পাপ কখনও গোপন থাকে না। ফুটে বেরোবেই। আর সেই কারণেই সমীরণ কখনও কিছু লুকোছাপা করে না। তার জীবন হল খোলা বই। এই যে শোয়ার ঘরে জুলেখা শুয়ে আছে, একটু বাদেই ঠিকে ঝি নবর মা এসে ওকে দেখবে। গত দশবারো দিন ধরে দেখছেও। এখন যদি হুট করে ক্ষণিকা চলে আসে, তা হলে সে-ও দেখবে। না দেখলেও ক্ষণিকা জানতে পারবে ঠিকই, তারপর অনেক অশাস্তি হবে। সব জানে সমীরণ, তবু কিছুই লুকোয় না।
হাই।
সমীরণ একটু চমকে গিয়েছিল। হাতের কাপ থেকে চলকে একটু চা পড়ল হাঁটুতে। ছ্যাক।
হাই। ঘুম ভাঙল?
ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে মস্ত একটা হাই তুলল জুলেখা। ছোটখাটো শ্যামলা, ছিপছিপে মেয়েটি চোখে পড়ার মতো নয়। তবে চলাফেরায় একটা বেড়ালের মতো চকিত তৎপরতা আছে। একটা ফিরিঙ্গি স্কুলে ও ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর। ইউপির মেয়ে, কলকাতায় জন্ম-কর্ম। আর বিশেষ কিছুই জানা নেই সমীরণের। জানার অনেক ল্যাঠা।
জুলেখা আর-একটা হাই তুলে বলল, ইটস বোরিং।
হোয়াট ইজ বোরিং?
এভরিথিং।
সমীরণ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ঠিক কথা। জীবনটাই ভারী একঘেয়ে। নাথিং হ্যাপেনস। সোমবার ঠিক মঙ্গলবারের মতো, মঙ্গলবার ঠিক বুধবারের মতো, অ্যান্ড সো
অন।
চা খাব।
খাও। জল গরম করা আছে।
তোমার ফোন বাজছে। ধরো।
জ্বালালে।
চলে গিয়ে ফোনটা ধরল সমীরণ। কানে লাগিয়ে হ্যালো বলেই চমকে উঠে কান থেকে ফোনটাকে একটু তফাতে ধরল সে। তার বাবা মধু বাগচী যাত্রাদলে ঢুকলে নাম করতে পারতেন। গলার রেঞ্জ সাংঘাতিক। রেগে গেলে আরও মারাত্মক। এখন সেই মারাত্মক মাত্রায় গলাটা তাকে ধমকাচ্ছে, কী ভেবেছ তুমি। সারারাত ফুর্তি করে সকালে হ্যাংওভার নিয়ে পড়ে থাকলেই হবে? তোমাকে কতবার বলেছি, আজ শুক্রবার অফিসের আগে মিস্টার ভার্মার বাড়ি থেকে একটা জরুরি ফাইল নিয়ে আসবে। উনি অপেক্ষা করছেন। আর-একটু বাদেই উনি একটা ফ্লাইট ধরতে বেরিয়ে যাবেন।
যাচ্ছি বাবা, এখনই যাচ্ছি।
রিচ হিম উইদিন ফিফটিন মিনিটস। ফিফটিন! হার্ড মি?
ইয়েস। ফিফটিন।
টেলিফোনটা নামিয়ে রাখতে না রাখতেই ডোরবেল বাজল। এ সময়ে বাবার কথা নয়। এ বাড়িতে খবরের কাগজ বা গয়লা আসে না। নবর মা আসে এগারোটার পর। সে ডোরবেল বাজায় না, তার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে। সাধাসাধি না করলে ক্ষণিকা নিজে থেকে ফিরে আসার মেয়ে নয়।
একটু চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন সমীরণ গিয়ে দরজাটার দিকে হাত বাড়িয়ে জুলেখাকে বলল, টু বি অন দি সেফ সাইড, তুমি বরং শোয়ার ঘরে যাও।
যাচ্ছি। বলে জুলেখা একটা হাই তুলল। তারপর সে বেশ ধীরেসুস্থে শোয়ার ঘরে চলে গেল।
দরজা খুলে সমীরণ যাকে দেখল সে বেশ ছোটখাটো মানুষ। গোঁফ আছে। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। চেহারা রোগা। পরনে কালো ট্রাউজার্স আর-একটা কটসউলের সবুজ চেকওলা হাওয়াই শার্ট, বিনা হাস্যে বলল, আসতে পারি?
সমীরণ দরজা না ছেড়ে বলল, কী চাই?
আপনাকেই।
কী দরকার?
লোকটা বুকপকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করে দেখিয়েই পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, তদন্ত। ভেরি ইস্পর্ট্যান্ট।
সমীরণ একটু ক্যাবলা হয়ে গিয়ে বলল, তদন্ত মানে সেই ইয়ের কেসটা কি? একবার তো এনকোয়ারি হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, সেই ইয়ের কেসটাই। এনকোয়ারি বারবার হবে। এবারেরটা গুরুতর। পরশু দিনও এসেছিলাম। আপনি বেশ সকালেই অফিসে বেরোন দেখছি।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তবে পরশু আপনার কাজের মেয়েটির সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে। রিগাড়ি ইউ। আমি ভিতরে এলে কি আপনার অসুবিধে হবে? ভিতরে গার্ল ফ্রেন্ডট্রেন্ড কেউ আছে নাকি মশাই?
না না। আসুন।
থাকলেও আমি মাইন্ড করব না। তাকেও হয়তো প্রয়োজন হবে। মার্ডার কেস যে কোথা থেকে কোথায় গড়ায়।
সমীরণ লোকটাকে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বলল, বসুন। কিন্তু আমি একটা জরুরি কাজে বেরোচ্ছিলাম।
আমার কাজটা কি কম জরুরি? এখন যদি আপনি কাজ দেখান তা হলে আপনাকে আমার অফিসিয়ালি থানায় টেনে নিয়ে যেতে হবে।
আতঙ্কিত সমীরণ বলল, প্লিজ। তা হলে আমি বাবাকে একটা টেলিফোন করে নিই? উনিই আমার বস।
জানি। কর্ডলেস টেলিফোনটা এই ঘরে নিয়ে এসে কথা বলুন। আর গার্ল ফ্রেন্ডটিও এখানে স্বচ্ছন্দে এসে বসতে পারেন।
সমীরণ টেলিফোনটা নিয়ে এল। খানিকটা চার্জ নিয়েছে। চলবে। সে লাইনটা অন করে ডায়ালের বোম টিপতে টিপতে বলল, জুলেখা টয়লেটে গেছে। এসে যাবে।
বেফাঁস বলা। টেলিফোনে তার বাবার গলা হঠাৎ ফেটে পড়ল, জুলেখা টয়লেটে গেছে? হোয়াট ডু ইউ মিন? কে জুলেখা? আর তার টয়লেটে যাওয়ার খবর তুমি এই সাতসকালে আমাকে শোনাচ্ছ কেন?
আপনাকে নয়।
আমি জানতে চাই তুমি এখনও বেরিয়ে পড়োনি কেন? তোমাকে বলেছিলাম কি না ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে ভার্মাকে রিচ করতে হবে।
হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
কী সমস্যা? জুলেখা কে? তার টয়লেটে যাওয়াটাই তোমার সমস্যা নাকি?
না বাবা। আই অ্যাম আন্ডার অ্যারেস্ট।
অ্যারেস্ট! বলে বাবা এমন চেঁচাল যে, মানুষ অত জোরে সচরাচর চেঁচাতে পারলে টেলিফোন যন্ত্রটারই দরকার হত না।
অ্যারেস্ট! আমি ঠিক শুনেছি তো।
ঠিকই শুনেছেন। তবু আমি ভেরিফাই করে নিচ্ছি। বলে মাউথপিসটায় হাত চাপা দিয়ে সে লোকটাকে জিজ্ঞেস করল, অ্যাম আই আন্ডার অ্যারেস্ট?