সেটা আমার জানার কথা নয়। আপনার জানার কথা। আর আমরা আপনার কাছ থেকেই জানতে চাই।
ভিকিজ মব কি বিজ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া করে মঁসিয়ে পল?
আজ্ঞে না। আমরা আর একজনের হয়ে কাজ করছি মাত্র।
সেই আর একজন কে?
আপনার পক্ষে সেটা জানা অস্বাস্থ্যকর হতে পারে।
আপনি আমার স্বাস্থ্য নিয়ে খুবই চিন্তিত দেখছি।
আজ্ঞে হ্যাঁ, খুবই চিন্তিত। কারণ আপনার সহকারী এক গবেষক ইতিমধ্যেই খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি এখন কলকাতার এক বড় ক্লিনিকে শয্যাশায়ী। নাও বাঁচতে পারেন।
সচকিত হয়ে বোস এই প্রথম উত্তেজিত গলায় বলল, কে? কার কথা বলছেন?
আপনার প্রিয় আদ্রেঁ।
আদ্রেঁ! তার কী হয়েছে?
উনি সকালে কফির সঙ্গে সামান্য একটু বিলম্বিত ক্রিয়ায় বিষ পান করেছেন।
সর্বনাশ!
সেইজন্যই আপনার স্বাস্থ্য বিষয়েও আমরা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন মঁসিয়ে বোস।
বোস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজেকে সামলাল। তারপর শান্ত গলায় বলল, আদ্রেঁকে কি আপনারা খুন করলেন?
ওভাবে বললে আমরা একটু বিব্রত বোধ করি। তবে স্বীকার করতে বাধা নেই, কাজটায় আমাদের একজন এজেন্টের হাত ছিল।
আদ্রেঁর অপরাধ কী?
উনি একজনকে চিনতে পেরেছিলেন। এর বেশি আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
আদ্রেঁ কি বেঁচে আছে?
মস্তিষ্কের মৃত্যু বলে ডাক্তারি শাস্ত্রের একটা কথা আছে না?
আছে।
প্রিয় মঁসিয়ে বোস, আদ্রেঁ বেঁচে থেকেও বেঁচে নেই।
আপনারা খুবই ভয়ংকর লোক।
পল একটু হাসল। বলল, আমাদের মৃত্যু-শিল্পীও বলতে পারেন। আমরা মোটা দাগের উগ্রবাদীদের মতো দুমদাম বোমা-বন্দুক ব্যবহার করি না, নিতান্ত প্রয়োজন না হলে। অপ্রয়োজনে নিরীহ মানুষকেও মারি না। আমরা শিল্পসম্মত এবং অনাটকীয়ভাবে কাজ করতে ভালবাসি।
কিন্তু আপনারা কি জানেন যে আদ্রেঁ মারা গেলে আমাদের গবেষণা আটকে যাবে এবং এই শেষ পর্যায়ের কাজ আরও বহুদিন পিছিয়ে যাবে?
না মঁসিয়ে বোস, আমার তা জানার কথা নয়। তবে আরে না মরে কোনও উপায় ছিল। অপারগ না হলে আমরা কাউকে মারি না।
আপনারা পিশাচ।
যা ঘটে গেছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না মঁসিয়ে রোস। ওটা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়।
দুঃখিত মঁসিয়ে পল, আপনার প্রস্তাব আমি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলাম। ভিকিজ মব যা খুশি করতে পারে, আমি পরোয়া করি না। শুভ রাত্রি।
বলেই বোস ফোনটা রেখে দিল। এবং পরমুহূর্তেই তুলে কলকাতার একটা নম্বর ডায়াল করল। অনেকক্ষণ রিং বেজে যাওয়ার পর একটা ঘুমকাতর পুরুষের গলা বলে উঠল, হ্যালো।
সুব্রত, আমি গোপীদা বলছি, প্যারিস থেকে।
আরে বলুন গোপীদা, কী খবর?
খবর তুমিই দেবে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের ব্যাপারে যে দলটা গিয়েছিল তাতে একজন ছিল আদ্রেঁ। তার খবর কী?
স্যাড কেস গোপীদা, উনি খুব অসুস্থ।
বেঁচে আছে?
কাল রাত বারোটা অবধি উডল্যান্ডসে ছিলাম। তখন অবস্থা ভাল ছিল না। এখন সকাল সাড়ে সাতটা। একটা ফোন করে দেখব?
দেখো। কিংবা আমাকে নম্বরটা দাও। আমি ফোন করছি।
নম্বরটা টুকে নিয়ে ফের ডায়াল করল গোপীনাথ বসু। যা খবর পেল তা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। আদ্রেঁর বাঁচার কোনও আশাই নেই।
ফোন রেখে গোপীনাথ ঘরের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করল। তারপর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চেয়ে রইল। কাকে চিনতে পেরেছিল আদ্রেঁ?
বাকি রাতটা আর ঘুম হবে না তার। মাথাটা গরম, আর বুকটা অন্ধকার। আদ্রেঁ তরুণ যুবা নয়, পঞ্চান্ন বছরের মধ্যবয়সি মানুষ। বুদ্ধিমান, সংযতবাক, খুবই কর্মঠ মানুষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করেছে। অভিজ্ঞতাও অনেক। সাক্কি ইনকরপোরেটেডে তাকে নিয়ে এসেছিল গোপীনাথ নিজেই। আদ্রেঁর মৃত্যুর জন্য কি সে-ই দায়ী থাকবে?
গোপীনাথ ঘরের এক কোণে একটা চেয়ারে বসে ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর হঠাৎ খেয়াল হতেই টেলিফোন ডিরেক্টরি খুলে একটা দৈনিক কাগজের অফিসে ফোন করল।
আপনারা কি আমাকে ভিকিজ মব সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেন?
আপনি একটু লাইনটা ধরুন। একজন মহিলার কণ্ঠ বলল।
কিছুক্ষণ পর ফোনে মহিলা বললেন, ভিকি একজন দক্ষিণ আমেরিকার লোক। বেস ছিল ব্রাজিলে। দশ বছর আগে তার একবার জেল হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সে পালায়, ভিকি পেশাদার অপরাধী। সারা পৃথিবীতে তার অপারেটররা কাজ করে। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রী দেশগুলির হয়ে সে অনেক কিছু করেছে। এক সময়ে তার প্রধান কাজ ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে যেসব মগজওলা লোক পালিয়ে যায়, যেমন বৈজ্ঞানিক, গবেষক, লেখক, গায়ক বা শিল্পী, তাদের ধরে আনা বা খতম করা। এ কাজে সে মোটা টাকা নিত।
এখন সে কোথায় থাকে?
সে এক জায়গায় থাকে না।
ধন্যবাদ। প্যারিসে তার এজেন্ট কে আছে জানেন?
দাতা।
দাতা? পুরো নাম কী?
এস দাতা।
তার সঙ্গে যোগাযোগ কীভাবে হতে পারে।
তা জানি না। আন্ডারওয়ার্ল্ড জানে। প্যারিসের গুন্ডা বদমাশরা জানবে।
এরকম কারও খোঁজ দিতে পারেন। আমার প্রয়োজনটা জরুরি।
লাইনটা ধরুন, দেখছি।
কিছুক্ষণ পর মেয়েটি বলল, দুঃখিত। আমাদের যে রিপোর্টার এসব জানে সে এখন নেই।
ধন্যবাদ।
টেলিফোনটা রেখে দিল গোপীনাথ। কিন্তু রাখতেই টেলিফোনটা তারস্বরে বেজে উঠল।
গোপীনাথ ফোনটা তুলে নিল।
০৫.
খুব ভোরবেলা রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকে বলে রোজমারি এ সময়টায় নিজেই গাড়ি চালায়। গাড়ি চালিয়ে সে আসে ময়দানে। ভোরের ময়দানের মতো সুন্দর জায়গা কলকাতায় নেই। রোজমারির পরনে থাকে শর্টস, গায়ে কখনও কামিজ, কখনও টি-শার্ট, পায়ে দৌড়োনোর জুতো। সকালে খানিকটা দৌড় এবং খানিকটা জগিং করার পর সে কয়েকটা বেন্ডিং করে। তারপর বাড়ি ফেরে। এই সময়টায় সে কোনও সঙ্গী পায় না। তার স্বামীর শরীরবোধ কম, ব্যায়ামট্যায়ামের ব্যাপারে কোনও আগ্রহ নেই। সকালে ঘুম থেকে তাকে তোলাই মুশকিল। রোজমারিকে তাই একাই আসতে হয়।