কেন করব না?
তুমি বুদ্ধিমান বলে। আমাকে মারা যায়, কিন্তু সিস্টেমকে কি মারতে পারবে? অতীতকে মারতে পারবে? যা ঘটে গেছে তাকে মারতে পারবে?
না।
তাই চাইনি। আমি হিরো নই, লজিক্যাল।
আপনিও বেশ কথা বলেন!
শবর একটু হাসল। মৃদু স্বরে বলল, মেয়েটাকে মারলে কেন?
মেয়েটার মরাটা দেখলেন, আমার মরাটা লক্ষ করলেন না?
শবর ম্লান একটু হাসল, তাও দেখছি।
আমি কবে মরে গেছি জানেন? আরও দশ বছর আগে।
শবর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আপনি কি বিশ্বাস করেন স্যার,আমি পালাচ্ছিলাম?
না। পালাতে চাইলে তুমি এই কানাগলিতে ঢুকতে না। কিন্তু তুমি পালালে আমি খুশি হতাম।
সে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে শবরের দিকে চেয়ে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। কিছুক্ষণ সময় লাগল সামাল দিতে। তারপর মুখের ঢাকা খুলে তার তীব্র চোখদুখানা শবরের চোখে স্থাপন করে বলল, লোকে জানে, আমি মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়েছিলাম, লোকে জানে আমি ওকে নষ্ট করেছি। পুলিশ আমাকে এমন মারল, যে, একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গেল। অপটিক নার্ভ জখম হয়ে আমার বাঁ চোখ হয়ে গেল কমজোরি, ভবিষ্যতে অন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ও থেকে গেল। আমার সেক্সয়াল আর্জ চলে গেল। তার চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতি হল, আমার পড়াশুনার। আমার ক্যারিয়ারের। মায়ের কাছে আমার মার্কশিট আছে স্যার। দেখে নেবেন।
দেখতে হবে না। বোর্ডে গিয়ে তোমার মার্কশিটের রেকর্ড আমি চেক করেছি।
স্তিমিত চোখে চেয়ে বলল, কী হল স্যার? বস্তিতে থাকি, গরিবের ছেলে, ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছিলাম, আমার সামনে ব্রাইট ফিউচার খুলে গিয়েছিল। কিন্তু কী হল স্যার? কী হল বলুন। এই মার্কশিট ধুয়ে কি জল খাব?
তুমি তখন মস্তানি করতে?
মস্তানি কি খারাপ স্যার, যদি তার পিছনে মর্যালিটি থাকে? ব্যায়াম করতাম, খেলাধুলোয় ভাল ছিলাম, গায়ে জোর ছিল, বুকে সাহস ছিল, তাই পাড়া শাসন করে বেড়াতাম। লোকাল থানায় খোঁজ নেবেন স্যার, আমার তখনকার লাইফে কোনও খারাপ রেকর্ড নেই। কোনও চুরি, ছিনতাই, দু’নম্বরি করিনি। কিন্তু বস্তির ছেলে তো, বুক ফুলিয়ে বেড়াতাম বলে ভদ্রলোকরা ভয় পেত। বলত, মস্তান।
মেয়েটার কথা বলো।
মিতালির কথা তো আপনিও জানেন স্যার। বড়লোকের মেয়ে, মাথাটা খাওয়াই ছিল। আমাকে লাইন দেওয়া শুরু করেছিল কবে থেকে, তখন ফ্রক পরত। চিঠি চালাচালি করত, ইশারা ইঙ্গিত করত। তারপর সিনেমায়টিনেমায় নিয়ে গেছি। গরম মেয়ে স্যার। বলতে লাগল, আমাকে নিয়ে পালাও। তখন আমি সায়েন্স নিয়ে কলেজে পড়ছি। ভাল রেজাল্ট করতে হবে বলে খাটছি, অন্যদিকে আমার মাথা খাচ্ছে মিতালি। ওই বয়স তখন আমার, ফাস্ট লাভ। সুন্দরী মেয়ে। বাপ বড়লোক। সব জেনেবুঝেও বয়সের দোষে ঝুলে পড়লাম। পড়া গেল, ক্যারিয়ার গেল। লোকে বলে, আমি ওকে নষ্ট করেছি। লোকে দেখল না, ও আমাকে কতটা নষ্ট করেছিল। বড়লোকের তো দোষ হয় না। মিতালি ফিরে গেল, বাপের কাছে, ক্ষমা হয়ে গেল, পড়াশুনো করতে লাগল, বিয়ে হল, আমেরিকা গেল। এমনকী অত ভাল পাত্র মিঠু মিত্তিরকে ডিভোর্স করার মতো আস্পর্ধাও দেখাল। মিতালির কি কিছু লস হল স্যার? কিছু না। জীবনটা টালও খেল না, ক্যারিয়ার বিল্ড আপটা দেখুন স্যার। আর অন্য দিকে আমাকেও দেখুন। জীবনটা শুরু করেছিলাম কী দুর্দান্ত। গরিব ঘরের ছেলে, প্রাইভেট মাস্টার দূরের কথা বইপত্তরই জোগাড় হয় না। পুষ্টিকর খাবার নেই। পড়াশুনোর জায়গা জুটত না। তবু ওরকম রেজাল্ট। কত কী করতে পারতাম স্যার। বাপ-মা কত স্বপ্ন দেখত আমাকে নিয়ে। পুরো ধস নেমে গেল। মিতালির দোষ কেউ দেখল না, দেখলেও চোখ ফিরিয়ে নিল। আর আমাকে? প্রথম অপমান আর তাচ্ছিল্য করে গেল মিতালি। তারপর পুলিশ তুলে নিল। তারপর আপনি সব জানেন…
জানি।
আজ আমি পালাব কেন স্যার? পালিয়ে কোথায় যাব? আমার হারানোর কিছু নেই। জিজ্ঞেস করছিলেন মেয়েটাকে মারলাম কেন? আপনি বুদ্ধিমান, কেন মারলাম তা কি বোঝেননি? হাসপাতালে পুরো দু’মাস থাকতে হয়েছিল। হাজতে চার মাস। পুলিশ কেস দিলে আরও কতদিন মেয়াদ হত কে জানে। বরুণ ঘোষ বেশি চাপাচাপি করেনি পাবলিসিটির ভয়ে। তাই ছেড়ে দিয়েছিল। ছাড়া পেয়ে কী হল স্যার? পাড়ায় সবাই দুয়ো দিত। পড়াশুনোর আর্জ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল আগেই। তার ওপর শরীর। বাইরে থেকে ভিতরের ভাঙচুর দেখতে পাবেন না স্যার। বলছিলাম না, মিতালি মরল সেদিন, আমি মারা গেছি অনেক আগে। কিন্তু একটা হিসেব তো মেটাতে হবে। ডিভভার্সের পর একদিন মিঠু মিত্তির আমাকে পিটিয়েছিল, আগেই বলেছি স্যার। বলিনি?
বলেছ। কিন্তু মিঠু মিত্তির টের পেয়েছিল সে একটা মরা মানুষকে পেটাচ্ছে। তাই মিঠু মিত্তির আমার সঙ্গে ভাব করে নেয়। শুধু তাই নয়, আমার সব কথা শুনে দয়া করে নিজের রিস্কে ট্যাক্সির লোন বের করে দেয়। নিজের পকেট থেকে টাকাও দিত সময়ে সময়ে। আমরা দোস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মিঠু মিত্তিরকে কী করেছিল স্যার আপনাদের সুন্দরী বড়লোক মিলি? মিঠু মিত্তিরের দোষটা কী ছিল বলবেন? তার জীবনটাও বরবাদ করে যায়নি কি ওই…যাক স্যার, আজ খারাপ কথা বলব না।
স্থির, অপলক, করুণ দু’খানা চোখে চেয়ে রইল শবর। কিছু বলল না।