- বইয়ের নামঃ ঈগলের চোখ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. বিষাণ
স্যার, আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। ডিসিপ্লিন ব্যাপারটা আমার ধাতেই নেই। কিছুদিন দিব্যি রুটিন ফলো করতে পারি। সকালে ওঠা, দাঁত মাজা, দাড়ি কামানো, স্নান, বাটার টেস্ট আর ডিম দিয়ে ব্রেকফাস্ট, পোশাক পরে তৈরি হয়ে ব্রিফকেস নিয়ে বউকে একটা আলতো চুমু খেয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়া–এসব মাসখানেক দিব্যি পারি। তারপরই আমার অস্থিরতা আসে। সাংঘাতিক অস্থিরতা। মনে হয়। এইসব রুটিন আমার গলা কেটে ফেলছে, হাত-পায়ে দড়ি পরাচ্ছে, একটা নিরেট দেয়ালে ঠেসে ধরছে আমাকে। আমার তখন ভীষণ কষ্ট হয়। পাগল পাগল। লাগে। আর তখনই আমি আমার কয়েকজন মার্কামারা পুরনো বন্ধুকে খবর পাঠাই। তারা ভাল লোক নয় ঠিকই, তবে বন্ধু হিসেবে খুব, খুব বিশ্বস্ত। খবর পেলেই তারা এসে হাজির হয়ে যায়। আর আমি তাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। উধাও হয়ে যাই। কাঁহা কাঁহা মুল্লুক চলে যাই। বেশিরভাগই হয় আদিবাসী ভিলেজ, নয়তো কোনও খনি এলাকা, ডক অঞ্চল। অর্থাৎ যেখানে ভদ্রলোকরা থাকে না। চোলাই খাই, জুয়া খেলি, ভাড়াটে মেয়েদের সঙ্গে শুই। হয়তো এসব খুব খারাপ কাজ স্যার, কিন্তু ওইরকম বেপরোয়া বেহিসেবি পাগলাটে মর্যালিটিহীন কিছুটা সময় কাটালেই আমার অস্থিরতাটা চলে যায়।
তখন কি ফিরে আসেন?
হ্যাঁ স্যার। হয়তো এক সপ্তাহ কিংবা দিন দশ-পনেরো ওইরকম বাঁধনছাড়া জীবন কাটাতে না পারলে আমাকে সুইসাইড করতে হত।
আমাদের কাছে যা খবর আছে তাতে আপনার পাঁচজন বন্ধুর মধ্যে রাজু শেঠ আর নিমু। কর্মকার ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল। তা কি জানেন?
ওরা আমার আজকের বন্ধু নয় স্যার। ছেলেবেলা থেকে আমরা প্ৰায় একসঙ্গে বড় হয়েছি। ওদের সব জানি স্যার। রাজু খুব অ্যাগ্রেসিভ টাইপের। নিমু একটু চুপচাপ কিন্তু একরোখা। হ্যাঁ স্যার, আপনার ইনফর্মেশনে কোনও ভুল নেই।
প্রবাল, শতরূপ আর নন্দনও খুব ভাল লোক নয়।
স্যার, আমরা কেউ ভাল লোক বলে দাবি করছি না। আর ওই বন্ধুদের সঙ্গে বছরে দু’–তিনবারই আমার দেখা হয়। যখন আমরা উইকেন্ড অ্যাডভেঞ্চারে যাই। নইলে কে কী করে তা নিয়ে আর কেউ তেমন মাথা ঘামায় না।
আপনার এইসব অ্যাডভেঞ্চার আপনার স্ত্রী কী চোখে দেখতেন?
সে কি আর বলতে হবে স্যার? উনি আমাকে আপাদমস্তক ঘেন্না করতেন। যখন ফিরে আসতাম। তখন ওঁর চোখ যেন আমার সর্বাঙ্গে ছ্যাক দিত। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হত তখন।
রিকনসিলিয়েশন কীভাবে হত?
সময় লাগত স্যার। উনি আমাকে খুব অপমান করতেন, গালাগাল দিতেন।
ডিভোর্সের ভয় দেখাননি?
বহুবার। যতদূর জানি, ইদানীং ল-ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলেন।
বিয়ে কতদিনের?
সাত বছর।
প্ৰেম করে, না নেগোশিয়েটেড?
আপনি কি আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জানেন স্যার?
জানি। তবু আপনি বলুন।
আমি প্ৰসাদ ফুড প্রোডাক্টের মালিকের ছেলে। সুতরাং আমাকে বড়লোকের ছেলে বলাই যায়। আমরা তিন ভাই, আমি মেজো এবং ফ্যামিলির ব্ল্যাক শিপ। আমার মিসঅ্যাডভেঞ্চারের জন্য আমি বাবার চক্ষুশূল। তিনি হয়তো আমাকে ত্যাজ্যপুত্ৰই করতেন। কিন্তু একটা কারণেই করেননি। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই একমাত্র ফুড টেকনোলজি নিয়ে পড়েছি এবং পাশ করেছি। আমার আর দুই ভাই ম্যানেজমেন্ট পাশ করেছে এবং ব্যাবসাও বোঝে।। কিন্তু আমি প্রোডাকশনটা বুঝি। আপনি জানেন না যে আমি কিছু ইনোভেশন করার ফলে আমাদের প্রোডাক্টের কোয়ালিটি অনেক ভাল হয়েছে এবং বিদেশেও মার্কেট পাচ্ছে। শুধু এই কারণেই বাবা আমাকে তাড়িয়ে দেননি। যাতে আমি শুধরে যাই সেইজন্যই শিবাঙ্গীর মতো সুন্দরী মেয়ে খুঁজে আমার বিয়ে দেন। ইট ওয়াজ অ্যান অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ স্যার।
বুঝলাম। আপনার স্ত্রী যে সুন্দরী তা আমরা জানি। কিন্তু শিবাঙ্গীও আপনাকে শোধরাতে পারেনি, তাই তো?
হ্যাঁ স্যার।
বেলঘরিয়ায় আপনাদের বিশাল বাড়ি থাকতেও আপনি এই সাউথ ক্যালকাটায় ফ্ল্যাট কিনে বাস করছেন কেন? বিশেষ কারণ আছে কি?
আইডিয়া আমার বাবার। কেন তা বলতে পারব না। বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। যা করেন ভেবেচিন্তেই করেন। আমার মা আপত্তি করেছিলেন বটে, কিন্তু বাবা বলেছিলেন, শিবাঙ্গীর সঙ্গে আলাদা থাকলেই নাকি আমার ভাল হবে। এই ফ্ল্যাট বাবাই কিনে দিয়েছেন।
কিন্তু এই ব্যবস্থায় আপনার ভাল হয়েছে কি?
না স্যার। আমি ইনকরিজিবল।।
স্ত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কীরকম?
লুকওয়ার্ম। অলমোস্ট কোন্ড।
তার জন্য আপনি কাকে দায়ী করতে চান?
আমাকে। শিবাঙ্গী ভাল মেলে।
আপনার ওই মার্কামারা পাঁচজন বন্ধুকে কি আপনার স্ত্রী চেনেন?
ওরা আমার বাড়িতে বড় একটা আসে না। আমাদের বন্ধুত্বটা বাইরে। তবে শিবাঙ্গী ওদের দু-চারবার দেখেছে। বিয়ের সময়ে ওরা ইনভাইটেড ছিল। দু-তিনবার বিভিন্ন অকেশনে এসেছে। শিবাঙ্গী ওদের খুব ফর্ম্যালি চেনে। ঘনিষ্ঠভাবে নয়। সত্যি কথা বলতে কী, ওদের সঙ্গে আমারও বিশেষ যোগাযোগ থাকে না। যখন আমার ঘাড়ে অস্থিরতার ভূতটা চাপে তখনই ওদের ফোন করি, আর ওরা চলে আসে।
সবাই একসঙ্গেই চলে আসে?
না স্যার। তা কি হয়! সকলেই নানা ধান্ধায় ব্যস্ত। কখনও দু’জন বা তিনজন জুটে যায়। আজকাল পাঁচজন জোটে খুব কম।
এই বন্ধুরা কি সবাই ওয়েল অফ?
হ্যাঁ স্যার। কারও মানিটারি কোনও প্রবলেম নেই। কিন্তু স্যার, আপনি আমার বন্ধুদের সম্পর্কে জানতে চাইছেন কেন?
এ ম্যান ইজ নোন। বাই দি কম্পপ্যানি হি কিপস।
সে তো ঠিকই। আমরা সবাই ক্যালকাটা বয়েজ-এ পড়তাম। অ্যাকাডেমিক রেকর্ড কারওরই খুব খারাপ নয়। তবে হ্যাঁ, আমাদের সবাই বদমাশ বলে জানত। অ্যান্ড দ্যাটস प्र6।।
এবার বলুন, জুন মাসের পাঁচ তারিখে আপনি এবং আপনার বন্ধুরা রাত বারোটার সময় কোথায় ছিলেন?
বন্ধুরা বলতে সবাই নয়। আমি, রাজু আর শতরূপ জুনের এক তারিখে গাড়ি নিয়ে বেরেই।
গাড়িটা কার?
রাজুর। রাজুর গাড়িরই ব্যাবসা। অন্তত তিনটে বড় বড় কোম্পানিকে ও বছরওয়ারি চুক্তিতে গাড়ি দেয়। সব কোয়ালিটি কার। তাই আমরা যখনই বাইরে যাই তখনই রাজুর কাছ থেকে গাড়ি নিই।
বুঝলাম। এবার বলুন, কোথায় গিয়েছিলেন?
লোধাশুলি।
সেখানে কেন?
শতরূপের ওখানে একটা ফাৰ্মহাউস মতো আছে। হাঁস, মুরগি, শুয়োরের খামার। সেইখানে।
তারপর?
পাঁচ তারিখ রাতেও আমরা শতরূপের ফার্ম হাউসেই ছিলাম স্যার।
ফার্ম হাউসের কর্মচারীরা সাক্ষী দেবে তো?
কেন দেবে না স্যার? তবে রাজু ছিল না। ওর জরুরি কাজ থাকায় দুই তারিখেই ফিরে এসেছিল। আমরা ফিরি ছয় তারিখের সকালে। ফার্ম হাউসের ডেলিভারি ভ্যান-এ।
কলকাতায় কখন পৌছন?
ভোর সাড়ে পাঁচটায়।
তারপর?
শত আমাকে এসপ্ল্যানেডে গ্র্যান্ডের সামনে নামিয়ে দেয়। আমি ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে আসি। এসব কথা আমি লোকাল পুলিশকে বলেছি স্যার। একাধিকবার বলতে হয়েছে।
জানি। হয়তো আরও কয়েকবার বলতে হবে।
ঠিক আছে। যতবার বলতে বলবেন, বলব। বাড়িতে ফিরে আমি বেল দিই। কেউ দরজা খুলল না। হঠাৎ মনে হল, দরজাটা লক করা নেই, শুধু আধভেজানো আছে। আমি দরজা খুলে ঢুকি। সামনের হলঘরেই নন্দিনী উপুড় হয়ে পড়ে ছিল। লট অফ ব্লাড। ক্লট হয়ে ছিল।
আপনার ফাস্ট রি-অ্যাকশন?
খুব নার্ভাস হয়ে, হাত-পা কেঁপে মেঝেতেই বসে পড়ি। কাউকে ডাকাডাকি করার মতো অবস্থা ছিল না। বোধহয় আরও আধঘণ্টা পর আমি শিবাঙ্গীকে ডাকতে ডাকতে হামাগুড়ি দিয়ে বেডরুমে যাই। অ্যান্ড শি। ওয়াজ লায়িং…
শিবাঙ্গীর সঙ্গে আপনি বাইরে গেলে ফোনে কথাটথা বলতেন না?
না স্যার। আমার হোয়ার আবাউটস সম্পর্কে ওর কোনও ইন্টারেস্ট ছিল না।
আপনার কোনও গার্লফ্রেন্ড আছে?
না স্যার।
কখনও ছিল?
না। আমার অনেক দোষ আছে, কিন্তু উওম্যানাইজার নই।
নারী-পুরুষের আকর্ষণ কোনও দোষের ব্যাপার কি?
আমি তা জানি না স্যার। আমি মরালিস্ট নই। কিন্তু আমার কোনও মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল না।
নন্দিনী এ বাড়িতে কী করত? হাউস মেইড? মানে কাজের লোক?
ঠিক তা নয়। নন্দিনীকে এ বাড়িতে এনেছিল শিবাঙ্গী। এ বাড়িতে অনেক কাজের লোক আছে। কুক, ডাস্টিং-এর লোক, ডোমেস্টিক হেল্প মিলিয়ে অন্তত জনা চার-পাঁচ তো হবেই। নন্দিনী হাউসমাদারের মতো ছিল। ওভার অল সুপারভিশন করত। কিন্তু ওর আসল কাজ ছিল শিবাঙ্গীকে সঙ্গ দেওয়া। শিবাঙ্গীর একটা ছোট ব্যাবসা আছে। বিদেশ থেকে নানারকমের সুগন্ধের কনসেনট্ৰেট আনিয়ে তা দিয়ে পারফিউম তৈরি করা। ওর একটা ল্যাবও আছে। লার্জ স্কেলে করত না। লিমিটেড কিছু ক্লায়েন্টের জন্য করত। কিন্তু ব্যাবসাটা খুব ভালই চলত। নন্দিনী ওকে ব্যাবসার কাজেও হেল্প করত।
নন্দিনীকে কি স্যালারি দেওয়া হত?
হ্যাঁ স্যার। আমার ধারণা, মোর দ্যান ফিফটিন থাউস্যান্ড।
নন্দিনীর বয়স পাঁচিশ-ছাবিবশের বেশি ছিল না, কোয়াইট গুড লুকিং। ম্যারেড?
জানি না স্যার। নন্দিনীর সঙ্গে আমার বিশেষ কথাবার্তা হত না। শি ওয়াজ এ প্রাইভেট পারসন, ফোর্থ বেডরুমটায় থাকত। আমার সঙ্গে বিশেষ দেখাও হত না।
তার মানে আপনার সঙ্গে নন্দিনীর কোনও অ্যাফেয়ার ছিল না?
না স্যার। কী বলছেন? নন্দিনীর সঙ্গে অ্যাফেয়ার? আমার তো মনে হয় নন্দিনী আমাকে শিবাঙ্গীর মতোই ঘেন্না করত। আর সেটাই তো স্বাভাবিক।
কী করে বুঝতেন যে নন্দিনী আপনাকে ঘেন্না করত?
আমার তেমন সূক্ষ্ম অনুভূতি নেই। তবু দেখা হলে নন্দিনীর মুখে-চোখে রিপালশনের ভাব লক্ষ করেছি।
রেকর্ডে দেখছি আপনি এক সময়ে খেলাধুলো করতেন।
হ্যাঁ স্যার। আই ওয়াজ এ গুড অ্যাথলিট। স্প্রিন্টার ছিলাম। পরে আই টুক আপ টেনিস।
নেশাভা কবে থেকে শুরু করেন?
পাটিফাটিতে যেতে হত। সেই থেকেই শুরু।
আর বোহেমিয়্যানিজম?
ওটা আগে থেকেই ছিল। স্কুলে পড়ার সময় দু’বার পালিয়ে দেরাদুন আর লাদাখ চলে গিয়েছিলাম। তারপর থেকে মাঝে মাঝে কেমন যেন পাগলাটে ইচ্ছে হয় পালানোর।
আপনি একজন বিচিত্র মানুষ।
হ্যাঁ স্যার। অনেকে বলে, আমি পাগল।
আপনার স্ত্রীকে সেদিন সকালে আপনি কী অবস্থায় দেখেছিলেন?
বিছানায় উপুড় হয়ে শোওয়া। হাফ নেকেড। মাথা থেকে রক্ত পড়ে বিছানা ভেসে যাচ্ছিল। ঘ্যাস্টলি সিন। ভেবেছিলাম মরে গেছে।
আপনার কাজের লোকেরা কোথায় ছিল?
ওরা ফ্ল্যাটের ভিতরে থাকে না। সারভেন্টস কোয়ার্টারে থাকে। কুক। আর একজন সবসময়ের লোক। বাকিরা ঠিকে। অত সকালে কেউ তো আসে না। আটটার আগে কারও আসবার হুকুম নেই।
তখন ক’টা বাজে?
হার্ডলি ছটা বা সোয়া ছ’টা।
কী করলেন?
প্ৰথমে সিকিউরিটিকে ডাকি। তারপর অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশ। কিন্তু সবটাই করেছি একটা ঘোরের মধ্যে। এরকম সাংঘাতিক ঘটনা তো কখনও দেখিনি।
আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?
না স্যার। তবে শুনছি, পুলিশ আমাকেই সন্দেহ করছে। এখনও কেন অ্যারেস্ট করেনি জানি না।
তার কারণ আপনার অ্যালিবাই। ঘটনাটা ঘটে পাঁচ তারিখে রাত বারোটার কাছাকাছি।
হ্যাঁ স্যার জানি। কিন্তু পুলিশের সন্দেহ আমি সুপার কিলার লাগিয়ে কাণ্ডটা করেছি।
সেটা খুবই সম্ভব।
হ্যাঁ স্যার, এরকম ঘটনা আকছার ঘটছে। আর আমার তো মোটিভও আছে, কী বলেন?
হ্যাঁ। তা হলে কি আপনি স্বীকার করছেন যে কাণ্ডটা আপনারই?
না স্যার। আমি শিবাঙ্গী বা নন্দিনীকে খুন করার কথা কখনও ভাবিনি। কারণ, খুন করার পিছনে কোনও একটা উদ্দেশ্য তো থাকবে! আমার তো কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। শিবাঙ্গীর জ্ঞান ফিরলে এবং কথা বলার মতো অবস্থা হলে ওর কাছ থেকেই জানতে পারবেন। যে, আমি স্বামী হিসেবে অযোগ্য হলেও ভিনডিাকটিভ নই। আমাকে ও কিছুদিন আগে মিউচুয়াল ডিভোর্সের কথা বলেছিল। আমি খুব অপরাধবোধের সঙ্গেই বলেছিলাম, আমি তো অপদার্থ, আমার সঙ্গে কোনও মহিলারই বসবাস করা সম্ভব নয়।
ডিভোর্সে আপনার মত ছিল?
ছিল। না থাকলেও ডিভোর্স ও পেয়ে যেত। দেড় কোটি টাকার একটা সেটলমেন্টের কথাও হয়েছিল।
বাঃ! এটাই তো মোটিভ! শিবাঙ্গী মারা গেলে আপনার দেড় কোটি টাকা বেঁচে যেত। তাই না?
হ্যাঁ স্যার। আমি তো বলেইছি আমার মোটিভের অভাব নেই। পুলিশ আমাকে অনায়াসে ঝুলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু নন্দিনীকে খুন করার পিছনে আমার কী মোটিভ থাকতে পারে তা আমি ভেবে পাচ্ছি না।
মোটিভ আছে বিষাণবাবু।
আছে তা হলে তো হয়েই গেল। কিন্তু নন্দিনীর সঙ্গে আমার তো সম্পর্কই ছিল না স্যার।
আপনি কখনও নন্দিনীর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চেক করেছেন কি?
ফেসবুক অ্যাকাউন্ট! না স্যার, ফেসবুকের কথা লোকের মুখে শুনি বটে, কিন্তু আমি কখনও ফেসবুক চেক করি না। কখনও ইন্টারেস্টই হয়নি। কেন স্যার, ফেসবুকে কি নন্দিনী আমার সম্পর্কে কিছু বলেছে?
ক্যাটেগরিক্যালি নয়, তবে কিছু হিন্ট আছে। নন্দিনী একজন রহস্যময় পুরুষের কথা লিখেছে। তার পুরো নাম বা ছবি লোড করেনি। শুধু ইনিশিয়াল দেওয়া আছে, আর ইনিশিয়াল হল বি পি। আপনার নামের আদ্যক্ষর। আপনি কি জানেন নন্দিনী ছবি আঁকতে জানত কিনা?
না। স্যার, নন্দিনী সম্পর্কে আমি বেশি কিছুই জানি না। শুধু জানি সে ছিল শিবাঙ্গীর ডান হাত। তাকে ছাড়া শিবাজীর এক মুহূর্তও চলত না। দু’জনের খুব ভাব ছিল, বন্ধুর মতো। এমপ্লয়ার-এমপ্লয়ির মতো নয়।
এতে কি আপনি বিরক্ত হতেন?
না। স্যার, বিরক্ত হব কেন? বরং শিবাঙ্গী যে মনের মতো একজন সঙ্গিনী পেয়েছে তাতে আমি খুশিই হতাম।
নন্দিনী কখনও আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ইন্টারফিয়ার করত?
না স্যার। কারণ শিবাঙ্গীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হত না। বরং দু’জনের মধ্যে একটা নীরবতাই ছিল। কোলান্ড ডিসট্যান্স। তবে কখনও সখনও শিবাঙ্গী গায়ের ঝাল। ঝাড়ত। একতরফা। আমি কখনও জবাব দিতাম না। কারণ আমি সর্বদাই পাপবোধে ভুগতম। আমি যে অন্যায় করছি তা তো আমি জানি।
সেয়ানা পাপী?
হ্যাঁ স্যার, আমাকে ওটা বলাই যায়। কিন্তু নন্দিনীর ছবি আঁকা নিয়ে আপনি কিছু জানতে চাইছিলেন।
হ্যাঁ। তার কারণ, নন্দিনীর মোবাইলে আমরা আপনার কয়েকটা ছবি পেয়েছি।
মাই গড! আমার ছবি। নন্দিনীর মোবাইলে? অসভ্য ছবি নয় তো স্যার?
কেন, সেরকম সম্ভাবনা আছে নাকি?
আজকাল মডার্ন টেকনোলজি দিয়ে কত কী করা যায়।
না, অসভ্য ছবি নয়। আর ছবিগুলো কোনও অ্যালবাম থেকে তোলা হয়েছে বলেই মনে হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, নন্দিনীর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে আপনার ছবি থেকে করা একটা স্কেচ আপলোড করা আছে। পাশে লেখা ‘মিস্টিরিয়াস বি পি ইজ মিরাজ টু মি’।
তার মানে কী স্যার?
আমার ডিডাকশন হল, নন্দিনী আপনার প্রেমে পড়েছিল।
এতে কি আমার খুশি হওয়া উচিত? কিন্তু স্যার, আমার তো শুনে কোনও খুশি হচ্ছে না।
খুশি না হওয়াই ভাল। কারণ এই মেসেজটা আপনাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে।
ও গড!
নন্দিনীর দিক থেকে আপনি কখনও কোনও ইশারা-ইঙ্গিত পাননি? কখনও না? ভাল করে ভেবে দেখুন।
ইশারা-ইঙ্গিত! বিশ্বাস করুন স্যার, নন্দিনী ওয়াজ এ ভেরি সিরিয়াস টাইপ অফ উওম্যান। সবসময়ে গভীর, সবসময়ে এনগেজড ইন সাম ওয়ার্ক। ওর গলার স্বরও আমি বিশেষ শুনতে পেতাম না। আর আমি বাড়িতে থাকতামই বা কতক্ষণ বলুন। সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে ন’টার মধ্যে বেরিয়ে যেতাম। ফিরতে রাত। বেশিরভাগ সময়েই ডিনার বাইরে খেয়ে আসতাম। আর শিবাঙ্গী বা নন্দিনীও তো বাড়িতে বসে থাকার লোক নয়। শিবাঙ্গীর ব্যাবসা ছাড়াও নানা সোশ্যাল এনগেজমেন্ট আছে। সুতরাং, নন্দিনী কী করে ইশারা-ইঙ্গিত করতে পারে? বরং আমার মনে হয় শি হেটেড মি।
আমি আপনাকে আর একটু কনসেনট্রেট করতে বলছি। আর একটু ভাবুন। কোনওদিন কোনও ছোটখাটো ইনসিগনিফিক্যান্ট কিছু মনে পড়ে কি?
স্যার, শিবাঙ্গী আমাকে ঘেন্না করে ঠিকই, কিন্তু কোনও মহিলা আমার প্রতি ইন্টারেস্টেড হলে শি। উইল নো ইট ইমিডিয়েটলি। এবং সে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়।
আর ইউ শিয়োর?
হ্যাঁ স্যার। আমাদের বিয়ের পরই ওর এক বান্ধবী আমার সঙ্গে একটু ঢলাঢলি করার চেষ্টা করেছিল। শিবাঙ্গী তাকে এমন অপমান করে যে সে আর কখনও মুখ দেখায়নি।
শুনুন মশাই, নন্দিনী সম্পর্কে আপনার ধারণা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। আপনার ই-মেলের পাসওয়ার্ড নন্দিনী কী করে জানল?
আমার পাসওয়ার্ড! ইম্পসিবল।
নন্দিনীর ঘরের ডেস্কের ড্রয়ারের মধ্যে পুলিশ অন্তত ছয়-সাতটা ই-মেল-এর প্রিন্ট আউট পেয়েছে যেগুলো আপনার অ্যাড্রেসে এসেছিল।
মাই গড। এটা কীভাবে সম্ভব?
আপনি খুব ভাল অভিনেতা নন বিষাণবাবু।
না। স্যার, আমি অ্যাকটিংটা পারি না। নেভার ইন মাই লাইফ। এখনও অ্যাকটিং করছি না। আমি সত্যিই বিস্মিত।
যদি প্ৰমাণ হয় যে নন্দিনীর সঙ্গে আপনার একটা গোপন সম্পর্ক ছিল তা হলে কিন্তু আপনি অগাধ জলে পড়বেন।
বুঝতে পারছি স্যার। আমার ভবিষ্যৎ খুব ভাল দিকে টার্ন করছে না। ই-মেল-এ কি কিছু ক্লু পাওয়া গেছে স্যার?
অবশ্যই।
দেন আই অ্যাম ডুমড্।
আপনি কি রেগুলার আপনার ই-মেল চেক করেন?
না। স্যার, আমার ই-মেলের যোগাযোগ বেশি মানুষের সঙ্গে নেই। মাঝে মাঝে খুলে দেখি। জাঙ্ক মেল-ই বেশি থাকে। আমাকে কম্পিউটারে অনেক কাজ করতে হয় বটে, কিন্তু ই-মেল বড় একটা দেখা হয় না। কী আছে স্যার আমার ই-মেল-এ?
একটা মেসেজ ছিল, ডু ইউ নো হু ওয়াজ হোল্ডিং ইয়োর হেড হোয়েন ইউ ওয়্যার ভমিটিং লাস্ট নাইট? ডিড ইউ হিয়ার মাইহাট বিট হোয়েন আই ওয়াজ হোল্ডিং ইউ ক্লোজ টু মাই ব্রেস্ট? ইউ পুয়োর রেচেড ম্যান!
এই মেসেজের মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার।
আপনি বাড়িতে মাতাল অবস্থায় ফিরলে কেউ কি আপনাকে অ্যাটেন্ড করে রেগুলার?
আগে মাঝে মাঝে শিবাঙ্গী এসে ধরত। বমিটমি করলে সব পরিষ্কার করত। সিমপ্যাথি ছিল স্যার। কিন্তু সেটা আমিই নষ্ট করে দিয়েছি।
মনে করে দেখুন, ইদানীং–
স্যার, মাতাল অবস্থায় যা ঘটে তা পরে আর মনে পড়ে না। তবে হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আবছা মনে পড়ছে, কিছুদিন আগে মাতাল অবস্থায় আমাকে কেউ দু-চারবার অ্যাটেন্ড করেছে। আমি ভেবেছিলাম, কাজের লোকজনই হয়তো হবে।
মহিলা না পুরুষ?
মনে হয় মহিলা।
ভাল করে ভেবে দেখুন, মহিলাটি নন্দিনী কিনা।
হলেও হতে পারে স্যার। মাতালের অবজার্ভেশন খুব একটা নির্ভরযোগ্য তো নয়। কিন্তু ব্যাপারটা একটা ধাঁধার মতো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আপনার ল্যাপটপ আছে?
আছে।
নিয়ে আসুন।
এক মিনিট স্যার।
বলে বিষাণ উঠে তার স্টাডি থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে এল। তারপর ল্যাপটপ খুলে মন দিয়ে তার ই-মেল খুলে ভাল করে পরীক্ষা করে বলল, দেখুন স্যার, ওরকম কোনও মেল আমার অ্যাকাউন্টে নেই।
এখন নেই, কিন্তু ছিল। কোনও কারণে আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে তা ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা করার আগে নন্দিনী একটি প্রিন্ট আউট বের করে নিয়েছে। মোট চারটি মেল। এবং মেলগুলো বেশ প্যাশনেট অ্যান্ড রোম্যান্টিক। ব্যাপারটা খুলে বললে ভাল হয় না?
জানা থাকলে বলতাম স্যার। কিন্তু রোম্যান্টিক সম্পর্কই যদি হবে তা হলে নন্দিনীকে খুন করব কেন সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
হ্যাঁ, সেটা একটা চিন্তার বিষয়।
স্যার, শুধু নন্দিনী কেন, আমার মতো একজন রুইনড ম্যানের সঙ্গে দুনিয়ার কোনও মেয়েই কি রিলেশন তৈরি করতে চাইবে?
দুনিয়াটা বড় অদ্ভুত জায়গা, কত কী যে হয় বা হতে পারে তার কোনও লজিক বা মাথামুডু নেই।
স্যার, আমি আইনকানুন জানি না। আমাকেই কি খুনি বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে?
না, এখনও নয়। আমরা শিবাঙ্গীর ওপর নির্ভর করছি। উনি এখনও কোমায়। ডাক্তাররা কোনও ভরসার কথা বলছেন না। তবে এখুনি ফ্যাটাল কিছু হয়তো হবে না। উনি চেতনায় ফিরলে ভাইটিাল উইটনেস হয়ে দাড়াবেন। এখন আপনার ভাগ্য।
আমার ভাগ্য ভাল নয় স্যার। আমাদের বাড়িতে প্রচুর জ্যোতিষীর চর্চা হয়। আমার মা আর বাবা দু’জনেই খুব জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন। আমাদের বাড়িতে বড় বড় জ্যোতিষীর যাতায়াত আছে। তারাই বলেছে, আমার কুষ্ঠিতে নাকি অনেক খারাপ ব্যাপার আছে।
কীরকম?
তা আমি জানি না। স্যার, আমার মা জানে। এক সময়ে আমাকে মায়ের চাপাচাপিতে অনেক আংটি আর তাবিচ-কবজ পরতে হয়েছিল। বড় হয়ে সেগুলো ত্যাগ করেছি।
আপনি জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন?
না স্যার। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে জ্যোতিষীরা আমার ভাগ্য নিয়ে মিথ্যে হয়তো বলেনি।
আপনার কি মনে হয়। শিবাঙ্গী আপনার ফেবারে সাক্ষী দেবে?
না স্যার। তা কী করে সম্ভব? পুলিশ বলছে খুন করতে এসেছিল ভাড়াটে খুনিরা।
শিবাঙ্গী বড়জোর বলবে আততায়ীদের সে চেনে না। সেক্ষেত্রে তো আমার রেহাই পাওয়ার কথা নয়।
একজ্যাক্টলি। শিবাঙ্গীর সংজ্ঞা ফিরলেও আপনার লাভ নেই।
না স্যার। গত পাঁচদিন ধরে আমিও নানা অ্যাঙ্গেল থেকে ভেবেছি। মনে হচ্ছে আমার রেহাই পাওয়ার কোনও রাস্তা নেই।
বাই দি বাই, আমি শুনলাম, আপনি গত সাতদিন একফোঁটাও মদ্যপান করেননি। সত্যি নাকি?
সত্যি স্যার। ইন ফ্যাক্ট আমার মদ খাওয়ার কথা মনেই হয়নি। এতটা শকড যে, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো সব হাওয়া হয়ে গেছে। সেই জায়গায় আমার মনের মধ্যে গুহার মতো একটা ভয়।
ভয় জিনিসটা কি গুহার মতো?
আমার যেন ওরকমই মনে হল।
গত পাঁচদিন কি আপনি বাড়িতেই বসে আছেন?
হ্যাঁ স্যার। প্রথম তিন-চারদিন তো সারাদিন ধরে পুলিশের জেরা চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই থানায় টেনে নিয়ে গেছে। স্নান-খাওয়ার সময়ও পাইনি। আমি এত টায়ার্ড যে মনে হচ্ছে, বুড়ো হয়ে গেছি। স্যার, আমি তো পুলিশকে বলেছি যে, আমি ফেঁসে গেছি। আমার আর বেশি কিছু বলার নেই।
বলার অনেক কিছু আছে। আপনি ঠিকমতো চেষ্টা করলে হয়তো ভাইটালি কোনও কু পাওয়া যেত। বিশেষ করে নন্দিনী সম্পর্কে।
নন্দিনী সম্পর্কে আমি তো প্ৰায় কিছুই জানি না স্যার। যেটুকু জানা ছিল বলেছি।
আপনার পাসওয়ার্ড কি আপনি কাউকে জানিয়েছেন, বা কোথাও লিখে রেখেছিলেন?
না স্যার। আমি সজ্ঞানে অন্তত করিনি।
কিন্তু পাসওয়ার্ড নন্দিনী জানত। সেটা কীভাবে সম্ভব?
আমার কথা যে কেউ বিশ্বাস করছে না তা আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই।
আপনার বেডরুম আর শিবাঙ্গীর বেডরুম কি আলাদা?
হ্যাঁ স্যার। পাশাপাশি।
বরাবর কি এরকমই বন্দোবস্ত ছিল? দু’জন দুই ঘরে?
না। আগে আমরা একই বেডরুম আর বেড শেয়ার করতাম। পরে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকায় এই সিস্টেম চালু হয়।
দুই ঘরের মধ্যে একটা লিংকিং দরজা আছে। সেটা কি বন্ধ থাকত?
হ্যাঁ স্যার। শিবাঙ্গীর দিক থেকে বন্ধ থাকত।
আর হলঘরের দিকের দরজাটা?
শিবাঙ্গীর কথা জানি না। তবে আমার বেডরুমের হলঘরের দরজাটা লক করা থাকত না। কারণ, আমার ঘরে তেমন কোনও ভ্যালুয়েবলস নেই। আমার হাতঘড়িটা বেশ দামি, আর মোবাইল ফোনটাও। আর হ্যাঁ, ল্যাপটপ। এগুলোর জন্য দরজা লক করার দরকার ছিল না। বাইরে সিকিউরিটি আছে, ফ্ল্যাটের দরজাও রাতে বন্ধ থাকে।
আমি চুরির কথা ভাবছি না। একটা সেনসিটিভ প্রশ্ন করছি। জবাবটা এড়িয়ে যাবেন না।
আমার লুকোনোর কিছু নেই।
শিবাঙ্গীর সঙ্গে আপনার সেক্সয়াল রিলেশন কি একদম ছিল না?
সেই অর্থে ছিল না বললেই হয়।
তার মানে কখনও সখনও আপনারা মিলিত হতেন কি?
সত্যি কথা বলতে কী, আমার দিক থেকে কোনও উদ্যোগ ছিল না। আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমি শিবাঙ্গীকে খুব ভয় পেতাম। ওর সামনে খুব পাপবোধে ভুগতাম। নিজেকে ছোট মনে হত। কিন্তু শিবাঙ্গী কখনও সখনও চলে আসত গভীর রাতে। অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ দ্যাট।
কিন্তু আপনি তো রোজই মদ্যপান করে ঘুমোতেন?
কম বা বেশি এবং প্রায় রোজই। কিন্তু কখনও সখনও বাদও গেছে। আমার দাদুগত বছর অনেক বয়সে মারা যান। হি ওয়াজ মাইমেন্টর। দাদুর মৃত্যুর পর আমি দিন পনেরো এক ফোঁটাও মদ খাইনি। আমি খুব একটা রিলিজিয়াস লোক নই, তবু পুজোটুজোর দিনে আমি মদ খাই না।
আপনার কাজের লোকেরা অবশ্য তাই বলেছে। কিন্তু এবার আমি আপনাকে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে চাই।
করুন স্যার।
শিবাঙ্গীর সঙ্গে লাস্ট কবে আপনার ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছে?
একটু ভেবে বলতে হবে স্যার। দু’মিনিট।
ভাবুন।
মে মাসের শেষ দিকে বোধহয় চব্বিশ বা পঁচিশ তারিখে।
ভেবে বলছেন তো!
খুব অ্যাকুরেট না হলেও দুটোর মধ্যে যে কোনও একটা দিন। আর তার আগে, মে মাসের ষোলো তারিখে।
শিয়োর?
মোটামুটি শিয়োর।
আপনি কি ড্রাংকেন অবস্থায় এনগেজড হয়েছিলেন?
অন্তত খুব একটা সচেতনও ছিলাম না।
আপনি আপনার স্ত্রীর হোয়ার অ্যাবাউটস সম্পর্কে কতটা খবর রাখেন?
খুব একটা নয়। উই লেড সেপারেট লাইভস।
উনি কি এসে আপনাকে ডেকে ঘুম থেকে তুলতেন?
না। কখন আসত আমি টের পেতাম না। এমব্রেস করত, চুমু খেত। অ্যান্ড…
বুঝেছি। আপনার কখনও সন্দেহ হয়নি যে মহিলাটি শিবাজী নাও হতে পারে?
কী বলছেন স্যার? ইমপসিবল! শিবাঙ্গী ছাড়া অন্য কেউ হতেই পারে না।
উত্তেজিত হবেন না বিষাণবাবু। এই ফ্ল্যাটে আপনি, শিবাঙ্গী আর নন্দিনী ছাড়া আর কেউ কি রাত্রিবাস করে?
জাহ্নবী। ও মেয়েটা শিবাঙ্গীর খুব ন্যাওটা। অল্পবয়স থেকে আছে। শুনছিলাম, শিবাঙ্গী তার বিয়ের ব্যবস্থা করছে। কিন্তু এসবই তো পুলিশ জানে স্যার।
হ্যাঁ। তবু জানার তো শেষ নেই বিষাণবাবু। ফর ইয়োর ইনফর্মেশন মে মাসের চব্বিশ আর পঁচিশ তারিখে শিবাঙ্গী কলকাতায় ছিল না। ব্যাঙ্গালোর গিয়েছিল।
২. জাহ্নবী
জাহ্নবী গাড়ি চালাতে শিখে গিয়েছিল মাত্র পনেরো বছর বয়সে। রঘুবীর সিং শিখিয়েছিল। ম্যাডামের হুকুমে। সবে যখন ষোলোয় পা তখন একদিন ম্যাডাম নিয়ে গেল তার ড্রাইভিং লাইসেন্স করাতে। বয়সের গড়বড় তো ছিলই, কিন্তু ম্যাডাম কলকাঠি নেড়ে বয়স বাড়িয়ে লাইসেন্স বের করে দিয়ে বললেন, এখন থেকে তুই আমার গাড়ি চালাবি।
জাহ্নবীর বুক ধড়ফড়, ওরে বাবা! কলকাতার রাস্তায় আমি চালাব?
ভয় পেলে থাক। কিন্তু সাহস করলে পেরে যাবি। আমি তোর চেয়েও অল্প বয়সে গাড়ি চালিয়েছি।
জাহ্নবীর সাহসের অভাব ছিল না। প্ৰথম কয়েকদিন ম্যাডাম সামনের সিটে তার পাশে বসে একটু-আধটু গাইড করত। মাসখানেকের মধ্যে হাত-পা সব সেট হয়ে গেল। সেই থেকে সে ম্যাডামের ড্রাইভার।
ওখানেই থেমে থাকতে দেয়নি ম্যাডাম। বাড়িতে ম্যাডামের যে সব বিউটিশিয়ান আসত তাদের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়ে ক্ৰ প্লাক, ম্যানিকিয়োর, পেডিাকিয়োর, মাস্ক তৈরি করা এবং কয়েক রকমের চুলের ছাঁট দিতেও শিখেছে সে। ম্যাডামের একটাই কথা ছিল, ট্রেনিং থাকলে ঝি খেটে মরতে হবে না, বুঝলি?
জাহ্নবীর এখন সতেরো বছর বয়স। ছিপছিপে জোরালো চেহারা। ম্যাডাম নিজের সঙ্গে তাকে জিম করাত, ওয়েট ট্রেনিং আর যোগা। জাহ্নবী বুঝতে পারছিল, ম্যাডাম তাকে তৈরি করে দিচ্ছেন। ম্যাডামের পারফিউম ল্যাবেও সে কাজ করে। ভারী মজার কাজ। কনসেনট্রেটেড নিৰ্যাস থেকে ব্যবহারযোগ্য পারফিউম তৈরি করা, খুব বড় ব্যাবসা নয়। মাত্র কয়েকজন বাঁধা খদের। তৈরি হতে না হতে বিক্রি হয়ে যায়। দাম খুব চড়া।
সতেরোতে এসে সব উলটেপালটে গেল। ম্যাডাম হাসপাতালে আইসিইউ-তে। বাঁচেন কিনা সন্দেহ। নন্দিনী ম্যাডাম খুন। পুলিশের জেরায় জেরায় বাঁঝরা হয়ে সে এখন বাধ্য হয়ে তাদের হাজরার বস্তিতে নিজের সংসারে এসে উঠেছে। ব্যাঙ্কে তার অ্যাকাউন্টে টাকা কম নেই। মাসের বেতন ব্যাঙ্কে জমা হয়ে যেত। কিন্তু এখন তার ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত। কী হবে কে জানে! তবে জাহ্নবীর ভয়ডর বিশেষ নেই।
তার মোটামুটি ভয়হীন জীবনে অনেকদিন বাদে হঠাৎ একটু যেন ভয়ের ব্যাপার ঘটল। খুন-জখম হয়ে যাওয়ার পর পুলিশের হুজতে হয়রান হয়েও ভয়টয় বিশেষ হয়নি তার। কিন্তু সোমবার সকালে জিনস-এর প্যান্ট আর সাদা হাওয়াই শার্ট পরা যে লোকটা তার সঙ্গে কথা বলতে এল তার চোখের দিকে এক পলক তাকিয়েই বুকটা ধড়ধড় করে উঠল। তার। অথচ লোকটা তেমন লম্বাচওড়া নয়। বরং একটু ছোটখাটো চেহারাই। পালোয়ানি শরীরও নয়। তবে গড়নটা মজবুত। কিন্তু চোখ দুটোই হাড় হিম করা। কাল রাতে মোবাইলে বড়বাবু তাকে ফোন করে বলে দিয়েছিলেন, সকালে সে যেন কোথাও না যায়, একজন গোয়েন্দা তাকে প্রশ্ন করতে আসবে।
যে এল তার নাম শবর দাশগুপ্ত। জিপ থেকে নেমে গলির রাস্তায় পা দিতেই বাচ্চু ছুটে এসে খবর দিল জাহ্নবীকে, কে এসেছে জানিস? শবর দাশগুপ্ত। সুপার কপ।
শবর দাশগুপ্তকে একটা চেয়ার দেওয়া হল। গোমরামুখো নয়। আবার বোকা বোকা হাসিও নেই মুখে। চারদিকে চেয়ে তাদের ঘরদোর একটু দেখল, তারপর তার দিকে চেয়ে বলল, এখানে কবে এসেছ?
ছয় তারিখে।
শিবাঙ্গীর বাড়িতে কতদিন আছ?
তেরো বছর বয়স থেকে।
তেরো বছর।
হ্যাঁ।
তেরো বছর বয়সের কাউকে কাজে রাখা বে-আইনি তা জানো?
বাঃ রে! আমি যখন আমার মায়ের কাছে থাকতাম তখনও তো ঘরের কাজ করতে হত। সাত-আট বছর বয়স থেকেই জল আনা, বাসন মাজা, ঘর ব্যাটানো, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করা, সব। সেটা বে-আইনি নয়?
শবর এবার হাসল। ঝকঝকে সাদা দাঁত। তাকে আর একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, শুনেছি। তুমি ষোলো বছর বয়স থেকেই গাড়ি চালাও।
হ্যাঁ। ম্যাডাম আমাকে সব কাজে পাকা করতে চেয়েছিলেন। আমি এক বছর যাবৎ গাড়ি চালাচ্ছি। কখনও কোনও অ্যাক্সিডেন্ট করিনি। কোনও কেস খাইনি।
হ্যাঁ। আমি তোমার রেকর্ড চেক করেছি।
আপনি কি আমার লাইসেন্স ক্যানসেল করে দেবেন?
না। ওটা মোটর ভেহিকলস ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। আর তুমি যখন গাড়ি ভালই চালাও তখন আমার গরজ কীসের?
থ্যাঙ্ক ইউ।
তুমি পুলিশের জেরায় বলেছ, ঘটনার সময়ে তুমি বাড়িতে ছিলে না।
না। পুলিশকে আমি তো বলেইছি যে সেই রাতে আমি ম্যাডামের বোন শ্যামাঙ্গীকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম বড় গাড়িটা নিয়ে। রাত বারোটায় সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা ছিল।
রাতের ফ্লাইটে রিসিভ করতে তোমাকে পাঠানো হয়েছিল কেন?
ওটা ইমার্জেন্সি ছিল। রঘুবীর সিং-এর মায়ের দয়া হয়েছিল সেদিনই। সকালে। তাই ম্যাডাম আমাকে পাঠান।
তুমি একা?
না। সঙ্গে বুম্বা ছিল।
বুম্বা মানে ইস্তিরিওয়ালা? নীচে যার গুমটি আছে?
হ্যাঁ। শ্যামাঙ্গী ম্যাডামের ফ্লাইট আধঘণ্টা লেট ছিল। রাত একটায় আমি ওঁকে পিক আপ করি। তারপর সোজা বারুইপুর। ফেরার সময় অবশ্য বুম্বা বাইপাসে সায়েন্স সিটির কাছে নেমে ফিরে আসে।
তুমি রাতে বারুইপুরে শ্যামাঙ্গীদের বাড়িতেই ছিলে?
হ্যাঁ। অত রাতে ওঁরা ফিরতে দিলেন না।
তুমি কখন খবর পাও?
খবর পাইনি। শ্যামাঙ্গী ম্যাডাম অনেকবার আমাদের ম্যাডামকে ফোন করেন। নন্দিনী ম্যাডামের নম্বরেও ফোন করা হয়। নো রিপ্লাই। আমরা ভাবলাম ম্যাডামরা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। শোওয়ার সময় ম্যাডাম ফোন সাইলেন্ট মোডে রেখে শুতেন। ওঁর ঘুমের প্রবলেম ছিল।
ওখান থেকে কখন ফিরে এসেছিলে?
সকালে ব্রেকফাস্টের পর। রাতেই আমি ম্যাডামকে একটি মেসেজ করে রেখেছিলাম যে, সকালে ফিরব। আমি সাড়ে আটটায় পৌছাই এসে। তখন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। বাইরেও খুব ভিড়।
তুমি কি শিবাঙ্গীর সঙ্গে ফ্ল্যাটের মধ্যেই থাকো?
সবসময়ে নয়। সারভেন্টস কোয়াটারে আমার ঘর আছে। তবে অনেক সময়েই ম্যাডাম রেখে দিতেন।
নন্দিনী ম্যাডাম সম্পর্কে কিছু বলবে?
সব বলা হয়ে গেছে। তিন-চারবার করে। আর কী শুনবেন?
যা বলা হয়নি। ধরে যদি জিজ্ঞেস করি বিষাণ রায়ের সঙ্গে নন্দিনীর সম্পর্কটা কেমন ছিল। বা তুমি ওই দু’জনের মধ্যে কিছু লক্ষ করেছ কিনা।
না, কিছু ছিল না। দাদা ভীষণ ভাল লোক। ভীষণ ভাল।
বিষাণ রায়কে কি তুমি দাদা বলে ডাকো?
হ্যাঁ।
তা হলে শিবাঙ্গীকে বউদি নয় কেন?
উনি বউদি ডাক পছন্দ করেন না।
তুমি বিষাণ রায়কে পছন্দ করো?
কেন করব না? দাদা খুব ভাল।
বিষাণ মদ খায়, জানো তো!
ধুস। আজকাল কে না খাচ্ছে! ম্যাডাম খেতেন, নন্দিনী ম্যাডাম খেতেন, আমিও কতদিন খেয়েছিা।
বুঝলাম। বিষাণের কী কী গুণ আছে বলতে পারো?
আমি তো অতি জানি না। তবে দাদা কখনও মিথ্যে কথা বলে না, কখনও চোঁচামেচি করে না, কখনও কাউকে অপমান করে না, ম্যাডাম দাদাকে যা খুশি বললেও দাদা কখনও উলটে কিছু বলে না। মদ খাওয়া ছাড়া দাদার মধ্যে আমি কখনও কোনও বেচাল দেখিনি। আর ম্যাডাম ইচ্ছে করলেই দাদাকে মদ ছাড়াতে পারতেন।
কীরকম?
দাদা তো ম্যাডামকে ভীষণ ভয় পায়।
ভয় পায় কেন?
ম্যাডামের সব ভাল, কিন্তু বড্ড রিগচটা। খুব সামান্য কারণেই ভীষণ রেগে যান। দাদা ওই রাগকেই বোধহয় ভয় পায়।
শিবাজীর সঙ্গে নন্দিনীর কীরকম ভাব ছিল?
দু’জন তো বন্ধু। ভােব তো ভালই ছিল।
দু’জনের কখনও ঝগড়া হত না?
ম্যাডামের সঙ্গে ঝগড়া। পাগল নাকি? ম্যাডামের চোখে চোখ রেখে কেউই কথা বলতে পারত না।
তুমিও কি ম্যাডামকে ভয় পাও?
ও বাবা। সাংঘাতিক। তবে হ্যাঁ, ম্যাডাম আমাকে খুবই ভালবাসেন।
অথচ ম্যাডামের চেয়ে বিষাণ রায়ের প্রতিই তোমার পক্ষপাত বেশি। তাই না?
জাহ্নবী হেসে ফেলল। তারপর বলল, কী করব, দাদা যে বড্ড বেচারা মানুষ। দেখলেই মায়া হয়।
যদি প্রমাণ হয় যে বিষাণ রায়ই নন্দিনী আর শিবাঙ্গীকে খুন করার পিছনে রয়েছে?
মরে গেলেও বিশ্বাস করি না। আপনি তো দাদাকে চেনেন না। একদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময় একটা বড় নীল মাছি চলে এসেছিল টেবিলের ওপর। রাঁধুনি নিতাইদা সেটাকে একটা ফ্লাই স্নাটার দিয়ে মারে। দাদা তো প্রায় কেঁদেই ফেলেছিল, কেন মারলি? কেন মারলি? বলে চোখ ছলছল। ভাল করে খেলই না সেদিন।
তুমি তো দেখছি বিষাণ রায়ের ডাই হার্ড ফ্যান!
হ্যাঁ তো। দাদাকে আমি ভীষণ ভালবাসি।
দাদাও কি তোমাকে ইকোয়ালি ভালবাসে?
দাদা। নাঃ, দাদা তো বাড়িতে কারও সঙ্গে কথাই বলে না। কারও দিকে তাকিয়েও দেখে না। খুব চুপচাপ থাকে। আমার তো মনে হয় রাস্তায়-ঘাটে আমাকে মুখোমুখি দেখলে দাদা চিনতেও পারবে না।
বিষাণ রায় কি এতটাই অন্যমনস্ক?
ভীষণ। কিন্তু গভীর মানুষ নয়। রাশভারী মানুষকে দেখলে যেমন ভয় ভয় করে, দাদাকে দেখলে তেমনটা হয় না।
তোমার সঙ্গে কখনও কথাটথা বলে না?
খুব কম। দাদা ফাইফরমাশ করতে পছন্দ করে না। তবে আমি মাঝে মাঝে গিয়ে ঘরটা একটু গুছিয়ে দিতাম।
ড্রাঙ্ক অবস্থায় বমি করলে তুমি কি কখনও ওঁকে অ্যাটেন্ড করেছ?
বমিটমি খুব একটা করে না তো! একবার বা দু’বার গিয়ে ধরেছিলাম। অনেকদিন আগে। আর একবার জ্বর হয়েছিল, তখন জোর করেই মাথা ধুইয়ে দিয়েছিলাম।
জোর করে কেন?
তখন ওঁর একশো চার ডিগ্রি জ্বর। বিছানা থেকে ওঠার শক্তি নেই। আমি মাথা ধোয়াতে চাইলে খুব আপত্তি করতে লাগলেন। কিন্তু আমি দেখলাম, মাথা না ধোয়ালে জ্বর হয়তো আরও বাড়বে। তাই নিতাইদাকে ডেকে এনে অয়েল ক্লথ বিছিয়ে একরকম জোর করে। অনেকক্ষণ ধরে মাথা ধুইয়ে দিয়েছিলাম। তাতে খুব খুশি ছিলেন। জ্বর ছাড়বার পর একদিন আমাকে ডেকে দুশো টাকা দিয়ে বললেন, শাড়িটাড়ি কিছু কিনে নিয়ো। আমি টাকা নিলাম না। বললাম, বাড়ির লোক সেবা করলে কি বখশিশ দিতে হয়? কথাটা ওঁর ভাল লেগেছিল।
বিষাণের সঙ্গে তোমার শেষ কবে দেখা হয়েছে?
রোজই তো হয়। কালও গিয়েছিলাম। আজও যাব। নার্সিংহোমে ম্যাডামকে দেখতেও যাই দু’বেলা।
তোমার তো ও বাড়িতেই থাকার কথা।
সেটা তো ভাল দেখাবে না। শত হলেও আমি তো বয়সের মেয়ে, দাদার সঙ্গে একা বাড়িতে থাকি কী করে? সকালে গিয়ে গাড়িটার স্টার্ট দিই। ডাস্টিং করি। দাদার ঘর, ম্যাডামের ঘরাও ডাস্টিং করতে হয়।
বিষাণবাবুর সঙ্গে মার্ডার নিয়ে কোনও কথা হয়েছে?
মার্ডার নিয়ে এত কথা হচ্ছে যে আর ওসব নিয়ে কথা কইতে ইচ্ছে করে না। দেখছি দাদা আজকাল ড্রিঙ্ক করছেন না, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়াও করছেন না। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকেন, না হলে কম্পিউটারে কাজ করেন। দাড়ি বড় হয়ে গেছে। ওঁর খেয়াল রাখার তো কেউ নেই। আমার খুব কষ্ট হয়, কিন্তু কিছু বলতে সাহস হয় না। শুনছি পুলিশ নাকি ওঁকে অ্যারেস্ট করবে?
হ্যাঁ, তা পারে।
কিন্তু সেটা খুব ভুল হবে। দাদা ওরকম লোক নয়।
তা হলে খুনটা কে করেছে বলে তোমার মনে হয়?
আমি জানি না তো!
নন্দিনীর সঙ্গে বা তোমার ম্যাডামের সঙ্গে কারও শক্ৰতা ছিল জানো?
না। নন্দিনী ম্যাডাম তো সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। আর কাজের লোকদের দিয়ে কাজ-করিয়ে নেওয়াটাও ওঁর কাজ ছিল। ফ্ল্যাটটা ছয় হাজার স্কোয়ার ফুটের। টুইন ফ্ল্যাট। অন্য ফ্ল্যাটটা তো ফাকাই পড়ে থাকে। তবু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে হয়।
তোমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই?
বয়ফ্রেন্ড। নাঃ, আমার কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই।
কেন নেই?
কেন থাকবে? আজিকালিকার ছেলেগুলোকে দেখেছেন? সারাদিন ছোঁক ছোঁক করে মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। যখন একা গাড়ি চালাই প্ৰায় সময়েই কিছু পয়সাওলা ছেলেছোকরা গাড়ি করে পিছু নেয়। পাশাপাশি এসে জানালা দিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলে। আপনিই বলুন, এদের কাউকে বয়ফ্রেন্ড বলে ভাবা যায়?
তুমি তো খুব চুজি দেখছি।
একটু আছি।
বলতে পারো নন্দিনী ম্যাডামের কোনও অ্যাফেয়ার ছিল কিনা।
ঠিক জানি না, উনি তো খুব আপনমনে থাকতেন।
ওঁর বয়স সাতাশ-আঠাশ, চেহারা ভাল। ওঁর তো কোনও বয়ফ্রেন্ড থাকারই কথা। কখনও কারও সঙ্গে ওঁকে দেখেছ?
না।
নন্দিনী ম্যান্ডামের সঙ্গে তোমার কেমন ভাব ছিল?
ছিল না স্যার। উনি আমাকে পছন্দ করতেন বলে আমার মনে হয় না।
কেন, তুমি কী করেছ?
কিছুই তো করিনি।
অপছন্দটা কীভাবে বুঝতে পারতে?
ওসব বোঝা যায়। আমাকে দেখলেই মুখটা আঁশটে হয়ে যেত।
ব্যস? ওটুকুই?
না। আরও অনেক ব্যাপার ছিল। ছোটখাটো ব্যাপার। তবে আমাকে ম্যাডাম তো বাইরের কাজেই বেশি পাঠাতেন, তাই আমাকে নন্দিনী ম্যাডামের মুখোমুখি বেশি হতে হত না।
তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। শুনে হয়তো তোমার ভাল লাগবে না।
কী কথা?
আমার সন্দেহ নন্দিনী ম্যাডামের সঙ্গে বিষাণ রায়ের একটা অ্যাফেয়ার চলছিল।
অসম্ভব!
অসম্ভব কেন? বিষাণবাবুর সঙ্গে শিবাঙ্গীর সম্পর্ক ভাল ছিল না। বিষাণবাবু একজন অ্যাট্রাকটিভ মানুষ এবং প্রচুর টাকার মালিক। নন্দিনী যথেষ্ট সুন্দরী, স্মার্ট, বুদ্ধিমতী। অ্যাফেয়ার তো হওয়াই স্বাভাবিক।
দাদা নন্দিনী ম্যাডামকে পাত্তাই দিত না।
কী করে বুঝলে?
বুঝব না কেন? আমার কি ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ নেই?
আছেই তো! এবং চোখ দুটো খুব সুন্দর। কথাটা নিশ্চয়ই তোমাকে অনেকেই বলেছে।
জাহ্নবী লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে একটু হাসল। তারপর বলল, ছাই সুন্দর।
জানতে চাইছি, ওই দুটো সুন্দর চোখ দিয়ে তুমি ঠিক কী কী দেখেছ, যাতে মনে হতে পারে যে বিষাণ রায় নন্দিনী ম্যাডামকে পাত্তা দিতেন না।
ইদানীং দেখছিলাম নন্দিনী ম্যাডাম সকালের দিকে প্রায়ই দাদার ব্রেকফাস্টের সময় এসে উলটো দিকে বসতেন। বেশ সেজোগুজে।
সেজোগুজে?
মানে ঠিক খুব বেশি সাজ নয়। হয়তো একটা বেশ চটকদার কিমোনো পরলেন, চুলটা একটু কায়দা করলেন, অল্প মেক-আপ, হালকা লিপস্টিক। ওসব আপনি বুঝবেন না। মেয়েরা বুঝতে পারে।
তা তো ঠিকই। কিন্তু উনি হয়তো ওই সময়ে ব্রেকফাস্ট করতেই এসে বসতেন।
মোটেই না। ম্যাডাম বা নন্দিনী ম্যাডাম তো ব্রেকফাস্ট করেনই না। শশা, দই আর কয়েক টুকরো ফল।
তবে এসে বসতেন কেন?
বুঝে নিন।
দু’জনে কথাবার্তা হত না?
নন্দিনী ম্যাডাম বা দাদা কেউই খুব একটা বলিয়ে-কইয়ে মানুষ নয়। নন্দিনী ম্যাডামকে দেখেছি। টোস্টে বাটার লাগিয়ে দিতে। দরদ দেখানো আর কী। দাদা তো তাকিয়েও দেখত না।
তার মানে নন্দিনীর বিষাণের ওপর দুর্বলতা ছিল?
ছিল।
কখনও বাড়াবাড়ি কিছু দেখোনি?
বললাম তো দাদা পাত্তা দিত না।
ব্যাপারটা তোমার ম্যাডামকে জানিয়েছিলে?
বাপ রে। ম্যাডামকে কে বলতে যাবে?
তুমি কি জানতে যে তোমার ম্যাডামের একটা পিস্তল ছিল?
না। তবে ওই ঘটনার পর পুলিশের কাছে শুনেছি।
তুমি তো শিবাঙ্গীর ঘর গোছগাছ করতে, কখনও দেখোনি?
না। আমার তো ক্যাবিনেট বা লকার খোলার হুকুম নেই।
শিবাঙ্গী তো মাঝেমাঝে কলকাতার বাইরে যেত, তাই না?
হ্যাঁ। ওঁর ব্যাবসার কাজে যেতে হত। দিল্লি, বোম্বে, ব্যাঙ্গালোর, সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক।
ঘটনার আগে কবে শেষবার বাইরে গেছে বলতে পারো?
পারি। ম্যাডামের টুর আমায় মনে রাখতে হয়। মে মাসের ষোলো আর সতেরো তারিখে উনি বোম্বে গিয়েছিলেন। চকিবশ আর পঁচিশ তারিখে দিল্লি।
সেই সময়ে কি নন্দিনী আর বিষাণ এক ফ্ল্যাটে ছিল?
না। ম্যাডাম বাইরে গেলে আমাকে ফ্ল্যাটের ভিতরে থাকতে হত। ম্যাডামের ঘরে। অনেক দামি জিনিস আছে তো, তাই।
অর্থাৎ তোমাকে পাহারা দিতে হয়?
হ্যাঁ।
ম্যাডামের বিছানাতেই কি শোও?
বাপ রে। ম্যাডামের বিছানায় কে শোবে? ম্যাডাম কেটে ফেলবে তা হলে আমার একটা ফোল্ডিং খাট আছে, সেটা পেতে শুই।
তার মানে মে মাসের ষোলো, সতেরো, চব্বিশ আর পাঁচশ তুমি ম্যাডামের ঘরেই রাতে শুয়েছিলে?
হ্যাঁ। কিন্তু এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? পুলিশ তো জিজ্ঞেস করেনি।
আমিও তো পুলিশ।
হুঁ। কিন্তু আপনি একটু অন্যরকম। ঠিক পুলিশ পুলিশ মনে হয় না। বাচ্চু বলছিল। আপনি নাকি সুপার কপ।
তা তো আমার জানা নেই। শুধু এটুকু জানি যে, আমি একজন পুলিশ কর্মচারী। তুমি বোধহয় জানো সেদিন রাতে শিবাঙ্গী নিজেকে বাঁচাতে তার পিস্তল থেকে এক রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। গুলিটা খুনিদের একজনের গায়েও লাগে। ঘরের মেঝেতে তার রক্তের দাগ পাওয়া গেছে।
জানি। সব শুনেছি। ম্যাডামের হেভি সাহস।
আমি শুনেছি। তুমিও খুব সাহসী মেয়ে!
জাহ্নবী কাঁধটা একটু বাঁকিয়ে একটা বখাটে হাসি হাসল। তারপর বলল, এ বাজারে সাহসী না হলে আমাদের ক্লাসের মেয়েদের কি চলে?
মারপিট করো নাকি?
না, শুধু শুধুমারপিট করব কেন? তবে দরকার হলে হাত-পা চালিয়ে দিই।
এরকম কোনও ঘটনা কি ঘটেছে?
জাহ্নবী আবার হাসল, কেস দেবেন না তো স্যার?
আরে না। মেয়েরা মারপিট করলে আমি খুশিই হই।
তিন-চারবার মারপিট হয়েছে। বদমাশ ছেলেদের সঙ্গে।
বদমাশ ছেলেদের সঙ্গে! তুমি তো সাংঘাতিক মেয়ে। মেরেছি, না মার খেয়েছ?
মারপিট করলে মার খেতেও হয়। কোনও হিরো তো আর আমাদের বাঁচাতে আসে না, সিনেমার মতো।
ঠিক কথা। মেয়েরা হিরোর জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবেই বা কেন? প্রত্যেকটা মেয়ের নিজেরই হিরো হয়ে ওঠা উচিত।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
করো।
দাদাকে কি আপনারা অ্যারেস্ট করবেন?
সেটা তদন্তের ওপর নির্ভর করছে। খুনিরা ধরা পড়ে গেলে এবং তোমার দাদার নাম বললে অ্যারেস্ট তো হবেই।
না। স্যার, দাদার নাম বলবে কেন?
বলবে না, তুমি কী করে জানো?
দাদা ও কাজ করতেই পারে না।
বাইরে থেকে দেখে মানুষকে আর কতটুকু চেনা যায়! তবে এখনই অ্যারেস্ট করা হচ্ছে না, এটুকু বলতে পারি। কিন্তু তোমার দাদার চেয়েও তোমার ম্যাডামের বিপদ বেশি। তাঁর হেড ইনজুরি, কোমায় আছেন। বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ত্ৰিশ পারসেন্ট। তাঁর জন্য তোমার টেনশন হচ্ছে না?
হচ্ছে। খুব হচ্ছে। কিন্তু কাল ডাক্তার সেন দাদাকে বলেছেন, ম্যাডামের প্রাণের ভয় নেই। আমি নিজে শুনেছি।
তাই বুঝি?
হ্যা স্যার। কাল দাদাকে আমিই তো গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছি।
তুমি কেন? বিষাণের তো আলাদা গাড়ি আছে।
আছে। কিন্তু ওঁর মনের যা অবস্থা গাড়ি চালাতে গেলে অ্যাক্সিডেন্ট করে বসবেন।
হুঁ। সে-কথা ঠিক। উনি খুব নার্ভাসনেসে ভুগছেন।
খেতে চাইছেন না, ঘুমোচ্ছেন না ভাল করে। ওজন কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। গালে বড় বড় দাড়ি। আমি গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে খাওয়াই।
তুমি বললে খান?
খুব বিরক্ত হন। তবে সামান্য একটু মুখে তোলেন।
কতক্ষণ থাকো ওঁর কাছে রোজ?
কাছে থাকা তো সম্ভব নয়। উনি কম্পিউটারে কাজ করেন, কাগজ বা বই পড়েন, টেলিফোনে কথা বলেন। আজ তো পুলিশের পারমিশন নিয়ে অফিসেও যাবেন শুনেছি।
হ্যাঁ, ওঁকে পারমিশন দেওয়া হয়েছে।
ওঁকে ছেড়ে দিন স্যার। উনি কিছু করেননি।
কিন্তু কেউ তো করেছে। সেটা না জানা অবধি ওঁকে তো সন্দেহের বাইরে রাখতে পারি না।
ওরকম ভাল একটা লোককে সন্দেহ করা কি ঠিক?
৩. শিবাঙ্গী
কেমন আছেন ম্যাডাম?
আপনি কে বলুন তো? আপনাকে কি আমি চিনি?
না, আমাদের পূর্বপরিচয় নেই। আমার নাম শবর দাশগুপ্ত। আমি পুলিশের গোয়েন্দা।
ওঃ। হ্যাঁ, এরা বলে রেখেছিল যে, পুলিশ থেকে কেউ আমাকে জেরা করতে আসবে।
না ম্যাডাম, জেরা নয়। জাস্ট একটু কনভারসেশন। কিন্তু আপনি এখন কেমন আছেন?
ভাল নেই। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, তাকাতে কষ্ট হয়। তার চেয়েও বেশি কষ্ট মনের মধ্যে। আচ্ছা, আমি কি একটা লোককে খুন করেছি? সবাই বলছে আমি খুন করিনি। কিন্তু ওরা বোধহয় সত্যি কথাটা আমাকে বলতে চায় না। আপনি তো পুলিশ। আপনি তো জানেন আমি গুলি চালিয়ে একটা লোককে মেরে ফেলেছি।
না। আপনার গুলিতে সামান্য জখম হলেও কেউ মরেনি।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি বড্ড পাপবোধে ভুগছি। অনুশোচনায় বুক পুড়ে যাচ্ছে।
অনুশোচনার কী আছে? আপনার ঘরে একজন ইনট্রিউডার ঢুকলে তার বিরুদ্ধে আপনি অ্যাকশন নিতেই পারেন। আমার মতে আপনি ঠিক কাজই করেছেন এবং সাহসের সঙ্গে।
পিস্তলটিা জীবনে কখনও ব্যবহার করতে হবে বলে ভাবিনি। তা ছাড়া কাউকে লক্ষ করেও গুলি চালাইনি। ভেবেছিলাম দেয়ালের দিকে তাক করে ফায়ার করব, আর ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে।
ওরা অত সহজে ভয় পাওয়ার পাত্র নয়।
ওরা কারা বলুন তো!
সুপারি কিলার বললে বুঝতে পারবেন?
ওসব আজকাল সবাই বোঝে। আমি যাকে গুলি করেছি। সে তা হলে বেঁচে আছে তো!
আছে বলেই মনে হয়। তবে সে ধরা পড়েনি, পালিয়ে গেছে।
লুটপাট করতে এসেছিল তো।
মনে হয় না। আপনার ঘর থেকে কিছু চুরি গিয়ে থাকলে আপনি ছাড়া আর কেউ ভাল করে বুঝতে পারবে না। তবে চুরি বা ডাকাতিটা উদ্দেশ্য ছিল না।
সুপারি কিলার বললেন না? তার মানে কস্ট্রাক্ট কিলার তো?
হ্যাঁ।
আমাকে মারতে এসেছিল?
তাই তো মনে হয়।
কিন্তু কেন?
সেটাই তো এখন লাখ টাকার প্রশ্ন, কেন?
ভারী আশ্চর্য ব্যাপার তো! আমাকে কেন খুন করবে। কেউ? আমি তো কারও কোনও ক্ষতি করিনি। ভাবতেই যে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে।
উত্তেজিত হবেন না। আমি তো শুনেছি আপনি একজন তেজস্বিনী মহিলা।
কে বলেছে?
সবাই তো বলছে।
তেজস্বিনীটিনি নই। তবে সাহসী বলতে পারেন। কিন্তু এই ঘটনার পর সব উলটেপালটে গেছে। খুব ভয় ভয় করছে এখন।
মাত্র গতকাল বিকেলে আপনার জ্ঞান ফিরেছে। এখনও আপনি খুব দুর্বল। আর শরীর দুর্বল থাকলে মনটাও ওরকমই হয়ে যায়।
বোধহয় তাই।
সংক্ষেপে ঘটনাটা একটু বলতে পারেন?
ঘটনা। ঘটনাটার তো মাথামুণ্ডুই নেই।
সেইটেই বলুন।
আমরা একটু আর্লি শুতে যাই রাতে। ধরুন দশটা নাগাদ। খুব প্রয়োজন ছাড়া কখনও লেট নাইট করি না। টিভি সিরিয়াল দেখার নেশা আমার নেই। তবে নন্দিনী বেশ রাত অবধি জেগে থাকে। ওয়ার্কহোলিক। কাজ ছাড়া থাকতে পারে না। আচ্ছা একটা কথা বলবেন?
কী কথা।
গতকাল থেকে আজ অবধি নন্দিনী তো আমাকে দেখতে এল না? এরা এই হাসপাতালে পেশেন্টদের মোবাইল ফোন অ্যালাউ করে না। তবু আজ সকালে এক সিস্টারকে ধরেকরে ফোন করিয়েছিলাম। কিন্তু নন্দিনীর ফোন সুইচ অফ আসছে। কী ব্যাপার বলুন তো!
কিছু না ম্যাডাম। আসলে ঘটনার ফলে উনি ভীষণ শৰ্কড। ওঁর নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে। এখন নার্সিংহোমে ভরতি।
ওঃ গড! নন্দিনীও হাসপাতালে?
হ্যাঁ। আপনি কি ওঁকে খুব মিস করছেন?
ভীষণ। ও তো আমার মেন্টর। আমার গ্রুমিং তো ও-ই করে।
হ্যাঁ, যা বলছিলেন–
সেদিন রাত দশটায় শুয়ে পড়েছিলাম। আমার ঘুমের প্রবলেম আছে বলে সেডেটিভ খেতে হয়। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভেঙে ডিম লাইটে দেখি ঘরের মধ্যে দুটো লোক। তাদের মুখ বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু হাতে কিছু ছিল।
কী ছিল?
পিস্তল বা ওরকম কিছু।
কথা বলেছিল?
আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম ‘কে?’ বলে। তখন সামনের লোকটার হাতে একটা ছোরাও দেখতে পাই। আমার বালিশের পাশেই আমার পিস্তলটা থাকে। কোনওদিন কাজে লাগবে বলে ভাবিনি। ওই বিপদের মুখে পিস্তলটার কথা মনেও পড়েনি। কিন্তু হাতে ভর দিয়ে উঠে বসতে গিয়ে হঠাৎ ডান হাতে পিস্তলটা পেয়ে যাই। একটুও ভাবনা চিন্তা না করে গুলি চালিয়ে দিতেই লোকটা ‘যাঃ শালা!’ বলে একটা আর্তনাদ করে পড়ে গেল।
তারপর?
তার পরের ব্যাপারটা ব্ল্যাঙ্ক অ্যান্ড ব্ল্যাক আউট। পরে শুনেছি। আমার মাথায় গুলি করা হয়েছে। কিন্তু মাথায় গুলি লাগলে তো আমার বেঁচে থাকার কথা নয়।
আবার বলছি, আপনি তেজস্বিনী মহিলা। আর হ্যাঁ, গুলিটল মাথায় লাগলেও ভাইটাল পার্টে লাগেনি। ফ্যাটাল ইনজুরি নয়। তবে সিরিয়াস ইনজুরি। আপনি প্ৰায় পনেরো দিন কনশাস ছিলেন না।
আমার গুলিতে সত্যিই কেউ মরেনি তো!
না। আর মরলেও ভারতের সংবিধান অনুযায়ী তাতে আপনি অপরাধী সাব্যস্ত হন না। আত্মরক্ষার জন্য খুন করা অপরাধ নয়।
সংবিধান নিয়ে কি আমাদের জীবন চলে? আমার হাতে কেউ খুন হয়ে থাকলে–সে গুন্ডা-বদমাশ যা-ই হোক, আমার নিজেকে বরাবর অপরাধী মনে হবে।
আপনি ওদের কারও মুখ দেখতে পেয়েছিলেন?
আমার ঘরে জোরালো আলো থাকে না। আর ঘুমের সময় আমি আলো সহ্য করতে পারি না বলে খুব কম পাওয়ারের একটা আলো জ্বালানো থাকে। ফলে ঘরটা একরকম আবছা অন্ধকার ছিল। দুটো লোককে দেখেছিলাম, আবছা ভাবে। তবে তারা পুরুষ, আর মনে হয় বয়স খুব বেশি নয়।
লম্বা না বেঁটে?
লম্বাও না, বেঁটেও না। গড়পড়তা হাইট।
পোশাক?
এই তো, আপনি তো আমাকে শেষ অবধি জেরাই করছেন। তাই না? অথচ বললেন কনভার্স করতে চান!
শবর হেসে ফেলল। তারপর বলল, মাপ করবেন। কেসটা এমন ঘাড়ে চেপে আছে যে, বে-খেয়ালে আপনার ওপর প্ৰেশার ক্রিয়েট করে ফেলেছি হয়তো।
আপনার হাসিটা কিন্তু ভারী সুন্দর! আচ্ছ। আপনি কি একটু শক্ত ধাতুর লোক?
ওকথা বলছেন কেন?
আপনার চোখ দুটো কিন্তু ভীষণ পেনিট্রেটিং ! তাকালে যে কেউ একটু ভয় পাবে।
দয়া করে আপনি যেন ভয় পাবেন না। কারণ আমি ইতিমধ্যেই আপনাকে সাহসী বলে মনে করতে শুরু করেছি।
আপনাকে দেখে মনে হয় না যে, আপনি মহিলাদের কমপ্লিমেন্ট দিতে পারেন।
ফাঁকা কমপ্লিমেন্ট নয় ম্যাডাম। যাক গে, আর কিছু যদি মনে পড়ে তা হলে বলুন। খুব বেশি ষ্ট্রেস-এর দরকার নেই। জাস্ট চোখ বুজে একটু ভেবে দেখুন। সেই রাতের আর কোনও ডিটেলস মনে পড়ে কিনা।
নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। কিন্তু আমি যখন মারা যাইনি আর ডাকাতরাও তেমন কিছু নিতে পারেনি তখন তদন্তের কি আর খুব একটা দরকার আছে? এখন থেকে একটু অ্যালার্ট থাকলেই তো হবে।
কিন্তু পুলিশকে তো শেষ পর্যস্ত তদন্ত করে দেখতেই হবে। আমরা তো এইজন্যই বেতন পাই।
তা অবিশ্যি ঠিক। আপনি যখন বলছেন তখন আমি নিশ্চয়ই সেই রাতের ডিটেলস মনে করার চেষ্টা করব। এখানে আমার একটুও ভাল লাগছে না। কবে যে এরা ছাড়বে।
আপনার কামব্যাকটা খুব অ্যামেজিং। ডাক্তাররা আশাই করেনি যে আপনার এত কুইক রিকভারি হবে। মনে হয়। আর দু-চারদিনের মধ্যেই আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন। বাই দি বাই, আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শিবাঙ্গী। তারপর সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলল, হয়েছে। বেশ রোগ হয়ে গেছে, মুখভরতি দাড়ি-গোঁফ। চিনতেই পারিনি প্ৰথমে।
কখন দেখা হল?
আমার কনশাসনেস ফিরেছে শুনে কাল রাতেই এসেছিল। সঙ্গে জাহ্নবী।
তখন তো ভিজিটিং আওয়ার্স নয়।
আপনি জাহ্নবীকে চেনেন না, একটা বিচ্ছু। ও কয়েকদিন এসেই হাসপাতালের সকলকে পটিয়ে নিয়েছে। ও তো যখন—তখন আসে-যায় বলে শুনেছি।
হ্যাঁ, মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী। আপনার খুব প্রিয় পাত্রী বুঝি?
আমার তো ছেলেপুলে নেই। ওর ওপর একটু মায়া পড়ে গেছে।
আপনি ওকে অল্পবয়সেই গাড়ি চালানো শিখিয়ে লাইসেন্স বার দিয়েছেন, শুনলাম।
মাই গড! কী বোকা। পুলিশের কাছে ওসব বলতে হয়?
ভয় নেই। আমরা আইনের পথ ধরে আর ক’জন চলি? তবে মাইনরের গাড়ি চালানো তার নিজের এবং অন্যদের পক্ষে বিপজ্জনক।
সরি শবরবাবু, কাজটা অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু ওকে আমি একটু তাড়াতাড়ি পাকিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। পড়াশোনাটা হয়নি, আর সব কাজে পাকা।
ওর বোধহয় নন্দিনী ম্যাডামের সঙ্গে একটু ইগো প্রবলেম আছে!
কী করে বুঝলেন? কিছু বলেছে বুঝি?
ভেবে বলেনি। তবে বুঝিয়ে দিয়েছে।
ওই তো প্রবলেম। অথচ নন্দিনীকে যে ও কেন পছন্দ করে না তাও বুঝি না বাবা।
নন্দিনীও কি ওকে অপছন্দ করে?
না না! নন্দিনী সেরকম মেয়েই নয়। ভীষণ বুদ্ধিমতী। আপনি নিশ্চয়ই নন্দিনীকে মিট করেছেন?
করেছি।
চার্মিং না?
উনি সুস্থ নন বলে আমার সঙ্গে বিশেষ কথা হয়নি। নন্দিনীর সঙ্গে আপনার কবে, কোথায় পরিচয়?
পরিচয় তো অনেক দিনের। আমার যখন ষোলো-সতেরো, ওর তখন চোঁদ-পনেরো। ওই সময়েই ওরা আমাদের পণ্ডিতিয়া টেরাসে ফ্ল্যাট ভাড়া করে এল।
অর্থাৎ যখন আপনার বয়স ষোলো-সতেরো আর নন্দিনীর চৌদ-পনেরো?
একজু্যাক্টলি।
ওঁর ব্যাকগ্রাউন্ড?
খুব সাদামাটা। বাবা পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন। ওরা দুই ভাই-বোন। ভাই ছোট। আমাদের বেশ ভাব হয়ে গেল।
নন্দিনী বিয়ে করেননি কেন?
বিয়ে করেনি মানে করবে না তো নয়। মাত্র তো পাঁচিশ বছর বয়সী।
কোনও বয়ফ্রেন্ড?
না। একটু চুজি। আচ্ছা নন্দিনীকে নিয়ে আমরা কথা বলছি কেন?
কৌতুহল। যাক গে। আপনি তাড়াতাড়ি সেরে উঠুন।
এ জায়গাটা বড্ড বিচ্ছিরি। ঘরে টিভি নেই, খবরের কাগজ দেওয়া হয় না, মোবাইল বা ল্যাপটপ কিছুই অ্যালাউ করে না। এরা। শুনছি। নাকি বাইরে পুলিশও চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়। সত্যি নাকি?
হ্যাঁ। সাবধানের মার নেই। আর আপনি আছেন আইসিইউ-তে। এখানে খবরের কাগজ, টিভি, মোবাইল সব নিষিদ্ধ।
সারাদিন কথা না বলে বা কাজ না করে কি থাকা যায়?
এখন বিশ্রাম নিন। কাজের জন্য সামনে লম্বা সময় পড়ে আছে। আজ তো কথাও অনেক বলেছেন। আমিই বকিয়েছি আপনাকে। এবার আসি?
চলে যাচ্ছেন? আবার আসবেন কিন্তু।
হাসালেন ম্যাডাম। পুলিশকে কেউ আবার আসতে বলে না। পুলিশ মানেই বিপদ।।
তা হতে পারে। কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার তো বেশ লাগল। আমি বাড়ি ফিরে গেলে একদিন চা খেতে আসবেন।
আপনি এখন বোর হচ্ছেন বলে আমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে। নইলে আই অ্যাম অ্যান আনকমফিটেবল কম্পানি।
একদম নয়। আবার এসে দেখুন না। আমি আনকমফর্টেবল ফিল করি কি না।
ঠিক আছে ম্যাডাম। বাই।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল।
কী কথা?
একটা নাম।
কার নাম?
তা জানি না। তবে ব্ল্যাক আউট হওয়ার সময় কে যেন বলল, বাচ্চু, আর চালাস না…
বাচ্চু?
হ্যাঁ।
আর কিছু মনে পড়ছে?
থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি লিড।
ফের বলছি। আবার আসবেন।
৪. শবর দাশগুপ্ত
দু’দিন পর এক ভোরবেলা পুলিশ বাদু মণ্ডলকে তুলে নিল তিলজলা থেকে। তার দু’দিন পর ভিক্টর ধরা পড়ল পার্ক সার্কাসে। দু’জনেরই প্ৰাথমিক স্টেটমেন্ট, তারা ডাকাতি করতে ঢুকেছিল। খুন করার উদ্দেশ্য ছিল না। কেউ সুপারি দেয়নি। বাধা পড়ায় গুলি চালিয়ে দিতে হয়। এই বিবরণ বার চারেক চার পুলিশ অফিসারকে দেওয়ার পর অবশেষে একদিন শবর দাশগুপ্তের মুখোমুখি হতে হল তাদের। এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা বুঝতে পারল, বিপদ।।
এই সাদা পোশাকের, সাদামাটা চেহারার লোকটা উঁচু গলায় কথা অবধি বলে না। ভারী মোলায়েম ভাষায় কথা কয়। গালাগাল দেয় না। ফালতু গরমও খায় না। একবার দুটো বাঘা চোখে দু’জনের দিকে চেয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে টেবিলের ওপর একটা পেপারওয়েট এক হাত থেকে অন্য হাতে এবং অন্য হাত থেকে ফের আগের হাতে গড়াতে গড়াতে বলল, টার্গেট একজন না দু’জন?
মাইরি স্যার, খুনখারাপি আমাদের লাইন নয়। ধরা পড়ার ভয়ে মেরে দিতে হল স্যার। শবর প্রশ্ন না করে অনেকক্ষণ দু’জনের দিকে চুপ করে চেয়ে বসে রইল। যেন গভীরভাবে কিছু ভাবছে। মিনিট দুয়েক পর একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, একটা প্রশ্নের জবাব না পেলে আমার অঙ্কটা মিলছে না। তোদের টার্গেট ক’জন ছিল, একজন না দু’জন?
দু’জনেই মুখ তাকাতাকি করে চুপ করে রইল অধোবদন হয়ে।
ভিক্টর! তুই বলবি? আমার যতদূর মনে হয় সেই রাতে তুই অপারেশনটা লিড করেছিল। বাদু নয়।
কাউকে মারার ইচ্ছে ছিল না। স্যার, বিশ্বাস করুন। গোলেমালে হয়ে গেল। আমাদের আপশোস হচ্ছে স্যার।
তুই যাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিস সে একজন মাইনর। যদি ধরা পড়ে তা হলে জুভেনাইল কোর্টে ট্রায়াল হবে। বড়জোর দু-তিন বছর কারেকশনাল হোমে সাজা কেটে বেরিয়ে আসবে। তাকে বাঁচানোর চেয়ে তোর নিজের গর্দান বাঁচানো অনেক ইম্পট্যান্ট।
ভিক্টর শুকনো মুখে বলে, আমাদের গর্দান তো যাবেই স্যার। আপনি কেস নিলে কি আমরা বাঁচব?
কেস নেওয়ার আমার কী দায়? চার্জশিট দেবে লোকাল পুলিশ। কেস স্ট্রং হলে ঘষে যাবি। আর যদি দাদাফাদা থাকে তো চার্জাশিটে জল ঢুকে যাবে। কোর্টে কত ক্রিমিনাল কেস ঝুলে আছে জানিস? শুনলাম, তোদের হয়ে একজন ঝানু উকিল মাঠে নেমেছে।
দু’জনেই একটু অধোবদন। তারপর ভিক্টর মুখ তুলে বলল, কথাটা কি কোর্টেও বলতে হবে?
জিজ্ঞেস করলে বলবি, তোর যদি ইচ্ছে হয়।
আমাদের টার্গেট একজন ছিল স্যার। নন্দিনী।
তা হলে শিবাঙ্গীর ঘরে ঢুকেছিলি কেন?
কাজটা তো গ্র্যাটিসের ছিল স্যার। আমরা কন্ডিশন করেই নিয়েছিলাম। ল্যান্ডলেডির ঘর থেকে কিছু মালু কামিয়ে নেব। কিন্তু ঘুমপাড়ানি রুমাল বের করারই সময় পাইনি, উনি গুলি চালিয়ে দিলেন। মরেও যেতে পারতাম স্যার!
তারপর?
বাদু ভয় পেয়ে পালটা ফায়ার করে। আমি বারণ না করলে আবার গুলি চালিয়ে দিত। কাজটা অন্যায় হয়েছে স্যার। ব্রিচ অফ ট্রাস্ট। শিবাঙ্গীকে আমাদের মারার কথা নয়।
শবর চিন্তিত মুখে বলে, আমার অঙ্কটা তবু মিলছে না।
কীসের অঙ্ক স্যার?
তোদের হয়ে যে উকিল মাঠে নেমেছে তার নাম জানিস?
না স্যার। একজন সেপাই বলছিল। আমাদের জামিনের জন্য নাকি একজন উকিল চেষ্টা করছে। কথাটা বিশ্বাস হয়নি। আমাদের মা-বাবারাও চায় যে, আমরা জেলে বন্ধ থাকি।
হুঁ। কিন্তু ওখানেই তো গণ্ডগোল। তোদের উকিলের নাম ব্ৰজবাসী দত্ত। কখনও নাম শুনেছিস?
দু’জনেই একসঙ্গে বলে, না স্যার।
কলকাতার টপ ক্রিমিনাল ল-ইয়ারদের মধ্যে একজন। অনেক টাকা ফি। টাকাটা কে দিয়েছে জানিস?
না স্যার।
আর ওখানেই অঙ্কটা মিলছে না।
শবর আবার কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। বলল, ঠিক আছে। আজ এই পৰ্যন্ত। দরকার হলে আবার আসব।
***
সকালে আজ অনেকদিন বাদে আয়নায় মুখ দেখল বিষাণ। নিজের দাড়িগোঁফওলা এই মুখটা তার চেনা নয়। যেন একটা অচেনা লোক তার সামনে।
অনভ্যস্ত দাড়িতে গাল কুটকুট করছে। একবার ভাবল কেটে ফেলবে কিনা। তারপর ভাবল, থাক। তার বেশ কিছু দাড়ি পেকে গেছে, এটা সে এতদিন টের পায়নি। তাকে বোধহয় এখন একটু বয়স্ক দেখাচ্ছে।
বয়স্কই। সে অনেকদিন জগিং করেনি। কোনওরকম ব্যায়াম করেনি। ফলে এখন তার শরীরের গাটে গাটে ব্যথা। বেশি পরিশ্রম করেত পারে না। সে যে একসময়ে দারুণ স্প্রিন্টার ছিল, এ তার নিজেরই বিশ্বাস হয় না। গত পঁচিশ দিন সে মদ খায়নি। অসম্ভব টেনশনে মদ ভাল কাজ করে। কিন্তু তার তেমন ইচ্ছে হয়নি। প্রথম চার-পাঁচদিন মদ পেটে না থাকায় ঘুম হচ্ছিল না। এখন হচ্ছে। খুব গাঢ় ঘুম নয়, তবু হচ্ছে তো।
আজ রবিবার। একা একটা ছুটির দিন কীভাবে কাটাবে সেটাই চিন্তার বিষয়। দিনটাও ভাল নয়। রাত থেকে একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কে যেন বলছিল, নিম্নচাপ। তবে এটা বর্ষাকাল, বৃষ্টি তো হওয়ারই কথা।
লিভিং রুমে এসে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে চেয়ারে বসতেই চমকে উঠল সে। মুখোমুখি আর একটা চেয়ারে একটা পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে। শবর দাশগুপ্ত।
আরে আপনি! কখন এসেছেন?
মিনিট পাঁচেক।
খবর দেননি তো!
দরজায় নক করেছিলাম, আপনার কাজের লোকদের মধ্যে একজন দরজা খুলে দিয়েছে। আমার তাড়া নেই বলে আপনাকে খবর দিতে বারণ করেছিলাম।
বাঃ! আমার তো বোধহয় সময় হয়ে এল, তাই না?
কীসের সময়?
শুনেছি খুনিরা ধরা পড়েছে এবং তদন্তও শেষের মুখে। আমার স্ত্রীও নিশ্চয়ই তাঁর ভার্সান পুলিশকে বলেছেন!! আমি তো এখন দিন গুনছি।
কেন? খুনটা কি আপনি করিয়েছেন?
না। কিন্তু সে-কথা কে বিশ্বাস করবে বলুন?
পুলিশ যে আপনাকেই সাসপেক্ট ভাবছে তা কী করে বুঝলেন?
গাট ফিলিং।
আপনার ফিলিং নির্ভুল নয়।
আপনি কি কিছু বলতে এসেছেন শবরবাবু? সিরিয়াস কিছু? আপনাকে খুব গভীর দেখাচ্ছে!
আমি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। বিরক্ত হবেন না তো!
আরে না। আমার লুকোনোর কিছু নেই। আমি চাই তদন্তটা তাড়াতাড়ি শেষ হোক।
আপনি কি কখনওই টের পাননি যে, নন্দিনী আপনার প্রতি আসক্ত?
এ প্রশ্নের জবাব তো দিয়েছি।
না দেননি। আপনি এড়িয়ে গেছেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তিত মুখে রইল বিষাণ। তারপর বলল, আমার তেমন সূক্ষ্ম অনুভূতি নেই।
তার মানে কী? একটু এক্সপ্যান্ড করবেন?
শুনলে আমার ওপর আপনার হয়তো ঘেন্না হবে।
আমি ক্রিমিনাল ঘেঁটে বুড়ো হলাম, আমার রি-অ্যাকশন অত সহজে হয় না।
এটাও হয়তো ক্রাইম। পনেরো-ষোলো বছর বয়সেই আই ওয়াজ সিডিউসড বাই এ উওম্যান। আমার দূরসম্পর্কের এক বউদি, বয়সে সাত-আট বছরের বড়। সিডাকশনটা চার-পাঁচ বছর ধরে চলেছিল। প্রেম নয়, জাস্ট সেক্স। সেক্স অ্যান্ড সেক্স। কোনও অদ্ভুত কারণে আমি মেয়েদের ইজি টার্গেট। ওই শুরু। তারপর আরও ঘটনা। কী বলব, আই ওয়াজ অলমোস্ট ড্রেইন্ড আউট বাই উইমেন ইন দ্যাট আর্লি এজ। কাউকেই রিফিউজ করতাম না, একটা অ্যাডভেঞ্চারের আনন্দও তো ছিল।
তারপর? গো অ্যাহেড।
এর ফলে আমার রোমান্টিক সেন্সটাই ভোঁতা হয়ে গেল। আপনাকে তো বলেইছি আমরা বন্ধুরা অনেক সময়েই পয়সা দিয়ে মহিলা জুটিয়ে নিতাম। এখন বোধহয় আমার তেত্রিশ বছর বয়স। এখন টের পাই মহিলাদের প্রতি আমার কোনও লাগামছাড়া আকর্ষণ নেই। বড্ড বেশি ব্যবহৃত হলে বোধহয় এরকমই হয়। আপনার নিশ্চয়ই আমাকে লম্পট
বলে মনে হচ্ছো!
লম্পট নন, তা বলছি না। তবে লাম্পট্য থাকলেও আপনি বোধহয় কোনও মহিলাকে কখনও সিডিউস করেননি!
না। তার দরকার হয়নি। বরাবর আমিই সিডিউসড হয়েছি।
তার কারণ আপনার ভাল চেহারা এবং সুইট পারসোন্যালিটি।
কে জানে কী! তবে মেয়েদের কাছে অ্যাট্রাকটিভ হওয়ার জন্য আমি কোনওদিনই কোনও চেষ্টা করিনি। যা হয়েছে এমনিতেই হয়েছে। তবে ইদানীং আমি মাঝে মাঝে রিমোর্সও ফিল করি। আমার ভীষণ প্রিয় এক বন্ধু আছে, ইন্দ্ৰনীল। সে সন্তুর বাজায় এবং নানা জায়গায় প্রোগ্রাম করে। সে বিয়ে করার পর তার নতুন বিউটি যখন আমাকে ইশারা-ইঙ্গিত করতে শুরু করল এবং টেলিফোনে নানা সাংকেতিক কথা বলতে এবং মেসেজ পাঠাতে শুরু করল, তখন হঠাৎ খুব আত্মগ্লানি হল আমার। মনে হল ইন্দ্ৰনীলের স্ত্রীকে ভোগ করলে আমি আর আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারব না। জোর করে সব কমিউনিকেশন বন্ধ করে দিলাম। মেয়েটা মরিয়া হয়ে অনেক পাগলামি করেছিল। ফলে শিবাঙ্গীর সঙ্গেও আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়।
তার মানে, আপনি কখনও তেমন করে কারও প্ৰেমে পড়ার সময় পাননি।
প্রবলেমটা অ্যাটিচুডের। সময়ের নয়। কিন্তু আপনি আমাকে বোধহয় নন্দিনীর বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন।
যদি আপত্তি না থাকে তা হলে বলুন।
প্রথমেই ক্ষমা চাইছি যে, আমি আপনাকে একটু মিথ্যে কথা বলেছিলাম। আসলে মেয়েটি মারা গেছে, তার সম্পর্কে তাই কথাটা বলতে ইচ্ছে করেনি। আমার। এখন ভাবছি সত্য গোপন করলে হয়তো পুলিশের কাজের অসুবিধে হবে। তাই বলছি যে, হ্যাঁ, নন্দিনীও আমাকে সিডিউস করেছে। কয়েকবার।
শিবাঙ্গী পাশের ঘরেই আছে, জেনেও?
হ্যাঁ। বোধহয় মেয়েদের এসব ব্যাপারে সাহস একটু বেশিই। আর নন্দিনী বোধহয় চাইত ধরা পড়তেই। তাতে শিবাঙ্গীর সঙ্গে আমার দূরত্ব আরও বাড়বে।
শিবাঙ্গী কি টের পেয়েছিলেন?
না। ও ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোয়।
আপনার ধারণাটা বোধহয় ভুল।
কেন ও কথা বলছেন?
সেটা পরে বলছি। এবার আরও একটা সেনসিটিভ প্রশ্ন।
বলুন।
নন্দিনী ছাড়া আর কেউ কি আপনার সঙ্গে উপগত হতে চেয়েছে। এ বাড়িতে?
না না! আর কে?
একটু ভেবে বলুন।
এসব কি আর ভেবে বলতে হয়?
আপনি বলতে চাইছেন না, কিন্তু আমি যে জানি।
হঠাৎ বিষাণের মুখটা লাল হয়ে উঠল। টেবিলের ওপর রাখা একটা জলের বোতল থেকে খানিকটা জল খেল। তারপর কেমন যেন কুঁকড়ে গিয়ে দুহাতে মুখটা ঢেকে চাপা গলায় বলল, প্লিজ, প্লিজ মিস্টার দাশগুপ্ত, লিভ হার অ্যালেন। শিইজ এ কিড ওনলি। এ মাইনর।
শুনুন বিষাণবাবু, ভারতের সংবিধান মতে একটি মেয়ে আঠারো বছরের আগে অ্যাডাল্ট বলে গণ্য হয় না। কিন্তু মানুষের যৌবন তো সংবিধান মেনে আসে না! তেরো-চোদ্দো বছর। বয়সে একটা মেয়ের ঋতুচক্র শুরু হয়, দেহবোধ আসে। সংবিধানের নিয়মে আঠেরো বছর। বয়সের আগে মেয়েদের বিয়ে করা নিষিদ্ধ। কিন্তু সংবিধান তো বলেনি। আঠারোর আগে প্রেমে পড়া চলবে না।
কিছুক্ষণ ঝুম হয়ে চোখ বুজে বসে রইল বিষাণ। তারপর বলল, আপনি জানেন না, আমার মেয়ের বয়সও এখন সতেরো।
আপনার মেয়ে?
হ্যাঁ। আমার যে বউদির কথা আপনাকে বলেছিলাম, মাই ফাস্ট অ্যাডভেঞ্চার, তার ফলেই মেয়ের জন্ম। যদিও অবৈধ।
কী করে শিয়োর হলেন যে, আপনারই মেয়ে। ডিএনএ টেস্ট করিয়েছেন?
তার দরকার হয়নি। সেই মেয়েকে দেখলেই আপনিও বুঝতে পারবেন। তার মুখে হুবহু আমার মুখের ছাপ। পাছে কেউ মিলটা ধরে ফেলে সেই ভয়ে আমি ওদের বাড়ির ত্ৰিসীমানাতেও যাই না। আরও একটা ভয়। মেয়ে তো জানে না যে, আমি ওর বাবা। তাই যদি বাবা হিসেবে না দেখে পুরুষ হিসেবে দেখতে শুরু করে তা হলেই সর্বনাশ!
শবর একটু হাসল, আপনার ট্রাজেডিটা আমি বুঝতে পারছি।
লম্পট হলেও বর্বর তো নই। তাই এই মেয়েটা যেদিন আমার বিছানায় ঢুকেছিল সেদিন আমার নিজের ওপরেই খুব ঘেন্না হল। ওকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। খুব রাগারাগিও করেছিলাম, মনে আছে। পরদিন এসে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইল। বলল, আর ওরকম করব। না। আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না। আমি শুধু আপনার দেখাশোনা করব। মিস্টার দাশগুপ্ত, আপনি কি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন?
পারছি। কিন্তু একটা মুশকিল কী জানেন?
কী?
এই পুরো ক্রাইমটার পিছনেই আপনি রয়েছেন। অথচ আপনি কিছুই করেননি। কিন্তু রয়েছেন অনুঘটকের মতো। গোটা ব্যাপারটাই ঘটেছে আপনাকে কেন্দ্র করে এবং আপনার জন্যই। কিন্তু আপনি ক্যাটালিস্ট মাত্র।
আমি বুঝতে পারছি না।
ব্যাপারটা একটু জটিল। তবে একটু কনসেনট্রেট করলে বুঝতে পারবেন। আপনি যে চেহারা এবং স্বভাব নিয়ে জন্মেছেন তাতেই আপনার চারদিকে কিছু সমস্যা তৈরি হয়ে গেছে। তাতে আপনার কিছু করারও নেই। শক্ত মানুষ হলে আত্মরক্ষার কিছু পন্থা অবলম্বন করতে পারতেন। কিন্তু আপনি তেমন শক্ত মানুষ নন, তাই ভেসে গেছেন। এই বাড়িতেই দুখ-দুটি অসমবয়সি মহিলা আপনার প্রতি আসক্ত হয়েছে। একজন নন্দিনী। নন্দিনীর সঙ্গে আপনার গোপন অভিসার প্রথম টের পায় জাহ্নবী। কারণ জাহ্নবীও আপনার অনুরাগিনী। তার বয়স অল্প, তাই হিংসের জ্বালাপোড়াও বেশি। সে ব্যাপারটা শিবাঙ্গীকে বলে দেয়। লক্ষ করলে দেখতে পেতেন, আপনার আর শিবাঙ্গীর ঘরের বন্ধ দরজায় খুব সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক আই বসানোর জন্য একটা ছ্যাদা করা আছে। চালাকি করে সেটা মোম দিয়ে আটকানো। দরকার মতো যন্ত্রটা বসিয়ে নিয়ে আপনার ঘরের সব দৃশ্যই দেখা সম্ভব। পুলিশ যন্ত্রটা শিবাঙ্গীর ক্যাবিনেটে খুঁজেও পেয়েছে।
মাই গড!
সুতরাং আপনার আর নন্দিনীর ব্যাপারটা শিবাঙ্গীর কাছে গোপন ছিল না। নন্দিনী শিবাঙ্গীর বন্ধু হয়েও ওকে অ্যাসেসমেন্ট করতে ভুল করেছিল। ভেবেছিল, ধরা পড়লেও শিবাঙ্গী বড়জোর রাগারগি করবে, তাড়াতাড়ি ডিভোর্সের মামলা করবে। আর বড়জোর নন্দিনীকে তাড়িয়ে দেবে। শিবাঙ্গী তা করেনি। নন্দিনী যে তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিল না। এটাতেই শিবাজী বোধহয় ফিউরিয়াস হয়ে ওঠে। আমি শুনেছি শিবাঙ্গী খুবই রাগী।
ঠিকই শুনেছেন। রাগলে ওর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না।
শিবাঙ্গী আর জাহ্নবী মিলে ঠিক করে নন্দিনীকে সবক শেখাতে হবে। জাহ্নবী ভিক্টরকে ঠিক করে দেয়। ভিক্টর ছোটখাটো উঠতি মস্তান। বোধহয় দু’লাখ টাকার কন্ট্রাষ্ট্রে রাজি হয়ে যায়। পুলিশ শিবাঙ্গীর ব্যাঙ্কে ক্যাশ উইথড্রয়াল চেক করে দেখেছে, জুন মাসের এক তারিখে এক লাখ টাকা ক্যাশ তোলা হয়।
তারপর?
কাহিনিটা একটু জটিল। কথা ছিল খুনটা করবে একা ভিক্টর। সিকিউরিটিকে এড়িয়ে বাড়ি ঢোকার পথ সম্ভবত ছক করে দিয়েছিল জাহ্নবী। ভিক্টর পেছনের দেওয়াল টপকে ঢোকে, গ্যারেজের গাড়ির আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ওপরে ওঠে। ওর ফ্ল্যাটে ঢোকার ব্যবস্থা শিরাঙ্গাই করে দেয়। কিন্তু একটা মস্ত গণ্ডগোল হয়েছিল।
কীসের গণ্ডগোল?
শিবাজী শত্রুর শেষ রাখতে চায়নি। ভিক্টরকে বলা ছিল সে একা আসবে, নন্দিনীকে খুন করবে, তারপর শিবাঙ্গীর কাছ থেকে বাকি এক লাখ টাকা নিয়ে সরে পড়বে। শিবাঙ্গীর প্ল্যান ছিল, ভিক্টর টাকা নিতে ঢুকলেই আগে থেকে প্ৰস্তুত শিবাঙ্গী তাকে গুলি করে মেরে দেবে।
সর্বনাশ! শিবাঙ্গী কি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?
পারে। এবং তার পিছনে আপনি এবং শিবাঙ্গীর ইগো। তার প্ল্যান মতো ঘটনাটা ঘটলে শিবাঙ্গী হয়তো উতরেও যেত। কিন্তু গণ্ডগোল হল ভিক্টর একা খুন করতে আসেনি। সঙ্গে বাদুকেও এনেছিল। হয়তো একা আসতে সাহস পায়নি। আর ওই জন্যই প্ল্যানটা ভেস্তে গিয়েছিল। নন্দিনী অনেক রাত অবধি জেগে তার ঘরে কাজ করে। সম্ভবত বাইরের দরজা খুলে কেউ ঢুকেছে টের পেয়ে সে ব্যাপারটা দেখতে আসে এবং খুন হয়ে যায়। তারপর বাকি টাকা নিতে ভিক্টর শিবাঙ্গীর ঘরে যায়। শিবাঙ্গী তৈরি হয়েই ছিল। ভিক্টর কাছাকাছি হতেই সে গুলি চালায়। কিন্তু প্রবলেম হল, ম্যাডামের শুটিং প্র্যাকটিস ছিল না। আর হ্যান্ডগানগুলোর ব্যারেল ছোট বলে বেশিরভাগ সময়েই তা হয়ে যায়। এরাটিক। গুলি লাগে। ভিক্টরের বা কঁধে। সে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যায়। ম্যাডাম হয়তো তাকে ফিনিশ করতে পারত, কিন্তু বাদ সাধল বাদু। সে গুলির আওয়াজ পেয়েই ছুটে এসে ম্যাডামের হাতে পিস্তল। দেখেই ফায়ার করে।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কি একটু জল খেতে পারি?
অবশ্যই।
এবার জল খেতে গিয়ে কাঁপা হাতে জল চলকে পড়ল বিষাণের বুকে। জল খেয়ে দম ধরে বসে রইল একটু। তারপর ধরা গলায় বলল, এবার বাকিটা বলুন মিস্টার দাশগুপ্ত।
ম্যাডাম আগুন নিয়ে খেলছিলেন, বুঝতে পারেননি। বাদুর গুলিতে ওঁর মারা যাওয়ার কথা। কপালজোরে বেঁচে গেছেন।
হ্যাঁ, ডাক্তাররাও বলছিলেন, উনি খুব অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। স্কালে ঢুকলেও গুলি ভাইটিাল জায়গাগুলোকে টাচ করেনি।
জ্ঞান ফেরার পর শিবাঙ্গীর নতুন প্রবলেম দেখা দিয়েছে উনি জানেন না, নন্দিনী সত্যিই মারা গিয়েছে কিনা বা খুনিরা ধরা পড়েছে কিনা। ওঁর কাছে খবরের কাগজ, মোবাইল বা টিভি নেই। ডাক্তাররা সবাইকে বলে দিয়েছে ওঁকে কোনও খবর দেওয়া চলবে না। আমাকে উনি বারবার নন্দিনীর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।
আমাকেও করেছে। জাহ্নবীকেও।
তবে মনে হয় তিন-চারদিন আগে উনি সত্যটা জানতে পেরেছেন যে, নন্দিনী মারা গেছে। এবং খুনিরা ধরা পড়েছে।
কী করে বোঝা গেল?
উনি এখন ড্যামেজ কন্ট্রোল করার জন্য প্ৰাণপণ চেষ্টা করছেন।
কীভাবে?
তিনদিন আগে উনি জাহ্নবীকে দিয়ে ওঁর অ্যাকাউন্ট থেকে এক লাখ টাকা ক্যাশ তুলে ভিক্টরের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আর ভিক্টরের পক্ষে ব্ৰজবাসী দত্তকে দাড় করিয়েছেন। ব্ৰজবাসী একজন ধুরন্ধর ক্রিমিনাল ল-ইয়ার। উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। যাতে ভিক্টর কিছু কবুল না করে। আমার কাছে ও যা বলেছে তার রেকর্ড নেই। সুতরাং আদালতে ও বয়ান পালটাবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিষাণ বলল, অ্যাডভোকেট ব্ৰজবাসী দত্তকে কন্ট্যাক্ট করার জন্য শিবাঙ্গই আমাকে বলেছিল। ওঁকে আমিই কন্ট্যাক্ট করি। আমি কি কোনও অন্যায় করেছি মিস্টার দাশগুপ্ত?
না। উনি এখনও আপনার স্ত্রী। আর স্ত্রী অন্যায় করে থাকলেও আপনার কাজ হল যতদূর সম্ভব তাকে প্রোটেকশন দেওয়া।
শিবাঙ্গী সম্পর্কে যা বললেন তাতে মনে হয় ওর বিরুদ্ধে কেন্সটা খুবই স্ট্রং। ওকে যদি অ্যারেস্ট করা হয় তবে আমাদের ফেস লস হবে। দুটো পরিবারই মর্যাদা হারাবে।
দেখুন, আপনাকে একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত করতে চাই। এই কেন্সটা অফিসিয়ালি সিআইডি-কে দেওয়া হয়নি। আপনাদের থানার ওসি দিবাকর গুপ্ত আমার দাদার মতো। উনি কেন্সটায় একটু অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছিলেন। ডাকাতি এবং ডাকাতি করতে গিয়ে খুন বলে ওঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না। আপনার ওপর ওঁর সবচেয়ে বেশি সন্দেহ ছিল, অথচ আপনার সঙ্গে কথা বলে ওঁর দ্বিধাও হছিল। ফলে উনি আমাকে বলেন সাহায্য করতে। আমি আমার হানচ। এবং ইনফর্মেশন ওঁকে জানিয়ে দিয়েছি। এখন উনি কী অ্যাকশন নেবেন তা আমি জানি না। তবে সম্ভবত শিবাঙ্গী আর জাহ্নবীর গ্রেফতার এড়ানো যাবে না।
হতাশা মাখা মুখে করুণ গলায় বিষাণ বলল, এর চেয়ে খুনের দায়টা আমার ঘাড়ে চাপলেই বোধহয় ভাল ছিল। আমি তো একজন রুইনড ম্যান, বাজে লোক, মাতাল, লম্পট! প্ৰতি মুহুর্তেই তো পুলিশের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
শবর হেসে বলল, এ যাত্রায় সেটা বোধহয় হচ্ছে না। তবে আপনি যতই দাড়ি-গোঁফ রেখে বিষগ্ন মুখে থাকুন না কেন আমার মনে হচ্ছে আপনার চেহারা একটু বেটার হয়েছে। মদটা আর খাবেন না।
খাচ্ছি না। কিন্তু বড্ড একা হয়ে গেলাম মিস্টার দাশগুপ্ত। একাই তো ছিলেন। কিন্তু আপনি তো নাকি মায়ের আদুরে ছেলে। কয়েকদিন মায়ের কাছ থেকে গিয়ে ঘুরে আসুন।
কোন মুখে যাব? একমাত্র মায়ের কাছেই সব মুখ নিয়ে যাওয়া যায়।