সুধাকর সামান্য অপ্রতিভ মুখ করে বলল, আপনাদের বিরক্ত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার ছিল না। অবস্থা এবং পরিস্থিতি আমাদের কিছু অসুবিধের মধ্যে ফেলেছে বলেই
ডোরিনের গাড়ির চাকা কীভাবে পাংচার হল হের দত্ত? আর আপনিই বা তা কী করে জানলেন দয়া করে বলবেন কি?
সুধাকর খুবই লজ্জিত মুখ করে বলল, সামান্য একটু হাতের কাজ। ওটাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন না ফ্রাউ ঘোষ। তার চেয়ে চলুন, আজ আপনার সঙ্গে আমিও খানিকক্ষণ জগিং করি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
এটা অনুরোধ না আদেশ? নাকি প্রচ্ছন্ন হুমকি?
ছিঃ ছিঃ, কী যে বলেন! আপনার সঙ্গে জগিং করতে পারাটা আমি সৌভাগ্য বলেই বিবেচনা করব।
ক্ষতি কী? বলে রোজমারি নামল। গাড়ি লক করে বলল, চলুন হের দত্ত। আমি প্রস্তুত।
দু’জনে পাশাপাশি ধীরগতিতে দৌড়োতে লাগল। ঘাসে শিশির পড়েছে। শিশিরের জল ছিটকে উঠে তাদের মোজা ভিজিয়ে দিচ্ছিল।
রোজমারি বলল, আপনি কি জানেন গতকাল আমাকে কে এক গোছা রক্তগোলাপ পাঠিয়েছিল?
রক্তগোলাপ?
হ্যাঁ, হ্যাপি বার্থ ডে জানিয়ে। কিন্তু গতকাল আমার জন্মদিন ছিল না।
কেউ ভুল করে পাঠিয়েছিল বলছেন?
মোটেই না। কার্ডের অন্য পিঠে লেখা ছিল আর আই পি। তার একটা ব্যাখ্যা ফ্লোরিস্ট দিয়েছে। জনৈক রজার আইভ্যান পোলক নাকি ফুল পাঠিয়েছে। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ বাজে কথা। আর আই পি মানে রেস্ট ইন পিস। আমাকে কেউ হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
সুধাকরের ছোটার গতি কমল না। সে একটু বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।
আমি জানতে চাই কে কী কারণে আমাকে খুন করতে চায়? আমি তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি হের দত্ত।
না, জ্ঞানত করেননি। তবু কারও কায়েমি স্বার্থে হয়তো না জেনে আঘাত করেছেন। আমি অনেক ভেবেও সেরকম কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। আপনিই বলুন, আমি কার কায়েমি স্বার্থে আঘাত করতে পারি?
সুধাকর মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি না।
আপনার রহস্যময় আগমনটাও আমার ভালো লাগছেনা হেরদত্ত। আপনার ক্রেডেনশিয়ালস হয়তো সবই ঠিকঠাক আছে, কিন্তু আমি জানি পাসপোর্ট থেকে আইডেন্টিটি কার্ড সবই নকল করা যায়। আপনি আসল না নকল তা কে বলবে?
ফ্রাউ ঘোষ, আপনার সন্দেহ অমূলক নয়।
তা হলে কি আমার অনুমান নির্ভুল?
তাও বলছি না। তবে আপনি যে পরিস্থিতিতে আছেন তাতে এরকম সন্দেহ হতেই পারে।
আদ্রেঁর অসুস্থ হয়ে পড়াটাও মোটেই স্বাভাবিক ব্যাপার নয় হের দত্ত।
মানছি। উনি অসুস্থ হননি।
তা হলে?
ওঁকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে।
সে কী?
বলে থমকে দাঁড়ায় রোজমারি।
দাঁড়াবেন না ফ্রাউ। দয়া করে দৌড়োতে থাকুন। এবং দয়া করে পিছনে তাকাবেন না।
কেন হের দত্ত?
সুধাকর একটু চাপা জরুরি গলায় বলল, প্রশ্ন করবেন না ফ্রাউ। শুধু স্বাভাবিক গতিতে দৌড়াতে থাকুন। ভয় পাবেন না।
কিন্তু রোজমারি ভয় পাচ্ছিল। বেশি দৌড়োয়নি সে, তবু হাঁফ ধরে যাচ্ছিল তার। বুকটাও দুরুদুরু করছে। সে হাঁফসানো গলায় বলল, কেউ কি আমাদের পিছু নিয়েছে?
হা ফ্রাউ। পিছু ফিরে না তাকালে আপাতত ভয় নেই।
রোজমারির পা ইতিমধ্যেই ভারী হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে সে এবার পড়ে যাবে। শুধু মনের জোরে দৌড়োতে দৌড়োতে সে বলল, ওরা কারা?
আমি সবজান্তা নই ফ্রাউ। তবে আমরা এক বিপজ্জনক পৃথিবীতে বাস করি।
আচমকাই পিছনে একটা শব্দ হল। চাপা শিস দেওয়ার মতো শব্দ। মানুষের শিস নয়, ধাতব শিস। যেন কোনও উচ্চশক্তিসম্পন্ন রাইফেল বা পিস্তলের সাইলেন্সর লাগানো শব্দ। তারপরই একটা আর্তনাদ।
পিছনে তাকাবেন না। দৌড়োন।
কেউ কি কাউকে গুলি করল?
পৃথিবীতে কত ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে, সবটা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী আমাদের? আমাদের সামনে এখন একটাই কাজ। দৌড়োনো এবং স্বাস্থ্যরক্ষা।
হের দত্ত, আপনি এত নির্বিকার কেন? ঘটনাটায় কি আপনার কোনও হাত নেই?
আমি নিমিত্ত মাত্র।
আমি গীতা পড়েছি। কথাটা গীতা থেকে বললেন?
আপনি যে মহাভারত পড়ছেন তাও আমি জানি।
কী সর্বনাশ। আপনি আমার সম্পর্কে আর কী জানেন?
একটা মানুষ সম্পর্কে জানার কি শেষ আছে?
সেটা ঠিক কথা। কিন্তু আমি এমনই একজন সাধারণ মানুষ যার সম্পর্কে জানাটাও বাহুল্য মাত্র। আমার সম্পর্কে জেনে কী হবে হের দত্ত?
আপনি একজন ছোট ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট বলে বলছেন?
ঠিক তাই। আমি একটা প্রোজেক্ট দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি মাত্র।
কিন্তু আপনি যতটা নিরীহ নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করেন বলে মনে হয়, আসল ঘটনা হয়তো তা নয়।
আপনি যে কী বলছেন হের দত্ত, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
ফ্রাই, আপনাকে তা হলে সোজাসুজি একটা প্রশ্ন করি। দয়া করে বলবেন কি যে আপনি জেনেশুনে জো ক্লাইনের মতো একজন খুনিকে কেন বিয়ে করেছিলেন?
রোজমারি একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, জো ক্লাইন কি খুনি?
আপনি তা ভালই জানেন। ভিয়েনার এক হোটেলে আপনার সামনেই সে গডার্ড নামে একজন ইংলিশ এজেন্টকে খুন করেছিল। আপনি তখন তার সঙ্গে ছিলেন।
ঘটনাটা ওভাবে ঘটেনি।
কীভাবে ঘটেছিল?
আমরা একটা কনসার্টের পর ঘরে ঢুকে দেখি, একটা লোক আমাদের জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করছে। জো তাকে চ্যালেঞ্জ করতেই লোকটা একটা পিস্তল বের করেছিল। তখন জো তাকে গুলি করে।
সুধাকর একটু হাসল, বেশ বললেন। লোকটা পিস্তল বের করার পর জো ক্লাইনও তার পিস্তল বের করল এবং গুলি করল এবং লোকটা ততক্ষণ পিস্তল নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল? এরকমও হয় নাকি?