ওরিজিন্যাল পেইন্টিং ঝুলছে। আদ্রেঁ ছবি-পাগল লোক ছিল। বিজ্ঞানী না হলে হত অবশ্যই একজন আর্টিস্ট।
ডেবুকটা বাইরে কোথাও পড়ে নেই। টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলে খুলে দেখল গোপীনাথ। কখনও কাজের জিনিসটা সহজে পাওয়া যায় না।
পাশের শোয়ার ঘরে গিয়ে গোপীনাথ দেখতে পেল, বিশাল রাজকীয় একখানা খাট ও বিছানা। আদ্রেঁ একটু বিলাসবহুল জীবন কাটাতে ভালবাসত। ভালবাসত একা থাকতে। অনেকে সন্দেহ করে আদ্রেঁ হোমোসেক্সয়াল। গোপীনাথ অবশ্য ততটা ভাল করে জানে না। শুনেছে, এই পর্যন্ত। আদ্রেঁ আর যাই হোক, ছিল অসম্ভব কাজপাগলা।
শোয়ার ঘরে খুঁজতে খুঁজতেও হয়রান হল সে৷ কোথায় রাখতে পারে ডে-বুকটা? গোপীনাথ অবশেষে বাথরুমে হানা দিল। বাথরুমটাও রাজকীয়। কোনও আধুনিক গ্যাজেট বাদ নেই।
বাথরুমে থাকার কথা নয়। তবু বাথরুমেই পেয়ে গেল ডায়েরিটা গোপীনাথ। একটা টেনশনমুক্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেখল, ডে-বুকের প্রথম পৃষ্ঠাতেই তার দরজা খোলার কোডটা লেখা রয়েছে। আদ্রেঁ কোড পালটাত না। তার স্বভাব একটু একবগগা। পরিবর্তন জিনিসটা সে পছন্দ করত না।
ডায়েরিটা অম্লানবদনে অ্যাটাচি কেসে ভরে বাতি নিভিয়ে দরজার সামনে একটু অপেক্ষা করল গোপীনাথ। আদ্রেঁ কি মারা গেছে?
সে ফের বাতি জ্বালাল এবং টেলিফোনের সামনে এসে বসে একটা নম্বর ডায়াল করল।
ও পাশ থেকে একটা পুরুষ গলা বলে উঠল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়।
আমি রোম থেকে বলছি। সুব্রত রায় কি আছেন?
না। উনি অফিসের বাইরে।
আমি একটা ইনফর্মেশন চাই। রিগার্ডিং আদ্রেঁ। ডেলিগেটদের একজন।
হ্যাঁ, উনি আজ মারা গেছেন সকাল এগারোটায়।
টেলিফোনের ওপরে গোপীনাথের মুঠো শক্ত হয়ে গেল। সে ঠান্ডা গলাতেই বলল, ডেডবডি কি নিয়ে আসা হচ্ছে?
হ্যাঁ। আজ রাতের ফ্লাইটে।
টেলিফোনটা রেখে গোপীনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল।
০৭.
দরজাটা খুব সাবধানে চুল পরিমাণ ফাঁক করল গোপীনাথ। নিবিষ্ট চোখে করিডরটা দেখল। ফাঁক দিয়ে শুধু বাঁ দিকের করিডরটাই দেখা যায়। ডান দিকেরটা দেখতে হলে মুন্ডু বের করতে হবে।