প্রথম দু’-চারটে দিন শোকের ভাবটা কাটিয়ে ওঠার পরই তাদের দুই বোনের মধ্যে কথার ফোয়ারা খুলে গেল। দিনের বেলায় জয়িতার কলেজ, মিতালিরও উকিল অ্যাটর্নির কাছে বা ব্যাঙ্কে যাওয়া। গল্প হত রাতে। দোতলায় শোওয়ার ঘরে মস্ত খাটে পাশাপাশি শুয়ে।
শ্রাদ্ধ বা নিয়মভঙ্গ কোনও অনুষ্ঠানেই মিঠু আসেনি। কিন্তু এক সন্ধেবেলা সাদার্ন ক্লাব থেকে বেরিয়ে মাঠের ওপর খানিকটা একসঙ্গে হেঁটেছিল দু’জন। মিঠু একটু চিন্তিত। বলল, জয়িতা, মিতালি আমাকে কিছু বলতে চায়।
কী?
তা জানি না। কিন্তু তোমাকে একটা অনুরোধ করব।
বলুন না।
তুমি আমাদের কথা, তোমার আমার কথা মিতালিকে জানিয়ে দিয়ো।
কেন? আমার যে ভীষণ লজ্জা করবে।
তোমার লজ্জা নিয়েই তো হয়েছে আমার বিপদ।
মিতালিদির সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে?
হ্যাঁ, মিতালি আমার ব্রাঞ্চে গিয়েছিল।
ও মা!
শি ইজ এ বিট অফ রিপেন্টেন্ট।
জয়িতার বুক অজানা ভয়ে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। সে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল, তা হলে কী হবে?
মিঠু একটু হাসল, কী হবে তুমি জানো না?
বলুন না!
মিতালি অনেক দূরে সরে গেছে জয়িতা।
জয়িতার বুকে সে যে কাঁপুনি উঠল সে বোঝাতে পারবে না। মিতালি মস্ত পার্টির আয়োজন করল। ককটেল ডিনার। জয়িতার ইচ্ছে ছিল পার্টির পর মিতালিকে ফঁক বুঝে বলবে কথাটা। কিন্তু কী হল, আগের রাতে যখন দু’বোনে কথা হচ্ছিল তখন মিতালি বলল, তুই কি প্রেমে পড়েছিস?
জয়িতা অবাক হয়ে বলল, কেন বলো তো!
তোর মুখচোখ বলছে, তোর গলার স্বর বলছে, তোর আনমনা ভাব বলছে, তুই প্রেমে পড়েছিস।
জয়িতা দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলেছিল।
লজ্জার কী আছে? বল না।
জানি না।
তার মানে সত্যিই প্রেমে পড়েছিস। কে রে?
জয়িতা একটা বুদ্ধির কাজ করল। বলল, আজ নয় মিতালিদি। কাল বলব।
কেন? কাল কেন?
জয়িতা বলেনি। সেই রাতটা সে ভাল করে ঘুমোতেও পারেনি।
পরদিন সকাল থেকেই ঘরদোর সাজানো, পরিষ্কার করা এসব নিয়ে ব্যস্ত রইল তারা। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে যখন দু’জনে মুখোমুখি তখন মিতালি জিজ্ঞেস করল, কাল বলিসনি। আজ বলবি?
বলব। খেয়ে নাও। তারপর বলব।
খেতে খেতেই মিতালি বলল, ছেলেটা ভাল?
জানি না।
ভাল করে বলছিস না কেন?
বলব মিতালিদি? বললে তুমি রাগ করবে না?
রাগ করব? তুই কাউকে ভালবাসলে আমার রাগ করার কী?
খাওয়া তখন শেষের মুখে। জয়িতা শুধু মিঠুর আদেশ পালন করার জন্যই তার সব লজ্জা সংকোচ আর ভয় মুঠোয় ধরে রেখেই বলল, মিঠুদা।
কে বললি? বলে অবাক হয়ে চেয়ে রইল মিতালি।
জয়িতা মাথা নিচু করে টেবিল ছেড়ে পালিয়ে গেল।
সে কী বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সেটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল তার। মিতালি বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ বসে রইল খাওয়ার টেবিলে। তারপর একতলার লিভিং রুমের সোফায় অনেকক্ষণ পড়ে ছিল চুপচাপ। তারপর ডেকোরেটরের লোকেরা এল ডাইনিং হলে টেবিল চেয়ার সাজাতে। এল ক্যাটারার। তাকে উঠতে হল। আড়াল থেকেই তাকে লক্ষ করছিল জয়িতা। সামনে যায়নি।
মিঠু এল বিকেলের দিকে। হঠাৎ।
দৃশ্যটা এ জীবনে কখনও ভুলতে পারবে না জয়িতা। দোতলায় সাজছিল মিতালি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে মিঠুর দিকে চেয়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ একটা অস্ফুট চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠুর বুকে। ভগ্নস্তূপের মতো। শুধু বলছিল প্রবল কান্না
ভেদ করে বলছিল, বিশ্বাস করি না–বিশ্বাস করি না
মিঠু পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। জয়িতা চলে গেল পিছনের বাগানে। এ দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব।
তাকে গিয়ে পিছনের বাগানে ধরল মিতালিই। চোখের জল মুছে ফেলেছে, মুখে একটা হাসি ফুটিয়েছে অনেক কষ্টে। তাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বলল, বেশ করেছিস। বেশ করেছিস। আমি খুশি হয়েছি। বিশ্বাস কর।
জয়িতা বিশ্বাস করেনি। তবু বলেছিল, আমি তো জানতাম না মিতালিদি—
মিতালি একটু চুপ করে থাকার পর বলল, এ কি জানার মতো কথা? কিছু নয় রে। আমি তো একটা পাগল, কত ভুল করেছি জীবনে। সব ঠিক হয়ে যাবে।
মুখে বলল, কিন্তু কিছুই ঠিক ছিল না সেদিন মিতালির। জন্মে মদ ছোঁয়নি। সেদিন জলের মতো খেল। কত কী উলটোপালটা বলতে লাগল লোকজনকে। কেঁদে ফেলল, হাসতে লাগল। কিছু ঠিক ছিল না।
পার্টি শেষ হওয়ার একটু বাদেই চলে এসেছিল জয়িতা। বুক ভার, মনে ভয়, অনিশ্চয়তা, এই অদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে কীভাবে মুক্তি ঘটবে।
০৫. মিতালিদেবীর খুনের কেসে
জয়িতাদেবী, মিতালিদেবীর খুনের কেসে আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে।
কিন্তু পুলিশকে আমি তো যা বলার বলেছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। সেটা আমি জানি। কিন্তু তদন্ত যত এগোয় ততই নতুন নতুন তথ্য বেরোতে থাকে, নতুন নতুন সত্য উদঘাটিত হতে থাকে–একটু শক্ত বাংলা বলে ফেললাম, মাফ করবেন–আর যত এসব হতে থাকে ততই মামলার প্যাটার্নটা পালটে যেতে থাকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবার নতুন করে জেরা করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না।
বলুন।
মিঠু মিত্র নামে কাউকে কি আপনি চেনেন?
চিনব না কেন? উনি আমার জামাইবাবু।
বাঃ, বেশ বেশ। কতদিন চেনেন?
মিতালিদির বিয়ের সময় থেকে।
চমৎকার। আপনি নিজেই বলেছেন যে, উনি আপনার জামাইবাবু। তার মানে কি যে, উনি এখনও আপনার জামাইবাবু এবং আপনি ওঁর শালি?
তার মানে?
মানে বিয়ের ইমিডিয়েট পরেই যে ওঁদের ডিভোর্স হয়ে যায় এটা কি আপনার জানা নেই?