আজও রোজমারি একা। ভোর সাড়ে চারটের আবছা আলোয় প্রেতপুরীর মতো ফাঁকা কলকাতার পথ। রোজমারির একটু অস্বস্তি হচ্ছে। গতকাল অনেকগুলো অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটে গেছে। তাকে কেউ ভুল করে বা ইচ্ছে করে লাল গোলাপ পাঠিয়েছে। না, ভুল করে নয় মোটেই। ইচ্ছে করেই। কারণ, ফ্লোরিস্টকে ফোন করে লাঞ্চ টেবিলের জন্য রজনীগন্ধার বদলে লাল গোলাপ পাঠাতে বলাটা তো আর ভুল করে করা নয়। তার ওপর ডেলিগেটদের একজনের অসুস্থ হওয়া এবং ইন্টারপোলের এক এজেন্টের আগমন, সবটাই একটা জিগস পাজলের মতো।
ময়দানে রোজমারি একা নয়। এখানে তার এক বান্ধবী জুটেছে। ডোরিন। ডোরিন জার্মান মেয়ে, বিয়ে করেছে মার্কিন কনসুলেটের এক অফিসারকে। সেই সুবাদে ডোরিন কলকাতায় থাকে এবং রোজ সকালে জগিং করতে ময়দানে আসে। ভিক্টোরিয়ার মূল ফটকের উলটো দিকে তাদের গাড়ি পার্ক করা হয়। দু’জনে একসঙ্গে হয়ে দৌড়োয়।
গাড়িটা পার্ক করল রোজমারি। ডোরিনের গাড়ি এখনও আসেনি। রোজমারি চুপ করে গাড়িতে বসে রইল। চারদিকে কুয়াশার আস্তরণ। একটু আবছা পথঘাট। লোকজন বেড়াতে বেরিয়েছে। কয়েকজন দৌড়োচ্ছেও। এত ভোরেও জায়গাটা নির্জন নয়। কলকাতার মতো ভিড়াক্রান্ত শহর রোজমারি দেখেনি। এত ভিড় তার ভাল লাগে না। কিন্তু আজ এই ভোরে চারদিকে লোকজন দেখে, কেন কে জানে, রোজমারির বেশ ভাল লাগছিল।
রোজমারি ঘড়ি দেখল। ডোরিন আজ একটু বেশি দেরি করছে কি? এ সময়ে তো রোজই এসে যায়।
গাড়ির সব কাঁচ তোলা থাকে রোজমারির। ভিতরে এয়ার কন্ডিশনার চলে। কলকাতার দূষিত বায়ুকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে সে। হঠাৎ ডানধারের কাঁচে টুক টুক করে দুটো টোকা পড়তেই রোজমারি একটু চমকে উঠল। চেয়ে দেখল, একজন বেশ লম্বাচওড়া লোক দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে সাদা স্পোর্টস গেঞ্জি এবং পরনে শর্টস।
রোজমারি কাচটা নামিয়ে প্রশ্নভরা চোখে তাকাতেই লোকটা পরিষ্কার জার্মান ভাষায় বলল, সুপ্রভাত।
সুপ্রভাত। কী চাই?
লোকটা জার্মান নয়, চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। লম্বাচওড়া হলেও লোকটাকে তার বাঙালি বলেই মনেই হল। তবে জার্মানটা মাতৃভাষার মতোই বলতে পারে।
লোকটা বলল, আপনার কি আর একটু সতর্ক হওয়া উচিত নয়?
রোজমারি অবাক হয়ে বলল, আপনি কে?
আমার নাম সুধাকর দত্ত।
ও, আপনি সেই ইন্টারপোলের এজেন্ট?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এখানে কী করছেন?
আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
আমার জন্য? কেন বলুন তো!
আপনার নিরাপত্তার জন্য।
আমার নিরাপত্তার অভাব ঘটেছে নাকি?
লোকটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তা জানি না। তবে সাবধান হওয়া ভাল।
আপনি আমার সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বাংলাতেও কথা বলতে পারেন।
আপনি যে বাংলা ভালই জানেন সে খবর আমি রাখি। তবু জার্মান ভাষায় কথা বলাটাই এখন নিরাপদ। হয়তো বাতাসেরও কান আছে। আপনার সঙ্গে আমার দু’-একটা কথা ছিল।
কথা তো অফিসেও বলতে পারতেন।
সুধাকর মৃদু হেসে বলল, কেন ময়দান জায়গাটাই বা মন্দ কী? এত সুন্দর সকাল, এমন খোলা মাঠ।
রোজমারি ঠোঁট উলটে বলল, কী এমন কথা?
কথাটা আপনার অতীত নিয়ে।
আমার অতীত? সে আবার কী?
জোসেফ ক্লাইন নামটা কি আপনার চেনা ঠেকছে?
জো ক্লাইন আমার প্রাক্তন স্বামী। কেন?
মুশকিল কী জানেন? আমার এই মিশনটাই যেন প্রাক্তন স্বামীদের নিয়ে। কালকেও আর একজনের প্রাক্তন স্বামীকে নিয়ে নাড়াঘাটা করতে হল। জো ক্লাইন সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন ফ্রাউ ঘোষ?
অনেক কিছুই জানি। আমরা এখনও বেশ বন্ধু।
জো ক্লাইনের সঙ্গে আপনার শেষ যোগাযোগ কবে হয়েছে?
যোগাযোগ? না, গত এক বছরের মধ্যে নয়।
তার মানে আপনি তার গতিবিধির খবর রাখেন না?
না।
গত জুলাই মাসে প্যারিসে একজন পুলিশের গোয়েন্দা খুন হন।
রোজমারি চেয়ে ছিল। বলল, এ খবরটায় আমার কী হবে?
দত্ত মাথা নেড়ে বলল, কিছু না, কিছু না। খবরটা আপনি উপেক্ষা করতে পারেন।
তবে বললেন কেন?
এই গোয়েন্দাটি একটি বিশেষ তদন্তে কাজ করছিল।
তাতে আমার কী?
সাক্কি ইনকরপোরেটেডের ব্যাপারে।
ও। কিন্তু তাতেই বা আমার কী যায়-আসে। সাক্কির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা নিতান্তই ব্যবসায়িক।
কিন্তু এই গোয়েন্দা খুনের ব্যাপারে যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের নামের একটা তালিকা আমি দেখেছি।
বেশ তো।
তালিকাটায় অন্তত পাঁচজনের নাম আছে। একদিন সন্ধেবেলা প্যারিসের এক কুখ্যাত গলির মধ্যে খুনটা হয়। অত্যন্ত পেশাদার কাজ। খুনিরা কোনও চিহ্ন ফেলে যায়নি।
এসব কথা কেন আমাকে বলছেন হের দত্ত?
সুধাকর যেন খানিকটা লজ্জিত হয়ে বলল, তাই তো! কেন যে বলছি।
রোজমারি ঘড়ি দেখে আপনমনে বলল, ডোরিন যে কেন আসছে না।
সুধাকর দত্ত অত্যন্ত নিরীহভাবে বলল, আসতে একটু দেরি হবে। ফ্ল্যাট টায়ার পালটাতে একটু সময় তো লাগবেই।
ফ্ল্যাট টায়ার? সেটা আপনি জানলেন কী করে?
আমাকে অনেক কিছুই জানতে হয়।
রোজমারি একটু বিরক্ত ও বিস্মিত হয়ে সুধাকরের দিকে চেয়ে থেকে বলল, তাই নাকি হের দত্ত? কিন্তু আমি জানতে চাই দুনিয়ায় এত লোক থাকতে আপনি কেন আমাদের পিছনে লেগেছেন? আমি এবং আমার স্বামী একটা ছোট কারখানা চালাই, কোনও বিপজ্জনক কাজ করি না, আমরা এ দেশে কিছু বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগও করিয়েছি এবং আমরা বিদেশি মুদ্রা আয়ও করি। তবু কেন আপনি বা আপনারা আমাদের বিরক্ত করছেন?